৩ নভেম্বর, ২০২০ ১৪:৩১
দশম পর্ব

বনবিহারী

আলম শাইন


বনবিহারী

আগেই বলেছি, জঙ্গলে ঘুরে বেড়ানো হচ্ছে একধরনের নেশা। এই নেশায় যাকে একবার পেয়ে বসে তা থেকে তাকে নিবৃত্ত করা বড়ই কঠিন। লোকালয়ে বাস তখন তার কাছে শাস্তিযোগ্য মনে হয়। বাড়ি-গাড়ি, ধন-খ্যাতি তার কাছে তুচ্ছতর। দুনিয়ার যত বিলাস, যত আনন্দ, হুইস্কি, ব্র্যান্ডি সেবন, ফেসবুক, টুইটারের ব্যবহার, আইফেল টাওয়ারে চড়া ইত্যাদি তার কাছে অতি নগণ্য বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। সে আর অসৎপথে ধাবিত হতে পারে না, এমনই এক জাদুকরি শক্তি জঙ্গলের। যে শক্তি একজন মানুষকে সত্যিকারের মানুষে রূপান্তরিত করতে সক্ষম। মায়া, মমতা, প্রীতি এবং বন-বনানী-বন্যপ্রাণীর প্রতি কর্তব্যবোধ বাড়িয়ে দেয়। যেমন কর্তব্যবোধ বাড়িয়ে দিয়েছে আমারও। বন-বন্যপ্রাণীর অনিষ্ট আমি বরদাস্ত করতে পারি না এখন। জঙ্গল আমার কাছে এখন ভিন্ন একটি রাজ্য মনে হয়। যে রাজ্যে বিচরণ করি আমি প্রতিনিয়তই। তাতে আমি আনন্দ পাই, সুখ পাই, চিত্ত প্রসারিত হয়।

আর তাছাড়া জঙ্গলে বাস করে যদি জঙ্গলেই ঘুরে না-ই বেড়াতে পারি, তার চেয়ে দুঃখজনক আর কী হতে পারে। আমার সেই নেশা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠলেই আর বাংলোয় শুয়ে বসে থাকতে পারি না, অফিসের কাজকর্মেও মন বসাতে পারি না। তাই উদগ্রীব হয়ে পড়ি, আষাঢ়ি লতা, স্বর্ণলতার সান্নিধ্য পেতে।

হিংস্রপ্রাণীর আনাগোনা যেখানে নেই, সেখানে দিনভর হেঁটে বেড়াই আমি। এতদিনের অভিজ্ঞতায় ধারণা হয়েছে হিংস্রপ্রাণীদের নিদৃষ্ট এলাকা সম্পর্কে। বন-বাদাড়ে কাটাতে হলে এই ধরনের অভিজ্ঞতা একান্ত আবশ্যক, না হলে সাবেক ম্যানেজার সালেহ দেওয়ান আর তমিজ ছৈয়ালের মতো পরিণতি হতে পারে। এসব মেনে চললে, আর বাড়তি সতর্কতা নিলেই তেমন কোন সমস্যা হওয়ার কথা নয়। দূর জঙ্গলে অথবা হিংস্রপ্রাণীদের আবাসের কাছাকাছি গেলে দোনালা অথবা হাতির প্রয়োজনীয়তা বেড়ে যায়, সেটি মাথায় রেখেই বিচরণ করি। বড়জোর পিয়ালতলা পর্যন্ত একাকী যাই। পিয়ালতলা খুব দূরে নয়, বাংলোর সন্নিকটেই।

পিয়াল গাছ আমাদের প্ল্যান্টে খুব একটা নেইও। দুই-চারটা গাছ যাও বা আছে, তাও সে গাছগুলো মেঘলা বাংলোর কাছেপিঠেই। অন্যান্য মৌজায় পিয়াল গাছ নেই, তবে অল্পসংখ্যক শাল-সেগুন আছে শালতলার মৌজায়।

পিয়াল গাছ আকৃতিতে তত বড় না হলেও পাতাগুলো বড় বড়; সূর্যরশ্মি ঠেকিয়ে দিতে পারে পাতাগুলো। যে কারণে আমি প্রায়ই ছায়া শীতল পিয়ালতলায় যাই বায়ুসেবনের উদ্দেশ্যে। পিয়ালতলায় তেমন কোন লতাগুল্মেরও বিস্তৃতি নেই, আছে কিছু বুনোফুল আর অসংখ্য ভাঁট গাছ। মাস খানেক বাদেই ভাঁটের দুধসাদা ফুলে পিয়ালতলা ভরে যাবে। তখন মৌমাছির গুঞ্জন বেড়ে যাবে যেমন, তেমনি বেড়ে যাবে আমার যাতায়াতও। কারণ ভাঁট ফুলের সঙ্গে আমার শৈশব স্মৃতির মাখামাখি, তাছাড়া এই ফুলের মিষ্টি সৌরভ আমি বেশ উপভোগ করি।

সেদিন দুপুরের খানিকটা পরে পিয়ালতলায় এসে পায়চারি করছিলাম। পায়ের নিচেপড়া শুকনো পিয়ালপাতার মর্মরধ্বনি আমার কানে পৌঁছতেই বিস্ময়কর সিম্ফনির সন্ধান পেলাম। সিম্ফনির সন্ধানে যখন শুকনোপাতা পদপিষ্ঠ করছি অনবরত, ঠিক তখনি আমার পেছনে এসে দাঁড়ালেন মৌমিতা ভাবি। তিনি ঢাকা থেকে এসেছেন স্বামীর সঙ্গে। তার স্বামী ইরফান আজিজ দ্বীপ বনে একটা মিশনে এসেছেন। তিনি ‘তাসিয়া’ গ্রুপের স্টাফ না হলেও কোম্পানি থেকেই পাঠানো হয়েছে। তার সঙ্গে একজন ট্রেনারও এসেছেন, হিংস্রপ্রাণী থেকে রক্ষার কিছু কৌশল শিখাবেন শ্রমিকদের। পাশাপাশি বুনো কুকুর নিধনের বিষয়ে পরামর্শ করবেন।

মৌমিতা ভাবি নিজেও চাকরিজীবী মানুষ। একটা বেসরকারি ফার্মে চাকরি করছেন। গত পরশু এসেছেন স্বামীর সঙ্গে দ্বীপ বনে বেড়াতে।

দ্বীপ বনের কয়েকটি জায়গা আমার খুব পছন্দ, তন্মধ্যে পিয়ালতলাও একটি। এখানে এলেই গাছের শেকড়-বাকড়ের ওপর বসে দুই-চার-দশ মিনিট সময় কাটিয়ে প্রফুল্লচিত্তে বাংলোয় ফিরি। সেই সতেজতা পরবর্তীতে টনিকের মতো কাজ করে; কর্মে উদ্দীপনা যোগায়।

অন্যদিনের মতো আজও বায়ুসেবনের ইচ্ছায় পায়চারি করছি পিয়ালতলায়। ফুরফুরে বসন্তবাতাস পিয়াল গাছের মোটাসোটা কাণ্ডের পাশ কাটিয়ে ভুরভুর করে ধেয়ে এসে গায়ে লাগছে। আরামদায়ক সেই নির্মল বায়ুসেবনে আমার ফুসফুস কানায় কানায় ভরে গেলো মুহূর্তেই। যাকে বলে বিনাপয়সায় বায়ুসেবন। যে বায়ু আমরা খুব সহজেই পাচ্ছি চাষাবাদ ছাড়াই। বিনামূল্যে বায়ু বা অক্সিজেন পাওয়ায় মানুষজন এর কদর জানে না। বরং অক্সিজেনের উৎসস্থল ‘বৃক্ষবন্ধু’র মুণ্ডুপাত করে। মাঝেমধ্যে সৃষ্টির সেরাজীবের অকৃতজ্ঞতাবোধে আমি বিস্মিত হই। আমি প্রায়ই ভাবছি এই জঙ্গল এই গাছ-গাছালির ভূমিকা বাবা-মায়ের চেয়েও কোন অংশেই কম কিসের! বাপ তো জন্ম দিয়েই খালাস, মা দশমাস দশদিন পেটেধরে ভূমিষ্ঠ করেন, লালানপালনও করেন; কিন্তু কেউ কি একবারও ভেবে দেখেছেন সন্তানকে বায়ুসেবন করানো ব্যতিত মা কতটা অসহায়!

মৌমিতা ভাবি আমার পেছনে এসে দাঁড়ালেও বুঝতে পারিনি তার আগমনী বার্তা। ভেবেছি আমার পদপিষ্টে শুকনো পাতা চুরমার হচ্ছে, সেই আওয়াজই বুঝি আমার কানে প্রবেশ করছে। আসলে আমি এক ধরনের ঘোরের মধ্যে রয়েছি। প্রকৃতিপ্রেম জাগ্রতহলে আমি তখন ভিন্নজগতে চলে যাই; যে জগতে আছে শুধু ভাবনা আর অর্ন্তদৃষ্টির খেলা।

মৌমিতা ভাবির আগমনে আমি হতচকিত হলাম। তিনি পেছন থেকে বললেন, ‘স্বার্থপরের মতো একা একা হেঁটে বেড়াচ্ছেন, বললেও তো আপনার সঙ্গে চলে আসতাম।’ 
  ‘আপনি।’ পেছনে তাকিয়ে বললাম। 
 ‘কেন, আমিই তো। এখানে ত আর অন্য কাউকে দেখছি না।’
 ‘না, আমি সেটা বুঝাইনি।’
 ‘আপনি কি চাননি, আমি এখানে আসি।’ অভিমানী কণ্ঠ মৌমিতা ভাবির গলায়।
 ‘আরে তা বুঝাইনি। একা এসেছেন... ।’
  ‘না এসে উপায় ছিল না, সাহেব বাংলোয় নেই।’ 
  ‘তিনি কোথায় গেলেন।’ 
  ‘সাহেব, আপনাদের অন্য অফিসে গিয়েছেন। একা একা বাংলোতে ভালো লাগেনি আমার। লোকজনকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম আপনি এদিকে আছেন, তাই চলে এলাম।’ 
   ‘তিনি এই অবেলায় গেলেন কেন।’
   ‘তা তো জানি না, তবে আমাকেও যেতে বলেছেন। আমি রাজি হইনি।’
  ‘আপনি জাননি, বুদ্ধিমানের কাজ করেছেন। দূরের পথ, তা ছাড়া এতটা সময় আপনি হাতির পিঠে বসে থাকতে পারতেন না। তিনি তো আজ ফিরে আসতে পারবেন না।’
  ‘বলেন কী, তাহলে আমার কী হবে।’ 
  ‘অসুবিধা নেই, আপনি তো বাংলোয় থাকবেন।’
  ‘সেটাই তো সমস্যা। একা একা...।’
  ‘ভয়ের কিছু নেই। আমরা তো আছিই।’
  কথা বলতে বলতে আমি গাছের শেকড়ের ওপর বসে মৌমিতা ভাবির মুখমণ্ডলের দিকে তাকালাম। মায়াবী সেই মুখমণ্ডলের ওপর চোখ পড়তেই আর যেন নজর ফেরাতে পারলাম না। যেন তার মুখমণ্ডলে কারও প্রতিচ্ছবি আমি অনুভব করতে লাগলাম। খুঁজতে খুঁজতে মিলও খুঁজে পেলাম কিছুক্ষণের মধ্যেই। হ্যাঁ, আমার হারিয়ে যাওয়া মানুষটির সঙ্গে কিছুটা মিল খুঁজে পেলাম। আমি চমকে ওঠলাম। কী অদ্ভুত মিল, চোখ আর থুতনির! তার মানে যাকে আমি খুঁজছিলাম সে আমার সামনেই দাঁড়িয়ে। বিষয়টা বিশ্বাস করতেই কষ্ট হচ্ছে। এই দুইদিন মৌমিতা ভাবির মুখের দিকে ভালো করে তাকাইনি। এখন তার দিকে তাকিয়ে নজর ফেরাতে পারছি না আর। আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলাম তাকে। বয়সও মেপে ফেললাম; চল্লিশের কাছাকাছি। গায়ের রঙ ফর্সা। বয়স-গায়ের রঙ মিলে যেতেই আমি আরও কৌতূহলী হলাম। পোশাক-আশাকেও নজর দিলাম, গাঢ় লাল-কালোবুটিকের কালো পাড়ের শাড়ি পরেছেন। কপালে লালটিপ, ঠোঁটে ম্যাচিং করা লিপিস্টিক মেখেছেন। বামহাতে ঘড়ি, আর সানগ্লাস ডানহাতে ধরা। সব মিলিয়ে ভীষণ চমৎকার লাগছে এ বয়সেও! দৃষ্টি ফিরিয়ে নিতে পারছি না আর। আমি তন্ময় হয়ে তাকিয়ে আছি, তিনি কৌতূহলী হলেন আমার বেহায়াপনায়। বললাম, ‘দাঁড়িয়ে কেন, এখানে বসুন।’
  থতমত খেলেন ভাবি। সম্ভবত আমার কাছ থেকে এতটা আশা করেনি তিনি। আমি লজ্জিত হলাম কাছে বসতে বলায়। একজন মানুষের চেহারার সাথে আরেকজন মানুষের একটু-আধটুু মিল থাকাটা স্বাভাবিক, তাই বলে হুট করে কাছে বসতে বলাটা ঠিক হয়নি আমার।
  মৌমিতা ভাবি রাগ করেননি, সেটাও বুঝতে পারলাম। তবে একটু লাজুকভাব লক্ষ্য করলাম তার মুখমণ্ডলের ওপর। সেই লাজে তার মুখের রঙে পরিবর্তন এল; গোলাপিরূপ ধারণ করল। এখন আরও চমৎকার লাগছে তাকে। আমি ইতস্তত হতেই তিনি প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে বললেন, ‘সাহেব কী তবে আজ সত্যিই ফিরতে পারবেন না।’
  ‘কোন মতেই সম্ভব নয়।’
  আজ সকালের দিকে ইরফান আজিজ ট্রেনারকে সঙ্গে নিয়ে শালতলার বাংলোয় যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সকালে না গিয়ে বিকেলে কেন রওয়ানা দিলেন তা আমি বুঝতে পারলাম না। আমি বলেছিলাম তাকে ওখানে পৌঁছতে পাঁচ ঘণ্টা সময় লাগবে। গেলে খুব সকালে রওয়ানা দিতে হবে, যেন ফিরে আসতে পারেন সন্ধ্যার আগেই। কিন্তু তিনি তা করেনি, রওয়ানা দিলেন কীনা বিকেলে। 
  ভাবিকে বসতে বলার একটু বাদেই আমার হুঁশ ফিরে এল। নিজকে সামলে নেওয়ার চেষ্টা করলাম এবার। ততক্ষণে তিনি আমাকে অবাক করে দিয়ে সামান্য দূরত্ব বজায় রেখে আমার পাশের আরেকটা শেকড়ের ওপর বসলেন। আমি ইতস্ততবোধ করলাম। কী বলতে কী বলে ফেলেছি, এখন তার মাশুল গুণতে হচ্ছে। এ অবস্থায় প্ল্যান্টের কেউ দেখে ফেললেই বা কী মনে করবেন। আসলেই তিনি হচ্ছেন, একজন মুক্তমনা মানুষ। আমার কাছে বেখাপ্পা লাগার কারণ হচ্ছে আমি এই প্ল্যান্টের ম্যানেজার। আমার সামান্য ভুলের জন্য প্রশাসন নড়বড়ে হয়ে যেতে কতক্ষণ, সেটি মাথায় রেখেই তার সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ আচরণ বজায় রাখতে চেষ্টা করলাম। বিষয়টি তিনিও বুঝতে পেরেছেন বোধ করি, তাই তিনি কয়েক মিনিট বসে থেকে আবার দাঁড়িয়ে গেলেন। বললেন, ‘চলুন না একটু নদীর পার ধরে হাঁটাহাঁটি করি, যেন স্মৃতিতে আজীবন মনে থাকে দ্বীপ বন।’

রাতের ঘটনা। মৌমিতা ভাবি বাংলোতে একাকী। তার স্বামীর কাণ্ডজ্ঞানে আমি মনে মনে ক্ষুব্ধ। দায়িত্বজ্ঞানহীন এমন পুরুষ মানুষ আমি জন্মেও দেখিনি। তিনি তো বলেও যেতে পারতেন তার স্ত্রী’র প্রতি যেন আমরা খেয়াল রাখি। আর তাছাড়া এভাবে তার যাওয়া উচিতও হয়নি। বিশেষ করে নিজ স্ত্রীকে কেউ এভাবে দুই দিনের পরিচিত একটা মানুষের কাছে রেখে যেতে পারেন, তা আমার ভাবনার বাইরে ছিল। স্ত্রী যতই জ্ঞানীগুণী, চাকুরিজীবী হোক না কেন, তিনি একজন নারী সেটা তার বোঝা উচিত ছিল।

রাত ১০টা বাজছে, বাংলোর বারান্দায় বসে আছি আমি আর মৌমিতা ভাবি। পাশাপাশি দুটি চেয়ারে বসেছি আমরা। তিনি খুব ভীতু মানুষ; ভূতপ্রেতে তার অগাধ বিশ্বাস; কথাবার্তায় সেটি টেরও পেলাম। বারান্দায় আমি তার কাছাকাছি বসেছি, তাতেও তিনি ভয় পাচ্ছেন। আসলেই ভয় পাওয়ারই কথা। নীরব নিস্তব্ধ বাংলো, তার ওপর আশেপাশে কোন লোকজনও নেই, আমি আর মহব্বত দয়াল ছাড়া। প্ল্যান্টের অন্যান্য স্টাফরা অফিসের ভেতরেই রাতযাপন করে। তাদের এই বাংলোতে যাতায়াত একেবারেই কম। কেবল আমি তলব করলেই তারা আসে।

রাত ১০টা পর্যন্ত চিলতে চাঁদ পশ্চিমাকাশে ভেসে ছিল, সেই কুমড়োফালি চাঁদ ক্ষয় যেতেই এখন ঘুটঘুটে আঁধার নেমে এসেছে বনপ্রান্তরে। বারান্দার হারিকেনের আলোকরশ্মি সেই ঘুটঘুটে আঁধার ভেদ করার সামর্থ্য রাখে না। এতটাই ক্ষীণ সেই আলোকরশ্মি। বরং কেমন যেন এক ভৌতিক আবহ সৃষ্টি করেছে হারিকেনের আলো। তার ওপর একটু বাদে বাদে বাদুড়ের ডানা ঝাপটানো ‘পত্ পত্’ আওয়াজ মৌমিতা ভাবির পিলে চমকে দিচ্ছে।
   ইতোমধ্যে আমার প্রচণ্ড ঘুম পেয়েছে, চোখ বুজে আসছে। মৌমিতা ভাবিকে ঘুমিয়ে পড়তে তাগাদা দিলাম। তিনি জানালেন, একা একা কামরায় ঘুমাতে পারবেন না। প্রয়োজনে আমার কামরায় গিয়ে তিনি বসে থাকবেন; আমি যেন নির্বিঘ্নে ঘুমাই সেটিও জানালেন। মৌমিতা ভাবি শঙ্কিত হয়ে আমার কামরায় বসে রাত কাটাতে চাইলেও আমি মনে মনে রাজি নই; এটি দৃষ্টিকটু বিষয় মনে হচ্ছে, আমার কাছে। তাছাড়াও আমি মানুষ; সব কিছুর ঊর্ধ্বেও নই। ভাবনায় পড়লাম, কী করা যায় এখন! প্ল্যান্টে নারী কেউ নেই, থাকলে তার সঙ্গে রাত যাপনের ব্যবস্থা করতাম। বড় ধরনের সমস্যায় পড়ে গেলাম আমি।

  এমতাবস্থায় মৌমিতা ভাবি খুব ক্ষিপ্ত হলেন তার স্বামীর ওপর। একাকীত্বের কারণে হোক, বা যে কোন কারণেই হোক, কৌশলে স্বামী সম্পর্কে দুই-চার কথা জানালেনও। ইরফান সাহেব ড্রিংক করেন; আবার জুয়া-টুয়াও খেলেন সেরকম ইঙ্গিতও দিলেন। সেসব জানাতে গিয়ে বুক ফেটে যাচ্ছে তার, চোখ ঝাপসা হয়ে আসতেই বৃত্তান্ত জানানো থেকে বিরত রইলেন তিনি। তার বোবাকান্নায় আমি খুব আবেগতাড়িত হলাম; ব্যতিত হলাম খুব; খুব আপন মনে হচ্ছে এখন তাকে। মনে হচ্ছে সমস্ত জগতটা তাকে সমর্পণ করি; তার হাতে হাত রাখি, তাকে জুয়াড়ি, মদ্যপ মানুষটার কবল থেকে উদ্ধার করি। কিন্তু সেসব সম্ভব নয়...

রাত গভীর হয়ে এল। মধ্যরাত এখন। মহব্বত দয়াল শুয়ে পড়েছেন ঘণ্টা খানেক আগেই। আমি বিছানায় যেতে পারিনি, মৌমিতা ভাবিকে সঙ্গ দিতে বারান্দায় তার পাশে বসে রইলাম। ভয়ে তিনি আমার গা ঘেঁষে বসেছেন, আমি সংকোচবোধ করছি না এখন আর। দুইজনের চেয়ার এতটাই কাছাকাছি যে বাতাসে তার চুল উড়িয়ে আমার নাকমুখ স্পর্শ করছে। সেই রেশম কোমল সুগন্ধময় চুলের স্পর্শে আমি শিহরিত হচ্ছি বারবার। পঞ্চাশোর্ধ্ব বয়সেও আমার ভেতরে কেমন জানি এক অদ্ভুত ঘোর তৈরি হয়েছে; যা ব্যক্ত করার মতো নয়। উপলব্ধি করছি আজ রাতজাগার প্রয়োজনীয়তা। ঘুমাতে যেতে আর ইচ্ছে করছে না এখন। সিদ্ধান্ত নিলাম, একটি রাতই তো, না হয় না ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিলাম। বেঁচে থাকা অবধি অন্তত স্মৃতিটা তো মনে রাখতে পারব!

চলবে... 

বিডি প্রতিদিন/ফারজানা

সর্বশেষ খবর