১০ নভেম্বর, ২০২০ ১৩:৫০
১১তম পর্ব

বনবিহারী

আলম শাইন

বনবিহারী

ইরফান আজিজ দুইদিন পরে মেঘলায় এলেন। মৌমিতা ভাবি তাকে দেখেই ভীষণ ক্ষুব্ধ হলেন। ভেতরে ভেতরে আমি ক্ষুব্ধ হলেও তা প্রকাশ করতে বোধে বাঁধছে। এই লোকটির জন্য দুইরাত আমাকেও নির্ঘুম কাটাতে হয়েছে। এমন মানুষ জগতে এই প্রথম দেখলাম, যার কাছে নিজ স্ত্রীর মর্যাদা এতটা তুচ্ছ।
  ইরফান আজিজ বিকেলের দিকে আমার কামরায় এলেন। তাকে দেখেই বললাম, ‘আপনি কাউকে বলে গেলেই পারতেন। এভাবে যাওয়া কি ঠিক হয়েছে আপনার?’
  ইরফান আজিজ বললেন, ‘সাধে কী আর গিয়েছি, ভাই? আপনাদের হেডঅফিস বলেছে যেভাবেই হোক হিংস্রপ্রাণী নিধন করে যেন ফিরি।’
  ‘সেই কথাটা আমাকে জানাননি কেন! তাছাড়া বন বিভাগের অনুমতি ছাড়া বন্যপ্রাণী নিধন করা যায় না, এটা কি জানা আছে আপনার?’ 
 ‘অনুমতির আর দরকার নেই। বিনা অনুমতিতেই কাজ সেরে ফেলেছি আমি।’  
  ‘বুঝতে পারিনি বিষয়টা।’
  ‘বোঝাবুঝির কিছু নেই ভাই। সব কাজ সমাধান করে এসেছি।’
  ‘একটু খুলে বুলন তো ঘটনাটা।’
  ইরফান আজিজ হেসে বললেন, ‘ঢাকা থেকে সায়ানাইড বিষ এনেছি, সেই বিষ মাখিয়ে দিয়েছি মহিষের মাংসের সঙ্গে। শালতলা, সাগরমুখী, কালাবন এখন শেয়াল, কুকুরমুক্ত।’
  ইরফান আজিজের কথা শুনে আমি থ’ মেরে রইলাম। কী বলছেন তিনি এসব! পঞ্চাশোর্ধ্ব বয়সের একজন মানুষের কথায় অবিশ্বাসই বা করি কি করে। আমার নিজের কানে শোনা কথাও বিশ্বাস হচ্ছে না। কোন ধরনের পরামর্শ ব্যতিরকেই হেডঅফিস হুট করে এমন একটা সিদ্ধান্ত নিবে, তা ভাবতেই পারিনি আমি।’ 
  শেয়াল কুকুর যতই হিংস্র হোক, ওরা হচ্ছে দ্বীপ বনের অতন্দ্রপ্রহরী। সেই প্রহরী বিষপ্রয়োগে নিধন! বিষয়টা আমি মানতেই পারছি না। এটি ভীষণ অপরাধ, মহাঅন্যায় কাজ। যে অন্যায়ের সমর্থন দেওয়া কখনো আমার পক্ষে সম্ভব নয়। 
  সুন্দরবনের বাঘ, শেয়াল-কুকুরের চেয়েও হিংস্র, তাই বলে কি বনের বাঘ নিধন করা হয়! না নিধন করা হয় না, বরং সংরক্ষণ করা হয়। কারণ সুন্দরবনের অতন্দ্রপ্রহরী হচ্ছে ডোরাকাটা বাঘ, যেটি সুন্দরবনের মহাসম্পদ; অলঙ্কারও বটে। বাঘ না থাকলে সুন্দরবন জনপদে পরিণত হতো এতদিনে, হাটবাজার বসত, দালানকোটা গড়ত মানুষ। তেমনি শেয়াল-কুকুর হচ্ছে দ্বীপ বনের মূল্যবান সম্পদ এবং অতন্দ্রপ্রহরী। এই প্রাণীগুলো না থাকলে চোরাশিকারিদের উপদ্রব বাড়বে যেমন, তেমনি একটি হরিণও বেঁচে থাকতে পারবে না। অবাধে বৃক্ষনিধন হবে, প্ল্যান্টের ভেষজ গাছ-গাছালির অকাল সমাধি ঘটবে। গোলমরিচ চুরি যাবে। অফিস অথবা বাংলোর নিরাপত্তায় বিঘ্নিত হবে; ডাকাতও পড়তে পারে। আবার বলা যায় না দ্বীপ বনে জনপদও গড়ে উঠতে পারে একদিন।
  ইরফান আজিজের কথাশুনে জবাব দেওয়ার মতো ভাষা খুঁজে পেলাম না। তারপরও কিছু বলতে হচ্ছে বিধায় বললাম, ‘কাজটি মোটেই ঠিক হয়নি। হেড অফিসকে প্রাণিহত্যার খেসারত দিতে হবে।’
   ইরফান আজিজ বললেন, ‘সে তাদের ব্যাপার। আজ মেঘলার জঙ্গলে মিশন। তারপর আমার কাজ শেষ।’
  আমি অসহায়; আর একটাও কথা বললাম না। কথা বললেও লাভ নেই, কাজ হবে না। তা ছাড়া আমার শরীরে প্রচণ্ড জিদ এসেছে। জিদ নিয়ে কথা বললে পরিস্থিতি অন্যদিকে মোড় নিতে পারে, তাই চুপ থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ মনে হলো। চুপচাপ থাকলেও ঘুরেফিরে আমার চোখের সামনে ভাসছে শেয়াল কুকুরের লাশগুলো। যদিও এখনো জানতে পারিনি প্রাণীগুলোর মৃতের সংখ্যা? জানার আগ্রহও নেই। তবে একটা বিষয় লক্ষ্য করলাম, প্ল্যান্টের সবাই হিংস্রপ্রাণী নিধনে খুশি হলেও মহব্বত দয়ালের মুখে বিশাদের চাপ। তার মানে সে মর্মাহত, সেটি আমি উপলব্ধিও করতে পারলাম। 
  এই প্রাণী হত্যায় আমার এতটাই খারাপ লেগেছে যে, আফসোস করতেও কষ্ট হচ্ছে। বিশেষ করে যদি প্রাণ রক্ষা করতেই না পারলাম, তাহলে আফসোস করেই বা লাভ কী! তাই বিমর্ষবদনে বারান্দায় বসে রইলাম।
  আরেকটি বিষয়ে আমি খুব মর্মাহত হলাম, আমি প্ল্যান্টের কর্তাব্যক্তি হয়েও ঘটনার বিন্দুবিসর্গ জানতে পারলাম না, বিষয়টা আমার জন্য পীড়াদায়কই বটে। কিন্তু সেই দুঃখের কথা এখন কাকেই বা জানাই। বৃত্তান্ত বন বিভাগকে জানাতে পারি; কিন্তু সেটি ঠিক হবে না, অপেশাদারিত্বের পরিচয় হবে। তাছাড়া জানালে তো আর প্রাণগুলো ফিরে আসবে না! সুতরাং দেখতে থাকি প্রকৃতির সঙ্গে বৈরী আচরণের ফলাফল। প্রকৃতির সঙ্গে বৈরিতা করে আজ অবধি কেউ টিকে থাকতে পারেনি যেমন, তেমনি সত্যি হচ্ছে প্রকৃতি কোন না কোনোভাবে সেই বৈরিতার প্রতিশোধ নিবেই। সেটি বোঝার সাধ্য সর্বসাধরণের নেই মনে হচ্ছে, অথচ জ্ঞানবিজ্ঞানে কতই না শীর্ষে মানুষ, কত কিছুই না জয় করতে সক্ষম হয়েছে মানুষ।
  মানুষ হিমালয় জয় করেছে, মহাশূন্যে পইপই করে ঘুরছে, সাগরতলে যাতায়াত করছে, রোবট বানিয়ে ফাইফরমাশ খাটাচ্ছে, আরও কত কী বানিয়েছে, যার কোন হিসেব কিতাব নেই, কিন্তু প্রাণ বানিয়ে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে পেরেছে কজ না! যদি তা না-ই পারল, তবে কেন প্রাণবিনাশের কারণ হবে মানুষ! অন্তর্দৃষ্টি খোলা থাকলে, অথবা বোধশক্তি থাকলে সেটি সম্ভব হতো না। আসলে সৃষ্টির রহস্য উপলব্ধি করতে পারলে মানুষের বোধ শক্তির ঘাটতি হয় না।
  মানুষ ফুলকে যদি ফুল হিসেবেই দেখে তাহলে অন্ধ আর বধিরের মধ্যে পার্থক্য রইল কোথায়! বোধশক্তি থাকলে ফুল নিয়েই চিন্তাভাবনা করত মানুষ। সকল প্রজাতির গাছ-গাছালির পাতার বর্ণ একরকম হলেও ফুলের রঙের ভিন্নতা নিয়ে ভাবত। তদ্রুপ ফলের ক্ষেত্রেও। ক’জন ভাবে সৃষ্টির সেই রহস্য! ক’জন ভাবে নদীর জলের পার্থক্য নিয়ে! ক’জন ভাবে নদী-সাগর জলের স্বাদের পার্থক্য নিয়ে! ওই যে শুরুতেই বলেছি অন্তর্দৃষ্টির খেলা সব। যে খেলায় জয়ী হতে হলে আগে প্রকৃতির সান্নিধ্যে কাটাতে হবে, প্রকৃতিপাঠ নিতে হবে, তবে হতে পারবে সত্যিকারের মানুষ। 
  সাঁঝের আঁধার ঘনিয়ে আসার আগেই তিন মৌজার শেয়াল কুকুরের মৃত্যের সংখ্যা আমার কানে এল। বিম্ময়কর সেই সংখ্যা শুনে আমি দ্বিতীয়বারের মতো মর্মাহত হলাম। তিন মৌজায় বুনো কুকুর মারা গেছে সাড়ে এগারোশো আর শেয়াল চারশ’র মতো। সব মিলিয়ে সাড়ে পনেরশো মত শেয়াল কুকুরের মৃত লাশ পাওয়া গেছে। যেগুলো মাটি চাপাও দেওয়া হয়েছে। আরও তো কত ছড়িয়ে ছিটিয়ে মরে আছেই, সেই হিসাব জানা নেই। মেঘলা মৌজার সংবাদ এখনো জানতে পারিনি। আগামীকাল নাগাদ জানা যাবে। তবে ধারণা করছি এখানেও শেয়াল কুকুর মিলিয়ে চার সাড়ে চারশ মৃত প্রাণীর সংবাদ পাবো।
  ঘটনার সপ্তাহ খানেক বাদে। পূর্ণিমার রাত। সৈকতে যাওয়ার কথা ছিল আজ, কিন্তু মৌমিতা ভাবির অনুরোধে যাওয়া হয়নি। তিনি হাতির পিঠে চড়ে বনপূর্ণিমা উপভোগ করতে আগ্রহী। পূর্ণিমায় হাতির পিঠে চড়ে বনপ্রান্তরে ঘুরে বেড়ানোর মজাই আলাদা, প্রসঙ্গক্রমে তাকে সেই কথা বলেছিলামও একদিন। তার পর থেকেই তার আবদার পূর্ণিমার রাতে বনপ্রান্তরে ঘুরে বেড়াবেন। সেই আবদার আজ রক্ষা করতে হচ্ছে, না করেও উপায় ছিল না আমার, আগামীকাল সকাল নাগাদ দ্বীপ বন ছেড়ে চলে যাবেন তারা। জীবনে আর কখনো দেখাসাক্ষাৎ হয় কীনা সন্দেহ আছে, সুতরাং বিদায় মুহূর্তের অবাদারটা রক্ষা করতে বদ্ধপরিকর হলাম।
   সাঁঝের আঁধার ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে আমরা হাতির পিঠে চড়ব, এমনই পরিকল্পনা আমাদের। যেন চন্দ্রদোয়ের দৃশ্যপট বনের গহীনে গিয়ে উপভোগ করতে পারি। সঙ্গে থাকবেন ইরফান আজিজ আর তার স্ত্রী অর্থাৎ মৌমিতা ভাবি। কিন্তু যখন হাতির পিঠে চড়ব, তখনি মৌমিতা ভাবি বললেন, ‘শুধু আমি আর আপনিই যাচ্ছি, আর কেউ যাচ্ছে না কিন্তু আমাদের সঙ্গে।’
  ‘ইরফান সাহেব কোথায়, তিনি যাবেন না?’ জানতে চাইলাম।
   ‘না, লোকটা যাবেন না। আমি তার কাছে না থাকলে বোতল নিয়ে বসতে সুবিধা হবে, তাই সাফসাফ বলে দিয়েছেন আমাকে আপনার সঙ্গে যেতে।’
  ‘এ কেমন কথা, কিছুক্ষণ আগেই ত বললেন যাবেন।’
   ‘মদ্যপদের সব কথায় বিশ্বাস করতে নেই। সারজীবন আমি ঠকেছি বিশ্বাস রেখেই। তাছাড়া স্ত্রী’র সম্মান লোকটার কাছে নেইও। এ ধরনের মানুষ নিজ স্ত্রীকে অন্যের ...।’ বাকি কথাটা চেপে গেলেন মৌমিতা ভাবি।
  ‘আচ্ছা, মহব্বত দয়ালকে সঙ্গে নেই তাহলে।’ বললাম।
  ‘মাহুত থাকতে তার দরকার কেন।’ ভাবি আপত্তি জানালেন।
   মৌমিতার ভাবির এই আবদারটাও রক্ষা করতে যাচ্ছি আমি; তিনি চাননি সঙ্গে আর  কেউ যাক। আসলেই আমি যেন কেমন একটা ইন্দ্রজালের মধ্যে ডুবে গেছি, বুঝতে পারছি না কিছুই। না হলে তিনি যা বলছেন তা-ই আমি অক্ষরে অক্ষরে পালন করছি কেন! তিনি আমার কে-ই বা হন; যে তার কথায় আমাকে ওঠ-বস করতে হবে। প্ল্যান্টের কর্তাব্যক্তি আমি, সবাই আমার আদেশ পালনে ব্যস্ত থাকেন, আমার আঙ্গুলের ইশারায় ওঠবস করেন সবাই, আর আমি কীনা একজন অচেনা অজানা নারীর নির্দেশনায় ওঠবস করছি। সত্যি বলতে, কেন জানি বিষয়টা তত খারাপ লাগছে না আমার কাছে, আত্মসম্মানেও লাগছে না। বরং উপলব্ধি করছি জগতের কেউ না কেউ তো রইলেন আমাকে নির্দেশনা দেওয়ার।
  সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে একমগ আদা চা গিলে হাতির পিঠে চড়লাম আমরা। আমি মাহুতের পেছনে বসেছি; সবার পেছেনে মৌমিতা ভাবি। আমাদের যাত্রা সমুদ্র সৈকতের রাস্তা ধরেই। ইচ্ছে আছে সৈকতে বিচরণ করার, অবশ্য যদি সময় থাকে। তবে ওখানে যেতে বেশি সময় লাগার কথা নয়। আসা যাওয়ায় সর্বোচ্চ দুই ঘণ্টা লাগতে পারে, অর্থাৎ রাত ১০টার আগেই আমরা বাংলোয় ফিরে আসতে পারবো। তাতে একঢিলে দুই পাখি শিকার হবে; পূর্ণিমায় সৈকত দর্শন আর পূর্ণিমার বনপ্রান্তর দর্শন, দুটিই উপভোগ করতে পারবো। 
  মায়ারানী হেলেদুলে হাঁটছে, কোন তাড়া নেই আমাদের, ওর ইচ্ছেমতোই হাঁটছে, মাহুতের কোন নির্দেশনা নেই। মেঘলার বাংলো ছেড়ে পাঁচ-সাত মিনিট হাঁটতেই মায়ারানীকে সৈকতমুখী করে দিলো মাহুত। এখন আর তার কোন কাজ নেই, সব দায়িত্ব মায়ারানীর, সে জানে কোনদিকে যেতে হবে এখন। 
  কয়েক মিনিট অতিক্রম করতেই দেখলাম পূব আকাশ চৌচির হয়ে সোনারথালা সদৃশ মস্ত একটা গোলাকার চাঁদ বনপ্রান্তর ফুঁড়ে উঁকি মেরেছে। গাছ-গাছালির উঁচুমাথা জ্বলজ্বল করলেও বনপ্রান্তরে তখনো ফর্সা আঁধার। গাছের বিপরীতে অর্থাৎ পশ্চিম দিকে তখনো ঘনকালো ছায়া। রঞ্জনরশ্মির প্লেটে তাকালে যে রকম আঁকিবুকি দেখা যায় সেরকম মনে হচ্ছে গাছ-গাছালির ডালপালাগুলোকে। হরর বইয়ের প্রচ্ছদে সাধারণত এই ধরনের ছবি ব্যবহৃত হতে দেখেছি। যেমন: উদীয়মান চাঁদের সামনে নেকড়ের কালোছায়া, সেরকম লাগছে বনপ্রান্তরটাকে এই মুহূর্তে।
  ধীরে ধীরে চাঁদ তার তেজোময় জ্যোতি ছড়িয়ে ওপরে উঠতে লাগল; সোনালি আভা ফুরিয়ে গেছে নিমেষেই, রূপালি জ্যোতি ছড়িয়ে পড়েছে দশ-বারো মিনিটের মধ্যেই। বনপ্রান্তর মুহূর্তেই ফকফকা, চন্দ্রপ্লাবনে ভাসছে এখন দ্বীপ বন। তার ওপর মৃদুমন্দ বসন্তবাতাসও বইছে, তাতে মন উদাস হয়ে গেল আমার। চন্দ্রের এত প্রখরআলো, এত তেজ, এত রূপ আগে কখনো দেখিনি আমি। ইচ্ছে করছে হাত বাড়িয়ে চাঁদটাকে স্পর্শ করতে। স্পর্শ করতে ইচ্ছে করছে মৌমিতা ভাবির কোমল হাতটাও। তিনি তার আত্মরক্ষার্থে পেছন থেকে আমার কোমর প্যাঁচিয়ে ধরছেন বটে। হাতির হাঁটার তালে তালে না হলে পিছলে পড়ে যেতে পারেন সেই আশঙ্কায়। তাই বলে আমি তাকে ছুঁই কোন ছুঁতায়।
  আমার সেই অব্যক্ত নীরব আকুতি চাপা পড়ে গেছে রহস্যময়ী জ্যোৎস্নাজ্যোতিতে। যে জ্যোতির আলোকচ্ছটায় উঁচু উঁচু গাছ ও লতাগুল্ম থেকে ছুঁইয়ে পড়ছে ফোঁটা ফোঁটা ক্ষীররস। কী অপূর্ব, কী অদ্ভুত পূর্ণিমার সেই ক্ষীরফোঁটা। 
  মায়ারানী ধীরে ধীরে হাঁটছে বাঁশঝাড়ের পাশ কেটে। বাঁশঝাড় থেকে ভেসে আসছে রাতচরা পাখির ‘চউঙ্ক-চউঙ্ক-চউঙ্ক’ সুরের আর্তনাদ। আর সেই আর্তনাদ যেন আমাকে বিষাদের বার্তা পৌঁছে দিলো। আগামীকাল সকালে মৌমিতা ভাবি চলে যাচ্ছেন দ্বীপ বন ছেড়ে, সেটা স্মরণ করিয়ে দিলো। এই মানুষটিকে আর জীবনে কখনো দেখতে পাবো না আমি, ভাবতেই যেন আমার ভেতরটা হুহু করে ওঠল। মাহুতকে বললাম, ‘মায়ারানীকে বাংলোর দিকে ঘুরিয়ে দাও। ভালো লাগছে না আর।’
  আমার নির্দেশ অমান্য করার নয়, তাই সঙ্গে সঙ্গে হাতিকে বাংলোমুখী করল মাহুত। মৌমিতা ভাবি কিছু বলতে চাইলেন, আমার মুড অফ হয়ে যাওয়ায় তিনি আর কোন কথা বলেনি, চুপচাপ থাকলেন। বুঝতে পেরেছেন কিছু একটা হয়েছে আমার।
  মায়ারানী এবার দ্রুত হাঁটছে তাই বিশ-পঁচিশ মিনিটের মধ্যেই আমরা বাংলোর আঙ্গিনায় পৌঁছতে পারলাম। হাতির পিঠ থেকে নামতেই মাহুত ওকে নিয়ে হাতিশালায় চলে গেলো। আমরা দুজন বাংলোর আঙ্গিনায় দাঁড়িয়ে তখনো। আশপাশে কেউ নেই, নীরব নিস্তব্ধ চারপাশ। সেই নীরবতা ভেঙ্গে মৌমিতা ভাবি বললেন, ‘মুড খারাপ হয়েছে কেন?’ তার কথার জবাব না দিয়ে শুধু বললাম, ‘আপনি দ্বীপ বনে থেকে যান। আমি আপনাকে সম্মানজনক পদে চাকরির ব্যবস্থা করে দিব।’ 
  মৌমিতা ভাবি চমকে ওঠলেন, শিহরিতও হলেন। তার ভেতর আত্মবিশ্বাসও চলে এল, তিনি দৃঢ়তার সঙ্গেই বললেন, ‘থেকে যেতে মন চাইছে, কিন্তু আমার একটা মেয়ে আছে, বছর ১৫ বয়সের। ওর লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যাবে। তাছাড়া ওকে ছেড়ে আমি থাকতেও পারবো না। কাল আমি চলে যাচ্ছি ঠিকই, তবে আমার মনটা দ্বীপ বনে রেখে গেলাম।’

চলবে...

বিডি প্রতিদিন/ফারজানা

সর্বশেষ খবর