১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ১৫:৫২
৩য় পর্ব

বনবিহারী

আলম শাইন

বনবিহারী

হাত ঘড়িটা বাংলোতে রেখে এসেছি, সঠিক সময় জানাতে পরছিনা তাই। তবে অনুমান করছি রাত ৮টার কাছাকাছি। আমি ওয়াচ টাওয়ারের উপরে একাকী দাঁড়িয়ে আছি। একটু নির্জনে কাটাতে ইচ্ছুক। জায়গাটাও নির্জন, নিরাপদও; তাই মাঝেমধ্যে টাওয়ারে চড়ে তাকিয়ে থাকি শূন্য আঁধারের দিকে। নিকষকালো আঁধারের মধ্যেও কী যেন খুঁজে বেড়াচ্ছি আমি। জানিনা কী খুঁজছি, কাকে খুঁজছি! তবে এটা উপলব্ধি করছি যে, আঁধারের সঙ্গেও মানুষের ভাববিনিময় আদানপ্রদান করা সম্ভব, যদি অন্তর্দৃষ্টি খোলাথাকে, তাহলে চোখের সামনে ভেসে ওঠে কালো আঁধারের কালোরূপ।

টাওয়ারে চড়ে তাকালাম চারদিকে, শুধু আঁধার আর আঁধার। দেখতে পেলাম বাংলোর বারান্দার দুইপ্রান্তে দুইটা হারিকেন ঝুলছে, আঁধারভেদ করে ক্ষীণ আলোকরশ্মি ছড়িয়ে পড়ছে আশপাশে। নজরে পড়ছে আলোর উৎসস্থল, তবে তত স্পষ্ট নয়। সৌরবিদ্যুতের ব্যবস্থা থাকলেও বিভিন্ন কারণে সার্ভিসটিতে ব্যাঘাত ঘটছে; পর্যাপ্ত চার্জ না হওয়ারও আরেকটি কারণ। তাতে হারিকেন বাতিই একমাত্র ভরসা। বনপ্রান্তরের উত্তর-দক্ষিণে ঘুটঘুটে আঁধার, নদীর ওপর সামান্য ফর্সা। নদীর কিনারে জোনাকিদের বিক্ষিপ্ত বিচরণে বনপ্রান্তরে আলোর ঝিলিক ছড়িয়ে পড়ল। জোনাকিবাতির নেভা আর জ্বলায় আশপাশ সামান্য ফর্সাও হয়ে এল। এদিকে আবার বনের ভেতর থেকে ভেসে আসছে একপাল শেয়ালের 'হুক্কাহুয়া' ধ্বনি; বুনো কুকুরগুলোও থেমে নেই, সমস্বরে ‘ঘেউ ঘেউ’ করে বনভূমি কাঁপাচ্ছে। তারিসঙ্গে ঝিঁঝি পোকার অনবরত ‘ঝিঁ..ঝিঁ..’ কণ্ঠের তীক্ষ্নসুর বনময় ধ্বনিত হয়ে ভৌতিক আবহের সৃষ্টি করছে। টাওয়ারের ওপর থেকেই শুনতে পাচ্ছি রাতজাগা প্রাণীদের সেই রহস্যময় চেঁচামেচি। আমি রাতের নীরব নিস্তব্ধতার মধ্যেই আকাশপানে তাকিয়ে নক্ষত্ররাজির গতিবিধি লক্ষ্য করছি। গতিবিধি লক্ষ্য করছি উল্কাপিণ্ডেরও। ছুটোছুটি করছে উল্কারা, তীরের গতিতে ছুটে যাচ্ছে কোথায় যেন, কিন্তু ফিরে আসতে দেখছি না আর। আমার কষ্ট হচ্ছে ভীষণ, তার কথা মনে পড়ছে, ঠিক এইভাবে তীরগতিতে একদিন তিনি আমাকে ছেড়ে তারকারাজ্যে ছুটে গিয়েছেন। যেখান থেকে তিনি আর কখনো খসে পড়বেন না মর্ত্যলোকে! আকাশ পরিষ্কার থাকলেই তার সাক্ষাতলাভের উদ্দেশ্যে আমি ছুটে আসি টাওয়ারের ওপরে। আমি হন্যে হয়ে গাছ-গাছালির ফাঁকফোকর দিয়ে উঁকিঝুঁকি মেরে তাকে খুঁজি। খুঁতে খুঁজতে এক সময় পেয়েও যাই তাকে, তিনি তখন আমার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসেন। মেয়েটার খবরাদি জানতে চান, আরও জানতে চান, ওষুধপত্র খেয়েছি কীনা। ইত্যাদি ইত্যাদি...।

উপরে দাঁড়িয়ে কত কী ভাবছি, ভাবনার শেষ নেই যেন আমার। হঠাৎ ভাবনায় বিঘ্ন ঘটালেন সহকারী ম্যানেজার সিকান্দার বারী। বিরক্ত হলাম খুব, যদিও মুখে তা প্রকাশ করিনি। সাধারণত টাওয়ারে চড়লে একাকী থাকতে পছন্দ করি আমি। এ সময় কারো উপস্থিতি আমার কাম্য নয়। তাই বিরক্তভরা কণ্ঠে জানতে চাইলাম, ‘কি খবর বারী সাহেব, কিছু বলবেন আমাকে?’

তিনি ইতস্ততঃ হলেন। সম্ভবত তিনি প্রস্তুত ছিলেন না কথাটা শোনার জন্য। এইভাবে জিজ্ঞেস করতে পারি এটা তিনি ভাবেননি। তিনি নিজকে সামলে নিয়ে বললেন, ‘বড়মিয়া, আমি একটা কথা বলতে এসেছি আপনাকে।’

‘ঠিক আছে বলেন শুনি।’ আমি খানিকটা আগ্রহ নিয়ে শুনতে চাইলাম। সিকান্দার বারী বললেন, ‘মনটা ভালো যাচ্ছে না আমার, খুব খারাপ লাগছে।’

আমি নড়েচড়ে দাঁড়ালাম। বিরক্তভাব কেটে গেছে আমার সঙ্গে সঙ্গে। তার মনোভাব জানতে উদগ্রীব হলাম এবার। বললাম, ‘বারী সাহেব, আপনার আপত্তি না থাকলে আমাকে খুলে বলতে পারেন সব।’

সিকান্দার বারী ক্ষীণকণ্ঠে বললেন, ‘গতরাতে স্বপ্ন দেখলাম মেয়েটা অসুস্থ। তাই ঠিক করলাম আগামীকাল সদর উপজেলায় গিয়ে মেয়েটার সঙ্গে ফোনে কথা বলে আবার ফিরে আসব। এই জন্য একদিন ছুটির প্রয়োজন। বিষয়টা আপনাকে জানাতে এলাম বড়মিয়া।’

তার কথা শুনে আমার মনটাও খারাপ হয়ে গেল। নিজের মেয়ের কথা মনে পড়ল হঠাৎ করেই; কতদিন দেখেনি মেয়েটাকে, কতদিন শুনিনি বাবাডাক। তবে বিষয়টা বুঝতে দেইনি তাকে। বরং হেসে হেসে বললাম, ‘স্বপ্ন ত স্বপ্নই, আর তা ছাড়া স্বপ্ন সবসময় সত্যি হয় না কিন্তু। তারপরেও পরিবার পরিজনের খোঁজখবর রাখা উচিত। আপনি উপজেলায় গিয়ে খোঁজ নিবেন কেন, বাড়ি চলে যান। দিন দশেক কাটিয়ে আসেন।’

সিকান্দার বারী আমার কাছে এতটা প্রত্যাশা করেননি। মাত্র মাস দুয়েক আগে ছুটি কাটিয়ে এসেছেন। বুঝতে পারলাম তিনি খুব খুশি হলেন। এতটাই খুশি হলেন যে, আমি আঁধারে তার মুখ না দেখলেও উপলব্ধি করলাম হাসির ঝলক উপচে পড়ছে।

ধন্যবাদ জানিয়ে টাওয়ার থেকে নেমে যাচ্ছেন তিনি। পেছন থেকে ডেকে বললাম, ‘মনে কিছু না নিলে আমার সামান্য উপহারটা নিয়ে যান, মেয়েকে কিছু কিনে দিবেন।’ কথাটা শেষ করে আমি তার হাতে কিছু টাকা গুজে দিলাম; মোটামুটি ভালো অংকের। তিনি এও প্রত্যাশা করেননি, যেমনি ছুটিও।

খুবভোরে  ট্রলারযোগে চলে যাবেন তিনি, নদীতে জোয়ার থাকে তখন। প্রথমে যাবেন উপজেলা সদর, সেখান থেকে লঞ্চে ঢাকা যাবেন আগে। ঢাকা থেকে নান্দাইল। সুতরাং তার সঙ্গে আর ভোরে দেখা হচ্ছে না। তাই বিদায় নিয়ে নিচে নামছেন তিনি। কয়েকটি সিঁড়ি ভেঙ্গেছেন মাত্র, অমনি পেছন থেকে ডেকে বললাম, ‘বারী সাহেব, মহব্বত দয়ালকে বলবেন আমার জন্য একটু আদা চা বানিয়ে ফ্ল্যাস্কে ভরে নিয়ে আসতে।’

ওয়াচ টাওয়ারটি অফিস সন্নিকটে, নদীঘেঁষা। শাল খুঁটি দিয়ে বানানো, বিদ্যুতের খাম্বার চেয়েও বেশি উচ্চতায়। কাঠের ঘুরানো মইবেয়ে উপরে ওঠতে হয়। উপরে কাঠের পাটাতন, কাঠের রেলিং, ছাউনি নেই, খোলামেলা। দুটি কারণে এটি বানিয়েছিলাম আমরা। প্রথমত হচ্ছে, প্ল্যান্টের ট্রলারের লোকজনকে রাত-বিরাতের প্রয়োজনে টর্চের মাধ্যমে সংকেত পাঠানোর জন্য। ট্রলারটি অপেক্ষাকৃত চওড়ানদীতে রাখা হয়। টাওয়ার সংলগ্ন নদীটি মৃতপ্রায়। জোয়ারে জল উপচে পড়লেও, ভাটায় থিকথিকে কাদাময় হয়ে যায়। সময়ের হিসেবকষে অফিস সংলগ্ন নদীটিতে ট্রলারের যাতায়াত করতে হয়। ফলে ট্রলারটাকে একটু দূরে আপেক্ষকৃত চওড়া নদীতে রাখতে হয়েছে। দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে, টাওয়ারে দাঁড়িয়ে নক্ষত্ররাজির সান্নিধ্য পাওয়ার চেষ্টা করি আমি, তাই ছাউনি দেইনি। দুটি বিষয়কে প্রধান্য দিয়েই ওয়াচ টাওয়ারটি আমার পরিকল্পনায় বানিয়েছিলাম।

এই সব উন্নয়নমূলক কিংবা বিনোদনমূলক কাজ করার জন্য কোম্পানির অনুমতির প্রয়োজন হয় না। এখানে অনেক কিছুই আমাদের সিদ্ধান্তেই হয়, সে ধরনের অনুমতি আগে থেকেই দেওয়া আছে। যে কোন কাজ করলে আমরা সবাই বসে আগে সিদ্ধান্ত নেই, তারপরে তা বাস্তবায়ন করি। আমি নিজে সিদ্ধান্ত দিলেও সবাই মেনে যায়। তারপরেও আমি ওইভাবে সিদ্ধান্ত দেইনি। কারও মনের ওপর জোর খাটাতে চাইনি কখনো, হৃদ্যতা নিয়েই বাঁচতে চাই। তা ছাড়া সবাই জানেন আমি নিজস্বার্থে কাজ করি না কখনো। আমি চাই বন-বনানী আজীবন টিকে থাকুন, বনের মাধ্যমে মানুষের উপার্জন হোক। যেমন আমরা প্ল্যান্টের সবাই বনভূমি থেকেই উপার্জন করছি। এখানে বেতনাদিও বেশ ভালো। বন-বাদাড়ে লোকবল ধরে রাখার কৌশল এটি। ভালো বেতনাদি না হলে কারই বা ঠেকা পড়েছে ভরা জঙ্গলে মাসের পর বছর কাটিয়ে দেওয়ার? ছুটিছাটাও সুবিধেজনক। সাপ্তাহিক ছুটি ছাড়াও বছরে দেড় মাস ছুটি। ছয় মাস অন্তর অন্তর ছুটি ভোগ করা যায়। সবাই ছুটি ভোগ করলেও আমি ভোগ করতে পারি না। আমি দ্বীপ বন ছেড়ে দূর কোথাও গিয়ে থাকতেই পারি না। এই বনপ্রান্তরই এখন আমার পরিবার পরিজন, এটাই আমার সন্তান, তাই বড়ই মায়া এই দ্বপী বনের জন্য। তা ছাড়া আমি কোম্পানি থেকে বেতনাদি নিয়ে স্টাফদের মাঝে বিতরণ করে দেই। আমার বেতন ব্যয়ের আর কোন পথ নেই। আগে প্রজাতন্ত্রের চাকরি করতাম, সেখান থেকে এখন মাসে মাসে যে পেনশন পাচ্ছি তাও ভোগ করার কেউ নেই। সুতরাং বনচারিরাই আমার পরমআত্মীয়, তাদের সুখদুঃখের অংশীদারও আমি। আমাকেই তাদের ভালোমন্দ দেখভাল করতে হয়। তাই তো তারা বলাবলি করেন, ‘আমি নাকী বনদেবতা হয়ে প্ল্যান্টে যোগ দিয়েছি।’ প্ল্যান্টে যোগ দেওয়ারও একটা কাহিনী আছে। ভাগ্য আমাকে কীভাবে টেনে এনেছে দ্বীপ বনে সেই কথাই এখন জানাচ্ছি।

আমি ছিলাম প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী; চাকরির মেয়াদপূর্ণ হওয়ার আগেই গোল্ডেন হ্যান্ডশেকে গেলাম। তখন আমার বয়স পঞ্চাশ। শেষ কর্মদিবস ছিল ৯ আগস্ট ২০১৪। তার পর থেকে আর কোন কাজ নেই, অফুরন্ত ছুটি, যে ছুটির শেষ নেই। সামনের বছরগুলো নিশ্চিত জীবন, অফিসে যেতে হবে না, ঘরে বসেই পেনশনের টাকা মিলবে। বিষয়টা মজাদার বটে, কিন্তু সহকর্মীসাক্ষাত থেকে বঞ্চিত হচ্ছিলাম। সে এক বিশাল যন্ত্রণা, ভূক্তভোগী মাত্র সে যন্ত্রণার বিষয়ে অবগত আছেন। সহকর্মীদের সঙ্গে একটা সামাজিক বলয় গড়ে উঠেছিল দীর্ঘদিনের মুখ দেখাদেখিতে। সেটি এখন অতীত; সে স্থানে ফেরা আর সম্ভব নয়। কর্তৃপক্ষ চেষ্টা করেছিলেন রেখে দিতে, আমি ইচ্ছুক নই বিধায় ছাড়তে বাধ্য হলেন।

আমি মনে করি গোল্ডেন হ্যান্ডশেকে আসায় আমার জন্য উত্তম হয়েছে। তাতে শরীর মন চাঙ্গা রাখতে পেরেছি, আবার অন্যসব কাজেকর্মেও প্রেরণা পাচ্ছি। তার ওপর সুযোগ পাচ্ছি দেশের নানান স্থানে ঘুরে বেড়ানোরও। আমার ইচ্ছে টইটই করে ঘুরে বেড়াব দেশের বিভিন্ন জনপদে, নানান প্রান্তরে। দীর্ঘ লালিত স্বপ্ন হাওরজোৎস্নায় স্নান করব, ডিঙ্গিচড়ে হিজল করচবনে হারিয়ে যাব। গড়াগড়ি খাব সবুজ প্রান্তরে, ছুঁয়ে দেখব দিগন্তরেখা। বন-বনানী, বন্যপ্রাণীর সান্নিধ্যে কাটাবো, পাহাড় পর্বত ডিঙ্গিয়ে দাপিয়ে বেড়াবো সমুদ্র সৈকতে। পায়েরতলায় স্পর্শ করবো কড়কড়ে বালুকারাশি আর সমুদ্রের ফেনিল আঠালো নোনাজল। ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিয়েছি নিজ দেশের বিভিন্নস্থানে ঘুরে বেড়াব আগে, সামর্থ্য থাকলে দূরদেশ ঘুরতে যাব। সংকল্পে অটুট রয়েছিও আমি, কারণ আমার পিছুটান নেই। কোন বাধাই দমিয়ে রাখতে পারবে না আমাকে, এমনকি বয়সও। আমার মনের তারুণ্য ত্রিশোর্ধ্বে নয়, পাহাড়-পর্বত ডিঙ্গানোর মোক্ষম ওষুধ এই দৃঢ় মনোবলই, সেটা আমি জানি। সামর্থ্য মনোবল সবই আছে আমার, শুধু নেই সহকর্মীদের হাসিঠাট্টা আর নেই চায়ের আসরের টুংটাং আওয়াজ। এখানেই আমি নিঃসঙ্গ, বড়ই নিঃসঙ্গ। আগে তাদের সঙ্গে এদিক-সেদিক যেতাম, এখন যেতে হবে একাকী। বিষয়টি পীড়াদায়কই বটে।

নিঃসঙ্গতা দূর করতে তাই স্থির করেছি দেশের দর্শনীয় স্থানগুলোতে ভ্রমণ করেই কাটিয়ে দিব। আমার বিশ্বাস ভ্রমণ বিলাস নয়, আনন্দ। এও বিশ্বাস করি যে মানুষ জীবনে কখনো ভ্রমণ করেনি, সে আনন্দ থেকে বঞ্চিত হয়েছে। আমি বঞ্চিত হতে চাইনি তাই সময় সুযোগ পেলেই ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ি। আগেও সুযোগ পেলে ভ্রমণে বেরুতাম, এখনো তারই ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছি। ঘুরে বেড়াই দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। এতে করে বন-বনানী, বন্যপ্রাণীর সঙ্গে যেমনি সাক্ষাত ঘটে তেমনি আবার নতুন জনপদের বৃত্তান্ত জানার সুযোগ হয়। ফলে বেশ উপভোগ করি।

চলবে...


বিডি প্রতিদিন/ ওয়াসিফ

সর্বশেষ খবর