৬ অক্টোবর, ২০২০ ১৩:৩৬
ষষ্ঠ পর্ব

বনবিহারী

আলম শাইন


বনবিহারী

বলতে ভুলে গেছি, আমাদের শাখা অফিসের অবস্থান শালতলা মৌজায়। মোট চারটি মৌজা দ্বীপ বনে। যথাক্রমে মেঘলা, শালতলা, সাগরমুখী আর কালাবন। এই চার মৌজার সমন্বয়ে দ্বীপ বন।

প্ল্যান্টের প্রধান অফিস মেঘলা মৌজায় অবস্থিত। এই মৌজাটি মেঘনা নদীর সন্নিকটে বিধায় ‘ম’ অধ্যাক্ষরে নাম রাখা হয়েছে ‘মেঘলা’। শালতলা মৌজায় বেশ কিছু শালগাছ থাকায় নামকরণ হয় ‘শালতলা’। উল্লেখ্য, বনের আর কোথাও শাল গাছ নেই। সমুদ্র সৈকতের কাছাকাছি বিধায় এলাকাটির নাম রাখা হয়েছে ‘সাগরমুখী’। আর কিছু মিথ নিয়ে ‘কালাবন’ নামকরণ হয়েছিল। তাছাড়া কালাবন মৌজার জঙ্গলটি বেশ দুর্গম। সূর্যরশ্মি বাধাপ্রাপ্ত হওয়ায় দিনেও বনের ভেতরে অন্ধকারাচ্ছন্ন থাকে। এমনি ঘনকালো জঙ্গলটি, যার ফলে লোকজনের কাছে এটি কালাবন নামে পরিচিতি পেয়েছে।

দ্বীপ বনের আয়তন প্রায় ৩৫ বর্গকিলোমিটার। নিঝুম দ্বীপের অভ্যন্তরে সবচেয়ে বড় দ্বীপ হচ্ছে ‘দ্বীপ বন’। অর্থাৎ দ্বীপপুঞ্জের ৯২ বর্গকিলোমিটারের মধ্যে ৩৫ বর্গকিলোমিটার দ্বীপ বন। বিশাল আয়তনের এই বনে লোকসংখ্যা অপ্রতুলতার কারণে এখানকার জীবনযাত্রা সুখকর নয় বিধায় ধীরে ধীরে আমাদের কর্মীর সংখ্যাও হ্রাস পাচ্ছে। আরও নানান ঘটনার কারণে বনকর্মীরা চলে যাচ্ছে, তেমনি একটি ঘটনা এখানে লিপিবদ্ধ করছি।

ঘটনাটি কালাবন মৌজার জঙ্গলে ঘটেছে বছর দুয়েক আগে। কালাবনে খুব একটা যাওয়া হয় না আমার। হাতি চলাচলের অনুপযুক্ত জঙ্গলটি, আর তাছাড়া ঘন জঙ্গলেও আবৃত কালাবন। বছরে দুইবার বাধ্যতামূলক যেতে হয়। তখন কাঁচামাল সংগ্রহের মৌসুম। গাছের পাতা, গাছের ছাল, ভেষজ ফল সংগ্রহে সময়ে যেতে হয়। সে এক কঠিন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় তখন। আমাকে দুইদিনের জন্য থাকতে হয় সেখানে, সুতরাং রাতযাপন বাধ্যতামূলক। সেখানে আমাদের বাংলো অথবা শাখা অফিস না থাকায় এই ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে। সিদ্ধান্ত নিয়েছি কালাবনে একটি ছোটখাট বাংলো বানাবো চলতি বছরেই। এখন ওখানে আছে টিনের একটা দোচালা ঘর; ঘরটি তত নিরাপদ নয়। মৌসুমে ওই ঘরেই রাতযাপন করতে হয় আমাদেরকে। 

বছর দুয়েক আগে হেড অফিসের তাগিদে এক সকালে আমি আর মহব্বত দয়াল হাতির পিঠে চড়ে কালাবনের উদ্দেশ্যে রওনা করলাম। সিদ্ধান্ত নিলাম শালতলার বাংলো পর্যন্ত হাতির পিঠে চড়ে যাব, তার পর হেঁটে কালাবন পৌঁছব।

শালতলা মৌজায় পৌঁছতেই আমাদের ৩টা বেজে গেছে। বনবাদাড়ে বিকেল ৩টা মানে শেষ বিকেল। মেঘলা থেকে আমরা সকাল ১০টায় রওয়ানা দিয়েছি। জলখাবার আর প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে একবার শুধু হাতির পিঠ থেকে নিচে নেমেছি। তাতে বড়জোর ১৫ মিনিট যাত্রাবিরতি দিয়েছি। সর্বসাকুল্যে মেঘলা থেকে শালতলা পৌঁছতে আমাদের ৫ ঘণ্টার মতো সময় লেগেছে। রাস্তা পরিষ্কার অথবা মসৃণ হলে হাতির পিঠে চড়ে এই দূরত্ব অতিক্রম করতে সময় লাগত বড়জোর তিন ঘণ্টা। আর পায়ে হেঁটে এলে না হয় আরও একঘণ্টা সময় বেশি লাগত।

শালতলার অফিসে সেদিন কর্মরত ছিল বিনয় ভৌমিক। আমাদেরকে দেখে সে খুব বিস্মিত হলো; লক্ষ্য করলাম তার কপালে দুঃচিন্তার ভাঁজ। দুই সপ্তাহ আগে শালতলায় এসেছিলাম, সেদিন কিন্তু জানিয়ে যাইনি আজ আসব। কাজেই সে একটু চিন্তিত হলো বৈকি।

হাতির পিঠ থেকে নিচে নেমে বাংলোয় না গিয়ে সোজা নদীর পারে চলে এলাম আমি আর মহব্বত দয়াল। টানা ৫ ঘণ্টার জার্নি, খুব ক্লান্ত পরিশ্রান্ত হয়ে গেলাম। এই মুহূর্তে গোসলের বিকল্প নেই, তাই বন বাদাড় পেরিয়ে নদীর কিনারে পৌঁছলাম। নদীতে জোয়ার বইছে; উপচেপড়া জল। নয়াজলে গোসলের মজাই আলাদা, তবে আর দেরি কেন?

তখন শরৎকাল। নদীর দুই পারে শুধু কাশ আর কাশ; ধবধবে সাদা নদীর পার। নদীর হাওয়া কাশবনের ওপর দিয়ে ধীরগতিতে প্রবাহিত হচ্ছে। হাওয়ার তালে তালে আনমনে দোল খাচ্ছে দাগি বাবুই আর ধলা কোমর মুনিয়া। ঘুড়ির মতো গোত্তা খেতে খেতে আকাশে ভাসছে একজোড়া ভুবন চিল। বাঁশির মতো ‘চি..চি..চি..’ সুরে ডেকে সঙ্গীর সঙ্গে ভাববিনিময় করছে। অদূরে একটি পানকৌড়ি গলা উঁচিয়ে ডুবোজাহাজের মতো ডুবছে আর ভাসছে। আমারও পানকৌড়ির মতো ভাসতে মন চাইছে, তাই তো চটজলদি নদীতে নেমে পড়লাম।

গোসলাদি সেরে বাংলোতে ফিরলাম আধ ঘণ্টার মধ্যেই। ইতোমধ্যে বিনয় ভৌমিক আমাদের জন্য খাবারদাবারের ব্যবস্থা করে রাখল। ডাল, ভাত আগেই রান্না করা ছিল। আমাদের জন্য এখন আস্ত ইলিশ ফ্রাই করিয়েছে; সঙ্গে আলুভর্তাও। মেঘনার তাজা ইলিশ ভাজার ঘ্রাণে আমার জিভ লক লক করতে লাগল। অপেক্ষা না করে তাই গপাগপ খেয়ে ফেললাম।

খেয়েদেয়ে বিশ্রামে যেতেই সাড়ে ৪ টা বেজে গেছে। ইতোমধ্যে বনময় আঁধার নেমে এসেছে। সৈকত কিংবা লোকালয়ে তখনো সূর্যের টাটকা তেজ, তাম্রাভাব ছড়াতে আরও ঘণ্টা খানেক সময় লাগবে। অথচ বনপ্রান্তরে সাঁঝের আঁধার অনুভূত হচ্ছে সাড়ে ৪টা বাজতেই।

বিশ্রাম সেরে বাংলোর বারান্দার চেয়ারে বসলাম। ততক্ষণে বারান্দায় হারিকেন ঝুলছে। বিনয় ভৌমিক পাশে এসে বসল। সে বলল, ‘বড়মিয়া, অফিসে খাবার পানির সংকট যাচ্ছে।’

‘কেন!’ জানতে চাইলাম।
‘টিউবওয়েলের ঝালি নষ্ট হয়ে গেছে সম্ভবত। ঘোলা ময়লা পানি উঠছে। খাওয়া যায় না। আবার দুর্গন্ধও প্রচুর।’
‘কতদিন ধরে সমস্যাটা?’
‘এক সপ্তাহ ধরে।’
‘এতদিন জানাওনি কেন! সদরে লোকজন গিয়েছিল। বললেই তো মিস্ত্রি আনাতাম।’
‘ভাবলাম ঠিক হয়ে যাবে, তাই জানাইনি।’
‘বলনি যখন, তখন ধৈর্য ধরতে হবে ক’দিন। সদরে লোক যাবে আরও দিন দশেক পরে।’
‘আচ্ছা, ততদিন চালিয়ে নিবো।’ 
‘কীভাবে?’
‘ ফিটকিরি মিশিয়ে নদীর পানি খাবো।
‘ঠিক আছে খাও। তবে ফুটানো ছাড়া খাবে না যেন।’ 

চা খেতে খেতে আমি আর বিনয় ভৌমিক নানান ধরনের আলোচনা সেরে ফেললাম। ঠিক করলাম আগামীকালের কর্মপরিকল্পনাও। সিদ্ধান্ত নিলাম আমি কিছু শ্রমিক নিয়ে সকালে কালাবনের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিবো। আর বিনয় ভৌমিককে এখানেই রেখে যাব, কালাবন যাওয়ার দরকার নেই। তার কাছে শুধু একজন প্রহরী থাকবে, বাকি সবাইকে আমার সঙ্গে নিয়ে যাব। সেখানে অনেক কাজ। থাকতে হবে দুইদিন। হরিতকি, বয়রা, নিমপাতা আর অর্জুনের ছাল সংগ্রহ করতে হবে; এখন মৌসুম।

কালাবনের মাটি হরিতকি, বয়রা, অর্জুনের জন্য বিশেষ উপযোগী। ভালো ফলনও হয়। শিপমেন্টেও সুবিধা হয়। শুধু হরিতকি, বয়রা, অর্জুনের ছাল দিয়েই শিপবোঝাই হয়ে যায়। কালাবন কোম্পানির জন্য বিশেষ রত্নভাণ্ডার বলা যায়। অথচ সেই কালাবনেই আমাদের যাতায়াত কম। কালাবনের নাম শুনলেই শ্রমিকরা আঁতকে ওঠে।

আগেই বলেছি, কালাবন অন্ধকারাচ্ছন্ন দুর্ভেদ্য একটি জঙ্গল। অন্য একটা বদনামও আছে কালাবনের; সেকথা আরেকদিন। কালাবনের গাছপালা যেমন বৃহৎ তেমনি জঙ্গলও ঘন। প্রচুর সাপখোপ আর খেপাটে মহিষের আস্তানা; কুকুর-বানর নেই তেমন একটা। কুকুর-বানরের জন্য অনুপযোগী জায়গাটা। এত গহীন জঙ্গলে ওরা বসবাস করতে পারে না। ওদের বাসস্থানের জন্য ফাঁকা জঙ্গলের প্রয়োজন।

পরদিন সকাল সাড়ে ১০টায় ২০-২২ জন শ্রমিক আর দুইদিনের রসদপত্র সঙ্গে নিয়ে কালাবনের উদ্দেশ্যে হেঁটে রওয়ানা দিলাম।

শালতলা মৌজার বন তত দুর্ভেদ্য নয়; তবে উঁচু উঁচু গাছ-গাছালি প্রচুর। শাল, দারুচিনি, তেজপাতা গাছও আছে কমবেশি। এদিকে তরুলতা তুলনামূলক কম। তবে এই বনে ভালো গোলমরিচ উৎপাদন হয়। উঁচু ঢিবি বানিয়ে তাতে গোলমরিচের লতা লাগিয়ে শালগাছের সঙ্গে লতা বেঁধে দিয়েছি। ফলে তর তর করে শালগাছ বেয়ে লতাগুলো বর্ধিত হয়েছে দ্রুত। গোলমরিচের ভালো ফলনও হয় মৌসুমে। তাতে কোম্পানির প্রচুর আয়ও হয়।

আমরা হাঁটছি শালতলার ছায়াশীতল জঙ্গল মাড়িয়ে। বাসক, আকন্দ, কালোমেঘ, উলটকম্বল, অশ্বগন্ধা, হাতিশুঁড়ের ছড়াছড়ি এ জঙ্গলে। উলটকম্বলে ফুল এসেছে প্রচুর। দেখতে ভারি চমৎকার সেই ফুলগুলো। পাঁচ পাপড়ির ফুলগুলো নিচের দিকে ছাতার মতো ঝুলছে। সূর্যের আলোকচ্ছটায় খয়েরি রঙের ফুলগুলো মিটিমিটি হাসছে। আকন্দ গাছেও ফুল এসেছে, দেখলাম ভ্রমর গড়াগড়ি খাচ্ছে; গুঞ্জরণে শালতলার জঙ্গল মুখরিত করে তুলছে। এমন মায়াময় জঙ্গল ছেড়ে যেতে আর ইচ্ছে করছে না আমার।

শালতলা পেরুতেই কালাবনের দুর্ভেদ্য জঙ্গলের শুরু। কালাবনের জঙ্গলে হাঁটতে গিয়ে এক ঘণ্টার মধ্যেই আমি ক্লান্ত পরিশ্রান্ত হয়ে গেলাম। জঙ্গল মাড়িয়ে আর হাঁটতে পারছি না, পা চলছে না যেন। ক্রমশ আরও দুর্ভেদ্য জঙ্গলের দিকে অগ্রসর হচ্ছি। শ্রমিকরা যতটা দাফিয়ে হাঁটতে পারছে আমি তার বিপরীত। ফলে আমার জন্য তাদের বারবার বিশ্রাম নিতে হচ্ছে। বিশ্রাম বলতে একটু জিরিয়ে নেওয়া আর মাঝেমধ্যে জলখাবার খাওয়া। আমরা আসার সময় অনেকগুলো ডিম আর গোল আলুসিদ্ধ এনেছি। ডিম আর গোলআলু জঙ্গলের সহায়ক খাবার। সেসব খাচ্ছি এখন। মহব্বত দয়াল আমার জন্য ফ্ল্যাস্কভর্তি চা এনেছে, তাতে বাড়তি এনার্জি পাচ্ছি।

আগেই বলেছি, পরিচিত লতাগুল্ম পেছনে ফেলে এসেছি আমরা। এখন ভিন্নমৌজা, ভিন্নবন, ভিন্নধরনের ঝোঁপ জঙ্গল। সেসব ঝোঁপ জঙ্গলের পাশ কাটিয়ে সতর্কতার সঙ্গে সামনে হাঁটছি। যত হাঁটছি ততই গভীর জঙ্গলের দিকে অগ্রসর হচ্ছি। হাঁটতে হাঁটতে দেড় ঘণ্টা অতিবাহিত হয়েছে, আরও এতখানি পথ হাঁটতে হবে; তবেই পৌঁছানো যাবে গন্তব্যে।

ইতোমধ্যে সূর্য মাথার ওপরে চড়ে বসল। গাছ-গাছালির ডালপালা ভেদ করে যৎসামান্য সূর্যরশ্মি বনতল স্পর্শ করল। সেই রোদের তেজ না থাকলেও ভ্যাপসা গরম অনুভূত হচ্ছে। ঘনঘন তেষ্টা পাচ্ছে, কিছুক্ষণ পরপর জলপান করছি তাই। শরীর ভিজিয়ে নিচ্ছি জল ছিটিয়ে। ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে গেছি। তার ওপর মশার আক্রমণ তো আছেই। কালাবনে প্রচুর মশা। একটু দাঁড়ালেই ঝাঁকে ঝাঁকে মশা ঘিরে ধরে। অসহ্য এক যন্ত্রণা!

প্রায় ঘণ্টা তিনেক হেঁটে দলবল নিয়ে আমি কালাবন পৌঁছলাম। ততক্ষণে খাড়া দুপুর। কালাবনে আমাদের থাকার জায়গা তত উন্নত নয়। দোচালা টিনের ঘর, দুটি কামরা মাত্র। স্কুলের আদলে লম্বা ঘর বানানো হয়েছে, যেন শ্রমিকরা রোদ বৃষ্টি থেকে রক্ষা পায়।

আমরা দোচালার কাছে পৌঁছতেই দেখলাম চিতা হরিণের পাল লাফিয়ে লাফিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। তার মানে ঘরটি এতদিন ওদের দখলেই ছিল। দরজা না থাকায় দোচালা দখলের সুযোগ পেয়েছে ওরা। ওদের মলমূত্রে দোচালার মেঝে সয়লাব। হঠাৎ মানুষজনের আগমনে হরিণপাল ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। ওরা বুঝতেই পারছে না এখানে আবার মানুষজন কেন! আবার এমনও হতে পারে হরিণগুলো জীবনে কখনো মানুষজন দেখেনি তাই ওরা অদূরে ঝোঁপের ভেতর দাঁড়িয়ে কৌতূহল নিবারণের চেষ্টা করছে। ঝোঁপ জঙ্গলের ভেতর থেকে উঁকিঝুঁকিও মারছে। তবে হরিণপাল এটুকু বুঝতে সক্ষম হয়েছে যে আমরা ওদের শত্রু নই।

এতগুলো চিতাহরিণ একত্রে দেখে শ্রমিকদেরও কৌতূহল বেড়ে গেলো। তারাও উঁকিঝুঁকি মারতে লাগল। তাতে হরিণপাল বিরক্ত হতে পারে ভেবে শ্রমিকদেরকে সেখান থেকে সরিয়ে দিতে কৌশলের আশ্রয় নিলাম; কাজ চাপিয়ে দিলাম ওদের ওপর। কাউকে রান্নাবান্না আর কাউকে কালাবনের পুকুরে মাছ ধরতে পাঠালাম।

কালাবনের পুকুরটা বেশ বড়োসড়। বন্যপ্রাণীরা এখানে এসেই জলতৃষ্ণা নিবারণ করে। দ্বীপ বন লিজ নেওয়ার পর কোম্পানি পুকুরটি খনন করেছে প্ল্যান্টের সেচ ব্যবস্থার জন্য। পুকুরটি এখন মাছের খনি। প্রাকৃতিকভাবেই এখানে মাছ বেড়ে ওঠছে। আমরা মাছ চাষবাস করিনি কখনো। জলোচ্ছ্বাসের সময় মাছ এসে পড়েছে পুকুরে, সেই মাছ বড়সড় হয়ে বংশবিস্তার ঘটিয়েছে। এই পুকুরে এখন মাছ আর মাছ। অসংখ্য কই, শিং, শোল, বোয়াল কিলবিল করছে।

প্লান্টের লোকজন ঘণ্টাখানেকের চেষ্টায় জাল দিয়ে প্রচুর মাছ ধরে ফেলেছে; কই, শিং আরও কত কী! তারপর যথারীতি রান্নাবান্না করেছে, খাবার জলও ফুটিয়েছে। এই ফাঁকে আমি গোসলাদি সেরে ফেললাম। তারপর দোচালার মেঝেতে বসে শিং মাছের ঝোল আর কইমাছ ভাজা দিয়ে পেটভরে ভাত খেলাম।

খাবার-দাবার শেষ করলাম, এবার গড়াগড়ি দিতে হবে। সঙ্গে বিছানাপত্র তেমন নেই, শ্রমিকরা শুধু চাটাই, মশারি, আর আমার জন্য কাঁথা-বালিশ এনেছে। চাটাইয়ের ওপর কাঁথা বিছিয়ে দিতেই আমি তাতে শুয়ে পড়লাম। এভাবেই দুই রাত কাটাতে হবে; করার কিছু নেইও।

সেদিনের মতো আর কোন কাজকর্ম করার সুযোগ হয়নি আমাদের। পরের দিনের কাজের চক কষে সবাইকে বিশ্রামের নির্দেশ দিলাম। পালাকরে যেন বিশ্রাম নেয় সেই বিষয়েও নির্দেশনা দিলাম। কারণ এই জঙ্গলে বাসকরে প্রচুর সাপ আর খেপাটে মহিষের দল।

বিশ্রাম সেরে মহব্বত দয়ালকে সঙ্গে নিয়ে একটু ঘোরাঘুরি করলাম। তার পর সাঁঝের আঁধার অনুভূত হতেই দোচালায় চলে এলাম। ইতোমধ্যে হারিকেন জ্বালিয়ে দোচালার চারপাশ আলোকিত করে ফেলেছে শ্রমিকেরা। তাতে ক্যাম্পিংয়ের মতো লাগছে; মনে হচ্ছে এ্যাডভেঞ্চারে এসেছি। এত লোকের সমাগমে বেশ আনন্দও লাগছে আমার। রাত বাড়তেই শ্রমিকদের কেউ কেউ সুরে বেসুরে গান গাইতে লাগল, কেউবা বাঁশের বাঁশি বাজাতে লাগল মনের সুখে। আমি তাদেরকে উৎসাহিত করলাম, বললাম যে ভালো গাইবে তার জন্য পুরস্কারের ব্যবস্থা আছে। ঘোষণাটা ওদের কানে যেতেই ওরা উল্লাসে ফেটে পড়ল, হরেক রকম গান শুনাতে লাগল আমাকে।

আনন্দ-উল্লাস শেষে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিলাম। সবাইকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে আমিও শুয়ে পড়লাম। দুই ঘণ্টা দুইজন করে পাহারা দিবে বাকিরা ঘুমাবে, হিংসপ্রাণী দেখা মাত্রই গুলি ছুঁড়বে সেই নির্দেশনাও দিলাম। সাপখোঁপের বিষয়টিও যেন খেয়াল রাখে সেই সতর্কতাও জারি করলাম। 

চলবে...

বিডি প্রতিদিন/ফারজানা

সর্বশেষ খবর