২৯ ডিসেম্বর, ২০২০ ১৫:০১
১৮তম পর্ব

বনবিহারী

আলম শাইন


বনবিহারী

  হেডঅফিস থেকে নির্দেশ এসেছে প্ল্যান্টের জন্য আরও কিছু লোকবল নিয়োগ দিতে। সেই সঙ্গে পল্লীচিকিৎসক নিয়োগেরও নির্দেশনা এসেছে। পল্লী চিকিৎসকের প্রয়োজনীয়তা আমিই হেড অফিসকে অবগত করেছিলাম কয়েক সপ্তাহ আগে। হেডঅফিস জানিয়েছে প্রশাসনিক কর্মকর্তা ছাড়া বাদবাকি স্টাফ আমাকে নিয়োগ দিতে। কালাবন ও সাগরমুখীর জন্য প্রশাসনিক কর্মকর্তা নিয়োগ দিবে হেডঅফিস। তবে আমার পছন্দের কেউ থাকলে কোম্পানি বিবেচনা করবে তা-ও জানিয়েছে। আর সাগরমুখীতে বাংলো কাম অফিস বানাতেও নির্দেশনা দিয়েছে। যেমনটি কালাবনে বানিয়েছিলাম। ঘূর্ণিঝড়ে বিধ্বস্ত হওয়ার পর প্ল্যান্টকে ঢেলে সাজাতে সিদ্ধান্ত নিয়েছে কোম্পানি। এ-ও জানিয়েছে লোকসান গুণতে হলেও কোম্পানি রাজি আছে। এতে যদি বছরব্যাপী স্টাফদের বেতনাদি চালিয়ে যেতে হয় তাতেও আপত্তি নেই। তারপরেও দ্বীপ বন কোম্পানি ছাড়বে না স্পষ্ট জানিয়েছে। আবার বিশেষ আরেকটি নির্দেশনা এসেছে, দ্বীপ বনের হিংস্রপ্রাণী সম্পর্কে। কোন মতেই আর হিংস্রপ্রাণী নিধন করা যাবে না। হিংস্রপ্রাণীর আক্রমণে যদি কারো অপমৃত্যু ঘটে তার ক্ষতিপূরণ কোম্পানি বহন করবে। পাশাপাশি সতর্ক হয়ে চলতেও পরামর্শ দিয়েছে। আমাকে কড়া হুঁশিয়ারি দিয়েছে একাকী বনভূমিতে ঘুরে না বেড়াতে। যেন অস্ত্রসহ সর্বক্ষণ প্রহরী সঙ্গে থাকে, সেই নির্দেশনাও দিয়েছে।

  হিংস্রপ্রাণীদের বিষয়ে আমি কথা বলেছিলাম হেড অফিসের ঊর্ধ্বতনের সঙ্গে একদিন। তিনি যখন ঘূর্ণিঝড় পরবর্তীকালে দ্বীপ বন পরিদর্শনে এসেছিলেন, তখন আমি হিংস্রপ্রাণীদের প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেছিলাম। তুলে ধরেছিলাম শেয়াল আর বুনো কুকুর নিধনের পরবর্তী চিত্রটাও। সুযোগ পেয়ে ধীরে ধীরে আমার ঊর্ধ্বতনকে সম্পূর্ণ বিষয়টা বুঝিয়ে বললাম। এক পর্যায়ে তিনি বলতে বাধ্য হয়েছেন, হিংস্র প্রাণী নিধনের সিদ্ধান্তটা ছিল কোম্পানির ভুল সিদ্ধান্ত। যে সিদ্ধান্তের কারণে প্ল্যান্ট আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। সেই ভুল সিদ্ধান্ত থেকে ফিরে আসতে রাজি হয়েছে কোম্পানি। নতুন সিদ্ধান্ত, নতুন পরিকল্পনায় প্ল্যান্ট এগুবে, তা সাফ সাফ জানালেন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। পাশাপাশি আমাকে আরও জানিয়েছেন, প্ল্যান্টটি যেন আমার মতো করেই সাজিয়ে নেই। হেড অফিসের কর্তারা এতটাই বিশ্বস্ত মনে করছেন আমাকে। প্ল্যান্টের উন্নয়নমূলক কোন বিষয়ে কোম্পানির ঊর্ধ্বতনেরা হস্তক্ষেপ করবে না বলে আমাকে স্পষ্ট জানিয়েছেনও সেদিন। অবশ্য আমার ওপর নির্ভরশীল না হয়েও উপায় ছিল না; নচেৎ প্ল্যান্টের অবস্থা আরও শোচনীয় হয়ে যাবে। নতুন পরিচালক এখানে এলে বুঝে ওঠতেই দুই বছর পেরিয়ে যাবে, ততদিনে প্ল্যান্ট অস্তিত্ব সংকটে পড়বে। কারণ দ্বীপ বন তথা প্ল্যান্ট এখন বিপর্যয়ের সম্মুখীন। এ ছাড়াও আমার সততা আর কর্মদক্ষতায় হেডঅফিস মুগ্ধ হয়েছেন। আমি কর্মচারী বান্ধব এটাও তারা উপলব্ধি করেছেন। হেড অফিসকে আমি স্পষ্ট ধারণা দিয়েছি কর্মচারী ঠকিয়ে প্ল্যান্টের উন্নয়ন কিংবা লাভজনক পর্যায়ে নেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব হবে না। যেখানে যা প্রয়োজন সেটাই করতে হবে। কথায় কথায় ছাঁটাই, বেতন কর্তন সেসব আমার হাত দিয়ে হবে না। অবশ্য আমাদের এখানে ছাঁটাই হয় না কখনো, তথাপিও শর্তের জালে বেঁধে দিলাম। 
   হেডঅফিস আমার সব শর্ত মেনে নিয়েছে। ফলে আমার দায়িত্ব আগের চেয়ে আরও বেড়ে গেছে। একদিকে স্টাফদের স্বার্থ রক্ষা করা, অপরদিকে প্ল্যান্ট টিকিয়ে রাখার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলাম আমি।
  হেড অফিসের সঙ্গে আলাপ আলোচনার পর পরই আমি সাবাইকে নিয়ে একদিন মেঘলার অফিসে মিটিং করলাম। দ্বীপ বন তথা প্ল্যান্টকে আমি আমার মতো করে আবার ঢেলে সাজাব, মিটিং-এ সেকথা উপস্থাপন করলাম। এ-ও জানালাম আমাদের কোন শ্রমিক বা স্টাফ যদি চুরি অথবা দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত থাকে তাহলে তাকে চাকরিচ্যুত করা হবে। এই অভিযোগ ছাড়া অন্য কোন অভিযোগে কারো চাকরিচ্যুত করা হবে না, যতদিন আমি থাকি এবং প্ল্যান্ট থাকে। এ অভয় দেওয়ার কারণ হচ্ছে যেন সবাই আন্তরিক হয় প্ল্যান্টের কাজকর্মে, বিশেষ করে যেন চুরি কিংবা বৃক্ষ নিধনের সঙ্গে কেউ জড়িত না হয়। 
  এমতাবস্থায় আমাকে প্রথমত যা করতে হবে, তা হচ্ছে প্রচুর বনায়ন সৃষ্টি করতে হবে। আমি টার্গেট নিয়েছি চলতি বছর ৫০ হাজার ভেষজ গাছ লাগাব প্ল্যান্টে, তার সঙ্গে এবার আমরা শাপলা ফুলের চাষও করব। আর শাপলার জন্য ১০ একর জায়গা চার ফুট পর্যন্ত খনন করে শালুক রোপণ করব; পাশাপাশি বাণিজ্যিকভাবে মাছ চাষও করব। 
  শাপলার রয়েছে প্রচুর ভেষজগুণ, ভেষজ কারখানায় খুবই প্রয়োজন পড়ে শাপলার। এদিকে শাপলা দেশে বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদ করা হয় না, কিন্তু মানুষ অবাধে শাপলা খেয়ে যাচ্ছে। বিশ্বের আর কোন দেশের মানুষই জাতীয় ফুল খাচ্ছে না, যে ফুল খাচ্ছে এ দেশের মানুষজন। এভাবে খেতে থাকলে হয়তবা একদিন শাপলা ফুল বলতে কোন ফুলের অস্বিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে না। 
  শাপলা শুধু যে সবজি হিসেবে খেয়ে অস্তিত্ব সংকটে ফেলা হচ্ছে তা কিন্তু নয়। আয়ুর্বেদিক ওষুধ বানাতেও শাপলার প্রয়োজন পড়ছে, সে ক্ষেত্রেও শাপলা নিধন হচ্ছে ব্যাপক, কিন্তু কেউ চাষাবাদ করছে না। অন্যদিকে কৃষি জমিতে অধিক মাত্রায় কীটনাশক এবং রাসায়নিক সার প্রয়োগের ফলেও শাপলার বীজ অর্থাৎ শালুক ধ্বংসের সম্মুক্ষীণ হচ্ছে। আবার লাঙ্গলের ফলা অথবা ট্রাক্টরের ফলার আঁচড়েও শালুক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এ ছাড়াও জলবায়ু পরিবর্তন কিংবা জলাশয় ভরাটের কারণেও শাপলা অস্তিত্ব সংকটে পড়ছে।
  এসব বিষয় চিন্তা করেই এবার সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমাদের কোম্পানির ভেষজ চাহিদা পূরণ করতে প্ল্যান্টে শাপলার চাষাবাদ করবো। লোকালয় থেকে আমরা শাপলা সংগ্রহ করবো না। শাপলা ক্রয় করলে অস্তিত্ব সংকটে পড়ে যাবে দ্রুত, তাই মৌসুম ঘনিয়ে এলে সেচের মাধ্যমে জল এনে শাপলা চাষের উপযোগী করবো। শুধু শাপলাই নয়; এবার আমরা কিছু তাল গাছও লাগাবো। তাল গাছগুলো লাগাবো অফিস আর বাংলোর চত্বরে। তাতে বজ্রপাত থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে, কারণ তালগাছ হচ্ছে বজ্র প্রতিরোধক। এছাড়াও অফিস চত্বরের চারপাশে আরও কিছু গাছ লাগাবো, যাতে ঘূর্ণিঝড়ে আমরা সুরক্ষা পাই। ঘূর্ণিঝড় মোরা-১৭ থেকে অনেক অভিজ্ঞতা অর্জন হয়েছে আমাদের। প্ল্যান্ট সুরক্ষায় সেই অভিজ্ঞতা এবার কাজে লাগাবো আমি।
   মিটিং-এ আমি লোকবল নিয়োগের কথাও জানিয়েছি। সবার উদ্দেশ্যে বলেছি, যদি তোমাদের মধ্যে কারো উপযুক্ত বন্ধু-বান্ধব বা আপনজন কেউ থাকে তাহলে তাকে আবেদন করতে বলবে। স্থানীয়দের অগ্রাধিকার দেওয়া হবে তাও জানালাম। তবে অবশ্যই তাকে নীতিবান, সৎ মানুষ হতে হবে।

  মাস খানেক পরের কথা। নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। প্রাথমিকভাবে ১০ জন প্রহরী আর একজন পল্লীচিকিৎসক নিয়োগ দিয়েছি। পল্লী চিকিৎসককে অফিসের অতিরিক্ষ দায়িত্বও দেওয়া হয়েছে। অফিসের অন্যান্য কাজের জন্য বাদবাকি স্টাফ মাস খানেক পরে নিয়োগ দিব। এদিকে শাপলাপুকুর খনন কাজেও লোক লাগিয়েছি। বর্ষার আগেই খননকাজ সেরে ফেলতে চাই, তাহলে বৃষ্টির জল ধরে রাখা যাবে। আমার ইচ্ছে সামনের ভাদ্র-আশ্বিন মাসেই যেন শাপলা আহরণ করতে পারি, অবশ্য যদি চাহিদা মোতাবেক শালুক পাওয়া যায়। এত শালুক সংগ্রহ করা চাট্টিখানি কথাও নয়; সে বিষয়েও ভেবে রেখেছি। অন্য এক পদ্ধতিতে শালুক সংগ্রহ করবো।
  জলাশয়টি খনন করা হচ্ছে মেঘলা মৌজায়। উক্ত মৌজায় একটা বিশাল ফাঁকা জায়গা আছে, ওখানে তেমন একটা গাছ-গাছালি না থাকায় খানিকটা সুবিধা হয়েছে আমাদের। বিশেষ করে জায়গাটি নদীর কাছাকাছি হওয়ায়ও সুবিধা হয়েছে। তাতে জল শুকিয়ে গেলে নদী থেকে সেচের মাধ্যমে জলাশয় ভরে দেওয়া যাবে, মাছ চাষেও যেন বিঘ্ন না ঘটে সেই পরিকল্পনায় এই মৌজায় জলাশয় খনন করছি।
   রাতদিন পালা করে কাজ করছে খননকারীরা। যারা কাজ করছে তারা আমাদের প্ল্যান্টের শ্রমিক নয়, বাইরের থেকে লোকজন এসে কাজ করছে। মূলত আমরা ঠিকাদারের মাধ্যমে জলাশয়টি খনন করাচ্ছি। হেডঅফিস থেকেই ঠিকাদার নিযুক্ত করেছে। তাই আমাদের নগদ অর্থকড়ির প্রয়োজন পড়ে না খননকারীদের জন্য। তার পরেও আমাদেরকে তদারকি করতে হচ্ছে নিয়মিত। সে জন্য দায়িত্ব দিয়েছি প্রশাসনিক কর্মকর্তা বিনয় ভৌমিক ও সিকান্দার বারীকে। তারা দুই জন খননকালীন সময়ে মেঘলা অফিসে অবস্থান করে তদারকি করবে।
  জলাশয় খননে শুধু শাপলা চাষই নয়, একসঙ্গে মোট চারটি কাজ হবে আমাদের। যেমন: শাপলাচাষ করব, মাছচাষ করব এবং খননকৃত মাটি বনে ফেলে উচ্চতা বৃদ্ধি করব, এতে গাছ-গাছালির পলির অভাবও পূরণ হবে। আর তরতর করে বেড়ে ওঠবে বনের গাছ-গাছালিসহ তরুলতাও।
  আমার নিজের পরিকল্পনায় এই প্রজেক্টে হাত দিয়েছি। অবশ্য বিষয়টা কোম্পানিকে অবগত করেছিও আগে। কোম্পানি আমার পরিকল্পনাকে সাদরে লুফে নিয়েছে এবং খুব দ্রুতই অনুমোদন দিয়েছে জলাশয় খনন করতে। কারণ জলাশয় এবং শাপলাচাষ দুটিই কোম্পানির জন্য লাভজনক পদক্ষেপ। জলাশয়টি খনন করতে আমাদের অনেকদিন সময় লেগেছে। সে সময়ের মধ্যে নানান ঘটনাও ঘটেছে, তার মধ্যে যে ঘটনা দেশব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে সেই ঘটনাই জানাচ্ছি এখন।
  জলাশয় খননের কাজ দ্রুত চলছিল। জলাশয়ের আকৃতি দুই ধরনের হবে। মোট ১০ একরের মধ্যে আট একরের গভীরতা হবে চার ফুট পরিমাণ, বাকি দুই একর হবে গভীর জলাশয়। তার কারণ হচ্ছে, জল কমে এলে যেন মাছেরা গভীর জলাশয়ে চলে যেতে পারে। তা ছাড়াও সেচের জন্যও সহায়ক হবে; খরচও কমে আসবে।
  শাপলা চাষের উপযোগী জলাশয়টির খনন কাজ শেষ হতেই গভীর জলাশয়ের কাজ শুরু হলো। এই জলাশয়ের গভীরতা হবে সাধারণ পুকুর বা দিঘির গভীরতার চেয়েও বেশি। যাতে জল মজুদ থাকে বারোমাস। গ্রীস্মে বা শুকনো মৌসুমেও যেন জল শুকিয়ে না যায়।
  আমরা দ্রুত খনন কাজ শেষ করতে চাই; আষাঢ়-শ্রাবণ মাসের আগেই। তাই হ্যাজাক লাইট জ্বালিয়ে রাতদিন কাজ করছে লোকজন। এদিকে পুকুরের গভীরতা ৭-৮ ফুটের কাছাকাছি চলে এসেছে। টার্গেট নিয়েছি ১২-১৫ ফুটের মধ্যেই খননকাজ শেষ করব।
  খনন মেশিন দ্বীপ বন পর্যন্ত আনা গেলেও ভেতরে প্রবেশ করানো সম্ভব হয়নি গাছ-গাছালির বিস্তৃতির কারণে। তাই লোকজনের মাধ্যমেই খনন করা হচ্ছে। অন্যদিনের মতো সেদিনও লোকজন কাজ করছিল। কাজ করতে গিয়ে হঠাৎ একজন শ্রমিক কিছু লোহা-লক্কড়ের সন্ধান পেল। কোদালের সঙ্গে ধাতব পদার্থের আঘাত লাগতেই সে চমকে ওঠে কয়েকজনকে বিষয়টা জানালো। ওরা জানতে পেরে সঙ্গে সঙ্গে কৌতূহলী হয়ে আরও দ্রুত খনন করতে লাগল। এক পর্যায়ে সিকান্দার বারীকেও বিষয়টা অবগত করল। সিকান্দার বারী তখন সেখানে উপস্থিত ছিল। সে বিষয়টা অবগত হয়ে নিজেও কৌতূহলী হলো এবং দ্রুত খননের নির্দেশ দিলো। তাতে সবাই একত্রিত হয়ে হাতাহাতি করে দ্রুত কাজ করতে গিয়ে আবিষ্কার করল বড় একটা লোহারপাত। এবার লোকজন আরও কৌতূহলী হয়ে ওঠল, সবাই মিলে আরও দ্রুত খনন করতে লাগল। ওরা যত খনন করছে ততই লোহারপাত স্পষ্ট হচ্ছে। যখন আরও খনন করল তখন সেই লোহারপাত স্পষ্ট হতেই দেখল সেটি হচ্ছে একটি কার্গো জাহাজের অংশবিশেষ। বিষয়টা এবার পরিস্কার হয়ে গেল সবার কাছে।

  ইতোমধ্যে সংবাদটা আমার কানেও পৌঁছল; সঙ্গে সঙ্গে আমি সেখানে উপস্থিত হলাম। গিয়ে দেখি বিশাল কাণ্ড! ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসছে একটি জাহাজ। জাহাজের গায়ে কোন রঙ বা লেখাটেখা নেই। মচিরা ধরে মচমচে হয়ে গেছে। কোদালের আঘাত লাগতেই চুরমার হয়ে যাচ্ছে। কিছু কিছু অংশ আবার এখনো খানিটা শক্তপোক্ত দেখলাম। শক্তস্থানে কোদালের আঘাত লেগে তেমন একটা ক্ষতি হয়নি। আমি নির্দেশ দিলাম সতর্কতার সঙ্গে খনন করতে; যেন লোহারপাতে আঘাত না লাগে।
    পরিশেষে তিন-চারদিন খাটাখাটুনি করে জাহাজের চারপাশ থেকে মাটি সরিয়ে ফেলতে সক্ষম হয়েছে লোকজন। এবার স্পষ্ট হয়েছে ওটা সাধারণ লোহারপাত নয়, ওটা হচ্ছে একটি কার্গো জাহাজের ধ্বংসাবশেষ। কোন এক সময় জাহাজ ডুবি হয়েছে হয়তবা, নতুবা ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবে ডুবে গিয়েছিল জাহাজটি। তবে অনুমান করছি জাহাজটি ৭০-৮০ বছর আগে দুর্ঘটনায় নিমজ্জিত হয়েছে। কেননা এই দ্বীপ বন জেগেছে প্রায় ৬০ বছর আগে। আর ডুবে যাওয়া জাহাজের ওপর পলি জমতে অনেক বছর সময় লেগেছে; তাতেই আমি অনুমান করেছি এতটা বছর পেরিয়েছে। অবশ্য কমও হতে পারে; সেক্ষেত্রে ৬০ বছরের কম নয়।
   যাই হোক, বিষয়টা এককান দুইকান করে লোকালয় হয়ে সদরে পৌঁছল খুব দ্রুত, তার পর চাউর হয়ে গেল সমস্ত দেশব্যাপী। ‘দ্বীপ বনের মাটির নিচে জাহাজের সন্ধান পাওয়া গেছে’, সংবাদটা নানানভাবে উপস্থাপন হলো। এদিকে খবরের কাগজ এবং বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলের স্থানীয় সাংবাদিকগণও আসতে লাগলেন পর্যায়ক্রমে। অনেকেই লাইভ অনুষ্ঠানও করলেন, আমাদের বক্তব্যও তারা কোড করলেন। 
    বিষয়টা দেশব্যাপী জানাজানি হতেই আমাদের হেড অফিসের লোকজনও চলে এলেন একনজর দেখতে। ইতোমধ্যে খনন কাজ সেদিকে বন্ধ করে দিয়েছি আমরা। এতবড় জাহাজ সরিয়ে নেওয়ার মতোও নয়; তা ছাড়া এটা এখন প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সম্পদ। আবার ওই দিকটায় কাজ করার মতো পরিবেশ পরিস্থিতিও নেই। সুতরাং সেই দিকটায় কাজ বন্ধ রেখে অন্যত্র খনন কাজ চালিয়ে গেলাম আমরা। ফলে আমাদের জলাশয়ের আকৃতিরও পরিবর্তন হয়ে গেলো। তাতে অবশ্য আমাদের সমস্যা হয়নি বরং জলাশয়টি নান্দনিক হ্রদ আকৃতি ধারণ করল।

চলবে...

বিডি প্রতিদিন/ফারজানা

সর্বশেষ খবর