১ জুলাই, ২০২০ ১৪:১২

হারিয়ে যাওয়া সাহিত্যিক হাবীবুর রহমান

প্রণব মজুমদার

হারিয়ে যাওয়া সাহিত্যিক হাবীবুর রহমান

স্মৃতি কী সত্যি হারিয়ে যায়? নাকি ভুলে যাওয়া? না তা নয়! আসলে ভোলা মন আমাদের। গুণীজনকে ভুলে যাই তাড়াতাড়ি। জাতি হিসেবে কী অকৃতজ্ঞ আমরা! যে ব্যক্তি সংসার, সমাজ কিংবা রাষ্ট্রে মেধাশ্রম দিয়ে সমৃদ্ধ করে গেলেন, তাঁকে খুব একটা হৃদয়ে ধরে রাখি না। মৃত্যুর পর তাঁকে হারিয়ে ফেলি। সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে অমরত্বের ধারণাটা ভুল হয়ে যায়। এই অকৃতজ্ঞতাবোধ দিনদিন আমাদের শিক্ষাকে করেছে ম্লান। গুণীজনের কদরের পরিবর্তে মন্দজনের প্রশংসাই করছি। লোভ ও স্বার্থের কারণে সমাজে হচ্ছে দুষ্টের পালন ও শিষ্টের দমন। আমাদের সাহিত্যেও বিষয়টি দৃশ্যমান। ভালো লেখক ও সাহিত্যিকরা আজ দেশে অপসৃয়মান। সৃজন এবং মননশীল বিশাল সাহিত্য ভাণ্ডারের অনেক লেখক ঢাকা পড়ে আছেন আমাদের স্মরণের খেলাঘরে। তেমন বিস্মৃত একজন প্রতিভাবান গুণী সাহিত্যিক হাবীবুর রহমান।

বয়স তখন সাত কি সাড়ে সাত। মেজদি ছিলেন আমার অবসরের সঙ্গী। বাল্যবেলায় দুষ্ট ছিলাম বেশ। দস্যিপনার জন্য মায়ের বকুনি ও মার খেতাম খুব। মেজদি মাঝে মাঝে রক্ষা করতেন। ছড়া, গল্প তিনিও বেশ শুনাতেন। ঘরে ছিলো বাবার অবসরের খোরাক রেডিও। সত্তরের দশকে সেই সময়। নিম্ন মধ্যবিত্তের ঘরে এ বিনোদন যন্ত্র থাকা মানে সে সময়ে বিশাল ব্যাপার! মহকুমা শহর চাঁদপুরে বাস। সাপ্তাহিক ছুটির দিন রবিবার। সকালে রেডিও নিয়ে মোড়াতে বসে পড়তেন মেজদি সাগরিকা মজুমদার। উদ্দেশ্য রেডিও বাংলাদেশ এ শিশুদের অনুষ্ঠান খেলাঘর শোনা। আমি পাশে গিয়ে দাঁড়াতাম। দিদি বলতেন ‘নারু ছড়া শোন। মজার ছড়া! ভাইয়া বলছেন।’
- ভাইয়া কে?
- ভাইয়ার নাম হাবীবুর রহমান।
শিশুবেলার এই ভাইয়াকে দিদির মতো বড় হয়ে বেশ মনে পড়তো। ছোট্টকালের রেডিওতে তাঁর গল্প, ছড়া শুনে বড় হয়েছি। তখন মনে হতো যদি সরাসরি দেখতে পেতাম তাঁকে? কেমন তিনি দেখতে? কীভাবে ভাইয়া আমাদের মন রাঙিয়ে তোলেন? কল্প কাহিনীর স্বপ্নরাজ্যে কি করে তিনি মধুর কথায় ভুলিয়ে দেন মন? শিশুবন্ধু ভাইয়াকে দেখেছি ঠিকই। তবে সশরীরে নয়, তাঁর কথা ও লেখায়। জেনেছি তাঁর শিশুতোষ বন্ধুময় প্রাণবন্ত প্রকৃতি। সে দিনগুলোর প্রাণময় স্মৃতি আজও মনের আয়নাতে দেখি। অত্যন্ত শিশুমনস্ক সংগঠক ভাইয়াকে লেখক হিসেবে বড় পরিসরে খুঁজে পাই আশির দশকের শুরুতে ওনার গ্রন্থপাঠে। উচ্চতর শিক্ষার সূত্রে ঢাকায় এসে বড় বড় পাঠাগারে পাঠের মধ্য দিয়ে এই লেখক বন্ধুর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়। বিজন বনের রাজকন্যা, আগডুম-বাগডুম, সাগরপাড়ের রূপকথা, পুতুলের মিউজিয়াম, গল্পের ফুলঝুরি, বনে বাদাড়ে, লেজ দিয়ে যায় চেনা, হীরা মতি পান্না, বনমোরগের বাসা ইত্যাদি শিশু সাহিত্যের জনক তিনি। অনুবাদ সাহিত্যে তিনি যুক্ত করেছেন চীনা প্রেমের গল্প, জন কেনেডি, জীবনের জয়গান ও পাল তুলে নাও গ্রন্থ। বড়দের জন্য লিখেছেন কবিতাও। তাঁর সৃজনী ভাণ্ডারে উপাত্ত নামে একটি কাব্যগ্রন্থও রয়েছে। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের কল্যাণমুখী এসব সৃষ্টিশীল লেখা বেশিরভাগই ১৯৬১ থেকে ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে রচিত। ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে সাহিত্যিক হাবীবুর রহমান সুসম্পাদিত কিশোর সাহিত্য সংকলন সপ্তডিঙ্গা বের হয় কলিকাতার বিখ্যাত প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান দেবসাহিত্য কুটীর থেকে। সে সময় দু’ বাংলায় শিশু কিশোর সাহিত্যের আকাল চলছিলো। সপ্তডিঙ্গা সে অভাব মোচন করে সম্পাদক হাবীবুর রহমানের কৃতিত্বে। বেশ কিছু নাটকের রচয়িতাও তিনি। শিশুতোষ নাটক কালের পুতুল বইটি প্রকাশিত হয় ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে। কিন্তু ছোটদের উপযোগী নাটক আলোর ফুল, মায়া কানন এবং চিতল হরিণ তিনি প্রকাশ করে যেতে পারেননি। আজও তা অপ্রকাশিত!

১৯২৩ খ্রিস্টাব্দের ১ জুলাই পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার মঙ্গলকোট থানার পালিশ গ্রামে সাহিত্য ও সাংবাদিকতার কৃতিমান পুরুষ হাবীবুর রহমানের জন্ম। আর মৃত্যু ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ জুন ঢাকায়। জীবনকাল মাত্র ৫২ বছর! ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দে কালজয়ী সাহিত্যিক হাবীবুর রহমানের জন্মের শতবর্ষ হবে! পেশায় তিনি ছিলেন সাংবাদিক ও শিক্ষক। পড়াশোনা করেছিলেন কলিকাতার স্বনামখ্যাত হেয়ার স্কুল এবং প্রেসিডেন্সি কলেজে। ছাত্র জীবনে অত্যন্ত মেধাবী ছেলেটিকে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা ও ছড়া লেখালেখিতে উদ্বুদ্ধ করে। কবিগুরুর লেখা আবৃত্তি করে বেড়ান। ষষ্ঠ শ্রেণিতে লিখে ফেলেন একটি কবিতা। স্কুল ম্যাগাজিনে ছাপা হয় বঙ্গমাতা নামের সেই কবিতাটি। ছাপার অক্ষরে নিজের নাম ও কবিতা দেখে আনন্দের আতিশয্যে সেদিন কিশোর হাবীব প্রায় কেঁদেই ফেলে! তারপর থেকে চলতে থাকলো লেখালেখি। টাকা পয়সার অভাবে বৃত্তির অর্থ দিয়ে পড়াশোনা করতে হয় তাকে। মেট্রিক পাশ করেন। আর্থিক দৈন্যতার জন্য ইন্টারমেডিয়েট পরীক্ষা দেয়া হয়নি তার। উপার্জনে নেমে পড়ে ছেলেটি। বাধ্য হয়ে নলতায় কয়লার খনিতে অমানুষিক খাটুনি এবং শিয়ালদহ ও হাওড়া রেল স্টেশনে কুলির কাজ করতে হয় তাকে। তারপর স্বল্প বেতনে জাগরণ নামের একটি পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত হন তিনি। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে দেশ বিভাগের পর চলে আসেন ঢাকায়। চাকরি নেন দৈনিক আজাদ পত্রিকায়। সাংবাদিকতার পাশাপাশি এখানে তিনি শিশু কিশোর বিভাগ মুকুলের মাহফিল পরিচালনা করেন বাগবান ভাই নামে। বেশিদিন থাকলেন না তিনি আজাদে, চলে এলেন দৈনিক সংবাদ এ, সাংবাদিকতায়। অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে ভাইয়া নামে সাপ্তাহিক শিশু কিশোর পাতা খেলাঘর প্রতিষ্ঠা করলেন হাবীবুর রহমান।

কুড়ি বছর বয়স থেকে শুরু হয় তাঁর সক্রিয়ভাবে লেখালেখি। শেষ মৃত্যু অবধি। পঞ্চাশ-ষাটের দশকে তিনি বিপুল খ্যাতি পান শিশু সাহিত্যিক হিসেবে। কলিকাতা থেকে প্রকাশিত ‘শিশু সওগাত’ পত্রিকায় হাবীবুর রহমানের পরিচয় ছিলো দাদুভাই নামে। তাঁর হাতে গড়া খেলাঘর আসর দেশের অন্যতম প্রধান শিশু সংগঠন। দৈনিক সংবাদ পত্রিকার শিশু কিশোরদের উপযোগী সাহিত্য পাতা খেলাঘর প্রকাশ হয় পঞ্চাশের দশকের শুরুতে। খেলাঘর পাতার প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ছিলেন ভাইয়া হাবীবুর রহমান। এ পাতার মাধ্যমে প্রগতিশীল এক ঝাঁক তরুণ লেখকের সমাবেশ ঘটে। পরে তা খেলাঘর সংগঠনে রূপ দেন ভাইয়া হাবীবুর রহমান। খেলাঘর পাতায় তাঁর মাধ্যমে সেসব লেখকের হাতেখড়ি তারা অধিকাংশই পরে দেশের নামকরা লেখক হয়েছেন।

শিশু সাহিত্যে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন হাবীবুর রহমান। তাঁর স্মৃতি রক্ষার্থে সাহিত্যের নানা শাখায় দেয়া হয় কবি হাবীবুর রহমান সাহিত্য পুরস্কার। বেশ দিলখোলা স্বভাবের মানুষ ছিলেন হাবীবুর রহমান। গল্প, ছড়া, কবিতা, বিদেশি সাহিত্যের অনুবাদ, প্রবন্ধ এবং নাটক; তাঁর ২২ বছর সময়কালের সাহিত্য জীবনের নিরলস সৃষ্টিতে দেশের সাহিত্যও সমৃদ্ধ। নাটকের ভঙ্গিতে কথা বলতেন তিনি। ছেলেবেলার রেডিওতে শোনা ‘সকাল’ শিরোনামে ভাইয়ার একটি ছড়া মনে পড়ছে -
‘কাঁচা কাঁচা রোদ মাখা সকাল বেলা
আকাশে ভাসলো আজ আলোর ভেলা
গাছে গাছে চিক চিক
আলো হাসে ফিক ফিক
চালে চালে ঝিকিমিকি এ কোন খেলা
কাঁচা কাঁচা রোদ মাখা সকাল বেলা।’
সুঠাম দেহ এবং অসীম সাহসের অধিকারী হাবীবুর রহমান। এর প্রমাণ মেলে কিশোর বয়সে লেখা ছড়ায়। অপ্রকাশিত ছড়াটি হলো -
‘লোকটা শুধু করতো বড়াই
দেখে নিতাম লাগলে লড়াই
উই ডিবিতে মারতো ঘুষি
চোখ পাকিয়ে জোরসে ঠুসি।’
শিশু মন রাঙানো সাহিত্যিক হাবীবুর রহমানের পরিচয় পাওয়া যায় নানা গল্পেও। দামাল ছেলেরা সন্ধ্যা হলেই মাঠ প্রান্তর, বন বাদাড় হয়ে ঘরে ফেরে। দস্যিপনার পর পড়ায় মন বসে না। ঘুম এসে যায় চোখে। ঘুম তাড়ানোর গল্প তাঁর অনাবদ্য সৃষ্টি। শিশু বাবলুকে গল্পে দেখতে পাই দুষ্ট বালক রূপে। সন্ধ্যায় পড়তে বসে ঘুমে আচ্ছন্ন থাকে বাবলু। এ জন্য মা ও বোনের বকুনি খেতে হয় তাকে। বেশ বিরক্তিকর! রোজ রোজ বকুনি আর ভালো লাগে না। চোখ থেকে কীভাবে ঘুম তাড়ানো যায়? সমস্যা নিরাময়ে ক্লাশের ফাস্ট বয় লাভলুর দ্বারস্থ হয় সে। দুষ্টু লাভলু এমনই বুদ্ধি দেয় বাবলুকে যে সে চোখ হারতে বসে। লাভলু বলে ‘ঘুম আসার আগে দু’ চোখে লেবুর রস লাগিয়ে দিবি।’ মেধাবী লাভলুর পরামর্শতো ফেলে দেয়া যায় না? যে কথা সেই কাজ। সূর্য ডোবার আগে বাসায় ফিরে বাবলু। সন্ধ্যায় সে রান্না ঘর থেকে আনে লেবুর রস। আঙ্গুল দিয়ে চোখে মেখে দেয়। ঘুম একবারেই চলে যায় তার! ছটফট করছে বাবলু। জ্বলে যাচ্ছে প্রদাহে চোখ! বাবলুর চিৎকারে ঘর একাকার। তাকে নিয়ে হুলুস্থ’ল। মা ও বোন এগিয়ে আসে। তারা জানতে পারে ঘুম তাড়ানোর রহস্য। মায়ের আশঙ্কা বাবলু না দৃষ্টি হারায়! কবিগুরুর ছোট গল্পের সংজ্ঞা অনুযায়ী হাবীবুর রহমানের ঘুম তাড়ানোর গল্পের সমাপ্তি ঘটে নাটকীয়তার মধ্য দিয়ে।
বাংলা শিশু সাহিত্যে পঞ্চাশ-ষাটের দশকে প্রতাপের সঙ্গে ঝঙ্কার দেয়া কবি ও সাহিত্যিক হাবীবুর রহমান এখন বিস্মৃত একটি নাম। তরুণ লেখক অনেকেই তাঁর নাম জানেন না। প্রবীণরাও তাঁকে ভুলে গেছেন। ছেলেবেলায় যাঁর সাহিত্য দিয়ে আমার লেখক হবার স্বপ্ন সূচিত হয়েছিলো নমস্য ও বরেণ্য সেই সাহিত্যিককে প্রাণভরে শ্রদ্ধা জানাই। সঙ্গে মেজদিকেও, যে ভাইয়াকে তিনি প্রথম পরিচয় করিয়েছিলেন রেডিও’র অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। জন্মদিনের শুভক্ষণে ভাইয়া প্রত্যাশা করি, আপনার সৃষ্টি আরও প্রকাশ হোক। ছড়িয়ে যাক অগণিত পাঠকের হৃদয়ে।

লেখক: গল্পকার, কবি, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক

বিডি প্রতিদিন/ফারজানা

সর্বশেষ খবর