শিরোনাম
শুক্রবার, ১২ এপ্রিল, ২০১৯ ০০:০০ টা

জলভরা চোখ এক চিলতে হাসি

মুন্নী সাহা

জলভরা চোখ এক চিলতে হাসি

ঘরজুড়ে মাথার খুলি আর খুলি। ফিমার, লাম্বার হাড়গোড়ের স্তূপ। আলোটা একটু নিভুনিভু। আরোপিত কোনো মিউজিক দিয়ে ভয় ধরানো বা ভুতুড়ে করার চেষ্টা নেই। রুয়ান্ডার গণহত্যা মেমোরিয়ালের ওই খুলির ঘরটাতে ঢুকে বেশিক্ষণ কেউ টিকতে পারে না। বলছি দর্শনার্থীদের কথা। সবাই অল্পক্ষণেই ছিটকে  বেরিয়ে আসে। ১৯৯৪ সালে ১১ এপ্রিল থেকে মে। এক-দেড় মাসে হুতু-তুতসিদের জাতিগত দাঙ্গায় অফিশিয়ালি নিহতের সংখ্যা বলা হয় প্রায় ২০ লাখ। আনঅফিশিয়াল পরিসংখ্যান এখন রুয়ান্ডান কেউ মুখেও আনেন না। কে আনবেন? কাকে জিজ্ঞাসা করব? হুতু না তুতসি কীভাবে বুঝব? আর মেরেছে তো হুতুরা তুতসিদের, তুতসিরা, হুতুদের। হঠাৎ করেই যে ১১ এপ্রিল একজন আরেকজনের মাথায় মুগুর মারা শুরু করল, তা যে নয়... আজকাল আমরা যারা গুগল দাদুর সাহায্য নিয়ে তথ্য জাহির করার প্রতিযোগিতায় তারা জানি। যুগ যুগের কলোনিয়াল শাসন, ডিভাইড অ্যান্ড রুল কৌশল, racism,  ethnicity   এসব দিয়ে মানুষের মানুষ থাকার অধিকার লুট করে নেওয়ার ফলই এত রক্ত... এত হিংসা, তা আর বুঝতে বাকি থাকে না। শুধু চট করে বুঝে উঠতে,  চিনে উঠতে পারি না এই দায়ী কুৎসিত চিন্তকদের। যারা আমাদের মতো ঐশ্বর্যের দেশকে গরিব বানিয়ে রাখে থিউরি দিয়ে, চোখে জলে  ধোয়া স্বচ্ছ হৃদয়ের  মানুষদের হুতু-তুতসি বা কালো মানুষ বানায়।

খুলির ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে,  এই  খেল দেখছিলাম। ঝট করে বেরিয়ে এলো চন্দনদা, অস্থির মানুষ। এটিএন বাংলার পরিচালক। ক্যামেরায় আঙ্গুল চলছিল না জ ই মামুনের। বুলবুল ভাই, শ্যামলদা, বিট্টুদা, সিংজি, তপনদা, শাহীন ভাই, পপুলার ইকবাল, মঞ্জুসহ টিমের সবারই একই কাণ্ড। অর্থাৎ বাংলাদেশ থেকে আমরা রুয়ান্ডায় বাংলাদেশের অনারারি কনসাল  জেনারেল ইকবাল হোসেন চৌধুরীর সঙ্গে রুয়ান্ডা  দেখতে গিয়েছিলাম।

মেমোরিয়ালের খুলিঘরের দরজার কাছে একটু যেন হারিয়ে গিয়েছিলাম মনে মনে। নরওয়ের অসলো ইউনিভার্সিটির সামার স্কুলের ক্লাসরুমে। আমাদের মিডিয়া স্টাডিজ গ্রুপে তখন রুয়ান্ডার দুজন সহপাঠীকে  পেয়েছিলাম। এরিক আর বিলি। তখন রিকনসিরিয়েশন হয়েছে, নতুন সরকার অর্থাৎ তুতসিরা দেশ চালাচ্ছে। হুতু নয়... তুতসি নয়... রুয়ান্ডান হিসেবে জাতীয়তা মেনে নিচ্ছেন। এমনি ট্রানজিশনাল সময়ে বিলি আর এরিক ক্লাসে ধুম ঝগড়া করত যে কোনো ইস্যুতে।  এমন বিকট ঝগড়া, যেন একজন আরেকজনকে মেরে  ফেলবে।

তখনো আমার peace process,  conflict politics,  harm reduction Gme terminology -এর অন্তর্নিহিত অনুভবের বাতাস লাগেনি। ক্লাসে আফ্রিকা থেকে এসেছিল ওরা তিনজন। বিলি ও এরিকের বাইরে কারিমা। জোবার্গ (জোহানেসার্গ) রেডিওর নিউজ এডিটর। রোল অব রেডিও নিয়ে কারিমা, কথা বলত বিশেষ করে, রুয়ান্ডা ইস্যুতে। আমি তো মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতাম না। রাগ হতো। কেনরে বাবা, একটা ইন্টারন্যাশনাল ক্লাসে বসে, সাংবাদিকতার আর্ট টেকনিক, ফাইভ ডব্লিউ ওয়ান এইচ না বলে, কীসের সব রুয়ান্ডা ফুয়ান্ডা, লাটভিয়া,  বসনিয়া, ইসরায়েল-প্যালেস্টাইন নিয়ে ক্লাসমেটরা ঝগড়া বাধাত। পাকিস্তানের মারিয়াম আপা ছিলেন। উড়িষ্যার সুদেষ। ক্লাস টিচার এলডার অ্যাসাইনমেন্ট করতে গিয়ে বাংলাদেশ পাকিস্তান ইন্ডিয়ার বিতর্ক হতো। আবারও আমরা মিলমিশ। আসলে, এই মিনি জাতিসংঘের দর্শনে গড়া ক্লাসরুমে শান্তি, মানবতা, সহমর্মিতার পাঠোদ্ধার করার বয়স, ম্যাচিউরিটি কিছুই আমার ছিল না। শুধু ক্লাসরুমটা মনে পড়ে, মনে পড়ে ইসরায়েলি বন্ধু গ্যাব্রিয়েলা, লাটভিয়ার ডায়নার কথা। মনে পড়ে এরিকের চোখ দুটো। আফ্রিকান গুঁড়িগুঁড়ি কোকড়ানো চুল, লম্বাটে গড়ন। খাটো, মোটা নাক থ্যাবড়া বিলির চেয়ে শ্যাম বর্ণে একপোচ উজ্জ্বল এরিক। আরও উজ্জ্বল ওর সদা ছলছল করা জলভরা চোখ।

এরিককে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, তোমার চোখে কী সমস্যা এরিক? জলভরা চোখ এক চিলতে হেসে বলেছিল, নো ইটস নট টিয়ার্স মুনি... (মুন্নী বলতে পারত না), ইটস অ্যাগোনি!

অসলো ইউনিভার্সিটির ট্রেন স্টেশনে রাত ১২টার ঝা চকচকে রোদের আলোয় (২৩ জুন সূর্য ডোবে না) আর এরিকের কাছে জানা হয়নি চোখের জলের এই অ্যাগোনির নিচে কত প্রিয়জনের বীভৎসভাবে নিহত হওয়ার ছবি। হঠাৎ খুলিঘরের ভিতর থেকে ওই জলভরা চোখই আমাকে হন্ট করল। কোথায় এরিক... কে এরিক? আর খোঁজ রাখা হয়নি। মেমোরিয়ালের বাইরে গণকবরের ওপর ফুল দিতে গিয়ে চোখে পড়ল একজোড়া জলভরা চোখ। ভারী শরীর নিয়ে লাঠিতে ভর দিয়ে হাঁটছেন। সাহস করে অ্যাগোনির কথাটা জিজ্ঞাসা করলাম না। হয়তো এই-ই এরিক!

তারপর রুয়ান্ডার ঝকঝকে তকতকে প্রকৃতি, পরিচ্ছন্নতা,  সবার মিষ্টি ব্যবহার, ভিক্ষুক, দোকানদার,  ব্যাংকার, ট্রাভেল এজেন্সির কর্মকর্তাসহ যাকেই দেখি, সবার পরিষ্কার-পরিপাটি পোশাক,  এটিকেট, হাজার পাহাড়ের গা ঘেঁষে সুন্দর সুন্দর নান্দনিক মাটির বাড়ি,  বড় বড় রাস্তা, নিয়ম মানার দৃশ্যÑ সবটাতেই মুগ্ধতা। এ মুগ্ধতায় সাংবাদিকসুলভ কৌতূহল... কীভাবে হলো? কেমনে হলো? ’৯৪ সালের জাতিগত দাঙ্গার ৩০ লাখ লাশের ভার একদিকে সরিয়ে রেখে, কীভাবে ন্যাচারাল বিউটি ন্যাচারাল রেখে রুয়ান্ডা প্রতিবছর তাদের প্রবৃদ্ধি বাড়াচ্ছে? সাফারি বা উন্মুক্ত চিড়িয়াখানা দেখানোর গাইড কাম গাড়িচালক জো উত্তর দেন... ইটস লিডারশিপ। রিকনসিলেয়েশ প্রসেসে প্রথম কী দিয়ে শুরু করেছি আমরা জানো? জো জিজ্ঞাসা করল। মাথা নাড়লাম। না...! জো বলল, প্রথমে বলা হলো, দেশের সব নাগরিককে জুতা পরতে হবে। তারপর এলো... clean your mind, clean your body and clean your territory.

হ্যাঁ, এত ঝকঝকে দেখে তাই-ই মনে হয়। তোমরা পরিচ্ছন্নতাকে ক্যাম্পেইন হিসেবে নিয়েছো। একটু শুধরে দিয়ে ড্রাইভার জো বলল... এটা ক্যাম্পেইন নয়... প্রার্থনার মতো। প্রতি মাসের শেষ শনিবার পুরো দেশের মানুষ সারা দিন ধরে ঘরদোর চারপাশ পরিষ্কার করে। প্রেসিডেন্টও নামেন। শুধু ময়লা পরিষ্কার নয়, দেখো প্রতিদিন আমলা, মন্ত্রী সব জেলে যাচ্ছেন। বই ছাপতে দেরি হলো এক সপ্তাহ, দেখো, গতকালই শিক্ষামন্ত্রী আউট। জেলের ভিতর এখন।

বাঃ দারুণ তো...।  এখন তো তুতসিরা ক্ষমতায় তাই না? তোমাদের প্রেসিডেন্ট তো তুতসি... বোকার মতো আমার এ প্রশ্নে হাস্যোজ্জ্বল জো একটু চোয়াল শক্ত করল,  no tutsi... no hutu...!  we Rwandan!  when we clean our country we clean it with our tears.. tears of agony!

হ্যাঁ... তাই তো! চোখের জলে ধোয়া দেশই তো রুয়ান্ডা!

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর