শিরোনাম
শুক্রবার, ১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা
অমর একুশে গ্রন্থমেলা

কিছু স্মৃতি কিছু কথা

সেলিনা হোসেন

কিছু স্মৃতি কিছু কথা

আমি বাংলা একাডেমিতে ১৯৭০ সালের ২ জুলাই গবেষণা সহকারী হিসেবে যোগদান করি। ৩৪ বছর চাকরি করে ২০০৪ সালে অবসর গ্রহণ করি। দীর্ঘ সময় ধরে বাংলা একাডেমি বইমেলা প্রতিদিন দেখার সুযোগ আমার হয়েছিল। নিজের লেখালেখির সূত্র ধরে ভেবেছিলাম এই মেলা আমার অস্তিত্বের মেলা। পরে দেখলাম লেখক-পাঠক নির্বিশেষে বাংলা একাডেমির বইমেলা অগণিত মানুষের প্রাণের মেলা হয়েছে। আমার ৩৪ বছরের চাকরি জীবনের এ আবহ আমার কাছে এখন পর্যন্ত খুবই অনুপ্রেরণার উৎস। মেলাকে কেন্দ্র করে বই প্রকাশ করার এমন গভীর আনন্দ পৃথিবীর আর কোথায় পাব!

সালটা মনে নেই, মনে আছে কোনো এক সময় ‘মুক্তধারা’র স্বত্বাধিকারী চিত্তরঞ্জন সাহা ব্যক্তিগত উদ্যোগে নিজের বইয়ের পসরা বসিয়েছিলেন বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে। ঘাসের ওপর চট বিছিয়ে রেখে দেওয়া বইগুলো ফুলের মতো ফুটেছিল। পাঠক উবু হয়ে বসে বই দেখছিলেন। মনে হচ্ছিল এ এক অন্য জগৎ। এই মেলাকে আস্তে আস্তে বড় হতে দেখেছি। স্টল তৈরি হতে দেখেছি। ছোট পরিসরে মেলার আয়োজন দেখেছি। এসব সত্তর দশকের কথা। মানুষের ভিড় কম ছিল। স্টলের সংখ্যা কম ছিল। ঘুরে ঘুরে বই দেখার আনন্দ ছিল বেশি। বই খুঁজতে ঠেলাঠেলি করতে হয়নি। অনায়াসে পেয়ে যেতাম নিজের পছন্দের বই।

আশির দশকে মেলার বড় পরিবর্তন হয়। ১৯৮৪ সালে বইমেলার আনুষ্ঠানিক নাম রাখা হয় ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’। এ বছর একাডেমি প্রাঙ্গণের বিভিন্ন জায়গায় মাটি ফেলে ভরাট করে মেলার আয়তন বাড়ানো হয়। মাটি ফেলা হয় পুকুরের পশ্চিমপাড়ে। ভরাট করা হয় বর্ধমান ভবনের উত্তর ও ক্যাফেটেরিয়া ভবনের দক্ষিণ দিক। আশির দশকে এটি একটি দিক ছিল যে মেলার আয়তন বাড়ানো। আর একটি দিক ছিল এই বছরে মেলার দিনও বাড়ানো হয়। ৭ ফেব্র“য়ারি থেকে ২৮ ফেব্র“য়ারি পর্যন্ত। আগে একুশে বইমেলার সময় ছিল মাত্র কয়েক দিন। এ সময়ের বইমেলা উদ্বোধন করতেন দেশের বরেণ্য কেউ। মেলার এমন পরিবেশে বিশ্বাস করতাম বইমেলা মানুষের সাংস্কৃতিক চেতনাকে পরিশীলিত করে। তথ্যপ্রযুক্তির এই সময়েও বলতে চাই বইয়ের বিকল্প নেই। বড় করে শ্বাস নিলে একুশের চেতনায় প্লাবিত হয়ে থাকা মেলা প্রাঙ্গণ জাতির ঐতিহ্যের সমৃদ্ধ জায়গা। নব্বই দশকে বইমেলা আরও বড় হয়। বইমেলা উদ্বোধন করতে আসেন দেশের প্রধানমন্ত্রী। এখন পর্যন্ত এই ধারা অব্যাহত রয়েছে। এ অনুষ্ঠান বিভিন্ন চ্যানেলে সরাসরি প্রচারের ব্যবস্থা করার ফলে দেশের দূর অঞ্চলের মানুষ দেখতে পাচ্ছে। প্রতিদিন বইমেলার খবর প্রচারিত হয় দৈনিক পত্রিকা ও ইলেকট্রনিক চ্যানেলে। এভাবে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ের নানা কর্মকাণ্ড একুশের বইমেলাকে সম্প্রসারিত করেছে।

অমর একুশে বইমেলা অনুষ্ঠিত হয় আমাদের ভাষার মাস ফেব্রুয়ারিতে। এটা যেমন মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় জীবনদানকারী মাস, তেমনি বইমেলা আয়োজন করে জাতির দর্শনের জায়গা প্রতিষ্ঠা করার মাস। এই বইমেলা সেই অর্থে ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় জনগোষ্ঠীকে উজ্জীবিত করার মেলা। আমি মনে করি, এ বইমেলা কেবল বাঙালির মেলা নয় বরং আমাদের দেশে অনেক নৃ-জাতিসত্তা আছে তাদেরও মেলা। কিন্তু বইমেলায় তাদের উপস্থিতি টের পাওয়া যায় না। তবে তাদের মাতৃভাষায় বই প্রকাশ করা বাংলা একাডেমিসহ অন্য প্রকাশকদেরও দায়িত্ব। আমি আশা করছি, আগামীতে নৃ-জাতিসত্তাদের জন্য একটি বিশেষ কর্নার তৈরি করা হবে। এ ব্যাপারে বাংলা একাডেমিকে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণের অনুরোধ জানাচ্ছি।

বইমেলাকে কেন্দ্র করে তিনটি স্মৃতি আমার আমৃত্যু মনে থাকবে। ১৯৭১ সালের একুশে ফেব্র“য়ারি অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু বাংলা একাডেমিতে এসেছিলেন। সেই প্রথম আমি তাঁকে দেখি। অবশ্যই দূরে দাঁড়িয়ে। তাঁর বজ্রকণ্ঠের ভাষণে মুগ্ধ হয়েছিলাম। ১৯৭৪ সালে বাংলা একাডেমি আয়োজন করেছিল আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলন। সেই উৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু এসেছিলেন।

বইমেলাকে কেন্দ্র করে আর একটি স্মৃতি আমার কাছে খুব উল্লেখযোগ্য। ১৯৮০ সালের বইমেলায় ঘুরছি। পড়ন্ত বিকাল। মেলার তিন নম্বর গেটের কাছের একটি দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। অপরদিক থেকে অধ্যাপক মনসুর মুসা এগিয়ে এসে বললেন, আপনার জন্য একটি সুখবর আছে। সুখবর! আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি। অধ্যাপক মনসুর মুসা তখন বাংলা একাডেমি কার্যনির্বাহী পরিষদের সদস্য ছিলেন। সেই বিকালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার কমিটির সভা ছিল। যেহেতু ফলাফল আগেই বলে দেওয়ার নিয়ম ছিল না তাই তিনি আমাকে একপাশে ডেকে নিচু স্বরে বললেন, এই বছরে উপন্যাসের জন্য বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার আপনি পেয়েছেন। আমি খুশিতে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠি। বইমেলা প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে বাংলা একাডেমি প্রদত্ত সম্মানজনক সাহিত্য পুরস্কার পাওয়ার খবর এখনো আমাকে আনন্দে আপ্লুত করে।

এখনো ভাবী এর চেয়ে গৌরবজনক স্মৃতি একজন লেখকের জীবনে আর কী হতে পারে!

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর