স্বাধীনচেতা টিপুর দেশাত্মবোধের দৃঢ়তার সঙ্গে খুব ভালোভাবেই পরিচিত ছিল ইংরেজ শাসকরা। তারা মোটেই স্বস্তিতে থাকত না সাহসী বীরযোদ্ধা টিপু সুলতানের ব্রিটিশবিরোধী আচরণে। তার মতো ভারতের স্বাধীনতা নিয়ে এত ভাবেননি আর কোনো শাসক। তিনি একাধারে ছিলেন প্রচ- ধার্মিক মুসলিম ও অন্যান্য ধর্মের প্রতি সহানুভূতিশীল। শের-ই-মহীশুর টিপু সুলতানের সাহসী রাজ্য পরিচালনা, বিচিত্র জীবনযাপন ও প্রভাব-প্রতিপত্তি নিয়ে বিস্তারিত থাকছে আজকের রকমারি আয়োজনে-
মহীশুরের বাঘ
ব্রিটিশ ভারতের মহিশূর রাজ্যের শাসনকর্তা ছিলেন টিপু সুলতান। তিনি শের-ই-মহীশুর নামে পরিচিত ছিলেন। উপাধিটা তখন ইংরেজদেরই দেয়। তার এই বাঘ (শের) হয়ে ওঠার পেছনে মূল কারণ হিসেবে ধরা হয় অসাধারণ ক্ষীপ্রতা, দক্ষতা, বুদ্ধিমত্তা আর কৌশলপূর্ণ রাজ্য পরিচালনা। বাবার সুযোগ্য উত্তরসূরি ছিলেন টিপু সুলতান। তার বাবা হায়দার আলী মহীশুর রাজ্যের সেনাপতি ছিলেন। নেপোলিয়ন বোনাপার্ট এর বন্ধু ছিলেন হায়দার আলী। বাবা হায়দার ১৭৪৯ সালে টিপু নামে এক ফকিরের কাছ থেকে দোয়া লাভ করেন। তারপর ১৭৫০ সালের ২০ নভেম্বর ঘর আলো করে আসে এক শিশুপুত্র। সেনাপতি হায়দার আনন্দিত হয়ে ওই ফকিরের নামেই ছেলের নাম রাখেন ‘টিপু’। মহীশুরের স্থানীয় ভাষায় ‘টিপু’ শব্দের অর্থ হলো বাঘ। হয়তো তাকে ‘শের-ই-মহীশুর’ ডাকার পেছনে এটাও একটা কারণ ছিল। অত্যধিক সাহসী এই বীর যোদ্ধা ছিলেন ইংরেজদের বিরুদ্ধাচারী। তার তীব্র আকাক্সক্ষা ছিল ভারতকে স্বাধীন করার। সে জন্য তাকে ভারতের বীরপুত্রও বলা হয়। টিপু সুলতান বিশ্বের প্রথম রকেট আর্টিলারি এবং বিভিন্ন অস্ত্র তৈরি করেন।
শ্রীরঙ্গপত্তনম গ্রামে কাবেরি নদীর একটি ব-দ্বীপে নির্মিত একটি দুর্গ থেকে তিনি রাজ্য শাসন করতেন। বর্তমানে গ্রামটি দক্ষিণ ভারতের কর্ণাটক রাজ্যের মান্ডিয়া জেলার অন্তর্গত। টিপু সুলতানের উপদেষ্টা হিসেবে ছিলেন প-িত পুরণাইয়া। তিনি সামরিক তালিম নেন সরদার গাজী খানের কাছ থেকে। তিনি ছিলেন বহুভাষায় পারদর্শী এবং প্রচ- ধার্মিক মুসলিম। নিয়মিত প্রার্থনা করতেন। এলাকার মসজিদগুলোর ওপর তার বিশেষ নজরদারি ছিল। তার শাসনকালে তিনি ১৫৬টি হিন্দু মন্দিরে নিয়মিত অর্থ বরাদ্দ দিতেন। বরাদ্দ পাওয়া এ রকম এক বিখ্যাত মন্দির হলো শ্রীরঙ্গপাটনার রঙ্গন অষ্টমী মন্দির। অথচ অনেকে মনে করেন টিপু সুলতান এক ধর্মান্ধ মুসলিম যে, হিন্দু ও খ্রিস্টানদের ওপর গণহত্যা চালিয়েছে। অবশ্য তিনি বেশ কিছু সম্প্রদায়ের ওপর অবরোধ আরোপ করেছিলেন। তার এ অবরোধ আরোপের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল কোরোগের হিন্দু, ম্যাঙ্গালোরের খ্রিস্টান, মালাবারের নাইর, মালাবাবের মাফিলা মুসলিম, মহাদেবী মুসলিম, সোহানুর এবং নিজামবাদ জেলার নবাব। এ অবরোধ আরোপের পেছনে শুধু তার ধর্মীয় কারণ নয় দায়ী ছিল রাজনৈতিক অনেক কারণ।
সুলতানের নান্দনিক গ্রীষ্মকালীন প্রাসাদ
বাবা হায়দার আলী খানের অসমাপ্ত কাজগুলো সম্পন্ন করাকেই ব্রত হিসেবে নিয়েছিলেন মহীশুরের সর্বশেষ স্বাধীন নবার টিপু সুলতান। অন্যান্য কাজের পাশাপাশি বেঙ্গালুরুতে গ্রীষ্মকালীন প্রাসাদ বানানোর কাজটিও করেছিলেন টিপু সুলতান। গ্রীষ্মকালে প্রশাসনিক কর্মকান্ডের জন্য মহীশুর থেকে ব্যাঙ্গালুরুতে প্রাসাদ তৈরি করার বুদ্ধিটা ছিল টিপু সুলতানের বাবা হায়দার আলী খানের। ১৭৮১ সালে বেঙ্গালুরুতে এই প্রাসাদ নির্মাণকাজে হাত দিয়েছিলেন হায়দার আলী। কিন্তু বাবার মৃত্যুর পরও প্রাসাদ নির্মাণ অব্যাহত রাখেন টিপু সুলতান। ১৬০টি পিলার দিয়ে নির্মিত ইট-কাঠের এই প্রাসাদটি নির্মাণ করতে লেগে গেছে ১০ বছর। দোতলায় চারটি ছোট-বড় রুম। একদিক দিয়ে ঢুকে অন্যদিক দিয়ে বেরিয়ে যাওয়া যায় দ্বিতল এই প্রাসাদ থেকে। তখনকার দিনে গরম পড়লে মহীশুর থেকে রাজ-কাজের জন্য প্রয়োজনীয় লোকবল নিয়ে এই প্রাসাদে উঠতেন টিপু সুলতান। ২ প্রান্তে ২টি ব্যালকনি, সেখানে দাঁড়িয়ে অথবা বসেই দিতেন উজির-নাজিরদের নির্দেশনা। প্রাসাদের সৌন্দর্য এখনো আছে ঠিক আগের মতোই। এখানে বসবাসকালে বেঙ্গালুরুর কৃষিকাজে আমূল পরিবর্তন আনতে ৮০ ফুট উঁচু পাথরের পাহাড় কেটে জলাধার নির্মাণ করেছেন, বাণিজ্যিক নগরীতে পরিণত করেছেন শহরকে। মালাবারের সড়কটিও তার আমলে হয়েছে নির্মিত। বেঙ্গালুরুর এই গ্রীষ্মকালীন প্রাসাদে টিপু ১০ বছরে কাটিয়েছেন অসংখ্যবার। তবে টিপু সুলতানের আমলে গড়া প্রাসাদটির জৌলুসে কিছুটা আঘাত হেনেছে ব্রিটিশরা। টিপু সুলতান নিহত হলে এই প্রাসাদটি ব্রিটিশদের হাতে তুলে দেন মহারাজা
কৃষ্ণরাজা ওয়াদেয়ার তৃতীয়। টিপু সুলতানের আমলে এই প্রাসাদে সাধারণের প্রবেশাধিকার ছিল না। কিন্তু টিপু সুলতান নিহত হওয়ার ৯ বছর পর প্রাসাদটি সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। ১৮৩১ সালে এই প্রাসাদটি ব্রিটিশ শাসককের প্রশাসনিক সদর দফতরে পরিণত হয়। সুলতানের প্রতি পুরনো আক্রোশের বশে এই প্রাসাদের একটা অংশ নিলামে বিক্রি করে দেয় ব্রিটিশ শাসকরা। টিপু সুলতানের সিংহাসনটি পর্যন্ত স্থানান্তর করা হয় এখান থেকে। টিপু সুলতানের ব্যবহৃত একটি তরবারি এবং কিছু চিত্রকর্ম এখন এই প্রাসাদের সাক্ষী। মহীশুরে তার শাসনামলের একটা খ-চিত্রও পাওয়া যায় এখানে। প্রাসাদের সামনে লম্বা লন, ঠিক নবাবি আমলের ঐতিহ্য ধরে রেখেছে এখনো।
টিপুর বাঘপ্রীতি
ছোটবেলা থেকেই টিপু, বাঘের গল্প শুনতে ভালোবাসতেন। বাবাই তাকে বাঘের গল্প শোনাতেন। কিশোর বয়সে টিপু সুলতান বাঘ পুষতে শুরু করেন। বাবার মৃত্যুর পর তিনি যখন সিংহাসনে আরোহণ করলেন, তখন বাবার পুরনো সিংহাসনটি তিনি পছন্দ করলেন না। তাই তৎকালীন শ্রেষ্ঠ কারিগর দিয়ে কাঠের ফ্রেমের ওপর সোনার পাত বসিয়ে তাতে মণিমুক্তা ও রত্নখচিত একটি সিংহাসন বানিয়ে নিলেন। আট কোণা ওই আসনটির ঠিক মাঝখানে ছিল একটি বাঘের মূর্তি। ৮ ফুট চওড়া আসনটির রেলিংয়ের মাথায় বসানো ছিল সম্পূর্ণ স্বর্ণে তৈরি দশটি বাঘের মাথা, আর ওপরে ওঠার জন্য ছিল দুধারে রূপার তৈরি সিঁড়ি। আর পুরো ব্যাঘ্রাসনটাই ছিল বাঘের শরীরের মতো ডোরাকাটা। সুলতানের রাজ্যের প্রতীক ছিলো বাঘ। এই বাঘ ছিল তার অনুপ্রেরণার মতো। তার রাজ্যের পতাকায় কানাড়ি ভাষায় লেখা ছিল ‘বাঘই ঈশ্বর’। তিনি সিংহাসনে বসে মাঝে মাঝেই বলতেন, ‘ভেড়া বা শিয়ালের মতো দুই শ বছর বাঁচার চেয়ে বাঘের মতো দুইদিন বেঁচে থাকাও ভালো’ তার সমস্ত পরিধেয় পোশাক ছিল হলুদ-কালো রঙে ছাপানো আর বাঘের শরীরের মতো ডোরাকাটা। তিনি যে তলোয়ার ব্যবহার করতেন, তার গায়েও ছিল ডোরা দাগ। হাতলে খোদাই করা ছিল বাঘের মূর্তি। তার ব্যবহৃত রুমালও ছিল বাঘের মতো ডোরাকাটা। তার রাজ্যের সমস্ত সৈনিকের পোশাকে
থাকত বাঘের ছবি। সৈন্যদের ব্যবহার্য তলোয়ার, বল্লম, বন্দুকগুলোর নল, কুদো, হ্যামারেও আঁকা থাকত বিভিন্ন আকারের বাঘের প্রতিরূপ কিংবা মূর্তি। এমনকি তিনি তার রাজ্যের প্রধান প্রধান সড়কের পাশে, বাড়ির মালিকদের বাড়ির দেয়ালে বাঘের ছবি আকার নির্দেশ জারি করেছিলেন। তখনো তার বাঘ পোষার বাতিক যায়নি। রাজবাড়িতে বেশ কয়েকটি পোষা বাঘ ছিল। ঘরের দরজার সামনে কিছু বাঘ বাঁধা থাকত।
টিপুর মৃত্যুতে ভারত হারায় অভিভাবক ব্রিটিশ করে আনন্দ
ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে যুদ্ধ করেন ‘মহীশুরের বাঘ’ টিপু সুলতান। কিন্তু এক সেনাপতি মীর সাদিকের বিশ্বাসঘাতকতায় ব্রিটিশদের কাছে টিপু পরাজিত হন। ১৭৯৯ সালের ৪ মে টিপু নিহত হওয়ার পর তার পরিবারের মানুষজনকে ভেলোরের দুর্গে বন্দী করে রাখে ব্রিটিশ শাসকরা। এরপর রাজধানী শ্রীরঙ্গপত্তনমে লুটতরাজের এক মহোৎসব শুরু হয়। উইলিয়াম উইল্কি কলিন্সের বিখ্যাত লেখা ‘দ্য মুনস্টোন’ উপন্যাসের প্রথম দৃশ্যটি শুরু হয় এই লুটতরাজের বর্ণনা দিয়ে। টিপু সুলতান যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিন ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়েছেন। তিনি শাহাদাতবরণ করলে শুধু হিন্দুস্থানই নয়, গোটা মুসলিম বিশ্ব যেন স্বাধীনতার এক অতন্দ্র প্রহরী হারিয়ে অভিভাবকহারা অবস্থায় পড়ে যায়। ভগবান এস গিদোয়ানীর তার ‘দ্য সোর্ড অব টিপু সুলতান’ বইতে উল্লেখ করেছেন, ‘মহীশুরের বাঘ’ টিপু সুলতানের মৃত্যু সংবাদ শুনতে পেয়ে ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পরিচালক ব্যক্তি রিচার্ড ওয়েলেসলি সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছিলেন। টিপুর মৃত্যুর পর ‘গোটা ভারতবর্ষই এখন আমাদের’ বলে মন্তব্য করেছিলেন ওয়েলেসলি। ওয়েলেসলির করা মন্তব্য শুনেই বোঝা যায়, ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য সম্প্রসারণে টিপু সুলতান কত বড় বাধা ছিলেন। টিপুর মৃত্যু ছিল তাদের কাছে হাঁফ ছেড়ে বাঁচার মতো। টিপুর মৃত্যুর পর ব্রিটেনেও আনন্দ উল্লাস করা হয়। টিপু সুলতানের শেষ যুদ্ধকে কেন্দ্র করে ইউরোপীয় নামকরা চিত্রকরদের কাজগুলো দেখলে তা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।
সাহসের প্রমাণ রেখেছেন পদে পদে
একবার এক ফরাসি বন্ধুর সঙ্গে টিপু সুলতান সুন্দরবনে গেলেন শিকারে। হঠাৎ বাঘের সামনে পড়ে যান তারা। ঠিক সেই সময়েই হাতে থাকা বন্দুকটি আর কাজ করছে না। অন্য কেউ হলে এমন পরিস্থিতিতে হয়তো ভড়কে যেত কিন্তু টিপু সুলতান ছিলেন আত্মবিশ্বাসী। হাতে থাকা ছোট্ট ছোরা দিয়েই বাঘের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। তারপর বাঘটি হত্যা করে দুজনেই প্রাণে রেহাই পেলেন। এমন বীরত্ব তিনি যুদ্ধের ময়দানেও দেখিয়েছেন। টিপু সুলতানের মতো আর কোনো শাসক মহীশুর রাজ্যকে ব্রিটিশ শাসনমুক্ত করতে মরিয়া হয়ে ওঠেনি। সব সময় তিনি পরিকল্পনা করতেন কীভাবে ব্রিটিশ শাসন থেকে রাজ্যকে বাঁচানো যাবে। তাই তো যুদ্ধাস্ত্রে হয়েছিলেন সমৃদ্ধ। ইংরেজদের সঙ্গে যুদ্ধের সময় তিনি যেসব হাতিয়ার ব্যবহার করেছেন তা ছিল অত্যন্ত আধুনিক মানের এবং ব্যতিক্রমী। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে প্রথম রকেট লাঞ্চার প্রযুক্তি ব্যবহার করেন টিপু সুলতান। ১৭৮৬ সালে টিপু সুলতান ৭২ কামানের ২০টি যুদ্ধজাহাজ এবং ৬২ কামানের ২০টি রণতরী দিয়ে তার নৌবাহিনীকে সুসজ্জিত করেন। ১৭৮৯ সালের মধ্যেই টিপু সুলতানের প্রায় সব জাহাজই তামার পাটাতনে উন্নীত করা হয়। ১৭৯০ সালে তিনি কামালুদ্দিনকে তার ‘মীর বাহার’ পদে নিযুক্ত করেন এবং জামালাবাদ এবং মাজিদাবাদে সুবিশাল ডকইয়ার্ড নির্মাণ করেন।
দ্য টিপুস টাইগার
‘দ্য টিপুস টাইগার’ নামের খেলনাটি গোটা দুনিয়ায় বিখ্যাত হয়ে আছে। এটি তৈরি হয়েছিল ইংরেজ বিদ্বেষ থেকে। এই খেলনায় দম দিয়ে ছেড়ে দিলে একটি অর্গান পাইপ থেকে বাঘের প্রচ- গর্জন আর এক ইংরেজের প্রচ- গোঙানির আওয়াজ বের হতো। পুরো খেলনাটি ছিল এ রকম- একজন ইংরেজ একটি বাঘের থাবার মধ্যে অসহায়ভাবে পড়ে গোঙাচ্ছে আর সেই বাঘ প্রচ- আওয়াজ করে সেই ইংরেজের বুকের ওপর চেপে গলা কামড়ে ধরছে। তখন ইংরেজটি তার হাত উঠিয়ে চেষ্টা করছে বাঘের মাথাটি এদিক-ওদিক সরিয়ে দিতে। ভিতরকার অর্গান থেকে আরও বেরিয়ে আসছে মহীশুর সুলতানের প্রিয় গজলের সুর। ‘টিপুস টাইগার’ বানানোর পেছনে একদিকে যেমন ছিল তার ইংরেজদের প্রতি উষ্মা, তেমনি অন্যদিকে ছিল প্রচ- বাঘপ্রীতি। ১৭৮১ সালে ইংরেজ সেনাপতি হেক্টর মুনরোর ও তার বাহিনীর কাছে দ্বিতীয় মহীশুর যুদ্ধে টিপু ও তার বাবা মারাত্মক নাজেহাল হন। এতে মহীশুরের যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতি হয়, নিহত হয় অনেক সৈন্য। এমনিতেই তিনি প্রচ- ইংরেজবিরোধী ছিলেন, তার ওপর এই পরাজয়ে তিনি আরও বেশি ইংরেজবিরোধী হয়ে ওঠেন। ঘটনাক্রমে ১৭৯৩ সালে হেক্টর মুনরোর একমাত্র ছেলে সুন্দরবনের সাগরদ্বীপে শিকারে গিয়ে বাঘের আক্রমণে নিহত হয়। এই সংবাদ পেয়ে টিপুর মাথায় এই খেলনা বানানোর বুদ্ধি খেলে যায়।
খোয়াবনামায় লেখা আছে ৩৭টি স্বপ্ন বৃত্তান্ত
প্রযুক্তির এই যুগে ডায়েরি লেখার অভ্যাস হয়তো খুব কম মানুষের আছে। বেশ কিছু বছর আগে এই অভ্যাস আরও বেশি ছিল সবার মাঝে। কিন্তু তাই বলে আজ থেকে দুই শ বছরেরও আগে কারও ডায়েরি লেখার অভ্যাস কিছুটা অবাক করবে বৈকি। টিপু সুলতানের ছিল ডায়েরি লেখার অভ্যাস। আর ৭ ইঞ্চি ৫ ইঞ্চির ডায়েরিটি ছিল তার খোয়াবনামা। সুলতানের খোয়াবনামা বলে যে ডায়েরিটি পাওয়া গেছে তার প্রথম ৩২ পাতায় স্বপ্নবৃত্তান্ত ও সামান্য কিছু ব্যক্তিগত ঘটনা লেখা রয়েছে। মাঝখানের বেশ কয়েকটি পাতা একেবারে সাদা। আবার শেষের দিকের ১১ পাতায় থেকে লেখা শুরু হয়েছে। গবেষকদের মতে, তার দেখা প্রতিটি স্বপ্নের বিবরণ এখানে লেখা হয়নি। শুধু যে স্বপ্নগুলো টিপুর মনোজগতে গভীর দাগ কেটেছিল, শুধু সেগুলোই এখানে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। প্রথম স্বপ্নটি লিখেছিলেন ১৭৮৯ সালে এবং সর্বশেষ স্বপ্নটির তারিখ লেখা রয়েছে ১৭৯৮। সব মিলিয়ে ১৩ বছর ধরে বিভিন্ন সময়ে দেখা নির্বাচিত ৩৭টি স্বপ্নবৃত্তান্ত রয়েছে এই ডায়েরিতে। স্বপ্নগুলোর কয়েকটি টিপুর শত্রু ইংরেজ, মারাঠা এবং নিজামের সঙ্গে টিপুর ক্রমাগত যুদ্ধ ও সন্ধি প্রচেষ্টার পটভূমিকা নিয়ে। ১৫টি স্বপ্নে টিপুর যুদ্ধে জয়লাভ এবং সাফল্যের সুসংবাদের ইঙ্গিত রয়েছে। কয়েকটি স্বপ্নে হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রতি তীব্র অনুরাগ এবং গভীর শ্রদ্ধা ফুটে উঠেছে। এ ছাড়া হজরত আলী (রা.) ও অন্যান্য মুসলিম সাধক-সুফির প্রতিও তার ভক্তি ও অনুরাগ নিয়ে কয়েকটি স্বপ্নবৃত্তান্ত রয়েছে। টিপু কখনো কখনো গভীর রাতে স্বপ্ন দেখে ঘুম ভাঙলেই বিছানা ছেড়ে সেই স্বপ্নটি লিখে ফেলতেন। কখনো ভোরে ঘুম থেকে উঠে ডায়েরিতে স্বপ্নের বিবরণ তুলে রাখতেন। এরপর স্বপ্নদর্শনের ব্যাখ্যাদানকারীদের সঙ্গে তার দেখা স্বপ্নের ব্যাখ্যা বুঝতে চাইতেন।