১ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ১৪:৫৩
১ম পর্ব

বনবিহারী

আলম শাইন

বনবিহারী

দ্বীপ বনে তখনো ফর্সা আঁধার। শান্ত বনপ্রান্তর। মন্থর গতিতে ভোরের নির্মল হাওয়া বইছে। শুভ্রকোমল শীতল হাওয়ার স্পর্শে পিয়ালপাতা ঝিরঝির করে নড়ছে। বেগ সামলাতে না পারা শুকনোপাতা গোত্তাখেয়ে ধীর গতিতে ভূতল স্পর্শ করছে। কোলাহল বেড়ে গেলেই ঝরাপাতাগুলো পদপৃষ্ট হয়ে চানাচুর ভাজার মতো মচমচ করে চুরমার হয়ে যাবে। তারি সঙ্গে ইতি টানবে একটি ক্ষণের, একটি অধ্যায়ের, একটি জীবনচক্রের। যে চক্রে গাঁথা বিশ্ববহ্মাণ্ড; প্রাণীজগৎও। প্রকৃতির রহস্য তো এখানেই; জীবনচক্র নিয়ে খেলা করা। যে খেলায় উন্মাদনা নেই, নেই আনন্দ, নেই জেতার প্রতিযোগিতাও, আছে ভারসাম্য বজায় রাখার কৌশল, প্রজন্ম নিশ্চিত করা, পরবর্তীকে সুযোগ দেওয়া। অকাতরে বিলিয়ে দিয়ে স্বস্তি অর্জন করাই প্রকৃতির সার্থকতা। এটাই প্রকৃতির খেলার মূলরহস্য। যে রহস্যভেদ করতে হলে প্রয়োজন অন্তর্দৃষ্টির। অন্তর্দৃষ্টির শূন্যতা থাকলে প্রকৃতি ধরা দেয় খটখটে মরুভূমি, কঠিন শৈলশীলা, জীবন্ত আগ্নেয়গিরি কিংবা মহাসাগরীয় সুনামি রূপে। ফুলের গন্ধ, পাখির কলতান, কচুপাতার জল, রোদেপোড়া লতাগুল্ম, অন্তর্দৃষ্টি সজাগ না থাকলে উপলব্ধি করা বড়ই কঠিন।

অন্তরদৃষ্টি সজাগ রাখতে হলে খুব বেশি জ্ঞানী হওয়ার প্রয়োজন নেই; নিস্প্রয়োজন কাগুজে সনদেরও। শুধু প্রয়োজন একটি প্রশস্ত মন। সেই মনের খেলায় অংশগ্রহণ করতে পারলেই নিশ্চিত জয়ী হওয়া যায়। আমি জয়ী হয়েছি; আমার মন সায় দিচ্ছে। না হলে শহরের দরদালান ফেলে এই ভরা জঙ্গলে বছরের পর বছর কাটিয়ে দেওয়ার মানেই বা কি! কোন যুক্তিতে, কীসের নেশায়, কীসের মোহে বন-বাদাড়ে পড়ে থাকা! যে বনে বিষধর সাপের আনাগোনা, বুনো কুকুর, খেপাটে মহিষ, আর শেয়ালের পদচারণায় তটস্থ থাকে বনকর্মীরা, সে জঙ্গলে কেনই বা পড়ে থাকা? তা-ও এক-দুইদিন নয়; এক-দুইমাস নয়; এক-দুই বছর নয়; পাঁচ পাঁচটি বছর কেটেছে দেখতে দেখতে। হয়তো আমৃত্যু কেটে যাবে দ্বীপ বনের ভোররহস্য উপলব্ধি করে আর মধ্যাহ্নের ঝাঁঝালো রোদের কড়কড়ে গন্ধ নাকে টেনে।

আমি উপভোগ করি নিভে যাওয়া সূর্যের শীতল রশ্মির কোমল স্পর্শও। তাই তো আমি অস্তমিত সূর্যের তাম্রাভরশ্মির জাদুটানে ছুটে যাই দ্বীপ বনের সমুদ্র সৈকতে। সমুদ্রসৈকত আমার বাংলোর সন্নিকটেই; মাঝেমধ্যে যাতায়াত সেই সুবাদেই। পূর্ণিমা রাতে তো সৈকতে যাওয়া চাই-ই চাই, এ যেন সমুদ্রের সঙ্গে এক অলিখিত চুক্তি, এক বন্ধনের বহিঃপ্রকাশ। পূর্ণিমা রাতে সমুদ্রের ওপর ভেসে থাকা চন্দ্রের রূপালী জ্যোতির ঝলকে বিভোর হয়ে পড়ি। আরও বিভোর হই দূর সাগর থেকে ধেয়ে আসা ক্ষিপ্রগতির ঊর্মিমালার সঙ্গে একাকার হয়ে যাওয়া চন্দ্রজ্যোতির ছলকে। সেই অধরা জোৎস্নাস্নানে সিক্ত হতে কড়কড়ে ঝুরঝুরে বালুকাবেলার ওপর বসে শূন্যে তাকিয়ে থাকি মোহগ্রস্থের মতো। মাথার ওপর চন্দ্রের আবির্ভাব না ঘটা পর্যন্ত বসে থাকি নির্জন রহস্যময় সৈকতের বালুকাবেলায়। অতঃপর প্রশান্তির ঢেঁকুর তুলতে তুলতে এক সময় ফিরে আসি নিজ গন্তব্যে, নিজ আলয়ে। ফিরতে ফিরতে গভীর রাত। দ্বীপ বন তখন নীরব, নিস্তব্ধ ভয়ঙ্কর রূপকথার একরাজ্য। জঙ্গল মাড়িয়ে বাংলোয় ফেরার পথে শুনতে পাই শেয়ালের হাঁকডাক, বুনো কুকুরের আর্তচিৎকার আর মহিষের ভয়ঙ্কর গোঙানি। শঙ্কিত হই তখন, এ বুঝি প্রাণ গেল! তবে যে রাতে সৈকতচারি হই সঙ্গী হিসেবে নিয়ে যাই মহব্বত দয়ালকে, এই যা ভরসা।

দ্বীপ বনের সৈকতে একাকী কাটানো কঠিনতর, এদিকে পর্যটকের আনাগোনা কদাচিৎ, নির্জনতায় শঙ্কিত হই বেশি। আগ্রহী থাকায় মহব্বত দয়ালকে আমার সঙ্গী হিসেবে বেছে নিয়েছি শুরু থেকেই। প্রতি পূর্ণিমার তিথিতে আমাকে সঙ্গ দেয় মহব্বত দয়াল। তার সাথে থাকে আমাদের প্ল্যান্টের দোনালা বন্দুকটিও। বনবাদাড়ে বন্দুক ছাড়া চলাফেরা বোকামির সামিল। কোম্পানির দেওয়া বন্দুকগুলো আমাদের বড় ভরসা।

মহব্বত দয়াল ‘তাসিয়া’ গ্রুপের পার্মানেন্ট স্টাফ; বাবুর্চি কাম প্রহরী। বয়স পঞ্চাশের কোঠায়। গায়ের রঙ তামাটে। যৌবনে ফর্সাই ছিলেন, পড়ন্তবেলার চেহারায় তাকালেই তা উপলব্ধি করা যায়। মুখের চামড়া এখনো টানটান, ভাঁজ পড়েনি একটুও। চলনে-বলনেও ফিটফাট। জন্মস্থান উওরবঙ্গে। সরল প্রকৃতির মানুষ, ভেতরে তেমন প্যাঁচগোচ নেই। চিরকুমার। প্ল্যান্টে অনেক বছর ধরেই আছেন, প্রায় পনের বছর তো হবেই। পুরানো স্টাফদের একজন সে। পাকা বাবুর্চি, যা-ই রাঁধেন তাই-ই অমৃত; এমনকি পঁচামাছও। কোম্পানির লোকজনের কাছে তার রান্নাবান্নার খুব কদর, খুব সুনাম। তার হাতের রান্না খেয়ে বিভোর না হয়েছেন এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। শুধু ট্রি প্ল্যান্টের লোকজনই নয়, কোম্পানির এমডি সাহেবও তুষ্ট হয়েছেন এককাপ চায়ের বিনিময়ে।

এমডি সাহেব রোমানিয়ান। নাম কার্ফেথিয়ান আরবান। বয়স ষাট পেরুলেও এখনো সুদর্শন। গায়ের রঙ ধবধবে ফর্সা। চিপচিপে দীর্ঘায়ত গড়ন, লম্বাটে মুখমণ্ডল। গালে দাঁড়ি নেই, থুতনিতে ফ্রেঞ্চকাট। তাতে মানিয়েছেও বেশ। চেহারায় বাড়তি আভিজাত্য ফুটিয়েছে একগুচ্ছ উজ্জ্বল তামাটে দাঁড়ি।

বছর পনের আগে এমডি সাহেব ট্রি প্ল্যান্ট উদ্বোধনের সময় দ্বীপ বনে এসেছিলেন দুইজন সফরসঙ্গী নিয়ে। ভীষণ মুগ্ধ হয়েছেন দ্বীপ বনের শাল-পিয়ালের সান্নিধ্য লাভে। সেই যে আসা, তার পর আজ অবধি এমডি সাহেব এখানে আর আসেননি। ঢাকা হেড অফিসের দুই-একজন পদস্থ বাঙালি অফিসারের যাতায়াত ছিল আগে, এখন খুব একটা আসেন না তারাও। এলেও রাত্রিযাপন করেন না। ফলে সমস্ত ট্রি প্ল্যান্টের দায়-দায়িত্ব আমার ওপরেই বর্তায়। আমিই এখন দেখাশুনা করছি সব। জন চল্লিশেক শ্রমিক আর কোম্পানির ১৮ জন পার্মানেন্ট স্টাফ নিয়ে আমাকে তদারকি করতে হচ্ছে দ্বীপ বনের ট্রি প্ল্যান্ট। উল্লেখ্য, আমিসহ প্ল্যান্টের মোট ১৯ জন পার্মানেন্ট স্টাফ অফিসের কাজকর্ম করছি, আর শ্রমিকদ্বারা বনায়ন, গাছের পরিচর্যা, ভেষজ কাঁচামাল সংগ্রহ ও মজুদকরা, এই সব কাজ করানো হচ্ছে। হাতির মাহুত আছে একজন, সে পার্মানেন্ট স্টাফ না হলেও চাকরির গ্যারান্টি আছে তার।

প্ল্যান্টের আগের ম্যানেজার ছিলেন সালেহ দেওয়ান। ভদ্রলোকের অপমৃত্যু হয়েছে বুনো কুকুরের আক্রমণে। সেই নির্মম ঘটনার বছর খানেক পরে আমি যোগ দিয়েছিলাম ‘তাসিয়া’ গ্রুপের এই প্রতিষ্ঠানটিতে।

রোমানিয়ার ‘তাসিয়া’ গ্রুপের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান ‘ব্যাকেড’ একটি আন্তর্জাতিক ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান। শুধুমাত্র ভেষজ ওষুধই প্রস্তুত করে ব্যাকেড। নিজেরা ওষুধ প্রস্তুতের পাশাপাশি কাঁচামালও সরবরাহ করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। ভেষজ ওষুধের কাঁচামালের ব্যাপক চাহিদা ইউরোপের একাংশ জুড়ে। অপরদিকে বাংলাদেশ-ভারতের মাটি ভেষজ উৎপাদনে শীর্ষস্থানে রয়েছে। দু’টি বিষয়কেই কাজে লাগিয়েছে কোম্পানি; ওষুধ প্রস্তুত আর কাঁচামাল সরবরাহ। উপযুক্ত পরিবেশের কারণে এই দ্বীপ বনেই গড়েছে কাঁচামালের একটি প্ল্যান্ট।

দ্বীপ বনের আয়তন প্রায় ৯২ বর্গ কিলোমিটার অর্থাৎ প্রায় ৩৬৯৭০ হেক্টর এলাকা জুড়ে বনের বিস্তৃতি। দ্বীপের সরকারি নাম ‘নিঝুম দ্বীপ’ হলেও কোম্পানির কাগজপত্রে লেখা ‘দ্বীপ বন’। তাসিয়া গ্রুপ বিশাল আয়তনের দ্বীপের এক-চতুর্থাংশ লিজ নিয়েছে সরকার থেকে বনায়ন গড়তে। দীর্ঘ মেয়াদি লিজ।

দ্বীপের বয়স পাঁচ যুগের বেশি হলেও স্থানীয়দের কাছে এটি এখনো ‘নয়াচর’ হিসেবে পরিচিত। আসলে এটি হচ্ছে নিঝুম দ্বীপের অভ্যন্তরে জেগে ওঠা আরেকটি দ্বীপ। অর্থাৎ দ্বীপের ভেতর দ্বীপ। দ্বীপ বনের চারপাশে সরুনদী বেষ্টিত, পাঁচ যুগ আগেও এখানে জঙ্গল, গাছ-গাছালি ছিল। যেটি এখন ভেষজ ওষুধের প্ল্যান্ট। দ্বীপের গড়ন বড়ই বৈচিত্র্যময়। অন্যসব দ্বীপের চেয়ে এই দ্বীপের গড়নেও বিস্তর তফাৎ। মোট ৪টি দ্বীপের সমন্বয়ে দ্বীপপুঞ্জ। ফলে প্রতিটি দ্বীপই আলাদা একেকটি দ্বীপ। ঠিক তেমনি একটি দ্বীপ বিশ্বখ্যাত তাসিয়া গ্রুপ লিজ নিয়েছে ভেষজ ট্রি প্ল্যান্ট গড়তে। যে প্ল্যান্টে আমি বছর পাঁচেক কাটিয়ে দিয়েছি যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ীবাসের লোভ বিসর্জন দিয়েও। চাকরি-বাকরির টানে নয়, বনের টানে, মনের টানে মোহগ্রস্থ হয়ে বনবাসি হয়েছি। তাতে নানান অভিজ্ঞতাও সঞ্চয় করেছি, কাছ থেকে দেখেছি অনেক রোমহর্ষক ঘটনা। নিজ চোখে দেখা বনপ্রকৃতির সেসব ঘটনার খণ্ডচিত্র পর্যায়ক্রমে তুলে ধরব আমি। এখন ফিরে যাচ্ছি অন্য আলোচনায়।

দ্বীপপুঞ্জের সবচেয়ে বড় আয়তনের একটি দ্বীপে বেশ কিছু লোকজনের বসতি রয়েছে, তন্মধ্যে জেলে সম্প্রদায়ের বসতি অধিক। এলাকাটা ঘনবসতি নয়, একেকটি বাড়ি থেকে আরেকটি বাড়ির দূরত্বও অনেক। বেশ কিছু জমিজমা নিয়ে তাদের বসতি। সরকার থেকে বন্দোবস্ত নিয়েই বসতি গড়েছেন তারা। সরকার উৎসাহিত করছে দ্বীপে লোকসমাগম ঘটাতে। তাদের জন্য সাইক্লোন সেন্টার, প্রাথমিক চিকিৎসা, মাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষার ব্যবস্থাও করেছে সরকার। তার ওপরে দুই-একটা এনজিও কাজ করছে চিকিৎসা ও শিক্ষা নিয়ে, কিন্তু তাদের স্টাফরা বেশিদিন এখানে না থাকার কারণে সেই কার্যক্রমে মাঝেমধ্যে ভাটা পড়ে।

বাইরের লোকজন দ্বীপে এসে বসবাস না করার প্রধান কারণই হচ্ছে, বিদ্যুৎ এবং মোবাইল টাওয়ারের সংকট। এছাড়াও দ্বীপে বাসস্থানের বড়ই সমস্যা। যে সমস্যার কারণে পর্যটকদের সমাগম হলেও রাত্রিযাপনের সংকটে দিনশেষে উপজেলা সদরে চলে যেতে উদগ্রীব হয়ে পড়েন।

দ্বীপ পুঞ্জের চারটি দ্বীপের মধ্যে একটিতেই শুধু জনপদ গড়ে উঠেছে। আর একটিতে গড়ে উঠেছে আমাদের ভেষজ প্ল্যান্ট। অর্থাৎ দ্বীপ বন। দ্বীপ বনে আগেও বনজঙ্গল ছিল। কোম্পানি লিজ নেওয়ার পর নতুন বনায়ন করা হলেও পুরাতন গাছপালা কাটা হয়নি। আর বাকি দুটি দ্বীপ বিস্তৃর্ণ বনভূমি। জনপদ গড়ে ওঠা দ্বীপ থেকে আমাদের দ্বীপ বনের দূরত্ব ১০ কিলোমিটারেরও বেশি। দুর্গম বন জঙ্গল মাড়িয়ে যাতায়াত করতে হয়। বেশ কঠিনতর সেই যাতায়াত ব্যবস্থা। এই জন্য এদিকে পর্যটকের সমাগম নেই বললেই চলে, মাঝেমধ্যে কেউ কেউ সমুদ্র সৈকতে আসেন ট্রলারযোগে; নদীপথে। দ্বীপ বনে যাতায়াতের জন্য নদীপথেও ব্যবস্থা রয়েছে। সে ক্ষেত্রে একটা সমস্যাও আছে অবশ্য। সেটি হচ্ছে জোয়ার-ভাটার খেলা। সময়ের হেরফের হলে নৌকার তলদেশে নদীর মাটি স্পর্শ করে। সে আরেক যন্ত্রণা! তার পরেও নিরাপদ বেশ খানিকটা।

আরেকটি কথা পরিষ্কার করছি, বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষেই দ্বীপ বনের অবস্থান। দ্বীপ বন শুধু সাগর কোলেই নয়, নদীর কোলেও আশ্রিত। এখানকার সৈকত তেমন দীর্ঘ নয়, তবে পরিচ্ছন্ন। পর্যটকদের যাতায়াত তেমন একটা না থাকায় সাগর কলমির দখলে থাকে সৈকতটি।

বঙ্গোপসাগরের কোলঘেঁষা দ্বীপের তিন দিকে সাগর অন্যদিকে উত্তাল মেঘনার মোহনা। এটি দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ অরণ্য। সুন্দরবনের পরেই আয়তনে দ্বীপপুঞ্জের অবস্থান। এখানে অসংখ্য চিতা হরিণ ও বানরের বাস রয়েছে। এ ছাড়াও রয়েছে খেপাটে মহিষ, বুনো কুকুর, বুনো শুকর, শেয়াল, সাপসহ বহু প্রজাতির জন্তু জানোয়ার। আরও রয়েছে ৩৫ প্রজাতির পাখ-পাখালি, ৪৩ প্রজাতির লতাগুল্ম এবং ২১ প্রজাতির অন্যান্য গাছ-গাছালি। তার মধ্যে কেওড়া গাছই অধিকাংশ বন দখল করে আছে। স্থানীয় লোকজনের কাছে এটি ‘কেরপা’ গাছ নামে পরিচিত। কেওড়া গাছের পরেই আছে গেওয়া, গরান, বাইন, পশুর, নোনা ঝাউগাছ ইত্যাদি। তবে আমাদের প্ল্যান্টে এসব গাছ খুব একটা নেই। প্ল্যান্টের অধিকাংশ গাছ এবং উদ্ভিদগুলো হচ্ছে ভেষজ প্রজাতির। এ ছাড়াও ফলজ গাছের অভাব নেই। দ্বীপের বিশেষ আকর্ষণ উভচর প্রজাতির মাছ। মাছের নাম ‘মারসৃপারি’, এরা জলে এবং স্থলে সমানভাবে বিচরণ করতে পারে। এদের দেখতে কিছুটা বেলে মাছের মতো। খেতেও সুস্বাদু। বিশেষ করে মহব্বত দয়ালের হাতে রান্নার দায়িত্ব পড়লেই তো কথাই নেই, জিভে সপ্তাহ অবধি স্বাদ লেগে থাকবে।
প্ল্যান্ট উদ্বোধনকালীন এমডি সাহেব একরাত কাটিয়েছেন দ্বীপ বনের বাংলোতে। নিজের খাবারদাবার সঙ্গেই এনেছেন; বাদ যায়নি জল আর হুইস্কির বোতলও। অনেক পীড়াপীড়ির পর তিনি শুধু শেষ বিকেলে এককাপ চা খেয়েছিলেন। তাও খেতেন না, সৈকতে হাঁটাহাঁটি করে ক্লান্ত হয়ে যখন বাংলোয় ফিরেছেন তখন কাপটা মুখে লাগিয়েছেন সবার অনুরোধে। আর এই এককাপ চায়ের স্বাদেই তিনি বুঁদ হয়ে পড়েন নেশাগ্রস্থের মতো। তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলতে তুলতে এমডি সাহেব ঢাকায় ফেরেন। যাওয়ার সময় মহব্বত দয়ালকে সঙ্গে নিয়ে যান। শেরাটন হোটেলে নিজের পাশের কামরায় যত্নসহকারে থাকার ব্যবস্থা করেন। সেখানে অবস্থান করেও তিনি মহব্বত দয়ালের হাতে বানানো চা খেতেন। এভাবে মহব্বত দয়ালের চায়ের নেশায় আকৃষ্ট হয়ে অবশেষে সফরসঙ্গী করে রোমানিয়া নিয়ে যায় তাকে।

মহব্বত দয়াল রোমানিয়ায় ক’দিন ভালোভাবেই কাটিয়েছিলেন। এমডি সাহেব রাজধানী বুখারেস্টের বিভিন্নস্থানে ঘুরিয়ে-টুরিয়ে দেখিয়েছেনও। এ ছাড়াও তিনি যেদিকে যেতেন সঙ্গে নিয়ে যেতেন তাকেও। কিন্তু মাস খানেক কেটে যেতেই মহব্বত দয়ালের মানসিক পরিবর্তন ঘটে। দেশে ফিরে আসতে ছটপট করতে থাকেন। ঘুমের ঘোরেই হু হু করে কেঁদে উঠেন। দ্বীপ বনের জন্যে তার বড়ই মায়া। রাতে স্বপ্নযোগে দ্বীপ বনের চিতা হরিণ আর গাছ-গাছালির সঙ্গে কথা বলতেন মহব্বত দয়াল। আবার স্বপ্নযোগে রান্নাবান্নার কাজও করতেন। ঘুম ভেঙ্গে গেলে কেবলই ছটফট আর ছটফট, শেষ পর্যন্ত আর রাতে ঘুমাতে পারতেন না, ভোর অবধি বিছানায় গড়াগড়ি খেতেন মহব্বত দয়াল। স্বদেশ ত্যাগের যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে পরিশেষে এমডি সাহেবকে বলেকয়ে মহব্বত দয়াল রোমানিয়া ত্যাগ করে সোজা দ্বীপ বনে হাজির হয়েছেন একদিন। এমডি সাহেব তাকে প্রথমে ছাড়তে রাজি হননি, রোমানিয়ায় স্থায়ী হতে পরামর্শ দিয়েছেন। তাসিয়া গ্রুপের বুখারেস্ট শাখায় যোগ দিতে বলেছেন। কাজ হয়নি, দ্বীপ বনেই বাকি জীবন পার করে দিতে ইচ্ছুক ছিল সে। যদিও তার বয়স তখন ছিল পঁয়ত্রিশ সর্বোচ্চ। বিয়েশাদিও করেননি। সংসারে তেমন কেউ নেই। বাবা জীবিত থাকলেও মা বেঁচে নেই। তার এস.এস.সি পরীক্ষা চলাকালীন সময় মা চলে গেছেন দুনিয়া ছেড়ে। সেই হিসেবে তেমন একটা পিছুটান ছিল না তার, ইচ্ছে করলেই রোমানিয়ায় থেকে যেতে পারতেন। তথাপিও দেশের টানে, মাটির টানে ফিরে এসে স্বপদে যোগ দিয়েছেন মহব্বত দয়াল।

আগেই বলেছি, প্রকৃতির লীলাভূমি হলেও এক ভয়ঙ্কর দ্বীপ বনে বাস করছি আমি। যেখানে বাঘের বাস না থাকলেও সাপ, শেয়াল, বুনো শুকর, খেপাটে মহিষ আর বুনো কুকুরের ভীষণ উপদ্রব। বছর ছয়েক আগে ট্রি প্ল্যান্টের সাবেক ম্যানেজার সালেহ দেওয়ান বুনো কুকুরের আক্রমণে প্রাণ হারিয়েছেন। প্ল্যান্টের অদূরেই ঘটনাটি ঘটেছিল। শুনেছিলাম, একদিন বিকেলে তিনি হাঁটতে বেরিয়েছিলেন একাকী, এমনকি অস্ত্রশস্ত্রও সঙ্গে নেননি। জঙ্গলের জাদুকরীমোহে আকৃষ্ট হয়ে কেবলই হাঁটছেন আর হাঁটছেন। ভুলে গেছেন তিনি একাকী এবং নিরস্ত্র। হাঁটতে হাঁটতে প্ল্যান্টের গভীরে চলে গেছেন তিনি, যেখানে ঘন গাছ-গাছালি আর গুল্মলতায় ঠাসা। তিনি পায়চারি করছেন ত করছেনই, ভুলে গেছেন জঙ্গলের হিংস্রতার কথাও। তার আগমন টের পেয়েছে একদল বুনো কুকুর। শিকারের উপস্থিতিতে ক্ষুধার্ত বুনো কুকুরগুলো আরও হিংস্র হয়ে ওঠল। তাকে ঘিরে ধরল মুহূর্তেই। তিনি কিছু বুঝে ওঠার আগেই বুনো কুকুরগুলো তাকে আক্রমণ করতে উদ্যত হল। উপায়ন্তর না দেখে তিনি গাছে ওঠতে চেষ্টা করলেন প্রথমে। কিন্তু বনের অধিকাংশ গাছ-গাছালি মোটাসোটা হওয়ায় সেই চেষ্টায় ব্যর্থ হয়েছেন। পরক্ষণে তিনি হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে দৌড়াতে লাগলেন। কিন্তু কতক্ষণ দৌড়াবেন, শ্বাসমূল আর ঘন জঙ্গলে আবৃত বনবাদাড়ে! জঙ্গলের লতাগুল্মের সঙ্গে পা আটকে যাচ্ছে বারবার। তার পরেও তিনি প্রাণপণে চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন বাঁচতে। কিন্তু লড়াইতে হেরে গেলেন, আর টিকতে পারেননি, পড়ে গেলেন ধপাস করে জঙ্গলের মাটিতে। তার পর যা ঘটার তাই-ই ঘটল, বুনো কুকুরের পাল তার শরীরটা ক্ষতবিক্ষত করে ফেলল নিমেষেই।

রাত ৯টা নাগাদ ম্যানেজার সাহেবের খোঁজ পড়ল। তিনি বাংলোতে নাই, কোথায় গেছেন কেউ জানেন না, কাউকে জানিয়েও যাননি তিনি। তাহলে কোথায় আছেন! রটে গেল মুহূর্তেই। বিষয়টা ভাবিয়ে তুলেছে সবাইকে। কোথায় যেতে পারেন? ব্যতিব্যস্ত হয়ে সবাই খোঁজাখুঁজি আরম্ভ করলেন। এরিমধ্যে শ্রমিকদের একজন বললেন, ম্যানেজার সাহেবকে প্ল্যান্টের পশ্চিম দিকে যেতে দেখেছেন।

পরিশেষে সেই সূত্র ধরে তখন লোকজন বন্দুক আর টর্চ নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন তার খোঁজে। খুঁজতে খুঁজতে একমসয় পেয়ে গেল তার ছেঁড়া জামাকাপড়ের সন্ধান; আর সন্নিকটেই পেল ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মাংসমিশ্রিত রক্তমাখা হাড্ডি। তখন বিষয়টা বুঝতে কারও আর কিছুই বাকি রইল না। এই ঘটনাটি প্রায়ই শুনি প্ল্যান্টের লোকজনের কাছে। ঘটনা জানিয়ে সবাই সবাইকে সতর্ক করেন এখনো। তার মৃত্যুর বছর খানেক পর একই পদে অধিষ্ঠিত হয়েছি আমি। সে আরেক কাহিনি। যথাযথ সময়ে তা জানানো হবে। এখন অন্যকথা।

শুনি সাবেক ম্যানেজার সাহেবের আত্মা নাকি এখনো বনময় ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিন্তু আমার বিশ্বাস হয়নি, হরর কাহিনির মতো মনে হচ্ছে। তাই বিষয়টা পাত্তা দেইনি। আবার আমাদের বিশ্বস্ত দুইজন শ্রমিক ম্যানেজার সালেহ দেওয়ানকে নিজ চোখে দেখার দাবিও জানিয়েছেন। তারা নাকী দেখেছেন, ম্যানেজার সালেহ দেওয়ান দৌড়াচ্ছেন আর দৌড়াচ্ছেন বনপ্রান্তর কাঁপিয়ে, দ্বিকবিদ্বিক জ্ঞান হারিয়ে। এক সেকেন্ডের জন্যেও থামেনি, কারও ক্ষতিও করেননি।

ম্যানেজার সালেহ দেওয়ানের আত্মা স্বচোখে দেখার দাবি করা এমন একজন শ্রমিককে একদিন জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি আসলেই কি দেখেছ, একটু খুলে বলতো?’

আমার প্রশ্নে সে আতঙ্কিত হয়ে এমনভাবে দু’চোখ প্রসারিত করে তাকালো, মনে হচ্ছে যেন তার সামনে ভূতপ্রেত জাতীয় কিছু দণ্ডায়মান এখনো। তার পর এদিক সেদিক তাকিয়ে নিচু গলায় বলল, ‘সাদা কাপড় পরা একটা লোককে উত্তর দিকে দৌড়াতে দেখলাম।’

‘সাদা কাপড় পরে যে দৌড়াচ্ছিলেন, তাকে কি তুমি চিনতে পেরেছ?’ 
‘না।’
‘তাহলে কিভাবে বুঝলে ম্যানেজার সাহেব দৌড়াচ্ছিলেন!’
‘আমি তারে চিনি। তেনার মতোই লাগছে।’
‘ধুরবোকা। কী দেখেছ, কাকে দেখেছ, তার ঠিক ঠিকানা নেই, ম্যানেজারের আত্মা বলে এখন চালিয়ে দিচ্ছ। যাও, কাজে যাও, এসব কথা আর কাউকে বলবে না যেন।’ ওকে মৃদু ধমক দিয়ে সরিয়ে দিলাম।

কথাটা আমার কাছে তেমন গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি। তার পরেও ঘটনাটা দ্রুত রটে গেছে প্ল্যান্টের লোকজনের মাঝে। জানাজানি হওয়ার পর থেকেই দিনমজুরের সংখ্যা জনাপঞ্চাশেক থেকে চল্লিশে নেমে এসেছে। নতুন করে আর কেউ-ই কাজে যোগ দিচ্ছে না। বিস্তারিত জেনেশুনে কোম্পানি থেকে আরও দু’টি দো-নালা বন্দুক বরাদ্ধ দেওয়া হয়েছে পর্যন্ত, তাতেও সাহস জোগানো যায়নি কারও। আমার সাহস জোগাতে একটি রিভলবারও পাঠিয়েছে কোম্পানি থেকে এবং কড়া হুঁশিয়ারি দিয়েছে, রাত-বিরাতে যেন বাংলো ছেড়ে না বেরুই। জরুরি প্রয়োজনে বেরুলেও যেন প্ল্যান্টের পোষাহাতির পিঠে সওয়ার হই এবং সঙ্গে রিভলবার থাকা চাই। আদেশের নড়চড় হলে দায়ভার কোম্পানির নয়। কড়া চিঠি, কড়া আদেশ; অমান্য করে কার সাধ্য।

সত্যি কথা বলতে আমি অন্যায় করছি, সেই আদেশ কখনো মান্য করিনি, রিভলবারটা ছুঁয়েও দেখিনি কখনো, বরং বনপ্রান্তরে একাকী ঘুরে বেড়াই, তবে নিরাপদ এলাকা দিয়েই ঘুরি। ঘোরাফেরার সময় হাতে বড়জোর ফুট তিন-চারেক লম্বা একটা লাঠি রাখি; সাপখোপের ভয়ে। আর সৈকতচারি হলে মহব্বত দয়ালকে সঙ্গী করে নেই; সেক্ষেত্রে দোনালার প্রয়োজন পড়ে বৈকি। আর তদারকির কাজে বেরুলে অবশ্যই হাতির পিঠে সওয়ার হই।

চলবে...

বিডি প্রতিদিন/ফারজানা

সর্বশেষ খবর