শুক্রবার, ৯ অক্টোবর, ২০১৫ ০০:০০ টা

বাবা কখন আসবে

বাবা কখন আসবে

শিল্পকর্ম : সমর মজুমদার

আমি আমার নানীকে ডাকতাম বুজি।

কাল বিকেলে বুজি বলেছেন, আজ বিকেলের লঞ্চে বাবা আসবেন। শোনার পর থেকে আমার ভিতর শুরু হয়েছে অদ্ভুত এক ছটফটানি। সন্ধেবেলা পড়তে বসে পড়ায় আর মন বসে না। হারিকেনের ম্লান আলোর দিকে উদাস হয়ে তাকিয়ে থাকি। বুজির কোলের কাছে শুয়ে রাতেরবেলা কিছুতেই ঘুম আসে না। শুধু মনে হয় কখন সকাল হবে। সকালবেলা মনে হয় কখন দুপুর হবে, দুপুর গড়িয়ে বিকেল। কখন হাজামবাড়ির মজিদের সঙ্গে মাওয়ার ওদিককার নদীতীরের লঞ্চঘাটে গিয়ে দাঁড়াব আমি। কখন পদ্মার বাঁকে ছবির মতো আস্তে ধীরে ফুটে উঠবে একটি লঞ্চ, তর তর করে এগিয়ে আসবে ঘাটের দিকে। কাছাকাছি আসার পর দেখা যাবে ডেকের ওপর হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছেন বাবা।

বাবার জন্য এই অপেক্ষাটা শুরু হয়েছিল ছেলেবেলায়। সেই বয়সেই বুঝে গিয়েছিলাম চারপাশের মানুষের মধ্যে আমি সবচাইতে ভালোবাসি আমার বাবাকে। আমার বাবার মতো মায়াবী, সুন্দর মুখের মানুষ আর কেউ নেই। বাবার মতো ভালোবাসতে কেউ জানে না।

আমার তখন ছসাত বছর বয়স। বিক্রমপুরের মেদিনী মণ্ডল গ্রামে বুজির কাছে থাকি। অন্য ভাই-বোনদের নিয়ে মা থাকেন ঢাকায়। জিন্দাবাহার থার্ড লেনে বাসা। বাবা চাকরি করেন মিউনিসিপ্যালিটিতে। আমরা অনেকগুলো ভাইবোন। এতগুলো ছেলেমেয়ে একা সামলাতে পারতেন না মা। এ জন্য আমাকে রেখেছিলেন বুজির কাছে। কিন্তু ছেলেমেয়েদের মধ্যে আমার জন্য বাবার ছিল সবচাইতে বেশি টান। এ জন্য ছুটিছাটায় বাবা আমাকে দেখতে আসতেন। মেদিনী মণ্ডলের পাশের গ্রাম কাজির পাগলা, সেই গ্রামের বিখ্যাত স্কুল কাজির পাগলা, এটি ইন্সটিটিউশনের সরাসরি ক্লাস টুতে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিলেন আমাকে।

বাষট্টি তেষট্টি সালের কথা। তখন ঢাকা থেকে মাওয়া-মেদিনী মণ্ডলে যাওয়ার দুটো পথ ছিল। একটি সরাসরি লঞ্চে। ঢাকার সদরঘাট থেকে সকালবেলা লঞ্চে চড়লে সেই লঞ্চ মুন্সীগঞ্জ চাঁদপুর হয়ে দিনের শেষে মাওয়া ভাগ্যকূল পৌঁছাত। আর একটা পথ ছিল শ্রীনগর হয়ে। মেদিনী মণ্ডল থেকে হেঁটে কিংবা সীতারামপুর, কাজির পাগলা অথবা গয়ালিমান্দ্রা থেকে কেরায়া নৌকায় শ্রীনগর ষোলঘর কিংবা আলমপুর থেকে লঞ্চে শীতলক্ষ্যা ধরে ঢাকায়। খরালিকালের পথ ছিল এই রকম। বর্ষায় শ্রীনগরের লঞ্চ গয়ালিমান্দ্রা পর্যন্ত আসত। তখনকার বর্ষায় শ্রীনগরের খাল আজকালকার ছোটখাটো নদীর মতো।

যা হোক আমাকে দেখতে এসে এক-দুই দিনের বেশি থাকতেন না বাবা।

আমরা বাবাকে ডাকতাম আব্বা। যে একটি দুটি দিন বাড়ি থাকতেন আব্বা, সারাক্ষণ তাঁর সঙ্গে। স্কুলে যেতাম না, পড়তে বসতাম না। খেতাম আব্বার সঙ্গে, ঘুমাতাম তাঁর গলা জড়িয়ে। আর কত যে কথা বলতাম আব্বার সঙ্গে। ওই বয়সের ছেলেমানুষি কথা। এমনকি গান গেয়েও শোনাতাম আব্বাকে। অর্থাৎ নিজের সব গুণপনা দিয়ে আব্বাকে মুগ্ধ করার চেষ্টা।

আব্বা মুগ্ধ হতেন। যখন তখন বুকে জড়িয়ে ধরতেন আমাকে। মাথায় পিঠে হাত বুলিয়ে আদর করতেন।

সেই বয়সে সবচাইতে দুখের দিন ছিল আব্বা যেদিন চলে যেতেন।

তখন খরালিকাল (গ্রীষ্ম)। মাওয়ার লঞ্চে এসে আব্বা ফিরে যাচ্ছেন শ্রীনগরের লঞ্চে। সকালবেলাই আব্বার জন্য গরম ভাত আর সাচরা (গুঁড়ো) মাছের ঝোল রেঁধেছেন বুজি। আমাকে নিয়ে খেতে বসেছেন আব্বা। কিন্তু আমাদের দুজনের কারোরই গলা দিয়ে ভাত নামে না। আব্বার চোখেও পানি আসে, আমার চোখেও পানি আসে। তারপর এক সময় আমাকে জড়িয়ে ধরে, মাথায় পিঠে হাত বুলিয়ে পথে নামেন আব্বা। বারবাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে নিঃশব্দে কাঁদতে থাকি। আব্বা হেঁটে যান আর ফিরে ফিরে তাকান। দূর থেকে আমি দেখি, থেকে থেকে চোখ মুচছেন আব্বা।

কোনো কোনো সময় সীতারামপুর থেকে কেরায়া নৌকায় করে শ্রীনগর যান আব্বা। হাজামবাড়ির মজিদ তাঁর ব্যাগ পৌঁছে দিতে যায়। মজিদ সঙ্গে থাকলে আমিও সীতারামপুর পর্যন্ত যেতে পারি। কিন্তু নৌকা ছাড়ার পর একদিকে কাঁদেন আব্বা আরেক দিকে আমি।

আমার সমগ্র ছেলেবেলা কেটেছে এইভাবে, আব্বার জন্য কেঁদে।

তারপর যখন ঢাকায় চলে এলাম তখন শুরু হয়েছিল আব্বার জন্য অন্যরকম এক অপেক্ষা। দশটি ছেলেমেয়ের সংসার এক চাকরিতে কিছুতেই চালাতে পারতেন না আব্বা। এ জন্য অফিসের পর নানা রকমের টুকটাক কাজ করতে হতো তাঁকে, টিউশনি করতে হতো। সকালবেলা বাসা থেকে বেরিয়ে ফিরতেন অনেকটা রাত করে। দুপুরে খেতেন কি খেতেন না জানতেও পারতাম না। কিন্তু রাত যত বাড়ত আব্বার জন্য উৎকণ্ঠা ততই বাড়ত আমার। পড়তে বসে আব্বার জন্য আনমনা হয়ে যেতাম আমি, খেতে বসে আনমনা হয়ে যেতাম। অন্যান্য ভাইবোন যে যার মতো পড়াশোনা খাওয়া-দাওয়া গল্প-গুজব করে শুয়ে পড়ত, আব্বার কথা হয়তো ভাবতই না, কিন্তু আমি শুতে পারতাম না। আমি একা একা চলে যেতাম রাস্তার মোড়ে। আব্বার জন্য দাঁড়িয়ে থাকতাম। অনেকটা রাত করে ফিরতেন আব্বা। দূর থেকে পা চালিয়ে হেঁটে আসতেন। আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মায়াবী মুখখানা তাঁর ভরে যেত মোহময় এক হাসিতে।

আব্বা মারা গেলেন একাত্তর সালে। অক্টোবরের ৬ তারিখ রাত ১টা। তার মানে ৭ তারিখ। আব্বার মৃত্যুর পর আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। চার দিন কথা বলতে পারিনি। আমার তখন ষোল বছর বয়স। এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার কথা। দেশে চলছে মুক্তিযুদ্ধ। প্রতিদিন দেশ এগোচ্ছে স্বাধীনতার দিকে। ঢাকা মেডিকেলে আব্বা শেষনিঃশ্বাস ফেলেছিলেন আমার চোখের সামনে। তবু আমার বিশ্বাস হয়নি আব্বা মারা গেছেন, আব্বা আর কোনোদিন ফিরে আসবেন না। তাঁর সঙ্গে কোনোদিন আমার আর দেখা হবে না।

তারপর থেকে কতদিন, কতভাবে যে আব্বার জন্য আমি অপেক্ষা করেছি। মনে হয়েছে হঠাৎ করে কোনো দুপুর শেষে আব্বা এসে হাজির হবেন। কোনো বৃষ্টিভেজা বর্ষায় বারান্দায় দাঁড়িয়ে গামছায় মাথা মুছবেন।

আব্বা মারা গেছেন বত্রিশ বছর আগে। এখনো কোনো কোনো গভীর রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে মনে পড়ে তাঁর কথা। নিজের অজান্তেই ফিরে যাই ছেলেবেলায়, কৈশোরকালে। নিজেকে দেখতে পাই গেণ্ডারিয়ার ডিস্ট্রিলারি রোডের কোনো এক মোড়ে গভীর রাতে একাকী দাঁড়িয়ে আছি। আব্বার জন্য অপেক্ষা করছি। ওই তো মলিন পাজামা আর খদ্দরের পাঞ্জাবি পরা আব্বা সারাদিনের ক্লান্তি নিয়ে ফিরে আসছেন। দূর থেকে আমাকে দেখেই মায়াবী মুখখানি তাঁর উজ্জ্বল হয়েছে। কাছে এসে আমার মাথায় হাত দিয়েছেন তিনি।

এখনো কোনো কোনো গভীর রাতে আব্বার জন্য কাঁদি আমি।

সর্বশেষ খবর