শুক্রবার, ৪ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

উন্নত জীবনের জন্য শিক্ষা

যতীন সরকার

উন্নত জীবনের জন্য শিক্ষা

শিল্পকর্ম : কাইয়ুম চৌধুরী

[পূর্ব প্রকাশের পর]

বিত্তহীন ও নিম্নবিত্তরা কোনোমতে খেয়েপরে বেঁচে থাকার ভোগ্যবস্তুর জন্য যেমন নির্ভর করে বস্তির ধারে কিংবা ফুটপাথে-বসা সস্তাপণ্যের বাজারটির ওপর, তেমনি শিক্ষার জন্যও তাদের শরণ নিতে হয় বিনামূল্যের বা স্বল্পমূল্যের বিদ্যালয়ের বা মক্তব-মাদ্রাসার। এ-রকম শিক্ষা পরিস্থিতি ব্যক্তির জীবনকেও উন্নত করে না, সমষ্টি বা জাতির জীবনকেও না। বরং এ-ধরনের শিক্ষায় ব্যক্তি লাভ করে বিকৃত জীবনচেতনা, জাতির ভিতর বাড়তে থাকে শ্রেণিবৈষম্য, উন্নত ব্যক্তিজীবন ও জাতীয় জীবনের স্বপ্ন কেবল স্বপ্নই থেকে যায়। শিক্ষা যেখানে পণ্য, শিক্ষকও তো সেখানে পণ্য বিক্রেতা ছাড়া আর কিছু হতে পারে না। সেই পণ্য বিক্রেতা শিক্ষকের কাছে বড় কিছু মহত্ কিছু আশা করা বাতুলতা মাত্র। সমাজের সবকিছুর পণ্যায়ের মধ্যে শিক্ষকও যদি তার শিক্ষাপণ্য ফেরি করার জন্য কোচিং সেন্টার খুলে বসেন, প্রাইভেট টিউশনির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন, ছাত্রত্রাণের জন্য নোটবুক আর গাইডবুক লেখার কাজেই তার বুদ্ধি ও মেধার প্রয়োগ ঘটান,— তা হলে কে তাকে দোষ দিতে পারে? আর এ-রকম পরিস্থিতিতে ছাত্রেরও শিক্ষার্থী হওয়ার কোনো দায় থাকে না, হতে হয় কেবলই পরীক্ষার্থী। ছাত্রের জন্য পরীক্ষা-বৈতরণী পার হওয়াটাই মূল লক্ষ্য হয়ে যাওয়ায় পরীক্ষার দিকেই তার নজর থাকে, শিক্ষার দিকে নয়। আর পরীক্ষায় পাস করাটাই যেখানে আসল কথা, সেই পাস করার পথটি বৈধ না অবৈধ— সে-বিচারের প্রয়োজন বোধ করবে কে? ছাত্রের অভিভাবকদের ক’জন বিচার করেন যে তারা যে-অর্থ সন্তান বা পোষ্যের জন্য ব্যয় করছেন সে-অর্থ বৈধ না অবৈধ পথে অর্জিত? তাই পরীক্ষা কেন্দ্রে যখন নকলের হাট বসে, অনেক শিক্ষক ও অভিভাবকও যখন পরীক্ষার্থীর নকলের সহায়তা কার্যে হন দরাজদিল, তখন কে কাকে নিন্দা করবে? শুধু পরীক্ষা কেন্দ্র নয়, বৃহত্ শিক্ষা কেন্দ্রগুলোতে শিক্ষার্থীরা যখন মাস্তান, সন্ত্রাসী, ধর্ষক বা টেন্ডারবাজে পরিণত হয়, আর তাদের সে পরিণতিপ্রাপ্তিতে ইন্ধন জোগান সমাজেরই বিভিন্ন স্তরের অভিভাবকরা, তখনই-বা কে কার অপরাধের বিচার করবে?

 

সন্দেহ নেই : আত্মসমালোচনার ছলে এ পর্যন্ত যা বললাম তার প্রায় সবই নেতিবাচক। তাই, যে-কেউ আমাকে প্রশ্ন করতে পারেন, ‘আমাদের ইতিবাচক অর্জন কি কিছুই নেই? শিক্ষা কি আমাদের জীবনকে একটুও উন্নত করেনি? সমাজের অধোগতিটাই তোমার নজরে পড়ে, উন্নতির দিকে চোখ তুলে তুমি তাকাতেই চাও না? এতো সিনিক কেন তুমি?’

সবিনয়ে বলব : না, আমি সিনিক নই। তবে আত্মসন্তুষ্টির মৌনতাতে আচ্ছন্ন থাকতে চাই না বলেই নির্মোহ আত্মানুসন্ধান ও সদাজাগ্রত আত্মসমীক্ষার আমি পক্ষপাতী। কারণ, আমি জানি, আত্মসন্তুষ্টির ছিদ্রপথেই সর্বনাশের শনি এসে প্রবেশ করে। সেই শনির প্রবেশ রোধ করার জন্যই নিজের সব স্খলন-পতন-ত্রুটি ও গ্লানি সম্পর্কে সর্বদা সচেতন থাকা এবং আত্মসমালোচনার আয়নাটির সামনে দাঁড়ানো প্রয়োজন। তাই বলে আত্মনিন্দাকেই আত্মসমালোচনার সমার্থক করে ফেলাটা মোটেই সঙ্গত নয়। নিজের দুর্বলতা ও ব্যর্থতার পাশাপাশি শক্তি ও সাফল্যের ক্ষেত্রগুলোকেও অবশ্যই চিহ্নিত করতে হবে, হীনম্মন্যতার হাত থেকে মুক্ত থাকতে হবে। আপন দেশ, সমাজ ও জাতি সম্পর্কে হীনম্মন্যতা ঝেড়ে ফেললে আমরা দেখতে পাব; অনেক প্রতিকূলতা ও বিরূপতার মোকাবিলা করে স্বাধীনতার অর্জন যেটুকু আমরা ধরে রাখতে পেরেছি— এবং স্বাধীন দেশে আমরা যা অর্জন করেছি— তা একেবারে উপেক্ষা করার মতো নয়। প্রাক-স্বাধীনতাকালের তুলনায় আমাদের গণশিক্ষার বিস্তৃতি অনেক বেশি। দেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা যেমন বৃদ্ধি পেয়েছে, তেমনি বিপুল পরিমাণ ‘ড্রপ আউট’ সত্ত্বেও, মাধ্যমিক ও পরবর্তী স্তরের শিক্ষার্থী সংখ্যাও ক্রমবর্ধমান। ইতিমধ্যেই সাক্ষরতার হার ষাট শতাংশে পৌঁছে গেছে বলে শুনেছি। গ্রামে গ্রামে বয়স্কদের শিক্ষালাভের সুযোগও প্রসারিত হচ্ছে। সেই সঙ্গে নারীশিক্ষার। গ্রামের মেয়েরাও অধিকার-সচেতন হয়ে সামাজিক নানা বাধা-নিষেধের ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে আসছে। এসব ক্ষেত্রে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার পাশাপাশি কার্যকর রয়েছে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোর ভূমিকাও। গায়ের ইস্কুলের পথে বালকদের পাশাপাশি প্রচুরসংখ্যক বালিকাকেও যখন বই-খাতা নিয়ে চলতে দেখি, গতানুগতিক গৃহকর্মের বাইরে সামাজিক-অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হতে দেখি গ্রামাঞ্চলের মাতা-বধূ-কন্যাদেরও, তখন প্রবল আশাবাদে উজ্জীবিত হই। বুঝতে পারি : শিক্ষা আমাদের সমাজের অচলায়তন ভাঙছে; উন্নত জীবনের দিগন্ত উন্মোচন করছে; উন্নতি মানে যে নারী-পুরুষের সমান বিকাশ, সমান মানবিক অধিকার ও সমান মর্যাদাপ্রাপ্তি, সে সত্যটি ক্রমেই বাস্তব স্বীকৃতি পাচ্ছে। অতএব মা ভৈঃ।

তবু, আবার বলি, এইটুকুতেই যদি আটকা পড়ে যাই আত্মসন্তুষ্টির ঊর্নাজালে, তবে তার পরিণতি হবে মারাত্মক। শিক্ষার ক্ষেত্রে অধিকার ও সুযোগের যেসব বৈষম্য অত্যন্ত বিশ্রী রকমে প্রকট হয়ে উঠেছে, শিক্ষক-শিক্ষার্থী-অভিভাবক তথা সমগ্র জনগোষ্ঠীতে মূল্যবোধের যে দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছে, সব শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস ও নৈরাজ্যের যে ভয়াবহ বিস্তার ঘটেছে, সে সবের প্রতিরোধ করতে না পারলে সব আশার আলো নিভে যাবে, আমাদের অর্জনের ‘ইতি’গুলো সব ‘নেতি’তে লয় পাবে।

আমাদের আরও অনেক পথ হাঁটতে হবে। প্রতিনিয়ত জপ করতে হবে সেই সঞ্জীবনী মন্ত্র— চরৈবেতি চরৈবেতি—এগিয়ে চলো, এগিয়ে চলো। পথ তো আমরা উন্নত জীবনের জন্যই হাঁটব। তাই উন্নত জীবনের স্বরূপটি আগে আমাদের ভালো করে বুঝে নেওয়া দরকার। কারণ অনেক সময় আমরা ভুল করে স্বার্থপর ভোগোন্মত্ত জীবনকেই মনে করি উন্নত জীবন। আমরা ভুলে যাই— ‘স্বার্থমগ্ন যে জন বিমুখ/বৃহত্ জগত্ হতে, সে কখনো শেখেনি বাঁচিতে।’ যে বাঁচতেই শেখেনি, সে আবার উন্নত জীবনযাপন করবে বা ভালোভাবে বাঁচবে কী করে? ভালোভাবে বাঁচতে হলে প্রথমেই নিতান্ত ব্যক্তিগত স্বার্থমগ্নতা ভুলে ‘বিশ্বের বুকে বুক মিলিয়ে বাঁচা’র শিক্ষাগ্রহণ করতে হবে। ‘সকলের তরে সকলে আমরা, প্রত্যেকে আমরা পরের তবে’— এই নীতিকে বাস্তবে কার্যকর করে তোলার জন্য যেরূপ শিক্ষার প্রয়োজন, সে রূপ শিক্ষারই আয়োজন ও প্রসারণ ঘটাতে হবে। সে রূপ শিক্ষাই প্রতিটি ব্যক্তির কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটাবে এবং পুরো জাতির জীবনকেও উন্নতির দিশা দেখাবে।

মানুষের সঙ্গে পশুর মূল পার্থক্যই এই যে পশু জন্ম থেকেই পশু, আর মানুষ জন্ম থেকেই মানুষ নয়। মানুষ অমিত সম্ভাবনা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে এবং শিক্ষা ও অনুশীলনের মধ্য দিয়ে সেই সম্ভাবনাগুলোকে বিকশিত করে করে ক্রমে তাকে মানুষ হয়ে উঠতে হয়। অর্থাত্ মনুষ্যত্ব লাভের জন্য শিক্ষা হচ্ছে অপরিহার্য। আর মানুষের জীবনের মতোই মানুষের শিক্ষাও বহুমুখী। মনুষ্যত্বের বিকাশের জন্যই তাকে বহু ধরনের শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে উঠতে হয়। তাকে বস্তু জগতের নিয়ম-কানুন জেনে তত্ত্বজ্ঞানী হতে হয় এবং সেই তত্ত্বজ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে বস্তুজগেক নিজের প্রয়োজনের উপযোগী করে নিতে হয়। প্রকৃতির সঙ্গে তাকে মিতালি পাতাতে হয়, আবার প্রকৃতির বিরূপতাকে জয় করার জন্য তার সঙ্গে সংগ্রামও করতে হয়। মানুষের সঙ্গে মানুষের যে বহুমুখী ও বহুমাত্রিক সম্পর্ক, সে সম্পর্ককে সুষ্ঠু ও সুন্দর করার জন্যও তাকে শিক্ষা নিতে হয়। মানুষ সৌন্দর্য সৃষ্টি করে ও সৌন্দর্য উপভোগ করে; সেই সৌন্দর্যের সৃষ্টি ও উপভোগের ক্ষমতাও শিক্ষা ছাড়া অর্জন করা যায় না। জীবনের এরূপ নানাবিধ প্রয়োজনের তাগিদ থেকেই মানুষের হাতে সৃষ্টি হয়েছে নানা ধরনের বিজ্ঞান, তত্ত্ব, নীতি ও শাস্ত্র। যেমন— প্রকৃতিবিজ্ঞান, প্রযুক্তিবিজ্ঞান, সামাজিক বিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, নৃতত্ত্ব, রাষ্ট্রতত্ত্ব, নন্দনতত্ত্ব, অর্থনীতি, সমাজনীতি, চিকিত্সাশাস্ত্র, নীতিশাস্ত্র, ধর্মশাস্ত্র ইত্যাদি ইত্যাদি। উন্নত জীবনের জন্য শাখা-প্রশাখা সমেত এ রকম সব বিজ্ঞান, তত্ত্ব, নীতি ও শাস্ত্রশিক্ষার প্রয়োজনই একান্ত অপরিহার্য, এসবের কোনোটিকে বাদ দিয়েই উন্নত জীবন নির্মাণ করা চলে না। ব্যক্তি ও জাতির জীবনে এসব শিক্ষার সুষ্ঠু ও সুষম সমন্বয়ই উন্নতিকে স্পর্শ করতে পারে। এসবের সমন্বয় না ঘটলেই দেখা দেয় নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলা, উন্নতি তখন নিম্নগতি ও দুর্গতির অন্ধকারে হারিয়ে যায়, দুর্বুদ্ধি সব শুভবুদ্ধিকে চাপা দেয়।

বর্তমানে আমাদের শিক্ষা-ভাবনায় সমন্বয় ও সুষমতার অভাব খুবই প্রকট। আমরা প্রায় সবাই চাই আমাদের সন্তানরা ডাক্তার কিংবা ইঞ্জিনিয়ার হোক, প্রচুর টাকা-পয়সা রোজগার করুক, জীবনযাত্রার উঁচুমানে আশপাশের সবার চোখে ধাঁধা লাগিয়ে দিক। সন্তানটির মধ্যে সামান্য একটু মেধা দেখলেই তাকে সায়েন্স পড়তে দিই। হিউম্যানিটিজমের শিক্ষা যেন নিতান্ত ভ্যাঁদামার্কা ছেলেমেয়ের জন্য। এভাবেই জাতির শিক্ষায় ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, প্রতিনিয়ত। আমরা ভুলে গেছি যে, সমাজের জন্য যেমন বিজ্ঞানী, প্রকৌশলী বা চিকিত্সকের প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন সাহিত্যিক-দার্শনিক-সমাজ চিন্তাবিদেরও। বিজ্ঞানবিদ্যা ও মানবিকীবিদ্যার সমন্বয়ে সুষ্ঠু মানুষ গড়ে তোলার গুরুত্বের কথা তো আমাদের চিন্তায় যেন কোনোমতেই ঠাঁয় পায় না। এমন মনোবৃত্তিই আমাদের শিক্ষা-পরিস্থিতিতে ভারসাম্যহীনতার সৃষ্টি করেছে। সেই সঙ্গেই নৈতিক মূল্যবোধে ঘটেছে বিপর্যয়। শিক্ষাকে উন্নত জীবনের সোপান হতে হলে ব্যক্তি ও সমাজের সব ধরনের ভারসাম্যহীনতা দূর করে নৈতিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার পথ সন্ধান করা ছাড়া অন্য কোনো পথ নেই। শিক্ষাই শিক্ষার লক্ষ্য নয়। মানুষের শিক্ষার ‘চিরদিন এক লক্ষ্য— জীবন বিকাশ/পরিপূর্ণতায়।’ সেই লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত এবং বাস্তব জীবনে সদর্থক পরিবর্তন আনতে অক্ষম যে শিক্ষা, সে শিক্ষা বিষবত্ পরিত্যাজ্য। আমরা বিজ্ঞান শিখব, কিন্তু বিজ্ঞানশিক্ষা যদি আমাদের বিজ্ঞানমনস্ক ও কুসংস্কারমুক্ত করতে না পারে তাহলে সে শিক্ষা দিয়ে কী হবে? আমরা সমাজবিদ্যার পাঠ নেব, কিন্তু সে পাঠ যদি আমাদের সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় উদ্বুদ্ধ না করে তবে সে পাঠ গ্রহণের কোনো প্রয়োজন আছে কি? সাহিত্য পড়ে যদি আমরা উদারচিত্ত ও সংবেদনশীল না হই, তাহলে কী দরকার সাহিত্য পড়ার? নীতিশাস্ত্র পাঠ করে যদি আমরা দুর্নীতিকে ঘৃণা করতে ও সুনীতির অনুশীলন করতে না শিখি, কিংবা ধর্মশাস্ত্র যদি আমাদের ধর্মান্ধতামুক্ত ও সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষহীন না করে তোলে, তাহলে শাস্ত্র আমাদের কোনো কাজে লাগবে?

এসব প্রশ্নকে চেতনায় সদাজাগ্রত রেখে এবং সদর্থক জীবনদর্শনকে পাথেয় করে পথ চললে উন্নত জীবনের গন্তব্যে আমরা অবশ্যই পৌঁছে যাব।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর