৩০ জুন, ২০২০ ১১:২৮

আমার করোনাকাল

মাহমুদ হাসান

আমার করোনাকাল

দেশে বেশিরভাগ মানুষ করোনাক্রান্ত হয়ে সেরে উঠছেন। প্রতিদিন জনেজনে তৈরি হচ্ছে করোনা জয়ের গল্প। ভাবিনি আমাকেও এমন গল্প লিখতে হবে। ভালোই যাচ্ছিল রমজান মাসের দিনগুলো। করোনাকালের শুরু থেকেই সাবধানে থাকার চেষ্টা করছি। একটু পরপর সাবান দিয়ে ২০ সেকেন্ড ধরে হাত ধোয়া, ঘরের-বাইরে, অফিসে মাস্ক ব্যবহার, হ্যান্ড স্যানিটাইজার, ব্লিচিং স্প্রে, টিস্যু কোনটাই বাদ রাখছি না। বাসা আর অফিসে সীমাবদ্ধ জীবন সেই মার্চের গোড়া থেকে। আমার অফিসে কত রকম সাবধানতা, দূরত্ব রক্ষা, মাস্ক, রাব, গরম পানি, কত কী!

রোজায় বাংলাদেশ প্রতিদিন অফিসে জমপেশ ইফতারির আয়োজন একটা রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। এবার ওসব ছিল না। স্বাস্থ্যবিধি মেনে ইফতারি আনা ও খাওয়া হয়। জামাতের বদলে সবাই একা একা নামাজ পড়ি নিজ নিজ জায়নামাজে। তারাবির জামাত বাদ। এত কিছুর পরও অদৃশ্য শত্রু করোনার হাত থেকে রক্ষা হলো না। প্রথম রিপোর্টিং বিভাগের দুই তরুণ সহকর্মী আক্রান্ত হলেন। প্রথমে জ্বর কাশি গলা-ব্যাথা। কোভিড-১৯ টেস্টে ওদের পজেটিভ এলো। সপ্তাহখানেক বাদে ২০ রোজার ইফতার শেষে বুঝলাম, আমার জ্বর আসছে। পরদিন শুক্রবার জ্বরের তোড়ে রোজা ভাঙতে বাধ্য হলাম। ফোন করলাম, এক চিকিৎসক বন্ধুকে। প্যারাসিট্যামল, ভিটামিন সি, বেশি বেশি জুস, গরম পানি আর বিশ্রামের পরামর্শ দিলেন। তিনদিন পরে কোভিড-১৯ টেস্ট করাতে বললেন। জ্বর কমে না, সবসময় ১০১। সঙ্গে গা ব্যাথা, মাথা ভার, ক্লান্তি, অরুচি।  প্রথম দিকে হাঁচি কাশি শ্বাসকষ্ট ছিল না। ১৯ মে করোনা পরীক্ষার নমুনা দিয়ে এলাম জাতীয় প্রেস ক্লাবে স্থাপিত ব্র্যাকের বুথে।

বনশ্রীতে আমরা তিনতলার ফ্ল্যাটে থাকি তিনজনা। আমি, স্ত্রী পারভীন চৌধুরী বেবি ও আমাদের ছোটমেয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া নুসফাক মাহমুদ। ২০ মে রাতে বেবির জ্বর এল। ২১ মে নুসফাকের। তিনজন তিন বেডরুমে থাকি। দোতলায় মায়ের বাসা থেকে আমাদের জন্য খাবার আসে। ২২ মে রাতে রিপোর্ট পেলাম আমি পজেটিভ। ঘরে জানালাম না। সহকর্মী বাংলাদেশ প্রতিদিনের চিফ রিপোর্টার মনজুরুল ইসলাম নিয়মিত খোঁজ রাখছেন। তাকে জানালাম। এক কান দুই কান হতে হতে সবাই জানলেন আমায় করোনা ধরেছে। স্ত্রী-কন্যার জ্বর তিনদিনের বেশি হওয়ায় ২৪ মে তারা টেস্টের স্যাম্পল দিয়ে এলেন। সেই রাতে আমার কাশি আর গলাব্যথা শুরু হলো। মৃদু শ্বাসকষ্ট। অসুস্থ নুসফাক এসে বাবাকে ন্যাবুলাইজার দিল। এদিকে ভদ্রমহিলা নিজের অসুস্থতার কথা ভুলে গিয়ে আমাকে হাসপাতালে পাঠানোর সমস্ত আয়োজন শেষ করেছেন, আমি জানি না। বেবি এসব করেছে আমার সহদোর অনুজ মাসুদ হাসানকে সঙ্গে নিয়ে। আর সব কিছুতে মূল সহায়কের ভূমিকা পালন করেন চিফ রিপোর্টার অনুজপ্রতীম মনজুরুল ইসলাম। আমার আরেক সহকর্মী সিনিয়র রিপোর্টার রফিকুল ইসলাম রনি এতে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। অন্য সহকর্মীরাও অভয় দিয়েছেন, কী খেতে হবে, কী করতে হবে, ফোনে ম্যাসেঞ্জারে পরামর্শের পর পরামর্শ দিয়েছেন। ঈদের আগেরদিন চাঁদরাতের আনন্দ অন্যরকম। এই প্রথম আমাদের বাসায় চাঁদরাতের উৎসব নেই, ঈদের কোন আয়োজন নেই।

দুই.
২৫ মের সকাল। ঈদুল ফিতরের জামাত শেষে লোকজন বাড়ি ফিরছে। রাস্তায় মুসল্লি­র ঢল নেই, শিশুরাও নেই। কেউ কোলাকুলি করছে না, কারুরই পরনে নেই নতুন কাপড় । সবার চোখে-মুখে ঈদের খুশির বদলে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। ঈদের দিনের এই অচেনা দৃশ্য দেখতে দেখতে আমি হাসপাতালে চলেছি। অ্যাম্বুলেন্স ছুটে চলেছে মগবাজার ইস্কাটন গার্ডেন রোডের হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল অভিমুখে। অ্যাম্বুলেন্সে আমার সহযাত্রী স্ত্রী বেবি, অনুজ মাসুদ আর ছোট ভগ্নিপতি শহিদুল ইসলাম বাবু। আমার অনুরোধে অ্যাম্বুলেন্স চালক রাস্তায় সাইরেন না বাজিয়ে হাসপাতালে পৌঁছালেন। পাথওয়ের অ্যাম্বুলেন্স কর্মীরা যত্ন করে আমার পুরো শরীরে জীবানুনাশক স্প্রে করেন। তারা বিদায় নেওয়ার সময় অনুচ্চ স্বরে বলেন, "গুড লাক, ঈদ মোবারাক"।

আগেই হাসপাতালে যোগাযোগ করে বলে রাখা হয়েছিল আমাকে আনা হবে। ইমারজেন্সিতে ঢুকে পরিচয় দিতেই দুজন নার্স দ্রুত আমার ভর্তির প্রক্রিয়া শুরু করেন। কিন্তু কোভিড-১৯ টেস্ট রিপোর্টের হার্ড কপি সাথে না থাকায় সমস্যা দেখা দিল। আমার মোবাইল ফোনে রাখা রিপোর্টের সফট কপির ওপর ভরসা করতে পারছিলেন না তারা। অতঃপর বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির ভাইস চেয়ারম্যান ও সিরাজগঞ্জ সদরের সংসদ সদস্য প্রফেসর ডা. হাবীবে মিল্লাত মুন্না'র সহযোগিতায় আমার ভর্তি প্রক্রিয়া সম্পন্ন হল। হাসপাতালের পরিচালক প্রফেসর ডা. মোরশেদ নিজে এ ব্যাপারে তদারকি করেন। পরে নিয়মিত খোঁজ-খবর নিয়েছেন তিনি।

এমনিতেই করোনাকালে হাসপাতালে ভিড় নেই, তার উপর ঈদের দিন। আমার ঠাঁই হল করোনা রোগীদের জন্য তৈরি করা দোতলার স্পেশালাইজড কেবিন ওয়ার্ডের এসসি-১এ নম্বর বেডে। তিন বেডের এই কেবিনে তখন একমাত্র রোগী আমি। পুরো রেস্ট্রিক্টেড এরিয়া এই কেবিন ওয়ার্ড। আমার কেবিনের দরজার ওপারে নার্স স্টেশন। বেবি, মাসুদ ও বাবু বিদায় নেয়ার আগে অনুমতি নিয়ে কেবিনে এসে আমাকে সান্ত্বনা দেয়। তাদের বলি, আমি একা এখানে থাকবো কীভাবে? বেবির হাত ধরতেই টের পাই বেশ জ্বর। সে অশ্রুসিক্ত। নিজেকে সামাল দিয়ে বলে, “তোমাকে আল্লাহ দেখবেন। তুমি ভালো হয়ে যাবে। কখনো মনোবল হারাবে না। ওরা যতই নিষেধ করুক আমরা রোজ তোমার কাছে আসবো।” হ্যাঁ, রোজ আমার কাছে আসতো মাসুদ। বাসার খাবার নিয়ে, ওষুধ পথ্য নিয়ে। কেবিন করিডোরের প্রবেশ পথে দোতলার সিঁড়ি বারান্দায় সব রেখে যেত প্রিয় অনুজ আমার। 

তিন.
ওরা আমাকে একা রেখে চলে যাওয়ার পরবর্তী মুহূর্তগুলো আর মনে করতে চাই না। আমি ক্ষুধায়-তেষ্টায় কাতর। গলা শুকিয়ে কাঠ, জিহ্বা নাড়াতে পারছি না। পানির বোতল মুখে তুলে ধরব সেই শক্তিও নেই। বেড থেকে ওঠার ক্ষমতা নেই। গা ভর্তি জ্বর। পুরো শরীর ব্যাথা। কেবিনের জানালা দরোজা সব বন্ধ। দিন না রাত ঠাওর করা যায় না। বারবার মনে পড়ে হাসপাতালে আসার আগে দোতলার সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে আম্মার কান্নার দৃশ্য। আর বিদায় বেলায় বেবির করুণ চাহনি। দুপুরের খাবার কেবিনের বাইরে পড়ে আছে। দিয়ে যাওয়ার কেউ নেই। বন্ধ দরোজার ওপারে নিস্তব্ধ করিডোরে মাঝে মাঝে একটি বিড়ালের মিউ মিউ ডাক কানে আসে। বিকেলে নার্স আসেন কিন্তু কেবিনে ঢোকেন না। দরোজার মুখে দাঁড়িয়ে ওষুধ খেয়েছি কী না খোঁজ নিয়ে চলে যান।
ঈদের দিন বলে কম সংখ্যায় স্টাফ কাজ করছেন। রোগিও কম। ১০ কেবিনের এ ওয়ার্ডে দুজন সিস্টার সব সামাল দিচ্ছেন। বিকেলে  অনেক কষ্টে কেবিন থেকে বেরিয়ে ওয়াশরুম গেলাম। ফেরার পথে খাবারের বক্সটা নিয়ে এলাম। লাঞ্ছবক্স খুলতে দেখি পোলাও আর চিকেন, ঈদ উপলক্ষে বিশেষ খাবার।  মুখে দিলাম, পোলাও বিস্বাদ। চিকেন কারিতে কেমন ওষুধ ওষুধ গন্ধ। রুচি হল না। সন্ধ্যার পর রাতের খাবার এল। ভাত সব্জি ডিম। জ্বর মুখে কিছুই ভাল লাগল  না। মনে হলো সব উগলে দেবো এখনি। ক্ষুধা তেষ্টা আর জ্বরে দুঃসহ প্রথম রাত কাটল নির্ঘুম। 

চার.
পরদিন ২৬ মে, সেদিনও ঈদের ছুটি। সকালের নাস্তা পেটপুরে খেলাম। ব্রেড, জেলি, ডিম, কলা। জ্বর কমে গেছে। এই প্রথম শরীরটা ভালো লাগছে। নাস্তার আগে প্যাথলজি বিভাগের কর্মী এসে ব্লাড  নিয়ে গেলেন। ইউরিন-স্টুলের স্যাম্পল দিলাম। বুকের এক্সরে। সিস্টার দরোজার ওপারে দাঁড়িয়ে জানিয়ে দিলেন, কাল থেকে পুরো চিকিৎসা শুরু হবে রিপোর্ট আসার পর। প্রথমদিন জ্বরের ঘোরে ছিলাম। দ্বিতীয়দিন আর কাটে না। নিজের জন্য চিন্তা আর স্ত্রী-কন্যার জন্য দুঃশ্চিন্তা জেকে বসে। হাসপাতালের খাবার মুখে তুলতে পারি না। বিকালে মাসুদ এসে খাবার ও প্রয়োজনীয় সামগ্রী ওয়ার্ডের বাইরে রেখে যায়। এখন মোবাইল ফোন আমার একমাত্র সঙ্গী। কোন কল রিসিভ করি না। রিসিভ করার অবস্থাও ছিল না। একটু ভাল লাগলে ফেইসবুক মেসেঞ্জার স্ক্রল করি। খুড়িয়ে খুড়িয়ে রাত এলো, সঙ্গে জ্বরও। দ্বিতীয় রাতও নির্ঘুম কাটালাম।

২৭ মে সকালে কেবিনে প্রথম চিকিৎসক ঢুকলেন। বললেন, আপনার সব রিপোর্ট ভাল। ১৪ দিন ইঞ্জেকশন নিতে হবে। বললাম, পজেটিভ রিপোর্ট আসার পর আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও ইউজিসি প্রফেসর ডা. এ. বি. এম আব্দুল্লাহর সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করি। তিনি আমাকে কিছু মেডিসিন প্রেস্ক্রাইব করেন। চিকিৎসক হাতে নিয়ে ওষুধের তালিকাটা দেখলেন। বললেন, স্যারের ওষুধগুলোই আমরা ফলো করবো। সেদিন থেকে শুরু হল প্রতি সন্ধ্যায় নাভির পাশে একটি করে ইনজেকশন। দিন কোন রকমে পার হলেও রাত এলে যেন দম বন্ধ হয়ে আসে। একা, কেউ নেই, পাশের দুই বেড শুন্য। সুনসান নীরবতা। রুমে আলো জ্বালিয়ে রাখি। আমার জীবনের আলো নিভতে দেবো না। অলুক্ষণে চিন্তা মাথা থেকে সরিয়ে ফেলার  প্রাণপণ চেষ্টা করি। তারপরও মাথার ভেতর বাজে "যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাঁটে।" আমি বালিশে মুখ গুজে কাঁদি।  

পাঁচ.
হাসপাতালের প্রথম তিনটি রাত ছিল আমার কাছে দুঃসহ। সেই নিঃসঙ্গ-নির্ঘুম রাত দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর, ফুরাতে চাইতো না। গভীর রাতে কখনো মনে হতো এখনই ট্রিপল নাইনে কল করি। এখান থেকে উদ্ধার করে নিয়ে যাক আমাকে। কত ভাবনা আসত মনে। খুব মনে পড়ত ছোটবেলার কথা। সারাক্ষণ মাথার ভেতর ঘুড়ি উড়াত মৃত্যুভাবনা । আমি মরে যাওয়ার পর কী হবে। মা, স্ত্রী, সন্তান, ভাই-বোনেরা বিলাপ করবে। পত্রিকায় সিঙ্গেল কলাম খবর বেরুবে। আমার সম্পাদক নঈম নিজাম এবং নির্বাহী সম্পাদক পীর হাবিবুর রহমান তাঁদের কলামে আমার স্মৃতিচারণ করবেন, আমার মন্দ দিকগুলো আড়াল করে গুণকীর্তন করবেন। করোনাকাল বলে প্রথা অনুযায়ী আমাকে জাতীয় প্রেসক্লাব প্রাঙ্গণে নিয়ে শেষ শ্রদ্ধা জানানো হবে না। স্বাস্থ্যবিধি মেনে জানাজা ও দাফনকাজ সম্পন্ন করা হবে। সবাইকে ডাকা হবে না। এসব ভাবতে ভাবতে রাত ভোর হয়। কিন্তু ঘুম আসে না। চিকিৎসকের কড়া নির্দেশ ঘুমের পিল নেওয়া যাবে না। একজন অসুস্থ মানুষের বড় দাওয়াই ঘুম, সেই ঘুম যদি না হয় বাঁচি কীভাবে?

হাসপাতালে আসার আগে বাসায় কত সেবা-শুশ্রুষা পেয়েছি। এখানে আমাকে দেখার কেউ নেই, এই প্রকাণ্ড কেবিনের ভেতর নিঃসঙ্গ আমি কীরকম বেঁচে আছি। কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতায় একটা লাইন আছে, "আমি কীরকম ভাবে বেঁচে আছি তুই এসে দেখে যা নিখিলেশ"। এই কেবিনে আমি কাকে দেখাব আমার বুকের ভেতরে বেঁচে থাকার আকুতি। আমি মরে যাবার বদলে বাঁচতে এসেছি এখানে। মৃত্যু নয়, আমি পুরানো জীবনের সঙ্গে নতুন জীবন বদল করতে চাই, যেমন মানুষ স্বপ্ন বদল করে। এক স্বপ্ন থেকে আরেক স্বপ্নের দিকে  ছোটে। এই কেবিনের কষ্ট আমি বুঝি। এখানে আশ্রিত কত রোগি শুশ্রুষার বদলে শেষ পর্যন্ত মৃত্যুকে করেছে আলিঙ্গন। "নিখিলেশ তুই একে কী বলবি?” হে ‘এসসি ওয়ান-এ’ কেবিন, "জেনে রাখো, আমি এখানে মরতে আসিনি। আমি সুস্থ হয়ে যাওয়া রোগি হয়ে বাড়ি ফিরতে চাই। আমি হাসপাতালের শবঘরে একাকী শুয়ে থাকতে চাই না। হে পৃথিবী জেনে রাখো, আমি মৃত্যুকে অবহেলা করি না, কিন্তু করোনায় মরতে চাই না। আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব আমার লাশ দেখবে না, জানাজায় অংশ  নেবে না, দাফন কর্মে শরীক হবে না, এমন মৃত্যু চাই না আমি। হে মৃত্যু, তোমার প্রতি আমার কোন আক্রোশ নেই, তুমি তো সত্যি, তুমি আছো বলেই জীবন এত সুন্দর!

ছয়.
২৮ মে দিনে আর জ্বর আসেনি। সন্ধ্যার পরও জ্বর এলো না। তবে এলেন একজন নতুন রোগি, তার বেড নম্বর এসসি-১বি। বেশ খারাপ অবস্থা, শ্বাসকষ্ট, কখনো সুগার কমে যাচ্ছে, কখনো ব্লাড প্রেসার নেমে যাচ্ছে, রক্তে অক্সিজেন ৯০ এর নিচে। ভদ্রলোকের নাম মর্তুজা আহমদ ফারুক, ডাকনাম চিশতী । বাপেক্স-এর সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং বর্তমানে 'এনার্জি এন্ড পাওয়ার' সাময়িকীর উপদেষ্টা সম্পাদক। অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে নার্স- ওয়ার্ড বয়দের ছোটাছুটির মধ্যে তার প্রথম রাত বেশ নাজুক অবস্থায় কাটল। পরের দিন সকালে আমাদের আনুষ্ঠানিক আলাপ-পরিচয় হলো। তিনি প্রয়াত ছাত্রনেতা ও সাংবাদিক মারুফ চিনুর সহদোর। মারুফ চিনুর অগ্রজ হওয়ার সুবাদে মর্তুজা আহমদ ফারুক হয়ে গেলেন চিশতী ভাই। ২৯ ও ৩০ মে কখনো ভালো কখনো মন্দ, মোটামুটি অক্সিজেন সিলিন্ডারই ছিল চিশতী সাহেবের ভরসা। ৩০ মে বিকেলে তার মুখে প্রথম এক ফালি হাসি দেখি নতুন চাঁদের মতো। চিশতী ভাই সজ্জন মানুষ। হাসপাতালে তার আন্তরিক সাহাচার্য আমাকে অনেক উদ্দীপনা দিয়েছে। শরীরটা একটু ভাল লাগলেই গল্প শোনাতেন। উত্তর কোরিয়া এবং নরওয়েতে প্রশিক্ষণকালীন গল্প। জানালেন উত্তর কোরিয়ার উপর একটা গ্রন্থের পাণ্ডুলিপি তৈরি করে রেখেছেন। আগামি বইমেলা ধরবেন।

সাত.
১ জুন রাত ১০টা নাগাদ সিস্টার এসে খবর দিলেন শূন্য এসসি-১সি বেডে রোগী আসছেন। খবরটাতে একটু ভয়ই পেলাম। আমি ভালো হওয়ার পথে, এ সময় নতুন রোগী। চিশতী ভাই বললেন, “তৈরি হোন আমাকে যেভাবে সেবা শ্রুশ্রষা করেছেন নবাগতকেও তেমনই করতে হবে।” আমি জবাব দেওয়ার আগেই তিনি সহাস্যে বলেন, “আমরা দু'জন আছি, ভয় নেই, দুজন মিলেই করব।” নতুন অতিথির অপেক্ষায় থাকতে থাকতে  আমার একসময় তন্দ্রা মতো আসে। কাশির শব্দে তন্দ্রা ভাঙতে আধো ঘুম আধো জাগরণে দেখি ১সি বেডে একজন যুবক বসে। মাথায় অবিন্যস্ত ঝাঁকড়া চুল, আর মুখভর্তি অযত্নে বেড়ে ওঠা দাঁড়ি। তিনি ঘনঘন কাশছেন। বোঝা যাচ্ছে শ্বাসপ্রশ্বাসে তার কষ্ট হচ্ছে। চিশতী ভাই আমার পাশে এসে নিচু গলায় বললেন, “ওনার অনেক কষ্ট হচ্ছে। নার্সকে বলে দেখেন না জরুরি একটা সিলিন্ডার অ্যারেঞ্জ করা যায় কিনা।” খুব চেনা মনে হলো, কিন্তু বড় চুল দাঁড়িতে ঢাকা ভদ্রলোককে চিনতে পারছি না। আমি কৌতুহলী চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছি। এবার আগন্তুক নিজেই বললেন, “মাহমুদ ভাই আমাকে চিনতে পারছেন না! আমি সূর্য, আবু জাফর সূর্য।” বুকের ভেতর হু-হু করে ওঠে। সূর্যের একি হাল! ওর এক্সট্রা অক্সিজেন প্রয়োজন। দ্রুত গিয়ে জানালাম নার্স স্টেশনে। কিছুক্ষণের মধ্যে সিলিন্ডার এল। ঘণ্টাখানেক অক্সিজেন নেওার পর সূর্য স্বাভাবিক হলো। চিশতী সাহেবের সঙ্গে পরিচয় করালাম সূর্যকে, সাংবাদিক নেতা, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের প্রাক্তন সভাপতি। এর আগে  সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। চিশতী ভাই নিজেই নিজেকে পরিচয় করালেন, আমি মারুফ চিনুর মেজভাই। সূর্য জানালেন, রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে মারুফ চিনুর সাহচর্য পেয়েছেন তিনি। প্রথম তিন দিবস রজনী আবু জাফর সূর্যের জন্য ছিল দুঃসময়। কাশির ধকলে যেন দম বন্ধ হয়ে আসে। দুঃসহ তিনরাত পেরিয়ে ৪ জুন আবু জাফর সূর্যের মুখে দেখলাম চাঁদের হাসি। একসময় অক্সিজেন সিলিন্ডারের ওপর নির্ভরতা কাটিয়ে উঠি আমরা। মোটামুটি ভরসা পেতে শুরু করেছি, সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরতে পারবো। বাড়ির কথা মনে হলে  মনটা ভারি হয়ে ওঠে। আমি হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছি, আমার বাড়িতে করোনা আক্রান্ত স্ত্রী ও কন্যা তারা কী সত্যি সেরে উঠেছে! আমার মতো আবু জাফর সূর্যের স্ত্রী-কন্যা করোনা আক্রান্ত। চিশতী সাহেবের শিশু পৌত্রসহ তার পরিবারেও দুজন আক্রান্ত। করোনাকালের সুবাদে হাসপাতাল জীবনে বড় আপন হয়ে গিয়েছিলাম আমরা তিনজন। চিশতী ভাইয়ের শালিকা, সূর্যের ভাগিনা আর আমার মায়ের বাসা থেকে আসা খাবার ভাগ করে খেতাম আমরা। একজন আরেক জনের শুশ্রুষায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে এসেছি। নতুনভাবে নিজেদের খুঁজে পেয়েছি। জীবনের ভেতর নতুনভাবে জীবনকে খুঁজে পাওয়ার মধ্যে দিয়ে আমার ভালোই কেটেছে হলি ফ্যামিলির শেষ দিনগুলো।
 
আট.
হাসপাতালের সাদা চাদরের বেডে শুয়ে রঙিন জীবনটা কখনো বিবর্ণ মনে হয়েছে। লম্বা জীবনের দীর্ঘ পথ চলায় কত উচ্ছ্বাস, কত স্বপ্ন, স্বপ্নভঙ্গ, নানা রঙের দিনগুলো কখনো চোখের সামনে ভেসে উঠেছে। আতঙ্কজাত উদ্বেগ দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়েছে। আবার সমান্তরালভাবে বেড়েছে আশা। সবসময় অটুট রাখার চেষ্টা করেছি মনোবল। স্বজন সুহৃদ শুভাকাঙ্ক্ষীদের কাছ থেকে সব থেকে বেশি পেয়েছি মনের শক্তি বৃদ্ধির অভিন্ন পরামর্শ। আমার দুশ্চিন্তার বড় জায়গাটা জুড়ে ছিল বেবি ও নুসফাক। তাদের খারাপ কিছু হলে কে হাসপাতালে নেবে? 

নয়.
কর্তব্য পালনে হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মী কারো আন্তরিকতায় কোন ঘাটতি দেখিনি। তবে কখনো কখনো করোনা আক্রান্ত হওয়ার অতিশঙ্কা এবং নিজেকে সংক্রমণ থেকে সুরক্ষার মাত্রাতিরিক্ত প্রচেষ্টা রোগী হিসেবে আমার সাময়িক মন খারাপের কারণ হয়েছে। যদিও তারা আগে নিজেকে সুরক্ষা করবেন, এটাই স্বাভাবিক। তারা অসুস্থ হলে রোগীদের কে চিকিৎসা দেবে, কে সেবা করবে! জেনেছি, এই চিকিৎসালয়ে অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। তাদের পিপিই নিয়ে আফসোস আছে। ঝুঁকি কমানোর ব্যবস্থাপনায় ঘাটতি ও নিরাপদ পরিবেশের নিশ্চয়তা নিয়ে আক্ষেপ আছে। বকেয়া বেতন ও অন্যান্য বঞ্চনার কথা নাই-বা বললাম। রোগী হই আর না-হই, করোনার বিরুদ্ধে লড়াইরত এইসব সম্মুখযোদ্ধাকে আমাদের শ্রদ্ধা সম্মান ভালোবাসতেই  হবে।

দশ.
অসুখ কখনো জীবনটাকে নতুনভাবে জানতে শেখায়, নতুন ভাবনার জন্ম দেয়। আমারও নতুন ভাবনার জন্ম দিয়েছে, কাউকে বাঁচাতে গেলে আগে নিজেকে বাঁচতে হবে। এটা স্বার্থপরতা নয়। মানুষ মানুষের জন্য। মনুষ্যত্ব মানুষকেই বিমোহিত করে, উদীপ্ত করে। সেসময় আমার মনোবলকে উদীপ্ত করেছেন আমারই তিন  প্রাক্তন সহকর্মী, তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানাই, তারা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক যোগাযোগ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক ও জাতীয় প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ফরিদা ইয়াসমিন। তারা নিয়মিত ফোন করে আমার চিকিৎসার খোঁজখবর নিয়েছেন, অভয় দিয়েছেন। ফরিদা ইয়াসমিন, তার তখন বিপদ, স্বামী বাংলাদেশ প্রতিদিনের সম্পাদক নঈম নিজাম করোনাহত হয়ে ঘরবন্দী, মায়ের আকস্মিক মৃত্যুর শোক, তারপরও তিনি আমার পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছেন পরম হিতৈষী হয়ে। ধন্যবাদ তথ্যমত্রী ড. হাছান মাহমুদ, প্রধানমন্ত্রীর প্রাক্তন তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী, আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আফম বাহাউদ্দিন নাছিম, যুগান্তর সম্পাদক ও জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি বন্ধু সাইফুল আলমকে। আমার প্রাক্তন ও বর্তমান সহকর্মীবৃন্দ, সুহৃদ ও শুভান্যধায়ীগণ, আত্মীয়স্বজন উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা নিয়ে নিয়মিত আমাদের খবর নিয়েছেন, শুভ কামনা করেছেন, মহান আল্লাহর দরবারে মোনাজাত করেছেন। আপনাদের ঋণ কোনদিন শোধ হবে না। ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট সেন্টারের সভাপতি রেজোয়ানুল হক ও সাধারণ সম্পাদক শাকিল আহমদকে তাদের মহতী উদ্যোগের জন্য শুভেচ্ছা রইল।

এগার.
৬ জুন ফের কোভিড-১৯ টেস্ট করাতে স্যাম্পল দিই। আমার আত্মবিশ্বাস ছিলো রেজাল্ট নেগেটিভ আসবে। ১১ জুন দুপুরে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানালেন, আমি সুস্থ, চাইলে আজই বাড়ি ফিরতে পারি, তবে ১৪ দিন হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকতে হবে। বাসায় ফোন করে এ সুসংবাদ দিয়ে মাসুদকে বললাম, আমাকে নিয়ে যাও। মাসুদও মনে হয় অপেক্ষা করছিল আমার এই কলের জন্য। আমি সূর্য ও চিশতী সাহেব, আমরা তিনজন দুপুরে একসঙ্গে খেলাম। চিশতী ভাই নিজেই প্লেটে প্লেটে খাবার বেড়ে দিলেন। খেতে খেতে দেখলাম সূর্যের মনটা ভার। আমি বিকালে ওদের ছেড়ে যাবো আমার ঠিকানায়, সেখানে অপেক্ষায় আমার কন্যা-জায়া-জননী। চিশতি সাহেব সম্ভবত ১৩ জুন হাসপাতাল ছাড়বেন। সূর্য তখন একা হয়ে পড়বে, কীভাবে থাকবে বাকি কটাদিন! আমার মনে পড়ল সেই নিঃসঙ্গ দুঃসহ দিনরাত্রির কথা। বিকেলে ছাড়পত্র এলো। মাসুদ কারপার্কিং থেকে কল করতে হাসিমুখে বিদায় নিলাম মর্তুজা আহমদ ফারুক ও আবু জাফর সূর্যের কাছ থেকে। দু'জনই হাসতে হাসতে উষ্ণ আবেগে বিদায় জানালেন। কেবিনের লবিতে সিস্টার মিষ্টি হেসে হাত নাড়তে নাড়তে বলতে ভুললেন না, “ভালো থাকবেন, সাবধানে থাকবেন।” ১৭ দিন পর হাসপাতাল ভবনের বাইরে খোলা আকাশের নিচে এলাম। দুপুরে বৃষ্টি হয়ে গেছে। হাসপাতাল চত্বরে গাছগাছালির বৃষ্টিভেজা সবুজ পাতাগুলো আষাঢ়ের বিকেলের নরম রোদে চিকচিক করছে। মুক্ত হাওয়া বুকে ভরে গাড়িতে উঠলাম। থ্যাংক ইউ হলি ফ্যামিলি।

বারো.
রাস্তায় মানুষ ও যানবাহনের ভিড় বেড়েছে। বনশ্রীতে পৌঁছে দেখি আম্মা দোতলার ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে তার বড় ছেলের অপেক্ষায়। নিশ্চয় তিনি মনে মনে বলছেন, আয় খোকা বুকে আয়। হাত তুলে আম্মাকে সালাম জানালাম। স্পষ্ট দেখি, তার পুরু চশমার নিচে আনন্দের অশ্রুবিন্দু। আম্মা দোতলার সিঁড়িমুখে এসে দাঁড়ালেন। সেখানে অপেক্ষমাণ ভাইবোন সবার স্বাগত সম্ভাষণের মধ্যে তিনতলায় উঠে দেখি দুয়ারে দাঁড়িয়ে বেবি ও নুসফাক। তাদের মুখে মাস্ক। চোখে আনন্দাশ্রু। আমরা তিন করোনাজয়ী, গভীরভাবে তাকিয়ে থাকি। আমার চোখ ভিজে যায় চোখের জলে।

লেখক: উপসম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন। 

বিডি প্রতিদিন/ফারজানা

সর্বশেষ খবর