শুক্রবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

প্রকৃতি মানুষ ছাড়া খুব ভালো বাঁচতে পারে

প্রকৃতি মানুষ ছাড়া খুব ভালো বাঁচতে পারে

কথাসাহিত্যিক ও প্রকৃতিসংবেদী বিপ্রদাশ বড়ুয়া (১৯৪০) সমকালীন ও চিরায়ত বিচিত্র বিষয় নিয়ে গল্পের ভুবন নির্মাণ করেন, উপন্যাস রচনা করেন বড়-ছোট সবার জন্য। তিনি গল্প, উপন্যাস, নিসর্গ, গবেষণা, ভ্রমণ, জীবনী ও পাঠ্যপুস্তকসহ ১৪০টিরও বেশি বই লিখেছেন। পেয়েছেন বাংলা একাডেমি, একুশে পদকসহ একাধিক পুরস্কার। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন—শেখ মেহেদী হাসান

 

আপনি লেখক হলেন কেন? চাবিকাঠি কি?

পাড়াগাঁয়ে ছেলেবেলা কেটেছে, কিন্তু অজপাড়াগাঁ নয়। গ্রামে একটি পাঠাগার ছিল, আমার জন্মের আগে থেকেই। নাম ইচ্ছামতী জ্ঞানদায়িনী পাঠাগার। গ্রামের নামও পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে উত্পন্ন ইচ্ছামতী নদীর নাম। এছাড়া কর্ণফুলী ও সুন্দরী খাল তো আছেই।

প্রাথমিক বিদ্যালয় ঘরে ওই পাঠাগার। বিদ্যালয়ের জায়গাও দিয়েছেন বাবা ডা. অরুণ কুমার বড়ুয়া। ঠাকুদাও ডাক্তার ছিলেন। দুজনেই কলকাতা থেকে পাস করে এসেছেন। ওই পাঠাগারে কলকাতায়পড়ুয়া গ্রামের ছাত্ররা নিয়মিত পত্রিকা ও বই পাঠাতেন।  সে সব বই গোগ্রাসে গিলতাম। প্রিয় ছিল গল্পের বই। শিশু-কিশোর উপন্যাস। কী সব দুর্দান্ত রোমাঞ্চকর নাম— যখের ধন, আবার যখের ধন, ছিন্নমস্তার মন্দির, মিসরের মমি ইত্যাদি ভয়ঙ্কর সুন্দর বই। ওই পড়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বেলা কেটেছে। শীতের দিনে ধান ও খড়ের পালায় চাদর গায়ে রোদের  দিকে পিঠ রেখে পড়তাম। একটুখানি খসখস শব্দেও আঁেক উঠতাম বইয়ের ভূতের ভয়ে।

প্রাথমিক থেকে উচ্চ বিদ্যালয় শেষ করতে করতে পাঠাগারের প্রায় বই গিলে খেয়েছি। বাকি বই ম্যাট্রিক শেষ করে। তার মধ্যে প্রবন্ধ ও উচ্চতর বইপত্র বাদ। ততদিনে পাঠাগারের সম্পাদক হয়ে শেষের কবিতা, পথের পাঁচালি, উদভ্রান্ত প্রেম, চন্দ্রশেখর প্রভৃতি বড়দের বই গিলে খেয়েছি। অসাধারণ আরও বইয়ের মধ্যে ছিল ম্যাক্সিম গর্কির নবজাতক। উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করার আগে কিছু সময় বঙ্গোপসাগরের এক মৎস্য কোম্পানির শেয়ার বিক্রির কাজও করেছি। সেই থেকে বঙ্গোপসাগরের প্রতি প্রেম। তারপর কী করে যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়েছি সে শুধু আমার গল্প-কবিতা লেখার প্রেরণাই জানে।

 

আপনি কলেজের শিক্ষকতা করতেন। বাংলাদেশ শিশু একাডেমিতে যোগ দিলেন কেন?

চট্টগ্রামের পটিয়া সালেহ নূর ডিগ্রি কলেজে বাংলা পড়াতাম। ১৯৭৫ পর্যন্ত শিক্ষকতা করেছি। তারপর তো অ্যাড-হকে সরকারি কলেজে নিচ্ছে। জানিও না কীভাবে নেয়? কে ঘুরবে? দূর। শেষে বুঝলাম, গ্রামে থাকা যাবে না। এখানে মন বসছে না। ঢাকায় চলে যেতে হবে। ঢাকায় এসে ব্র্যাকে চাকরি পেয়ে এক বছর চাকরি করেছি। ‘গণকেন্দ্র’ বলে ওদের একটি পত্রিকা ছিল। স্টাফ রাইটার ছিলাম। ততদিনে একজন গল্পকার ও শিশু পত্রিকার সহকারী সম্পাদক হলেও ছিল সম্পাদকের সবই দায়িত্ব। ততদিনে মুক্তিযুদ্ধ পেরিয়ে এসেছি। তারপর বখে যেতে বসা এই আমির পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি... শুধু চলা চলা চলা। এর মাঝে বাংলাদেশ শিশু একাডেমি প্রতিষ্ঠিত হলো। পত্রিকায় লোক নিয়োগের বিজ্ঞাপন ছাপল। ইন্টারভিউ দিয়ে টিকে গিয়েছি। তারপর বহু বছর শিশু একাডেমিতে কাজ করেছি। ১৯৯৭ সালে অবসর নিয়েছি। আমাদের হাতেই এটি গড়ে উঠেছে।

শিশু একাডেমির প্রকাশনা বিভাগ আপনি সমৃদ্ধ করেছেন।

আমি যদিও প্রকাশনা বিভাগের প্রধান ছিলাম, লাইব্রেরিটি আমার অধীনে ছিল, বাগানও ছিল। শিশু একাডেমির বাগান নিজের পরিকল্পনায় করা। অবশ্য অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মার সহযোগিতা নিয়েছি। বিভিন্ন রকমের গাছ লাগিয়েছি। আমি, নাসরীন জাহান আর সৈয়দ ইকবাল তিনজনে চালতাগাছ রোপণ করেছি। কুর্চিও রোপণ করেছি। এটি বুনো গাছ। পার্বত্য চট্টগ্রামে থরে থরে স্থানীয় কুর্চি আছে, এইটুকু হয়, কাটে, জুম চাষ করে আবার ওঠে। প্রথম কুর্চি দেখেছিলাম রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনে। বাগানের জন্য বলধায় আমাজন লিলি আনতে গিয়েছি। ওরা বলে, দেওয়া যাবে না, আমরা বীজ দিই না, ডালও দিই না। কোথায় যাব? বলল, অ্যাগ্রিকালচার অফিসে। গেলাম, আমাকে তো চিনে ফেলেছে, বলল, চিঠি দিন। প্যাড নিয়ে, চিঠি লিখে দিয়েছি, তারপর বীজ দিয়েছে। শিশু একাডেমির মাঠের সামনে, ইট ভেজানোর জন্য দুই হাত গভীর গর্তে বাঁশ কিনে এনে চারদিকে বেড়া বানিয়ে ঘেরাও করে লিলি রোপণ করলাম। পরে ছবি তুলে পত্রিকায় দিয়েছি। সে ছবি দেখে কেরানীগঞ্জ থেকে এক লোক এসে বলল, ভাই, আমাজন লিলি কোথায় ফুটেছে? দেখালাম। বেড়া তো দুই বছর পর ভেঙে নষ্ট হয়ে গেছে। মানে আমি চেষ্টা করেছি; কিন্তু ওরা সেভাবে টিকিয়ে রাখেনি।

 

আপনি সারা দেশে বেশ ঘুরেছেন। কেন?

গ্রামের পাঠাগারের পূর্বসূরি সাহিত্যিকদের বই পড়ে হাতে তুলে নিয়েছি রিলে রেসের মায়াবী কাঠি। এবার দরকার ওই কাঠি হাতে নিজের দেশ দেখা। ততদিনে দৈনিক ভোরের কাগজ নামজাদা খবরের কাগজ। কার্জন হলে সাদা মাদার ফুল দেখে বিস্মিত ও বিভ্রান্ত আমি। জন্ম থেকে ভিটেয় দেখা মাদার ও পলতে মাদার চিনি।  একি বিস্ময়। লেগে গেলাম সুলুক সন্ধানে। পেয়ে গেলাম। দু’কলম লিখে দৈনিক বাংলায় দিলাম। ছবিসহ ছাপা হল প্রথম পৃষ্ঠায় প্রথম কলামে। আমি বিস্মিত।

শুরু হলো ভোরের কাগজে পেছনের পৃষ্ঠায় লেখা। ছবিসহ ছাপা হতে লাগল। নাম ‘নগরে নিসর্গ’। সেই থেকে দেশের যেখানে যাই তার প্রকৃতি ও গাছপালা নিয়ে লিখি। একটা ক্যামেরা আছে, ছবি তুলি। প্রকৃতি যে খবরের বিষয় হতে পারে, সাহিত্যের অংশ এবং শুধু সংবাদ নয় তার জয়গান শুরু করলাম। ‘নগরে নিসর্গ’ ও ‘পথে পথে’— দুটি কলাম ছাপা হতে থাকে। সুন্দরবন থেকে তেঁতুলিয়া, থেগায় সেখানে কর্ণফুলী নদী প্রবেশ করেছে, চাকমা লোককবি চান্দবির ঘাট থেকে কুতুবদিয়া-টেকনাফ ঘুরে ঘুরে লিখছি। শিশু একাডেমি থেকে অবসর পাওয়ার পর বাংলাদেশ ঘোরাই আমার পেশা হয়ে গেল। এমনকি দৈনিক পত্রিকায়ও চাকরি নিলাম না। গল্প-উপন্যাসের সঙ্গে হাত ধরে চলল প্রকৃতি। কুড়িটির বেশি প্রকৃতি বিষয়ক বইয়ের দুর্দান্ত মালিক আমি। প্রকৃতিও চর্চার বিষয়। প্রকৃতি মানুষ ছাড়া খুব ভালো বাঁচতে পারে, কিন্তু মানুষ একটুও পারে না। এজন্যই কি মানুষ প্রকৃতির উপর এত হৃদয়হীন নিষ্ঠুর!

সারা বিশ্ব আমি দেখতে পারব না, সেই সংগতি আমার নেই। এই ব্যর্থতাও হয়তো দেশের আনাচ-কানাচের প্রকৃতি অন্বেষণের জন্য দায়ী।  বাংলাদেশে অরণ্য যে লুপ্ত হয়ে গেছে তাও এজন্য জানা হয়ে যায়। আমাদের বন, বনখণ্ড বা অরণ্যের ছাইপাশ আছে মাত্র।

 

প্রকৃতি বিষয়ক কুড়িটির অধিক বই লিখেছেন। কেন জানাবেন কি? আপনি কি মনে করেন এতে মানুষ প্রকৃতি সচেতন হয়েছেন?

আমি নিজেকে প্রকৃতির সন্তান মনে করি। আমাদের প্রিয় বাসভূমি পৃথিবী ও বিশ্বব্রহ্মাণ্ড বিশ্বপ্রকৃতির ছড়ানো জাল বলে আমি বিশ্বাস করি। এই জালের কোনো একটি সুতো ছিঁড়ে গেলে তা মানুষকেই বুনে নিতে হবে। কারণ পশুপাখি, গাছপালা বা ব্রহ্মাণ্ডের কোনো প্রাণী এই জাল ছিন্ন করে না, কাজেই তাদের দায়িত্বও নয় তা বুনে নেওয়ার। জীবনীশক্তির মূল ধাত্রী সূর্য। সূর্যের আলোককর্ণিকা তরুর মাধ্যমে শর্করা হয়ে আমাদের শরীরে এলে তবেই আমাদের বাঁচা। এর মধ্যে লুকিয়ে আছে সময় জীবজগতের প্রাণরহস্য। যে অক্সিজেন আমাদের শ্বাসের মাধ্যমে প্রয়োজন তারও জোগানদার ওই উদ্ভিদকুল। জীবন থেকে মৃত্যু পর্যন্ত অজস্র আচার-অনুষ্ঠানেও বৃক্ষই একমাত্র সম্বল। কোনো দিন বিজ্ঞান যদি বৃক্ষের উপর আমাদের নির্ভরতার অবসান ঘটাতে পারে তখনও বৃক্ষ থাকবে। বৃক্ষ সেদিন থাকবে সৌন্দর্যের আনন্দের, ভাবনা ও প্রশান্তির এবং মনের মুক্তির অনাবিল উৎস হয়ে।

বৃক্ষের সুষমা কোনো দিন শেষ হবে না। বৃক্ষের কোনো বিকল্প কোনো দিন পাওয়া সম্ভব নয়। এ জন্য শিল্পসাহিত্যে প্রাচীনকাল থেকে এত বৃক্ষবন্দনা, ফুল-পাখি-সমীরণ নিয়ে এত উৎসবের আয়োজন, ঋতু নিয়ে এত মাতামাতি। এ জন্য আমাদের পূর্বপুরুষেরা সেই সুপ্রাচীন কালে বলে গেছেন, ‘মানবজাতির মাতৃস্বরূপা হে তরু স্বাগত!’ প্রাচীন সেই কথাগুলো বর্তমানেও এত প্রয়োজনীয় যে তার জয়গান এখনো অপরিহার্য। এসব কথা আমার প্রকৃতি-বিষয়ক গ্রন্থে পুনর্কথিত হয়েছে নানা অনুষঙ্গে, সমকালের নিক্তিতে। আবার সৌন্দর্যের জয়গান গাওয়া নতুন করে, শিল্পকলা-সাহিত্য-সংগীত-সিনেমায় পাচ্ছে নব নব রূপ। আমি যতটুকু পারি অঞ্জলি ভরে পাঠিকা-পাঠকদের কাছে নিবেদন করে চলেছি। আমার এ চলা গল্প-উপন্যাসে, আমার চলা ফুলের ধারায়। প্রকৃতি সমগ্র প্রথম ও দ্ব্বিতীয় খণ্ড প্রকাশিত হয়েছে পার্ল পাবলিকেশন্স থেকে তৃতীয় ও চতুর্থ খণ্ডের প্রস্তুতি চলছে। এই যাত্রা আমার থামবার নয় বোধ করি।

 

আপনি গ্রহনক্ষত্র নিয়ে একটি বই লিখেছেন। জ্যোতির্বিজ্ঞানে আগ্রহ কী করে হলো।

১৯৬৭ সালে কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বোর্ড থেকে ‘তারা-পরিচিতি’ বই প্রকাশিত হয়। লেখক মোহাম্মদ আবদুল জব্বার। দাম মাত্র ১৬ টাকা। প্রাতঃস্মরণীয় এই গ্রন্থাকারের আর একটি আকর গ্রন্থ ‘প্রাচীন জ্যোতির্বিজ্ঞান’। ছেলেবেলায় মা-ঠাকুরমার কোলে বসে শুকতারার টিপ পরেছি। সাত ভাই চম্পার গল্প পড়েছি। বই দুটি আমাকে গল্প-উপন্যাসের মতো হাতে ধরে নিয়ে চলল বৃষ, মেষ, তুলা, কুম্ভ প্রভৃতির আকাশ-রাজ্যে।

ছাদে পাটি পেতে শুয়ে, টর্চ ও বইয়ের তারার ছবি দেখে আকাশের সঙ্গে মেলাতে শুরু করলাম। আমার দরকার তারাদের সঙ্গে সঙ্গে তাদের আক্রমণাত্মক আকর্ষণীয় কাহিনী। এর সঙ্গে ফরহাদ খানের ‘প্রতীচ্য পুরাণ’ বইয়ের কাহিনীজুড়ে আপন ভুবন সৃষ্টি করে নিলাম। গ্রিস-মিসর, আরব ও বাংলার কালপুরুষ নিয়ে কী সব আশ্চর্য সুন্দর কাহিনী। ২০১১ সালে অ্যাডর্ন পাবলিকেশন থেকে প্রকাশিত হলো ‘গ্রহ-নক্ষত্রের হাতছানি’।

শিশুদের  জন্য একটি উপন্যাস প্রকাশিত হলো ‘রাতের রেলগাড়িতে ছায়াপথে ভ্রমণ’। কল্পবিজ্ঞান ও আকাশ নিয়ে আরও বই আছে। পড়তে পড়তে চলে আসে গল্পের কাহিনী। স্বপ্নেও হানা দেয়। কল্পবিজ্ঞান নিয়ে সিনেমা তো আছেই। ‘কল্পবিজ্ঞান ও রহস্য গল্প’, ‘রোবট ও ফুল ফোটানোর রহস্য’ সব আমার আচাচারণের কাহিনী। গল্পও আছে। বিশ্বব্রহ্মাণ্ড প্রকৃতির অংশ, কোন সুদূরে সাত বোন কৃত্তিকা বা সেভেন সিসটার্স আছে, তারা একের অপরে বেশি সুন্দরী। ঊষা দেবী অনিন্দ্যসুন্দরী। বীর পারপিয়াস বা কালপুরুষ— ওদের আকর্ষণ আমি অবহেলা করি কী করে! এজন্যই গল্পের সৃষ্টি, শিল্প-সাহিত্যের উদ্ভব। আমি ডুবে থাকি।

 

বঙ্গোপসাগর নিয়ে আপনার অনেক গল্প ও একটি বিখ্যাত উপন্যাস আছে। বাংলা সাহিত্যে অবহেলিত বঙ্গোপসাগরকে এত মায়া কেন!

আমার বাড়ি থেকে কর্ণফুলী হয়ে ৩০ মাইল দূরে বঙ্গোপসাগর। ছেলেবেলা থেকে জোয়ার-ভাটা, ঝড়-জলোচ্ছ্বাস ও মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে না দেখা বঙ্গোপসাগরকে চিনি। বড় হয়ে জেলে নৌকোয় করে জেলেদের সঙ্গে পাতা জাল থেকে মাছ আনতে গেছি। গাঙচিলের গূহ্য কথা শিখিয়েছে জেলে মনীন্দ্র ও তার ভাই চন্অ বাঁশি।

বঙ্গোপসাগর আমাকে কতভাবেই না উজাড় করে দেয়। স্বপ্ন দেখায়। ১৯৮৯ সালের গোড়ায় বঙ্গোপসাগর আমাকে দুটি ছোট উপন্যাস রচনায় উসকানি দেয়। ১৯৯৭ সালে প্রকাশিত হয় ‘আমি তোমার কাছে সমুদ্রের একটি ঢেউ জমা রেখেছি’। আরেকটি গল্প-বইয়ের নাম ‘স্বপ্ন সমুদ্রে বনদেবীরা আছে’। অন্যটির নাম ‘বঙ্গোপসাগর আমার শত্রু’। ১৯৮৯ সালে লেখা শুরু করি ‘সমুদ্রচর ও বিদ্রোহীরা’, ১৯৯৯ সালে তিন পর্বে একত্রে প্রকাশিত। বাংলা সাহিত্যে একেবারেই নতুন। এমনিতেও বাংলা সাহিত্যে সমুদ্র গল্প-উপন্যাস-কবিতা খুব কম। কেন? বাঙালি কি সমুদ্রভীড় বা সমুদ্রবিদ্বেষী।

১৯৭৬ সালে ‘সমুদ্র সওয়ার’, তারপর ‘সমুদ্র সম্ভোগ’ থেকে ‘মৃত মানুষের ডায়েরী থেকে’ বা ‘১৯৭০ ঝড়ের আগে’। আমার চার শতাধিক গল্পের সিংহভাগ সমুদ্র তীরবর্তী মানুষের কাহিনীতে ভরপুর। সুযোগ পেলেই স্টিমার ও লঞ্চে করে কুতুবদিয়া, হাতিয়া বা কক্সবাজার, মহেশখালী, সুন্দরবন চলে গেছি। গল্পের নামের হিসাব দেওয়া কঠিন। আমার গল্পের সর্বশেষ ভঙ্গি ‘আমি গল্প’ এখানে দল মেলেছে। সেখানেও দরিয়া।

 

আদিবাসীদের নিয়ে গল্প-উপন্যাস এত নগণ্য কেন? আপনি কী করছেন।

হ্যাঁ, বেদনাদায়ক কম। গুন্টার গ্রাস বাংলাদেশে এসে এ নিয়ে আক্ষেপ করেছেন তাও আমরা দৈনিক পত্রিকায় তার মুখে শুনেছি। উপন্যাস-গল্প কোথাও সগৌরবে তাদের উপস্থিতি নেই। আদিবাসীরা এখন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী হয়ে গেছেন। তেমনি খ্রিস্টানদের জনজীবনও উঠে আসেনি সাহিত্যে। বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর এই অনীহা কাম্য হওয়া উচিত হতে পারে না। সাহিত্যে চাকমা, মারমা, মুরং, মনিপুরী বা গারো, হাজংরা কোথায়!

আমার ছয়টি উপন্যাস নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদি জনগোষ্ঠীর একটি সংকলন খাগড়াছড়ি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ইনস্টিটিউট থেকে প্রকাশিত হতে যাচ্ছে। একটি গল্প সংকলনের পাণ্ডুলিপিও তৈয়ার করছি।

 

সুন্দরবন কি ধ্বংস হয়ে যাবে?

সুন্দরবনের প্রতি আমাদের ভালোবাসা মুখেই সীমাবদ্ধ। অরণ্য বলতে আমাদের অবশিষ্ট আছে সুন্দরবন। পার্বত্য চট্টগ্রামে আমি অরণ্য খুঁজে পাইনি, বনখণ্ড আছে। কাচলং, মাচলং বা কোথাও সংরক্ষিত অরণ্য আমি পাইনি, আছে ঝোঁপঝাড়। একমাত্র পরিত্রাতা প্রেম সুন্দরবন। তাও কয়লাচালিত বিদ্যুৎ উৎপাদন হলে আস্তে আস্তে সুন্দরবন স্বপ্ন হয়ে যাবে। সর্বোচ্চ বা সবরকম সতর্কতা কি নদী-নালা-বন ঘেরা অঞ্চলে সম্ভব! আমরা নিশ্চিত হতে পারছি না। বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলকে সুরক্ষা দিয়ে রেখেছে সুন্দরবন, তাকে এই একটি কাজই করতে দেওয়া উচিত কর্ম হওয়া জরুরি প্রয়োজন।

 

আপনার পরিবারের কথা জানতে চাই।

১৯৭৪ সালে সত্যিই প্রেমে পড়ি রুবী বড়ুয়ার। সে কলকাতা থেকে চট্টগ্রামে বেড়াতে এলো। তখন কলেজে পড়ে। প্রথম দেখাতেই কুপোকাত। ওর মা-বাবা সঙ্গে এসেছিলেন, এক মাস থেকে তারা চলে গেলেন। আসলে আমাদের একই গ্রাম। ওর বাবাকে চিনি, কিন্তু ও থাকে কলকাতায়, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বে এমএ পড়ে। বাবার ব্রিটিশ সরকারের চাকরিসূত্রে ওখানে গিয়ে ওরা থেকে গেল। ১৯৭৭ সালে বিয়ে করে ফেললাম। বউ ভাবল, চলে যাওয়াই ভালো। ওখানে সে লেখাপড়া করে। ভাবলাম, থাকুক কলকাতায়, অসুবিধা কী? দুনিয়া তো অন্য রকম হয়ে গেছে। রুবী শিক্ষকতা করত, এখন করে না, ৬০ বছর হয়ে গেছে। আগে খ্রিস্টান স্কুলে পড়াত। যারা ফাদার হন, তাদের বাংলা শেখাত। কলকাতায় ঠাকুর পুকুরের পরে জেসুইট মিশনারি স্কুলে বহু বছর কাজ করেছে। আমাদের দুই সন্তান। মেঘনা বড়ুয়া বড় আর তূর্য বড়ুয়া ছোট। মেঘনা এমএসসি পাস করে পশ্চিমবঙ্গে চাকরি করে। ছেলে ইলেকট্রনিকস অ্যান্ড টেলিকমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ার। দেশের বাইরে বিভিন্ন জায়গায় কাজ করেছে। তারপর চলে এসেছে। বলে, বিদেশে থাকব না।

 

সাম্প্রতিক সময়ে কি লিখছেন।

অনুস্মৃতি! ফেলে আসা জীবনের মধুর স্মৃতি ‘জোনাকির ঝিকিমিকি’ নামের গ্রন্থে ধরার চেষ্টা করছি। আর আমার গল্পের সঙ্গে বহু দূর যাওয়ার অভিলাষী। ভবিষ্যৎ বংশদরের কাছে সুন্দরবন ও আমাকে সমর্পণ করতে চাই।

সর্বশেষ খবর