৫ জানুয়ারি, ২০২১ ১৫:০১
১৯তম পর্ব

বনবিহারী

আলম শাইন

বনবিহারী

   ক’দিন আগে আমার কাছে সংবাদ এসেছে শালতলার জঙ্গলে নাকি কেউ কেউ বাঘ দেখেছে। শ্রমিকরা ভয়ে কাজকর্মে যোগ দিচ্ছে না এখন। সংবাদটার ভিত্তি কতটুকু তা যাচাই করতে আজ শালতলার বাংলোয় এসেছি। আমি জানি দ্বীপ বনে বাঘ নেই; শুধু দ্বীপ বনেই নয়, সমস্ত নিঝুম দ্বীপেই বাঘের কোন অস্তিত্বই নেই। বাঘ বলতে আমি রয়েল বেঙ্গল টাইগার অথবা চিতাবাঘকে বুঝিয়েছি। এই দুই প্রজাতির প্রাণী দ্বীপ বনে নেই, এটা আমি নিশ্চিত করেই বলতে পারি। থাকলে এতদিনে কোন না কোন আলামত নজরে পড়ত আমার। কারণ দ্বীপ বনের কিছু কিছু জায়গা জোয়ারে ডুবে যায়, সেই জায়গাগুলো সবসময় থাকে থিকথিকে কাদাময়। বাঘগোত্রের প্রাণীদের বিচরণ থাকলে অন্তত সে কাদাময় জায়গায় পায়ের ছাপ দেখতে পেতাম। এত বড় ওজনদার প্রাণীদের পায়ের চাপ লুকানোর মতোও নয়; সুতরাং বাঘ নেই, এটা আমি জোর দিয়েই বলতে পারি।

  তাছাড়া শালতলার জঙ্গলেও দিনরাত ঘুরে বেড়িয়েছি আমি, তাতে বাঘ তো দূরের কথা বাঘডাশও দেখিনি। আমার ধারণা তারা অন্যকোন জানোয়ার দেখেছে হয়তোবা। তারপরেও বিষয়টা যখন অবগত হয়েছি তখন আমাকে বৃত্তান্ত জানার চেষ্টা করতেই হবে। সত্য হোক, মিথ্যেই হোক সংবাদটা আমার কাছে ভালো ঠেকেনি। প্রথমত সালেহ দেওয়ান আর তমিজ ছৈয়ালের অপমৃত্যু। আবার জলোচ্ছ্বাসের তাণ্ডবে নোনাজল প্ল্যান্টে ঢুকে লতাগুল্মসহ অনেক ভেষজ উদ্ভিদ মরে সাফ হলো; অন্যদিকে কলাগাছ কর্তন, বৃক্ষনিধন, গোলমরিচ চুরি, মমিন মাঝিকে কোপানোসহ একের পর এক বিপর্যয়ে আমি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লাম। একবার কালাবনে শুনে এলাম অতিপ্রাকৃত ঘটনা, ওখানে বৃক্ষ নিধন, জঙ্গলে আগুন লাগানো তো নিজ চোখেই দেখে এলাম। এখন যেভাবেই হোক, আগে সমস্যাগুলোর মোকাবেলা করতে হবে আমাকে। হোক না ছোট সমস্যা, তা একসময় বড় আকার ধারণ করতেই বা কতক্ষণ? যার জন্য খুব দ্রুত ছুটে এলাম শালতলা মৌজায়।

  শালতলায় আমি হাতির পিঠে চড়েই এসেছি। যথারীতি আমার সঙ্গে ছিল মহব্বত দয়াল। ওকে ছাড়া একা কোথাও যাওয়ার অনুমতি নেই আমার তা আগেই বলেছি। কোম্পানির নিষেধাজ্ঞা রয়েছে, সুতরাং সবসময় মহব্বত দয়ালকে সঙ্গে রাখতেই হচ্ছে। আর তাছাড়া, দ্বীপ বনে শেয়াল কুকুরের সংখ্যা কমে এসেছে ঠিকই, তাই বলে শেয়াল কুকুরমুক্ত তা বলা যাবে না। অতএব সাবধান হতেই হবে।

  আজ মধ্য দুপুরে শালতলায় পৌঁছলাম। অগ্রহায়ণের মিঠেকড়া রৌদ্র গায়েমেখে হাতির পিঠে চড়ে এলেও ৫ ঘণ্টার জার্নি শরীরটাকে দুর্বল করে দিয়েছে। সুতরাং বাধ্যতামূলক বিশ্রাম নিতেই হচ্ছে আমাকে।

  যথারীতি গোসলাদির পর মধ্যাহ্নভোজ সেরে বিছানায় গড়াগড়ি দেওয়ার প্রস্তুতি নিলাম। অমনি সিকান্দার বারী ছুটে এল আমার কামরায়। তাকে খুব শঙ্কিত দেখাচ্ছে। জিজ্ঞেস করলাম, ‘বারী, কোন সংবাদ আছে?’

  বারী বলল, ‘বড়মিয়া, রাতের খাবারের জন্য আমরা ৪টা হাঁস কিনে এনেছিলাম। জানি হাঁসের মাংস আপনার খুব প্রিয়, তাই আপনার আসার সংবাদ জানতে পেরে আগেই ব্যবস্থাটা করলাম আমি।’
  বললাম, ‘বাহ, ভালো কাজ করেছ বারী; অনেক ধন্যবাদ।’ 
  ‘বড়মিয়া একটা ঘটনা ঘটে গেছে।’
  ‘আবার কি ঘটনা ঘটল?’
  ‘হাঁসগুলো এখনো জবাই করেনি, বেঁধে রেখেছিলাম বাংলো থেকে সামান্য দূরে। সেখান থেকে একটা হাঁস বাঘে মুখে করে নিয়ে গেছে। আমাদের একজন প্রহরী দেখেছেও বাঘটাকে। এই মাত্র ঘটনাটা ঘটেছে।’
  ঘটনাটা শুনে আমি চিন্তিত হলাম। জানি না আসলেই বাঘে নিয়েছে কীনা। যদি তাই হয়ে থাকে তাহলে শালতলার জঙ্গলে আর কাউকে পাঠানো যাবে না। তবে ওদেরকে সতর্ক করার আগে আমি প্রাণীটাকে নিজ চোখে দেখতে চাইলাম। বারীর কথাশুনে আমার ভেতর খটকা লেগেছে, বাঘ হাঁস নিয়ে যাবে, কেমন জানি অবিশ্বাস লাগছে আমার কাছে। বাঘ খাবে হরিণ, খরগোশ ও অন্যান্য জীবজানোয়ার অথবা মানুষ আক্রমণ করবে, আর সেখানে কীনা শুনছি হাঁস নিয়ে গেছে। এ কেমন বাঘ! এবার আমার সন্দেহ লাগল, ওটা নিশ্চয়ই বাঘ নয়। ওরা বলেছে, জানোয়ারটার গায়ে ছোপ ছোপ কালো দাগও দেখেছে। তার মানে চিতা বাঘ! দ্বিধায় পড়লাম; হলাম চিন্তিতও। যেভাবে হোক নিজচোখে দেখতে হবে জানোয়ারটা। আমি নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত শ্রমিকরা জঙ্গলে কাজে যাবে না, এটাই সত্যি। আগে আমাকে আশ্বস্ত করতে হবে জানোয়ারটা সর্ম্পকে। দায়িত্বটা কঠিন; সামান্য ভুলে অনেক কিছু ঘটে যেতে পারে। কাজেই আমাকে জানোয়ারটা দেখে বুঝেশুনে রায় দিতে হবে। সেটি সম্ভব হবে ওকে শিকারের প্রলোভনে ফেলে তার পরে দেখা, অন্যথায় দেখা কঠিন হবে। শুধুমাত্র দেখা সম্ভব হতে পারে জানোয়ারটার হাঁস শিকারের মাধ্যমেই। আমার বিশ্বাস জানোয়ারটা আবার আসবেই। যেহেতু হাঁস শিকারকালে জানোয়ারটা বাধাপ্রাপ্ত হয়নি, অথবা আক্রান্ত হয়নি, তাহলে আমি ধরে নিতে পারি ওটা আবার আসবে শিকারের খোঁজে। সেটি হতে পারে আজ, কাল অথবা পরশুও। আবার নাও আসতে পারে; সুতরাং ধৈর্য্য ধরেই পর্যবেক্ষণ করতে হবে সব। যতদিন প্রয়োজন পড়ে জানোয়ারটা নিজচোখে দেখার, তত দিনই আমাকে শালতলায় অবস্থান করতে হবে। 

  সংবাদটা শুনে আর বিশ্রাম নিতে পারলাম না। সিদ্ধান্ত নিলাম হাঁস যেখানে বাঁধা আছে সেটার আশেপাশেই আমি লুকিয়ে থাকব। বারীকে বলে দিলাম, ‘হাঁসগুলো আজ জবাই করার দরকার নেই। আমি বিষয়টা পর্যবেক্ষণ করব আগে। হাঁস যেখানে বেঁধে রেখেছ, সেখান থেকে নিরাপদ দূরত্বে বসার জায়গা করে দাও; আমি বসব। যাতে জানোয়ারটা আমাকে না দেখে, সেরকম একটা জায়গায় বসার উপযোগী করে দিবে। পারলে গাছের ওপর মাচা বাঁধতে বল। না হলে তাঁবু টানিয়ে গাছের ডালপালা দিয়ে ডেকে দিতে বল। তবে হাঁস আগে যেখানে বাঁধা ছিল, ঠিক ওই জায়গাই রাখতে বলবে।’

  আমি যখন সিদ্ধান্তটা দিলাম তখন দুপুর গড়িয়েছে মাত্র। সূর্য গাছের নিচে পড়ে যাওয়ায় বিকেলের আমেজ অনুভূত হলো। আর একটু বাদেই বনময় আঁধার ঘনিয়ে আসবে; লোকালয়ে থাকবে তখনো ঝলমলে রোদ্দুর; লোকালয়ে সূর্য অস্তগেলে বনময় তখন আঁধার। বনপ্রান্তরে রাতের আঁধারকে যতটা না ভয় লাগে, তারচেয়ে বেশি ভয় লাগে সাঁঝলগ্ন। সাঁঝলাগ্নে এক অজানা আশঙ্কায় শিহরিত হই। তখন পাখিদের কলকাকলি থেমে যায়; থেমে যায় মানুষের কর্মচঞ্চলতাও। হতে পারে সেই নীরবতাই আমাকে বিষাদের বার্তা পৌঁছায়। তাই তো সাঁঝলগ্নে আমি সবসময় কর্মমুখর থাকতে চেষ্টা করি। আজও সাঁঝ মুহূর্তে ব্যস্ততায় থাকব, ভাবতেই খারাপ লাগছে না। 

  এখন সমস্যা হচ্ছে হাঁসগুলো যেখানে বাঁধা আছে, সেখানে বিস্তৃত ডালপালার তেমন কোন গাছ-গাছালি নেই। শালগাছ কয়েকটা পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকলেও মাচা বাঁধার মতো সুযোগ নেই। তাহলে কি করা? কীভাবে দেখব? ভাবতে ভাবতে একটা বুদ্ধি পেয়ে গেলাম। সুন্দরবনের হরিণ শিকারিরা গর্ত করে ওপরে কাঁচা ডালপালা বিছিয়ে রাখে, আর হরিণরা সেগুলো খেতে এসে গর্তে তলিয়ে যায়। সে সুযোগে ওরা হরিণ ধরে জবাই করে।
  বুদ্ধিটা মাথায় আসতেই শ্রমিকদের নির্দেশ দিলাম দ্রুত একটা গর্ত খুঁড়তে। গর্তের মাপও বলে দিলাম; তিন বাই চারফুট। গভীরতা আরও বেশি হলে ভালো; তাও বলে দিলাম।

  নির্দেশনা দিয়ে আমি বাংলোর ওপরে চলে এলাম। শ্রমিকরা কয়েকজন মিলে কোদাল, শাবল, টুকরি নিয়ে কাজে লেগে গেল। আমি বারান্দায় বসে কফি খেতে খেতে সিকান্দার বারীর সঙ্গে নানান বিষয়ে আলাপ আলোচনা করতে লাগলাম। কিছু গোলমরিচ গাছের লতা লাগাতে নির্দেশ দিলাম। ঘূর্ণিঝড়ে প্রচুর ক্ষতি হয়েছে প্ল্যান্টের, অধিকাংশ গোলমরিচের লতা মরে গেছে। নোনাজল সইতে না পেরে শুধু গোলমরিচের লতাই নয়, অনেক লতাগুল্ম, ভেষজ গাছ অকালে মারা গেছে। যে ক্ষতি পুষিয়ে ওঠতে আমাদের অনেক বেগ পেতে হচ্ছে এখন।

  গোলমরিচ ভেষজ কারখানায় প্রচুর প্রয়োজন হয়। এই মশলাটার ভেষজগুণ বলে শেষ করারও নয়। তাছাড়া গোলমরিচ অনেক দামীও; কেজি হাজার টাকার ওপরে। ফলে আজকাল চুরিও হতে শুরু করেছে গোলমরিচ। শেয়াল কুকুর নিধনের পরে লোকালয়ের অনেকেরই যাতায়াতও বেড়ে গেছে দ্বীপ বনে। কোন ফাঁকে ওরা কাঁচা গোলমরিচ তুলে নিয়ে যায়, তাও টের পায়নি আমাদের লোকজন। আবার জানতে পেরেছি গোলমরিচ চুরির সঙ্গে আমাদের শ্রমিকরাও নাকী জড়িত। ইত্যাদি বিষয়ে আলাপ সারতে সারতে গর্ত খোঁড়া হয়ে গেছে। শ্রমিকদের বলে দিলাম এবার গর্তের মুখে চিকন ডালপালা রেখে তার ওপর একটা হাঁসের পা বেঁধে রেখে দিতে। ততক্ষণে পুরোপুরি আঁধার নেমে এসেছে শালতলার জঙ্গলে।

  সমস্ত প্রক্রিয়া শেষ করে যে যার মতো চলে গেল। আমি বারান্দায় বসে স্টাফদের সঙ্গে গল্পগুজব করতে লাগলাম। আমার বিশ্বাস জানোয়ারটা আজকেই আসবে আবার। কারণ ও দেখে গেছে এখানে শিকার রয়েছে। আর এলেও রাতের প্রথমার্ধ্বে আসবে; তারপরে জানোয়ারটাও ঘুমিয়ে পড়বে। আমি শিওর হয়েছি জানোয়ারটা নিশাচর নয়; নিশাচর হলে দিনেদুপুরে শিকারে বের হতো না। এটি আমার কৈশরের অভিজ্ঞতা থেকে অনুধাবন করেছি। তখন দেখেছি আমাদের গৃহপালিত হাঁসমুরগি সন্ধ্যালগ্নে শিকারি প্রাণীদের কবলে পড়তে।

   গল্পগুজব শেষ হতে হতেই রাত ১০ টা বেজে গেছে; খাওয়াদাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। অমনি আমার মনে পড়ল ফাঁদটার কথা। অমনি টর্চ আর মহব্বত দয়ালকে সঙ্গে নিয়ে গর্তের কাছাকাছি এলাম আমরা। ঠিক তখনি দেখতে পেলাম কী যেন একটা প্রাণী দৌড়ে পালাচ্ছে। টর্চের আলোতে সামান্য নজরে পড়েছে মাত্র। কিছু বুঝে ওঠার আগেই পালিয়েছে। বুঝতে পারলাম জানোয়ারটা আবারও এসেছে, এ মুহূর্তে আমাদের আসাটা ঠিক হয়নি। ভুল যখন করেই ফেলেছি হাঁসটাকে দেখে যাই একবার। গর্তের কাছাকাছি যেতেই দেখি গর্তের মুখে হাঁসটা নেই; ডালপালাও উধাও। বিষয়টা কী হতে পারে তা আমি বুঝে ফেলেছি। মহব্বত দয়ালকে বললাম, বন্দুকের নিশানা ঠিক করে গর্তের মুখের দিকে অগ্রসর হও। আমি টর্চ নিয়ে সামনে হাঁটছি; পেছনে সে। একপা দুইপা করে গর্তের মুখের সামনে চলে এলাম আমরা। দেখলাম গর্তের মুখে কিছু নেই, খোলা। তার মানে হাঁসসহ গর্তে কিছু একটা পড়েছে। ওপর থেকে টর্চ জ্বেলে অনুধাবন করলাম অনুমানটা সত্য।

   টর্চের ফকফকা আলো গর্তের তলদেশে পৌঁছতেই দেখলাম কী যেন একটা প্রাণী গুটিসুটি মেরে বসে আছে। আর মৃত হাঁসটা অর্ধ খাওয়া অবস্থায় পড়ে আছে। তার মানে প্রাণীটা আরও আগেই গর্তে পড়েছে। আর যে প্রাণীটা দৌড়ে পালিয়েছে ওটা হচ্ছে এরই সঙ্গী। সম্ভবত ওরা একত্রেই এসেছে। সঙ্গী বিপদে পড়ায় বেচারি গর্তের কাছেই বসেছিল এতক্ষণ, আমাদের আগমনে পালিয়েছে প্রাণীটা।

  সবাইকে বাংলোর নিচে আসতে বললাম। সংবাদ পেয়ে সবাই লাঠিসোঠা নিয়ে গর্তের কাছে এল। যারা আগে জানোয়ারটা দেখেছে, ওদের কয়েকজনও উপস্থিত ছিল। সবাই আসতেই নির্দেশ দিলাম গর্তে পড়ে যাওয়া ডালাপালাগুলো ওপরে তুলতে।
  গর্তের মুখ পরিস্কার করতেই এবার জানোয়ারটা স্পট নজরে এল। টর্চের আলোতে দেখলাম, ওর শরীর ধূসর লোম আবৃত, তার ওপর কালো কালো ছোপ; চিতাবাঘের মতো দেখাচ্ছে। আর দুচোখ জ্বলজ্বল করছে। তবে প্রাণীটা আকারে তেমন বড় নয়; দৈর্ঘ্য তিন ফুট সর্বোচ্চ। প্রাণীটা ভয়ে গুটিসুটি মেরে বসে আছে। আলো জ্বালতেই ওপরের দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। ওর চাহনিতে আমি মমতা খুঁজে পেলাম। এখুনি প্রাণীটাকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হবে, ভাবতেই আমি শিউরে ওঠলাম। সবাই প্রস্তুতি নিয়েছে মেরে ফেলতে তেমনি মুহূর্তে বললাম, ‘তোমরা কি এ রকম প্রাণীর কথাই বলেছ? আগে ভালো করে দেখ এই ধরনের প্রাণী কীনা?’

  উপস্থিত কয়েকজন বলল, ‘হুবহু এরকমই দেখতে ওই বাঘটা, তবে এটা কীনা তা বলতে পারছি না বড়মিয়া।

  বললাম, ‘যদি দেখতে এরকম হয়, তাহলে এটাকে মারার চেষ্টা করবে না আর। এটা কোন হিংস্রপ্রাণী নয়। এটা হচ্ছে মেছোবাঘ।’

  আমার কথা শুনে সবাই থ’ হয়ে রইল। প্রাণীটা হিংস্র নয়, এটা মানতে পারছে না কেউ-ই। আমি বিস্তারিত জানালাম প্রাণীটা সম্পর্কে; চিড়িয়াখানায় দেখেছি সেকথাও বললাম। বললাম, ‘এরা সাধারণত মাছ খায়, খাদ্য সংকটে হাঁস-মুরগিও খায়। তোমরা নিশ্চিত থেকো এ প্রাণীদের দ্বারা তোমাদের বিন্দুমাত্র ক্ষতি হবে না। কাছাকাছি গেলে আত্মরক্ষার্থে মুখ খিঁচিয়ে গর্জন করে সত্যি, তবে কারো ক্ষতি করে না, তেড়েও আসে না। সুতরাং নিশ্চিত থাকতে পার।’

   আমার কথায় এবার আশ্বস্ত হলো সবাই। সবার আতঙ্ক নিমেষেই কেটে গেল; লক্ষ্য করলাম ওদের মধ্যে উল্লাসিত ভাবও। নির্দেশ দিলাম প্রাণীটাকে উদ্ধার করতে, কিন্তু কেউ নামতে চাচ্ছে না ভয়ে। পরিশেষে বললাম, ‘একটা মই এনে গর্তে ফেল রাখ, দেখবে ও নিজ থেকেই ওঠে পালাবে।’
  মই ফেলা হতেই সবার উদ্দেশ্যে বললাম, ‘এবার তোমরা যার যার কাজে চলে যাও। সকালে এসে দেখবে প্রাণীটা আছে কীনা। থাকলে ওঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে; না থাকলে ঝামেলামুক্ত।’ 

   বাংলোর বারান্দায় এসে বসতেই আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এল। এই মেছোবাঘই হবে প্ল্যান্টের ভবিষ্যৎ। প্ল্যান্ট টিকিয়ে রাখতে হলে মেছোবাঘকে ব্যবহার করতে হবে। জুজুর ভয় দেখাতে হবে দুষ্কৃতিকারিদেরকে। কেবল একটু বুদ্ধি খাটাতে পারলেই হয়। যেহেতু লোকালয়েও রটে গেছে দ্বীপ বনে চিতাবাঘ এসেছে, তাহলে বন রক্ষার জন্য এটি হবে প্লাস পয়েন্ট। তবে তার আগে প্ল্যান্টের সব স্টাফদেরকে নিয়ে বসতে হবে আমার। আর সেই মিটিংটা হবে গোপনীয় মিটিং। যেহেতু এখন শালতলায় আছি তাহলে এখান থেকেই কাজটা শুরু করার সিদ্ধান্ত নিলাম।

  পরের দিন সকালে বাংলোর টানা বারান্দায় সবাইকে নিয়ে বসলাম। তাদেরকে জানালাম আমার সেই পরিকল্পনার কথা। আমার পরিকল্পনাটা হচ্ছে, দ্বীপ বনের চারপাশে আমরা অনেকগুলো সাইনবোর্ড টানিয়ে দিব। সাইনবোর্ডে লেখা থাকবে, “বাঘ থেকে সাবধান! কোন ধরনের ক্ষতি হলে প্ল্যান্ট কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়।” ব্যাস, আর কিছ্ইু প্রয়োজন হবে না। বাইরের লোক আর দ্বীপ বনে প্রবেশের সাহস পাবে না। চুরি, বৃক্ষ নিধন সবই কমে যাবে। শুধু স্টাফ আর শ্রমিকরা মুখ না খুললেই আমার পরিকল্পনায় বন তছরুপ থেকে অনেকখানি রক্ষা পাবে।

  আমার পরিকল্পনার সঙ্গে সবাই সম্মত হলো। শ্রমিকদেরকে প্রতিজ্ঞা করালাম একথা যেন তারা ঘুণাক্ষরেও ফাঁস না করে বাইরে। এ বাঘ হিংস্র নয়, কথাটা ফাঁস করলেই সমস্যা সবার আগে ওদেরই হবে, সেটি বুঝালাম। বন বা প্ল্যান্ট ধ্বংস হলে তারা বেকার হয়ে যাবে। এখানে তারা যে পরিমাণ মজুরি পাচ্ছে, দেশের আর কোথাও দৈনিক হাজিরার ভিত্তিতে কাজ করে এতটাকা মজুরি পায় না কোন শ্রমিক। প্ল্যান্ট না টিকলে ওরা যে তা থেকে বঞ্চিত হবে সেটিও স্পষ্ট করে বুঝালাম।

   পরিকল্পনা মোতাবেক শালতলা মৌজা থেকে প্রথম সাইনবোর্ড টানানোর সিদ্ধান্ত নিলাম। সাইনবোর্ড বনের বাইরে নদীর পারে টানিয়ে দেওয়া হবে যেন লোকজনের নজরে পড়ে। একজনকে সাইনবোর্ড বানানোর দায়িত্ব দিয়ে পরের দিন মেঘলার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম আমি। 

  মেঘলায় পৌঁছে সবাইকে ডেকে শালতলার ঘটনা শুনালাম। সেখানে যেভাবে কাজ করার নির্দেশ দিয়েছিলাম ঠিক একইভাবে মেঘলাও কাজ করতে বিনয় ভৌমিককে নির্দেশনা দিলাম। ইচ্ছে আছে সপ্তাহ খানেকের মধ্যে কালাবন ও সাগরমুখীতে সাইবোর্ড ঝুলিয়ে দিব। আমি জানি এটা এক ধরনের প্রতারণামূলক কাজ; তথাপিও দ্বীপ বন তথা প্রকৃতিরক্ষার স্বার্থে বাঘের ভয় দেখালাম। তা ছাড়া মেছোবাঘও তো এক ধরনের ছোটখাটো বাঘই; ওরা বাঘ বা বিড়াল প্রজাতির মধ্যেই পড়ে। সুতরাং একেবারেই মিথ্যে প্রচারণা নয়। ওদের গায়ের কালো ছোপ দেখে চিতাবাঘই মনে করবে লোকজন। মেছোবাঘের বংশ বিস্তার ঘটলে দ্বীপ বনের যত্রতত্র ওদের বিচরণ বেড়ে যাবে, তাতে দুষ্কৃতিকারিরাও সাবধান হবে, লোকজনের যাতায়াতও বন্ধ হবে, বন্ধ হবে বৃক্ষ নিধনসহ চুরিচামারিও।

চলবে... 

বিডি প্রতিদিন/ফারজানা

সর্বশেষ খবর