শুক্রবার, ৩১ মে, ২০১৯ ০০:০০ টা

রমজানে যুদ্ধ ও বিজয়গাথা

রমজান সিয়াম সাধনার মাস। তারপরও বৃহত্তর স্বার্থে মুসলমানদের যুদ্ধ করতে হয়েছিল এ মাসে। এমন কিছু যুদ্ধ ও যুদ্ধ জয়ের কথা লিখেছেন- মেজর নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ (অব.) পিএইচডি

রমজানে যুদ্ধ ও বিজয়গাথা

মক্কা বিজয় ১৮ রমজান

হজরত মুহাম্মদ (সা.) নবুয়ত লাভের পর প্রায় ১২ বছর মক্কায় অবস্থান করে কুরাইশদের ইসলামের পথে আনার সংগ্রাম চালিয়ে যান। এতে কিছু সাফল্য এলেও কুরাইশদের বিরোধিতাই ছিল বেশি। এই বিরোধিতা এক সময় এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে, মহানবীর (সা.) জীবননাশের চক্রান্ত শুরু হয়। জন্মের পর দীর্ঘ ৫২ বছর প্রিয় জন্মভূমি মক্কায় কাটিয়েছিলেন মহানবী (সা.)। কিন্তু ৫২ বছর পর তার পক্ষে মক্কায় অবস্থান অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে। ইংরেজি ক্যালেন্ডারে তখন ৬২২ খ্রিস্টাব্দ।

মহানবী (সা.) বিভিন্ন দিক বিবেচনা করে মক্কা ছেড়ে প্রায় ২১১ মাইল উত্তরে তৎকালীন জাথরিব (বর্তমানে) মদিনায় গমনের সিদ্ধান্ত নেন। রাজনৈতিক ও ক্ষমতাজনিত কারণে বিরোধিতা করলেও সত্যবাদী ও বিশ্বাসী হিসেবে কাফের এবং কুরাইশরা তাকে শ্রদ্ধা করত এবং মূল্যবান ধনসম্পদ তার কাছে আমানত রাখত। মহানবী (সা.) এক রাতে হজরত আলী (রা.)-কে সব আমানত বুঝিয়ে দেন আমানতকারীদের কাছে পৌঁছে দিতে। তার ঘর তখন শত্রুরা ঘিরে রেখেছিল। কথা ছিল পরদিন সকালে হত্যা করা হবে হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে। বিষয়টি বুঝতে পেরে তিনি হজরত আলী (রা.)-কে তার বিছানায় ঘুমিয়ে থাকতে বলেন এবং একমুঠো বালুতে দোয়া পড়ে ফুঁ দিয়ে চারদিকে ছিটিয়ে দেন। এতে শত্রুরা মূলত কিছুই দেখতে পেল না। অথচ মহানবী (সা.) আবু বকর (রা.)-কে সঙ্গী করে মক্কা ত্যাগ করে মদিনায় গমন করেন। এখান থেকে হিজরত এবং আরবি হিজরি মাস ও সনের প্রচলন ঘটে। মদিনায় হজরত মুহাম্মদ (সা.) আট বছর অবস্থানকালে বেশ কিছু যুদ্ধে অংশ নেন এবং বিভিন্ন চুক্তি বা সন্ধিতে আবদ্ধ হন। এর মধ্যে হুদাইবিয়ার সন্ধি অন্যতম। যার মাধ্যমে বিভিন্ন গোত্রকে কুরাইশ কিংবা মুসলমানদের সঙ্গে জোট বাঁধার সুযোগ দেওয়া হয় এবং পরস্পরকে আক্রমণ না করার চুক্তি হয়। ৬৩০ খ্রিস্টাব্দে অর্থাৎ হিজরি ৮ সালে রমজানের আগে কুরাইশ পক্ষ চুক্তিভঙ্গ করে এবং মুসলমানদের পক্ষে যোগ দেওয়া বানু খাওজা গোত্রকে আক্রমণ করে। কুরাইশদের এই বিশ্বাসঘাতকতা এবং মুসলমানদের কাবা শরিফে হজ পালনে বারবার বাধা দেওয়ার কারণে হজরত মুহাম্মদ (সা.) মক্কায় ফেরার সিদ্ধান্ত নেন। প্রকৃত মুসলমান, তাদের পক্ষ অবলম্বনকারী বিভিন্ন গোত্র এবং স্বেচ্ছাসেবক মিলিয়ে প্রায় ১০ হাজার সৈন্যের এক শক্তিশালী বাহিনী প্রস্তুত হয়ে যায় অল্প সময়ে। ইসলাম ধর্মের আবির্ভাব এবং মহানবী (সা.)-এর তৎকালীন জমানায় এটা ছিল সর্বোচ্চসংখ্যক সৈন্য সমাবেশ। এই বিশাল বহর নিয়ে ৮ হিজরির ১০ রমজান (মতান্তরে ৬ অথবা ৮ রমজান) তারিখে মহানবী (সা.) মদিনা ছেড়ে মক্কার পথে যাত্রা করেন। দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে মক্কার ১০ মাইল উত্তর-পশ্চিমে মার-উজ-জাহান নামক স্থানে অবস্থান নেয় মুসলমান বাহিনী ও তাদের শরিকরা। মক্কা শহর এবং কাবা শরিফ তখন কম-বেশি ৩০০ মিটার বা ১০০০ ফিট উচ্চতার কালোপাথর বিশিষ্ট পাহাড় দ্বারা পরিবেষ্টিত ছিল। কাবা শরিফে ঢোকার জন্য পাহাড়ের মধ্য দিয়ে চারদিক থেকে চারটি পাহাড়ি রাস্তা বা ফাঁকা গলি ছিল। মহানবী (সা.) শত্রুকে বিভ্রান্ত করার জন্য চারদিক থেকেই কাবার পথে এগিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন এবং একটি দল বিপদে পড়লে অন্য দলকে সাহায্য করার নির্দেশ দেন। ক্যাম্প এলাকা ত্যাগের আগে মহানবী (সা.) এবং তার বাহিনীকে রাতের বেলায় মশাল ও লণ্ঠন জ্বালানোর নির্দেশ দেন। রাতের আঁধারে এত আলোর সমাহার মুসলমানদের মনোবল বাড়িয়ে দেয় আর শত্রুর মনে ভয় জাগায়। এরপর চূড়ান্ত সময়ের আগে এক বিরল মহানুভবতার পরিচয় দেন হজরত মুহাম্মদ (সা.)। যে কুরাইশরা তাকে হত্যা করতে চেয়েছিল এবং জন্মভূমি মক্কা ত্যাগে বাধ্য করেছিল, তিনি নিজে আক্রমণের শিকার না হলে তাদের আঘাত করতে নিষেধ করেন। তিনি আরও ঘোষণা দেন, কেউ যদি অস্ত্র ফেলে দেয় অথবা নিজ ঘরে দরজা বন্ধ করে বসে থাকে অথবা নিরাপদ এলাকা হিসেবে ঘোষিত আবু সুফিয়ানের বাড়িতে আশ্রয় নেয়, তবে তার কোনো ক্ষতি হবে না। এই মহান ঘোষণার পর ইসলামের প্রতি মক্কাবাসী অমুসলিমরা আকৃষ্ট হয় এবং তাদের পুরনো ধারণা বিসর্জন দেয়। ইতিমধ্যে মুসলমানরা চারটি দলে বিভক্ত হয়ে চতুর্দিক থেকে প্রচলিত পাহাড়ি রাস্তা ধরে পবিত্র কাবার দিকে এগুতে থাকে। মহানবী (সা.) মদিনামুখী রাস্তা ধরে এগিয়ে যান। তিনটি সেনাদল প্রায় বিনাবাধায় কাবা শরিফে পৌঁছে যায়। কেবল আবু সুফিয়ান কিছু কুরাইশ সৈন্য নিয়ে মুসলমান বীর খালিদ বিন ওয়ালিদের সামনে বাধা হয়ে দাঁড়ান। এই পথে যুদ্ধ করে ১২ জন কুরাইশ মারা যায়। আর মুসলমানদের পক্ষে দুজন শহীদ হন। পরাজয় মেনে পালিয়ে যায় কুরাইশরা। আর তাদের সেনাপতি আবু সুফিয়ান নিজেই উপলব্ধি করেন, কাবায় রাখা দেব দেবীদের মূলত কোনো ক্ষমতা নেই তাকে রক্ষা করার। ফলে আবু সুফিয়ান ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। এরপর কাবা এবং মক্কা শহরে থাকা সব দেব-দেবীর মূর্তি ভেঙে ফেলা হয়। শুরু হয় ইসলামের নবযাত্রা। ততদিনে রমজানের ১৮ তারিখ অতিক্রান্ত হয়।

 

বদরের যুদ্ধ ১৭ রমজান

৬২২ খ্রিস্টাব্দে হজরত মুহাম্মদ (সা.) প্রিয় জন্মভূমি মক্কা ছেড়ে মদিনায় হিজরত করেন। এর দুই বছর পর ৬২৪ সালের ১৩ মার্চ; আরবি দ্বিতীয় হিজরি ১৭ রমজান তারিখে মক্কার অমুসলিম কুরাইশদের সঙ্গে মদিনার মুসলমানদের এক যুদ্ধ হয়। মদিনা থেকে ৭০ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে বদর নামক স্থানে সংঘটিত হয়েছিল বলে যুদ্ধটি বদরের যুদ্ধ নামে পরিচিত। মক্কার কুরাইশরা তখন মদিনার কাছ দিয়ে গড়ে ওঠা রাস্তা ধরে কাফেলা আকারে সিরিয়ায় যেত এবং বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনা করত। এই বাণিজ্যের ফলে অর্জিত লাভের বিরাট অংশ তারা ব্যয় করত হজরত মুহাম্মদ (সা.) এবং ইসলামবিরোধী বিভিন্ন কাজে। ফলে কুরাইশদের শক্তি কমানোর কৌশল হিসেবে মদিনার মুসলমানরা কুরাইশদের কাফেলা আক্রমণ করত এবং তাদের ধনসম্পদ কেড়ে নিত। ৬২৪ সালের শুরুতে এমনি একটি দল পাঠানো হয়েছিল কুরাইশদের চলাচল সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের জন্য। এই  দলটির কোনো যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার কথা ছিল না। কিন্তু সুযোগ সামনে আসায় দলটি একজন কুরাইশকে হত্যা করে। এছাড়াও দুজনকে বন্দী করে ও প্রচুর সম্পদ আটক করে। এ ঘটনাটি ঘটে আরবি রজব মাসে। মক্কায় প্রচলিত প্রথা অনুসারে রজব মাসকে পবিত্র মনে করা হতো এবং এই মাসে যুদ্ধ নিষিদ্ধ ছিল। তথাপি এই হত্যা, বন্দী ও সম্পদ আটকের ঘটনা কুরাইশদের উত্তেজিত করে তোলে এবং একটি যুদ্ধের প্রেক্ষাপট তৈরি করে। ৬২৪ সালের শুরুতে মহানবী (সা.)-এর কাছে খবর পৌঁছে যে, কুরাইশ নেতা আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে একটি বহর মুসলমানদের বিরুদ্ধে ব্যবহারের জন্য অস্ত্র সংগ্রহ করে সিরিয়া থেকে মক্কা ফিরছে। মহানবী (সা.) খবর পেয়ে ৩১৩ জন মুসলিম সৈন্য নিয়ে এই বহর আক্রমণের জন্য প্রস্তুত হন। এদিকে আবু সুফিয়ানও গোয়েন্দা মারফত মুসলমানদের প্রস্তুতির খবর জেনে যান। ফলে আবু সুফিয়ান তার নির্ধারিত পথ পরিবর্তন করে মক্কায় এই সংবাদ পাঠান। মক্কার নেতা এবং ইসলামের শত্রু আবু জাহেল খবর পেয়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিশাল বাহিনী প্রস্তুত করে। হজরত মুহাম্মদ (সা.) প্রিয় সঙ্গী হজরত আবু বকর (রা.), হজরত ওমর (রা.) ও হজরত আলী (রা.), হজরত হামজা (রা.)সহ ৩১৩ জন মতান্তরে প্রায় ৩৫০ জন সৈন্য নিয়ে প্রস্তুত হন কুরাইশদের মোকাবিলা করার জন্য। ৬২২ সালের ১১ মার্চ বদর যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে মুসলিম ও কুরাইশ বাহিনী ১৩ মাইল দূরে অবস্থান নেয়। রণকৌশল হিসেবে মুসলিম সৈন্যরা বদর এলাকার পানির কূপসমুহ দখল করে নেয়। ১৩ মার্চ মধ্য রাতে কুরাইশরা ১০০ টি ঘোড়া, ১৭০টি উট এবং প্রায় ১০০ জন পদাতিক যোদ্ধা নিয়ে বদরের যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত হন। ১৩ মার্চ ৬২২ সাল আর ১৭ রমজান হিজরি দিনের বেলায় শুরু হয় বদরের যুদ্ধ। তৎকালীন প্রথা অনুসারে সেরা যোদ্ধাদের সম্মুখযুদ্ধে হজরত আলী (রা.) কুরাইশদের সেরা যোদ্ধা ওয়ালিদ বিন উতাবাকে হত্যা করেন। আরেক কুরাইশ যোদ্ধা ইবনে রাবিহ প্রাণ হারান হজরত আমির হামজার (রা.) হাতে। অন্যদিকে কুরাইশদের শোয়াইবা ইবনে রাবিহ পরাজিত হয়ে প্রথমে আহত ও পরে মৃত্যুবরণ করেন মুসলিমপক্ষের উবাইদার হাতে। এরপর উভয় পক্ষের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়। প্রথমে দূর থেকে তীর নিক্ষেপে উভয় পক্ষের হতাহতের ঘটনা ঘটে। এরপর পাথর নিক্ষেপ ও সামনা-সামনি তলোয়ার ও হাতাহাতি যুদ্ধ চলতে থাকে। মুসলমানরা সংখ্যায় কম হলেও তাদের রণ হুংকার ও বীরত্বের কাছে পরাজিত হয়ে ছত্রভঙ্গ হয় কুরাইশ বাহিনী। পবিত্র কোরআনের সূরা আল ইমরানের ১২৩, ১২৪ এবং ১২৫ নম্বর আয়াতে বদরের যুদ্ধে দুর্বল মুসলমানরা আল্লাহর সাহায্য লাভ করেছিলেন। যুদ্ধে কয়েক হাজার ফেরেশতা মুসলমানদের পক্ষে এবং যুদ্ধে মুসলমানের শক্তি বৃদ্ধি করেছিল বলে উল্লেখ আছে। এই যুদ্ধে মুসলমানদের মধ্যে ১৪ জন শহীদ হন। আর কুরাইশদের ৭০ জন নিহত ও ৭০ জন বন্দী হয়। হিজরতের পর ১৭ রমজানের এই যুদ্ধ মুসলমানদের মনোবল বৃদ্ধি করে এবং মক্কা ও মদিনার বিভিন্ন গোত্রকে ইসলাম গ্রহণে উৎসাহিত করে। পক্ষান্তরে ১৭ রমজান যুগে যুগে অমুসলিমদের মধ্যে আতঙ্ক ও বিভীষিকা রূপে আবির্ভূত হয়।

 

স্পেন বিজয় ২৮ রমজান

৯২ হিজরির ২৮ রমজান (মতান্তরে ২৫ রমজান) মুসলমানদের জন্য ছিল একটি গর্বের দিন। এই দিন স্পেন বিজয়ী মুসলিম সেনাপতি তারিক বিন জিয়াদের হাতে গুয়াজলেটের যুদ্ধে প্রাণ হারান তৎকালীন স্পেনের (হিসপানিয়া) রাজা রোডরিক। যার মধ্য দিয়ে মুসলমানদের বিজয় কেতন উড়ে স্পেনের মাটিতে। আরব জাহানে উমাইয়া বংশের শাসনকালে খলিফা প্রথম আল ওয়ালিদের পরিকল্পনায় মুসলমানরা বেশ কিছু অভিযান চালায় এবং উমাইয়া শাসিত এলাকা তথা মুসলিম বিশ্বের বিস্তৃতি ঘটায়। প্রথম আল ওয়ালিদ বিভিন্ন যুদ্ধের জন্য উপযুক্ত সেনাপতি নিয়োগ দিতেন। এসব যুদ্ধে মুসলমানদের সৈন্যদের পাশাপাশি অমুসলিম দাস এবং ভাড়াটিয়ারা সৈন্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হতেন। যার বড় অংশ আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ থেকে আসত। অমুসলিম এই সৈন্যদের বারবার বলা হতো। উমাইয়া খলিফা প্রথম আল ওয়ালিদের একজন সেনাপতি ছিলেন মুসা বিন নুসাইর। খলিফার আদেশে ৭১০-৭১১ সালে মুসা তৎকালীন তানজিয়া রাজ্য জয় করেন এবং বীর সেনানী তারিক বিন জিয়াদকে তানজিয়ার্সের গভর্নর নিযুক্ত করেন। তানজিয়ার্স এবং স্পেনের মধ্যবর্তী একটি সামুদ্রিক দ্বীপাঞ্চল কিউটা তখন খ্রিস্টান শাসক জুলিয়ানের অধীনস্থ ছিল। কথিত আছে তৎকালীন প্রথা অনুসারী জুলিয়ান তার কন্যাকে শিক্ষার উদ্দেশে স্পেনের একটি রাজবংশীয় শিক্ষালয়ে পাঠান। অধ্যয়নকালীন ওই রাজকন্যা রাজা রোডরিকের যৌন নির্যাতনের শিকার হন। ফলে বাবা জুলিয়ান প্রকাশ্যে রোডরিকের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। তৎকালে জুলিয়ানের বেশ কিছু সমুদ্রগামী জাহাজ ও স্পেন উপকূলে নিজস্ব দুর্গ ও অন্যান্য স্থাপনা ছিল। জুলিয়ান অতি গোপনে তানজিয়ার্সের মুসলিম শাসক তারিক বিন জিয়াদের সঙ্গে চুক্তি করেন এবং তারিকের বাহিনীকে জিব্রালটার প্রণালি তথা সমুদ্রের অপর পাড়ে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব নেন। নির্দিষ্ট দিনে তারিক বিন জিয়াদ সমুদ্র অতিক্রম করেন এবং পাড়ে পৌঁছে সব নৌকা আগুনে পুড়িয়ে ফেলেন। এর মাধ্যমে তারেক তার সঙ্গে থাকা মুসলমান এবং বারবার (অমুসলমান) সৈন্যদের এই বার্তা পৌঁছে দেন যে, যুদ্ধে জয় নইলে শত্রুর হাতে মৃত্যু, এর বাইরে কোনো পথ খোলা নেই তাদের সামনে। এ সময় তারেকের সৈন্য সংখ্যা ছিল সাত হাজার।

পরবর্তীতে তারেকের অনুরোধে উমাইয়া নেতা মুসা তার কাছে আরও পাঁচ হাজার সৈন্য প্রেরণ করেন। সেই তুলনায় রোডরিকের খ্রিস্টান সৈন্য সংখ্যা ছিল তিনগুণেরও বেশি। তাই তারেক সরাসরি সম্মুখযুদ্ধের বদলে মূলত অশ্বারোহী সৈন্য দ্বারা ‘হিট অ্যান্ড রান’ কৌশল অবলম্বন করেন। এর ফলে দ্রুতই পরিস্থিতি মুসলমানদের পক্ষে আসতে থাকে। অপরদিকে রোডরিকের সঙ্গে যোগ দেওয়া বিভিন্ন অঞ্চলের সেনারা যুদ্ধের বদলে নিজেদের জীবন বাঁচাতে তৎপর থাকে। এই সুযোগে মরিয়া হয়ে ওঠে মুসলমানরা। যার ফলে যুদ্ধ ক্ষেত্রেই ২৮ রমজান প্রাণ হারান রোডরিক। রক্তে গড়াগড়ি খায় তার দেহ আর লাল রক্তের উপর ওড়ে মুসলমানদের সবুজ পতাকা।

 

মঙ্গোলদের পতন ২৫ রমজান

বর্তমান ইসরায়েলের অন্যতম শহর জেরুজালেমের উত্তরে পাহাড় ও উপত্যকা বেষ্টিত এলাকা জাজরিল। এই উপত্যকায় দুটি কৃষিনির্ভর গ্রাম গড়ে উঠেছিল মাঝখানের একটি কূপ ও ঝরনাকে কেন্দ্র করে, যা ইংরেজিতে হারোড ¯িপ্রং আর আরবিতে আইন জালুত নামে পরিচিত। এই এলাকাতে ইংরেজি ১২৬০ সালের ৩ সেপ্টেম্বর অর্থাৎ আরবি ৬৫৮ হিজরির ২৫ রমজান তারিখে মুসলমান ও তাদের পক্ষের অমুসলিম সম্প্রদায় এবং মঙ্গোলদের মধ্যে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়, যা ইতিহাসে আইন জালুতের যুদ্ধ নামে পরিচিত। ত্রয়োদশ শতকে মঙ্গোলিয়ার দুর্ধর্ষ সেনাপতি ও বিভিন্ন মঙ্গোল গোষ্ঠীর নেতা চেঙ্গিস খাঁর স্বপ্ন ছিল সব শক্তিকে দূর করে সমগ্র পৃথিবীর সম্রাট বা শাসক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার। বহুদেশ জয়ের পর ১২২৭ সালে এই নির্মম ও রক্তপিপাসু যোদ্ধার মৃত্যু ঘটে। পরবর্তীতে তার বংশধররা প্রায় ১৫০ বছর দাপটের সঙ্গে মঙ্গোল সাম্রাজ্য শাসন করেন এবং চরম বর্বরতার মধ্য দিয়ে একের পর এক দেশ ও রাজ্য জয় করতে থাকেন। এরই ধারাবাহিকতায় ১২৫১ সালে মংকি খান মঙ্গোল সম্রাটের দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং তার ভাই আরেক দুর্ধর্ষ মঙ্গোল রণবীর হালাকু খানকে সঙ্গে নিয়ে দাদার স্বপ্ন পূরণ অর্থাৎ সমগ্র বিশ্ব শাসনের উদ্যোগ নেন। এরই অংশ হিসেবে প্রায় পাঁচ বছর যাবৎ সৈন্য সংগ্রহের পর ১২৫৬ সালে হালাকু খান একের পর এক রাজ্য জয় করতে থাকেন। স্বেচ্ছায় আধিপত্য মেনে নেওয়া কিংবা আত্মসমর্পণ করার নির্দেশ দেওয়া হতো একেকটি রাজ্যকে। এর অন্যথা হলেই রাজ্যের ধ্বংস এবং অবাধ্য শাসকের করুণ মৃত্যু অনিবার্য ছিল। এই নীতির কারণে বহু রাজ্য স্বেচ্ছায় তার সঙ্গে যোগ দেয়। তার সৈন্য সংখ্যা ও শক্তি বৃদ্ধি পায়। ১২৫৮ সালে বাগদাদ ধ্বংস ও আব্বাসীয় সাম্রাজ্যের পতন ঘটিয়ে তিনি ইতিহাস কাঁপিয়ে দেন। তার আরেকটি বিশাল অর্জন ছিল, তৎকালীন শক্তিশালী রাজ্য সিরিয়া জয় এবং দামেস্কের পতন। এরপর তার নজর পড়ে মিসরের সাম্রাজ্যের ওপর। ১২৬০ সালে হালাকু খান মিসরের রাজধানী কায়রোতে মিসরের সম্রাট কুতুজের কাছে আত্মসমর্পণের বার্তা পাঠান। যার সারমর্ম হলো ‘... আমাদের ঘোড়াগুলো দ্রুতগামী, আমাদের তীর তীক্ষè, আমাদের তলোয়ার বজ্রের মতো, আমাদের হৃদয় পাহাড়ের মতো কঠিন। আমাদের সৈন্য সংখ্যা বালুর মতো অগণিত, কোনো দুর্গই আমাদের বাধা নয়, কোনো সেনাবাহিনী আমাদের রুখতে পারবে না। আমাদের বিরুদ্ধে তোমাদের কোনো প্রার্থনা কাজে আসবে না। কান্না আমাদের চালিত করে না এবং শোক বা মাতম আমাদের স্পর্শ করে না। অতএব...’

আত্মসমর্পণের এই বার্তা মেনে নিতে পারেনি মুসলমান ও মামলুকরা। ফলে এই বার্তাবাহককে হত্যা করা হয় এবং বাহকের খ-িত মস্তক কায়রোর জুলাইলা নামক প্রবেশ দ্বারে ঝুলিয়ে রাখা হয়। ঠিক এ সময়ে হালাকু খানের ভাই মঙ্গোল সম্রাট মংকে খানের মৃত্যু ঘটে। নতুন নেতা হওয়ার আশায় সব মঙ্গোল নেতা তখন মঙ্গোলিয়ায় পাড়ি জমান, একই পথ অনুসরণ করেন হালাকু খান। সঙ্গে নিয়ে যান নিজ সৈন্য দলের অধিকাংশ সৈন্য। তার রেখে যাওয়া সৈন্যদের প্রধান ছিলেন কিবুকা নয়ান। এই সুযোগে মিসরের শাসক কুতুজ মঙ্গোলদের প্রতিহত ও বিতাড়িত করার লক্ষ্যে দ্রুত প্রস্তুতি নেন এবং সৈন্যদের নিয়ে ফিলিস্তিন যাত্রা করেন। আশপাশের অনেক অমুসলিম রাজ্য তখন মুসলমানদের সঙ্গে যোগ দেয়। এ সময় মঙ্গোলরা জর্ডান নদী অতিক্রম করে সিরিয়ার দিকে অগ্রসর হয়। এ খবর পেয়ে মিসরের শাসক কুতুজ তার সৈন্যদের নিয়ে দক্ষিণ-পশ্চিমে সিরিয়ার জাজরিল উপত্যকার আইন জালুতে অবস্থান নেন। সেখানে ২৫ রমজানে যুদ্ধটি হয়েছিল। এলাকা সম্পর্কে যথার্থ জ্ঞান ছিল মুসলমানদের। তাই মুসলমানরা একটি দলকে পাহাড়ে লুকিয়ে রাখে। অন্যদিকে বাইবাস নামক এক সেনাপতিকে দিয়ে একটি সৈন্যদল পাঠানো হয় মঙ্গোলদের আক্রমণ করে পালিয়ে আসতে। এই ‘হিট অ্যান্ড রান’ কৌশলে বিভ্রান্ত হয়ে যায় মঙ্গোল বাহিনী। মুসলমানরা পালিয়ে যাচ্ছে ভেবে কিবুকা নয়ান মঙ্গোল বাহিনী নিয়ে তাদের ধাওয়া করে এবং পাহাড়ি এলাকায় ঢুকে পড়ে। এই সুযোগেরই অপেক্ষায় ছিল মিসরীয় বাহিনী। আচমকা তারা পাহাড় থেকে বেরিয়ে মঙ্গোলদের ঘিরে ফেলে। অনেক চেষ্টা করেও এই ফাঁদ থেকে বের হতে পারেনি মঙ্গোলরা। এক পর্যায়ে প্রাণ হারান মঙ্গল প্রধান কিবুকা। অচিরেই মঙ্গোলদের পতন ঘটে এবং ১০ হাজার সৈন্যের প্রায় সবাই মারা যায়। ২৫ রমজানের এই যুদ্ধ পরবর্তীতে আরব জাতির ইতিহাসের বাঁকে পরিণত হয়।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর