১৩ অক্টোবর, ২০২০ ১৪:২১
সপ্তম পর্ব

বনবিহারী

আলম শাইন


বনবিহারী

রাতে সবাই বেঘোরে ঘুমালেও আমি ঘুমাতে পারলাম না আর। আগামীকালের কাজকর্ম নিয়ে ভাবতে লাগলাম। কাঁচামাল শিপমেন্ট না করা পর্যন্ত দুশ্চিন্তা থেকেই যাচ্ছে। হেডঅফিস থেকে বারবার চিঠি আসছে দ্রুত কাঁচামাল শিপমেন্ট করতে। কালাবন থেকে কাঁচামাল নিয়ে আসাও কষ্টসাধ্য। বন থেকে বেশ কিছু দূরে হাঁটু সমান জলাশয়ে ডিঙ্গি রাখা আছে, সেই ডিঙ্গিগুলো বোঝাই করে প্যাঁককাদা দিয়ে টেনে সরু খালে নিতে হয় আগে। সেখান থেকে আবার সরুনদী অতিক্রম করে মেঘনা নদীতে আনতে হয়, তারপর শিপমেন্ট। বিষয়টা অনেক কষ্টসাধ্য ব্যাপার। সেই ভাবনায় অস্থির; ঘুম নাই চোখে। আবার বিছানাটাও আরামদায়ক নয়, মেঝেতে কাঁথা বিছিয়ে কোন রকম শুয়েছি। ঘুম না আসার আরেকটি কারণও হতে পারে এটি।

দোচালার দুটি কামরার একটিতে আমি শুয়েছি, বাকি সবাই অন্য কামরায়। একাকী থাকায় কেমন যেন গা ছমছম করছে, যদিও পাশাপাশি কামরায় শুয়েছি। মাইন্ড ফ্রেশ করার জন্য শোয়া থেকে ওঠে জানালার পাশে দাঁড়ালাম। ভাবছি কিছুক্ষণের জন্য বাইরে গিয়ে পায়চারি করলে হয়তো ঘুম আসবে।

বাইরে ঘুটঘুটে আঁধার। দোচালার চারপাশে চারটা হারিকেন ঝুলছে। হারিকেনের ক্ষীণ আলো দোচালার আঙ্গিনায় রহস্যময় ভৌতিক আবহের সৃষ্টি করেছে। দুইজন প্রহরী দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে, তবুও শঙ্কা কাটছে না আমার। তার ওপরে এই জঙ্গলের বোবা ভাষাটাও আমার রপ্ত হয়নি এখনো, কেমন জানি দুর্ভেদ্য ঠেকছে। অন্যান্য জঙ্গলের ভাষা আমি ঠিকই বুঝতে পারি। বলে রাখা ভালো, প্রতিটি জঙ্গলেরই একটা নিজস্ব ভাষা আছে, যে ভাষা হাওয়ায় ভেসে বেড়ায়। নিবিড়ে কান পেতে রাখলে অথবা অন্তর্দৃষ্টি খোলা থাকলেই কেবল সেই ভাষা হৃদয়ঙ্গম করা যায়; নচেৎ দুর্ভেদ্য ঠেকে।

বনপ্রান্তর তখন নীরব নিস্তব্ধ। হিংস্র জানোয়ারের হাঁকডাক নেই, নেই রাতচরা পোকামাকড়ের চেঁচানিও। মাঝেমধ্যে হরিণের ডাক ভেসে আসছে দূর থেকে। সেই ক্ষীণ কণ্ঠ বনপ্রান্তরে ধ্বনি প্রতিধ্বনি হয়ে শঙ্কা বাড়িয়ে দিয়েছে আরও। তবে কিসের শঙ্কায় শঙ্কিত আমি তাও বুঝে উঠতে পারছি না। চোর-ডাকাত হলে মোকাবেলা করার সামর্থ্য আমাদের আছে, কিন্তু সেই ধরনের কিছু আঁচ করতে পারলাম না।

আমি জানালার পাশে দাঁড়িয়ে খোলা আকাশপানে তাকিয়ে আছি। আকাশ পরিষ্কার এখন, নক্ষত্ররাজি মিটমিট করে জ্বলছে। রাতের প্রথমার্ধ্ব পর্যন্ত চন্দ্রকরের উপস্থিতি থাকলেও এখন ঘোর আঁধার; যেন অমাবশ্যার প্রতিচ্ছবি। আকাশ পরিষ্কার থাকায় নক্ষত্ররাজি স্পষ্ট নজরে পড়ছে। লক্ষ কোটি যোজন দূরে হলেও নক্ষত্রমণ্ডলীকে পড়শিদের কেউ মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে কতচেনা সেই সব নক্ষত্রমণ্ডলী। আবার যেন দেখতে পাচ্ছি প্রিয়জনের প্রতিচ্ছবিও, যে আমাকে ছেড়ে তারকারাজ্যে গিয়ে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। আমি উঁকিঝুঁকি মারছি আকাশপানে, যদি এই সুযোগে তার দেখা মিলে যায়।

যখন কত কী ভাবছি, ঠিক তখনি জানালার ফাঁক দিয়ে দেখতে পেলাম দোচালা ছাড়িয়ে ২৫-৩০ গজ দূরে বনপ্রান্তরে ক্ষীণ আলো জ্বলছে। আমি বিস্মিত হলাম আলোকরশ্মির দেখে। প্রহরীদের কেউ প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে গেল কীনা সেটি নিশ্চিত হতে দরজার কাছে এলাম। না, আমার ধারনাটা সঠিক নয়। প্রহরীদ্বয় দরজার সামনেই বসে আছে তখনো। আমাকে দেখে উঠে দাঁড়াল ওরা। ওদের উদ্দেশ্যে বললাম, ‘তোমাদের মধ্যে কেউ কী প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে জঙ্গলে প্রবেশ করেছে?’

ওরা ‘না’ সূচক জবাব দিতেই আমি চিন্তিত হলাম। আমি নিজ চোখেই দেখেছি আলোর ঝিলিক। যদিও তত প্রখর নয় সেই আলোকচ্ছটা। বিষয়টা খুলে বললাম ওদেরকে।

ওদের একজন হচ্ছে কায়েছ আলী। সে বলল, ‘বড়মিয়া, ডাকাত সন্দেহ হয় আমার। সবাইকে জাগিয়ে দেই।’

বললাম, ‘ডাকাত নয়, আমি নিশ্চিত। ডাকাত তথ্য ছাড়া ডাকাতি করে না। কারণ আমাদের সঙ্গে নগদ টাকা-পয়সা আছে কী নেই, এটা ওরা আগে নিশ্চিত হবে। সুতরাং এ ধরনের তথ্য ওদের পাওয়ার কথা নয়। প্ল্যান্টে আমাদের নগদ টাকা-পয়সার কারবার নেই, সেটি দ্বীপ বনের আশপাশের মানুষও ভালো করে জানে। কাজেই ওসব চিন্তা বাদ। অন্য কিছু হবে হয়তো।’

কায়েছ আলী বলল, ‘বড়মিয়া, যেই হোক না কেন, গুলি ছুঁড়ে দেই, অর্ডার করেন।’

‘এখন না। সময় হলে বলব। বিষয়টা আগে নিশ্চিত হতে হবে আমাকে,’ আমি বললাম।

এই গহীন জঙ্গলে গভীর রাতে কারা এসেছে, কেনই বা এসেছে যোগ-বিয়োগ দিয়ে কূলকিনারা করতে পারছি না। আমি যখন হিসেব নিকেশে ব্যস্ত ঠিক তখনি নজরে পড়ল আলোর সেই ঝলকানি। এবার অত কাছাকাছি নয়; স্পষ্টও নয়; ক্ষীণ। প্রহরীদেরকে আঙ্গুল উঁচিয়ে দেখিয়ে বললাম, ‘দেখ দেখ, ওই যে আলোর সেই ঝলকানি।’

ওরা দুজন সেদিকে তাকাল, উঁকিঝুঁকিও দিল, কিছুই দেখল না আর। এবার সত্যি আমি বেকুব বনে গেলাম। কী ভাববে ওরা আমাকে!

দুই-তিন মিনিট দাঁড়িয়ে রইলাম, আবার যদি নজরে পড়ে। এরইমধ্যে শুনতে পেলাম, ‘দ্রিম... দ্রিম...’ আওয়াজ। প্রহরীদের উদ্দেশ্যে বললাম, ‘তোমরা শুনতে পেয়েছ কিছু?’

ওরা বন্দুকটা উঁচিয়ে পজিশন নিল। একজন আমার উদ্দেশ্যে বলল, ‘ডাকাত! গুলি ছুঁড়েছে, আমরাও ফাঁকা আওয়াজ করি?’

আমি বললাম, ‘ডাকাত ডাকাত করছ কেন! দ্বীপ বনের কোথাও ডাকাতদল নেই। এরা চোরাশিকারি। হরিণ শিকার করতে এসেছে। তোমরা দুই রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছুঁড়, দেখবে বাপ বাপ করে পালাবে।’

মুহূর্তেই আমাদের দুই বন্দুক গর্জে উঠল। তথাপিও প্রতিপক্ষের সাড়া মিলেনি আর। ডাকাত হলে ওরাও গুলি ছুঁড়ে এগিয়ে আসত, এতক্ষণে দোচালা ঘিরে ফেলত। অথবা আমাদেরকে আক্রমণ করত। সেরকম কোন ঘটনা না ঘটায় আমি আরও নিশ্চিত হলাম ওরা চোরাশিকারি।

ঘটনার ঘণ্টাখানেক বাদে দোচালায় ঢুকে চাটাইয়ের বিছানায় শুয়ে পড়লাম। রাতে আর ঘুমাতে পারিনি। নানান কথা ভাবতে ভাবতে কখন যে রাত পেরিয়ে গেছে টেরই পাইনি। ভোররাতের খানিকটা পরে একটু চোখ বন্ধ হয়েছে কেবল। তাও কান সজাগ, কমবেশি শুনতে পাচ্ছি কিন্তু চোখে ঘুম।

ইতোমধ্যে ভোর হয়ে এসেছে। শ্রমিকরা শয্যাত্যাগ করে রান্নাবান্না করতে লাগল, খেয়েদেয়ে কাজকর্মে যোগ দিবে। আমি ঘুমিয়ে আছি তখনো।

আমার ঘুম ভেঙেছে আনুমানিক ৭টায়; শ্রমিকদের শোরগোলে। শোরগোল শুনেই লাফিয়ে বাইরে এলাম, কিছু একটা ঘটেছে বুঝতে পারলাম। না হলে সাতসকালে অমন সরগোল ওঠার কথা নয়। কারণ শ্রমিকদের এখনো এমন সাহস হয়নি শোরগোল করে আমার ঘুম ভাঙাবে। তাই আমি নিশ্চিত, কিছু একটা ঘটেছে।

দোচালা থেকে বেরিয়ে আঙিনায় দাঁড়াতেই দেখতে পেলাম রক্তাক্ত কাণ্ড! শ্রমিকদের একজন তমিজ ছৈয়াল, মাটিতে পড়ে আছে। খুনখারাপি ঘটে গেল নাকী আবার! ঘটনার আগামাথা কিছুই উদ্ধার করতে পারলাম না। ঘুমের ঘোরে কিছুই মাথায় নিতে পারছি না আমি।

মহব্বত দয়াল বুঝতে পেরেছে আমার মাথা সচল নেই, ঘুমের রেশ চোখে রয়ে গেছে এখনো, তাই সে আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে বিষয়টা বুঝিয়ে বলতে। মহব্বত দয়াল পাশে এসে দাঁড়াতেই আমি বললাম, ‘কী হয়েছে মহব্বত দয়াল খুলে বলো তো।’

মহব্বত দয়াল বলল, ‘বড়মিয়া, তমিজ ছৈয়ালের পেটে পাগলা মহিষ শিং ঢুকিয়ে দিয়েছে, ওর অবস্থা ভালো না এখন।’

‘বিষয়টা পরিষ্কার করে বলো?’

মহব্বত দয়াল বলল, ‘তমিজ ছৈয়াল পুকুর পারে গিয়ে মহিষের বাছুর ধরেছে, তারপর দড়ি দিয়ে বেঁধে টেনে আনছিল, আর অমনি ভয়ে বাছুরটা চেঁচাতে লাগল। সামান্য দূরে ছিল মা মহিষ, সে দেখে ফেলেছে সব, দেরি না করে বাছুরটাকে উদ্ধার করতে দৌড়ে এসেই ওর পেটে শিং ঢুকিয়ে দিয়েছে।’

‘সর্বনাশ! বলো কি? এখন কেমন আছে?’

‘ভালো না। খুব খারাপ অবস্থা, বাঁচবে কীনা সন্দেহ আছে।’

কথাটা শুনেই আমার শরীর হিম হয়ে এল। এগিয়ে গেলাম তমিজ ছৈয়ালের কাছে। দেখলাম শিংয়ের গুঁতায় ওর পেট এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে গেছে। দেখে আমার হাত পা কাঁপতে লাগল, অবশ হয়ে এল শরীর। সাহস করে ওর শরীরে হাত ঠেকালাম, বেঁচে আছে কীনা নিশ্চিত হতে। দেখলাম শ্বাসপ্রশ্বাস বইছে ঠিকই, তবে আশঙ্কামুক্ত নয়। এখন দ্রুত ওর চিকিৎসা প্রয়োজন। এমতাবস্থায় কী করব কিছুই বুঝে ওঠতে পারছি না। তথাপিও মাথা ঠাণ্ডা রাখতে চেষ্টা করলাম। শ্রমিকরা খেপে গেলে আরেক সমস্যা। তাই সবাইকে আশ্বস্ত করলাম, ‘কালাবনে আর তোমাদের কাজ করতে হবে না। তোমরা এখন তমিজকে কাঁধে তুলে শালতলার দিকে রওয়ানা দাও। আমি তোমাদের সঙ্গেই যাচ্ছি। দ্রুত চল। পালা করে কাঁধে নিবে, ওকে যে করেই হোক বাঁচাতে হবে।’

আমার সিদ্ধান্তে শ্রমিকরা সন্তুষ্ট হলো। কারণ ওরা এখানে আর কাজ করতে ইচ্ছুক নয়, আমি ওদের মতিগতি দেখে বুঝতে পেরেছি, তাই দ্রুত এই সিদ্ধান্তটা নিলাম।

আমাদের এই দলে তমিজের ছোট ভাইও আছে; এই প্ল্যান্টেরই শ্রমিক সে। ওর বয়স ত্রিশের কাছাকাছি। আর তমিজের বয়স সর্বোচ্চ পঁয়ত্রিশ।

আমার নির্দেশে তমিজের ছোট ভাইসহ আরও দুইজন মিলে ওকে কাঁধে তুলে নিয়ে শালতলার উদ্দেশ্যে হাঁটতে লাগল। পেছন পেছনে আমিও হাঁটতে লাগলাম। রক্ত ঝরছে তখনো, কোন কিছুতেই রক্তঝরা বন্ধ হচ্ছে না। আর তাছাড়া আমাদের পক্ষে সম্ভবও নয় রক্তঝরা বন্ধ করা। কারণ সেলাইয়ের ব্যাপার-স্যাপার আছে। তার পরেও চেষ্টা করছি গামছা প্যাঁচিয়ে রক্তঝরা বন্ধ করতে।

জঙ্গল মাড়িয়ে ছুটছি শালতলার উদ্দেশ্যে। পথের শেষ নেই যেন। যেখানে একা হাঁটতেই দায়, সেখানে পূর্ণবয়ষ্ক একজন মানুষকে কাঁধে নিয়ে হাঁটা কী যে কষ্টসাধ্য, তা বোঝানো মুশকিল। এভাবে বহুকষ্টে হেঁটে বন জঙ্গল পাড়ি দিয়ে তমিজ ছৈয়ালকে নিয়ে আমরা শালতলায় পৌঁছলাম।

তমিজের অবস্থা ক্রমশ খারাপের দিকে যাচ্ছে। শালতলায় পৌঁছে দ্রুত হাতির পিঠে ওঠালাম ওকে। এক মিনিটের জন্যেও দেরি করিনি আর সেখানে। দ্রুত মেঘলার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। হাতি দ্রুত হাঁটতে পারছে না। পথ সুবিধার নয়, দেখেশুনে হাঁটছে হাতি। চলতি পথে দেখলাম বারবার তমিজ ছৈয়াল চোখ বুজছে। অধিক রক্তক্ষরণ, তার ওপর ৩-৪ ঘণ্টা অতিবাহিত হয়ে গেলেও কোন চিকিৎসাই করাতে পারলাম না এখনো। বিষয়টা পীড়াদায়কই বটে। আমি খুব হতাশ হয়ে গেলাম। কীভাবে দ্রুত সদরে নেওয়া যায় সেই পরিকল্পনা আটতে লাগলাম। মেঘলার বাংলো পর্যন্ত পৌঁছতে পারলে স্পিটবোটে সদরে নিতে পারব, সেরকম ভরসা আছে আমার। কিন্তু মেঘলা পর্যন্ত পৌঁছাই এখন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

হাতির পিঠে চড়ে রওয়ানা দেওয়ার পর ঘণ্টাখানেক অতিবাহিত হয়েছে। এখনো চারঘণ্টা বাকি। বুঝতে পারলাম তমিজ ছৈয়ালের অবস্থা আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। এদিক সেদিক তাকাতে চেষ্টা করছে সে, কিছু যেন বলতে চাচ্ছে কিন্তু পারছে না। লক্ষ্য করলাম তার শ্বাসপ্রশ্বাস দ্রুত বইছে, চোখ বুজে আসছে, শরীর কাঁপছে। লক্ষণগুলো দেখে আমার কাছে ভালো ঠেকল না; অন্তিমমুহূর্ত মনে হলো।

তমিজ ছৈয়ালকে মহব্বত দয়াল ঝাঁপটে ধরে বসেছে। ওর যেন কষ্ট না হয় সেই চেষ্টাই করছে। অন্য কোনভাবে বসানোর সুযোগ নেই, সুযোগ নেই শুইয়ে দেওয়ারও। মাহুতের পেছনে তারা দুইজন; আমি একদম পেছনে বসেছি। যাতে ওর ঝাঁকনি কম লাগে; তার পরেও হাতির হাঁটার ঝাঁকুনিতে তমিজের সমস্যা হচ্ছে লক্ষ্য করলাম। তবে ওর শরীর থেকে এখন আর রক্ত ঝরছে না। রক্তঝরা বন্ধ হওয়ার কারণ হচ্ছে শরীরে তেমন রক্ত অবশিষ্ট নেইও।

তমিজ ছৈয়ালের শেষ পরিণতি আমার চোখের সামনে ভাসতে লাগল। তারপরও আমি আশাবাদী, ওকে চিকিৎসা করিয়ে সারিয়ে তুলব। আমি এ-ও জানি আমার সেই ইচ্ছে পূর্ণ হওয়ার নয়। প্ল্যান্টের ম্যানেজার হিসেবে শেষ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। কারণ আমার দায়িত্ব কর্তব্য অবহেলার নয়; সামান্য চেষ্টায় যদি তমিজ বেঁচে যায় তাহলে এটি হবে আমার জীবনের শ্রেষ্ট অর্জন। কিন্তু সেই অর্জনের আর সুযোগ পেলাম না। মিনিট খানেকের মধ্যেই মহব্বত দয়াল কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বলল, ‘বড়মিয়া, তমিজ আর নাই!’

শুনেই আমি শোকাহত হয়ে গেলাম। যদিও আগে থেকেই প্রস্তুত ছিলাম এমন একটি সংবাদ শুনার জন্য। সংবাদটা শোনামাত্র পেছন থেকে ঘাড়টানা দিয়ে তমিজ ছৈয়ালকে একনজর দেখে নিজকে আর ধরে রাখতে পারলাম না। দু’চোখ ঝাপসা হয়ে এল আমার। নিজেকে ভীষণ অপরাধী মনে হচ্ছে এখন। ভাবছি, আমিই কি তবে ওর মৃত্যুর জন্য দায়ী? নাকি তমিজ ছৈয়াল নিজেই নিজের মৃত্যুর জন্য দায়ী? ভেবেচিন্তে মনের যুদ্ধে জয়ী হলাম আমি। সমাধানও পেলাম; তমিজের লোভই তার মৃত্যুর প্রধান কারণ। মহিষ শাবকটাকে ধরে বেঁধে শালতলায় আনার চেষ্টা করছিল তমিজ ছৈয়াল। শাবকটা লালন পালন করে ওটার মালিক হওয়ার চিন্তা করেছে সে। কয়েকজনকে তার পরিকল্পনার কথা জানিয়ে পুকুর পারে এসেছে মহিষের বাছুরটা ধরতে। সবাই আমাকে সেই কথা জানিয়েছে ঘটনার পর। কিন্তু তার সেই পরিকল্পনা ভেস্তে গেছে মা মহিষের হিংস্রতার কারণে। চোখের সামনে দিয়ে সন্তান হারিয়ে যাবে সেটি বরদাস্ত করতে পারেনি মা মহিষ। ঠিক তখনি জগতের সমস্ত প্রাণিকুলের মায়ের মমতা মা মহিষের ঘাড়ে ভর করল। আর শাবক রক্ষায় যতটা হিংস্রতার প্রয়োজন ততটাই হিংস্র হলো। পরিশেষে ওর সম্বল প্রকৃতি প্রদত্ত দুটি তীক্ষ শিং ব্যবহার করে নিজ শাবককে উদ্ধার করল। যা পরবর্তীতে অপমৃত্যু হিসেবেই পুলিশের খাতায় নথিভুক্ত হলো।

চলবে...
  
বিডি প্রতিদিন/ফারজানা

সর্বশেষ খবর