২ ডিসেম্বর, ২০২০ ১৭:০৭
১৪তম পর্ব

বনবিহারী

আলম শাইন


বনবিহারী

  ক’দিন ধরেই ভ্যাপসা গরম অনুভূত হচ্ছিল। অনুমান করেছিলাম কালবৈশাখী ঝড় বইবে। দুই-তিনদিন যেতেই জানতে পারলাম, কালবৈশাখী নয়, ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হয়েছে বঙ্গোপসাগরে।
  বঙ্গোপসাগরের ঘূর্ণিঝড় সম্পর্কে কমবেশি অবগত আছি আমিও। বিভিন্ন পত্রপত্রিকা মারফত জানতে পেরেছিলাম, এ পর্যন্ত বিশ্বের ৩৫টি ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড়ের মধ্যে ২৬টি ঘূর্ণিঝড় বঙ্গোপসাগরে সৃষ্টি হয়েছিল। তার মধ্যে ১৯৭০-এর ঘূর্ণিঝড় তো বিশ্বে আলোড়ন তুলেছিল। বিশ্বের ইতিহাসে যে ক’টি প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় বিভিন্ন দেশে তাণ্ডবলীলা চালিয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ দৃষ্টান্ত রেখেছে সেই সাইক্লোনটি। যার নাম করণ হয় ‘ভোলা সাইক্লোন’ নামে। ভারত এবং তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) উপকূলীয় এলাকায় এ ঝড় আঘাত হেনেছিল ১২ নভেম্বর, ১৯৭০ সালে। ঘূর্ণিঝড়টি ১৮৫ কিলোমিটার বেগে উপকূলে আঘাত হানলেও ২০৫ কিলোমিটার বেগের স্থায়িত্ব ছিল ১ মিনিট। তৎসঙ্গে ১০ থেকে ৩০ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসের ফলে গাছ-গাছালির ডালে আশ্রয় নেয়া মানুষজনও রেহাই পায়নি। তাতে প্রায় ৫ লাখ মানুষের প্রাণহানি ঘটেছিল। রেহাই পায়নি গবাদিপশুসহ বন্যপ্রাণীরাও। যার ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছিল ৮৬.৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার (১৯৭০)।

 ২০১৭ সালে জাতিসংঘের বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা বিশ্বের পাঁচ ধরনের ভয়াবহ প্রাণঘাতী আবহাওয়া জনিত ঘটনার শীর্ষ তালিকা প্রকাশ করেছিল। সেই তালিকায় শীর্ষ প্রাণঘাতী ঘটনা হিসাবে চিহ্নিত করা হয় ১৯৭০ সালে উপকূলীয় অঞ্চলের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ‘ভোলা সাইক্লোন’-কে। সেই সাইক্লোন অন্যান্য উপকূলীয় জেলার মতো সমগ্র নিঝুম দ্বীপেও ভয়ঙ্কর তাণ্ডব চালিয়েছিল। ঘূর্ণিঝড়ের আভাস পেলে দ্বীপবাসী এখনো আতঙ্কিত হয়ে পড়ে সেই ভয়াবহ স্মৃতি মনে করে। সেসব করুণ কাহিনি মাঝেমধ্যে শুনি এলাকার প্রবীণ কেউ প্ল্যান্টে এলে। ক’দিন আগে ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবে মুখোমুখি হওয়া ‘কেরপা বুড়ি’র নিজের অভিজ্ঞতা শুনলাম নিঝুম দ্বীপ পরিদর্শনে গিয়ে।

  কেরপা বুড়ি নিঝুম দ্বীপের বাসিন্দা। ৭০-এর ঘূর্ণিঝড়ে তার দুই ছেলেকে হারিয়েছেনও, আর তিনি আটকে ছিলেন ‘কেওড়া’ গাছের উঁচু ডালে। সেই থেকে তার নাম ‘কেরপা বুড়ি’। স্থানীয়লোকেরা কেওড়া গাছকে ‘কেরপা’ গাছ বলে, এ জন্য ঘূর্ণিঝড়ের পর থেকেই বুড়ি এই নামে পরিচিতি পায়। কৌতূহলী পর্যটকরা দ্বীপে এলে আশি বছর বয়সী এই বুড়ির সঙ্গে দেখা করে তাঁর সেই ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার কথা শুনেন।
 
ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাসে আমিও খুব শঙ্কিত হই, আমার দেখা ১৯৯১ সালের সুপার সাইক্লোনের কথা মনে পড়ে। মনে পড়ে ২০০৭ সালের সিডর, ২০০৯ সালের আইলার তাণ্ডবলীলার কথাও। গতকাল থেকে বয়ে যাওয়া আবহাওয়াটা আমার কাছে ওই ধরনের ভয়ঙ্কর কিছুই মনে হচ্ছে।
  
ধীরে ধীরে বাতাসের গতি বৃদ্ধি পাচ্ছে। এরই মধ্যে আমাদের স্টাফ নরেন বিশ্বাস জানাল, সে সমুদ্র সৈকতে পায়চারী করে এসেছে কিছুক্ষণ আগে, দেখেছে সমুদ্র নাকি খুবই উত্তাল। সৈকতে গিয়ে দুই-একজন পর্যটকের সঙ্গে কথা বলে জানতে পেরেছে, বঙ্গোপসাগরে নাকি ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হয়েছে। তবে কত নম্বর সিগন্যাল পড়েছে, সেটি জানাতে পারেনি পর্যটকরা। তারা দ্বীপে আটকা পড়ায় অনুমান করছে বড় ধরনের ঘূর্ণিঝড় বইতে পারে।

  নরেন বিশ্বাসের কাছে বিস্তারিত শুনে আমিও বসে থাকেনি আর, সঙ্গে সঙ্গে স্পিটবোটে লোকজন পাঠিয়ে দিলাম নিঝুম দ্বীপে। সেখানে গিয়ে আমাদের লোকজন জেনে এসেছে ঘূর্ণিঝড়ের নাম ‘মোরা’। ঘূর্ণিঝড়ের কারণে কক্সবাজারের জন্য ১০ নম্বর মহাবিপদসংকেত দেওয়া হয়েছে, আর নিঝুম দ্বীপসহ অন্যান্য স্থানের জন্য ৮ নম্বর। ৩০ মে ভোর ৬ টা নাগাদ ঘূর্ণিঝড়টি উপকূলে আঘাত হানবে। কক্সবাজার উপকূলে আঘাত হানলেও দ্বীপ বন নিরাপদ নয়, কারণ সমস্ত নিঝুম দ্বীপের অবস্থান বঙ্গোপসাগর ঘিরেই।

  ঘূর্ণিঝড়টি সম্পর্কে সামান্য তথ্যাদি জেনে আমরা কিছুটা সতর্ক হওয়ারও সুযোগ পেলাম। আরও একদিন আগে জানতে পারলে অনেক ভালো হতো, তাতে শুকনো খাবার সংগ্রহের সুযোগ পেতাম। এখনো যে শুকনো খাবার মজুদ আছে তাতে শ্রমিকসহ স্টাফদের দুই-একদিন চলবে, কিন্তু এটি পর্যাপ্ত নয়। অন্তত সপ্তাহ খানেকের খাবার মজুদ রাখা উচিত আমাদের। তবে আমাদের মাসকাবারি বাজার করা আছে। যদি বাংলো ডুবে না যায় তাহলে চাল-ডালের ঘাটতি হবে না আশা করি।
  
ইতোমধ্যে বাতাসের গতি বেড়েই চলেছে, তারিসঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বৃষ্টিবাদলও। বিকেল নাগাদ বাতাসের গতি আরও বেড়ে গেছে। শো শো করে ধমকা হাওয়া ঝাপটা মারছে কিছুক্ষণ পর পর। উঁচু উঁচু গাছপালাগুলো নুয়ে পড়ছে ধমকা হাওয়ার চোটে। অপেক্ষাকৃত ছোট গাছগুলো কিছুটা নিরাপদে রয়েছে, উঁচু গাছের আবডালে থাকায় সেগুলো ঝড়ঝাপটা থেকে কিছুটা রক্ষা পাচ্ছে। ধমকা হাওয়ার আঘাতে মাঝেমধ্যে অফিস, বাংলো ও টাওয়ার কাঁপছে। ভয়ে শঙ্কিত সবাই, আমিও কম শঙ্কিত নই।

  অবস্থা বেগতিক দেখে প্ল্যান্টের সবাইকে বাংলোতে অবস্থানের নির্দেশ দিলাম। শালতলায় মৌজায় দুপুরের মধ্যে সতর্কবার্তা পৌঁছে দিলাম। শ্রমিকদের কঠোরভাবে সতর্ক করলাম তারা যেন কোনমতেই বাংলো ছেড়ে না বেরোয়। যদিও ওদের আবাসস্থল মজবুত তথাপিও বাংলোয় এবং অফিস ভবনে অবস্থানের নির্দেশ দিলাম।

  মাহুতকে ডেকে বললাম, হাতির পায়ে যেন শিকল পরানো না হয়। আর ফাস্ট এইড বক্স নিজের হেফাজতে রাখলাম। শুকনো খাবার, দিয়াশলাই, মোমবাতি এসব নিরাপদে রাখলাম। মোটামুটি আমরা ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলায় প্রস্তুতি সম্পূর্ণ করলাম অল্প সময়ের মধ্যেই। এবার অপেক্ষার পালা, কখন কী ঘটছে সেটি পর্যবেক্ষণ করছি।

  রাত বাড়ছে, বাড়ছে বাতাসের গতিও, বাড়ছে আমাদের উৎকণ্ঠাও। আমি বেশি চিন্তিত হাতিটাকে নিয়ে। আমরা না হয় দোতলা সমান উচ্চতায় অবস্থান করছি, কিন্তু হাতির কী হবে? তা ছাড়া ৪-৫ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হলে মানুষ, বন্যপ্রাণী সবাই বিপদে পড়বে। বিশেষ করে জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা বৃদ্ধি পেলে হরিণ, কুকুর ও মহিষগুলো মারা পড়বে, এটা নিশ্চিত। প্ল্যান্টেরও প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হবে, যা এ মুহূর্তে নিরূপণ করা কঠিন।
  বাংলোর বারান্দায় দাঁড়াতে পারছি না, ধমকা হাওয়ার সঙ্গে বৃষ্টির ছাঁটে শরীর ভিজে যাচ্ছে। তথাপিও মাঝেমধ্যে উঁকিঝুঁকি মেরে ঝড়ের রুদ্রমূর্তি অবলোকন করছি। একটা বিষয় আমি লক্ষ্য করলাম, ৮ নম্বর মহাবিপদসংকেতে যে রকম তোলপাড় করার কথা, সে রকম এখনো অনুভূত হচ্ছে না। না হওয়ার কারণটাও অবশ্য অনুধাবন করতে পারলাম, সেটি হচ্ছে বাংলোর চারপাশে উঁচু উঁচু গাছপালা থাকায় ঝড়ঝঞ্ঝা গাছের ওপর দিয়েই প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে অফিসভবন ও বাংলো এখনো নিরাপদে রয়েছে।

  রাত ২টা বাজতেই অফিস সহকারী বাহারুদ্দিন আমার কামরায় এসে বলল, ‘বড়মিয়া, সম্ভবত জলোচ্ছ্বাস শুরু হয়েছে। আমাদের অফিস চত্বরও জলে সয়লাব হয়ে গেছে। ওই যে, নিচে দেখুন।’

  আমি আঁতকে ওঠে বললাম, ‘সর্বনাশ, বলো কি!’

  টর্চ নিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম, বাতাসের ঝাপটায় দাঁড়ানো যাচ্ছে না। জবুথবু হয়ে কোন রকম দাঁড়িয়ে টর্চ জ্বেলে দেখতে পেলাম অফিস চত্বর জলমগ্ন। আনুমানিক ১৫-২০ সেন্টিমিটার জল এখন অফিস চত্বরে। কয়েক মিনিট দাঁড়াতেই উপলব্ধি করলাম, যে গতিতে জল বাড়ছে, তাতে দুই-তিন ঘণ্টার মধ্যে আমাদের বাংলোও ডুবে যেতে পারে; অবশ্য যদি এ গতি অব্যাহত থাকে। আর জলের তোড় কমে গেলে রক্ষা পেয়ে যাব এবারের মতো।

  আমি দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না আর। শরীর কাঁপছে, বুক ধড়ফড় করছে, এমতাবস্থায় কী করণীয় তা মাথায় ঢুকছে না। টর্চ জ্বেলে চারদিকে তাকাতে লাগলাম; জল আর জল থৈ থৈ করছে। নজরে পড়ল আট-দশটা হরিণ আর কয়েকটা বুনো কুকুর, গা ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে আছে। বুঝতে পারলাম বনভূমি তলিয়ে গেছে। অফিসচত্বর অপেক্ষাকৃত উঁচু বিধায় জানোয়ারগুলো এখানে আশ্রয় নিয়েছে। দেখলাম মায়ারানীও জলে দাঁড়িয়ে আছে। শুঁড় উঁচিয়ে মাঝেমধ্যে গগণ ফাটানো আর্তচিৎকার করছে। সম্ভবত আমাদেরকে নিরাপদে থাকতে সতর্ক করছে অথবা আশ্রয়প্রার্থী সেও।

   আগে শুনেছি বিপদে পড়লে সাপ-বেজি হিংসাবিদ্বেষ ভুলে একই বৃত্তে আশ্রয় নেয়, সেরকম একটা দৃশ্য আজ নিজ চোখে দেখলাম। যদিও সাপ-বেজি দেখিনি, দেখেছি বুনো কুকুর আর হরিণের ঈর্ষ-অসূয়া দূর হতে। উপলব্ধি করলাম সৃষ্টির সেরা জীব আর পশুদের মধ্যের তফাতটা। মানুষের বিপদে মানুষ সুযোগ খুঁজে, আর বনের পশু বিপদে হিংসাবিদ্বেষ ভুলে যায়। ওরা মনে রাখে না পেছনের ঘটনা, মানুষ পুষে রাখে পেছনের সব, কারণ মানুষের স্মৃতিশক্তি প্রখর। স্মৃতিশক্তি, বুদ্ধিমত্তা এবং অন্যান্য গুণাবলীর কারণেই সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে মানুষ। যে বুদ্ধি খাটিয়ে মস্ত পশু হাতিকেও পরাস্ত করতে সক্ষম হয়েছে মানুষ; কিন্তু নিজের ভেতরের পশুত্বটাকে পরাস্ত করতে পারেনি। এ-যে বড়ই ব্যর্থতা মানবকুলের; যে ব্যর্থতার দায়ভার কারও ওপর চাপিয়েও পার পাবার নয়। কারণ মানুষের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা আছে; জানোয়ারের নেই।

  রাত আড়াইটা। কারও চোখেই ঘুম নেই, সবাই বসে আছে বাংলো আর অফিসভবনে। আমি একটু পর পর বারান্দায় এসে টর্চ জ্বেলে নিচে দেখছি জলের উচ্চতা কতটুকু বৃদ্ধি পেয়েছে কিংবা জানোয়ারগুলো কী অবস্থায় আছে। আমি মরিয়া হয়ে ওঠলাম হরিণ আর বুনো কুকুরগুলোকে বাঁচাতে। হাতিটা আপাতত নিরাপদে আছে। মাহুত ওকে হাতিশালায় নিয়ে রেখেছে, স্থানটা খানিকটা উঁচু, কাজেই কিছুটা নিরাপদ মায়ারানী। কিন্তু আশ্রয় নেওয়া অন্যান্য প্রাণীগুলোকে বাঁচতে সাহায্য করি কী করে!
  
আমি পেরেশান হয়ে গেলাম; তেমনি অবস্থায় সিকান্দার বারী বলল, ‘বড়মিয়া, বনের হরিণ, কুকুর, শেয়ালগুলো হয়তবা এতক্ষণে জলোচ্ছ্বাসে তলিয়ে গেছে, আর এই কয়টাকে বাঁচানোর চিন্তা করে লাভই বা কী।’

  ওর কথাশুনে আমি রেগে বললাম, ‘বারী, তুমি তো এই প্ল্যান্টে চার-পাঁচ বছর ধরে আছ, কোনদিন হরিণ কুকুরকে দেখেছ অফিস চত্বরে আসতে?’

 ‘না এই প্রথম দেখলাম। ওরা তো গভীর জঙ্গলেই থাকে।’

 ‘তাহলে আজ কেন এসেছে তোমাদের কাছে, এটা কি বুঝার বয়স হয়নি তোমার এখনো!’

  আমি কী বুঝাতে চেয়েছি বারী তা বুঝতে সক্ষম হয়েছে, সে মাথা নিচু করে ফেলল সঙ্গে সঙ্গে। বারী লজ্জ্বিত হয়েছে বুঝতে পারলাম। বললাম, ‘বারী আমি একটা কাজ করতে চাই, ওদেরকে যেভাবেই হোক বাঁচাতে সাহায্য করব।’

 ‘কীভাবে!’ বারী বিস্মিত হয়ে জানতে চাইল।

 বললাম, ‘আমি নিচে যাবো। তুমি আমার সাথে যেতে চাইলে বর্ষাতি পরে নাও। দেখি কিছু একটা করতে পারি কীনা।’ 

  আমার কথায় বারী আর আপত্তি করেনি, বর্ষাতি পরলো সে; আমিও পরলাম; মহব্বত দয়ালকেও পরতে বললাম। তার পর তিনজন টর্চ নিয়ে বাংলোর নিচে নামলাম। বাংলোর চত্বরে তখন জলের উচ্চতা ৩০ সেন্টিমিটারের মতো। ক্রমশই জলের উচ্চতা বাড়ছে; ভোর নাগাদ কী হয় বলা মুশকিল। তবে জলোচ্ছ্বাস না হলে বিপদে পড়বো না আশা করি, জোয়ারের জল ততটা ফুঁসে ওঠবে না জানি। 

  নিচে নেমে জলের স্বাদ পরখ করার জন্য সামান্য একটু জল জিভে লাগালাম। যা ভাবলাম তাই, নোনা জল। তার মানে সমুদ্রের জল ঢুকে পড়েছে প্ল্যান্টে অর্থাৎ সাধারণ জোয়ারের জল নয় এগুলো; তার মানে জলোচ্ছ্বাস বইছে মৃদু আকারের। তবে এখনো মারাত্মক আকার ধারণ করেনি বুঝতে পারলাম। 

  আমরা নিচে নামলেও হরিণ কুকুরগুলো দাঁড়িয়েই রইল; আমাদের আগমনে ওরা ভয় পায়নি কিংবা সরেও যায়নি। আগে যেখানে ছিল ওখানেই ঠিক ওভাবেই দাঁড়িয়ে রইল। আমাদের দিকে তাকালো করুণ চোখে, যদিও আমাদেরকে দেখেনি ওরা, টর্চের আলো দেখেছে শুধু। তারপরেও সরে যায়নি; যাওয়ার চেষ্টাও করেনি। বাংলো থেকে সামান্য দূরে অফিস চত্বরের মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে রইল জানোয়ারগুলো। কী করা যায় বুদ্ধি খুঁজছি। হঠাৎ মাথায় এল কলাগাছের ভেলা বানিয়ে দেই চার-পাঁচটা, তাহলেই তো রক্ষা পেয়ে যায় বুনো জানোয়ারগুলো। ভেলা বানানো আমাদের জন্য সহজ; কলা বাগানটাও কাছাকাছি আছে।
   
বুদ্ধিটা মাথায় আসতেই ডাকলাম শ্রমিকদের। আমার গলার আওয়াজ শুনেই ১৫-১৬ জন শ্রমিক নিচে নেমে এল সঙ্গে সঙ্গে। ওদেরকে বললাম, ‘দ্রুত কলাবাগানে চল, কলাগাছ কেটে আনতে হবে কয়েকটা। আমিও তোমাদের সঙ্গে যাব। বর্ষাতি পরে নাও সবাই।’

  ঝড়ের গতি স্থিতিশীল। তেমনি মুহূর্তে আমিও ওদের সঙ্গে রওয়ানা দিলাম। ওরা বারবার বারণ করছে আমি যেন না যাই ওদের সঙ্গে। বললাম, ‘তা হয় না, তোমাদেরকে বিপদের মুখে ঠেলে দিয়ে আমি বাংলোয় নিরাপদে থাকতে পারবো না।’

  বাংলো থেকে কলাবাগান বেশি দূরে নয়। অল্প সময়ের মধ্যেই আমরা হাঁটুজল মাড়িয়ে কলাবাগান পৌঁছতে সক্ষম হলাম। কলাবাগানেও একই অবস্থা, জল থৈ থৈ করছে, বরং এদিকে আরও বেশি জলের উচ্চতা। ভয় পাচ্ছি, যদি মাথার ওপর গাছের ডালপালা ভেঙ্গে পড়ে, অথবা গাছ উপড়ে পড়ে, তাহলে বিষয়টা হবে আরও মর্মান্তিক। জানোয়ার বাঁচাতে মানুষ মেরেছি, যা হবে আরও মারাত্মক অপরাধ। যে অপরাধের জন্য নিজের কাছে নিজেকে আজীবন অপরাধী হয়ে থাকতে হবে। সেই বিষয়টি মাথায় রেখে খুব সাবধানের সঙ্গে আমরা দ্রুত কলাগাছ কাটলাম। তার পর প্রত্যেক শ্রমিকের কাঁধে একটা করে কাটা কলাগাছ চাপিয়ে দিলাম অফিস চত্বরে নিয়ে যেতে।

  আমরা অফিস চত্বরে কলাগাছ এনে গাছের ডাল গেঁথে ৪-৫ টা ভেলা বানিয়ে ফেললাম তাৎক্ষণিকভাবে, এতে খুব বেশি সময় লাগেনি। তার পর খুঁটি গেঁথে ভেলাগুলোর সঙ্গে লম্বা দড়ি বেঁধে দিলাম। যাতে জল বাড়লেও ভেলা ওপরে ভাসতে পারে। আপাতত আমাদের কাজ শেষ; এবার জানোয়ারগুলোর বুদ্ধিমত্তা পরখ করার পালা।  

  ভেলা ভাসিয়ে বাংলোর ওপরে ওঠে এলাম আমরা। ইতোমধ্যে জল আরও বেড়েছে; কুকুরগুলোর থুঁতনি ডুবুডুবু করছে আর হরিণের পেটের নিচে জল ছুঁই ছুঁই করছে। আমি উপরে দাঁড়িয়ে ওদের গতিবিধি লক্ষ্য করছি। টর্চের আলো ভেলার আশপাশে ফেললাম, যাতে ওরা চোখে ভেলাগুলো দেখতে পায়। এখন বেঁচে যাওয়াটা নির্ভর করবে ওদের বুদ্ধিমত্তার ওপরে। বুদ্ধি করে লাফিয়ে ওঠতে পারলেই বেঁচে যাবে। দেখতে দেখতে কয়েক মিনিট অতিক্রম হলো, এরই মধ্যে দেখলাম একটা কুকুর লাফিয়ে উঠল ভেলায়। ওর দেখাদেখি বাকি কুকুরগুলো লাফিয়ে ওঠল ভেলায়। হরিণগুলোকেও দেখলাম এবার নড়াচড়া দিতে। ওরা ভেলায় ওঠতে চেষ্টা করছে, কিন্তু কুকুরের মতো লাফিয়ে ওঠার সাহস পাচ্ছে না। আবার ওঠতে গিয়ে পা পিছলেও পড়ছে। আমি টর্চ জ্বালিয়ে রাখলাম ভেলা বরাবর। এক সময় দেখলাম একটা হরিণ খানিকটা চেষ্টাকরে ভেলায় ওঠতে সক্ষম হয়েছে, তার পর ধীরে ধীরে সবাই ওঠল আলাদা আলাদা ভেলায়। দেখে আমি অভিভূত হলাম, আনন্দে আমার চোখে জল চলে এল।

  রাত ৫টা বাজতেই দৃশ্যপট পাল্টে গেল। বাংলোর কয়েকটা সিঁড়ি জলে তলিয়ে গেল। অনুমান করলাম ভয়ঙ্কর বিপদের মুখোমুখি হতে যাচ্ছি আমরা। বাংলো ডুবে যাওয়া অসম্ভবের কিছুই নয়। ভূমি থেকে মাত্র ১২-১৩ ফুট বাংলোর উচ্চতা; সুতরাং যে কোন সময় কিছু একটা ঘটতে পারে। এমতাবস্থায় আমরা কী করব সেটি নিয়ে পরামর্শ করলেও ভালো কোন সমাধান বের করতে পারলাম না কেউই। এরই মধ্যে আমি একটা ধারণা নিতে সক্ষম হলাম যে, জলোচ্ছ্বাস তত উচ্চতার নয়। যদি জলোচ্ছ্বাস তত উঁচু হতো, তাহলে জল ফুঁসে ওঠত ভয়ঙ্কর গতিতে, তাতে এতক্ষণে বাংলো তলিয়ে যেত। কিন্তু সেরকম হচ্ছে না; জলটা আসছে ধীরে ধীরে; তাহলে ধরে নিতে পারি সকাল নাগাদ আমরা নিরাপদ থাকবো। আর ততক্ষণে ঘূর্ণিঝড় উপকূল অতিক্রম করে ফেলবে। সুতরাং ভরসা পাচ্ছি জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষা পাওয়ার।
   
সাড়ে ৫টা থেকে শুরু হলো তুমুল ঝড়। বাংলোর আশপাশের কয়েকটা গাছপালা ধুমড়ে মুচড়ে পড়ল। অফিস, বাংলো, টাওয়ার কখন উপড়ে পড়ে যায় বলা যায় না। সেরকম কিছু ঘটলে অনেক প্রাণহানি ঘটবে নিশ্চিত বলতে পারি। এমতাবস্থায় ধৈর্যধারণ করা ছাড়া আর কোন উপায় খুঁজে পেলাম না।

  ভোর ৬টার পর থেকে ঝড়ঝাপ্টা কমতে শুরু করল। সম্ভবত ঘূর্ণিঝড় উপকূল অতিক্রম করেছে ততক্ষণে। ধীরে ধীরে আবহাওয়ার উন্নতি হতেও দেখলাম; তাতে আমাদের ধড়ে প্রাণ ফিরে এল। দুপুর নাগাদ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে এলেও বনপ্রান্তরের জল নামেনি। নদীতে জলস্ফীতি থাকায় জল নামার সুযোগ হয়নি। পরবর্তীতে দুইদিন বাদে জল নেমে গেলেও প্ল্যান্টের নিচুস্থানে সপ্তাহ ব্যাপী জল রয়ে গেছে। তাতে আমাদের প্ল্যান্টের প্রভূত ক্ষতিসাধিত হয়েছে; লতাগুল্ম নোনাজল সইতে না পেরে মারা গেছে। গোলমরিচের লতা একটাও অবিশিষ্ট রইল না আর। অনেক ভেষজ গাছের পাতা শুকিয়ে আসতেও দেখলাম। সিদ্ধান্ত নিলাম বনভূমি শুকালে প্ল্যান্ট পরিদর্শনে বের হবো; তার আগে বেরোনোর উপায়ও নেই। সবগুলো মৌজায় পরিদর্শন করে তবে হেড অফিসে চূড়ান্ত রিপোর্ট পাঠাব। এর আগে প্রাথমিক ক্ষয়ক্ষতির বিবরণ জানাতে সদরে লোক পাঠিয়েছিও অবশ্য। পরবর্তীতে চূড়ান্ত রিপোর্ট সংগ্রহ করে আমি হেড অফিসের সঙ্গে কথা বলব।

   ঘূর্ণিঝড়ের দিন সাতেক পর ঢাকা হেড অফিসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা দ্বীপ বন পরিদর্শনে এসেছেন। তাদের সঙ্গে এসেছেন অফিসের বাইরের আরও দুইজন লোক। তারা ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষয়ক্ষতির প্রামাণ্যচিত্র বানাবেন। সেই প্রামাণ্যচিত্র রোমানিয়ায় পাঠানো হবে। ফলে হয়তো এমডি সাহেবও আসতে পারেন দ্বীপ বনে, সেই ধরনের ইঙ্গিতও দিয়েছেন কর্মকর্তারা।

  ঘূর্ণিঝড় মোরা’র প্রভাবে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে প্ল্যান্টের, যে ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে আমাদের কয়েক বছর লেগে যেতে পারে। তা-ও যদি প্ল্যান্টের পরিচর্যা ঠিকমতো করা হয়, নচেৎ লোকসান গুনতে হবে কোম্পানিকে। এমনি মহাবিপর্যয় ঘটেছে দ্বীপ বনের ভেষজ প্ল্যান্টের।

  হেড অফিসের লোকজনের সঙ্গে আমি দ্বীপ বন পরিদর্শনে বের হলাম সেদিন। এতদিন আমিও বের হতে পারিনি, বন প্রান্তর জলে নিমজ্জিত ছিল। জল শুকিয়েছে দুই-একদিন হয়েছে; কাদাজল এখনো থিকথিক করছে। তার ওপরে রয়েছে শ্বাসমূলের যন্ত্রণা, সুতরাং দেখেশুনে পা ফেলতে হচ্ছে। যদিও আমাদের পায়ে গামবুট পরা, তথাপিও সতর্ক হয়ে হাঁটতে হচ্ছে।

  ঢাকা থেকে আগত সবাইকে নিয়ে আমি বনের গভীর প্রবেশ করলাম। আমার উদ্দেশ্য গাছ-গাছালি, লতাগুল্মর ক্ষয়ক্ষতির পাশাপাশি বন্যপ্রাণীদের দুর্গতিও তুলে ধরা। যাতে প্রামাণ্যচিত্রে সেসব নজরে পড়ে। 

  ধীরে ধীরে আমরা অগ্রসর হচ্ছিলাম। যতই অগ্রসর হচ্ছি ততই আমাদের মন খারাপ হতে লাগল। বনের অধিকাংশ লতাগুল্ম মরে শুকিয়ে গেছে। হাজার হাজার ভেষজ গাছের পাতা শুকিয়ে এসেছে, বোঝাই যাচ্ছে এ গাছগুলোও মারা যাবে অচিরেই। অপেক্ষাকৃত নিচুস্থানে দেখলাম এখনো নোনাজল আটকে আছে। অসংখ্য হরিণ, শেয়াল, কুকুর, খরগোশ, শূকরের লাশ পচে দুর্গন্ধ বেরুচ্ছে। ভীষণ দুর্গন্ধ; সেই গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে বনভূমির আনাচে-কানাচে। অতিমাত্রার দুর্গন্ধের কারণে সামনে অগ্রসর হওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। তাই আমরা কয়েকজন দাঁড়িয়ে রইলাম, আর যারা প্রামাণ্য চিত্রের ভিডিও করছেন, তারা সামনে অগ্রসর হলেন।

  প্ল্যান্টের বিপর্যয়ে আমি খুবই মর্মাহত হলাম। এতদিনের সাজানো প্ল্যান্টটি নিমেষেই তছনছ হয়ে যাবে, ভাবতেই আমার মাথা চক্কর দিয়ে ওঠল। এ নৈসর্গিক সবুজ বন প্রান্তর আমি কোথায় দেখব আর! আবার কত বছর লাগবে এই প্ল্যান্ট গড়ে তুলতে তা অনুমান করাও কঠিন হয়ে পড়েছে আমার পক্ষে। সেসব মনে আসতেই আমার দুচোখ ছলছল করতে লাগল। এমতাবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকতে আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। আমি শুনতে পাচ্ছি হাজারও বন্যপ্রাণীর আর্তনাদ, তরুলতার বোবাকান্না; আর চোখের সামনে ভাসছে প্ল্যান্টের ভবিষ্যত। এতদিন বনে প্রবেশ করতে পারিনি জলে নিমজ্জিত থাকায়, আজ বনে প্রবেশ করতেই আমার ধারণা সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে। আমি ভেবেছিলাম ক্ষয়ক্ষতি হলেও ভেষজ গাছগুলোর সমস্যা হয়নি তেমন। বনের গভীরে প্রবেশ করে দেখলাম মহাবিপর্যয় ঘটে গেছে প্ল্যান্টের। জানি না এত বড় ক্ষতি কীভাবে পুষিয়ে ওঠবে কোম্পানি। কেন জানি আমার মনে হচ্ছে প্ল্যান্টের ভবিষ্যত নড়বড়ে হয়ে গেছে। আমি হিসেব-নিকেশ করে দেখলাম স্টাফদের বেতনাদি দিতেই কোম্পানিকে হিমশিম খেতে হবে এখন। একমাস-দুইমাস নয়, এক-দুই বছর লোকসান গুনতে হতে পারে। ততদিন ভর্তুকি দেওয়া চাট্টিখানি কথাও নয়। সব মিলিয়ে আমি প্ল্যান্টের ভবিষ্যত নিয়ে শঙ্কিত হয়ে ওঠলাম।  

চলবে...

বিডি প্রতিদিন/ফারজানা 

সর্বশেষ খবর