শুক্রবার, ২ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

শহীদ, সে তো নেই

জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত

শহীদ, সে তো নেই

‘না, শহীদ সে তো নেই, গোধূলিতে তাকে কখনো বাসায় কেউ কোনো দিন পায়নি, পাবে না। নিসর্গে তেমন মন নেই, তাহলে ভালোই হতো অন্তত চোখের রোগ সযত্নে সারিয়ে তুলতো হরিৎ পত্রাদি। কিন্তু মধ্যরাতের সশব্দ কড়া তার রুক্ষ হাতের নাড়ায় (যেন দুঃসংবাদ-নিতান্ত জরুরি) আমাকে অর্ধেক স্বপ্ন থেকে দুঃস্বপ্নে জাগিয়ে দিয়ে তারপর যেন মর্মাহতের মতো এমন চিৎকার করে—ভাই, ভাই ভাই বলে ডাকে, মনে পড়ে সেবার দার্জিলিংয়ের সে কি পিচ্ছিল রাস্তার কথা, একটি অচেনা লোক ওরকম ডেকে ডেকে ডেকে খসে পড়ে গিয়েছিল হাজার হাজার ফুট নিচে।

সভয়ে দরজা খুলি—এভাবে দেখা পাই তার মাঝরাতে, জানি না কোথায় যায়, কী করে, কেমন করে দিন-রাত কাটে চাকরিতে মন নেই, সর্বদাই রক্তনেত্র, শোকের পতাকা মনে হয় ইচ্ছা করে উড়িয়েছে একরাশ চুলের বদনে।

না, না, তার কথা আর নয়, সেই বেরিয়েছে সকাল বেলায় সে তো— শহীদ কাদরী বাড়ি নেই।’

[অগ্রজের উত্তর]

কবিতাটি সম্পূর্ণ উদ্ধৃত করার সুযোগ নিলাম এই কারণে যে, এটি আমার প্রিয় কবিতা। এই শহীদ কাদরীকে আমি চিনি। যেন আমার চোখের সামনেই দেখি—এই এতকাল পরেও। শহীদের রচনায় শাহেদ কাদরীর বিরক্ত, ক্রুদ্ধ, ভীতি, অভিমানী এ বয়ান অনেকবারই শুনেছি—কখনো দরজার কড়া নাড়ার আগেই। দোতলায় বারান্দায় দাঁড়ানো তিনি আমাদের দেখলেই জানিয়ে দিতেন, শহীদ বাড়ি নেই। তবে সব দিন নয়—অনেক সময়ই তাকে পেতাম বাড়িতে। বাইরের ঘরে বসিয়ে রেখে হয়তো রাতের ঘুম ভেঙে ওঠা শহীদ হাত-মুখ ধুয়ে কি দিনের ঢেকে রাখা খাবার কিছু মুখে দিয়ে বেরিয়ে আসতো সারা বিকাল কি সন্ধ্যা কি রাতের মতোই! আমি অফিস ফেরতা, যতক্ষণ পারা যায় একসঙ্গে থাকতাম। গোপীবাগ পার হয়ে, মতিঝিল কি হাটখোলা ওয়ারী, তারপর গুলিস্তান, স্টেডিয়াম এবং শেষে রেক্স কি গুলিস্তান রেস্তোরাঁয়। আমার বাইরে থাকার সময় শেষ হলে ঘরে ফেরার জন্য রিকশা ডাকি, পর দিন অফিস আছে, আর শহীদ ধীরে চলে যায় ফুলতলা স্টেশনের রেলওয়ে রেস্তোরাঁর দিকে। ভিন্ন এক সুহৃদের দল সেখানে অপেক্ষায় আছে তার জন্য— নীরু, বুড়ো, বাচ্চু। আমাদের সঙ্গে প্রায় কখনোই তাদের দেখা হতো না।

একবার আমরা কয়েকজন— হায়াৎ মামুদ, আল মাহমুদ, হুমায়ুন চৌধুরীসহ রেক্স রেস্তোরাঁর প্রায় পেছনেই ‘মর্নিং নিউজ’ অফিসে গিয়ে শামসুর রাহমানকে সঙ্গে নেই। তারপর সেকালের সন্ধ্যাপারের স্টেডিয়াম নির্জন মতিঝিল, হাটখোলা, সার্কুলার রোড ধরে ফুলতলা স্টেশনের কাছে আসার আগেই শামসুর রাহমান আর হাঁটতে চান না। তাকে রিকশায় তুলে দিয়ে চলি আমরা ঢাকা স্টেশনের দিকে।

এইরকম করেই চলেছিল কিছুকাল। পঁয়ষট্টির সেপ্টেম্বর আমাদের এ সান্ধ্যসম্মিলন বন্ধই করে দেয়। ব্ল্যাকআউটের রাত, নানা শঙ্কা, দুর্ভাবনা সাহিত্য সৃষ্টির চিন্তাও থাকে না আর মনে। তৎকালীন সরকারের কিছু হয়রানির শিকারও হই আমি, এবং ওই বছরেরই শেষে ঢাকা টেলিভিশনের উদ্বোধন হয়। সতীর্থ গল্পকার হুমায়ুন চৌধুরী ঢাকা টেলিভিশনে যোগ দেয়। আমি বাংলা একাডেমির চাকরি ছেড়ে দিলে কবি আবদুল গণি হাজারি আমাকে অবজারভারে ডেকে নিয়ে যান সানডে অবজারভারের সহকারী সম্পাদক হিসেবে। তার কিছুকাল পরেই বিস্ময়ের সঙ্গে দেখি শহীদ ঢাকা টেলিভিশনে নিয়মিত চাকরি নিয়েছে—প্রোগ্রাম প্রডিউসারের। শহীদ ঢাকা টেলিভিশনে আসার ফলে টেলিভিশনের দরজা খুলে যায় আমাদের জন্য। ঢাকা টেলিভিশনের জন্য নাটক লিখতেও শুরু করি।

আমি যখন দেশ ছাড়ি শহীদ তখন ঢাকা টেলিভিশনে কর্মরত। ‘উত্তরাধিকার’ প্রকাশিত হয়েছে, নতুন আধুনিক বাংলা কবিতার ভুবনে তার পরিচিতি কাউকে বলে দিতে হয় না। ঊনসত্তরের পরে কখন, কোথায়, কী কবিতা সে লিখেছে ভালো জানি না। ‘তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা’র, একত্রিশটি কবিতাকেই ধরে নিতে হয় তার রচনার পরিমাণ—সাত বছরের ফসল কিন্তু ওই ফসলই মুগ্ধ করেছিল বাংলা কবিতার পাঠককে—১৯৭৩-এর বাংলা একাডেমি পুরস্কার তার প্রমাণ। পরবর্তী চার বছরে তার কবিতা রচনায় একরকম গতির সঞ্চার হয়েছিল বোঝা যায়—‘কোথাও কোনো ক্রন্দন নেই’ গ্রন্থের পঁয়ত্রিশটি কবিতা থেকে। কবিতা রচনায় তার উৎসাহ স্পষ্ট—অনেকে তার কারণও হয়তো খুঁজবেন। সে তখন বিবাহিত। একরকম জীবন অনুকূল বাতাস হয়তো বয়েছিল তার জীবনে তখন। তার কাছের লোকেরা সে কথা ভালো জানেন। আমি জানি না। শুধু উনিশ শ’ আশিতে যখন তাকে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শয্যাশায়ী দেখি তখন ঢাকায় সে একা। স্ত্রী বিদেশে। শুনি সেও বিদেশে কিছুকাল কাটিয়ে ফিরে এসেছে আবার বিদেশে যাবে বলেই। কি পরিমাণ কবিগুণ জমা হয়েছিল আটাত্তরের পরে তার সংগ্রহে অথবা লেখাই বা হয়েছিল কি পরিমাণ জানি না। শুধু দেখি ত্রিশ বছর পরে প্রকাশিত ‘আমার চুম্বনগুলো পৌঁছে দাও’ কাব্যগ্রন্থে কবিতার সংখ্যা ছত্রিশ এবং লক্ষ্য করি ছত্রিশটি কবিতার মধ্যে বেশকিছু কবিতা পুরনো শতকের শেষে নতুন শতকের প্রথমে লেখা। আমার পরিচিত কয়েকটি কবিতা দেখি আমারই তাগিদে লেখা। শহীদ কাদরী রচিত কবিতার সংখ্যা ও রচনাকালের ব্যাপ্তিবিষয়ক এই বিবরণ নিতান্ত মামুলি—চাই কি প্রচুর পরিমাণ কাব্যজ্ঞানসমৃদ্ধ কি বুদ্ধিদীপ্তও নয়। তবুও এই বিবরণ এটিই সম্ভবত বোঝায় যে, আশির দশকের পরে দীর্ঘকাল শহীদ কবিতার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। ওই সময়ে তার জীবনে নানা প্রতিকূলতা কি অনিকেত যাত্রাপথের কথা অনেকেই বলবেন জানি কিন্তু পরে যখন তার জীবনে কিয়ৎ পরিমাণে স্বস্তি ফিরেছিল তখনো সে কবিতাবিমুখই ছিল। অথবা তাই কি?

১৯৮২’র মে মাসে সপ্তাহ দুয়েকের জন্য আমি ও পূরবী ইউরোপে বেড়াতে যাই নিউইয়র্ক থেকে। বেলজিয়াম, ফ্রান্স ও সুইজারল্যান্ড। যাওয়া-আসার পথে লন্ডনে দু’চার দিন করে থাকা। পূরবীকে শহীদ দেখেছিল ঢাকাতেই। সাতষট্টিতে আমার বিবাহোত্তর অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিল সে। লন্ডনে পৌঁছে কবি দেবব্রত চৌধুরীর মুখে শহীদ কাদরীর লন্ডনে বাসের কথা শুনি এবং দেবুদাকে নিয়ে শহীদের সঙ্গে দেখা করতে যাই ‘সুরমা’ পত্রিকা অফিসে। শহীদ সেখানে সপ্তাহের কিছু সময় ব্যয় করত পত্রিকা সম্পাদনায় সাহায্যকারী হিসেবে। ঐদিন দেখা হওয়ার পরে স্থির হয় আমরা ইউরোপ ভ্রমণ থেকে ফিরলে শহীদের সঙ্গে কিছু সময় কাটানো যাবে।

সাত দিন পরে শহীদ আমার বড় ভাইয়ের ব্যালহ্যামের বাড়িতে দেখা করতে আসে। পুরনো দিনের নানা গল্প শেষে রাত হলে সে আমাদের সঙ্গে থেকে যায়। কথায় কথায় শহীদকে বলি, আমার কিছু নগদ অর্থ প্রয়োজন, তাই পরদিন ব্যাংকে যেতে হবে ট্রাভেলার্স চেক ভাঙানোর জন্য। ব্যাংকে যাওয়ার প্রয়োজন নেই, জানিয়ে শহীদ আমাকে প্রয়োজনমত ডলার দিয়ে বলে, আমি খুব শিগগিরই আমেরিকায় আসছি। ওখানেই বরং আমায় টাকাটা ফেরত দিও। অতি বিস্মিত আমি বেশি প্রশ্ন করার সুযোগ পাই না। শহীদও বেশিকিছু বলে না। দু-তিন মাস পরে শহীদের টেলিফোন পাই। বোস্টনের উপকণ্ঠে মলডেন শহরে থাকে সে। নতুন সংসার। যেন যাই তাকে দেখতে। শহীদের সংসার ভেঙে যাওয়ার খবর জানতাম আগেই। ফলে লন্ডন থেকে বোস্টন আসার পর সব কথা বুঝে যাই সহজেই। বোস্টনের শহরতলি মলডেন সম্পূর্ণ মধ্যবিত্তের অঞ্চল। শহীদের বাস বহুতল এক অ্যাপার্টমেন্টে। তার শ্বেতাঙ্গিনী স্ত্রী ডেনার সঙ্গেও আলাপ হয়। শুনি ডেনার সঙ্গেই লন্ডন ছেড়ে এসেছে সে। দেখি অতি স্বাস্থ্যসচেতন সে। বার বার তরকারি ধুয়ে নেয়, বাঁধাকপির কয়েক স্তরের পাতা ফেলে দিয়ে রান্না করে। ভাবি মধ্যরাতে ‘ভাই, ভাই, ভাই’ বলে দরজায় কড়া নাড়া শহীদের জন্য এ বড় মন্দ ব্যবস্থা নয়। মলডেনে একাধিকবার গেছি আমরা আমাদের ছয় বছরের কন্যা জয়ীতাসহ, কখনো কবি ইকবাল হাসানকে সঙ্গে নিয়ে, কখনো সাংবাদিক বদিউজ্জামান খসরুকে নিয়ে। মলডেনের আড্ডায় লেখালেখির নানা কথা উঠত।

আমাদের পুত্রসন্তান দীপন জন্মানোর কিছুকাল পরে শহীদ ডেনাকে নিয়ে নিউইয়র্কে আমাদের পার্কওয়ে ভিলেজের বাসায় বেড়াতে আসে। পঁচাশির শেষদিকে সম্ভবত। আর ঠিক ওই সময়েই নিউইয়র্ক থেকে সৈয়দ মোহাম্মদ উল্লাহ ‘প্রবাসী’ নামে সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ শুরু করেন। ইকবাল হাসান প্রবাসীর প্রথম সংখ্যার জন্য একটি সাহিত্য পাতার আয়োজন করে। আমাকে লিখতে বলে, শহীদকেও। যথারীতি ভয় দেখিয়ে বলে যদি গল্প লিখে না দিই তাহলে সে আমার পুরনো গল্পই একটি ছেপে দেবে। দিয়েছিলও তাই। শহীদের একটি কবিতাও ছেপেছিল। বাধ্য হয়ে প্রবাসীর পরবর্তী সংখ্যার জন্য প্রায় আট বছর আগে শুরু করা মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গল্প ‘দিন ফুরনোর খেলা’ শেষ করে প্রবাসীতে ছাপাতে দিই। আঠারো বছর পরে সে-ই আবার আমার গল্প লেখা শুরু। ইকবাল হাসানের প্ররোচনায় আগ্রহে। শহীদের কবিতাও প্রবাসীতে ছাপা হয়েছে কোনো কোনো বিশেষ সংখ্যায়। সেসব তার পূর্বে লেখা কবিতা না নতুন লেখা জানি না। পুরোপুরি তাকে কবিতা লেখায় ফেরানো না গেলেও কবিতা লেখার প্রতি তার বিরোধিতা অনেকাংশে কমেছিল সেই কালে বলে আমাদের ধারণা। এমনকি ১৯৯৩-এ ‘যুক্তরাষ্ট্র সাহিত্য পরিষদ’ নামে আমরা নিউইয়র্ক-নিউজার্সি-পেনসিলভানিয়া-কনেকাইকাট ম্যাসাচুসেটস অঙ্গরাজ্যসমূহে বসবাসরত বাংলা সাহিত্যসেবকদের যে গোষ্ঠীর পত্তন করেছিলাম তার প্রথম সাহিত্য সমাবেশে শহীদ কাদরীকে প্রায় জোর করেই নিয়ে এসেছিলাম প্রধান অতিথি হিসেবে। ঢাকা থেকে নির্মলেন্দু গুণও এসেছিলেন সেই সাহিত্য সমাবেশে। রকফেলার ইউনিভার্সিটির স্কলারস রেসিডেন্সের আটাশ তলায় অনুষ্ঠিত সেই সাহিত্য সম্মেলনে নির্মলেন্দু গুণের একটি কথা মনে পড়ে। ‘আজ আপনারা বাংলাসাহিত্যকে যে অভূতপূর্ব উচ্চতায় তুলে এনেছেন...।’ প্রকৃতই মাটি থেকে এত উঁচুতে বাংলাসাহিত্যের কোনো সমাবেশ হয়েছে বলে জানি না। সাহিত্য সমাবেশের শেষে শহীদ কাদরী ও গুণকে নিয়ে চলে যাই জাতিসংঘের সামনে একুশের চেতনামঞ্চ নির্মিত অস্থায়ী শহীদ মিনারে ফুল দিতে। প্রচণ্ড শীতের রাতে, ইস্ট রিভার থেকে উঠে আসা হাড় হিম করা বাতাসকে আমল না দিয়ে।

‘যুক্তরাষ্ট্র সাহিত্য পরিষদ’ প্রায় পাঁচ বছর টিকেছিল। সাহিত্য পরিষদের নানা সভায় ও অনুষ্ঠানে ঢাকা ও কলকাতার অনেক যশস্বী লেখক অংশগ্রহণ করেছেন। শহীদ কাদরীকে আর আনা যায়নি। তবুও মনে হয় সম্ভবত যুক্তরাষ্ট্র সাহিত্য পরিষদ শহীদের মনে আবার কবিতা লেখার সামান্য বাসনা হয়তো সঞ্চারিত করতে পেরেছিল। সাতাশির শেষে দেশে ফিরে যাওয়ার জন্য মনস্থির করলে শহীদকে সে কথা জানাই। নভেম্বরের দিকে দেশে ফিরে যাওয়া যখন প্রায় নিশ্চিত শহীদকে টেলিফোন করলে ডেনা টেলিফোন ধরে বলে, তোমরা বরং আর শহীদকে ফোন করো না। দেশে ফিরে যাওয়ার কথা শুনলেই সে অস্থির হয়ে পড়বে, মন খারাপ করবে। ঐ দেশের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই। ‘হি বিলংস হেয়ার।’

দেশে সেবার আমি বছর খানেক ছিলাম। ফিরে এলে দেখি শহীদ মলডেন ছেড়ে সালেমত চলে গেছে। পারিবারিক আবেষ্টনও পাল্টেছে বেশ। সালেমতের এক হাসপাতালে কাজ করে সে তখন। সালমতও গেছি আমি শহীদ কাদরীর বাসায়। কবিতা-আলাপে কবিতা লেখানোর চেষ্টাও। ঊনসত্তরেই দেশ থেকে ফিরে আমি প্রকাশনা সংস্থা জন ওয়াইশি অ্যান্ড সন্স-এ কাজ শুরু করি। দেশে পাকাপাকি ফেরার চিন্তা কিছুতেই ছাড়ে না। শহীদের সঙ্গে যোগাযোগ ক্ষীণ হয়। তবু তার মধ্যে বিরানব্বইয়ে দেশে সাহিত্য প্রকাশ-এর মফিদুল হকের সঙ্গে আলাপে শহীদের কথা ওঠে। মফিদুল বলেন, শহীদ কাদরীর কোনো বই তো আর পাওয়া যায় না। যদি আমি শহীদকে রাজি করাতে পারি তাহলে তিনটি বই একত্র করে একখণ্ডে প্রকাশ করা যায়। আমি আগ্রহে সেই দায়িত্ব গ্রহণ করি। শহীদের সঙ্গে কথা বলি, ১৯৯৩-এ শহীদ কাদরীর তিনটি কবিতাগ্রন্থ একত্রে ‘শহীদ কাদরীর কবিতা’ নামে সাহিত্য প্রকাশ একালের পাঠকের হাতে তুলে দেয়। শহীদ কাদরী বাংলা একাডেমি পুরস্কার পাওয়ার কুড়ি বছর পরে শহীদকে নতুন করে পাঠকের কাছে পৌঁছানোর ওই ঘটনাস্রোতে আমার সম্পৃক্ততার কথা ভাবলে সামান্য আত্মপ্রসাদ বোধ করি না এমন নয়, যদিও কবিতার জগতে শহীদের পুরোপুরি না ফেরার কথাও মনে থেকে যায়। কচিৎ দু’একটি কবিতা প্রবাসীতে ছাপা হয়েছে তখন।

সাতানব্বইয়ে জন ওয়াইশির চাকরি ছেড়ে দিয়ে দেশে ফিরে যাই। এবার দীর্ঘ সময়ের জন্য। যদিও বছরে একাধিকবার দুই দেশে যাতায়াত আমার থাকেই। শহীদের সঙ্গে যোগাযোগও থাকে— ক্ষীণ হলেও। যাওয়া-আসার কোনো এক কালেই শহীদের সঙ্গে দেখা হয়। বুঝি জীবনের মোড় পাল্টেছে, তার আবার অসুস্থতাটিও ধরা পড়েছে ততদিনে। নিউইয়র্কেই বাস তখন তার। মনে হয় নতুন সংসারে সে বেশ স্বচ্ছন্দে যত্নে আছে। একাকী জীবন আর নয়। আমাদের রকল্যান্ড কাউন্টির বাড়িতে আসে সে সস্ত্রীক। কবিতার কথা হয়। দু’একটি কবিতা লেখেও। কালি ও কলম-এ ছাপা হয়। এবং ওই সময়ই কখনো ঘরে কখনো হাসপাতালে। আমি তাকে চতুর্থ গ্রন্থটির পৃষ্ঠা সাজাতে বলি। নীরার উৎসাহে সেটি সাজানোও হয়ে যায়। প্রকাশক বন্ধু আলমগীর রহমানকে বলি সেটি প্রকাশের জন্য। আলমগীর সানন্দে, রাজি হয়ে যান। নিউইয়র্কের সাপ্তাহিক ‘বাঙালি’র সম্পাদক কৌশিক আহমদ মুদ্রাক্ষরিকের কাজ করেন। দুই হাজার নয়-এর ফেব্রুয়ারিতে ‘আমার চুম্বনগুলো পৌঁছে দাও’ শহীদের কবিতাপিপাসু পাঠক হাতে পায় এত কাল পরে। পুনরায় দেখেন তারা তাকে। বাংলাদেশ সরকার একুশে পুরস্কারে সম্মানিত করে তাকে। শহীদের পুনরাবির্ভাব চির উজ্জ্বল হয়ে যায়। এবং এই জন্যই বুঝি, কবিতায় শহীদের আগ্রহ আবার সবাই জেনে যায়। হৃদয়ের গভীরে যেটি ছিল, তখন সেটি যেন বাইরে এসে দাঁড়ায়।

শহীদের বাসায় নিউইয়র্কে, নিয়মিত কবিতার আসার হয়। কাব্যপাঠ, আলোচনা কাব্যরসিক শ্রোতাকুল পরম আনন্দে সেসবে অংশগ্রহণ করেন। নীরা কাদরী আসরের আয়োজক, পরিচালক। কবিতা সম্পর্কে অনেক কথাও বলে শহীদ কাগজে কাগজে। যাপিত জীবনের কিছু ছায়া লেখকের রচনায় পড়ে এ কথা জানা। লেখকের আপন জীবনই তার রচনার সর্বোত্কৃষ্ট উপাদান এ কথাও অনেকে বলেন। সময়, সমাজ, স্বদেশ দূরদেশ, পারিপার্শ্ব এসব নিয়েও কথা হয়— লেখকের রচনায় কি পরিমাণ প্রভাব দেশে ঐসব। কিন্তু সময়, সমাজ স্বদেশ দূরদেশ পরিপার্শ্ব পরিবেশ ইত্যাকার বিষয় লেখককে রচনাবিমুখও করে। তবে কখনো কোনো জীবনানুকূল বাতাস শরীর স্পর্শ করলে লেখক আবারও উড়তে পারেন সেই হাওয়ায়, ছড়িয়ে দিতে পারেন তার সৃষ্টি। শহীদের বেলায়ও বুঝি তাই ঘটেছিল।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর