রবিবার, ৮ আগস্ট, ২০২১ ০০:০০ টা

চোখ ভেসে যায়

আনোয়ারা সৈয়দ হক

চোখ ভেসে যায়

আমাদের চোখ ভেসে যায়, অশ্রু এসে আমাদের দুচোখ প্লাবিত করে দেয়, যখন বঙ্গমাতার কথা ভাবী। এই মহীয়সী নারীর অবদানের কথা লিখতে গেলে লেখা আর শেষ হবে না। যে স্বাধীন বাংলাদেশে আমরা আজ বসবাস করি, যে স্বাধীন বাংলাদেশ তলাহীন ঝুড়ি থেকে মাথা উঁচিয়ে বিশ্বের দরবারে আজ সম্মানের সঙ্গে আসন পেতেছে, সেই বাংলাদেশের জন্মই হতো না যদি বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা রেণু সাহস এবং বুদ্ধিমত্তা নিয়ে বঙ্গবন্ধুর পাশে এসে না দাঁড়াতেন।

রাজনীতির ইতিহাস ঘাঁটলে কত ইতিহাস যে জানা যায়! কিন্তু সেসব শুধুই বীর রাজনীতিবিদের ইতিহাস। সেখানে তাঁদের পেছনে নারীর অবদান এবং তাঁদের অশ্রুজলের কথা লেখা থাকে না। বঙ্গমাতা রেণুও আজ তাঁদের মধ্যেই হারিয়ে যেতেন যদি না নারীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল মহামহিম বঙ্গবন্ধু অনুগ্রহ করে ফজিলাতুন নেছার কথা লিখে না যেতেন তাঁর স্বহস্তে লিখিত আত্মজীবনীগুলোর ভিতরে।

তারপরও কথা থাকে। পৃথিবীর বহু প্রতিভাসম্পন্ন রাজনীতিবিদ, যাদের সংবাদ আমরা জানি না, শুধু পরিবারের কারণে তাঁরা রাজনীতি থেকে এককালে সরে গেছেন। কেউ কেউ জেলখানায় থেকে পরিবারে আগ্রহেই সারা জীবনের জন্য মুচলেকা লিখে জেল থেকে বেরিয়ে মহাকালের প্রবাহে মিশে গেছেন।

কারণ পরিবারের আছে এক অমোঘ আকর্ষণ, সে আকর্ষণের হাত এড়িয়ে রাজনীতির বিপৎসংকুল পথে এগিয়ে যাওয়া কোনো সহজ কাজ নয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন তো সে রকমেরই হতে পারত। হলে আশ্চর্য কিছু হতো না। তাঁর আত্মজীবনীতেই তো আছে একবার পরিবারের সঙ্গে মাত্র সাত দিন একনাগাড়ে কাটিয়ে আবার একাকী নদীপথে ঢাকায় ফেরার সময় মনে হয়েছিল, তাঁর যেন এবার নিজের পরিবারের প্রতি একটু বেশি মায়া হয়েছিল! তাহলে আরও কিছুদিন তিনি যদি পরিবারের সঙ্গে থাকতেন, যে পরিবারে রেণু ছিলেন, বাচ্চারা ছিল, ¯েœহশীল বাবা-মা ছিলেন, ছিলেন ভাইবোন, তখন সেই মায়ার বশে তিনি কি রাজনীতির অনিশ্চিত ডামাডোল থেকে বেরিয়ে আসতে পারতেন না? অবশ্যই পারতেন।

কারণ তাঁর আগে ও পরে বহু রাজনৈতিক নেতা এরকম কাজ করেছেন। পরিবারে মায়ার বন্ধন ছিন্ন করে তাঁরা বেরিয়ে আসতে পারেননি। বাবা-মায়ের সজল চোখ, স্ত্রীর কান্নারত মুখ, ছেলেমেয়েদের পিতার গলা জড়িয়ে মুখ গুঁজে বাবার বুকে পড়ে থাকা, এসব মায়ার বন্ধন ত্যাগ করে জেলখানায় ফিরে আসা কোনো স্বামী, পিতা কিংবা পুত্রের পক্ষে কি সম্ভব ছিল?

অনেক সময় সম্ভব ছিল না এবং এভাবে পৃথিবী তার বহু প্রতিভাবান ও প্রতিশ্রুতিশীল রাজনীতিবিদকে হারিয়েছে। কালের অতলে তাঁরা মিশে গেছেন।

কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের পক্ষে সেটা করা সম্ভব ছিল না।

কারণ তিনি লক্ষ্য করতেন যতবার তিনি কলকাতা বা ঢাকার দিকে রওনা হতেন, তাঁর বালিকা স্ত্রী রেণু কিছু টাকা হাতে করে গোপনে তাঁর জন্য অপেক্ষা করছেন, টাকাগুলো তাঁর হাতে তুলে দেবেন বলে। না, বিলাসিতা করার জন্য নয়, নাটক বা সিনেমা দেখার জন্য নয়, রাজনীতি করতে গেলে যে খরচ হয়, তার কিছুটা সুরাহা করার জন্য। এ টাকা রেণুর সংসার থেকে বাঁচানো টাকা নয়, এ টাকা ছিল রেণুরই নামে রেখে যাওয়া পৈতৃক সম্পত্তির উপার্জন।

শ্বশুর-শাশুড়ি বা দেবর-ননদকে সাক্ষী রেখে তাঁর দানের কথা জনসমক্ষে প্রচার করে নয়, গোপনে, সঙ্গোপনে।

আর তাঁর এই মনোভাব দেখেই বঙ্গবন্ধু বুঝে যেতেন যে তিনি যে পথে তাঁর জীবনকে চালিত করেছেন, তা যত বন্ধুর এবং সমস্যাসংকুল পথই হোক না কেন, তার জন্য রেণুর পূর্ণ সমর্থন আছে। কারণ রেণু বেশি কথা খরচ করার মানুষ ছিলেন না। অযথা বায়না ধরার মানুষও ছিলেন না। ছেলেবেলা থেকে ছিলেন চুপচাপ, শান্ত। কিন্তু যেটা তাঁর জীবনের কর্তব্য বলে মনে করতেন, সে ব্যাপারে তাঁর মনে কোনো দ্বিধা বা ভয় ছিল না।

দেশভাগের আগে থেকেই বঙ্গবন্ধু রাজনীতি করতেন। তখন ছিল মুসলিম লীগ, তিনি সোহরাওয়ার্দীর হাত ধরে মুসলিম লীগের রাজনীতি করতেন। বিভাগপূর্ব কলকাতা ছিল তাঁর কর্মক্ষেত্র। দেশ স্বাধীনের পর তিনি ঢাকায় এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হলেন। কিন্তু মুসলিম লীগের অপরাজনীতি দেখে তিনি বিদ্রোহী হয়ে উঠলেন। তখন পাকিস্তানের মুসলিম লীগ সরকার তাঁকে জেলে পাঠাল।

সেই থেকে জেলখানা হলো বঙ্গবন্ধুর ঘরবাড়ি। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে তিনি তখনকার পাকিস্তানের প্রাদেশিক রাজধানী ঢাকায় তাঁর রাজনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালনা করতে লাগলেন। মুসলিম লীগ ত্যাগ করে বয়স্ক নেতাদের সঙ্গে সহযোগিতা করে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন করলেন। যে ঢাকা ছিল বিভাগপূর্ব কালে বঙ্গবন্ধুর অচেনা ও বন্ধুহীন একটি শহর, সেই ঢাকাই হয়ে উঠল তাঁর রাজনীতির কর্মক্ষেত্র।

আর সবুজ শ্যামলিমায় ভরা শান্ত নিরূপদ্রব টুঙ্গিপাড়া গ্রামের সহজ সরল গৃহবধূ ফজিলাতুন নেছা রেণু কী করলেন? যা করলেন তা প্রায় অবিশ্বাস্য।

তিনি ততদিনে তিন ছেলেমেয়ের মা হয়েছেন, বঙ্গবন্ধুর জেলখানার সহচরী হওয়ার জন্য চলে এসেছেন ঢাকায়। তিনি জেলে থাকতে পারবেন না, জানেন, কিন্তু জেলখানার কাছে তো থাকতে পারবেন। বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সমমনা রাজবন্দীদের জন্য খাবারটা তো জেলখানায় পৌঁছে দিতে পারবেন! বঙ্গবন্ধু তো বলেছিলেন, ‘রেণু তুমি দেশে ফিরে যাও, আমি কবে জেল থেকে মুক্তি পাব, জানি না, এই অচেনা, অজানা শহরে তুমি তিন তিনটে নাবালক ছেলেমেয়ে নিয়ে কীভাবে বসবাস করবে?’

বঙ্গমাতা মন দিয়ে তাঁর কথা শুনেছিলেন, কিন্তু কোনো উত্তর দেননি। কারণ ততদিনে তিনি আর গ্রাম্য বালিকা নন, বঙ্গবন্ধুর আদর্শে উজ্জীবিত একজন রমণী। তিনি তখনই বুঝেছিলেন যে এই আদর্শকে বাস্তবে রূপ দিতে গেলে বঙ্গবন্ধুর অর্থ দরকার, নিবেদিতপ্রাণ কর্মী দরকার, সেসব কর্মীকেও দেখভাল করা দরকার, কারণ তারাও কোনো না কোনো পরিবার থেকে উঠে এসেছেন, তাঁদেরও স্ত্রী ছেলেমেয়ে আছে, বাবা-মা বোন আছে। বঙ্গবন্ধুর ডাকে তাঁরা রাজনীতি করতে নেমেছেন বলে তো পরিবারের দায়িত্ব একেবারে ভুলে যাননি। তো এসব দায়িত্ব পালন কে করবে? বঙ্গবন্ধু তো নিজের পরিবারেরই কোনো তোয়াক্কা করেন না, তো এদের কী হবে?

একবার তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে ঢাকায় এসে রেণু আর ফিরে গেলেন না। কিন্তু ঢাকা শহরে বাড়ি ভাড়া করা কি কম ঝামেলার! বাড়ি ভাড়া নিতে গেলেই বাড়িঅলার প্রশ্ন, মা, আপনার স্বামী কী করেন?

তিনি রাজনীতি করেন।

বাড়িঅলা উত্তর শুনে অবাক।

ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াবার নাম ছিল তখন রাজনীতি করার অর্থ।

তার নাম কী, মা? বাড়িঅলার জিজ্ঞাসা।

তাঁর নাম শেখ মুজিবুর রহমান।

স্বামীর নাম উচ্চারণ করতে গিয়ে কি রেণুর গলাটা কেঁপে যায়?

কিন্তু সেটা বাইরে থেকে বোঝা যায় না।

কিন্তু নাম শুনে বাড়িঅলার নিজের গলা কেঁপে যায়। তড়িঘড়ি করে বলে ওঠেন, ওরে বাবা, শেখ মুজিব? শেখ মুজিবুর রহমান! যাকে পুলিশ রাতদিন খুঁজে বেড়ায়? না, না না, এখানে বাড়ি ভাড়া হবে না, অন্য জায়গায় দেখুন। পুলিশের দৌরাত্ম্য সহ্য করতে পারব না। পাড়ায় বদনাম হয়ে যাবে।

তিনটে ছোট ছোট ছেলেমেয়ে মায়ের পিছনে দাঁড়িয়ে বাড়িঅলার কথা শোনে। কিন্তু তাঁরা এই বৈরী ব্যবহারের মানে বুঝতে পারে না। কারণ তাঁদের বাবার সঙ্গে যখন জেলখানায় মাঝে মাঝে দেখা হয়, সেই বাবা তখন এমন করে তাদের আদর করেন যে, এতদিন বাবাকে যে চোখে দেখেনি, সেই দুঃখও তারা ভুলে যায়।

ততদিনে শেখ মুজিবের আওয়ামী কর্মী বাহিনী তৈরি হয়ে গেছে। কিন্তু রেণুর কর্মকান্ড এবং মনোভাব দেখে মনে মনে বিস্মিত মুজিব এখন তাঁর বিরুদ্ধে সরকারের দায়ের করা মামলার জন্য রেণুকেই যেতে বলছেন উকিলের বাসায়, সরকারের বিরুদ্ধে মামলা পরিচালনা করার জন্য। তিনি জেলখানায় থাকলেও তাঁর মাথার ওপর কমসে কম ১৪টা মামলা ঝুলছে। সেগুলোর বিচার পাকিস্তান সরকার এমনভাবে করবে যেন শেখ মুজিব জীবনেও জেল থেকে বেরোতে না পারেন। এসব নীলনকশা শেখ মুজিবের জানা আছে।

কিন্তু তিনি এখন তাঁর দলকে নয়, দল তাঁর নির্দেশের অপেক্ষায় সর্বদাই বসে আছে। তবু তিনি গ্রামে বেড়ে ওঠা, উচ্চশিক্ষা থেকে বঞ্চিত ফজিলাতুন নেছা রেণুকেই বলছেন, উকিলের দফতরে গিয়ে মামলার তদবির করতে। তিনিই এখন শেখ মুজিবের অতিশয় বিশ্বাসী হাত নুড়কুড়। তাঁকেই মামলার কাগজপত্র গুছিয়ে উকিলের বাসায় ঢুঁ মারতে হচ্ছে। বঙ্গমাতা রেণু, যে রেণু পাখিডাকা এক অজপাড়াগাঁয়ে শ্যামল সবুজের নিবিড় ছায়ায় নিরীহ সরল মনে পৃথিবীর ঘোরপ্যাঁচ না জেনে বড় হয়ে উঠেছেন। যে অচেনা ঢাকার রাস্তাঘাট তাঁকে প্রতিনিয়তই নতুন করে জানতে হচ্ছে।

তাঁর বাহন হচ্ছে প্রতিদিন পায়ে হাঁটা, কখনো রিকশা, কখনো বা বেবিট্যাক্সি। গ্রামের বাড়িতে তাঁকে কখনো এরকম হাঁটতে হয়নি। পিতৃমাতৃহীন হলেও ছেলেবেলা থেকে বড় আদরের তিনি তাঁর শাশুড়ি মাতার কাছে বড় হয়েছেন, যেখানে বাড়িভর্তি কাজের মানুষজন। পাঁচ বছর বয়স থেকে তিনি পিতৃমাতৃহীন হয়েছেন। বাবাকে হারিয়ে ছেলেবেলায় বাবার জন্য কাঁদতেন বলে শাশুড়ি সায়রা খাতুন তাঁকে বলেছিলেন, শাশুড়িকেই বাবা বলে ডাকতে। তিনি তাঁর শাশুড়ি মাকে বাবা বলে সারা জীবন ডেকেছেন।

শাশুড়ি তাঁকে বড় ছেলের বউ হিসেবে বড় যত্ন করে মানুষ করে তুলেছেন। গ্রামের পরিবেশে বড় হয়ে ওঠা একজন মানুষ তিনি, শালীন মুসলিম ঘরের একজন মেয়ে ও পুত্রবধূ, এখন ঢাকার খোয়া ওঠা রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে তাঁর পা ফুলে যাচ্ছে, পায়ে ফোসকা পড়ে যাচ্ছে। রাতে তেল গরম করে পায়ে মালিশ করছেন, পায়ে সর্বক্ষণ ব্যথা থাকছে, কিন্তু তাঁর প্রধান কাজ- যা বঙ্গবন্ধু নির্দেশ দিয়েছেন, তা অতিশয় মনোযোগ দিয়ে সম্পন্ন করছেন। সব সময় রাসেলকে কোলে কাঁখে করে রাখেন। ছোট্ট রাসেলের মুখেও এখন রাজনৈতিক স্লোগান শোনা যাচ্ছে। ৬ দফা মানতে হবে।

এখন মাকেই রাসেল বাবা বলে ডাকছে, কারণ জেলখানায় আটকা থাকা বাবার জন্য রাসেলের ক্রন্দন সহ্য করতে না পেরে বঙ্গমাতা রাসেলকে বলেছেন, তাঁকেই বাবা বলে ডাকতে। ছোট্ট কচি রাসেল সেই নির্দেশমতো তাঁর মাকেই এখন ‘বাবা’ বলে সম্বোধন করছে।

মাকে বাবা বলে ডাকতে দেখে জেলখানায় বন্দী থাকা বঙ্গবন্ধুর বুক ভেঙে যাচ্ছে, নিজেকে অপরাধী বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু না, দেশের জন্য তিনি কোনো কিছুকেই ছাড় দিতে পারবেন না।

কিন্তু বঙ্গবন্ধু যতই এখন রেণুকে দেখছেন, ততই বিস্মিত হচ্ছেন। আগে তাঁর ডায়েরির রোজনামচায় রেণুকে রেণু বলে সম্বোধন করতেন, রোজনামচার পাতা পাঠক এখন যত ওল্টাচ্ছেন, ততই লক্ষ্য করছেন যে রেণুকে তিনি এখন বেগম সাহেবা বলে সম্বোধন করছেন! যেন রেণুর ক্ষমতা এবং বুদ্ধিমত্তা রেণুকে তাঁর কাছে ভালোবাসার বাইরেও শ্রদ্ধার পাত্র করে তুলছে।

রেণু এখন ধানমন্ডিতে তাঁর নিজের হাতে গড়ে তোলা বাড়িতেই আওয়ামী লীগের সভা হতে দিচ্ছেন। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ মেনেই হচ্ছে। ফজিলাতুন নেছা রেণুর বাড়ির রান্নাঘরে এখন ডজন কে ডজন কাপ শোভা পাচ্ছে। কারণ কর্মীরা সভা শেষে কেউ চা না খেয়ে বাড়ি যায় না। কর্মীদের বিশেষ সভা হলে কেউ ভাত না খেয়েও বাড়ি ফেরে না। রেণু নিজের হাতে এবং তাদের সেসব রান্না করেন। ‘ভাবী’ রেণুকে না হলে কর্মীদের চলে না। তাদের যে কোনো সমস্যায় বঙ্গবন্ধু এখন কর্মীদের নির্দেশ দেন, তোমাদের ভাবীকে বল। বাড়ি ভাড়া দিতে পারছ না? ভাবীকে বল। মেয়ের বিয়ে দিতে পারছ না? ভাবীকে বল। বাড়ি ফিরে যাওয়ার গাড়ি ভাড়া নেই? ভাবীকে বল।

যেন বঙ্গবন্ধুর অজান্তেই ফজিলাতুন নেছা রেণু হয়ে উঠলেন আওয়ামী লীগের একজন বিশেষ কর্মকর্তা এবং ট্রেজারার। মনে হয় বঙ্গবন্ধু কোনো দিন চিন্তা করেননি যে টুঙ্গিপাড়া ছাড়া এই বাংলাদেশে তাঁর আর কোনো বসবাসের জায়গা হবে বা প্রয়োজন হবে। কখনো চিন্তা করেননি যে সলিড রাজনীতির জন্য ঢাকায় একটি পারমানেন্ট বাসস্থান প্রয়োজন। যেন কখনো ভাবেননি যে, যেভাবেই হোক, যত কষ্টই হোক, ছেলেমেয়েদের এখানেই রাখতে হবে। রাজনীতি-পাগল এ মানুষটি, দেশের মুক্তিকামনায় সারা জীবন যুদ্ধ করা এ মানুষটি, নিজের ব্যক্তিগত সুবিধার কথাও যেন কখনো চিন্তা করেননি। যেন জেলকেই তিনি তাঁর নিজের মনের অজান্তেই ঘরবাড়ি বানিয়ে ফেলেছিলেন! কারণ বঙ্গবন্ধুর নিজের থাকা নিয়ে কোনো চিন্তাভাবনা ছিল না। যে কোনো জায়গায়, যে কোনো বাসস্থানে-সে মোগলটুলী হোক বা মন্ত্রিপরিষদের অস্থায়ী আস্তানা হোক, কোনো না কোনো খানে তাঁর আশ্রয় মিলে যাবে। আর তা যদি না হয় তো জেলখানা তো আছেই! যে কোনো খোলা জায়গায় দাঁড়িয়ে পাকিস্তানের দুর্নীতি নিয়ে কিছু কথাবার্তা বললেই তো অচিরে তাঁর বাসস্থান হবে জেলখানা, ঢাকায় থাকার অসুবিধা কী?

কিন্তু বঙ্গমাতা রেণু ছিলেন বাস্তবের কশাঘাত সহ্য করা একজন অভিজ্ঞ মানুষ। এই অভিজ্ঞতা তাঁকে ঢাকায় এসে রাতারাতি অর্জন করতে হয়েছিল। নিজের পরিশ্রম এবং অক্লান্ত চেষ্টার ফলে তিনি ঢাকার ধানমন্ডিতে একটি বাসস্থান গড়ে তোলেন যা পরবর্তীতে রাজনীতিবিদদের জন্য একটি সভাস্থলে পরিণত হয় এবং বাংলা ও বাঙালির জাতীয় ইতিহাসে একটি মাইলফলক হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। যা বর্তমানে জাদুঘরে পরিণত হয়েছে।

বঙ্গমাতা যখন জীবিত ছিলেন তখন তাঁর নাম কি আমরা খুব বেশি উচ্চারিত হতে শুনেছি? মোটেও নয়। প্রথম তাঁর নাম আমরা জানতে পারি যখন তিনি আগরতলা মামলায় ঘাঘু রাজনীতিবিদদের অনুরোধ না মেনে বঙ্গবন্ধুকে প্যারোলে মুক্তি নিতে নিষেধ করেন। সেই প্রথম আমরা বঙ্গমাতার রাজনীতির অঙ্গনে কোনো অ্যাকটিভ ভূমিকার কথা জানতে পেরেছিলাম।

তার আগেও নয়, পরেও নয়।

তখন দেশ স্বাধীন হয়েছে, কিন্তু দেশের শত্রুরা নিশ্চিহ্ন হয়নি। এই বাংলা যেমন মীরজাফরের দেশ, এই বাংলা যেমন ঘাতক মোশতাকের দেশ, তেমনি এই বাংলা আমাদের বঙ্গবন্ধুর দেশ, এই বাংলা আমাদের বঙ্গমাতার দেশ। বঙ্গমাতা নিজে কোনো দিন নিজের আত্মজীবনী লিখে রেখে যাননি। কারণ সেটি করার তাঁর সময় ছিল না, সংসার এবং রাজনীতির যুদ্ধক্ষেত্রেই তাঁর সমস্ত সময় ব্যয় করতে হয়েছিল। এদেশের যেখানেই তাঁর বাসস্থান ছিল, সেখানেই ছিল হয় পুলিশের তান্ডব, নয় পাকিস্তান সরকারের গুপ্তচরের তান্ডব অথবা পাকিস্তানি মিলিটারির তান্ডব, বাড়ি লুট হওয়ার তান্ডব। সর্বশেষ নিজের দেশের মিলিটারির তান্ডব।

আর এসব ডামাডোলের মধ্যে তাঁর দৈনন্দিন জীবনের ওঠাপড়ার মধ্যে, রাজনীতি ও জাতীয় সংকটেরও ওঠাপড়ার মধ্যে তাঁর আজীবন সঙ্গী ছিল একটি গ্রামোফোন ও কতগুলো রেকর্ড। আর ছিল কতগুলো বই। সেই সঙ্গে ছিল তাঁর গোছালো পরিপাটি সংসার। কারণ যতবার তাঁর সংসারে তান্ডব হতো, শুধু শেষবার ছাড়া- তান্ডব শেষ হলে আবার তিনি তাঁর সংসার গুছিয়ে ফেলতেন।

ঘরবাড়ি থাকত টিপটপ। রান্না, খাওয়া, মেহমানদারি করা সবকিছু চলত নিয়ম ধরে। আলমারির তাকে তাকে গোছানো থাকত তাঁর বাড়ির বিছানার চাদর, বালিশের ওয়াড়, চাদর, সুজনি, পরনের শাড়ি, ছেলেমেয়েদের জামাকাপড়, তোয়ালে, গামছা। সব থাক থাক করে সাজানো। বঙ্গবন্ধুকেও কেউ কোনো দিন মলিন জামাকাপড়ে বাইরের জনসভায় দেখেনি।

এ যেন তাঁর সংসার গোছানো ছিল না, সংসারের ভিতর দিয়েই যেন তিনি দেশ গুছিয়ে তুলতেন! সত্যি বলতে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে ঘটে যাওয়া যে কোনো তান্ডবেই তো দেশও এলোমেলো, ভাঙচুর হয়ে যেত। এ সবই তো ঐতিহাসিক সত্য।

জীবনের এ রকম এক কর্কশ যুদ্ধক্ষেত্রে তিনি হিমালয় পর্বত পার হয়েছিলেন, নীরবে নিভৃতে তিনি বাংলা ও বাঙালির জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। সেই কথা মনে পড়ে এখন আমাদের চোখ ভিজে যায়, অশ্রুতে ভেসে যায় চোখ। আরও দুঃখ লাগে যখন ভাবী যে ৮ আগস্টে এই মহীয়সী নারীর জন্মদিন তাঁর ঠিক সাত দিন বাদেই হলো তাঁর মৃত্যু দিন। মাত্র সাত দিন আগেই তাঁর বাড়িতে কত হাসিখুশির আসর বসেছিল! কত কথা, কথা প্রশংসা, কত ভালোবাসা, কত শ্রদ্ধা, আরও কত-কত- কত-। অথচ তার মাত্র সাত দিন বাদেই তাঁর সংসারে নেমে এলো দানবের তান্ডব।

আজ তোমার জন্মদিনে তোমাকে আমরা স্মরণ করি, মাতা। যতদিন এই বাংলাদেশ থাকবে, ততদিন তোমার কীর্তির কথা দেশের মানুষ ভুলবে না। তুমি চিরজীবী হও, বঙ্গমাতা।

তোমাকে আমাদের প্রাণঢালা অভিনন্দন।

লেখক : মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, অধ্যাপক ও কথাসাহিত্যিক।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর