শুক্রবার, ৫ এপ্রিল, ২০১৯ ০০:০০ টা

মুসলিম উদ্ভাবিত অপরিহার্য যত জিনিস

তানিয়া তুষ্টি

মুসলিম উদ্ভাবিত অপরিহার্য যত জিনিস

বীজগণিত

অ্যালজেবরা শব্দটি আসে বিখ্যাত পার্সিয়ান গণিতবিদ আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে মুসা আল খারিজমি লিখিত ‘কিতাব আল জাবর ওয়াল মুগাবালা’ থেকে। নবম শতকে বইটি ‘দ্য বুক অব রিজনিং অ্যান্ড ব্যালান্সিং নামে ইংরেজিতে অনুবাদ হয়। খারিজমি মূলত এই বইয়ের মাধ্যমে অ্যালজেবরা শব্দটিকে পরিচিত করেন। এই বই থেকে জানা যায়, খারিজমি ছিলেন একনিষ্ঠ মুসলিম। মধ্য এশিয়ার দীর্ঘতম এবং আরব সাগরে পতিত আমু দরিয়ার কাছে একটি দ্বীপের কাছে খাওয়ারিজম নামক শহরে আনুমানিক ৭৮০ খ্রিস্টাব্দে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। বীজগণিত ছাড়াও তিনি পাটীগণিত, বীজগণিত, ভূগোল, জ্যোতির্বিজ্ঞান, জ্যামিতিতে ভূমিকা রাখেন। মূলত বীজগণিতের জন্যই তিনি সবচেয়ে আলোচিত হন, তাকে ধরা হয় বীজগণিতের জনক। বইটি থেকে আরও জানা যায়, খলিফা মামুনের বিশাল লাইব্রেরিতে আল খারিজমি চাকরি করতেন। এখানেই সম্ভবত তিনি বিজ্ঞানের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। বর্তমান যুগ পর্যন্ত গণিতবিদ্যায় যে উন্নয়ন এবং এর সহায়তায় বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় যে উন্নতি ও আবিষ্কার সম্ভব হয়েছে তার মূলে রয়েছে আল খারিজমির উদ্ভাবিত গণিতবিষয়ক নীতিমালারই বেশি অবদান।

 

শল্যচিকিৎসার বিভিন্ন যন্ত্র

গুলিবিদ্ধ রোগী, দুর্ঘটনায় হাত-পা ভাঙা অথবা শরীরের অভ্যন্তরে থাকা ফেটে যাওয়ার উপক্রম টিউমারটি এখনই অপারেশন দরকার। কিন্তু ভাবুন তো, অপারেশন থিয়েটারে কোনো যন্ত্রপাতিই নেই। তাহলে কী শুধু ওষুধের ওপর নির্ভর করবেন নাকি চোখের সামনে প্রিয়জনের ধুঁকে ধুঁকে মরতে দেখবেন? এভাবে নিশ্চয়ই আমরা ভাবতে পারি না, অবশ্য ভাবার দরকারও নেই। জীবন বাঁচাতে অস্ত্রোপচারের যন্ত্রপাতির মতো অপরিহার্য যন্ত্রের উদ্ভাবন হয়েছে দশম শতকেই। চিকিৎসাবিজ্ঞানকে এগিয়ে নিতে এই গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভাবন করেছেন একজন মুসলিম শল্যচিকিৎসক। তিনি আবুল কাসিম খালাফ ইবনে আল আব্বাস আল জাহরাউয়ি (৯৩৬-১০১৩)। পাশ্চাত্যে তিনি আবুল কাসিম নামে পরিচিত। তিনি সূচনা করেন অস্ত্রোপচার যুগের। তার রচিত ৩০ খণ্ডের চিকিৎসা বিশ্বকোষ ‘আল-তাদরিফ’ এর একটি খণ্ড লিখেছেন ‘অস্ত্রোপচার’ নামে। তাকে মধ্যযুগের মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে মহৎ শল্যবিদ এবং আধুনিক শল্যচিকিৎসার জনক বলে গণ্য করা হয়। তার অবদান প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যে আধুনিক চিকিৎসায়ও প্রভাব ফেলেছে।

 

ফ্লাইং মেশিন

আজকের দিনে দূরযাত্রার সহজ সমাধান উড়োজাহাজ। কিন্তু এখনকার উড়োজাহাজ আর শুরুর গল্পটি মোটেও এক ছিল না। সর্বপ্রথম আকাশে ওড়ার জন্য পাখির ডানার মতো একটি যন্ত্র উদ্ভাবন করা হয়। ফ্লাইং মেশিনটির উদ্ভাবক আব্বাস ইবনে ফিরনাস। নবম শতাব্দীতে তিনি স্পেনের কাছে করডোবার একটি মসজিদের মিনার থেকে যন্ত্রটি ধরে লাফ দেন। কয়েক মুহূর্তের জন্য উড়তে সক্ষমও হন। ইবনে ফিরনাস এই ঘটনার পর উড্ডয়ন যন্ত্রটিকে উন্নয়নে মনোযোগ দেন। দীর্ঘ ২৩ বছর পর আবারও তিনি আকাশে ওড়ার প্রচেষ্টা চালান। এটি অনস্বীকার্য যে, ৬০০ বছর পর আব্বাস ইবনে ফিরনাসের উদ্ভাবিত উড্ডয়ন যন্ত্র থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ইতালিয়ান আর্টিস্ট লিওনার্দো দা ভিঞ্চি আঁকেন উড্ডয়ন যন্ত্র অর্নিথপটার। আব্বাস ইবনে ফিরনাসের পুরো নাম আব্বাস আবু আলকাসিম ইবনে ফিরনাস ইবনে ইরদাস আল তাকুরিনি। তার জন্ম ৮১০ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন মুসলিম জ্ঞানচর্চার অন্যতম কেন্দ্র স্পেনের রোনদায়। তবে জ্ঞান অšে¦ষণে করবোডায় ছিলেন বহু বছর। তিনি ছিলেন একাধারে প্রকৌশলী, উদ্ভাবক, উড্ডয়ন বিশারদ, চিকিৎসক, কবি, সুরকার, পদার্থবিদ, সংগীতজ্ঞ ও জ্যোতির্বিজ্ঞানী।

 

প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়

মরক্কোর ফেজ নগরীতে গড়ে উঠা পৃথিবীর সর্বপ্রথম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মুসলিম নারী ফাতিমা আল-ফিহরির নামটি ইতিহাসের পাতায় অবস্থান করছে। তিনি উচ্চশিক্ষার অগ্রপথিক হিসেবে এমন একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেন। ঐতিহাসিকদের মতে এটি বিশ্বের প্রাচীনতম সনদ বিতরণকারী বিশ্ববিদ্যালয়, যা এখনো কাজ করছে। ফাতিমা স্বয়ং নির্মাণকাজের তদারকি করেছিলেন এবং নির্মাণ প্রক্রিয়ায় দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন। অভিজাত পরিবার তিউনিসিয়ার কাইরুয়ান থেকে তার পরিবার মরক্কোর এই নগরীতে চলে আসেন। নবম শতকের প্রথমভাগে অনেক পরিবারই পশ্চিমের এই ব্যস্ত নগরীর অভিবাসী হতে চাইতেন। ফেজ ছিল মুসলিম-পশ্চিম তথা আল-মাগরেবের অন্যতম কর্মব্যস্ত রাজধানী। সম্ভাবনাময় একটি নগরী যা মানুষের মনে সৌভাগ্যের ধারণা ও পরম সুখের প্রতিশ্রুতি দিত। প্রভাবশালী এই ইসলামী নগরীতে ঐতিহ্যবাহী ও বিশ্বজনীন- উভয় ধরনের ধর্ম ও সংস্কৃতির সমাবেশ হয়েছিল।

 

দিকনির্ণয় যন্ত্র ও মানচিত্র

জ্ঞান-বিজ্ঞানের অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো তারা দিকনির্ণয় যন্ত্র উদ্ভাবন এবং নদ-নদী ও সাগর-মহাসাগরের মানচিত্র তৈরিতে অবদান রাখেন। মানচিত্র জগতে মুসলমানদের অবদানের কথা উল্লেখ করতে গেলে সর্বপ্রথম স্মরণ করতে হয় আল ইদ্রিসের নাম। সপ্তম শতকে স্পেনে জন্মগ্রহণকারী এই মনীষী সমসাময়িক পৃথিবী সম্পর্কে ব্যাপক জ্ঞান অর্জন করেছিলেন। তার রচিত ‘আল রজারি’ ভূচিত্রাবলী এতই প্রসিদ্ধ লাভ করেছিল যে, সমগ্র ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকা তার মানচিত্রকে ওয়ালম্যাপ হিসেবে ব্যবহার করত। মানচিত্র অঙ্কনের পাশাপাশি দিকনির্ণয় যন্ত্র উদ্ভাবনেও মুসলমানরা অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করেছিলেন। ‘ম্যাগনেটিক নিডল’ও সর্বপ্রথম উদ্ভাবন করেন আরবরা। তারা সমুদ্রে নৌ-চলাচলের ক্ষেত্রে এর ব্যবহার করতেন। মুসলমানদের বিনা অনুমতিতে অন্য কোনো জাতির যুদ্ধজাহাজ তখন ভূমধ্যসাগরে প্রবেশ করতে পারত না।

 

ক্যামেরা

স্থিরচিত্র বা চলচ্চিত্র- সবখানেই ক্যামেরার কত শত কেরামতি। মোবাইলের কল্যাণে সবার হাতে হাতে পৌঁছে গেছে ক্যামেরা। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে একটি ক্যামেরার গুরুত্ব কতখানি তা সবাই কমবেশি বুঝি। এই অপরিহার্য যন্ত্র ক্যামেরার উদ্ভাবকও হয়েছে মুসলিম আলোকবিজ্ঞানের জনক ইবনে আল হাইথামের হাতে। তিনি ৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে ইরাকের বসরা নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন। ইবনে আল হাইথাম ছিলেন একজন ধর্মপ্রাণ মুসলিম। পদার্থবিজ্ঞানের ওপর প্রভাবের ক্ষেত্রে ইবনে আল হাইথাম রচিত ‘কিতাব আল মানাজির’ অর্থাৎ ‘বুক অব অপটিকস’কে নিউটনের প্রিন্সিপিয়া ম্যাথমেটিকার সমকক্ষ ধরা হয়। তিনি আলোকরশ্মির সরল পথে গমনের বিষয়টি পরীক্ষা করেন এবং প্রমাণ করেন। হাইথাম আলোকবিজ্ঞানের ওপর ‘রিসালা ফিল দাও’ বা ‘ট্রিটিজ অব লাইট’ রচনা করেন। সেখানে তিনি আলোর প্রতিসরণ, বিচ্ছুরণ, গ্রহণ, রংধনু, অধিবৃত্তিক কাচ, বিবর্ধন কাচ ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা করেন। চোখের জৈবিক গঠন ও ব্যবচ্ছেদ বিষয়েও বিস্তর আলোচনা করেন তিনি। তাকে পিনহোল ক্যামেরা এবং ক্যামেরা উদ্ভাবকের জনকও বলা হয়। রজার বেকন এবং জোহান কেপলারের মতো বিজ্ঞানীরা হাইথামের বুক অব অপটিকস দ্বারা প্রবলভাবে প্রভাবিত ছিলেন।

 

৭০০ বছর আগেই ঘড়ির ধারণা

ঠিক সময়ে পৌঁছতে না পারলে ট্রেন মিস, পরীক্ষার হলে দেরি, অফিসে বকুনি, জরুরি মিটিং বানচাল, গুরুত্বপূর্ণ জিনিস হাতছাড়াসহ অনেক সমস্যা হতে পারে হাতে ঘড়ি না থাকলে। এবার ভাবুন তো, ঘড়ির উদ্ভাবনই হলো না, তাহলে কী আমরা এমন আধুনিক আর চটপটে হতে পারতাম? এসব প্রশ্নের অবশ্য এখন আর অবকাশ নেই, টিকটিক ঘড়ির কাঁটা জানিয়ে দেয় আমাদের কাজের সময়। এই ঘড়ির উদ্ভাবক ছিলেন তুর্কি মুসলিম মনীষী আল জাজারি। ১২০৬ সালে তিনি একাধিক আকৃতির ঘড়ি তৈরির ধারণা দেন। আজ আমরা যে ঘড়ি ব্যবহার করছি এর ধারণা ৭০০ বছর আগেই তিনি দিয়েছেন। চাকার শ্যাফটে এক ধরনের ঘূর্ণায়মান যন্ত্র ব্যবহার করা হয়, যাকে ক্যামশ্যাফট বলা হয়। স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র তৈরির জন্য আল জাজারি তৈরি করেন পৃথিবীর প্রথম ক্যামশ্যাফট। এই ক্ষুদ্র যন্ত্রাংশটি তিনি ব্যবহার করেছিলেন নিজের তৈরি জলঘড়ি, অটোম্যাটা আর পানি উত্তোলন যন্ত্রেও। বেশ সহজ গঠনের এই যন্ত্রাংশটি তৈরির সঙ্গে সঙ্গেই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং ১৪ শতকে ইউরোপে এর ব্যাপক ব্যবহার দেখা যায়।

 

মুসলিম ড্রিঙ্ক

এক কাপ কফিতে চাঙ্গা হওয়ার অভ্যাস আমাদের দেশীয় রীতিতেও মিশে আছে। পৃথিবীতে প্রতিদিন প্রায় ১৬০ কোটি কাপ কফি পান করা হয়ে থাকে। কফি শব্দটি ডাচ শব্দ কোফি থেকে এসে ১৫৮২ সালে ইংরেজি ডিকশনারিতে যোগ হয়। তবে ১৪০০ সালের দিকে ইয়েমেনের মুসলিম সমাজে সর্বপ্রথম কফি জনপ্রিয়তা পায়। ইয়েমেন কিংবা ইথিওপিয়ার এক মুসলিম মেষপালক হঠাৎ লক্ষ্য করেন তার মেষগুলো অজানা এক ধরনের গাছের পাতা খেয়ে সতেজ হয়ে উঠছে। এটা দেখে মেষপালক নিজেও সেই পাতা খান এবং ক্লান্তি দূর হয়ে সতেজ অনুভব করেন। এ ঘটনার পর থেকে কফির দানা গরম পানিতে দিয়ে পান করার ব্যাপারটা ইয়েমেনে প্রচলিত হতে থাকে। এরপর গুরুত্বপূর্ণ মুসলিম শহর যেমন- ইস্তাম্বুল, বাগদাদ, কায়রো, দামাস্কারে কফি হাউস তৈরি করা হয়। এরপর মুসলিম সভ্যতা থেকে কফি ইতালির ভেনিস হয়ে ইউরোপে জনপ্রিয়তা অর্জন করে। ইউরোপে কফিকে নিন্দাভরে ‘মুসলিম ড্রিঙ্ক’ নামে ডাকত তখনকার ক্যাথলিক প্রশাসনের কর্মকর্তারা। ১৬০০ শতকে ইউরোপের কফি হাউসগুলো বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সরকারের সমালোচনার স্থান হয়ে উঠেছিল। পরবর্তীতে কফি হাউসভিত্তিক আলোচনাই ইউরোপে অনেক নবজাগরণের পথ সূচনা করেছিল।

সর্বশেষ খবর