১২ জানুয়ারি, ২০২১ ১৫:০৫
শেষ পর্ব

বনবিহারী

আলম শাইন


বনবিহারী

 মাস ছয়েক আগের ঘটনা। পৌষের দ্বিতীয় সপ্তাহ। সেদিন সকাল সাড়ে ১০টা নাগাদ আমি মেঘলার অফিসে রুটিন ওয়ার্কে ব্যস্ত ছিলাম। বাইরে কনকনে ঠাণ্ডা, ঘন কুয়াশায় আবৃত সমস্ত দ্বীপ বন। এতই ঘন কুয়াশা পড়েছে যে, চারপাশের সব কিছু আবছা দেখাচ্ছে। কয়েক গজ দূর থেকেই গাছ-গাছালির প্রজাতি নির্ণয় করা যাচ্ছে না, সব গাছপালাকে একই প্রজাতির মনে হচ্ছে। কুয়াশার প্রলেপে পাতার সবুজ রঙ উধাও; পাতাগুলো এখন আইসক্রিমের মতো ঝলমল করেছে। মাকড়সার জালে কুয়াশার জল জমে হীরক বিন্দুর মতো বিচ্ছুরিত হচ্ছে। যেন দ্বীপ বন আজ নতুন সাজে সজ্জিত হয়েছে। খুব বেশি ঠাণ্ডা অনুভূত না হলে দরজা জানালা খোলা রেখেই উপভোগ করতাম কুয়াশাচ্ছন্ন দ্বীপ বনকে; সেটি আজ সম্ভব নয়, ঘন কুয়াশায় আবৃত থাকায়। দরজা-জানালার ফাঁক গলে ধোঁয়ার কুণ্ডলির মতো কুয়াশার ধলা ঘরে ঢুকে গায়ের চাদর ভিজিয়ে দিচ্ছে। তাই জানালায় ছিটকিনি লাগিয়ে আমি শিপমেন্টের কাগজপত্রগুলো ঠিকঠাক করছিলাম। কাগজপত্রে ত্রুটি থাকলে বন্দরে নানান সমস্যা হয়, সে সবই ঠিকঠাক করছি এখন। অবশ্য এসব আমার রুটিন ওয়ার্কের মধ্যেই পড়ে। আমি যখন রুটিন ওয়ার্কে ব্যস্ত অমনি মহব্বত দয়াল একমগ কফি এনে রাখল আমার টেবিলে। ওর হাত থেকে টেবিলে মগটা রাখতেই যা দেরি, আমি ছোঁ মেরে ধূমায়িত মগটা টেনে ঠোঁটের ফাঁকে চেপে ধরলাম। দুই-এক চুুমুক দিতেই শরীরটা চাঙ্গা হয়ে ওঠল নিমেষেই; গরম অনুভূত হলো খানিকটা। মহব্বত দয়াল দাঁড়িয়ে আছে তখনো। অন্যদিন কফির মগটা রেখেই সে চলে যায়, আজ দাঁড়িয়ে থাকতেই ওকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কিছু বলবে দয়াল?’

  সে নিচুস্বরে বলল, ‘বড়মিয়া আমার বাবা এসেছেন, আপনার সাথে দেখা করতে।’
  ‘কোথায় তিনি?’
  ‘পাশের রুমে বসেছেন।’
  আমি ওকে জোরসে ধমক দিয়ে বললাম, ‘জলদি নিয়ে এসো উনাকে। তোমার বাবা এসেছেন আমার সঙ্গে দেখা করতে, আর তুমি তাঁকে পাশের রুমে বসিয়ে রেখেছ, কাজটা কি ভালো করলে দয়াল? সব ক্ষেত্রে নিয়ম মেনে চলতে হয় না। যাও জলদি নিয়ে এসো উনাকে।’
  মহব্বত দয়াল জলদি করে ওর বাবাকে নিয়ে এল আমার সামনে। আমি তাঁকে চেয়ারে বসতে বললাম। কুশলাদি বিনিময়ের পর আমি অন্য একজন প্রহরীকে ডেকে বললাম, ‘অতিথির জন্য চা-নাস্তার ব্যবস্থা করো। আর তিনি দুপুরে আমার সঙ্গে খাবেন, সেই ব্যবস্থাও করবে।’
  মহব্বত দয়াল বলল, ‘বড়মিয়া, বাবা এখনি চলে যাবেন। অন্যদিন আসলে খাবেন।’
  বললাম, ‘অন্যদিন আসলে খাবেন এটা কেমন কথা; উনি আজ খাবেন, অন্যদিনও খাবেন। আর হ্যাঁ, উনি আজ থাকবেন। কাল আমাদের বোট সদরে যাবে, তখন উনাকে বোটে করে পৌঁছে দিতে বলব। বুড়ো মানুষ এত কষ্ট করে এসেছেন, আর তুমি বলছ আজই চলে যাবেন, এ হয় না দয়াল।’
  মহব্বত দয়ালের বাবার বয়স আশির কাছাকাছি। কথায় কথায় তিনি আমাকে তার বয়সের কথাও জানালেন। আমার কাছে মনে হচ্ছে তাঁর বয়স আশির ঊর্ধ্বে হবে। তাঁর চেহারার অবয়ব দেখে আমি তা আন্দাজ করলাম।
  বেচারি শীতে জবুথবু হয়ে বসে আছেন। ওনার মুখমণ্ডলের দিকে তাকিয়ে আমার খুব মায়া ধরেছে। বাবার কথা মনে পড়ে গেলো। তিনি বেঁচে থাকলে এখন তাঁর বয়স ৮২-৮৩ ছাড়িয়ে যেত। আমি তাকিয়েই রইলাম মহব্বত দয়ালের বাবার দিকে। আর যখন জানতে পারলাম তিনি তার ছেলেকে দেখতে এসেছেন দ্বীপ বনে, তখন শ্রদ্ধায় আমার মাথানত হয়ে এল।
  উনার সঙ্গে আমি অনেক কথা বললাম। একটা জিনিস লক্ষ্য করলাম তিনি এখনো আমার সঙ্গে তাল মিলিয়ে কথা বলতে পারছেন। অর্থাৎ কথার খেই হারিয়ে ফেলছেন না এ বয়সেও। সাধারণত এ বয়সের মানুষ বেশিরভাগই অগোছালো কথাবার্তা বলে থাকেন। সেই হিসেবে তিনি বেশ গুছিয়ে কথাবার্তা বলছেন। তার মানে ওনি যথেষ্ট সুস্থ আছেন এবং ওনার স্মরণশক্তিও বেশ প্রখর।
  বিভিন্ন কথাবার্তা বলতে বলতে এক পর্যায়ে তিনি আমার কাছে এসে হাত চেপে ধরলেন। আমি বিস্মিত হলাম, ততক্ষণে তিনি আমার হাত আরও শক্ত করে ধরলেন। বললেন, ‘বাবা, আমি আপনার কাছে বড় আশা নিয়ে এসেছি। আপনি কি আমার একটু উপকার করবেন?’
  আমি বুঝতে পারলাম মহব্বত দয়াল কাছে না থাকায় তিনি আমার হাত চেপে ধরেছেন, সে কাছে থাকলে হয়তবা এমনটা করতেন না। কারণ আমি লক্ষ্য করছি তিনি বারবারই দেখছেন মহব্বত দয়াল আশপাশে আছে কীনা।
  এবার আমি অনুমান করতে পেরেছি তিনি কেন এসেছেন আমার কাছে। নিশ্চয় কিছু অর্থকড়ির প্রয়োজন হয়েছে, তাই হয়তো তিনি আশা নিয়ে এসেছেন আমার কাছে। তিনি আমার হাতচেপে ধরাতে আমি লজ্জিত হলাম। স্বাভাবিকভাবে চাইলেও আমি তাঁকে খালি হাতে ফেরাতাম না। আমি তাঁকে হাত ছেড়ে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করলাম। আমার অনুরোধে তিনি হাত ছেড়ে চেয়ারে বসলেন। তারপর বললেন, ‘বাবা কথাটা আপনাকে বলব, আপনি মহব্বতকে বলবেন না যেন।’
  ‘ঠিক আছে বলব না। কাকা এখন বলুন কী করতে হবে আমাকে।’
  যখন তিনি বলেছেন মহব্বত দয়ালকে কিছু না জানাতে, তখন আরও শিওর হলাম তিনি অর্থকড়ি চাইতে এসেছেন আমার কাছে। তাছাড়া এ বয়সে আর কী বা আছে তাঁর চাওয়ার মতো। আমি যখন সাত-পাঁচ ভাবছিলাম তখন তিনি বললেন, ‘বাবা আমি এসেছি মহব্বতের বিষয়ে একটা কথা জানাতে।’
  এবার আমি একটু সংযত হলাম। বুঝতে পেরেছি মনে মনে আমি যা ভেবেছিলাম আসলেই তা নয়; তিনি অন্যকিছু বলতে এসেছেন। সেই অন্যকিছু কী হতে পারে তা জানতে এবার আমি উদগ্রীব হয়ে ওঠলাম। বললাম, ‘কাকা, বলেন, কী বলতে চাচ্ছেন। মহব্বত কি আপনার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করছে?’
  তিনি বললেন, ‘মহব্বত খুব ভালো ছেলে, ওর বিরুদ্ধে আমার কোন অভিযোগ নেই। ওর মা মারা যাওয়ার পর আমি দ্বিতীয় বিয়ে করেছিলাম। সেই ঘরে আমার একটা মাত্র মেয়ে আছে। মহব্বত নিজেই ওর সেই বোনের বিয়েশাদি দিয়েছে। আবার ওর ছোট মায়ের জন্য ওষুধপত্রসহ যাবতীয় খরচাদি মহব্বত বহন করে, আমার কিছুই করতে হয় না। ওর মতো এমন ভালো ছেলে আর হয় না, আমি ওর বাবা হওয়ায় বলছি না; যা সত্যি, তাই-ই বলছি।’
  বললাম, ‘তাহলে...!’
  তিনি বললেন, ‘বাবা, মহব্বত ছাড়া আমার বংশ রক্ষা করার আর কেউ নেই। আমার বয়স হয়েছে সহসাই দুনিয়া ছেড়ে চলে যাব, মহব্বতও একদিন চলে যাবে, তখন আমার ঘরে বাতি দেওয়ার আর কেউ থাকবে না। ছেলে যদি বিয়েশাদি করে তাহলে হয়তো আমাদের বংশ রক্ষা হবে। এমনি ওর বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি, এখনো যদি বিয়েশাদি না করে, তাহলে আর কবে বিয়ে করবে? এই বয়সে ওর জন্য মেয়ে পাওয়া কঠিনও হয়ে যাবে। বাবা, আপনি যদি ওকে একটু বিয়ে করতে রাজি করান, তাহলে আপনার জন্য প্রাণখুলে দোয়া করব।’
  তাঁর কথা শুনে আমি কিছুক্ষণ চুপচাপ রইলাম। তার পর বললাম, ‘কাকা, আমি ওর সঙ্গে একটু কথা বলে নেই আগে। আপনি একটু ধৈর্য ধরেন, আশাকরি দ্রুতই বিয়ের ব্যবস্থা হবে। ওই নিয়ে আপনি চিন্তা করবেন না, আমি ওকে রাজি করাবই কথা দিলাম।’
  মহব্বত দয়ালের বাবা কামরা থেকে বেরিয়ে যেতেই বিষয়টি নিয়ে আমি ভাবতে লাগলাম। ওর বিয়ে করা একান্ত প্রয়োজন, চিরকুমার থাকবে কেন! বনবাদাড়ে চাকরি করলে কিংবা প্রকৃতিপ্রেমী হলে কী সাংসারিক হওয়া যায় না? প্রকৃতিপ্রেম থাকবে মনেপ্রাণে, কাজেকর্মে, এতে সাংসারিক হতে বাধা কোথায়?
  ভাবতে ভাবতে আরেকটি বিষয় আমার মাথায় এল, মহব্বত দয়ালের অন্যকোন সমস্যা আছে কিনা জানতে হবে আগে। ওর কাছ থেকে কৌশলে জানতে হবে বিষয়টা, তার পর বিয়ের ব্যাপারে ওকে রাজি করাব।
  ভাবনানুযায়ী একদিন অন্যভাবে মহব্বত দয়ালের কাছে বিষয়টা উপস্থাপন করলাম। সে আমাকে জানিয়েছে তার ব্যক্তিগত কোন সমস্যা নেই। তবে সাংসারিক হতে মন চাচ্ছে না, সমস্যাটা এখানেই, অন্য কিছু নয়। আমি তাকে বুঝিয়ে বললাম, সংসার আর ধর্মকর্ম মানুষের জীবনের পরিপূর্ণতা এনে দেয়। মানুষের যদি উত্তরসূরি না থাকে তাহলে সে মানুষ হয় মূল্যহীন, জড়পদার্থ বললেও ভুল হবে না। মানুষের মৃত্যুর পরে তার নাম নেওয়ার মতো নিজ বংশে কাউকে না কাউকে রেখে যেতে হয়। পশুপাখিদের সেটি প্রয়োজন হয় না; প্রয়োজন হয় না মনিষীদের ক্ষেত্রেও। মনিষীদের কর্মফলই হচ্ছে তাঁদের উত্তরসূরি। যেহেতু আমরা মনিষী নই, সেহেতু আমাদের নিদৃষ্ট উত্তরসূরী রেখে যেতে হবে দুনিয়ায়। না হলে দুনিয়ায় আগমনই বৃথা; সুতরাং তোমাকে সাংসারিক হতে হবে দয়াল।
  আমার যুক্তি খণ্ডাতে না পেরে মহব্বত দয়াল মাথা নিচু করে রাখল। তার পর শুধু বলল, ‘বড়মিয়া আমার একটা শর্ত আছে।’
  বললাম, ‘একটা কেন, তোমার পাঁচটা শর্ত রাখব আমি; শর্ত জানাও।’
  মহব্বত দয়াল বলল, ‘আমি বিয়ে করলে পাত্রী দেখবেন আপনি। আপনার পছন্দের পাত্রী বিয়ে করব।’
  আমি হেসে বললাম, ‘ওইসব তোমাকে চিন্তা করতে হবে না। আমিই আগে দেখব পাত্রী, আমার পছন্দ হলে বিয়ের ব্যবস্থা করব। এখন আমাকে একদিন তোমার বাড়ি নিয়ে চল। তোমার বাবার সঙ্গে কথা বলব।’
 সে বলল, ‘বাবাকে তাহলে আমি দ্বীপ বনে নিয়ে আসি?’
 বললাম, ‘না না ওনাকে আনার দরকার নেই। বুড়ো মানুষ এতদূর পথ আসবেন এটা ঠিক না, বরং তুমিসহ আগামীকালই আমরা যাই। তাছাড়া আগামীকাল আমার কোন কাজকর্ম নেই, বলা যায় অবসরই আছি।’
  সে বলল, ‘আচ্ছা বড়মিয়া তাহলে চলেন।’ 
  বললাম, ‘তোমার বাড়িটাও দেখা হবে, আবার তোমার বাবার সঙ্গেও কথা হবে।’
  পরের দিন আমরা দুজন তার বাড়ি গেলাম। যাওয়ার পথে মোমিন মাঝির বাড়ি ডিঙ্গিয়ে গেলাম। ওদের দুই জনের বাড়ি সদর উপজেলার পাশাপাশি গ্রামে।
  মহব্বত দয়ালের বাবা আমাকে দেখে খুব বিস্মিত হলেন। মনে হচ্ছে হাতে নক্ষত্র পেয়েছেন। তিনি ভাবতেই পারেননি আমি তার বাড়ি যেতে পারি। আমাকে বাড়ির উঠোন থেকে হাত ধরে টেনে ঘরে নিয়ে গেলেন। উঠোনে উপস্থিত অনেক লোকজন ছিলেন। তিনি তাদের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘তোমরা আজ চলে যাও, আগামীকাল তোমাদের বিচারটা করে দিব আমি।’
   মহব্বত দয়ালের বাবার কথাশুনে আর তার সামনের লোকজন দেখে আমার একটু খটকা লাগল। বিষয়টা আমি মহব্বত দয়ালের কাছে জানতে চাইলে সে জানাল তার বাবা এক সময় গ্রামের প্রভাবশালীদের একজন ছিলেন, তখন গ্রামের বিচার সালিশ তাঁকেই করতে হতো। এখন বয়স হয়েছে বিধায় বিচার সালিশ করা ছেড়ে দিয়েছেন, তার পরেও মাঝেমধ্যে দুই-একটা বড় ধরনের বিচার এখনো করতে হয় তাঁকে।
  আমি অবাক হয়ে গেলাম মহব্বত দয়ালের কথাশুনে। আরও অবাক হলাম তাদের ঘরদোর দেখে। তিন রুমের একতলা বিল্ডিং, বেশ ফিটফাট করে সাজানো। অথচ এই বুড়ো মানুষটি সম্পর্কে আমি সেদিন কীসব ভেবেছিলাম। সেটি ভাবতেও এখন আমার লজ্জা লাগছে।
   মধ্যাহ্নভোজ সেরে বিভিন্ন কথাবার্তার পর মহব্বত দয়ালের বাবাকে বললাম, ‘কাকা, আপনার ছেলে বিয়ে করতে রাজি হয়েছে, ওর জন্য পাত্রী দেখেন।’
  আমার কথা শুনে তিনি খুশিতে কেঁদে দিলেন। তাঁর খুশিতে আমিও আপ্লুত হলাম।
  তিনি বললেন, ‘বাবা, আপনি খুব ভালো মানুষ। আমার ছেলেটা বাড়ি এলে সারাদিন আপনার কথাই বলে, তাই ভাবলাম দায়িত্বটা আপনাকে দিলেই ভালো হবে। ছেলে আপনার কথা শুনবে। আমার ভুল হয়েছে আরও আগে আপনার কাছে গেলে ভালো হতো।’
  বললাম, ‘কাকা, আপনাকে আর চিন্তা করতে হবে না, মহব্বত দয়ালের বিষয়ে আমিই ভাববো এখন থেকে।’
  আমার কথা শুনে তিনি আমাকে অনেক আশীর্বাদ করলেন। তার পর বললেন, ‘আজ থেকে আমি শান্তিতে ঘুমাতে পারবো বাবা।’
  বললাম, ‘কাকা, দয়ালের বিয়ের কাজটা দ্রুতই সারতে চাই। যেহেতু দয়াল বিয়ে করতে রাজি হয়েছে সুতরাং এখনই কাজটা সারতে হবে, বলা যায় না আবার বেঁকে বসতে পারে।’ 
  আরও বিভিন্ন বিষয়ে কথাবার্তা বলে সেদিনের মতো মহব্বত দয়ালের বাবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমরা দ্বীপ বনে চলে এলাম।
  দুই মাস পরের ঘটনা। একদিন মহব্বত দয়াল এসে আমাকে জানালো ওর জন্য নাকী এলাকায় পাত্রী খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। পাত্রীপক্ষ ওর বয়সের কথা জানলেই পিছিয়ে যায়। এখন বিয়ে করলে হয়তো বিধবা অথবা তালাকপ্রান্ত নারীকেই বিয়ে করতে হবে। এতে আবার মহব্বত দয়ালের আপত্তি আছে। তাই আমি একটু দমে গেলাম, তবে হাল ছাড়িনি।
   এরই মধ্যে মহব্বত দয়ালের বিয়ের বিষয়ে অবগত হলো মাহুত মোমিন মাঝি। সে একদিন আমাকে জানাল তার দূর সম্পর্কে এক আত্মীয়ের একটা মেয়ে আছে, সমস্যা হচ্ছে সেই মেয়ে কথা বলতে পারছে না; মুখবধির। যার কারণ তার বিয়েশাদীও হচ্ছে না। ফলে মেয়ের বয়সও বেড়েছে। মহব্বত দয়াল রাজি থাকলে মোমিন মাঝি কথা চালাচালি করবে বলে জানিয়েছে। এ-ও জানিয়েছে মেয়েটি কমবেশি লেখাপড়া জানে; সুন্দরীও।
  বিষয়টা আমি অবগত হয়ে বিস্তারিত মহব্বত দয়ালকে জানালাম। সে সব জেনেশুনে আমাকে সম্মতি জানাল, তাতে তার আপত্তি নাই।
   মহব্বত দয়ালের অনুমতি নিয়ে মোমিন মাঝিকে মেয়ের বাবার সঙ্গে কথা বলতে পাঠালাম একদিন। মোমিন মাঝি মেয়ের বাবার সঙ্গে কথা বলে দিন তারিখ ঠিক করে এসেছে। এবার আমাদের মেয়ে দেখতে যেতে হবে।
  নির্ধারিত দিনে আমরা প্ল্যান্ট থেকে ৫ জন রওয়ানা হলাম। আমাদের সঙ্গে আছে মোমিন মাঝি, মহব্বত দয়াল, আমি আর দুইজন প্রশাসনিক কর্মকর্তা সিকান্দার বারী ও বিনয় ভৌমিক। এছাড়াও মহব্বত দয়ালের বাবাসহ আরও কয়েকজন আমাদের সঙ্গী হলেন। আমরা প্রস্তুতি নিয়েই যাচ্ছিলাম, যদি পাত্রী পছন্দ হয় তাহলে আজই কাবিননামা সেরে ফেলব। অনুষ্ঠানাদি পরে হবে, প্ল্যান্টের সবাইকে নিয়ে আনন্দ করব মহব্বত দয়ালের বাড়ি গিয়ে। এ হচ্ছে আমার পরিকল্পনা, তাতে মহব্বত দয়ালেরও আপত্তি নেই।
  মধ্যাহ্নভোজ পাত্রীর বাড়িতেই সেরেছি আমরা। যথারীতি এবার পাত্রী দেখার পালা। পাত্রী এল আমাদের সামনে। প্রথম দেখায়ই পাত্রী পছন্দ হয়েছে আমার। গায়ের রঙ উজ্জ্বল শ্যামলা, স্বাস্থ্যবতীও। দেখতে ভারি চমৎকার। একে একে আমাদের সবার পছন্দ হয়েছে; পছন্দ হয়েছে মহব্বত দয়ালের বাবারও। সবার সঙ্গে কথা বললাম আমি, দুই পক্ষের সবাই বিয়েতে রাজি। পাত্রীর কাছে ইশারায় আমি জানতে চাইলাম তার পাত্র পছন্দ হয়েছে কীনা। সে ইশারায় আমাকে জানাল পাত্র তার পছন্দ হলেও এ বিয়েতে রাজি নয়। সে একটা কাগজে লিখে দিলো, ‘আমি মুখবধির। বিয়ে করলে একজন মুখবধিরকে বিয়ে করবো। কারণ সে মানুষ আমাকে যতটা বুঝতে পারবে, এই মানুষটা আমাকে ততটা বুঝতে পারবে না। আর এই মানুষটাকে বিয়ে করলে পরবর্তীতে তার মোহ কেটে গেলে আমার সঙ্গে খারাপ আচরণ করবে। যদি জোর করে আমাকে বিয়ে দেয়া হয়, তাহলে ফল ভালো হবে না।’
  পাত্রীর লেখা চিরকুট আমি মহব্বত দয়ালের হাতে দিলাম। চিরকুটে নজর দিয়ে মহব্বত দয়াল বলল, ‘বড়মিয়া ওর কথায় যুক্তি আছে। আমি ওকে স্যালুট জানাই।’
  এমন একটি ঘটনা ঘটাতে পারে মেয়ে, সেটা ওর বাবার ধারণার বাইরে ছিল। তিনি সামাজিক মানুষ, মেয়ের অমতের জন্য তিনি দুঃখ পেলেও মেয়েকে চাপাচাপি করেননি আর। তার পর তিনি মেয়ের হয়ে আমাদের কাছে ক্ষমা চাইলেন।
  বিকেল নাগাদ সেখান থেকে আমরা চলে এলাম। আসার সময় মহব্বত দয়াল বলল, ‘আমি আর জীবনে বিয়েশাদী করব না, আমাকে মাফ করবেন বড়মিয়া।’
  মহব্বত দয়ালের আক্ষেপ শুনে আমি খুব দুঃখ পেলাম। এমন একজন ভদ্রনম্র সহজ সরল মানুষ বিনা যৌতুকে বিয়ে করবে অথচ পাত্রী খুঁজে পাচ্ছে না। একটু বয়স বেশি হওয়া কি দোষণীয় কিছু? বিষয়টা ভাবতেই আমি খুব হতবাক হলাম। 
  আমি বললাম, ‘দয়াল, মন খরাপের কিছু নেই, আজকে বিয়ে হয়নি, আরেক দিন হবে। এটা স্বাভাবিক ঘটনা, এমন অনেক ঘটনা ঘটছে সমাজে প্রতিনিয়ত; বরং আমাদের একটা অভিজ্ঞতা অর্জন হয়েছে আজকের ঘটনায়। আমি মনে করি মেয়েটা বধির হলেও বুদ্ধিমতি। তুমি ভেঙ্গে পড়বে না, তুমি যখন রাজি হয়েছ সাংসারিক হতে, বিয়ে তোমার হবেই। আমি সব ব্যবস্থা করব। আমি তোমাদের সহযোগিতায় উজাড় হওয়া বনভূমির সতেজতা ফিরিয়ে এনেছি। বন্যপ্রাণীদের বংশবিস্তার ঘটাতে সাহায্য করেছি, ধ্বংসপ্রাপ্ত প্ল্যান্টকে আবার দাঁড় করিয়েছি। সেই কঠিন কাজে কি আমি সফল হইনি? হয়েছি। আর তোমার জন্য পাত্রী খুঁজে পাব না, এটা কি কোন ভাবনার বিষয় হলো? তুমি আর ক’টা দিন অপেক্ষা কর, নিশ্চিত তুমি সাংসারিক হবে, সব ব্যবস্থাই আমি করব।’   
  বিষয়টা আমি চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছি। আমার হাতে কিছু কাজকর্ম আছে সেসব সেরে মহব্বত দয়ালের বিয়ের ব্যবস্থা করব আমি। আমার ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্ল্যান্টেও অনুষ্ঠান করব, সেই অনুষ্ঠানে আমরা প্ল্যান্টের সবাই মিলে আনন্দ করব, সেরকম পরিকল্পনাও আমি নিয়ে রাখলাম।
   একমাসের মধ্যেই প্ল্যান্টের সব গুরুত্বপূর্ণ কাজ শেষ হয়ে এল আমার। হাতে তেমন কোন কাজকর্ম নেই এখন। সামনের মাসে শিপমেন্ট থাকলেও জটিল কোন কাজকর্ম নেই, রুটিন ওয়ার্ক ছাড়া। সেই সুযোগে মহব্বত দয়ালের বিয়ের কথা ভাবছিলাম আমি। প্ল্যান্টে লোকালয়ের কেউ এলেই আলাপ আলোচনা করি মহব্বত দয়ালের বিয়ের বিষয়ে। এভাবে আলাপ আলোচনা করতে করতে একদিন এক পাত্রীর সন্ধান পেয়েও গেলাম। পাত্রীর বাড়ি মহব্বত দয়ালের পাশের ইউনিয়নে। 
  পাত্রীর খোঁজ পেতেই দিনক্ষণ ঠিক করে মহব্বত দয়ালের বাবাকে সঙ্গে নিয়ে আমরা কয়েকজন মিলে পাত্রী দেখতে গেলাম। মধ্যাহ্নভোজের পর পাত্রী দেখার পালা। পাত্রীকে আমাদের সামনে নিয়ে আসা হলো। পাত্রী দেখলাম; পছন্দও হয়েছে আমাদের। আমাদের পছন্দে মহব্বত দয়ালেরও আপত্তি নেই, তাই আর দেরি না করে আমরা সে দিনই কাবিননামা করে ফেললাম। তারপর বিয়ের কয়েকদিন পর অনুষ্ঠানাদি সম্পন্ন করে বউ নিয়ে মহব্বত দয়ালের বাড়ি ফিরলাম। 
  মহব্বত দয়াল এখন সাংসারিক মানুষ। প্রতি সপ্তাহে ওকে বাড়ি যেতে হয়। ব্যস্ততার মধ্যেই ওকে সপ্তাহটা পার করতে হয়। এভাবে মাস তিনেক অতিবাহিত হওয়ার পর একদিন সে জানালো সংসার গোছাতে তার দুই সপ্তাহের ছুটি প্রয়োজন। আমি সঙ্গে সঙ্গে তার ছুটি মঞ্জুর করে দিলাম।

  আমি প্ল্যান্টে থাকাকালীন পাঁচ বছরের মধ্যে এ প্রথম মহব্বত দয়াল দীর্ঘদিন ছুটি নিয়েছে। এর আগে বাড়ি গেলে সর্বোচ্চ একদিনের ছুটি নিতো সে; এবার একটানা দুই সপ্তাহ। ওকে ছাড়া দুই সপ্তাহ পার করা আমার জন্য খুব কঠিন, সত্যি বলতে আমার ভীষণ খারাপ লাগছে মহব্বত দয়াল ছুটিতে যাওয়ায়। সে ছুটিতে যাওয়ার পর আমি নিঃসঙ্গ হয়ে গেলাম। আমার নিরাপত্তায় অন্যজন নিয়োজিত থাকলেও মহব্বত দয়ালকেই ঘুরেফিরে মনে পড়ছে।
   এদিকে প্রথম সপ্তাহ ছুটি কাটিয়ে মহব্বত দয়াল দ্বীপ বনে এসে হাজির হলো একদিন। ওকে দেখে আমি যেন হাতে নক্ষত্র পেলাম। খুব খুশি হলাম মনে মনে, এতটা খুশি আমি সহসাই হতে পারিনি আর। বললাম, ‘দয়াল, আমি জানতাম তুমি ছুটি কাটাতে পারবে না, চলে আসবে বনের টানে, মনের টানে।’
  মহব্বত দয়াল চুপচাপ; কোন কথা বলছে না, মাথা নিচু করে রেখেছে। ওর মন খারাপ, চোখ ছলছল করছে। আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, ‘দয়াল, তোমার মন খারাপ কেন? বাড়িতে কিছু ঘটেছে নাকি! তোমার বাবা-মা-স্ত্রী সুস্থ আছেন তো?’
  মহব্বত দয়াল বলল, ‘বড়মিয়া, বাড়ির সবাই ভালো আছেন। আমার মন অন্য কারণে খারাপ লাগছে।’
 ‘কি সে কারণ!’
  আমার প্রশ্নের জবাব দিচ্ছে না সে। মাথা নিচু করে রাখল। লক্ষ্য করলাম ওর গালবেয়ে অশ্রুজল গড়িয়ে পড়ছে। ব্যাপারটা আমাকে খুব ব্যথিত করল; বিষয়টা জানতে উদগ্রীব হলাম আমি। কী অমন ঘটনা ঘটেছে যে তার জন্য ওকে অশ্রু বিসর্জন দিতে হচ্ছে। আমার কৌতূহল বেড়ে যেতেই মহব্বত দয়াল বলল, ‘বড়মিয়া আমি আর প্ল্যান্টে চাকরি করতে পারবো না, সে জন্য আমার খুব খারাপ লাগছে।’
  ‘কেন চাকরি করতে পারবে না! কি হয়েছে? আমাকে সব খুলে বল তো দয়াল।’
  সে বলল, ‘বড়মিয়া, আমাকে বাড়িঘরে স্থায়ী হতে হবে। আমার কোন ভাই নেই, বাবার শরীরটা খুবই খারাপ যাচ্ছে, মা-ও অসুস্থ। নয়া বউকে এখন কার কাছে রেখে আসব; সে তো একা থাকতে পারবে না। বাবা সুস্থ থাকলে তিনিই দেখাশুনা করতে পারতেন সব। এখন সংসারটা দেখারও কেউ নেই, তাই সংসারের দায়িত্বটা আমাকেই নিতে হচ্ছে। বড়মিয়া, সংসার কী জিনিস এতদিন বুঝিনি, এখন বুঝতে শিখেছি, আপনি শিখিয়েছেন। সংসারের হাল ধরতেই নিকট আত্মীয়রা সবাই পরামর্শ দিয়েছেন ব্যবসা-বাণিজ্য করতে। উপজেলা সদরে আমাদের একটা দোকানঘর আছে, সেটা বাবা ভাড়া দিয়েছিলেন। ভাড়ার মেয়াদও শেষ হয়েছে কয়েক মাস আগে, তাই সবাই বলছেন দোকানটা আমাকে চালাতে। ছুটিতে বাড়ি গিয়ে সেই সব ঠিকঠাক করে এলাম।’
  মহব্বত দয়ালের কথা শুনে আমার ভেতরে দুমড়ে মুচড়ে এলেও আমি মুখে কিছু বলতে পারলাম না আর। যেন হঠাৎ করে আমার বাকরুদ্ধ হয়ে এল। ভাবছি এসব কী বলছে মহব্বত দয়াল! আমার সঙ্গে ঠাট্টা করেনি তো সে? কিন্তু মহব্বত দয়াল আমার সঙ্গে ঠাট্টা করার মতো মানুষ নয়; প্ল্যান্টের কেউ-ই আমার সঙ্গে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করে না। তবে কি আমি ভুল শুনছি? আমি কি সত্যি সত্যিই নিঃসঙ্গ হতে যাচ্ছি ? মহব্বত দয়ালকে সাংসারিক বানিয়ে দূরে ঠেলে দেওয়ার মতো কাজটি তো আমিই করেছি। সে তো সাংসারিক হতে চায়নি, জোর করে কাজটি করেছিলাম আমি। সুতরাং সঙ্গী হারানোর বেদনা তো আমাকে মেনে নিতেই হবে। তার পরেও সান্ত্বনা, মহব্বত দয়াল এখন আর চিরকুমার নয়, সাংসারিক হয়েছে, বাবা-মাকে দেখাশুনা করছে; বিষয়টা মন্দ লাগছে না আমার। ভাবছি বন্যপ্রাণীর বংশবিস্তারে উদ্যোগ নিয়েছি আমি, আর মানুষের বংশবিস্তারে সহায়ক হবো না, তা কি হয়? আসলে এ কাজটি আমার আরও আগেই করা উচিত ছিল। সংসারধর্ম না থাকলে মানুষের জীবনে পরিপূর্ণতা আসে না। মহব্বত দয়ালের জীবনে আমি পরিপূর্ণতা এনে দিলাম; এতেই আমি পরিতুষ্ট, এতেই আমি সফল। তবে সহকর্মী হারানোর ব্যথায় আমারও যে মনস্তাপ নেই, তা কিন্তু নয়। আমার বক্ষঃস্থল ভারি হয়ে এলেও বিলাপ করে হালকা করতে পারিনি; যা পেরেছে মহব্বত দয়াল।

বিডি প্রতিদিন/ফারজানা

সর্বশেষ খবর