৮ ডিসেম্বর, ২০২০ ১৪:০৯
১৫তম পর্ব

বনবিহারী

আলম শাইন


বনবিহারী

 বন-বনানী বা বনভূমি হচ্ছে বিভীষিকাময় এক রহস্যময়ী জগৎ। যে জগতে টিকে থাকতে হলে বুদ্ধিমত্তা আর সাহসের বিকল্প নেই। তাই বনচারীদের মাথা ঠাণ্ডা রেখেই জঙ্গলে চলাফেরা করতে হয়, জঙ্গলের নিজস্ব ভাষা বোঝার সক্ষমতা থাকতে হয়, থাকতে হয় উপস্থিত বুদ্ধিও। এসব গুণাবলী কারও মধ্যে ঘাটতি থাকলে তার পক্ষে জঙ্গলে বিচরণ করা সম্ভব নয়, বরং জঙ্গল তখন তার জন্যে অমঙ্গল ডেকে আনে। বিশ্বখ্যাত ডিসকভারি চ্যানেলের অনুষ্ঠান ‘ম্যান ভার্সেস ওয়াইল্ড’ থেকেও শিক্ষা নেওয়া যায় জঙ্গলে বিচরণ সম্পর্কে।

  জঙ্গলে অনেক সময় কিছু কিছু অতিপ্রাকৃত ঘটনাও ঘটে, যে ঘটনা বা রহস্যের সমাধান নিজ প্রচেষ্টায় বের করে নিতে হয়, না হলে জঙ্গলবাস হয়ে ওঠে বিভীষিকাময়। তেমনি অতিপ্রাকৃত দুটি ঘটনার মুখোমুখিও হয়েছিলাম, যে ঘটনার রহস্যের কূলকিনারা করতে পারিনি আজও। ঘটনা দুটি না জানালে পরিতৃপ্তি আসবে না আমার; আর এই কাহিনিটাও অস্পূর্ণ থেকে যাবে, তাই রহস্যময় সেই ঘটনা দুটি লিপিবদ্ধ করলাম।
 
  বছর খানেক আগের ঘটনা। এক দুপুরে মহব্বত দয়ালসহ চারজন শ্রমিক নিয়ে কালাবন পৌঁছলাম। কালাবনে বাসস্থানের সমস্যা হয় না এখন আর। মাস ছয়েক আগে এখানে একটা বাংলো বানিয়েছিলাম আমরা। ছোটখাটো ৩ কামরাবিশিষ্ট বাংলোটি। তদারকির কাজে আসলে সপ্তাহব্যাপী অবস্থান করতে হয় আমাকে। এছাড়াও কালাবনে ৬ জন প্রহরী অবস্থানও করছে নিয়মিত। ছিমছাম পরিপাটি বাংলোটি, বাংলোর চত্বর প্রায় দুই একর জায়গা নিয়ে বিস্তৃত। চত্বরে কিছু উঁচু উঁচু গাছপালা থাকলেও সম্পূর্ণ জঙ্গলমুক্ত চত্বরটি। বলা যায়, আগের চেয়ে অনেকটাই নিরাপদ কালাবনের বাসস্থান। তার পরেও কেউ কালাবনে অবস্থান করতে চায় না, বিভিন্ন অজুহাত দেখায়। জিজ্ঞেস করলেও সদ্বোত্তর পাওয়া যায় না কারো কাছেই। শুধু বলে, ‘ভয় লাগছে।’ কীসের ভয়, কেন ভয়, সেকথা আমাকে কেউ জানায়নি। আমিও জানতে আগ্রহী হইনি আর। কারণ এসব আমার কাছে বাহানা মনে হচ্ছিল। আসলে নির্জনে কেউই থাকতে চায় না, মূলকথা হচ্ছে সেটি। আমাদের অন্যান্য মৌজায় লোক সমাগম থাকায় সেখানে অফিস করতে সবাই আগ্রহী হলেও কালাবনের ক্ষেত্রে যত বাহানা। যাই হোক, সেসব পরে জানানো হবে, আগে ঘটনাটি জানাচ্ছি।

  আষাঢ়ের মাঝামাঝি সময়। আমরা কালাবন গিয়েছিলাম ভেষজ গাছপালা লাগিয়ে বনায়ন সৃষ্টি করতে। যাওয়ার সময় হরিতকি, বয়রা আর অর্জুনের অসংখ্য চারাগাছ সঙ্গে নিয়েছি। চারাগুলো বহন করতে আমাদের অনেক কষ্ট হয়েছে। তবে বেশিরভাগ চারা এখানে উৎপাদন করায় কষ্ট অনেকটা লাঘব হয়েছে। আমরা বর্ষায় পর্যায়ক্রমে কালাবনে ১০ হাজার ভেষজ গাছ লাগানোর পরিকল্পনা করেছি। কালাবনের দুর্ভেদ্য জঙ্গল ছেঁটে ভেষজ গাছ লাগানোই ছিল আমাদের মূল উদ্দেশ্য। যেন কালাবন ভেষজখনি হয়ে ওঠে। কালাবনের জন্য আমরা আলাদা লোকবলও নিয়োগ দিব; নিয়োগ দিব আরেকজন প্রশাসনিক কর্মকর্তাসহ কিছু প্রহরীও। লোকবল বৃদ্ধি পেলে মেঘলার অফিসের মতো কালাবনও সরগরম হবে নিঃসন্দেহে। হেড অফিসের সঙ্গে যোগাযোগ করেই আমি এ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষতি পুষিয়ে ওঠতেই আমরা বনায়নের দিকে নজর দিয়েছি। তা ছাড়া কালবনকে শঙ্কামুক্ত করার প্রয়াসও আছে আমার, অবশ্য তার আগে আমাকে জানতে হবে শঙ্কিত হওয়ার মূল কারণটি।

  বর্ষায় কালাবনে আর কখনো যাইনি, সেবারেই প্রথম গেলাম। ইচ্ছে হয়েছিল কলাবনের বর্ষার সৌন্দর্য উপভোগ করার, কাছ থেকেই বর্ষা দেখতে চাই। সেই ভাবনা ভেবেই  সেদিন অন্তর্দৃষ্টি খোলা রেখে বাংলোর বারান্দায় গিয়ে বসলাম। বারান্দায় বসতেই আমার মনটা খারাপ হয়ে গেল; ওর কথা মনে পড়ে। বর্ষা ছিল ওর প্রিয় ঋতু, তুমুল বর্ষণে মেয়েটাকে নিয়ে খোলা ছাদে ভিজতে পছন্দ করত। সেকি আনন্দ; মেয়েটাও খিলখিল করে হাসত। আজ মেয়েটার কথাও মনে পড়ছে বারবার, অনেকদিন দেখিনি ওকে। সিদ্ধান্ত নিয়েছি মেঘলায় ফিরলে যেকোনো একদিন সদরে গিয়ে সেলুরার ফোনের ম্যাসেঞ্জারের মাধ্যমে মেয়েটার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে দুই-চার কথা বলে পরাণটা জুড়াব।

  মন খারাপ করে বারান্দায় বসে রইলাম। তাকিয়ে রইলাম আকাশপানে, লক্ষ্য করলাম আকাশে শকুনি মেঘের আনাগোনা। অনুমান করলাম ভারি বর্ষণের সম্ভাবনাও। বৃষ্টিতে আমাদের কাজকর্মে বিঘ্ন ঘটেনি অবশ্য, বরং চারারোপণে সহায়ক হবে বৃষ্টিপাত; তাই বর্ষণে ভাবনা নেই আমাদের। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হতেই শ্রমিকদের দিক নির্দেশনা দিয়ে আমি বারান্দায় এসে বসলাম। এই ফাঁকে চা খাবো আর কাছ থেকে বর্ষা উপভোগ করব, উদ্দেশ্যটা এরকমই ছিল। কিন্তু হঠাৎ মনটা এলোমেলো হয়ে গেল। তার পরেও বারান্দায় বসে রইলাম। কারণ বারান্দাটা বেশ চমৎকার, ভরা জঙ্গল নজরে পড়ে বারান্দায় বসলেই।

  বারান্দার আশপাশের কয়েকটি উঁচু গাছ, গাছগুলো এখনো কাটা হয়নি, তবে বাংলো চত্বর ঝোপজঙ্গলমুক্ত। পরিবেশটা বেশ চমৎকার, সুনসান নীরব নিস্তব্ধ চারপাশ। বাংলোয় এ মুহূর্তে আমি ছাড়া কেউ নেইও, ফলে আরও নিস্তব্ধ লাগছে কালাবন। মহব্বত দয়ালও নেই; আমার সামনে একমগ কফি রেখে সে পুকুরে গিয়েছে গোসল করতে। বাংলোর পাশেই পুকুর, কাজেই গোসলাদি করতে কারও সমস্যা হয় না। খাল-নদী খানিকটা দূরে বিধায় বাংলোটা পুকুরের কাছাকাছি বানিয়েছিলাম পরিকল্পনা করেই। 

  সুনসান নীরবতার মধ্যেই বারান্দায় একাকী বসে আছি আমি। এমনি সময় কানে এল পাখির ক্ষীণ কণ্ঠস্বর। উঁকিঝুকি মেরে আবিষ্কার করলাম পাখির অবস্থান বারান্দা লাগোয়া সেগুন গাছের ডালে। দুটি কাঠশালিক বসে খুঁনসুটি করছে, আর ফাঁকে ফাঁকে সেগুন ফুলের মধু ও পোকামাকড় ধরার চেষ্টা করছে। সেগুনগাছে তখন প্রচুর ফুল এসেছিল, ময়লাসাদা ফুলগুলো দেখতে নক্ষত্র আকৃতির। হালকা মিষ্ট সৌরভ ভেসে আসছিল ফুলগুলো থেকে। ফুলের ওপর মৌমাছিদের আনাগোণাও লক্ষ্য করলাম, তার মানে আশপাশে মৌচাকও আছে। মৌচাক থাকলে মৌয়ালদেরও যাতায়াত থাকতে পারে। আমি চাই কালাবন মুখরিত হয়ে উঠুক। তাহলে আমাদের বনকর্মীরা এখানে অবস্থান করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবে।

  পাখির কাকলিতে আমি খানিকটা মুগ্ধ হলাম। এ নির্জনে দুটি পাখি আমার চিত্তে প্রশান্তি এনে দিল মুহূর্তেই। বড়ই আপন মনে হচ্ছিল ওদেরকে মেঘাচ্ছন্ন নির্জন সেই দুপুরে। তখন আমার বোধগম্য হলো কেন কালাবনে লোকজন থাকতে চাচ্ছে না। যতটুকু অনুধাবন করতে পারলাম আমি, তা হচ্ছে ওখানকার নির্জনতাই মূলত সবাইকে ভয় পাইয়ে দিচ্ছে। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম খুব দ্রুত জনবল বাড়াবো এই বাংলোতে। প্রয়োজনে শ্রমিকদের পরিবার-পরিজন নিয়ে থাকার ব্যবস্থাও করে দিব। তাতে কোম্পানির লাভ বৈ লোকসান হবে না। কোলাহল বাড়লেই কালাবন শঙ্কামুক্ত হবে।

  আমি যখন নানান বিষয় নিয়ে ভাবছিলাম, ঠিক তখনি মহব্বত দয়াল বাংলোয় এল। ও বারান্দায় এসেই আমাকে বলল, ‘বড়মিয়া, কালাবনে মনে হয় আমাদের কর্মীরা ছাড়াও অন্য কেউ পরিবার-পরিজন নিয়ে বাস করে।’

  ওর কথা শুনে আমি বিস্মিত হলাম। আরে আমি তো ওটাই ভাবছিলাম, আর সেই কথাটাই ও বলে ফেলল! বললাম, ‘কেন এমন মনে হলো তোমার। আমি যতদূর জানি কালাবনে জনবসতি নেই। শুধু কালাবন কেন, আমাদের প্ল্যান্টের কোথাও কারো বসতি নেই, আর তোমার ভাবনা দেখছি সম্পূর্ণ বিপরীত। বিষয়টা আমাকে খুলে বল দয়াল।’

  মহব্বত দয়াল এবার বিপাকে পড়ে গেল। কী বলতে কী বলেছে, এখন সেটি গুছিয়ে বলতে পারছে না আর। তবে আমি নিশ্চিত সে মিথ্যে তথ্য দেয়নি। প্ল্যান্টে যদি একজন সত্যবাদী মানুষ থেকে থাকে, তাহলে সে-ই হচ্ছে মহব্বত দয়াল। কেন এমন উপাধি দিলাম সেটাও বলছি। যেমন কেউ একজন আমাকে জিজ্ঞেস করল, “আপনি কেমন আছেন?” বললাম, “ভালো আছি।” আসলে আমি ভালো নেই। অথচ কথায় কথায় তো বলে ফেললাম ভালো আছি। মহব্বত দয়াল কথায় কথায়ও এমন জবাব দেয় না। ভালো থাকলে বলবে ভালো, না থাকলে যা সত্যি তা-ই বলবে। অর্থাৎ সত্যবাদীদের একজন সে, তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। কাজেই সে যখন বলেছে বা অনুমান করেছে লোকজনের বসতি আছে, তাহলে কথাটা একেবারেই উড়িয়ে দিতে পারি না আমি। কারণ আমি তার কাছেই শিখেছি মিথ্যে ভালো থাকার অভিনয় করতে নেই।

   মহব্বত দয়ালকে চুপচাপ থাকতে দেখে আমি পুনরায় বললাম, ‘বিষয়টা তোমার অনুমান নির্ভর হলেও আমাকে বিস্তারিত জানাও।’

  মহব্বত দয়াল বলল, ‘অনুমান নির্ভর নয় বড়মিয়া, সত্যিই বলছি কালাবনে কেউ না কেউ পরিবার নিয়ে থাকে। আমি পুকুরে নামার আগে শিশুকণ্ঠের হাসির আওয়াজ শুনেছি। আমার মনোযোগ গোসলে থাকায় আর দেখে সারলাম না।’
  ‘বলো কি!’
  ‘সত্যি বলছি বড়মিয়া।’
  আমাকে না জানিয়ে কেউ জঙ্গলে বসতি গড়বে, তা ভাবতেও আমি অবাক হলাম। বিষয়টা বিশ্বাস করতেও আমার কষ্ট হচ্ছে। আবার বিশ্বাস না করেও পারছি না, জানিয়েছে মহব্বত দয়াল, সুতরাং বিশ্বাস করতেই হচ্ছে। আবার মনে মনে ভাবলাম, মহব্বত দয়াল ভুল শুনেনি তো। অনেক সময় অবচেতন মনে অনেক কিছুই ঘটে যায়, সেরকম কিছুও তো ঘটতে পারে। আমি মহব্বত দয়ালের উদ্দেশ্যে বললাম, ‘ধরে নিলাম জঙ্গলে কারো বসতি আছে, কিন্তু এ ভরা জঙ্গলে কীভাবে বাস করা সম্ভব দয়াল?’
  মহব্বত দয়াল বলল, ‘বড়মিয়া, আমাদের লোকজনের কাছ থেকে জেনে নেই আগে, আসলেই কেউ বসতি করছে কীনা।’
  বললাম, ‘মন্দ বলনি, রাতে ওদেরকে জিজ্ঞেস করব। আর দুই একদিন বাদে আমরা জঙ্গল ঘুরে দেখব বিষয়টা কতটুকু সত্য।’ 

  সেরাতে আর শ্রমিকদেরকে কাছে ডাকিনি। ওরা সারাদিন কাজকর্ম করে ক্লান্ত শরীর নিয়ে দ্রুত ঘুমিয়ে পড়েছে, তাই আর বিরক্ত করলাম না। সপ্তাহ খানেক যেহেতু এখানে থাকব, না হয় অন্যদিন জেনে নিবো সবকিছু। 

  রাত অনেক হয়েছে; মধ্যরাত তখন। সবাই ঘুমিয়ে পড়লেও আমি তখনো ঘুমাইনি; মনোযোগ সহকারে পুরানো খবরের কাগজ পড়ছি। রাত ১০টা নাগাদ মহব্বত দয়াল এসে আমার মশারি টানিয়ে দিয়ে পাশের কামরায় ঘুমাতে গেছে। যাওয়ার সময় বলে গেছে, প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে গেলে যেন তাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে নেই; একা যেন না বেরোই; সতর্কও করে গেছে।

  ঘণ্টা দুয়েক কাগজ পড়তেই আমার প্রচণ্ড ঘুম পাচ্ছিল, বসে থাকতে পারছিলাম না আর। শোয়ার প্রস্তুুতি নিচ্ছিলাম তাই। সমস্যা হচ্ছে শোয়ার আগে প্রকৃতির ডাকে (মূত্রত্যাগ) সাড়া দিতে হয় আমাকে। এই অভ্যাসটা আমার দীর্ঘদিনের, না হলে ঘুমই আসতে চায় না। কী করি এখন, টয়লেটটা আবার কীনা নিচে।

  মহব্বত দয়ালকে ঘুম থেকে জাগাতে আমার বিবেক সায় দেয়নি, যদিও সে আমাকে জাগাতে বলে গেছে। আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে টর্চ জ্বেলে আগে বাংলো চত্বরের চারপাশ দেখে নিলাম। নিরাপদ মনে হওয়ায় মহব্বত দয়ালকে আর না জাগিয়ে টর্চ নিয়ে একাই নিচে নামলাম।

  টয়লেটে প্রবেশ করেই ছিটকিনিটা লাগিয়ে দিলাম আমি। রাতবিরাতে ছিটকিনিটা না লাগালেও পারতাম; এটি হচ্ছে বাড়তি সতর্কতা। বলা যায় না, কখন হিংস্রপ্রাণীর আগমন ঘটে আবার। তাই আমি বনভূমিতে অবস্থানকালীন সময় সতর্ক থাকতে চেষ্টা করি সবসময়; যেমনটি আজও।

  টয়লেটের কাজ প্রায় শেষ হয়ে এল, অমনি শুনতে পেলাম ধুপধাপ পায়ের আওয়াজ। কানখাড়া হয়ে গেলো আমার। আওয়াজের উৎসস্থল খোঁজার চেষ্টা করলাম। কিছুক্ষণ কানখাড়া রাখতেই বুঝতে পারলাম আওয়াজের উৎসস্থল বাংলো চত্বরেই। আওয়াজটা কিসের হতে পারে! প্রহরীদের বুটের আওয়াজের মতো কানে লাগল। মনে হচ্ছিল পিটি প্যারেড করছে ওরা। প্রশ্নবিদ্ধ হলো মনে এতরাতে ওরা পিটি প্যারেড করবে কেন? আমি বিস্মিত হলাম, পাশাপাশি আমার রাগও হলো। এটা কেমনতর শৃঙ্খলা; মধ্যরাতে পিটি প্যারেড! যুদ্ধবিগ্রহ লেগে গেলো নাকী দেশে, যে রাতেই প্রস্তুুতি নিতে হবে। টয়লেট থেকে বেরিয়ে দু-চার কথা শুনাবো মনে মনে ঠিক করলাম।

  টয়লেট থেকে বেরোনোর আগে কৌতূহলবশত: দরজার ফাঁক দিয়ে আমি বাইরে তাকালাম। বাইরে তাকাতেই আমি হতবাক হলাম, না কেউ নেই বাংলো চত্বরে। যদিও আঁধাররাত, তথাপিও বুঝতে পারলাম কেউ নেই; থাকলে আলো নজরে পড়ত। আঁধারে তো কারো পিটি প্যারেড করার কথা নয়। আমি ভয়কে গেলাম এবার, টয়লেটের বাইরে পা ফেলতে পারছি না আর, ভেতরেই দাঁড়িয়ে রইলাম তাই। ভেতরে দাঁড়িয়েই শুনতে পাচ্ছিলাম পিটি প্যারেডের আওয়াজ। কেন জানি আমার মনে হচ্ছে আওয়াজটা আসছে টয়লেটের দরজার বিপরীত দিক থেকে। অর্থাৎ বিষয়টা খতিয়ে দেখতে হলে আমাকে টয়লেটের বাইরে বেরিয়ে আসতে হবে। কি করি এখন? কতক্ষণই বা টয়লেটবন্দী থাকবো। কাউকে যে ডাকবো সে শক্তিও আমার কণ্ঠে নেই, কণ্ঠ চেপে আসছে যেন; এতটাই ভয় পাচ্ছিলাম আমি। ভয়ে আমার হাত পা কাঁপছে, মনে হচ্ছে এক্ষুণি হাত থেকে টর্চটা পড়ে যাবে। 

  মিনিট পাঁচেক দাঁড়িয়ে রইলাম ভেতরে, মশার ঝাঁক ঘিরে ধরছে আমাকে। কতক্ষণই বা দাঁড়িয়ে থাকবো আর এখানে। সাত-পাঁচ ভাবছিলাম, তেমনি মুহূর্তে শুনতে পেলাম আওয়াজটা ধীরে ধীরে বাংলোচত্বর থেকে মিলিয়ে জঙ্গলের দিকে ধাবিত হচ্ছে। কয়েক মিনিটের মধ্যে আর শুনতে পেলাম না, সম্পূর্ণ মিলিয়ে গেছে। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম একলাফে টয়লেট থেকে বেরিয়ে বাংলোর সিঁড়িতে লাফিয়ে ওঠবো। টয়লেট থেকে সিঁড়ির দূরত্ব কয়েক ফুট মাত্র। এ ছাড়া এই মুহূর্তে অন্য কিছু ভাবতেও পারছি না। না হলে সারারাত দাঁড়িয়ে থাকতে হবে টয়লেটের ভেতর। ভেবেচিন্তে আমি এক ঝটকায় দরজা খুলে লাফিয়ে সিঁড়ির ওপর ওঠলাম। তার পর পেছনে আর না তাকিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠে এলাম। বারান্দায় পৌঁছতেই এবার সাহস সঞ্চয় হলো আমার। বারান্দায় দাঁড়িয়ে টর্চ মেরে চারদিকে এক ঝলকে দেখে নিলাম; কাউকে দেখলাম না, শুনলাম না আর সেই আওয়াজও।

  তার পর আমি প্রহরীদের কামরার জানালায় ধাক্কা দিয়ে দেখলাম সবাই ঘরে আছে কীনা। টর্চ মেরে দেখলাম, সবাই বেঘোরে ঘুমাচ্ছে; মহব্বত দয়ালও। আমার টর্চের আলোকরশ্মিতে ওদের চোখের পাপড়ি সামান্যও নড়েনি, এতটাই বেঘোরে ঘুমাচ্ছিল ওরা। প্রহরী কিংবা শ্রমিকদের আর বিরক্ত করলাম না। আমি আমার কামরায় দ্রুত প্রবেশ করে দরজার খিড়কিটা লাগিয়ে বিছানায় এসে বসলাম। আমার ভয় কাটছে না এখনো, শরীর ঘামছে। নিচে নামার সময় হারিকেনটা নিভু নিভু করে জ্বালিয়ে গিয়েছিলাম। সেই ক্ষীণ আলো আরও ভয়ের উদ্রেক ঘটালো আমার। দ্রুত হারিকেনের আলো বাড়িয়ে দিলাম। এবার কামরা আলোকিত হলেও তা আমার ভয় কাটানোর জন্য যথেষ্ট নয়।
 
  হারিকেন জ্বালানো রেখেই আমি শুয়ে পড়লাম। উৎকণ্ঠায় আমার ঘুম উধাও। জোর করে চোখের পাতা জড়ো করার চেষ্টা করলাম, পারলাম না; কানে ভেসে আসছে সেই আওয়াজের প্রতিধ্বনি। ভাবতে লাগলাম আওয়াজটা কিসের শুনলাম। তবে কি বুনো মহিষের দল ঢুকেছে বাংলোর চত্বরে, কিন্তু মহিষের পদধ্বনি তো পিটি প্যারেডের মতো নয়। তাহলে কি ভুল কিছু শুনলাম? হতেও পারে। কারণ মানুষের অবচেতন মনে অনেক কিছুই ঘটে, সেরকম কিছুই হবে হয়তো। ভাবতে ভাবতে কখন যে রাত পেরিয়ে গেলো তা টেরই পেলাম না। সকালে সামান্য তন্দ্রা এলেও যথাসময়ে বিছানা ত্যাগ করলাম। শোয়া থেকে উঠেও আমি বিষয়টা নিয়ে ভাবতে লাগলাম; হিসেব মিলাতে পারছি না। তথাপিও বিষয়টি আমি কারো সঙ্গে শেয়ার করিনি। কারণ এমনিই সবাই ভয়ে তটস্ত, তার ওপর যদি এসব অমূলক কাহিনি ফেঁদে বসি তাহলে সবাই কালাবন ছেড়ে পালিয়ে যাবে। 
 
চলবে...

বিডি প্রতিদিন/ফারজানা

সর্বশেষ খবর