শুক্রবার, ২৩ অক্টোবর, ২০১৫ ০০:০০ টা

জীবনানন্দ, নিঃশব্দে দ্যুতিমান

মাসুদুজ্জামান

জীবনানন্দ, নিঃশব্দে দ্যুতিমান

জীবনানন্দ দাশ [ জম্ন: ১৮ ফেব্র“য়ারি ১৮৯৯-মৃত্যু : ২২ অক্টোবর ১৯৫৪]

‘কবিতা রূপ পরিগ্রহ করে একটা অমেয় পরিধির ভিতর যেন যাকে পাতালেও দেখা যায়, এবং নীলিমায়, কিন্তু প্রধানত এই পৃথিবীর ভিতর, জনসমাজে...।’ জীবনানন্দ দাশ, মাত্রাচেতনা, কবিতার কথা। জনপ্রিয় জননন্দিত কবি তিনি। অর্ধ শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে বাঙালির হৃদয়াসনে স্বমহিমায় অধিষ্ঠিত। তরুণতর কবি থেকে বয়োজ্যেষ্ঠ কবি, সদ্য পাঠক হয়ে ওঠা তরুণ থেকে প্রাজ্ঞ প্রৌঢ় পাঠক, সবার কাছেই তিনি সমাদৃত। এতক্ষণ পর্যন্ত নিরুচ্চার্য থাকলেও সেই কবি যে জীবনানন্দ দাশ, না বললেও পাঠকদের নিশ্চয়ই বুঝতে অসুবিধা হয়নি। জীবনানন্দ দাশ নিঃসন্দেহে আমাদের কালের শ্রেষ্ঠ কবি। শ্রেষ্ঠত্বের এ মহিমার কারণেই আজও তাকে প্রাসঙ্গিক মনে হয়, প্রয়োজনীয় মনে হয়। যে কবিতা তিনি লিখে গেছেন, সময়ের দূরতর ব্যবধান সত্তে¡ও মনে হয় তা এ মুহূর্তের কবিতা, আমার কবিতা, আমাদের কবিতা।

কিন্তু কে এই আমি বা আমরা? এ সময়ের যাপিত মানুষ, সময়ের ক্ষরণ ও চিম্নয় সৌন্দর্যকে যারা অনুভব করেন সেই তো এই আমি, আমরা। বিপন্নতার বোধ আমাদের তীব্র, সেই সঙ্গে আÍঅতিক্রান্তির অনুভবও আমাদের প্রাণিত করে। জীবনানন্দ এ বিপন্ন বিষণ বিধুর সময়ের কবি, সেই সঙ্গে উৎক্রান্তিরও। নীৎশেই বলেছিলেন, প্রতিটি কালেরই আছে ‘সংকটময় মুহূর্ত’। কিয়ের্কেগাড আবার বলেছিলেন, অস্তিত্বের অভিজ্ঞানও মানুষের টিকে থাকার প্রাথমিক উপায় বিশেষ। এই টানাপড়েনের ভিতরে, আমাদের মনে পড়বে শোপেনহাউয়ারের অস্তিত্ব বিষাদময় ভাবনার কথা। জীবনানন্দ দাশ, তার ভিতরেও এ অস্তিত্বমোথিত সংকটের কথা আছে। ‘তিমিরবিলাসী’ এবং ‘তিমিরবিনাশী’ শব্দ দুটির দ্বিমেরু ভাবময়তা বা দেরিদা যাকে বলেন ‘দ্বিবৈপরীত্যে’র মধ্যেই এই সংকটের ধারণাটা স্পষ্ট : তিমির হননে তবু অগ্রসর হয়ে/ আমরা কি তিমিরবিলাসী?/ আমরা তো তিমিরবিনাশী/ হতে চাই / আমরা তো তিমিরবিনাশী। লক্ষণীয়, শেষ পঙ্ক্তিটির ওপরই জোর দিয়েছেন জীবনানন্দ। মানুষ হিসেবে তিমিরবিনাশ বা অতিক্রমণের ভাবনাটাই মানবিক। জীবনানন্দ এই অতিক্রমের কথাই বলেছেন কবিতায়। তবে অমানবিক বিষয়গুলোকে পরিহার করে নয়, আÍস্থ করে সংকটমুক্তির ইশারা রেখে গেছেন, ‘ভাবা যাক / ইতিহাস খুঁড়লেই রাশি রাশি দুঃখের খনি / ভেদ করে শোনা যায় শুশ্র ষার মতো শত শত / শত জলঝরনার ধ্বনি।’

বলছিলাম, জীবনানন্দ আজও কেন প্রাসঙ্গিক? পাঠক, জীবনানন্দের কবিতা আপনার ভালো লাগে, আপনি তার ভিতরে নিজেকেই খুঁজে পান কী বিপন্নতার, কী সংকট মুক্তির। কিন্তু কীভাবে এটা সম্ভব করে তুলেছিলেন জীবনানন্দ? কী সেই মায়াবী সম্মোহন যার টানে বার বার জীবনানন্দের কবিতা পড়তে হয়? এই প্রশ্নের উত্তরের ভিতরেই আছে সেই সূত্রটি যার জন্য অন্য সব কবিকে সরিয়ে জীবনানন্দের কাছেই যেতে হয় আমাদের। কিছুটা গভীরভাবে যদি দেখি প্রধানত দুটি কারণে জীবনানন্দ এখনো আমাদের কাছে প্রাসঙ্গিক : প্রথমত, সময়চেতনা, দ্বিতীয়ত, কবিতার শৈলী বা নন্দন এতটাই দেদীপ্যমান যে তা আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করবেই। কবির শান্ত, আÍপ্রতিজ্ঞ, দৃঢ় দৃষ্টিভঙ্গিও যে পরবর্তী কবিদের মধ্যে কতটা সংহত সুচেতনার জম্নদিতে পারে, সেই শিক্ষাও জীবনানন্দের কাছে পেয়েছিলেন উত্তরকালের কবিরা। কিন্তু সহজ সরল কোনোকিছুর কাছে সমর্পণ নয়, বহমান সরল জীবনের কথা নয়, জটিল, বিষাদমাখা যে জীবন, সেই জীবনের কথা আছে বলেই জীবনানন্দের কবিতা আমাদের ভালো লাগে।

আধুনিক মানুষের একটা দিক হচ্ছে সে নিজেকে ছড়িয়ে দিতে ভালোবাসে। নিজের যাপিত ছোট্ট গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে পৃথিবীর সঙ্গে সে সম্পর্কিত হতে চায়। জীবনানন্দ এভাবেই অনুভব করেছেন, পৃথিবীর গভীর গভীরতর অসুখ এখন। এই পৃথিবীতে ‘না এলেই ভালো হতো’, কিন্তু ‘এসে যে গভীর লাভ হলো’ তাও বুঝেছেন তিনি। এই যে একদিকে না এলেই ভালো হতো, আরেক দিকে এসে লাভ হলো, চিন্তনের এই সংঘাতই হলো আধুনিক মানুষের বৈশিষ্ট্য। কিন্তু ভাবনাটি যখন পরের পঙ্ক্তিতে ‘মানুষ তবুও ঋণী পৃথিবীরই কাছে’ এভাবে স্থির হয়, তখন পাঠক যে স্বস্তি খুঁজে পান, সেই স্বস্তিসূচক অবস্থার কথাও মনে পড়বে আমাদের। অর্থাৎ পাঠক যতই বিপন্নতার ভিতর দিয়ে অগ্রসর হোক না কেন, সামান্য হলেও তার স্বস্তি চাই। নির্মমতার মধ্যেও তাই উলি­খিত কবিতায় ঋণের কথাও উচ্চারিত হয়েছে। জীবনানন্দের এই হচ্ছে ভাববিশ্ব, যা থিসিস আর অ্যান্টিথিসিসের স্তর পেরিয়ে সিনথিসিস গিয়ে পৌঁছায়, পায় পূর্ণতা।

কিন্তু যে স্বস্তি পাঠককে দেন জীবনানন্দ দাশ, সেই স্বস্তি মনের, হৃদয়ের, ‘নারী, শুধু তোমাকে ভালোবেসে / বুঝেছি নিখিল বিষ কী রকম মধুর হতে পারে।’ জীবনানন্দের জনপ্রিয় হয়ে ওঠার এও আরেক বড় কারণÑ আধুনিক মানুষের হার্দিক বিপন্নতার কথা সংগোপনে তুলে ধরেছেন তিনি। নারীকে ঘিরেই তার এই হৃদয়যাপন, এই নারী আধুনিক নারী ও পুরুষ উভয়েরই মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু। কী এশিরিয়ায়, মিসরে, বিদিশার রূপসী, কী মরুভ‚মির মনভুলানিয়া দুলালী, সর্বত্রই তাদের বিচিত্র রূপ তাকে মুগ্ধ করে রেখেছে, ‘আমি দেখিয়াছি তারে ঘুমপথে, স্বপ্নে কত দিন।’ কিন্তু নারীকে ঘিরে এই ভাবনাও তো জাগে, ‘প্রেম ধীরে মুছে যায়, নক্ষত্রেরও একদিন মরে যেতে হয়, / হয় নাকি?’ প্রেম মুছে যায়, কিন্তু সত্যিই কি মুছে যায়, এই যে টানাপড়েন, এই যে অনিশ্চয়তার বোধ, এটাই তো এখনকার পাঠককে আকর্ষণ করে। বনলতা সেন, কিংবা সুরঞ্জনা এভাবেই পাঠকের কাছে প্রিয় হয়ে উঠেছে। সুরঞ্জনার সংস্পর্শেই নারীর প্রতি সমর্পণের সৌন্দর্যটা বিচ্ছুরিত হয় এভাবে, ‘আরো আলো : মানুষের তরে এক মানুষীর গভীর হৃদয়’। কিন্তু এই নারীকে ঘিরেই ঘনিয়ে ওঠে বেদনা : ‘আহা, ইহাদেরই কানে / অনেক ঐশ্বর্য ঢেলে চলে গেল যুবকের দল; / একবার নক্ষত্রের পানে চেয়েÑ একবার বেদনার পানে।’ তবে এতকিছুর পরেও কী মধুর জীবনানন্দের নারীভাবমূর্তি, ‘এই জীবনের সত্য তবু পেয়েছি এক তিল : / পদ্মপাতায় তোমার আমার মিল। / আকাশ নীল, পৃথিবী এই মিঠে, / রোদ ভেসেছে, ঢেঁকিতে পাড় পড়ে; / পদ্মপাতা জল নিয়ে তারÑ জল নিয়ে তার নড়ে; / পদ্মপত্রে জল ফুরিয়ে যায়।’ সময়চেতনাও তার কবিতায় স্পষ্ট।

জীবনানন্দের কবিতার আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, সব মহৎ কবিতারই যেমন থাকে, অর্থের বহুমাত্রিকতা। ‘গোধূলিসন্ধির নৃত্য’ কবিতাটিকে ঘিরে যে বিতর্ক ঘনিয়ে উঠেছিল, সেই বিতর্ক থেকেই বোঝা যায় একটি মাত্র অর্থ নয়, বহুমাত্রিক অর্থারোপের দিকেও পাঠককে টেনে নেয় জীবনানন্দের কবিতা। কলকাতার কবি বন্ধু রণজিৎ দাশই এ বিতর্কের কথাটা সবিস্তারে বলেছেন তার একটা প্রবন্ধে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছিলেন ‘কয়েকটি সর্বনাশপন্থি নারী কোথাও এক জঙ্গলের মধ্যে সদ্য জ্যোৎøায় নাচ শুরু করেছে। তাদের ঘিরে কয়েকটি পুরুষ। কবিতাটির বিষয় এটুকু। কবি নরেশ গুহ বললেন, সর্বনাশপন্থি নারীদের তিনি খুঁজে পাননি, বরং এটি একটি ঠাট্টার কবিতা। কবি অরুণ কুমার সরকার এ বিতর্কে যোগ দিয়ে বললেন, ‘...আলোচিত কবিতাটি এযাবৎ আমার মনে যে অর্থ বহন করে এসেছে সেটা নাচেরও নয়, ঠাট্টারও নয়... একটি পরিব্যাপ্ত বিষাদের’। অন্যদিকে কবি সঞ্জয় ভট্টাচার্য লিখলেন, ‘জীবনানন্দ আমাদের কালের ইতিহাসের অতীত ও ভবিষ্যতের সন্ধিক্ষণকে যে প্রতীক-নৃত্যে ধরেছেন তারই নাম ‘গোধূলিসন্ধির নৃত্য।’ সবশেষে অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত তার ‘জীবনানন্দ’ শীর্ষক চমৎকার আলোচনা গ্রন্থে কবিতাটির মধ্যে খুঁজে পেলেন ‘ঐশিতা ও নারকীয়তার সংমিশ্রণ’। জীবনানন্দের কবিতা এভাবেই অনিশ্চিত অনেক অর্থের দিকে পাঠককে টেনে নিয়ে যায়, কিংবা একটি কবিতার নানান অর্থ করতে পারেন নানান জন। পাঠককৃত এ ধরনের বহুমাত্রিক পাঠ নিঃসন্দেহে যে কোনো কবিতার জন্য গৌরবের। জীবনানন্দের অনেক কবিতারই এরকম নানা অর্থ করা যায়, পাঠক সেভাবেই তার কবিতা পাঠ করে আনন্দ পায়। সত্যি এ এক বিস্ময়, কীভাবে মাত্র একটি কবিতায় এ বহুমাত্রিক ভাবার্পণ সম্ভব হলো? রণজিৎ ঠিকই বলেছেন, জীবনানন্দের এসব কবিতা খণ্ড বৈচিত্র্যে বহুকৌণিক। বাংলা কবিতায় জীবনানন্দের হাতেই তৈরি হলো এ ধরনের কবিতা। এর বৈশিষ্ট্য হলো, তা একাধারে বহির্বাস্তবতা অন্যদিকে মনোবাস্তবতাকে ধারণ করে পাঠককে জাদুবাস্তবতার মধ্যে নিয়ে যায়। অস্তিত্বের অমোঘ উচ্চারণে ও অনুভবে জ্বলে উঠেছিলেন জীবনানন্দ দাশÑ ‘তবুও মানুষ তার বিছানায় মাঝরাতে নৃমুণ্ডের হেঁয়ালিকে / আঘাত করিবে কোনখানে?’

আঙ্গিকের এই যে নিরীক্ষা, এটাই হলো জীবনানন্দের সেই নান্দনিকতা, যার মাধ্যমে বাংলা কবিতায় ঘটল বাঁকবদল। পঞ্চাশের প্রখ্যাত কবি সদ্যপ্রয়াত উৎপল কুমার বসু একে উল্লেখ করেছিলেন ইমেজের সমাহার বলে, রবীন্দ্রনাথ যাকে বলেছেন ‘চিত্ররূপময়তা’। জীবনানন্দ-পরবর্তী কবিতা এ ইমেজের ব্যবহার এতটাই অবিরল, প্রায় অনিঃশেষ হয়ে উঠবে যে ইমেজের পর ইমেজ সাজিয়ে দিলেই বুঝি কবিতা হয়ে ওঠে, এরকমটাই ভাবেন তরুণ কবিরা। দার্শনিক মনন ও মনোবাস্তবতার জন্যও জীবনানন্দের কবিতা আলাদা কিন্তু উল্লেখযোগ্য হয়ে উঠেছিল। দার্শনিকতার জন্য তার কবিতা যেমন ঋদ্ধ, তেমনি মনোলোকের আবছায়া ভাবচ্ছবির জন্যও নিঃসন্দেহে চমৎকার। কবিতার ভাষাও আদ্যন্ত বদলে গেল। এ কথা তো আমাদের অজানা নেই যে বাংলা কবিতায় পরাবাস্তবতার সূচনা ঘটেছিল জীবনানন্দের হাতে, সেই সঙ্গে ম্যাজিক রিয়্যালিজমেরও। উৎপল কুমার বসু বলেছিলেন, জীবনানন্দের কাছে তিনি শিখেছিলেন কীভাবে খণ্ড বৈচিত্র্যকে ইমেজের মধ্য দিয়ে কবিতা রচনা করা যায়।

শুরুটা ছিল সেই ষাটের দশকে, জীবনানন্দের মৃত্যুর পর অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছিল জীবনানন্দের প্রভাব। বিনয় মজুমদার তো প্রকাশ্যেই স্বীকার করে নিয়েছিলেন জীবনানন্দের প্রভাব কী অমোঘ হয়ে উঠেছিল তার কাব্যচর্চায়। কিন্তু তিনি এও বুঝেছিলেন, ‘জীবনানন্দের কবিতা নকল করার মতো ক্ষমতা আমার নেই। জীবনানন্দকে নকল করা এত সহজ ব্যাপার নয়।’ জীবনানন্দের কবিতার সূত্রে তিনি আবিষ্কার করেছিলেন কবিতার ‘সৌন্দর্যতত্ত¡’। সেই সৌন্দর্য হচ্ছে এলিমিনেশনের, আলোকচিত্র ধর্মিতার চ্যুতির, চিত্রকল্প, রূপকল্প এবং উপমার ব্যবহার, উপমার বদলে বিকল্প হিসেবে প্রতীকের ব্যবহার, রসাÍক বাক্য নির্মাণ, কবিতাকে স্মৃতিস্থ করার ব্যবস্থা, গভীরতা, সংযম আর বহুমাত্রিক ভাবের উপস্থিতির। জীবনানন্দ যে স্বতন্ত্র ভাষার স্রষ্টা, তাও বিনয় মজুমদারের দৃষ্টি এড়ায়নি। বিনয়ের মতো শক্তি চট্টোপাধ্যায়ও জীবনানন্দের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিলেন বেশি। বাংলাদেশেও পঞ্চাশের কবিরা তাদের কাব্যচর্চার শুরুতেই জীবনানন্দ দাশের কাছ থেকে কাব্যশৈলী আর ভাব প্রকাশের দীক্ষা নিয়েছিলেন। শামসুর রাহমান, শহীদ কাদরী, সৈয়দ শামসুল হক, আল মাহমুদÑ সবার ওপরই কমবেশি প্রভাব পড়েছিল জীবনানন্দের। ষাটের কবিরাও জীবনানন্দের অনুরাগী ছিলেন। তবে সব ছাপিয়ে গত শতকের আশির দশকে বাংলাদেশের কবিতা যখন নতুনভাবে বাঁক নিচ্ছিল, তখন জীবনানন্দ এবং তার উত্তরসূরি উৎপল কুমার বসু এবং পশ্চিম বাংলার সত্তরের কোনো কোনো কবি বাংলাদেশের তরুণ কবিদের নতুন ধরনের কবিতা লেখায় প্রাণিত করেছিলেন। এখনো জীবনানন্দ কিংবা জীবনানন্দের অনুসারী কবিরাই তরুণতর কবিদের প্রিয় কবি। অর্থাৎ একক জীবনানন্দ নয়, জীবনানন্দের যে সম্মিলিত [জীবনানন্দ, বিনয়, উৎপল] ভাবমূর্তি গড়ে উঠেছে, বাংলাদেশের তরুণ কবিদের ওপর তাদেরই প্রভাব লক্ষ্য করা যায় ভাবনায়, ভাষায় ও প্রকাশ ভঙ্গিতে। সব মিলিয়ে জীবনানন্দ আমাদের কাব্যরুচি নির্মাণ করে দিয়েছেন, এ ধারাতেই তরুণ কবিরা স্বকীয়তার কম-বেশি স্বাক্ষর রেখেই কাব্যচর্চা করে চলেছেন।

নন্দনতত্তে¡র ব্যাখ্যাতা সুসান ল্যাঙ্গার বলেছেন, ‘কবিতামূলক চিন্তন হুবহু লজিকসম্মত যৌক্তিকতা নয়’। বোঝাই যায় ল্যাঙ্গারের মতে কবিতা ভাবের, এমনকি ভাষা ও প্রকাশের যৌক্তিকতাকে অনুসরণ করে না। কবিতা আসলে অনুভবের যৌক্তিক পথ ধরে চলে, যে পথটি আদতে যৌক্তিক নয়। জীবনানন্দের কাছ থেকে পরবর্তীকালের কবিরা মূলত এর দ্বারাই প্রাণিত হয়েছেন। সময়ের তীব্র অভিঘাতে স্বতঃস্ফ‚র্ত, অনুত্তেজিত, পরিমিত, সংহত কবিতা রচনার দিকে তারা ঝুঁকেছেন, বাংলা কবিতার ঘটে গেছে রূপান্তর। জীবনানন্দই মূলত কবিদের কবি। রবীন্দ্রনাথের পাশাপাশি স্বতন্ত্র মহিমায় উজ্জ্বল কবি-নক্ষত্র। মৃত্যুর দিনে তার প্রতি অসীম শ্রদ্ধা।

সর্বশেষ খবর