শুক্রবার, ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ ০০:০০ টা
চাঁদ সদাগর

তিমির হননের কবিতা

অনুপম সেন

তিমির হননের কবিতা

শামসুর রাহমান (২৩ অক্টোবর ১৯২৯-১৭ আগস্ট ২০০৬), পোট্রেট : কাইয়ুম চৌধুরী

মহৎ কবিতা অমর। অমর তার মহৎ স্রষ্টারাও। এরকমই একজন মহৎ কবি শামসুর রাহমান ১৭ আগস্ট তার নশ্বর দেহ ত্যাগ করে অমর্ত্যলোকে চলে গেলেন।

রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের মতো শামসুর রাহমানের কবিসত্তাও তার অবয়বে-ব্যক্তিত্বে-কথাবার্তায় ও আচার-আচরণে মূর্ত হয়ে উঠত। দেহী শামসুর রাহমান আজ আমাদের মধ্যে নেই, কিন্তু তিনি অনেক কবিতা লিখেছেন যেগুলো অনশ্বর। সেদিন তার মৃত্যুর পরে যখন তার কবিতাগুলো আবার নতুন করে পড়ছিলাম, তখন আগে ভালো করে উপলব্ধি করিনি, এরকম এক কবিতা আমাকে দারুণ শিহরিত করে। কবিতাটির নাম ‘চাঁদ সদাগর’।

উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ কবিতাগ্রন্থের প্রথম কবিতা, অপার সুন্দর এক রূপক কবিতা। চাঁদ সদাগর মধ্যযুগের মনসামঙ্গল কাব্যের মহানায়ক। মঙ্গল কাব্যের অধিকাংশই পুরাণাশ্রিত ও ধর্মভারাক্রান্ত। ইয়োরোপের মধ্যযুগের রেনেসাঁসের সাহিত্যকর্মে যে ঋজু, দার্ঢ্য ও মানবচেতনা-ঋদ্ধ চরিত্র সৃষ্টি করা হয়েছে, এখানে তা নেই। মঙ্গলকাব্যে অপরাজেয় মানুষের কথা খুবই বিরল। এখানে মানুষ প্রতিনিয়ত কুসংস্কারে ন্যুব্জ, নানা শঙ্কায় আতঙ্কিত। মঙ্গলকাব্যের পটভূমি মুখ্যত পল্লীসমাজ। এখানে তত্কালীন পল্লীসমাজের দীনতা ও ক্ষুদ্রতা প্রায় প্রত্যেক পঙিক্ততে, চরিত্রে পরস্ফুট। এরই মধ্যে চাঁদ সদাগর এক অসাধারণ চরিত্র, যিনি এক মহানায়ক, তিনি যে-কোনো শক্তির সামনে, তা যত পরাক্রান্ত দৈবশক্তি হোক না কেন, মাথা নোয়াতে রাজি নন। এ যেন গ্রিক মহাকাব্য ও নাটকের প্রমিথিউস, হেক্টর বা আজাক্স। গ্রিক ট্রাজেডির মহানায়কের মতো চাঁদ সদাগর প্রতি মুহূর্তে, প্রতি পলে ধ্বংসের মুখে এগিয়ে যাবেন, কিন্তু নতি স্বীকার করবেন না। শামসুর রাহমানের কবিতার পঙিক্ততে চিত্রিত এই চাঁদ সদাগর কেবলমাত্র একটি মহৎ চরিত্রই নন, তিনি যেন সমগ্র জাতির প্রতিভূ— জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষার ধ্বংসাবশেষের ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছেন অনম্য মেরুদণ্ড নিয়ে। তিনি তার চারদিকে সবকিছু ভেঙে পড়তে দেখছেন, ক্রুরতা ও জিঘাংসা তার শতসহস্র ফণা বিস্তার করে সবকিছু গ্রাস করছে। তার মধ্যেই চাঁদ সদাগর তার অসাধারণত্ব নিয়ে নেংটি পরে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। কবিতাটির শুরু এভাবে :

আমি কি এখন সত্যি বেঁচে আছি? না কি জীবন্মৃত

পড়ে আছি বিড়ম্বিত মাস্তুলের মতো। বণিকের

খ্যাতি আছে কিছু টিকে, অথচ যাই না বাণিজ্যেতে

কতকাল, কতকাল সপ্তডিঙ্গা ভাসে না তরঙ্গে

সমুদ্রের জ্বলজ্বলে প্রাসাদের মতো হা আমার

মধুকর সেই কবে গেছে ডুবে কালীদহে।

কবি এর পরে জানান, হূতসর্বস্ব চাঁদ সদাগর এখন শ্মশানের ছিন্ন কাপড় পরে ঘুরে বেড়ান অচেনা লোকালয়ে। একমুঠো তণ্ডুলের জন্য কাঠুরের সঙ্গে কাঠ কাটেন গভীর বনে। তবুও তিনি অশুভ সর্পিণী-শক্তির কাছে নতজানু হবেন না। দৃপ্তকণ্ঠে তাই চাঁদ সদাগর বলছেন :

কতবার চ্যাঙড়ামুড়ি কানি

নানা ছলে কেড়ে নিয়ে আমার ঘর্মাক্ত দিনান্তের

কষ্টার্জিত অন্ন খলখল ব্যাপক উঠেছে হেসে,

ভেবেছে অভুক্ত আমি ক্ষুধার করাতে চেরা, ভয়

পেয়ে হব নতজানু, ঘটে তার ঠেকাব আমার

অবসন্ন মাথা দীন ভিক্ষুকের মতো।

তা হবার নয় কোনদিন

চাঁদ সদাগর তার হতশ্রী চম্পক নগরীর যে-ছবি এঁকেছেন, তার সর্বগ্রাসী অন্ধকার যেন আমাদের নগরজীবনেরই অমা—

হায়, দীপ্র, প্রিয়

নগরী আমার, একি দশা দেখি আজকে তোমার

কেমন আন্ধার এলো নিষ্করুণ দশদিক ব্যেপে

চম্পক নগরে। সূর্যাস্তের পরে গেরস্ত রাখে না

পা তার নিজস্ব গৃহকোণ ছাড়া অন্য কোনোখানে

আজ, আর পথে পথে বঙ্গদাড়া, বিড়ঙ্গিনী আর

তক্ষক, শংকর আর মহিজঙ্গ সাপের বসতি।

ঘরে ঘরে, এমনকি প্রত্যেকের মগজের কোষে

কোষে দোলে ফণা,

এর পরের পঙিক্তগুলো তীব্র ও তীক্ষ ভাষায় আমাদের সমাজের দুর্নীতি, শঠতা, কাপট্য, ধনীর অন্যায় পথে আরও ধনী-হওয়া, বিদ্বানের আত্ম-বিক্রি এবং দরিদ্রের লাঞ্ছিত-বঞ্চিত যে-চিত্র তুলে ধরেছে, তা তুলনাহীন :

সৎ অসতের ভেদাভেদ লুপ্ত, মিথ্যার কিরীট

বড় বেশি ঝলসিত দিকে দিকে, লাঞ্ছিত, উদ্ভ্রান্ত

সত্য গেছে বনবাসে। বিদ্বানেরা ক্লিন্ন ভিক্ষাজীবী,

অতিশয় কৃপালোভী প্রভাবশালীর। নব্য কত

ক্রোড়পতি করে ক্রয় সাফল্যের অন্দর বাগান,

দরিদ্র অধিকতর দরিদ্র হবার ফাঁদে পড়ে

কাঁদে, করে করাঘাত দিনরাত সন্ত্রস্ত কপালে

.................

আদর্শ বিনষ্ট ফল

যেন, নর্দমায় যাচ্ছে ভেসে;

এখানে চাঁদ সদাগর তো কবি নিজেই। চম্পক নগরী তার নিজেরই রাজধানী, যে-নগরী তিনি তিলতিল করে গড়ে উঠতে দেখেছেন, সে-নগরী আজ তার কাছে অজানা, অচেনা!

যেখানে বিলাপ ছাড়া অন্য কোনো ধ্বনি নেই আর,

যেখানে নাগিনী ছাড়া অন্য কোনো প্রাণী নেই, আর,

যেখানে বরণযোগ্য বীর নেই, কবির অভীষ্ট

কোনো জয়গাথা নেই।

এ-নগরীর অবক্ষয়, মূল্যহীনতা ও ধনীর দৈন্যের অত্যাচারে চাঁদ সদাগরের হাহাকার, কবিরই হূদয়-দীর্ণ-করা হাহাকার— যা আমাদের আবারো মনে করিয়ে দেয়, যুগে যুগে কবিরা তাদের রাষ্ট্র-সমাজের বেদনাবিদ্ধ চিত্র নানা রূপক ও সংকেতে এঁকেছেন। মধুসূদন বিজয় সিংহের সিংহল বিজয়ের মধ্য দিয়ে বাঙালির বিজয়গাথা লিখতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তার সময়ের পরাধীন বাংলার দৈন্য তাকে বিজয় সিংহের বিজয়গাথার পরিবর্তে মেঘনাদ-বধ কাব্য লিখতেই উদ্বুদ্ধ করেছিল। রাবণ ও লঙ্কার পরাজয়ের মধ্য দিয়ে বাঙালির পরাজয়ের চিত্রই তার লেখায় ফুটে উঠেছিল।

একে একে নিভিছে দেউটি, নীরব

রবাব বীণা মুরজ মুরলী

কিন্তু শত ধ্বংসের মুখেও রাবণ অদম্য ছিল, অন্তরের ঐশ্বর্যে অপরাজিত ছিল। মধুসূদনই রাবণ, যেমন শামসুর রাহমানই চাঁদ সদাগর। একে একে রাবণের সব সন্তান যুদ্ধে মারা যাচ্ছে, চারদিকে ভয়ংকর হতাশা ও বিলাপ তার চৈতন্যকে আচ্ছন্ন করে ফেলছে; তবুও তিনি মাথা নোয়াবার নন। একইভাবে চাঁদ সদাগর বা কবি ঘোষণা করছেন :

অপার বিস্ময়, আজও

সাপের স্পর্শের মতো চমকিত অস্তিত্ব আমার।

যতদিন হিন্তাল কাঠের

লাঠি আছে হাতে, আছে

ধমনীতে পৌরুষের কিছু তেজ, যতদিন ঠোঁটে

আমার মুহূর্তগুলি ঈষৎ স্পন্দিত হবে, চোখে

নিমেষে উঠবে ভেসে কোনো শোভাযাত্রার মশাল।

করব না আন্ধারের বশ্যতা স্বীকার ততদিন,

যতই দেখাক ভয় একশীর্ষ, বহুশীর্ষ নাগ

কবিরা জীবনকে হারতে দিতে চান না, ধ্বংস ও মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েও তাদের নায়ক ও মহানায়কেরা জীবনেরই জয়গান করে, অপরাজিত থাকে। শেকসপিয়রের Antony and Cleopetra-য় মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েও অসীম জীবনপিয়াসী ক্লিওপেট্রা বলছে, ‘আমাকে আমার পোশাক দাও, মুকুট মাথায় পরিয়ে দাও, আমার মধ্যে রয়েছে জীবনের অমর পিপাসা’ Give me my robe, put on my crown, I have immortal longings in me.

অনেক অমর কবিই তাদের রাষ্ট্র ও সমাজের অবক্ষয়ের চিত্র এঁকেছেন। রঘুবংশ কাব্যে কালিদাস রঘুর বংশধরদের সময়ে নগরজীবনের যে-ক্ষয়িষ্ণু চিত্র এঁকেছেন, অনেক পণ্ডিতের মতে তা গুপ্তসাম্রাজ্যের পতনের কালে উজ্জয়িনীরই অবক্ষয়ের ছবি। শেকসপিয়র Hamlet--এ যখন বলছেন, (মার্সেলেসের মুখ দিয়ে) Something is rotten in the state of Denmark তখন আসলে রানী এলিজাবেথের সময়কার ইংল্যান্ডের রাজধানী ও রাজসভার মূল্যহীনতা ও স্বার্থান্ধতাকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে। কিন্তু এই কালজয়ী কবিরা দেখিয়েছেন, মেরুদণ্ডী মানুষ সব পরাজয় আর প্রতিকূলতার মুখেও তাদের অদম্য মানবসত্তার স্বাধীনতাকে, সম্ভাবনাকে পরাজিত হতে দেয় না।

তারা ধ্বংস হয়, কিন্তু নত হয় না।

বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন যুগের অবক্ষয়ের যে-চিত্র কবিরা আঁকেন, তা আসলে মানুষেরই ক্রুরতা, শঠতা, কাপট্য, স্বার্থান্ধতা ও নির্লজ্জ লোভেরই চিত্র, তাই এসব চিত্রে দেশাতীত ও কালাতীত এক গভীর ঐক্য রয়েছে। মানুষের সাময়িক অধঃপতন ও পরাজয়ের ছবি হূদয়ের রক্ত দিয়ে কবিরা আঁকেন বলে তাতে থাকে হূদয়-মথিত-করা ক্রন্দন; কিন্তু তারা জানেন, মানবসত্তা অপরাজেয় ও স্বাধীন। সেই অপরাজেয় স্বাধীন মানুষের জন্যই তাদের ব্যাকুল আর্তি।

শামসুর রাহমান বাঙালির স্বাধীনতার অশেষ আকাঙ্ক্ষাকে কেবলমাত্র চাঁদ সদাগরেই যে মূর্ত করেছেন, তা নয়। তার বহু কবিতাই বাঙালির মুক্তির বাণীকে বহন করছে। তারই মধ্যে ‘চাঁদ সদাগর’ এক অনন্য সৌন্দর্যের আকর, চিরন্তন অপরাজেয় মানুষের প্রতীক।

যে-কোনো প্রকৃত কবির মতো শামসুর রাহমানের মধ্যেও কবিজনোচিত প্রকৃতিপ্রেম, নারীপ্রেম ও রূপতৃষ্ণা রয়েছে। কিন্তু কেবল এসবের মধ্যেই তার কবি-পরিচিতি শেষ হয়নি, তিনি তার কবিসত্তায় ধীরে ধীরে রবীন্দ্রনাথের রোমান্টিকতা ও বিশ্ববোধ, নজরুলের বিদ্রোহ ও তীব্র স্বাদেশিকতা, সুকান্তের পরিশুদ্ধ মানবিকতা, জীবনানন্দের মৃত্তিকালীনতা আত্মস্থ করেছিলেন, জারিত করেছিলেন।

কিন্তু এসব প্রভাব কখনো তার কবিতার স্বকীয় বাণী ও ভাষা গড়ে-ওঠার পথকে আবৃত করেনি। যে-কোনো কবির মতো তার কবিতার ভাষা তার একান্ত নিজস্ব। বিশেষ বিশেষ মুহূর্তে এই স্বকীয় ভাষাতেই তিনি সৃষ্টি করেছেন অসাধারণ কবিতা, যা বাঙালিকে বহু বছর ধরে অপরিমেয় গভীরতা ও সীমাহীন সৌন্দর্যের সন্ধান দেবে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর