শুক্রবার, ৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

কবিতা আমার জীবন

কবিতা আমার জীবন

বাংলা ভাষার অন্যতম প্রধান কবি নির্মলেন্দু গুণ-এর জন্ম ১৯৪৫ সালের ২১ জুন, নেত্রকোনা জেলার বারহাট্টা উপজেলার কাশতলা গ্রামে। পরবর্তীকালে কবি তার গ্রামের নাম পাল্টে রাখেন কাশবন। কবিতার পাশাপাশি তার গদ্যসম্ভারও কম নয়। তার রচিত নাটক ‘এ যুগের আকবর’ মামুনুর রশীদের নির্দেশনায় ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে মঞ্চস্থ হয়। তার লেখা জনপ্রিয় কবিতা ‘হুলিয়া’ (পরিচালক তানভীর মোকাম্মেল) ও ‘নেকাব্বরের মহাপ্রয়াণ’ (মাসুদ পথিক) চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। সাহিত্যে অবদানের জন্য তিনি একুশে পদক, স্বাধীনতা পদকসহ একাধিক পুরস্কার অর্জন করেছেন। তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন— শেখ মেহেদী হাসান

 

 

আপনার বাবা-মার সম্পর্কে কিছু বলুন।

আমার বাবা সুখেন্দু প্রকাশ গুণ, মা বীণাপানি। খুব ছোটবেলায় মাকে হারিয়েছি। আমরা পাঁচ ভাইবোন। আমার বড় ভাইয়ের নাম পূর্ণেন্দু। আমরা তাকে দাদামণি ডাকতাম। তার বয়স তখন দশ। বড় বোন রূপালী ছয় বছরের। বয়সে দুই বছরের বড় হলেও তাকে আমি দিদি বলে ডাকতাম না। নাম ধরেই ডাকতাম। তার ডাক নাম রূপু। দাদামণি এবং রূপুর মাঝখানে আমার একটি বড় ভাই ছিল। মহাকবি কালিদাসের সঙ্গে মিলিয়ে বাবা তার নাম রেখেছিলেন কালিদাস। তিন বছর বয়সে কালিদাস ম্যালেরিয়ায় মারা যায়। কালিদাসকে আমি দেখিনি, আমার জন্মের আগেই কালিদাস মারা যায়। আমার ছোট বোন সোনালি, দুই বছরের। সোনালির ছোটটির নাম দুলালী, ওর বয়স মাস ছয়েকের মতো। মা মারা যাওয়ার পর দুই ভাই ও তিন বোনকে নিয়ে বাবা অকূল সাগরে ভাসলেন। আমার মার মৃত্যুতে আমি কাঁদিনি—দুলালীর জন্য কেঁদেছিলাম। পরে তিনি পুনরায় বিয়ে করেছিলেন। নতুন মায়ের স্নেহচ্ছায়ায় শুরু হয় আমাদের নতুন জীবন।

 

শৈশবেই আপনার কবিতা লেখা শুরু, সেই শুরুর গল্পটা বলবেন?

আমি মনে করি, যতদূর স্মরণে আসে, কবিতার রাজ্যে আমার অভিষেক ঘটেছিল নিজের গ্রামের নাম ‘কাশতলা’ পাল্টে ‘কাশবন’ রাখার মধ্য দিয়ে। ‘কাশবন’ শব্দটা যে ‘কাশতলা’র চেয়ে শোভন ও শ্রুতিমধুর, শব্দশক্তির এই হঠাৎ-উপলব্ধিকেই আমি আমার কাব্যশক্তির জন্মলগ্ন বলে মনে করি। তখন আমার বয়স বড়জোড় নয়-দশ হবে। সবে স্কুলের তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছি। প্রথম এবং দ্বিতীয় শ্রেণির পাঠ আমি বাড়িতেই নিয়েছিলাম। তখন না বুঝলেও পরে জেনেছি, শব্দ হচ্ছে ব্রহ্ম। আর কবি হচ্ছেন ব্রহ্মার বরপুত্র। শব্দের জাদুকর। আমার দ্বিতীয় কবিতাটি হচ্ছে একটি দুই পঙিক্তর ছড়া। ‘কচি পাঁঠা, বৃদ্ধ মেষ;/ ভগল কবিরাজ, ডাক্তার এষ।’

 

বারহাট্টা স্কুল নিয়েও আপনি কবিতা লিখেছিলেন?

একদিন শিক্ষকের অভাবে আমাদের স্কুল ছুটি হয়ে যাবে, এমন সংবাদ পেয়ে অধীর আগ্রহে আমরা অপেক্ষা করছি। এমন সময় মণীন্দ্র গুণ স্যার এলেন আমাদের ক্লাসে। আমাদের ক্লাসে আসার আগে তিনি দশম শ্রেণিতে গিয়েছিলেন। সেখানে ছাত্রদের রেইনি ডে সম্পর্কে একটি ইংরেজি রচনা লিখতে বলে এসেছেন। নবম শ্রেণিতে ছাত্রদের জন্য একই রচনা বরাদ্দ হয়েছে বাংলায়। অষ্টম শ্রেণির জন্য নির্ধারিত হয়েছে সুলতান মাহমুদের ভারত আক্রমণের প্রশ্নটি—আর আমাদের সপ্তম শ্রেণিতে এসে কী কারণে জানি না, আর কোনো প্রশ্ন খুঁজে না পেয়ে তিনি বললেন : ‘তোরা চুপ করে বসে কবিতা লেখ। আমি আসছি।’ এই বলে উপরের শ্রেণিগুলোতে তার নির্দেশ কতটা পালিত হচ্ছে, তা তদারকি করার জন্য চলে গেলেন। স্যার চলে যাওয়ার পর আমরা শর্ষে ফুল দেখতে লাগলাম। তারপর শুরু হলো সাদা কাগজে কাঠ পেনসিলের যুদ্ধ। ক্লাসের সেরা ছাত্র মতি, সর্ববিদ্যাবিশারদ রণজিৎ পর্যন্ত ব্যর্থ। আমি লিখছি আর কাটছি। তখন আমি লিখি— ‘আমি এখন পড়ি যে ভাই, বারহাট্টা হাইস্কুলে/একে অন্যে থাকি হেথায় ভাই-বন্ধু বলে/এই স্কুলটি অবস্থিত কংশ নদের তীরে/আমাদের বাড়ি হইতে দেড় মাইল উত্তরে।’ আমার কবিতা পাঠের পর ক্লাসের মধ্যে বিদ্যুৎ তরঙ্গের মতো একটি আনন্দহিল্লোল বয়ে গেল। ক্লাসের ওই আনন্দ স্যারকেও স্পর্শ করে। কবিতার দুর্গম পথে আমার পা বাড়ানোর শুরুটা ছিল এ রকমই।

 

ঢাকায় এসে তো আবুল হাসানের সঙ্গে পরিচয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের পাশে শরীফ মিয়ার ক্যান্টিনে আমাদের প্রথম পরিচয়। তার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল মলয় ভৌমিক। পরিচয়ের প্রথম সূত্রেই ‘কণ্ঠস্বর’-এ প্রকাশিত তার কবিতার জন্য ধন্যবাদ দিলাম। সেও আমাকে জানায়, আমার কবিতা আজাদ, সংবাদ ও সমকালে পড়েছে। সে আমাকে করমর্দনের জন্য হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। আবেগে তার হাত কাঁপছিল। সেই আবেগে কম্পিত হাতটি বহু সময় ধরেছিলাম। এমনকি আমার মনে হয়, আমি তার হাত মৃত্যু অবধি ধরেছিলাম।

 

শরীফ মিয়ার ক্যান্টিনে কবি-সাহিত্যিকদের মধ্যে আর কে কে আসতেন?

‘কণ্ঠস্বর’ পত্রিকায় যারা যুক্ত ছিলেন তারা প্রায় সবাই আসতেন। তাদের মধ্যে হুমায়ুন কবির, সাযযাদ কাদির, আবদুল মান্নান সৈয়দ, মোহাম্মদ রফিক, রাজীব আহসান চৌধুরী এবং মাঝে মাঝে রফিক আজাদ আসতেন। শরীফ মিয়ার ক্যান্টিন ছাড়া পল্টনের আউটার স্টেডিয়াম মাঠের কোনো এক কোনায় আমাদের আরেকটি আড্ডার স্থান ছিল। সেখানে শিশুসাহিত্যিক আখতার হুসেন, রশীদ সিনহা ও দিলু ভাই আসতেন। দিলু ভাই মানে কবি দিলওয়ার। দিলু ভাই আমাদের সবাইকে কবিতার জীবনবোধ ও সমাজ সচেতনতা নিয়ে কথা বলতেন। তার কথা কিছুটা আমি মানলেও হাসান পাত্তা দিত না। আমি ও হাসান দুজন দুজনাকে প্রভাবিত করেছি কিন্তু আমাদের কাব্যযাত্রার পথ ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত। আবুল হাসান ছিল খুব রোমান্টিক প্রকৃতির কবি। তার কাব্যভাষাটা ছিল খুব পরিশীলিত এবং চিত্রকল্পময়। আমরা যখন রাজনৈতিক কবিতা লিখতাম, আবুল হাসান তখন নন-পলিটিক্যাল কবিতা লেখার চেষ্টা করত। এ নিয়ে তার সঙ্গে আমাদের দ্বন্দ্বও ছিল। ও অকালে মারা গেল; ১৯৭৫ সালের ২৬ নভেম্বর পিজি হাসপাতালে।

 

আপনার প্রথম কবিতা ছাপা হয় কোথায়?

হ্যাঁ, সাপ্তাহিক জনতায়, ১৯৬৫ সালে। তখন জনতার সম্পাদক ছিলেন ব্যারিস্টার শওকত আলী। জনতার ২১ ফেব্রুয়ারি সংখ্যায় আমার প্রথম কবিতা ঢাকায় প্রকাশিত হয়। তখন আমি ময়মনসিংহে আনন্দমোহন কলেজে পড়ি।

 

কণ্ঠস্বর পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত হলেন কবে?

১৯৬৭-তে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম। তখন আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ ‘কণ্ঠস্বর’ নামে ভিন্নধারার সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশ করতেন। সেখানে আমাকে বিজ্ঞাপন সংগ্রহের একটি চাকরি দেওয়া হয়। হুমায়ুন কবির, সাযযাদ কাদির, গালীব আহসান খান তখন কণ্ঠস্বরে আমার সঙ্গে কাজ করতেন। সায়ীদ ভাইয়ের একটা বাই সাইকেল ছিল। সেটা তিনি আমাকে দিয়েছিলেন আর আমি সেটি নিয়ে সারা ঢাকা শহর ঘুরে বেড়াতাম। পরে মামুনুর রশীদ চাকরি পেয়ে আগারগাঁওয়ে বাসা ভাড়া নিলেন। আমি সেখানে চলে গেলাম, আমাদের সঙ্গে আবুল হাসানও থাকত। ১৯৬৯ সালে আমি সাংবাদিক হিসেবে দৈনিক পিপল-এ সাব-এডিটরের চাকরি পাই। আমার বেতন মাসে ২৫০ টাকা। চাকরিটা পাওয়ার পর আমি ২০ টাকা দিয়ে আজিমপুর গোরস্থানের পশ্চিম পাশে একটা মেসে উঠি। এর আগে ১৯৬৬-’৬৯ পর্যন্ত আমার নিজের কোনো বালিশও ছিল না, থালাও ছিল না।

 

বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আপনার ব্যক্তিগত পরিচয় কীভাবে? তাকে নিয়ে আপনি কবিতা লিখেছেন?

বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার সত্যিকারের পরিচয় কখনো হয়নি। শেখ হাসিনা একবার বলেছিল, চলেন আপনার সঙ্গে আব্বার পরিচয় করিয়ে দিই। কিন্তু আমার কাপড় ময়লা ছিল বলে আমি যাইনি। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ১৯৬৬ সালের ১২ নভেম্বর আমি একটি কবিতা লিখি, তখন তিনি ছয় দফার জন্য জেলে ছিলেন। সংবাদে কবিতাটি ছাপা হওয়ার পর তিনি আমার নাম জেনেছিলেন। ব্যাপারটা আমি শুনেছিলাম জেলখানায় বঙ্গবন্ধুর সহবন্দী ছাত্রনেতা লতিফ সিদ্দিকী ও রণেশ দাশগুপ্তের কাছে। বঙ্গবন্ধু আমার কবিতা নিয়ে আলোচনা করতে রণেশ দা-র কক্ষে গিয়েছিলেন। পরে আমি ‘হুলিয়া’ কবিতাটি লিখি। ওই কবিতায় একটি পঙিক্ত ছিল, ‘শেখ মুজিব কি ভুল করছেন?/ আইয়ুব খান এখন কোথায়?’ এই কবিতা নিয়ে আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরী পূর্বদেশে কলাম লিখেছিলেন।

 

বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আপনার দেখা হয়নি?

হয়েছে। ১৯৭২ সালে হুমায়ুন কবিরকে হত্যার পর আমরা মিছিল নিয়ে বঙ্গবন্ধুর কাছে গিয়েছিলাম। তখন সবাই আমাকে ঠেলে দিল বঙ্গবন্ধুকে উদ্দেশ্য করে কথা বলার জন্য। আমি বললাম, ‘বঙ্গবন্ধু, আপনি কবিতা পড়েন, আমার মনে হয় আপনি কবিতা পছন্দ করেন, কবিতাপ্রিয় মানুষ আপনি। আমাদের কবি হুমায়ুন কবিরকে কে বা কারা রাতের অন্ধকারে ডেকে নিয়ে হত্যা করল। উনি একজন মুক্তিযোদ্ধা। আপনি তার জন্য একটি শোকবাণীও দিলেন না। এটা কেমন কথা?’ সেদিনই তাঁর সঙ্গে আমার সরাসরি কথা হয়। বঙ্গবন্ধু সেদিন আমাকে আপনি বলে সম্বোধন করছিলেন। আমাকে রাজি করাতে না পেরে, আমার পাশ থেকে আহমদ ছফা বঙ্গবন্ধুকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘বঙ্গবন্ধু আপনি নির্মলকে তুমি বলতে পারেন।’ উত্তরে বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘তা পারি, কিন্তু উনি তো কবি, তাই আমি তাঁকে আপনি করে বলছি।’

 

কবি শামসুর রাহমানের সঙ্গে আপনার দীর্ঘদিনের সম্পর্ক ছিল। পরিচয় হয় কীভাবে?

শামসুর রাহমানের সঙ্গে প্রথম পরিচয় ১৯৬৭ সালে। হাসানই পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। তিনি তখন দৈনিক পাকিস্তানের সহকারী সম্পাদক। তবে এ মুহূর্তে ঠিক মনে পড়ছে না যে, পত্রিকা অফিসে তার সঙ্গে প্রথম দেখা হয়েছিল নাকি তার মাহুতটুলীর বাসায় প্রথম পরিচয় হয়েছিল। সম্ভবত প্রথম সাক্ষাতে তিনি আমাদের সঙ্গে জীবনানন্দ দাশের সঙ্গে তার সাক্ষাতের স্মৃতিচারণা করেছিলেন। জীবনানন্দ দাশের মৃত্যুর কিছুদিন আগে এই সাক্ষাৎ ঘটেছিল। রাহমান ভাইয়ের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তার সঙ্গে আমার নিবিড় সম্পর্ক ছিল। আমাদের স্বভাবের বৈপরীত্য আমার মনে হয় একে অপরকে আকৃষ্ট করত। শামসুর রাহমান ছিলেন ধীরস্থির, শান্ত। আর আমি উদ্দাম, বোহেমিয়ান। আমার মুখ থেকে ভালো কথা সহজে বেরোত না আর শামসুর রাহমান খুব রেগে গেলেও বড়জোর স্টুপিড শব্দটি বলতেন, তার বেশি নয়। একবার একটি সাক্ষাৎকারে তিনি আমাকে ‘খুব শক্তিশালী কবি’ বলেছিলেন। আমি খুশি হয়ে পাঁচ কেজি লেংড়া আম নিয়ে চলে যাই তার শ্যামলীর বাসায়। আমার কাণ্ড দেখে তিনি সেদিন খুব খুশি হয়েছিলেন।

 

দৈনিক পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক কীভাবে হলো?

হাসান শুধু শামসুর রাহমান নয়, আমাদের সমসাময়িক প্রায় সব কবি-সাহিত্যিকের সঙ্গে আমার পরিচয় করে দিয়েছিলেন। একদিন আমরা মতলব করে দুজন মিলে দৈনিক পাকিস্তানে গেলাম। মতলব ছিল, কবি আহসান হাবীবকে পটানো। তিনি সহজে পটতেন না, খুব কড়া মানুষ ছিলেন। কবিতা ছাপার আগে কবিদের শিল্প সাহিত্য ও কবিতার ছন্দ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করতেন। তাই বড় ভয় পেতাম। দৈনিক পাকিস্তানে এর আগে অনেকবার হাসানের কবিতা ছাপা হয়েছে। তাই হাসান তার স্নেহভাজনে সফল ছিল। তবে মূল ব্যাপারটা ছিল আমাকে নিয়ে। আহসান হাবীব সম্পর্কে ভয়ের মূল কারণটা ছিল তার কবিতা পাঠ্যপুস্তকে পাঠ করেছি এবং পরীক্ষার খাতায় তার ‘এই মন-এই মৃত্তিকা’ থেকে প্রশ্ন এসেছে। তার রুমে ঢুকতেই দেখি, অনেক কবিতা ও পাণ্ডুলিপি নিয়ে তিনি কাটাকাটি করছেন এবং অধিকাংশই ঝুড়িতে ফেলে দিচ্ছেন। তারপর একটি সিগারেট ধরিয়ে তিনি আমাদের সঙ্গে কথা বলা শুরু করলেন। হাসান আমার পক্ষে হাবীব ভাইয়ের সঙ্গে ওকালতি করছিল। হঠাৎ সে হাবীব ভাইকে বলল, আপনার কবিতা নির্মলের মুখস্থ। তখন তার ‘এই মন, এই মৃত্তিকা’ কবিতাটি পাঠ করলাম। তার হাসি দেখে বুঝলাম, ওষুধ কাজে লেগেছে। সেদিনকার মতো হাবীব ভাইয়ের মন জয় করে আমরা তার রুম থেকে বেরিয়ে পড়লাম।

 

আপনার প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রেমাংশুর রক্ত চাই কীভাবে প্রকাশিত হয়?

প্রথম বই প্রকাশের জন্য ১৯৭০ সালে নওরোজ কিতাবিস্তান, মাওলা ব্রাদার্স এবং বইঘর প্রকাশনীতে ধরনা দিয়ে বার বার ব্যর্থ হয়েছি। কোনো প্রকাশকই আমার বই প্রকাশের ঝুঁকি নিতে চায়নি। কবিতার বইয়ের তখন কাটতি কম থাকায় কবি আল মাহমুদের ‘লোক লোকান্তর’ কবি-সাহিত্যিকদের যৌথ উদ্যোগে প্রকাশ পেয়েছিল। আবদুল মান্নান সৈয়দ তার প্রথম বই ‘জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ’ নিজের টাকায় প্রকাশ করেছিলেন। অবশেষে খান ব্রাদার্স নিজ থেকে আমার প্রথম কবিতার বই প্রকাশের উদ্যোগ নেয়। এই বইটি কিন্তু ১৯৭১ সালে কলকাতা থেকেও বেরিয়েছিল। বাংলাদেশেরই একটি প্রকাশনা সংস্থা ‘মুক্তধারা’ থেকে বেরিয়েছিল এবং এই ‘মুক্তধারা’র জন্ম হয়েছিল কলকাতাতেই। মুক্তধারার প্রতিষ্ঠাতা শ্রদ্ধেয় চিত্তরঞ্জন সাহা। 

 

রাজনৈতিক ও প্রেমের কবিতা দুটোতেই আপনার সৃষ্টিশীলতার স্বাক্ষর রয়েছে। কোনো কোনো কবিতায় কামের প্রাধান্য পেয়েছে।

আমাদের গড় পরমায়ু বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে আমাদের যৌবন কিন্তু এখন আগের চেয়ে প্রলম্বিত, দীর্ঘ হয়েছে। আগে ৫০ বছর হলে মানুষকে প্রবীণ বা বৃদ্ধ বলা হতো। যেমন আবদুল হক সাহেব তার ডায়রিতে লিখছেন, তিনি বাংলা একাডেমিতে কাজ করছেন, শওকত ওসমান এসেছেন। অনেকক্ষণ ধরে তিনি কথা বললেন। শওকত ওসমান সম্পর্কে আবদুল হক মন্তব্য করছেন, ওঁর ৫০ বছর হয়ে গেছে, তাই ওঁকে কথার বাতিকে ধরেছে। বয়স বেশি হলে মানুষ বেশি কথা বলে। শওকত ওসমানের ৫০ হয়ে যাওয়াটাকে হক সাহেব বেশ বয়স যাওয়া মনে করেছেন। এখন আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে একটা আড্ডার আয়োজন করেন। সেখানে আমাদের বয়সী যারা আছি, ষাটের দশকের জেনারেশন বা কণ্ঠস্বর গোষ্ঠীর অনেকেই আসেন। এদের সবারই বয়স ষাটের ওপর। কিন্তু আমরা যখন একসঙ্গে বসি তখন আমাদের মনেই হয় না যে আমরা প্রবীণ বা বয়স্ক হয়েছি। আমরা বেশ প্রগলভ আচরণ করি, নারী নিয়ে আমাদের তীব্র আসক্তি গল্প বলি। আমাদের ষাটের প্রজন্ম অনন্ত যৌবনের প্রত্যাশী প্রজন্ম। ওই বয়সী যারা, তাদের অনেকের কবিতার মধ্যেই কাম কিন্তু প্রবল।

 

আপনার আগ্রহ বিচিত্র বিষয়ে। কবিতা, ছবি চিত্রকলা, আড্ডা, অভিনয়, খেলা ইত্যাদি।

অভিনয় করেছি সেই পাকিস্তান আমলে। আমারই একটি নাটক ‘আপন দলের মানুষ’-এর কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেছিলাম। ১৯৭১ সালের ১২ ফেব্রুয়ারিতে নাটকটি পাকিস্তান ঢাকা কেন্দ্র থেকে প্রচার হয়েছিল। মোমিনুল হক সাহেব ছিলেন সেটার প্রযোজক। তিনি ওই নাটকের উপযুক্ত নায়কের সন্ধান করে না পেয়ে শেষ পর্যন্ত আমাকে গিনিপিগ বানিয়ে একটা এক্সপেরিমেন্ট করেছিলেন। বলেছিলেন, আমি যদি অভিনয় না করি তো তিনি ওই নাটক করবেনই না। তারপর আমি অভিনয় করলাম। এখন যে রকম নাটক আগে থেকে রেকর্ডিং হয়ে যায়, তখন এসব পদ্ধতি ছিল না। তখন লাইভ টেলিকাস্ট হতো। সেই লাইভ টেলিকাস্টে অভিনয় করা খুব রিস্কি! এবং সেই রিস্কি কাজটা সাফল্যের সঙ্গে না হলেও, আমি করেছিলাম বটে। তখন সপ্তাহে একটি নাটক হতো, রবিবারে। সবাই দেখত। চলচ্চিত্রকার আলমগীর কবির সাহেব নাটকটি দেখে  ‘লাস্ট সানডেজ গুণ-শো’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ লিখেছিলেন।

ছোটবেলায়ও কিছু এঁকেছি। আলোকচিত্রশিল্পী নাসির আলী মামুন মাঝে-মধ্যে আমার ছবি তুলতে আসত। ছবি তুলে সেই ছবির মধ্যে অটোগ্রাফ নিত আর বলত, ‘দাদা, পাশে একটা ছবি এঁকে দেন।’ তখন আমি ওর কথামতো পাশে একটা ছবি এঁকে দিতাম। কোনো সময় একটা মুখ, কখনো প্রাকৃতিক দৃশ্যের ছবি আঁকার চেষ্টা করতাম। এভাবে বেশকিছু ছবি এঁকেছি। প্রদর্শনীও করেছি। আর ক্রিকেট ও ফুটবল আমার প্রিয় খেলা। আর কবিতা আমার জীবন।

 

আপনি শিশু-কিশোরদের জন্য প্রচুর লিখেছেন।

শিশু-কিশোরদের জন্য আমার উল্লেখযোগ্য বই ‘বাবা যখন ছোট ছিলেন’, ‘কালো মেঘের ভেলা’, ‘সোনার কুঠার’, ‘আমি যখন বড় হব’ ইত্যাদি।

 

আপনি তো একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছেন।

আমার গ্রামে প্রতিষ্ঠা করেছি কাশবন বিদ্যানিকেতন। নেত্রকোনার মালনীতে ‘কবি নির্মলেন্দু গুণ পাঠাগার ও গবেষণা কেন্দ্র’ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছি।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর