২২ ডিসেম্বর, ২০২০ ১৪:২১
১৭তম পর্ব

বনবিহারী

আলম শাইন


বনবিহারী

  কদিন ধরে আমার শরীরটা ভালো যাচ্ছে না; শরীরে সবসময় ১০২-১০৩ ডিগ্রি জ্বর থাকছে। খাবারে অরুচি ধরেছে; ভালোমন্দ খেতে পারছি না; হাঁটাচলা করতে কিংবা পেপার পুস্তক পড়তে ভালো লাগছে না। সারাদিন বাংলোয় শুয়ে বসে কাটাই। অথচ আমি প্রতিদিনই বনপ্রান্তরে চষে বেড়ানোর মানুষ। মূলত শারীরিক দুর্বলতার কারণেই শয্যাশায়ী হয়েছি। নিয়মিত খাওয়াদাওয়া করতে পারলে হাঁটাচলায় সমস্যা হতো না। দুইবেলায় দুই গ্লাস মহিষের দুধ আর বড়জোর দুইপিস রুটির সঙ্গে সামান্য সবজি খেয়ে সপ্তাহ পার করেছি। ভাত খেতে পারছি না, জিভের ডগায় তিতা লাগছে। তার ওপর ভাত মুখে দিলে বমির উদ্রেক হয়। ভাবছি দুই একদিনের মধ্যেই সদরে গিয়ে ডাক্তার দেখাব। আপাতত শুধু প্যারাসিটামল গ্রুপের কিছু ওষুধপত্র খাচ্ছি। ডাক্তার দেখানো ছাড়াও আমাকে সদরে যেতে হবে জরুরি ভিত্তিতি। মাহুত মোহন মাঝি হাসপাতালে ভর্তি আছে। দুর্বৃত্তরা ওকে চুরিকাঘাত করে মারাত্মক জখম করেছে। ওর শারীরিক অবস্থা তেমন ভালো নয়। আমি হয়তো শীঘ্রই সেরে ওঠব; ঠাণ্ডা জ্বরে কাবু হয়েছি সামান্য, সেরে ওঠতে বেশি সময় লাগবে না। কিন্তু মোহন মাঝির অবস্থা যে কী হবে, সেই চিন্তাই করছি রাতদিন বিছানায় শুয়ে বসে।

হাসপাতালে গিয়ে যদি মোহন মাঝির অবস্থার উন্নতি না দেখি, তাহলে তাকে চিকিৎসার জন্য দ্রুত ঢাকা পাঠানোর ব্যবস্থা করব, আমি সিদ্ধান্তটা নিয়ে ফেলেছি। 
  
এদিকে আরেকটি সমস্যায় পড়েছি মায়ারানীকে নিয়ে, বলা যায় বিপাকে পড়েছি। মাহুতকে না দেখে মায়ারানী অস্থির হয়ে ওঠেছে। ওর খাওয়াদাওয়া প্রায় বন্ধ, খাবার খেলেও যৎসামান্য খায়। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, মায়ারানীর কাছে এখন কেউ ঘেঁষতেও পারছে না। খুব রাগ দেখায়; পারলে তেড়ে আসে ভাবসাব এমনি ওর। সোজাকথা ওকে সামলানোই এখন দায়। ভাগ্যিস মাহুত আহত হওয়ার আগেই ওর পায়ে শিকল লাগিয়ে ছিল। সেই শিকল এখনো পায়ে লাগানো আছে। না হলে এখন ভীষণ সমস্যায় পড়ে যেতাম আমরা, শিকল লাগানো মুশকিল হতো, কাজটি আমাদের দ্বারা সম্ভবই হতো না। বন্ধু মাহুতকে না দেখে শান্ত মায়ারানী এখন প্ল্যান্টের জন্য ত্রাস হয়ে ওঠছে। পায়ে শিকল লাগানো না থাকলে এতদিনে দুই-একটা দুর্ঘটনা ঘটিয়ে ফেলত হয়তবা। অবশ্য মাহুতকে দেখলে এখনো সে আগের মতোই শান্ত হয়ে যাবে, এ আমি হলফ করেই বলতে পারি। সেই বিষয়ে বিস্তারিত পরে জানাচ্ছি, তার আগে মোহন মাঝি আহত হওয়ার ঘটনাটা খুলে বলছি, তাহলেই বোধ করি মায়ারানী অশান্ত হয়ে ওঠা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে।

  দুই দিন আগের ঘটনা। রাত তখন প্রায় ৮টা বাজে। আমি বিছানায় শুয়ে জ্বরে চটপট করছি, মহব্বত দয়াল আমার কপালে জলপট্টি লাগিয়ে তাপমাত্রা কমাতে চেষ্টা করছে। অমনি মুহূর্তে প্রহরীপ্রধান তৈমুর আলী এসে জানাল মোহন মাঝিকে দুর্বৃত্তরা চুরিকাঘাত করেছে, ওর অবস্থা নাকি আশঙ্কাজনক। বিস্তারিত আর জানতে পারলাম না তৈমুর আলীর কাছে, সে দুঃসংবাদটা জানিয়েই ঘটনাস্থলে দ্রুত ছুটল। আমি আর বাধা দেইনি, যদি দুর্বৃত্তদের আটকানো যায়।

  দুঃসংবাদটা শুনার সঙ্গে সঙ্গে আমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। বৃত্তান্ত জানতে পারলে এতটা উদ্বিগ্ন হতাম না হয়তো; মাথায় কিছুই ঢুকছে না এ মুহূর্তে। বুঝতে পারছি না কার এতবড় সাহস হয়েছে যে প্ল্যান্টের লোকজনকে চুরিকাঘাতে জখম করেছে। এলাকার নেতৃত্বস্থানীয়দের আমরা ম্যানেজ করে চলি সবসময়। কোম্পানির নির্দেশ রয়েছে কোন ধরনের সাহায্য সহায়তা চাইলে যেন কাউকে ফিরিয়ে না দেই। সুতরাং আমাদের সঙ্গে তাদের সুসম্পর্ক শুরু থেকেই আছে। না হলে এত বিশাল আয়তনের প্ল্যান্ট চালানোই দায় হতো। ঘটনাটা যদি দিনে ঘটত, আর সেটি এলাকার লোকজনের কানে পৌঁছত, তাহলে তারাও দলবল নিয়ে হাজির হতো, এটা নিশ্চিত বলতে পারি। সে কথা পরে জানানো হবে; এ মুহূর্তে জানতে হবে কারা ঘটনা ঘটিয়েছে, কেন ঘটিয়েছে সেসব তথ্য।

  দুঃসংবাদটা শুনে আমি আর বিছানায় শোয়ে থাকতে পারলাম না, বহুকষ্টে উঠে দাঁড়ালাম। দাঁড়াতেই দেখি আমার মাথাটা চক্কর দিচ্ছে। মহব্বত দয়াল আমাকে বারবার বারণ করছে আমি যেন বিছানা ছেড়ে না উঠি, সে গিয়ে বিস্তারিত জেনে আসবে বলল। এমতাবস্থায় আমি বিছনায় শোয়ে থাকতে পারিনি আর। অবশ্য শোয়ে থাকার মানুষ নই আমি, আমার স্টাফ জখম হয়েছে আর আমি দেখতে যাব না, সে কোন মতেই হয় না। যত কষ্টই হোক আমি ওর কাছে যাব; নিজ চোখে দেখব; বৃত্তান্ত শুনবো। তার পর যা করণীয় তাই করব।

  হাতে টর্চ নিয়ে আমি ধীরে ধীরে নিচে নেমে এলাম। দেখলাম প্রহরীরা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে উল্কাবেগে ঘটনাস্থলে দৌড়াচ্ছে। আর কয়েকজন মোহন মাঝিকে ধরাধরি করে বাংলোর চত্বরে এনে চাটাইতে শুইয়ে দিয়েছে। দেখলাম মোহন মাঝির সমস্ত শরীর রক্তে ভেজা। মাথায় আর পিঠে চুরিকাঘাত করেছে দুর্বৃত্তরা। এখনো রক্ত ঝরছে শরীর থেকে। কয়েকজন চেষ্টা করেও রক্তঝরা বন্ধ করতে পারছে না। শরীরের চুরিকাঘাতের চিহ্নগুলো ততটা গভীর না হলেও মাথার দুইটা কোপে মারাত্মক জখম হয়েছে। খারাপ কিছু ঘটলে মাথার কোপ দুইটার কারণেই ঘটতে পারে।

  এমতাবস্থায় স্টাফদের অনেকেই হুঁশ হারিয়ে ফেলেছে, কী করবে না করবে বুঝে ওঠতে পারছে না। শ্রমিকদের একজন দৌড়ে গিয়ে হলুদের গুঁড়া এনে মোমিন মাঝির মাথায় লাগিয়ে গামছা প্যাঁচিয়ে বেঁধে দিলো। তাতে কয়েক সেকেন্ডের জন্য রক্তঝরা বন্ধ হলেও পুনরায় রক্ত ঝরতে শুরু করল। এই মুহূর্তে কী করার আছে তা আমার মাথাও ঢুকছে না। হুঁশ হারিয়ে ফেলেছি আমিও। ওর চিকিৎসার ব্যবস্থা না করে কেবল হাহুতাশ করছি। বিষয়টা বিনয় ভৌমিক বুঝতে পেরে আমাকে ধরে সেখান থেকে সরিয়ে নিয়ে এল। এদিকে মোমিন মাঝি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে প্রায়। সে কথা বলতে পারছে না; ক্রমশ অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছে। আমারও মাথা অনবরত চক্কর দিচ্ছে। তার পরেও বুদ্ধি করে বললাম, ‘বিনয়, ওকে  ট্রলারে করে সদরে নিয়ে যাও।’

  ধীরে ধীরে আমার হুঁশ ফিরে এলে মোমিন মাঝির সঙ্গে থাকা প্ল্যান্টের ট্রলার চালককে বললাম, বিস্তারিত জানাতে। সে জানাল বিস্তারিত।

  ঘটনার কিছুক্ষণ আগে মোহন মাঝি প্ল্যান্টের ট্রলার ঘাটে গিয়েছে। ট্রলার চালকের সঙ্গে মোমিন মাঝির খুব সখ্যতা; বন্ধুত্বও আছে। প্রতিরাতে ওরা দুইজন একত্রে ট্রলারে রাতযাপন করে। ট্রলারে বিছানাপত্র বিছিয়ে রাতযাপনের ব্যবস্থা করেছে।

  সন্ধ্যায় মায়ারানীর পরিচর্যা শেষ করে যথাসময়ে মোমিন মাঝি বন্ধুর কাছে চলে যায়। দুইজনে গল্পগুজব করে সময় কাটায়; আর রাতে ট্রলারেই ঘুমায় দুইজন। এতে তাদের খানিকটা সুবিধা হয়; একা থাকতে হয় না কারোই। আমিও বিষয়টা ইতিবাচক হিসেবে নিয়েছি। ট্রলার চালক রাতে একা থাকলে চোর-ডাকাত তার ক্ষতি করতে পারে, দুইজন একত্রে থাকলে সুবিধা হবে। অপরদিকে হাতিশালার পাশে মাহুতের থাকার ব্যবস্থা রয়েছে ঠিকই কিন্তু একা রাতযাপনে কষ্ট হয়। কাজেই ওরও সুবিধা হয় ট্রলারে ঘুমালে। ট্রলারঘাট বাংলো থেকে খুব বেশি দূরে নয়, কাছাকাছি।

  ট্রলারটা আমরা খালে না রেখে সবসময় নদীর পারে বেঁধে রাখি। কারণ খালের জল ভাটায় একেবারেই শুকিয়ে যায়, ওই মুহূর্তে  ট্রলারের প্রয়োজন হলে বিপাকে পড়তে হয়, তাই অপেক্ষাকৃত চওড়া নদীতে ট্রলার রাখার ব্যবস্থা করেছি।

  রাতে মোহন মাঝি আর ট্রলার চালক ট্রলারে বসেই ধূমপান করছিল। দূর থেকে সিগারেটের আলো নজরে পড়েছে আরেক ট্রলারে থাকা দুর্বৃত্তদের। ওরা ওদের ট্রলার নিয়ে কাছে এসে সিগারেট জ্বালাতে দিয়াশলাই চাইল। দিয়াশলাই আদান-প্রদান মুহূর্তে দুর্বৃত্তদের ৩ জন লাফিয়ে ওঠল আমাদের ট্রলারে। ট্রলারে ওঠেই প্রথম চালককে ধাক্কা মেরে নদীতে ফেলে দিলো দুর্বৃত্তরা। তার পর মোহন মাঝিকে ধাক্কা দিলো, কিন্তু ওকে নদীতে ফলতে না পেরে ধস্তাধস্তি আরম্ভ করল, এক পর্যায়ে উপর্যুপরি চুরিকাঘাত করতে লাগল মোহন মাঝিকে। ওই অবস্থায়ই ইঞ্জিন চালু দিয়ে মোহন মাঝিকেসহ ট্রলার নিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ নিলো। অমনি মুহূর্তে আমাদের চালক নদীর পারে ওঠে জোরে চেঁচাতে লাগল। চালকের চেঁচানিতে নদীতে চলাচলরত আরেকটি ট্রলার এগিয়ে আসতেই দুর্বৃত্তরা আমাদের ট্রলারটা রেখে পালিয়ে গেল। মোটামুটি এই ছিল সেই রাতের ঘটনা।

 মোমিন মাঝিকে সে রাতেই প্ল্যান্টের ট্রলারযোগে সদর হাসপাতালে পাঠিয়ে দিলাম। স্প্রিডবোটেই পাঠাতাম, রাতে স্প্রিডবোটে যাতায়াত সম্ভব নয় বিধায় ট্রলারেই পাঠাতে বাধ্য হলাম। সঙ্গে পাঠালাম বিনয় ভৌমিককে। বলে দিলাম মোমিন মাঝির যেন চিকিৎসায় গাফিলতি না করা হয়। চিকিৎসার ব্যয়ভার প্ল্যান্ট থেকেই বহন করা হবে, ব্যক্তিগতভাবে আমিও সহযোগিতা করব। সুতরাং ওকে আমি সম্পূর্ণ সুস্থ দেখতে চাই, এটাই আমার শেষ কথা।

  শুনেছি মোমিন মাঝির অবস্থা অপরিবর্তনীয়। তাই স্থির করলাম সদর হাসপাতালে গিয়ে ওকে দেখে আসবো; পাশাপাশি আমিও ডাক্তার দেখাব। শরীর খারাপ না থাকলে ওর সঙ্গে সেরাতে আমিই যেতাম। বিনয় ভৌমিকের যাওয়ার প্রয়োজন হতো না আর।

 এখন যে সমস্যার মুখোমুখি হলাম তা হচ্ছে মায়ারানীকে নিয়ে। খুব উত্তেজিত মায়ারানী; পারলে শিকল ছিঁড়ে মোমিন মাঝিকে খোঁজতে বের হয়। ভয়ে কেউ ওর কাছে ঘেঁষতে চাইছে না। দূর থেকে কলাগাছ ছুঁড়ে মারে। সেই মুহূর্তে মায়ারানী গগনবিদারী গর্জন করে সবার পিলে চমকে দেয়। তাছাড়াও রাতদিন গর্জন করতে থাকে, তাতেও ভীষণ সমস্যা হয়। উচ্চ আওয়াজের কারণে বাংলোয় থাকা কষ্ট হয়ে পড়ে।

 ওইদিন আমার শরীরটা একটু ভালো যাচ্ছিল। জ্বর কমে আসায় খাবারে সামান্য স্বাদ অনুভব করলাম। সকালের নাস্তা সেরে মহব্বত দয়ালকে জানালাম আজ স্প্রিডবোটে সদরে যাব মোহন মাঝিকে দেখতে, সে যেন সবকিছু ঠিকঠাক করে রাখে, সেই নির্দেশনাও দিয়ে রাখলাম।

  সদরে যাওয়ার আগে মায়ারানীকে একটু দেখার ইচ্ছে হয়েছে আমার। আমি জানি মোহন মাঝি আমার কাছে মায়ারানী সম্পর্কে জানতে চাইবে। তখন কী জবাব দিব না দেখে গেলে, তাই নিজ চোখে দেখতে ইচ্ছে হলো।

   হাতিশালার কাছে যাওয়ার আগে মহব্বত দয়ালকে বললাম, ‘মায়ারানীর কাছে যাব, বড় এক ঠোঙ্গা বাদাম নিয়ে আস।’

 মহব্বত দয়াল বলল, ‘বড়মিয়া ওর কাছে না যাওয়াই ভালো। খুব তেজ দেখায়।’
 বললাম, ‘দেখা যাক কী হয়, তুমি বাদাম নিয়ে আস।’

  মহব্বত দয়াল বাদামের ঠোঙ্গা আনতেই আমি হাতিশালার দিকে রওয়ানা দিলাম। হাতিশালায় গিয়ে দেখি মায়ারানী দাঁড়িয়ে আছে ঠিকই, তবে ওর মেজাজ মর্জি তেমন ভালো না, রুক্ষ দেখাচ্ছে। সামনে কলাগাছ রেখে গেছে শ্রমিকেরা, সামান্য খেয়েছে বাদবাকি পড়ে আছে। এমতাবস্থায় ওর কাছে যাওয়া ঠিক নয়; দূর থেকে বাদামের ঠোঙ্গাটা ছুঁড়ে দিলাম তাই। তাতে অনেকগুলো বাদামও ছিটকে পড়েছে। লক্ষ্য করলাম মায়ারানী বাদামের ঠোঙ্গার দিকে নজর দেয়নি। ওর চোখের কোণ বেয়ে জলের ধারা নামছে। দৃশ্যটা আমাকে খুব পীড়া দিয়েছে। আমি দূর থেকে বললাম, ‘মায়ারানী মন খারাপ করিস না। আমি তোর বন্ধুকে আনতে যাচ্ছি, সে খুব অসুস্থ। তুই এখন খাওয়াদাওয়া কর।’ আমি কথা শেষ করে ওকে একটু আদর করতে চাইলাম, মহব্বত দয়াল খপ করে আমার হাত চেপে ধরে বলল, ‘বড়মিয়া আপনি কাছে যাবেন না, ওর মেজাজমর্জি ভালো না।’

  বললাম, ‘ওকে বোধহয় আমি বুঝাতে পেরেছি, দেখ না আগের চেয়ে শান্ত দেখাচ্ছে।’

 মায়ারানী শুঁড় উঁচিয়ে একটা আওয়াজ করল। আওয়াজটা আমার কাছে আর্তনাদের মতো মনে হলো। সে যে এখন শান্ত তাও আমি বুঝতে সক্ষম হলাম। দীর্ঘদিন থেকেই আমি মায়ারানীকে চিনি, তাই আমার সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগালাম মনের সঙ্গে যোগ-বিয়োগ দিয়ে। সাহস করে আমি কাছে এগিয়ে গেলাম, মায়ারানী চুপচাপ। ক্ষিপ্ত হলে কাছে যাওয়ার আগেই গর্জন করত অথবা মায়ারানী তেড়ে আসত। দুইয়ের কিছুই যখন করেনি তখন আমি নিশ্চিত মায়ারানী আগের মতো আচরণ করবে আমার সঙ্গে। আরেকটি কথা বলে রাখি, পশুরা অভিনয় করতে জানে না, ওদের হিংস্রতা চোখে মুখে ফুটে ওঠলেও তা লুকিয়ে রাখতে পারে না, প্রকাশ পায়। মানুষ তার হিংস্রতাকে লুকিয়ে রাখতে পারে, যা সুযোগে যথাযথভাবে প্রয়োগও করে।

  সবকিছু মাথায় নিয়ে আমি নিশ্চিত হয়েই এগুচ্ছি। বলে রাখি, মাহুতের পরে মায়ারানীর সখ্যতা আমার সঙ্গেই বেশি। প্রায়ই বাদাম খেতে আসত আমার কাছে। বাংলোর নিচে এসে হাঁকডাক দিতো, বাদামের ঠোঙ্গা নিয়ে নিচে নামলে তবে সে শান্ত হতো। এতে করে ওর সঙ্গে আমারও বেশ সখ্যতাও গড়ে ওঠেছে।

  আমি একপা দুইপা করে ওর কাছে গিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে আবার মাহুতের অসুস্থতার কথা জানালাম। জানি না ও কী বুঝল, এবার দেখলাম শুঁড় দিয়ে প্যাঁচিয়ে বাদাম খাচ্ছে। আমি খুব খুশি হলাম, ওকে অনেক আদর করলাম। বললাম, ‘মায়ারানী তুই ঠিক মতো খাবার খাবি, আমি তোর বন্ধুকে দ্রুত নিয়ে আসব।’

  হাতিশালা থেকে বেরিয়ে আর দেরি করিনি, সোজা স্প্রিডবোটের উদ্দেশ্যে হাঁটতে লাগলাম। প্রায় সপ্তাহ খানেক নদীর পারে আসেনি; ঘুরাফেরা করিনি বনপ্রান্তরেও। কেমন জানি অচেনা লাগছে আজ বনপ্রান্তরটাকে। মাত্র সপ্তাহের ব্যবধানে প্রকৃতিতে বিশাল পরিবর্তন এসেছে, বৃক্ষরাজি, তরুলতা চিকচিক করছে। পাতাগুলো গাঢ় সবুজ রঙ ধারণ করেছে। আষাঢ়ি লতা, কুঁচ লতা, স্বর্ণলতা শাখা প্রশাখা বিস্তার করেছে। ফণাতোলা সাপের জিভের মতো লতাগুলো লকলক করছে আরও বিস্তৃত হতে। মূলত কার্তিকের টানা বৃষ্টিতেই বৃক্ষরাজি যৌবন ফিরে পেয়েছে। বৃক্ষরাজির দিকে কৌতূহলী হয়ে তাকাতে তাকাতে কখন যে স্প্রিটবোটে গিয়ে বসলাম টের পাইনি আর।

  স্প্রিডবোট ছাড়তেই ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই আমরা হাসপাতালে পৌঁছালাম। আমাকে দেখে মোহন মাঝির স্ত্রী ভেউ ভেউ করে কেঁদে দিলো। তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললাম, ‘ওর কোন সমস্যা হবে না, সারিয়ে তোলার সব ব্যবস্থাই আমি করব। আর তোমাদের সংসারের দায়িত্বভার কাঁধে নিলাম আমি। আশা করি, চিন্তামুক্ত থাকবে তোমরা।’

  তার পর বিনয় ভৌমিকের কাছে জানতে চাইলাম মোহন মাঝির শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে। বিনয় আমাকে জানাল, মোহনমাঝি এখন সুস্থ আছে; আশঙ্কামুক্ত। শুনে আমি খুব খুশি হলাম। জীবনে এতটা খুশি বোধহয় আর হতে পারিনি কখনো। মনের অজান্তে আনন্দাশ্রু গড়িয়ে পড়ল আমার।

  মোমিন মাঝির শয্যার কাছে যেতেই সে আমাকে প্রথমেই জিজ্ঞেস করল মায়ারানীর কথা। আমি সব খুলে বললাম মায়ারানীর বৃত্তান্ত। শুনে সে আর স্থির থাকতে পারল না, দ্বীপ বনে আসতে অস্থির হয়ে ওঠল। ওকে বুঝিয়ে বললাম, আরও সপ্তাহ খানেক তোমাকে হাসপাতালে থাকতে হবে, তার পরে দ্বীপ বনে যাবে তুমি। মায়ারানীর মতো ওকেও বুঝিয়ে শুনিয়ে পরিশেষে আমি দ্বীপ বনে ফিরে এলাম। আসার সময় ওর হাতে আমার ব্যক্তিগত তহবিল থেকে কিছু অর্থকড়ি দিলাম। যাতে কিছুটা হলেও পরিবার দুশ্চিন্তা মুক্ত থাকতে পারে। 

  স্প্রিডবোটে ওঠে আমি চিন্তা করতে লাগলাম প্ল্যান্টে একজন চিকিৎসক নিয়োগ দিতে হবে। পল্লীচিকিৎসক হলেও চলবে আমাদের। যাতে করে বিপদে সহায়ক হয়। অন্তত কাটাছেঁড়া সেলাই করতে পারে সেরকম হলেও চালিয়ে নিবো। প্রয়োজনে তাকে অন্য দায়িত্ব দেওয়া হবে। যেন কোম্পানি চিকিৎসক নিয়োগ দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। তমিজ ছৈয়ালের মৃত্যু আর মমিন মাঝির দুর্ঘটনা আমাকে চিকিৎসক নিয়োগ দিতে সজাগ করল। যদিও বিষয়টি নিয়ে আমার শুরুতেই ভাবা উচিত ছিল, তাহলে হয়ত প্রাণহাণির মতো ঘটনাটা ঘটতো না তখন।

চলবে...
   
বিডি প্রতিদিন/ফারজানা

সর্বশেষ খবর