শুক্রবার, ৪ মার্চ, ২০১৬ ০০:০০ টা

কবি শহীদ কাদরীর সঙ্গে আড্ডা

ইকবাল হাসান

কবি শহীদ কাদরীর সঙ্গে আড্ডা

কবি শহীদ কাদরীর (বাঁয়ে) সঙ্গে ইকবাল হাসান

কী অবাক কাণ্ড! কানাডার থান্ডার বে’ শহরটির আকাশ ঘন মেঘে ছেঁয়ে আছে বেশ কদিন। সূর্যের নাম গন্ধ নেই। চারদিক সাদা আর সাদা। গ্রাউন্ড টেম্পারেচার মাইনাস টুয়েনটি থ্রি। হাড়ে কাঁপন লাগানোর মতো জানুয়ারি। শীত তো নয় যেন সাপের ছোবল!

ওয়েস্টজেট যখন মেঘের স্তর পেরিয়ে উপরে উঠল অর্থাৎ আকাশে, অই যে ঘন মেঘের কথা বললাম, কী আশ্চর্য, সেই মেঘের ওপর সহসা উদ্ভাসিত হলো ঝকঝকে আকাশ, চারদিকে সোনার আলো ছড়িয়ে যেন অদূরে বসে তামাশা করছেন সূর্যদেব। কী অমায়িক হাসি তার।

গন্তব্য নিউইয়র্ক। উদ্দেশ্য, কবিতা সন্ধ্যায় অংশগ্রহণ ও সেই সঙ্গে ধীমান কবি শহীদ কাদরীর সঙ্গে দিন কয়েক নিরবচ্ছিন্ন আড্ডা দেওয়া। বাংলা ভাষায় কবি শহীদ কাদরী একজন বিরলপ্রজ কবি হিসেবে পরিচিত। তিনি আমাদের দেশের প্রধান কবিদের একজন। সর্বাংশে আধুনিক, বিজ্ঞানমনস্ক, রোমান্টিক, নাগরিক কবি শহীদ কাদরী সাতচল্লিশোত্তর বাংলা কবিতার নিজস্ব অবয়ব গঠনের ক্ষেত্রে নিজেকে অনিবার্য করে তুলেছেন। তার কবিতায় অন্তর্গত বিষাদ ও বৈরাগ্যের পাশাপাশি আমরা পাই বিশ্বনাগরিকতা বোধের সঙ্গে গভীর স্বাদেশিকতার শৈল্পিক মিশেল। আছে মার্কসীয় দর্শনের হালকা ছোঁয়া। কবি শহীদ কাদরীর কবিতা দুরূহ পাঠ নয়, এ কারণে যে, উচ্চারণ-বিষয় ও আঙ্গিকের অতি-ধ্রুপদ ভঙ্গিটিকে তিনি রোমান্টিকতার কোডিংয়ে আবৃত করে দেন। কয়েক দশক ধরে দেশ থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে লোকচক্ষুর আড়ালে থাকলেও দুই বাংলার কবিতাপ্রেমীরা তাকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন আজও। লেখেন কম, সুধীন দত্তের মতো। এত কম যে, তার লেখা খুঁজে খুঁজে বের করে পড়তে হয়।

একটা সময় ছিল, রাত-দিন আমাদের আড্ডা হতো পুরানা পল্টনের বাড়িতে। আড্ডার মধ্যমণি কবি শহীদ কাদরী। তিনি বলেন, আর আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনি। আমাদের অগোচরে কখনো মেঘ ডাকে, কখনো বৃষ্টি হয়, কখনো সূর্য ওঠে অস্ত যায়, আবার ওঠে, আবার অস্ত যায়। কখনোবা আকাশ দখল করে মস্ত চাঁদ। অমাবশ্যা হয়, পূর্ণিমা হয়। আমরা কিছুই দেখি না, কিছুই শুনি না, আমাদের চোখে কিছুই ধরা পড়ে না—দালীর ছবির মতো আড্ডার ক্যানভাসে যেন অলক্ষ্যেই গলে গলে ঝরে যায় সময়, মেঘ বৃষ্টি রোদ, চাঁদ ও সূর্য, অমাবশ্যা ও পূর্ণিমা। শহীদ কাদরী মাঝখানে, যেন এক পরাবাস্তব চরিত্র, আর তাকে ঘিরে আমরা, কবি রফিক আজাদ, আবদুল মান্নান সৈয়দ, বেলাল চৌধুরী, মাহমুদুল হক, হাবীবুল্লাহ সিরাজী, রবিউল হুসাইন, রাজীব আহসান চৌধুরী, মুহম্মদ খসরু, আবিদ আজাদ, শিহাব সরকার, ইমদাদুল হক মিলন, মাহবুব হাসান, হাফিজুর রহমান, হাসান হাফিজ, ত্রিদিব দস্তিদার ও আমি বলতে গেলে প্রায় নিয়মিত। রাহাত খান এবং আল মুজাহিদী আসতেন কখনো কখনো। এ আড্ডায় কবি শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ ও ফজল শাহাবুদ্দিনকেও দেখেছি বারকয়েক। মাঝেমধ্যে হুটহাট করে এসে হাজির হতেন বিপ্লব দাশকে সঙ্গে নিয়ে বুড়ো ভাই।

আড্ডা হতো নয়া পল্টনেও, ‘সচিত্র সন্ধানী’র অফিসে। কবি বেলাল চৌধুরী ছিলেন সচিত্র সন্ধানী পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্বে, শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী, কবি শিহাব সরকার, রেজাউল হাসান যুক্ত ছিলেন পত্রিকাটির সঙ্গে। আমি বেশ কয়েকটি প্রচ্ছদ প্রতিবেদন করেছিলাম এ কাগজে। সেই সূত্রে শহীদ ভাই, মাহমুদুল হক আর প্রকাশক গাজী শাহাবুদ্দিন মনু ভাইয়ের সঙ্গে দুপুর আর বৈকালিক আড্ডায় দেখা হয়ে যেত। এখানের আড্ডায় মুহম্মদ খসরু ও ত্রিদিব দস্তিদার ছিলেন নিয়মিত। কখনো দেখা হয়ে যেত মতিউর রহমান আর মালেকা বেগমের সঙ্গে। প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান তখন ‘একতা’ বলে একটি পত্রিকার দায়িত্বে ছিলেন। বিকালের দিকে সন্ধানী অফিসে আসতেন।

গ্রিনরোডে আবদুল মান্নান সৈয়দের বাসভবনের কাছাকাছি আপ্যায়ন নামে একটি রেস্তোরাঁ ছিল, প্রতি রবিবার আমাদের আড্ডা হতো সেখানে। সকাল থেকে দুপুরঅব্দি। বাড়ির একেবারে কাছে হলেও মান্নান ভাই এ আড্ডায় আসতেন দেরি করে। রফিক ভাই অলওয়েজ ‘রাইট ইন টাইম’। শহীদ কাদরীর সঙ্গে বিশ্বসাহিত্য, বিশেষ করে আধুনিক ইউরোপীয় সাহিত্য নিয়ে জটিল ধ্রুপদ আলোচনায় মেতে উঠতেন রফিক আজাদ ও আবদুল মান্নান সৈয়দ। জেমস জয়েস, কাম্যু, কাফকা থেকে শুরু করে র‌্যাবো, মালার্মে, টিএস এলিয়ট, ইয়েটস, রবীন্দ্রনাথ কারও নিস্তার নেই এই ত্রিমুখী আড্ডালোচনা থেকে। শহীদ ভাইয়ের মুখস্থ কবিতার শত শত পঙক্তি। এ আড্ডার একমাত্র শ্রোতা আমি, বিস্ময় নিয়ে মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনতাম শুধু। সেদিনের সেই বিস্ময়ের ব্যাপারটি আজও আছে আমার মধ্যে। ভেবে বিস্মিত হই এদের জ্ঞান ও অসাধারণ পাণ্ডিত্য!

২.    

নিউইয়র্কের আকাশ ছিল ঝকঝকে। হালকা শীত, থান্ডার বের তুলনায় নাথিং। শহীদ কাদরীর স্ত্রী নীরা ভাবী বিমানবন্দর থেকে তুলে নিলেন আমাকে। বললেন, আপনি আসছেন, শহীদ খুব এক্সাইটেড। খুব ভালো হলো, আপনারা ম্যারাথন আড্ডা দিতে পারবেন। শহীদও প্রাণ খুলে কথা বলতে পারবে। জানেন, ওর শরীরটা ইদানীং ভালো যাচ্ছে না।

সপ্তাহে তিন দিন ডায়ালসিসের জন্য হাসপাতালে যেতে হয়। ডায়ালসিসের পর বড় ক্লান্ত থাকেন। তবে শনি ও রবিবার হাসপাতালে যেতে হয় না। বাড়িতে সার্বক্ষণিক নার্স আছে দেখাশোনার জন্য।

ঘরে ঢুকতে না ঢুকতেই সেই অতি পরিচিত গুরুগম্ভীর প্রাণস্পর্শী কণ্ঠ— আবে শালা, আগেয়া। আহো, আহো।

নীরা ভাবী হাসলেন।

বললেন, আপনি থাকবেন মাস্টার বেডরুমে, দিন কয়েকের জন্য আপনার নামে ওটা আমরা আগেভাগেই বরাদ্দ করে রেখেছি। আমার অস্বস্তি, আর গাইগুই করা দেখে শহীদ ভাই ধমকে উঠলেন, আবে চোপ! মনে হলো, এ আমার জন্য এক ধরনের সম্মান। আমি আর কথা বাড়াই না।

সোফায় বসে আছেন কবি শহীদ কাদরী, সামনের চেয়ারে আমি। মানুষ তো ধাতব কোনো ব্রিজ নয়, কিংবা নয় সুপ্রাচীন অট্টালিকা, মনে হলো, আমি যেন বরং জীবন্ত এক কিংবদন্তির সামনে বসে আছি। কথা বলার চিরাচরিত ভঙ্গিটি ধরে রেখেছেন আজও। টেবিলের পাশে রাখা একটি হুইল চেয়ার। সেদিকে চোখ যেতেই সহসা ভিজে ওঠে চোখের পাতা।

৩.

শহীদ ভাই বললেন, ডায়ালসিস শুরুর পর মানুষ বড়জোড় তিন থেকে চার বছর বাঁচে। আর আমি তো বেশ ছ’বছর পার করে দিলাম। লিভিংরুমের অন্যপ্রান্ত থেকে নার্স মেয়েটি বেশ একটু চড়া স্বরে বলে উঠল, শাহীদ, ইট ইজ টাইম টু টেক ইওর মেডিসিন। জানো, মাসকয়েক আগে ইমদাদুল হক মিলন এসেছিল ঢাকা থেকে। শহীদ কাদরী বললেন, ও আমাকে দেখে বেশ অবাকই হয়েছিল। অবাক হওয়ারই কথা। কত যুগ পরে দেখা। খুব ভালো লাগল ইকবাল। কত যুগ পর মিলনের সঙ্গে দেখা হলো। হুটহাট করে এমন অনেকেই আসে, তবে মিলনকে দেখে আমি খুব আপ্লুত হয়েছিলাম।

উঠতি সময়ে আমাদের কয়েকজনের মতো মিলনও ছিল শহীদ ভাইয়ের কাছের মানুষ। খুব কাছের। একবার, শহীদ কাদরী জার্মানি যাচ্ছেন, আমরা সবাই তাকে বিদায় জানাতে বিমানবন্দরে, সহসা মিলনের খেয়াল হলো, শহীদ ভাই বিদেশ যাচ্ছেন, অথচ তার হাতে ঘড়ি নেই! মুহূর্তেই নিজের হাতের দামি ঘড়িটি খুলে শহীদ ভাইয়ের হাতে পরিয়ে দিলেন। ঘটনাটি এত দ্রুত ঘটল যে আমরা অবাক হওয়ার মতো সময়ও পেলাম না।

জানো, মিলনের দেওয়া সেই ঘড়িটি আজও আমার কাছে আছে। ও ভেবেছিল, আমি বোধহয় এতদিনে ঘড়িটি হারিয়ে ফেলেছি।

আড্ডার শুরুতেই কথা উঠল, কবিতার আয়ুষ্কাল নিয়ে। বিশেষ করে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির দাপটে কবিতার বেঁচে থাকা না-থাকা নিয়ে। এরই মধ্যে আমাদের সঙ্গে এসে যোগ দিয়েছেন লেখক দম্পতি, হাসান ও রানু ফেরদৌস। হাসান ফেরদৌস প্রথম আলো এবং কালি ও কলমের নিয়মিত লেখক। রানু ফেরদৌস গল্প লেখেন। শহীদ কাদরী বললেন, দেখ, শিল্প বিপ্লবের পর থেকেই কবিতার আয়ুষ্কাল নিয়ে আশঙ্কার কথা আমরা শুনে আসছি। কবিতা বেঁচে থাকবে কি থাকবে না। যে ধারণার ফলশ্রুতিতে এ আশঙ্কা, তা হলো, কবিতা হচ্ছে তুলনামূলকভাবে যেসব সভ্যতা অতীতমুখী, পুরোপুরি অগ্রসর হয়নি, অনেকটাই পিছিয়ে আছে— তাদের কথা, তাদের আবেগের কথা। অন্যদিকে যন্ত্রবিপ্লব হচ্ছে বিজ্ঞানের সুফল। প্ল্যাটো তো বলেছেন, কবিতা হচ্ছে বায়বীয় মনগড়া ব্যাপার। এর সঙ্গে বাস্তবের যথার্থ কোনো সংযোগ নেই।

প্রকৃত প্রস্তাবে দর্শন এবং বিজ্ঞানের কাজ ও উদ্দেশ্যই হচ্ছে যথার্থ সত্যের অনুধাবন, অনুসন্ধান। কবিতায় যেহেতু কল্পনার আধিপত্য বেশি, তাই কবিতা সত্য জানার নির্ভরযোগ্য কোনো মাধ্যম নয়। এসব কথা শিল্প বিপ্লবের সময় থেকেই শুরু হয়েছে।

আমি মনে করি, বিজ্ঞান দ্বারা প্রতিপালিত ইট কাঠের এ নগর সভ্যতায় মানুষের জীবন যত যান্ত্রিক হয়ে উঠবে বেঁচে থাকার জন্য, ভারসাম্য আনার জন্য মানুষকে ততই শিল্পের দ্বারস্থ হতে হবে। শিল্প বিপ্লবের পরপরই রোমান্টিক কবি জন কিনটস বলেছিলেন, এ গ্রহে কবিতার কোনো মৃত্যু নেই।

আই এ রিচার্ডস বলেছেন, জীবন যত যান্ত্রিক হবে কবিতার প্রয়োজন তত বেড়ে যাবে।

শিল্প বিপ্লবের এতকাল পরেও আমরা দেখছি, মানুষের জীবনে ভাবের রাজ্যে বিচরণ করা অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। অপরিহার্য হয়ে উঠেছে, কল্পনাপ্রসূত পরীর রাজ্যে পরিভ্রমণ। মানুষ যতদিন বেঁচে থাকবে, সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতো কবিতা থাকবে। এ গ্রহ, এ গ্রহের আচ্ছাদন, আবরণ এটাই তো কবিতা। ফলে মানুষের মনকে কখনোই কোনো ধরনের নিয়মতন্ত্রের মধ্যে বাঁধা যাবে না।

ই ই কামিংস যেমন বলেছেন, যারা বিজ্ঞানী তারা তোমাকে পরীক্ষাগারে নিয়ে কাটাছেঁড়া করেছে, যারা দার্শনিক তারা তোমাকে হাঁটুর ওপর বসিয়ে তাদের নোংরা আঙ্গুল দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে জানতে চেয়েছে, কে তুমি? কী তুমি? কী তোমার স্বরূপ? কিন্তু তাদের প্রতি নিরুত্তর থেকে তুমি শুধু বসন্ত উপহার দিয়ে গেছ আমাদের।

৪.

আপনার কাব্যজীবনে আধুনিকতার শুরুটা অর্থাৎ কীভাবে সর্বাংশে এমন একজন আধুনিক কবি হয়ে উঠলেন? শহীদ কাদরী বললেন, আধুনিক কবিতার বাইরে অন্য কিছুর সঙ্গে তো পরিচয় হয়নি, তো শুরুর দিকে চার-পাঁচটি কবিতা লিখেছিলাম, আধুনিক কবিতার অবয়বে। তবে ওসব তো আর আধুনিক বাংলা কবিতার সংস্পর্শে আসা নয়। আধুনিকতার সংস্পর্শে আসি আরও পরে। ১৯৫৪ সালের দিকে, একবার কুমিল্লা বেড়াতে গিয়েছিলাম। যে বাড়িতে বেড়াতে গেছি সেই বাড়ির একজনকে ডেকে বললাম, তোমাদের বাড়িতে কি কোনো বইপত্র নেই? সে একটা বই নিয়ে এলো। বুদ্ধদেব বসুর কঙ্কাবতী। কবিতাগুলো দারুণ, খুব ভালো লাগল আমার। আর একদিন হাঁটতে বেরিয়েছি, হঠাৎ একটি বইয়ের দোকান দেখে ঢুকে পড়লাম।

দেখি, অশোক বিজয় রাহার একটি কবিতার বই, দীহং নদীর ধারে। আমার চোখ আটকে গেল একটি পঙক্তিতে : আধখানা চাঁদ আটকে গেছে টেলিগ্রাফের তারে/ আরে আরে আরে...।

আমার বড় ভাই শাহেদ কাদরী একবার কলকাতার সিগনেট প্রেস থেকে বেশ কিছু কবিতার বই আমার জন্য নিয়ে এলেন। নরেশ গুহ দুরন্ত দুপুর, অরুণ কুমার সরকারের দূরের আকাশসহ তখনকার প্রায় সব আধুনিক কবির কবিতার বই ওখানে ছিল।

আর এভাবেই আধুনিকতার সঙ্গে আমার পরিচয়।

৫.

আধুনিক কবিতার কথা যখন উঠল, প্রসঙ্গত সুধীন দত্তের কথা যদি বলি, তার কবিতার অনিবার্য ধ্রুপদ ভঙ্গিটি আজকাল তেমন আর চোখে পড়ে না। আমাকে থামিয়ে শহীদ কাদরী বললেন, এখানে দুটো ব্যাপার তোমাকে বুঝতে হবে। ধ্রুপদী সাহিত্যের দুটো দিক আছে। একটা দিক তার শৈলী, যা অত্যন্ত শুদ্ধ ও নিয়মতান্ত্রিক। অন্য দিকটি হচ্ছে, এর নৈর্ব্যক্তিকতা। ধ্রুপদী সাহিত্য বস্তুত নৈর্ব্যক্তিক। লেখক চরিত্রের প্রতি পক্ষাবলম্বন করেন না। আমরা যখন মহাকাব্য পড়ি, সেখানে দেখি, কবি পুরোমাত্রায় নৈর্ব্যক্তিক। যেমন, হোমারের ইলিয়াদ। সুধীন দত্ত চেষ্টা করেছেন। তিনি আপাদমস্তক রোমান্টিক কবি। তার শৈলী ধ্রুপদী। আর একটি কথা, আমাদের এখানে রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে আজতক যাদের দেখি, সবাই রোমান্টিক। রোমান্টিক লেখকরা শৈলীর প্রতি অন্ধ আনুগত্য দেখান না। এ জন্যই হয়তো মনে হতে পারে, আমাদের কবিতায় ধ্রুপদ ভঙ্গিটি অনুপস্থিত। কথাটা সত্য নয়। শেষে একটা কথা বলা প্রয়োজন, সুধীন দত্ত শ্রেষ্ঠ রোমান্টিক কবি ছিলেন। কিন্তু তার শৈলী বাংলা কবিতা গ্রহণ করেনি। কারণ, শৈলীর ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে তিনি পুরোপুরি সংস্কৃতের আশ্রয় নিয়েছিলেন।

থান্ডার বে, কানাডা। ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

সর্বশেষ খবর