শুক্রবার, ২৮ এপ্রিল, ২০১৭ ০০:০০ টা

রবীন্দ্রনাথের শ্বশুরবাড়ি দক্ষিণডিহি

বিধান দাশগুপ্ত

রবীন্দ্রনাথের শ্বশুরবাড়ি দক্ষিণডিহি

ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের বুড়ি ছুঁয়ে যে শীর্ণকায় রাস্তাটি কদমছাঁট ধান খেতের ভিতর ঢুকে গেছে তার দূরত্ব এক থেকে দেড় কিলোমিটার। রাস্তার দুই পাশে দেবদারু, সেগুন, শিরিশ, মেহগনি সবুজ গাছের সারি। মাথা নুয়ে হয়তো প্রথমে ওরাই আপনাকে অভিনন্দন জানাবে। শূন্য প্রান্তরে গড়ে উঠেছে কিছু বসতবাড়ি। এসব কিছুকে পেছনে ফেলে সর্পিল রাস্তায় কিছুটা এগিয়ে গেলে জমিদারবাড়ির বিশাল প্রাঙ্গণ। দক্ষিণডিহির রায়চৌধুরীদের এই বাড়িটি সারা বিশ্বের সংস্কৃতিসেবীদের কাছে ‘দক্ষিণডিহি রবীন্দ্র  কমপ্লেক্স’ নামে স্বীকৃতি পেয়েছে। ব্রিটিশ-শাসিত ভারতে যশোর ছিল একটি সমৃদ্ধ মহকুমা। শিল্প, সাহিত্য, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষাদীক্ষায় তখন যশোরের বেশ সমৃদ্ধি; এ মহকুমার শেষপ্রান্তে এখন খুলনা জেলার অধীন ফুলতলা তখনো একটি উন্নত জনপদ। উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা, সড়ক ও রেলপথ, সঙ্গে নদীসভ্যতা ফুলতলার বিকাশকে আলাদাভাবে সহায়তা দিয়েছে। ফুলতলাকে খুলনার ‘প্রবেশদ্বার’ কিংবা একটু বাড়িয়ে বললে ‘সিংহদুয়ার’ও বলা যায়। ফুলতলা উপজেলার একটি ‘ছায়া ঢাকা, পাখি ডাকা’ নিবিড় গ্রাম দক্ষিণডিহি। দক্ষিণডিহি আজ সারা বিশ্বের বাংলা ভাষাভাষীদের কাছেও পরিচিত, বিখ্যাত। এই দক্ষিণডিহি গ্রামের রায়চৌধুরীদের বাড়িটিই বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের শ্বশুরবাড়ি। ১২৯০ বঙ্গাব্দের ২৪ অগ্রহায়ণ বেণীমাধব রায়চৌধুরী ও দাক্ষায়ণী দেবীর একমাত্র কন্যা ভবতারিণী ওরফে ‘ফুলি’র সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের বিয়ে অনুষ্ঠিত হয়। বিয়ের পর ঠাকুরবাড়ির প্রথানুযায়ী ভবতারিণীর নাম হয় ‘মৃণালিনী’। রবীন্দ্রনাথের পূর্বপুরুষ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের স্ত্রী দিগম্বরীদেবী দক্ষিণডিহির পিরালী বংশের কন্যা। রবীন্দ্রনাথের পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরও বিয়ে করেন দক্ষিণডিহির রামনারায়ণ রায়চৌধুরীর কন্যা সারদাদেবীকে। রবীন্দ্রনাথের আদিপুরুষ জগন্নাথ কুশারী ষোলো শতকের গোড়ার দিকে খুলনার পিঠাভোগ ছেড়ে এসে দক্ষিণডিহির জমিদার দক্ষিণানাথ রায় চৌধুরীর পুত্র শুকদেব রায়চৌধুরীর কন্যা সুন্দরীদেবীকে বিয়ে করে এই দক্ষিণডিহিতে বসতি স্থাপন করেন। এবং তারা বংশপরম্পরায় প্রায় দুই শত বছর এই দক্ষিণডিহির স্থায়ী বাসিন্দা ছিলেন। লেখাবাহুল্য, এই দক্ষিণানাথের নামানুসারে এলাকাটির নাম দক্ষিণডিহি। অতঃপর জগন্নাথ কুশারীর অধস্তন পঞ্চমপুরুষ পঞ্চানন কুশারী দক্ষিণডিহি ত্যাগ করে কলকাতার উপকণ্ঠে গোবিন্দপুরের আদিগঙ্গার পাড়ে জেলেদের চৌহদ্দির মধ্যে বসবাস শুরু করেন। পঞ্চানন কুশারী কলকাতায় আসেন মূলত অর্থের সন্ধানে। সেই সময়ে কলকাতা ক্রমেই সমৃদ্ধির পথে। পর্তুগিজ, ওলন্দাজ প্রভৃতি বিদেশি বণিক আগমনে তখন রমরম করছে কলকাতা। পঞ্চাননের আসল উদ্দেশ্য, যেসব বিদেশি জাহাজ গোবিন্দপুরে আসে তাদের মালামাল সরবরাহ করে সাহেবদের সঙ্গে ব্যবসা করা। তিনি এই ব্যবসায় অচিরেই বেশ অর্থ উপার্জন করেন। এবং গঙ্গার ধারে জমি কিনে বাড়ি নির্মাণ ও একটি শিবমন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। মন্দির প্রতিষ্ঠা করায় জেলে-মালো-কৈবর্তরা তাকে ‘ঠাকুরমশাই’ বলে ডাকত। ক্রমে ক্রমে কুশারীদের এই শাখাটি ‘ঠাকুর’ পদবিতে পরিণত হয়। পঞ্চানন কুশারীর পৌত্র নীলমণি ঠাকুর জীবনের প্রান্ত-সীমায় এসে ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দে রবীন্দ্রনাথের জন্মের ঠিক সাতাত্তর বছর আগে জোড়াসাঁকোয় বাড়ি নির্মাণ করেন। এই নীলমণি ঠাকুর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পূর্বপুরুষ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের পিতামহ। দেশত্যাগ করলেও বিয়ের কাজসহ অন্যান্য পারিবারিক কারণে ঠাকুরপরিবারকে বারবার দক্ষিণডিহিতে আসতে হয়েছে। শিকড় এখানেই। রবীন্দ্রনাথের পূর্বপুরুষরা পিরালী ব্রাহ্মণ হওয়ায় অন্য শ্রেণির লোকেরা তাদের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করতে চাননি। কিন্তু শিক্ষা, অর্থবিত্ত আর ক্ষমতার জোরে ঠাকুররা নিজেদের মতো চলতে পারতেন। আবার রবীন্দ্রনাথের পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর মানবতাবাদী নিরাকার ব্রাহ্মধর্মের অনুসারী হওয়ায় পিরালীরাও তাদের এড়িয়ে চলতেন। ঠাকুরপরিবার তাই নিজেদের মধ্যে এমনকি নিকটাত্মীয়দের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনে বাধ্য হন। এ ছাড়া এককালে দক্ষিণডিহি সুন্দরী ও গুণবতী নারীদের জন্য বিখ্যাত ছিল। ঠাকুরপরিবারের প্রায় সবার জন্য কন্যা এসেছিল দক্ষিণডিহি এবং তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চল থেকে।

দক্ষিণডিহির মৃণালিনী নানাভাবে রবীন্দ্রনাথের গল্প, উপন্যাস, কাব্যকলা এমনকি রবীন্দ্রচিত্রকলাকেও প্রভাবিত করেছেন। কবি প্রথম দেখায় নিজেই পছন্দ করেন ফুলিকে। ‘যে দেখায় সে আমার চোখ ভুলিয়েছে/তাতে আছে যেন এই মাটির শ্যামল অঞ্জন...।’ তিনি কিশোরী বধূর উদ্দেশ্যে কবি লিখেছেন, ‘এই তনুখানি তব আমি ভালবাসি,/এ প্রাণ তোমার দেহে হয়েছে উদাসী।’ বিবাহিত জীবনে মৃণালিনী ক্রমেই হয়ে ওঠেন সংস্কৃতিমনা, সাহিত্যরসিক ও কবির যোগ্য সহচরী। উনিশ বছরের বিবাহিত জীবনে মৃণালিনী শুধু ঠাকুরপরিবারের বধূ হিসেবে নয়, একজন কবির আদর্শ স্ত্রী হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলেছেন। ঊনত্রিশ বছর বয়সে ১৯০২ খ্রিস্টাব্দের ২৩ নভেম্বর মৃণালিনীদেবীর মৃত্যু হয়।

রবীন্দ্রনাথের শ্বশুর বেণীমাধব রায়চৌধুরী দেশবিভাগের বহু আগে থেকেই কলকাতায় বসবাস শুরু করেন। বেণীমাধবের একমাত্র পুত্র নগেন্দ্রনাথ ওরফে ফেলুবাবু জমিদারি দেখার জন্য মাঝেমধ্যে দক্ষিণডিহিতে আসতেন। ফেলুবাবুর ছেলেরা কেউ তখন দক্ষিণডিহি, কেউ কলকাতার বাসিন্দা। ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে শেষবারের মতো পরিবারের সবাই দেশত্যাগ করেন। দেশভাগের পর বাড়িসহ জমাজমি অরক্ষিত হয়ে পড়ে। এই সুযোগে রুস্তম ও হারেজ বিশ্বাসগং স্থানীয় কিছু মতলববাজ প্রভাবশালীদের সহযোগিতায় এ বাড়িটি অবৈধভাবে দখল করে রাখে। ইতিহাসখ্যাত বেহাত হয়ে যাওয়া এ বাড়িটি প্রায় ৫০ বছর পর ১৪ নভেম্বর ১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দ জনদাবির ভিত্তিতে উদ্ধার করা হয়। রবীন্দ্র স্মৃতিধন্য বেণীমাধব রায়চৌধুরীর বাড়িসহ মোট ৭ একর ৮ শতক জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে দক্ষিণডিহি রবীন্দ্র কমপ্লেক্স।

গাছগাছালির ঘেরাটোপে বন্দী পুরনো দোতলা বাড়ি। বাড়ির থামগুলো বেশ চৌকস। প্রাচ্যরীতির কারুকাজ। উপযুক্ত রক্ষণাবেক্ষণের অভাব থাকলেও কবির জন্মবার্ষিকী উদ্যাপন উপলক্ষে সংস্কার কাজ অনেক দূর এগিয়েছে। বাড়ির দুই পাশে স্থাপিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথ ও মৃণালিনীদেবীর আবক্ষ মূর্তি।

১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দের ১৮ নভেম্বর বৃহস্পতিবার দক্ষিণডিহি রবীন্দ্র  কমপ্লেক্স গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের স্বীকৃতি অর্জন করে। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রকাশিত বিভিন্ন পোস্টার, ব্যানার ফেস্টুন, স্মারক ও প্রচারপত্রে দক্ষিণডিহির নাম সংযুক্ত হয়। স্থানীয় সাংবাদিক, সংস্কৃতিসেবী ও সুশীল মানুষের সহযোগিতায় একটি সুস্থ সংস্কৃতিচর্চা কেন্দ্র হিসেবে পরিকল্পনা মাফিক ধীরে ধীরে গড়ে উঠছে দক্ষিণডিহি রবীন্দ্র কমপ্লেক্স।

দক্ষিণডিহি রবীন্দ্র, সাহিত্যকর্ম, অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক চেতনা বিকাশে জন্মলগ্ন থেকে কাজ করে যাচ্ছে। প্রতিবছর কবির জন্মবার্ষিকী উদ্যাপন উপলক্ষে লোকমেলা, আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। প্রতিবেশী ও দেশের বরেণ্য শিল্পী সাহিত্যিক কবি গবেষকবৃন্দ এসব অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হন। জন্মবার্ষিকী ছাড়াও কর্তৃপক্ষ কবির মৃত্যুবার্ষিকী ও বিবাহবার্ষিকী উদ্যাপন করে থাকে। এসব অনুষ্ঠানে সব মানুষের এক অলিখিত নিমন্ত্রণ রাখা আছে।

সর্বশেষ খবর