শুক্রবার, ২ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

শহীদবিহীন ঢাকা

বেলাল চৌধুরী

শহীদবিহীন ঢাকা

শহীদ কাদরী : জন্ম : ১৪ আগস্ট ১৯৪২—মৃত্যু : ২৮ আগস্ট ২০১৬

বাংলাদেশের প্রথিতযশা কবি শহীদ কাদরী এক সময় ছিলেন ইউরোপে পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টনে। শহীদ সম্পর্কে বহু উড়ো খবর শোনা যায় প্রায়শ। সত্য-মিথ্যা বলা মুশকিল। তবে শহীদ কাদরী যে ঢাকায় নেই বা শহীদবিহীন ঢাকা শহর এটা দেখছি শহীদের শত্রুমিত্র সবার কাছেই সমান আক্ষেপ ও বেদনার নানা সময়ে এবং প্রসঙ্গে অনেককেই বলতে শুনেছি, ‘আহা শহীদ যদি থাকতে এখন, বেশ হত।’ এই একটি বাক্য দিয়েই বোঝা যায়, শহীদের মিত্র এবং শত্রুরা কতটা ‘মিস’ করত শহীদকে। যে কোন বিষয়ে প্রসঙ্গ থেকে প্রসঙ্গান্তরে যেতে শহীদদের ক্ষমতা ছিল এক কথায় দ্বিতীয় রহিত। ২৮ আগস্ট শহীদ চলে গেলেন না ফেরার দেশে। আমাদের সাহিত্যের অঙ্গনে শহীদের অনুপস্থিতি সত্যি এই সময়ের একটি বিরাট ঘটনা।

শহীদ মানেই ঢাকার অশুনতি কাফে, রেস্তোরাঁ চায়ের দোকানে অখণ্ড ও নির্ভেজাল আড্ডা আর আড্ডা, সদলবলে অ্যাসফল্টের রাস্তা, অলিগলি ভেঙে উদ্দেশ্যবিহীন ঘুরে বেড়ানো দিনের পর দিন, রাতের পর রাত। জমজমাট আড্ডার জন্য যত গুণাবলির প্রয়োজন সেগুলোর সবকটাই শহীদদের মধ্যে অধিক ছাড়া কম ছিল না। যার ফলে যেখানেই শহীদ কাদরী সেখানেই অন্তহীন আড্ডা আর আড্ডা। চায়ের পেয়ালায় তুমুল ঝড়। তা সে শতজীর্ণ চায়ের দোকানেই হোক, চাই শহীদদের নিজের কিংবা অন্য যে কারুর আস্তানা কিংবা আস্তাবল যাই হোক না কোন, এ ব্যাপারে শহীদের কোনো বাছবিচার নেই। কবি বলে শহীদ যে শুধু কবিদের সঙ্গেই আড্ডা দিত মোটেই তা নয়। শহীদদের আড্ডার পরিমণ্ডলে বহু বিচিত্র চরিত্রের সমাবেশ ঘটত। তবে কবি ও কবিতা যে শহীদের কাছে পরম উপাদেয় ও মুখরোচক প্রসঙ্গ ছিল তা তো বলাই বাহুল্য। শহীদকে নিয়ে অজস্র চুটকি, বহু রসিকতা, অনেক কৌতুক প্রচলিত আছে বাজারে। সংখ্যার দিক থেকে সেগুলো এতই প্রতুল ও কৌতূহলোদ্দীপক যে কোনটা ছেড়ে কোনটার কথা বলি! শহীদকে নিয়ে বহু গল্প তার বন্ধুদের মুখে মুখে ঘোরে প্রায় নিত্য এবং প্রিয় প্রসঙ্গে মতো।

এমন একটা সময় ছিল যখন শহীদ কাদরীর দিন শুরু হতো বেলা বারোটার পর থেকে। সদ্য ঘুমভাঙা চোখে মুখে জলের ছিটে দিলো না দিলো, ভরদপুরের রোদ মাথায় নিয়ে শহীদ বেরিয়ে পড়ত আড্ডার সন্ধানে। ওয়ারি পাড়ার কোন চা দোকানের মধ্যাহ্নকালীন আড্ডা সেরে শেষ বিকালের পড়ন্ত রোদ ঝিরঝিরে হাওয়া শরীরে মেখে শহীদ এগুলো বাংলাবাজারের দিকে। বিউটি বোডিং কিংবা গোবিন্দ ধাম ছিল তার গন্তব্যস্থল। রাত ন’টা দশটার দিকে আবার নবাবপুরের কোনো হোটেল কিংবা রেস্তোরাঁ। রাত ১২টার পর ফুলবাড়িয়া রেল ইস্টেশনের টি-স্টল। সেখানে থেকে ভোর ৪টা কি ৫টার দিকে এলোমেলো ইতিউতি হাঁটতে হাঁটতে ততক্ষণে চা দোকানগুলোর উনোনে আঁচ দেওয়া শুরু হয়ে গেছে, জিলিপি ভাজার আয়োজন চলছে। ঝাপসা ফিকে অন্ধকারে জেগে উঠেছে দু’একজন মানুষ। ঝাড়ুদার ঝাড়ুদারনীরা নেমে পড়েছে রাস্তায়। শহীদ গরম গরম জিলাপি সহযোগে দোকানের প্রথম কাপ চা। গতরাতের শেষ কাপ চাও শহীদই পান করেছিল। খেয়ে সিদ্দিকবাজারে ঘরে ফিরে একটানা ঘুম লাগাতে দুপুর বারোটা অব্দি। ফের দুপুর ১২টা থেকে শুরু হতো। এইভাবে শহীদ কাটিয়েছে তার প্রথম যৌবনের অনেকগুলো বছর তার ভাই শাহিদ কাদরীর প্রশ্রয়ে আড্ডা অন্তপ্রাণ শহীদদের।

শহীদ কাদরী সর্বতোভাবে একজন খাঁটি কবি। শহীদ এমন কবিদের দলে যারা অত্যন্ত কম লিখেন কিন্তু তাদের প্রতিটি রচনাই সমানভাবে উল্লেখযোগ্য। এবং পাঠক, সমাজে আদৃত হয়। সংখ্যার দিক থেকে এত কম লিখেছেন যে বিশ্বাসই হতে চায় না তারা কী করে একজন মালার্মে কিংবা টেড হিউজসে হতে পেরেছেন। কারা অনুরাগীরা কিন্তু আগ্রহ ব্যাকুলতার সঙ্গে প্রতীক্ষায় থাকেন তাদের প্রতিটি নতুন রচনার জন্য। কেন না সেগুলোই পাঠকের কাছে এক অনির্বচনীয় অভিজ্ঞতার উপহার স্বরূপ। বিগত পনেরো বছরে শহীদদের মাত্র দুটি কাব্যগ্রন্থ বেরিয়েছে। সব মিলিয়ে তার কবিতার সংখ্যা হয়তো শতাধিকও হবে না। ব্যক্তিগত জীবনে শহীদ অত্যন্ত মার্জিত, সুরাসিক এবং বন্ধুবৎসল অমিয় কোমল হৃদয়। ক্ষুরধার, রসালো তির্যক বাক্যবাণে শহীদে পটুত্ব অসাধারণ কিন্তু সেটা নির্ভেজাল ও মলিনতাহীন। শহীদদের কবিতায় মূর্ত হয়ে ওঠে শহুরে মানুষ নাগরিক মানসের প্রতিচ্ছবি, তাদের সমস্যা-জর্জরিত জটিল জীবন, ভাবাবেগ, আতঙ্ক, অনিশ্চয়তাবোধ, ক্রোধ, হিংসা, হতাশা কখনো বহিরাশ্রয়ী প্রতীকের গভীরতায় কখনো তীক্ষ উপমায় রূপকল্পে। বিংশ শতাব্দীর রুদ্ধশ্বাস নাগরিক জীবনে নাটকীয় স্পন্দনময়তাকে শহীদ তার কবিতার সর্বাঙ্গে বিস্ময়ের নিপুণতার সঙ্গে সংহত করে তোলেন। তার প্রতিটি কবিতাই বুদ্ধিদীপ্ত ও ঝকঝকে। তার ভাষা অত্যন্ত ঋজু সংকেতময় এবং তীব্র গতিসম্পন্ন। ত্রিশোত্তর বাংলা কবিতার নিরক্ত ধমনিতে শহীদ নতুন রক্তচ্ছ্বাস এনে দিয়েছেন। সোপার্জিত মুদ্রা অঙ্কিত করেছেন তার কাব্যপ্রতিমায়। প্রেমের কবিতায় শহীদ একটি ব্যাপক প্রেমানুভূতিকে পরতে পরতে মেলে ধরে তার মধ্যে সঞ্চরিত করেন শাশ্বত রহস্যের আর্থি আকুতি। তার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা’র সুন্দর প্রচ্ছদচিত্রটি এঁকেছেন শহীদের রূপসী এবং বিদূষী স্ত্রী নাজমুন্নেসা ওরফে পিয়ারী। আর কবি গ্রন্থটি উৎসর্গ করেছেন পিয়ারীকে। উৎসর্গপত্রের উজ্জ্বল পঙিক্ত দুটি তুলে দিচ্ছি—‘গানগুলো যেন পোষা হরিণের পাল/ তোমার চরণ চিহ্নের অভিসারী।’ মধুর দাম্পত্য ছবি নয় কি? আর একটা গোপন খবর, বিজ্ঞানের অধ্যাপিকা হলেও নাজমুন্নেসা ছবি আঁকা ও কবিতা লেখাতেও বিশেষ পারদর্শিনী।

শহীদ পাবলো নেরুদা আকতাভিও পাজ, সেফেরিসের কিছু কবিতার চমৎকার তরতাজা অনুবাদ করেছিলেন বাংলায়। কবিতা ও সাহিত্যবিষয়ক আলোচনায় শহীদ ইতিমধ্যেই লব্ধপ্রতিষ্ঠা। দৈনিক সংবাদপত্রের রবিবাসরীয়তে নিয়মিত ফিচার লিখে শহীদ প্রমাণ করেছেন তার গদ্যশৈলী তার কবিতার মতোই অনুকরণীয়। ইংরেজি রচনাতেও শহীদ অত্যন্ত সাবলীল। কিছু বাংলা কবিতার ইংরেজি অনুবাদও করেছিলেন এক সময়।

শহীদদের  মতো প্রকৃত খাদ্য রসিক আমি অন্তত জীবনে খুব কমই দেখেছি। ভালো খাবারের প্রতি তার এক ধরনের দুর্ময় টান ছিল। দানাদার কী জিনিস এবং দানাদার খাওয়ার ভেতর কী অনির্বচনীয় স্বাদ সুখ ও তৃপ্তি পাওয়া যায় সেটা আমি শহীদদের অভিব্যক্তি থেকেই বুঝেছিলাম।

অসম্ভব ভালো গালগল্প বানানোর একটা আশ্চর্য এবং সহজাত ক্ষমতা ছিল শহীদের। এ ব্যাপারে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই একটি সরস এবং উপাদেয় গল্পের জন্য প্রকৃত তথ্য কখনো বাধার বিদ্ধ্যচল হয়ে দাঁড়াতে পারেনি শহীদের সামনে। প্রয়োজনে কাটছাঁটা বা সংযোজন, পরিবর্ধনের এক নিপুণ শিল্পী ছিল শহীদ। শহীদের পড়াশোনার পরিধি ছিল বিশাল, বিচিত্র ও ব্যাপক। কিন্তু তাই বলে অযথা পণ্ডিত্যের ভারে শহীদকে কখনো ন্যুব্জ হতে দেখিনি। শহীদ তার পড়াশোনাকে ব্যবহার করত খাপখোলা বাঁকা তরবারির মতো। আর ছিল শহীদের সেই প্রায় কিংবদন্তিখ্যাত অট্টহাসি। হাস না বলে হাস্য বললে বোধ হয় কিছুটা মানানসই হয়। এই হাসি দিয়ে যে শহীদ কত রথী-মহারথীকে কুপোকাত করেছে, কত অসার দশ্বের ফাঁপা বেলুনকে মুহূর্তে চুপসে দিয়েছে তার হিসাব-নিকাশ নেই। কিন্তু এই যে এত কিছু যে শহীদকে নিয়ে অর্থাৎ তুখোড় আড্ডাবাজ শহীদ, বাকপটু শহীদ, বিশালবপু শহীদ, পণ্ডিত শহীদ তার সব পরিচয়কে ছাপিয়ে শহীদের ভেতর যে এক সরল, অভিমানী ও অমলিন শিশু এবং সর্বোপরি একজন বড়-মাপের  কবি লুকিয়ে রয়েছে—তার মধ্যে কিন্তু কোথাও একরত্তি খাদ মেশানো নেই। আমার মতে শহীদবিহীন ঢাকা শহরকে আগের তুলনায় অনেক নিষ্প্রভ দেখায়। শহীদের স্বেচ্ছায় নির্বাসনের সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা শহর হারিয়েছে তার ঔজ্জ্বল্য, তার মেধাবী রাত আর দিন, বসন্ত দিনের সোনালি কিচেন নক্ষত্রের মতো চকচকে মুদ্রার আস্ফাালন উল্লাস দুহাতের আঙুল গলানো অজস্রতা।

এই শহীদই আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল স্বাধীনতা-পূর্ব ও পরবর্তীকালে যথাক্রমে টাঙ্গাইলের রফিক আজাদ, পশ্চিম থেকে আগত মাহমুদুল হককে। এরপর কী করে যে আমরা সবাই একই গোয়ালের হয়ে যাই তা টের পাইনি। শহীদের সঙ্গে আমার যতবারই দেখা হতো প্রবাস জীবনের ফাঁকে ফাঁকে। আমি ছিলাম আজন্ম প্রবাসী। আজ এ শহর তো কাল ও শহরে। আজ এ বেলা নারিন্দা তো অন্যবেলা তেজকুনিপাড়া। তবে সে দিনের নারিন্দা আর শহর ঢাকার তেজকুনিপাড়ার দ্বিরত্ব বা অবস্থায় দিয়ে আজকে ওই জায়গা দুটি নির্ণয় করতে গেলে বিপদে পড়বেই। সমূহ সম্ভাবনা। একদা জেলা শহর ঢাকা আর আজকের রাজধানী শহর ঢাকার বিস্তর ফারাক। যেমন সে দিনকার শ্রীদাস লেন নিবাসী তরুণ কবি যশোপ্রার্থী শহীদ কাদরী আর হাল সাকিন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অঙ্গরাজ্য বোস্টন নিবাসী স্থিতিজাত্য শহীদ কাদরীর মধ্যে যোজন প্রমাণ যতটা দূরত্ব। কথাবার্তায় শহীদের হয়তো ভরাট কণ্ঠের কারণেই দারুণ একটা সম্মোহনী শক্তি ছিল। তা সে খুব সিরিয়াস কথার বেলাতেই হোক চাই হালকা মেজাজের চটুল কথাবার্তাই হোক। তার স্বাধীনতাচেতা জীবনযাপন। কারুক্কে তোয়াক্কা করতে হয় না। মাঝখানে দীর্ঘ অদর্শন। ৩১ আগস্ট সে দেশে এসেছে, প্রিয় বাংলাদেশে। সে আর ফিরবে না মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। তবু আমার সঙ্গে চিরদিনের জন্য দেখা হবে না। কবি শহীদ কাদরীর আত্মা শান্তি লাভ করুক।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর