শুক্রবার, ২৩ আগস্ট, ২০১৯ ০০:০০ টা

আউলিয়া হজরত শাহজালাল (রহ.)

বহুমুখী গুণাবলি ও আধ্যাত্মিক ক্ষমতার কারণে হজরত শাহজালাল (রহ.) বাংলার মুসলিম সমাজে বহু গুণবাচক উপাধিতে ভূষিত। এই উপমহাদেশে ধর্ম-বর্ণ, শ্রেণি নির্বিশেষে জনসাধারণের মাঝে তাঁর প্রতি ভালোবাসা ও নামের মাহাত্ম্য ব্যাপক। তিনি বহু বছর আগে ইহলোক ত্যাগ করলেও তাঁর জ্যোতির্ময় অস্তিত্ব আমাদের মাঝে বিদ্যমান। আমরা তাঁর কাছ থেকে আল্লাহ ও রসুল (সা.) এর প্রতি প্রেম-ভালোবাসার তৃষ্ণা নিবারণের জন্য শুদ্ধতার সঞ্জীবনী লাভ করি। আল্লাহপ্রেমী আউলিয়া হজরত শাহজালাল (রহ.) এর জীবনী নিয়ে বিশেষ আয়োজন।

তানিয়া তুষ্টি

আউলিয়া হজরত শাহজালাল (রহ.)

বাংলায় এলেন দ্বীনের দাওয়াত নিয়ে

  ভারতীয় উপমহাদেশকে ইসলামের আলোয় আলোকিত করার ক্ষেত্রে যাদের নাম সবচেয়ে উজ্জ্বল তিনি হজরত শাহজালাল (রহ.) তাঁদের অন্যতম। এদেশের সুফি, দরবেশ, আউলিয়াগণের মাঝে তাঁর প্রভাব ও মর্যাদা সবচেয়ে বেশি লক্ষণীয়। সবার কাছে শাহজালাল (রহ.) নামে পরিচিত হলেও তাঁর পুরো নাম শেখ শাহজালাল কুনিয়াত মুজাররদ। ৭০৩ হিজরি মোতাবেক ১৩০৩ ইংরেজি সালে ৩২ বছর বয়সে তিনি ইসলাম ধর্ম প্রচারের লক্ষ্যে বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলে এসেছিলেন বলে ধারণা করা হয়। সিলেট আগমনের সময়কাল নিয়ে যদিও বিভিন্ন অভিমত রয়েছে, তবু শাহজালালের সমাধির খাদিমগণের প্রাপ্ত ফার্সি ভাষার একটি ফলক-লিপি থেকে উল্লিখিত সন-তারিখই সঠিক বলে ধরা হয়। সিলেটে তাঁর মাধ্যমেই ইসলামের বহুল প্রচার ঘটে। এই অঞ্চলে ধর্ম-বর্ণ, শ্রেণি নির্বিশেষে জনসাধারণের মাঝে তাঁর প্রতি ভালোবাসা ও নামের মাহাত্ম্য ব্যাপক ও অতুলনীয়। সিলেট বিজয়ের পরে শাহজালালের সঙ্গী-অনুসারীদের মধ্য থেকে অনেক পীর-দরবেশ এবং তাদের পরে তাদের বংশধরগণ সিলেটসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে গিয়ে বসবাস করেন। শাহজালালের সফরসঙ্গী ৩৬০ জন আউলিয়ার সিলেট আগমন ইতিহাসের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। মৃত্যুর পর তাঁকে সিলেটেই কবর দেওয়া হয়। ইবনে বতুতার বর্ণনা অনুসারে গবেষকগণের মতে, হজরত শাহজালাল  ইয়েমেনি (রহ.) ৭৪৬ হিজরি সনের ১৯ জিলকদ ইন্তেকাল করেন। সে মতে তাঁর ১৫০ বছর জীবনকাল ধরে জন্ম সাল হয় (৭৪৬-১৫০)= ৫৯৬ হিজরি। হিজরি ষষ্ঠ শতকের শেষাংশে মক্কার কোরাইশ বংশের একটি শাখা মক্কা শহর হতে হেজাজ ভূমির দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্তে ইয়েমেন প্রদেশে গিয়ে বসবাস করেন। এই শাখার হজরত শেখ মুহাম্মদ তাবরিজি (রহ.) শাহজালাল (রহ.) এর বাবা। তিনি একজন কোরাইশ বংশীয় স্বনামধন্য খ্যাতিমান দরবেশ ছিলেন। সুহেলি ইয়ামনিতে উল্লিখিত তথ্য মতে, হজরত শাহজালাল (রহ.) এর জন্মভূমি ছিল প্রাচীন আরবের হেজাজ ভূমির তৎকালীন প্রদেশ ইয়ামেনের কুনিয়া নামক শহর। শাহজালাল যখন তিন মাসের শিশুবালক, তখনই তাঁর মায়ের মৃত্যু হয় এবং পাঁচ বছর বয়সে বাবাকে হারান। এই অবস্থায় অসহায় এতিম শিশু শাহজালালকে মামা সৈয়দ আহমদ কবির সোহরাওয়ার্দী (রহ.) দত্তক নেন। আহমদ কবির তাকে আরবি ভাষায় কোরআন হাদিস শিক্ষা দেওয়াসহ ইসলাম ধর্মের প্রাথমিক বিষয়ে (নামাজ, রোজায়) অভ্যস্ততার গুরুত্ব প্রদান করেন।

 

 

মাজার শরিফে ছুটে যান ভক্তরা

প্রীতির নিদর্শনস্বরূপ তিনি তাঁকে একজোড়া সুরমা রঙের কবুতর বা জালালি কবুতর উপহার দেন। সিলেট ও এর আশপাশের অঞ্চলে বর্তমানে যে সুরমা রঙের কবুতর দেখা যায় তা ওই কপোত যুগলের বংশধর।

সিলেট নগরের মধ্যখানে টিলার ওপর চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন হজরত শাহজালাল (রহ.)। তার মাজার জিয়ারতের জন্য দেশের নানা প্রান্ত থেকে প্রতিদিনই ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে হাজার হাজার মানুষ সিলেটে আসেন। মাজার চত্বরের উত্তর দিকে রয়েছে একটি পুকুর। এই পুকুরে আছে অসংখ্য গজার মাছ। এসব মাছকে পবিত্র জ্ঞান করে দর্শনার্থীরা ছোট ছোট মাছ খেতে দেন। হজরত শাহজালাল (রঃ) এর আধ্যাত্মিক শক্তির পরিচয় পেয়ে হজরত নিজামুদ্দিন আউলিয়া (রহ.) তাঁকে সাদরে গ্রহণ করেন। প্রীতির নিদর্শনস্বরূপ তিনি তাঁকে একজোড়া সুরমা রঙের কবুতর বা জালালি কবুতর উপহার দেন। সিলেট ও এর আশপাশের অঞ্চলে বর্তমানে যে সুরমা রঙের কবুতর দেখা যায় তা ওই কপোত যুগলের বংশধর। এগুলো জালালি কবুতর নামে খ্যাত। মাজারের পাশেই রয়েছে একটি কূপ। এই কূপে সোনা ও রুপার রঙের মাছের অবস্থান প্রত্যক্ষ করা যায়। চারপাশ পাকা এই কূপে দিনরাত পানি প্রবাহিত হয়। মাজারের পশ্চিম দিকে গেলে ঝরনা দেখতে পাওয়া যায়। মাজারের দক্ষিণ দিকে গ্রিলঘেরা তারকাখচিত ছোট্ট ঘরটি শাহজালালের চিল্লাখানা। স্থানটি মাত্র দুই ফুট চওড়া। কথিত আছে হজরত শাহজালাল (রহ.) এই চিল্লাখানায় জীবনের ২৩ বছর আরাধনায় কাটিয়েছেন। দরগার পার্শ¦বর্তী মুফতি নাজিমুদ্দিন আহমদের বাড়িতে হজরত শাহজালালের তলোয়ার ও খড়ম সংরক্ষিত আছে। প্লেট ও বাটি সংরক্ষিত আছে দরগাহর মোতওয়াল্লির বাড়িতে।

 

পুণ্যভূমি সিলেট

হজরত শাহজালাল (রহ.) বাংলাদেশের সিলেটে আগমনের আগে একটি স্বপ্ন দেখেন। সেই স্বপ্নের বৃত্তান্ত পীর মুরশিদ ও মামা সৈয়দ আহমদ কবির সোহরাওয়ার্দী (রহ.) এবং সঙ্গীয় পীর বাহাউদ্দীন  সোহরাওয়ার্দীর কাছে বর্ণনা করেন। স্বপ্নের বৃত্তান্ত শুনে তারা অবিলম্বে হিন্দুস্তান যাত্রার আদেশ দেন। স্বপ্নের ইঙ্গিত মতে, মুরশিদ একমুষ্ঠি মাটি তাঁর হাতে দিয়ে বলেন, এই মাটির বর্ণ, গন্ধ ও স্বাদ যেখানে পাবে সেখানেই তুমি অবস্থান ঠিক করবে। তিনি আরও বললেন, এই মাটির মুষ্ঠি যে স্থানে খুলবে সে স্থানের মহত্ত্বের আর তুলনা থাকবে না। এই নির্দেশনা পেয়ে হজরত শাহজালাল আর দেরি করলেন না। সঙ্গে বহুসংখ্যক ভক্ত-আশেকান নিয়ে সিলেটের উদ্দেশে তিনি যাত্রা শুরু করলেন। কিন্তু তিনি যখন সিলেট পৌঁছেন তখন বাংলার শাসক ছিলেন সুলতান শামসুদ্দীন ফিরোজ শাহ। তার আমলে ৭০৩ হিজরিতে শাহজালাল ইয়েমেনি আধ্যাত্মিক শক্তির সাহায্যে সিলেট বিজয় করেন। বর্ণিত আছে যে, গৌর গোবিন্দ কর্তৃক শেখ বুরহানুদ্দীনের শিশুপুত্র হত্যার প্রতিশোধের উদ্দেশ্যে পাঠানো সিকান্দার গাজীর বাহিনী গৌর গোবিন্দের ক্ষমতার কাছে বার বার পরাজিত হয়। অবশেষে হজরত শাহজালাল (রহ.) ও তাঁর অনুসারী ৩৬০ আউলিয়াসহ গৌর গোবিন্দের এই ক্ষমতাকে পরাজিত করে সিলেট জয় করেন। সেখানেই তিনি দীর্ঘদিন থাকেন। নিজের প্রভাব বিস্তার করেন সমাজের সর্বস্তরে। দিনে দিনে তার ধর্মীয় জ্ঞান-গরিমার বিস্তার সবার আত্মতুষ্টি অর্জন করে নেয়। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত হজরত শাহজালাল (রহ.) সিলেটে ছিলেন। ওফাতের একদিন আগে তাঁর মুরিদগণকে ডেকে বললেন, তোমরা আল্লাহর প্রতি ইমান রাখবে, আল্লাহকে ভয় করবে। আল্লাহর হুকুমে কাল আমি তোমাদের কাছ থেকে বিদায় নেব। পরের দিন জোহরের নামাজের শেষ সিজদায় থাকা অবস্থায় তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন। পাশেই অলৌকিকভাবে একটি কবর খোদিত অবস্থায় পাওয়া যায়। সেই কবরে কাফন ও খুশবু-আতর মজুদ ছিল। মুরিদগণ তখন হজরতকে কাফন পরিয়ে জানাজা সম্পন্ন করে দাফন করলেন।

 

দ্বীনের আলো ছড়ালেন সব ক্ষেত্রে

হজরত শাহজালাল (রহ.) এর প্রেমময় দ্বীনের আলোয় আলোকিত পুরো বাংলাদেশ। এ দেশের জনগণের ধর্মীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক জীবনে, লোক সাহিত্যে, ধ্রুপদী সাহিত্যে, শিক্ষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, সব ক্ষেত্রেই হজরত শাহজালাল ইয়েমেনি (রহ.) এর প্রভাব  পাওয়া যায়। চিশতিয়া তরিকার বুজর্গগণের মালফুয়াত, বিভিন্ন ঐতিহাসিকের উক্তি  বাংলার শাসকদের বিভিন্ন স্থাপনা ও শিলালিপি, তাঁর নামে স্থানের নামকরণ ও মুদ্রার প্রচলন তা প্রমাণ করে। বাংলার ইতিহাসে এমন কোনো শাসকের দরবার নেই যা হজরত শাহজালাল ইয়েমেনি (রহ.) এর দরবারের অনুগ্রহে অনুগৃহীত হতে চায়নি। এ দেশের রাজনৈতিক শাসক যারাই হোক না কেন, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে আপামর জনগণের হৃদয়ের মণিকোঠায় শ্রদ্ধা ও ভক্তির সঙ্গে সমাসীন হজরত শাহজালাল (রহ.)। তিনি এই অঞ্চলের মুকুটহীন সম্রাট। আর এ কারণেই সিলেটকে বাংলাদেশের আধ্যাত্মিক রাজধানী ও পুণ্যভূমি হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।

 

ছিলেন অন্যতম বুজুর্গ

এতিম শিশু হজরত শাহজালাল ইয়েমেনি (রহ.) এর লালন-পালন ও শিক্ষা-দীক্ষার ভার ছিল বুযুর্গ মামা সৈয়দ আহমদ কবির সোহরাওয়ার্দী (রহ.) এর ওপর। তিনি সোহরাওয়ার্দীয়া তরিকার একজন প্রখ্যাত সুফি দরবেশ এবং মক্কার বিশিষ্ট আলেম ছিলেন। পর্যটক ইবনে বতুতার বর্ণনায়-  হজরত শাহজালাল (রহ.) কে তাঁর মুরিদ কর্তৃক মাওলানা সম্বোধন করা হতো। তিনি একজন প্রাজ্ঞ আলেম ছিলেন। এ ছাড়াও হজরত শায়খ আবু সাঈদ তাবরিজি (রহ.), হজরত বাহাউদ্দিন সোহরাওয়ার্দী (রহ.) ও হজরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতি (রহ.) এঁর মতো জগৎ খ্যাত তরিকতের ইমাম ও বুজুর্গ দরবেশ সাধকগণের শিষ্যত্ব ও সান্নিধ্য এবং যুগের দিকপাল মহান মনীষীগণের সঙ্গে গভীর বন্ধুত্ব থাকাটাও প্রমাণ করে যে, হজরত শাহজালাল ইয়েমেনি (রহ.) আধ্যাত্মিক অতিন্দ্রীয় জ্ঞান তো বটেই ইন্দ্রীয়গ্রাহ্য জ্ঞানরাজ্যের বিভিন্ন শাখায়ও বুৎপত্তিসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব ছিলেন।

 

আধ্যাত্মিকতার অনন্য উদাহরণ

হজরত শাহজালাল (রহ.) এর জ্ঞান-গরিমা, আধ্যাত্মিকতা ও অলৌকিকতার খবর বিশ্ববিদিত। প্রচলিত কাহিনী অনুযায়ী, ইয়েমেনের বাদশাহও তার ব্যাপারে জানতেন। একবার শুনলেন হজরত শাহজালাল (রহ.) ইয়েমেনে আসছেন। তখন বাদশাহর ইচ্ছা হলোÑ তাঁর আধ্যাত্মিকতা পরীক্ষা করার। যথারীতি হজরত শাহজালাল (রহ.) সহ সঙ্গীদের আপ্যায়ন করা হলো বিষ মেশানো শরবত দিয়ে। কিন্তু দেখা গেলো, সে শরবত পান করেও সবাই সুস্থ। কিন্তু স্বয়ং বাদশাহ সাধারণ শরবত খেয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছেন! প্রচলিত তথ্য অনুসারে, হজরত শাহজালাল (রহ.) তার আধ্যাত্মিকতার বলে শরবতের বিষের ব্যাপারে জানতে পেরেছিলেন। সিলেট নগরীর প্রধান নদী সুরমার পানি বেশিরভাগ সময়ই ঘোলা থাকে। তাই মানুষের খাবার পানির সংকট নিরসন করা যাচ্ছিল না। এমন পরিস্থিতিতে এলাকাবাসী গেলেন হজরত শাহজালাল (রহ.) এর কাছে। তিনি সব শুনে আল্লাহর কাছে  মোনাজাত করলেন। যখন মোনাজাত শেষ হলো তখন একটি গায়েবি আওয়াজে একটি কূপ খননের নির্দেশ পেলেন। সবাই মিলে তার দরবারের পাশে একটি কূপ খনন করলেন। এরপর এক শুক্রবার কূপের কাছে গিয়ে হাতে থাকা লাঠি উঁচিয়ে ধরলেন। আঘাত করা মাত্র গায়েবিভাবে নিচ থেকে পানি আসতে শুরু করল। শুধু পানিই নয়, পানির সঙ্গে করে রং-বেরঙের মাগুর, কৈ প্রভৃতি মাছও আসতে শুরু করল। সে মাছের বংশধরদের এখনো দেখতে পাওয়া যায়। তাঁর আধ্যাত্মিকতার আরও উদাহরণ মেলে তাঁর উদ্দেশে পাঠানো হজরত নিজামুদ্দীন আউলিয়া (রহ.) এর আগুনে মোড়ানো রুটি পাঠানোর গল্পে। কিন্তু হজরত শাহজালাল (র:) না দেখেই জেনে গিয়েছিলেন এর ভিতরে কী আছে। কিন্তু  রুটির কৌটাটি খুলে খেতে শুরু করলেন আগুনের টুকরোগুলোকে। আর অলৌকিকভাবে এ আগুন সুস্বাদু খাদ্যে পরিণত হয়ে গেল।

সর্বশেষ খবর