শিরোনাম
শুক্রবার, ১২ এপ্রিল, ২০১৯ ০০:০০ টা

হাজার পাহাড়ের দেশে মুক্তির সংগ্রাম

মনজুরুল আহসান বুলবুল

হাজার পাহাড়ের দেশে মুক্তির সংগ্রাম

অস্কারজয়ী ‘হোটেল রুয়ান্ডা’র দৃশ্যগুলোই মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। কিন্তু সম্বিৎ ফিরে পেলাম বিমানের ঘোষণায়Ñ ‘ভদ্র মহিলা ও মহোদয়গণ! আপনারা জানেন, রুয়ান্ডায় প্লাস্টিক ব্যাগ নিষিদ্ধ। কাজেই যারা প্লাস্টিক ব্যাগ বহন করছেন, বিমানবন্দরেই তা ফেলে দেবেন, আপনার সুবিধার জন্য সেখানে কাগজ বা কাপড়ের ব্যাগ পাওয়া যাবে।’ ভোররাতে রুয়ান্ডা এয়ারের বিমানটি যখন কিগালি এয়ারপোর্টে নামছে তখন সর্বশেষ যে ঘোষণা কয়েকটি ভাষায় দেওয়া হলো তার বাংলা তরজমা এ রকমই। একটু পরই ‘হাজার পাহাড়ের দেশে’র একটি ছোট পাহাড়ের ওপর যখন বিমানটি নামল দেখি কেবল ঘোষণাই নয়, দুবাই থেকে আসা যাত্রীরা প্লাস্টিকের শপিং ব্যাগ ফেলে দিচ্ছেন, এমনকি রেপিং করে আনা বড় লাগেজের প্লাস্টিকও কেটে রাখা হচ্ছে। পরের কয়েকদিনে ঘোষণা আর বাস্তবায়ন দেখা গেছে প্রতি ক্ষেত্রে। বলা হয়েছে ‘ক্লিন সিটি’, বাস্তবেও রুয়ান্ডার কোনো সড়কে এক টুকরো কাগজ বা আবর্জনা খুঁজে পাওয়া যাবে না। লোকজন ফেলেই না, ফেললেও পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা তা সঙ্গে সঙ্গেই তুলে নিয়ে যান এটা মিলিয়ে দেখার সুযোগ মেলেনি।

কিগালি এয়ারপোর্টে ওয়ানস্টপ সার্ভিস একইসঙ্গে দুটি তথ্যের সত্যতা দেয়- ব্যবসা শুরু করার ‘ঝামেলামুক্ত’ দেশ হিসেবে রুয়ান্ডা পৃথিবীর ২৯ নম্বরে, আফ্রিকায় ২ নম্ব^রে। যেখানে আফ্রিকার দেশগুলোয় একটি কোম্পানি খোলার গড় সময় লাগে সাড়ে ১১ দিন, সেখানে রুয়ান্ডায় একটি কোম্পানি খুলতে লাগে মাত্র ৪৮ ঘণ্টা, এজন্য কোনো দফতরেও যেতে হয় না, অনলাইনেই সব সম্ভব। এয়ারপোর্টেই দেখা মিলল সেই সত্যের বাস্তব চিত্রের। একজন ইমিগ্রেশন কর্মকর্তাই কাগজপত্র পরীক্ষা করছেন, ভিসা ফি নিচ্ছেন, ডলার জমা রাখছেন এবং অন অ্যারাইভাল ভিসা দিচ্ছেন। এক অফিসার একইসঙ্গে চারটি কাজ করছেন, সময় জনপ্রতি গড়ে মাত্র তিন মিনিট। বিশ্বের দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির তালিকায় রুয়ান্ডাকে রেখেছে বিশ্বব্যাংক। আরও কয়েকটি তথ্য রুয়ান্ডা সম্পর্কে ধারণা পাল্টে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। ডিজিটাল বিপ্লব হচ্ছে সেখানেও। রাজধানীর সব প্রতিষ্ঠান ও জনবহুল এলাকায় বিনামূল্যে ইন্টারনেট সেবা উন্মুক্ত করা হচ্ছে, দেশটির সংসদে নারী সদস্য ৬৭ ভাগ পৃথিবীতে সর্বোচ্চ, ৯০ ভাগ মানুষ স্বাস্থ্যবীমার আওতায়, ৭০ ভাগ মানুষ শিক্ষিত, ২০০৭ সালে পৃথিবীর একমাত্র দেশ হিসেবে রুয়ান্ডা প্লাস্টিক ব্যাগ নিষিদ্ধের আইন ও তা কার্যকর করেছে, প্রতি মাসের শেষ শনিবার দেশটির প্রেসিডন্টসহ সর্বস্তরের মানুষ পালন করে ‘উমুগান্ডা’ স্বেচ্ছাশ্রমে সমাজ উন্নয়ন। এর মধ্য দিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে বহু প্রতিষ্ঠানসহ বহু উন্নয়ন প্রকল্প।

বলি পৃথিবীজুড়ে একই আকাশ, কিন্তু না, সেদিন ভোরে কিগালির যে আকাশ আমাদের স্বাগত জানাল, ঘনকালো মেঘের আবরণে রক্তাভ সেই ভোর কেন জানি মনে করিয়ে দেয় মাত্র ২৫ বছর আগে সেই গণহত্যাযজ্ঞের কথা। জেনোসাইড মেমোরিয়ালে গিয়ে পাশবিকতার যে নমুনা দেখি তার সঙ্গে আমাদের ২৫ মার্চ বা পরের নয় মাসের পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর পাশবিকতার মিল পাই। কিগালি থেকে চার ঘণ্টার পথ পেরিয়ে কিভু লেক এলাকায় যেতে যে পাহাড় আর সবুজ দেখি তার সঙ্গে সমতল আর পাহাড়ি মিলে বাংলাদেশের কোনো ভিন্নতা নেই।

রুয়ান্ডায় আমাদের মিশনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন বাংলাদেশে রুয়ান্ডার মান্যবর কনসাল জেনারেল মোহাম্মদ ইকবাল হোসেন। দলে দুই সম্পাদক নঈম নিজাম, শ্যামল দত্ত, দুই তারকা সাংবাদিক জ ই মামুন ও মুন্নী সাহা, জাতীর পুরস্কার বিজয়ী শিল্পী ‘নিঃস্ব হয়ে যাব’ খ্যাত চন্দন সিনহা, তরুণ ব্যবসাসন্ধানী আবু হাসান মো. আলমগীর শাহীন, গণহত্যাযজ্ঞের সময় রুয়ান্ডায় জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী দলে দায়িত্ব পালনকারী মেজর জেনারেল (অব.) মাসুদ রিজওয়ান, বিনিয়োগ গবেষক নেদারল্যান্ডস-প্রবাসী নাহিদুল হাসান, ব্যবসায়ী প্যারিস-মস্কো থেকে আসা কিটু শাশ্বত মাইকেল মজুমদার, ভারত থেকে প্রকৌশলী একলব্য সিং, তপন রায়, সিঙ্গাপুরের তরুণ ব্যবসায়ী গৌরব মালহোত্রা। চট্টগ্রামের তিন তরুণ নাজমুল হাসান, সৈয়দ ইকবাল, মনজুর আলম দলের নিয়ন্ত্রণে। মিশনের লক্ষ্য রুয়ান্ডাকে জানা। কেউ জানতে চান বিনিয়োগ সম্পর্কে, কেউ দেশটির অগ্রগামী পথচলা নিয়ে, কারও আগ্রহ গণহত্যা, গণহত্যার বিচার আর পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ে।

বিমানবন্দর থেকেই গাইড কূটনীতিক এরিক কায়গি রুটনি। কিগালি থেকে কিভু লেক পর্যন্ত আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ পাহাড়ের মতোই সাজানো। কিন্তু এরিকের ঘণ্টা আর শেষ হয় না। এতগুলো বাঙালি একসঙ্গে, গাড়ির মাপা গতিতে মন ভরে না। বলি গতি বাড়াও। কিন্তু ড্রাইভারের স্থানীয় ভাষা অনুবাদ করে এরিক জানায়, গতি বাড়ানো যাবে না, কারণ গাড়িতে ‘স্পিড গভর্নর’ লাগানো। ড্রাইভার চাইলেও গতি বাড়াতে পারবে না। এরিকের দীর্ঘ ঘণ্টা শেষ হলো প্রায় সাগরসম লেক কিভু দর্শনে। রুয়ান্ডার পশ্চিম সীমান্ত ৫৬ মাইল দৈর্ঘ্য ও ৩১ মাইল প্রস্থের এ লেকের সর্বোচ্চ গভীরতা ১৫৫৮ ফুট। এ লেক শুধু মাছের জোগান দেয় না, এখান থেকে স্বল্পমাত্রায় মিথেন গ্যাস তোলা হচ্ছে, আরও খনিজ থাকার সম্ভাবনা; কিন্তু গরিবের যা হয়, নিজেদের আর্থিক সামর্থ্য নেই বলে কাজ এগোচ্ছে না। লেক কিভুর গা ঘেঁষেই কঙ্গো সীমান্ত। সকালে হাঁটতে গেলেই পথ আটকে দাঁড়ায় এই সীমারেখা।

কিভু লেকের পাশে সন্ধ্যা নামে আফ্রিকান ঘুঙুরের শব্দে। নানা রঙের সাদামাটা পোশাকে দৃঢ় পেশির তরুণ-তরুণীর দৃপ্ত পায়ে ঝড় ওঠে কিভু লেকের বালিয়াড়িতে। আমরা ভাষা বুঝি না কিন্তু তাল-লয়-সুর সবাইকে ভাসিয়ে নেয়। বাঁধনহারা এমন সন্ধ্যায় শিল্পী চন্দন সিনহার হারমোনিয়ামের ঝড় যোগ করে অন্য মাত্রা। লেকের জলতরঙ্গে কালো আফ্রিকার লোকসুরের সঙ্গে চন্দন সিনহার গলা ধরে সেই আসরে আসেন শচীন কর্তা, কিশোর কুমার, মান্না দে, বশির আহমেদ। চন্দনের নিজের ‘নিঃস্ব হয়ে যাওয়া’র গল্প তো আছেই। সেদিনই শাহনাজ রহমতুল্লাহর চলে যাওয়ার খবরে ‘যে ছিল দৃষ্টির সীমানায়...’-এর সুরে হাহাকার ছড়ান মান্যবর কনসাল জেনারেল ইকবাল হোসেন। এ কথা ঠিক, মাত্র ২৯ হাজার ৩৩৮ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের ১২.২২ মিলিয়ন মানুষের দেশে যে কোনো পরিকল্পনা নেওয়া ও বাস্তবায়ন করা তুলনামূলক সহজ। কিন্তু রুয়ান্ডার ক্ষেত্রে এ সহজ সমীকরণ মিলবে না। দেশটির আবাদ ও বসবাসযোগ্য জমির পরিমাণ কম। দীর্ঘ, কঠিন ও জটিল সময় পাড়ি দিতে হয়েছে তাদের। ধনী-গরিবের বৈষম্য ব্যাপক, দারিদ্র্যের হার কমছে কিন্তু গতি ধীর, প্রত্যন্ত অঞ্চলে সড়ক সংযোগ ভালো তবে যানবাহন অপ্রতুল, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর পায়ে হাঁটা পথই ভরসা। মাত্র ২৫ বছর আগের গণহত্যার স্মৃতি এখনো তুতসি ও হুতু সবার মনেই দগদগে ঘায়ের মতোই। গণহত্যার জন্য দায়ীদের বিচার হচ্ছে।

কিগালি শহরের জেনোসাইড মেমোরিয়ালে গণহত্যার বীভৎসতার দৃশ্য শিউরে ওঠার মতো। আমাদের উপমহাদেশের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার মতোই আগ্রাসি এই জাতিগত দাঙ্গা। তুতসি-হুতুর দাঙ্গা হলেও উভয় পক্ষের উদারপন্থিরা শিকার হয়েছেন নিজেদের গোত্রের কট্টরপন্থিদের হাতেই। শ্রমজীবী জনগোষ্ঠী হুতুর সঙ্গে ভূস্বামী তুতসিদের দ্বন্দ্ব শত বছর ধরেই। জার্মান, বেলজিয়াম, ফ্রান্সের ঔপনিবেশিক প্রভুদের দাবা খেলায় ক্ষমতার পালাবদলে রুয়ান্ডার ক্ষমতায় কখনো ছিল হুতুরা, কখনো তুতসিরা। ইউরোপীয় গোষ্ঠীর সমর্থনপুষ্ট তুতসিদের বিরুদ্ধে হুতুরা ১৯৫৯ সালে বিদ্রোহ করে, ’৬২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় হুতু সরকার। ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ ও নির্যাতনের মুখে তুতসিরা পালিয়ে যায় প্রতিবেশী দেশগুলোয়। উগান্ডায় আশ্রয় নেওয়া তুতসিরা গড়ে তোলে রুয়ান্ডান প্যাট্রিয়টিক ফ্রন্ট-আরপিএফ, সরকারবিরোধী সামরিক ও রাজনৈতিক দল। ১৯৯০ সালে আরপিএফ যুদ্ধ ঘোষণা করে। এ গৃহযুদ্ধ চলতেই থাকে। ’৯৪ সালের ৬ এপ্রিল কিগালিতে দেশটির প্রেসিডেন্ট হুতু জনগোষ্ঠীর হাবিয়ারিমানাকে বহনকারী বিমান গুলি করে ধ্বংস করা হয়। কারা এ কাজ করেছে আজও জানা যায়নি । কিন্তু ক্ষমতাসীন হুতু জনগোষ্ঠীর উগ্রপন্থিরা সরল সমীকরণে দায়ী করে তুতসি জনগোষ্ঠীকে। শুরু হয় দেশটিকে তুতসিমুক্ত করার অভিযান। হুতু নিয়ন্ত্রিত রেডিও থেকে হত্যাযজ্ঞে উসকানির আগুন ছড়িয়ে দেওয়া হয়। মাত্র ১০০ দিনে হত্যা করা হয় ৮ লাখ নারী, পুরুষ, শিশুকে। মানুষ হত্যা করে তাদের কলাপাতায় ঢেকে রাখা হয়, যাতে ছবিতে শুধু সবুজ দেখা যায়। এ হত্যাকাণ্ডের সময় নিশ্চুপ থাকার জন্য ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয় জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা বাহিনী। ‘শান্তিরক্ষা’ নাকি ‘প্রয়োজনে শক্তি প্রয়োগ করে শান্তি প্রতিষ্ঠা’ এ বিতর্কে চুপ থাকে তারা। এ ভূমিকার জন্য আঙ্গুল তোলা হয় ব্রিটেনের দিকে। এ প্রেক্ষাপটেই আরপিএফ নেতা পল কাগামির নেতৃত্বে ক্ষমতায় আসে তুতসিরা। গণহত্যার বিচারে জাতিসংঘ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে। সেই ট্রাইব্যুনালের কাজ শেষ হলেও রুয়ান্ডা নিজেদের আইনেই বিচার করছে খুনিদের।

কিন্তু এ পরিস্থিতিতে সরকার প্রায় ধ্বংসস্তূপের মাঝে দাঁডিয়েও দুটি কাজ দৃশ্যমান করছে : একটি হচ্ছে সমাজের সর্বস্তরে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা, দুর্নীতিকে বিন্দুমাত্র ঠাঁই না দেওয়া আর সকল পর্যায়ে দেশপ্রেমকে শক্তভাবে প্রতিষ্ঠিত করা। হুতু বা তুতসি নয়, এখন সবাই রুয়ান্ডান। বিপ্লবের মধ্য দিয়ে আসা বর্তমান সরকার স্পষ্টভাবেই জনমনে এ কথা বোঝাতে পেরেছেÑ রুয়ান্ডার পেছনে ফেরার পথ নেই। বিদ্যুতের অবস্থা করুণ, জেনারেটরনির্ভর কিন্তু কাজ থেমে নেই। কলা ছাড়া বড় পরিমাণের কৃষিপণ্য নেই, কলা আর আলুর ওপরই সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জীবিকা নির্ভর। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলজুড়ে ছোট ছোট বাজার। পায়ে হেঁটে সবাই সেখানে যাচ্ছে, সড়ক-মহাসড়ক দখল করে বসছে না। রুয়ান্ডা পার্লামেন্টের ৬৪ ভাগ আসন নারীদের দখলে, পৃথিবীতেই সর্বোচ্চ। এর প্রভাব সমাজজীবনে ও ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও। পর্যটক আকর্ষণের জন্য গরিলা, আগ্নেয়গিরি, অভয়ারণ্য, লেক শুধু নয়; অন্য ক্ষেত্রেও এগিয়ে যেতে চায় রুয়ান্ডা। সে কারণেই এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে ‘আফ্রিকান সিইও সম্মেলনে’ আফ্রিকা তো বটেই বিশ্বের সব অঞ্চল থেকে যোগ দিয়েছেন দেড় হাজারের বেশি শীর্ষ ব্যবসায়ী নেতা। রুয়ান্ডার বিপ্লবী নেতা দেশটির প্রেসিডেন্ট পল কাগামি স্পষ্ট করেই বলেছেন, বড় বিনিয়োগকারীদের মানসিকতার বদল ঘটাতে হবে। ছোট অর্থনীতির উদ্যমীদের সঙ্গে সংযোগ ঘটাতে হবে তাদের। ‘আফ্রিকা দখলে’র চীন-ভারত যুদ্ধকেও ইতিবাচক বলেই দেখছেন প্রেসিডেন্টের সহযোগী শীর্ষ রাজনীতিক ও ব্যবসায়ীরা। এ অভিযাত্রায় সরকারের বিরোধীদের ভূমিকা কেমন হওয়া উচিতÑ কঠিন এ প্রশ্নটির সহজ জবাব দিলেন কূটনীতিক এরিক। স্বাধীনতাযুদ্ধে তার বাবা মারা গেছেন, গণহত্যার সময় হত্যা করা হয়েছে তার মাকে। সেই এরিকের সপ্রতিভ জবাবÑ ‘আমাদের মতো দেশে বিরোধী গোষ্ঠীর রাজনীতির মধ্যেও পরিবর্তন আসতে হবে, সরকারের উন্নয়ন প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত হয়েই তাদের রাজনীতি করতে হবে, শুধু “মিডিয়ায় তারকা” হওয়ার জন্য বিরোধিতা করার রাজনীতি জনগণ গ্রহণ করবে না।’

রুয়ান্ডা তাদের এই এগিয়ে চলার পথে হাত রাখতে চায় সবার সঙ্গেই। সেই সহযাত্রায় বাংলাদেশের ভূমিকাও দেখি দৃশ্যমান। তরুণ উদ্যমী জামিলুর রহমানের হাত ধরে বাংলাদেশের ‘আশা’ এখন আশা ছড়াচ্ছে রুয়ান্ডায়। কয়েক হাজার পরিবার তাদের ‘ক্ষুদ্র ঋণ’ কর্মসূচির আওতায়। তপন কুমারের নেতৃত্বে খুঁটি গাড়ছে ব্র্যাক, স্যার ফজলে হাসান আবেদ শিগগিরই যাচ্ছেন উদ্বোধন করতে, ইউএনএইচসিআর ও ইউএসএআইডির চালিকাশক্তিও বাংলাদেশের আরিফের মতো তরুণদের হাতেই। তাদের অধীনেই চাকরি করছে রুয়ান্ডার তরুণ-তরুণীরা। আশা ও ব্র্যাক সেখানে চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠান মাত্র নয়, দারিদ্র্য দূর করতে বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা ছড়িয়ে দেওয়ার কাজে নিয়োজিত। বাংলাদেশের পিএইচপি গ্রুপও পরিকল্পনা করছে বড় বিনিয়োগ নিয়েই রুয়ান্ডা যেতে। গোটা রুয়ান্ডায় সর্বসাকল্যে ২৫-৩০ জন বাংলাদেশির বাস। এই ক্ষুদ্র দলটিকে বড় করতে তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন কলকাতার বাংলাভাষী কয়েকটি পরিবারও।

২৫ মার্চ বাংলাদেশ যখন গণহত্যার কালরাত স্মরণ করছে তখন আমরা কিগালিতে জেনোসাইড মেমোরিয়ালে। ভাবছিলাম, গণহত্যার নারকীয়তা পৃথিবীজুড়ে একই। হত্যাযজ্ঞের শিকার যারা তাদের রক্তের রং একই, বেঁচে থাকা স্বজনদের অশ্রুর ভাষা একই। পৃথিবীর সব গণহত্যার বিচার চাই। পরদিন আমাদের স্বাধীনতা দিবসে ইউএনএইচসিআরের প্রাণ তরুণ আরিফের বাসায় যখন রুয়ান্ডার সব বাঙালি মিলে ‘আমার সোনার বাংলা...’ গাইছি চন্দনের নেতৃত্বে, তখন গর্বে বুক ভরে উঠছে। বাংলাদেশ স্বাধীন বলেই না আজ আরেক রক্তস্নাত দেশ রুয়ান্ডার এগিয়ে চলার পথে হাত বাড়িয়েছে বাংলাদেশ। রক্ত দিয়ে স্বাধীনতার মূল্য যেমন আমরা বুঝি, বোঝে রুয়ান্ডাও। রুয়ান্ডার বিপ্লবী নেতা প্রেসিডেন্ট পল কাগামি যখন বলেন, ‘ওরা আমাদের হত্যা করে মাটিতে পুঁতে দিয়ে ভেবেছিল সব শেষ হয়ে গেছে, কিন্তু আমরা সেই মাটিতে পুঁতে দেওয়া বীজ থেকে বৃক্ষ হয়ে মাথা তুলে দাঁড়াব।’ কথাটা শুনে চমকে উঠি, আরও প্রায় পাঁচ দশক আগে এই কথাই তো বলেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, ‘আমরা যখন মরতে শিখেছি... কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবা না।’ সব মু্িক্তসংগ্রামের ভাষা একই। যে জনগোষ্ঠী নিজের রক্তে স্বাধীনতা কেনে তাদের কেউ দাবায়ে রাখতে পারবে না। বাংলাদেশকেও না, রুয়ান্ডাকেও না।

সর্বশেষ খবর