শুক্রবার, ১৮ অক্টোবর, ২০১৯ ০০:০০ টা

হাদিসের সন্ধানে হেঁটেছেন যাঁরা

মেজর নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ (অব.), পিএইচডি

হাদিসের সন্ধানে হেঁটেছেন যাঁরা

জান্নাতুল বাকী

শুরুর কথা

ইসলাম ধর্ম তথা মহাবিশ্বের এক অপার বিস্ময় মহাগ্রন্থ আল কোরআন, যার রচয়িতা মহান আল্লাহ স্বয়ং। এই কোরআন নাজিল হয় মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মাধ্যমে। ফলে কোরআনের বিভিন্ন বাণী ও ঘটনার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে মহানবী (সা.) যা কিছু বলেছেন, তা হাদিস হিসেবে গ্রহণ করেছে মুসলমান জাতি। এ ছাড়াও হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর যাবতীয় বাণী, উপদেশ, বক্তৃতা, জীবনাচার এবং যে কোনো কিছুর সরব বা নীরব অনুমোদন বা সম্মতিকেও হাদিস হিসেবে গণ্য করা হয়। মহানবী (সা.) জীবদ্দশায় বলা এসব কথা বা বাণী পরবর্তীতে তার অনুসারীদের মাধ্যমে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে লিপিবদ্ধ হয় সংকলিত গ্রন্থ হিসেবে। এসব বাণী বা বক্তব্যের বিশুদ্ধতা নিয়ে বিভিন্ন সময়ে অনেক তর্ক-বিতর্ক হয়েছে। তবে দেশ-বিদেশের কয়েকজন মহান সাধক, ইসলামী চিন্তাবিদ ও হাদিস সংগ্রহকারী অক্লান্ত পরিশ্রম করে বেশ কিছু বিশুদ্ধ হাদিস গ্রন্থ সংকলন করেন। এসব হাদিস পরবর্তীতে ইসলামের সমাজব্যবস্থা, রাজনীতি, অর্থনীতি এমনকি পারিবারিক জীবনেও ব্যাপক প্রভাব ফেলে। বিশুদ্ধতার প্রশ্নে মান উত্তীর্ণ এবং সর্বমহলে গ্রহণযোগ্যতার কারণে বিশুদ্ধ হাদিসের সন্ধানে হাঁটা এসব মহান সাধক ও হাদিস সংগ্রহকারীরা অমর হয়ে আছেন ইতিহাসের পাতায়।

 

ইমাম মালিক ইবনে আনাস (রহ.), মদিনা

ইসলামের ইতিহাসে প্রাচীনতম হাদিস সংগ্রহকারীদের একজন ইমাম মালিক ইবনে আনাস (রহ.)। তাঁর পূর্ব পুরুষরা হিজরি দ্বিতীয় সালে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে ইয়েমেন ছেড়ে মদিনায় বসবাস শুরু করেন। এখানেই হিজরি ৯৩ সালে বা ইংরেজি ৭১১ সালে বাবা আনাস ইবনে মালিক এবং মা আলিয়া বিনতে সুরাইয়াকের ঘরে জন্ম হয় ইমাম মালিক ইবনে আনাসের। সংক্ষেপে ইমাম মালিক (রহ.), তাঁর দাদা মালিক ইবনে আবি আমির ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর ইবনে খাত্তাব (রা.)-এর ছাত্র ছিলেন এবং সেই আমলে পশুর চামড়ায় লেখা কোরআনের বাণী বিভিন্ন স্থান থেকে সংগ্রহ করেন। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, ইমাম মালিক (রহ.) ছিলেন ফর্সা ও  লম্বা। সাদা চুল-দাড়ি ও নীল চোখের কারণে তাঁর মাঝে স্বর্গীয় দ্যুতি লক্ষ্য করা যেত। বাল্যকালেই তিনি কোরআন মুখস্থ করে হাফেজ হন। এরপর ইমাম আবু হানিফা (রহ.) সহ আরও অনেক প্রখ্যাত মুসলমান দার্শনিক ও জ্ঞানী ব্যক্তির কাছ থেকে ধর্মীয় শিক্ষা লাভ করেন। কথিত আছে যে, হজরত মুহাম্মদ (সা.) তাঁর জীবদ্দশায় মদিনায় অত্যন্ত জ্ঞানী ইসলামিক চিন্তাবিদের আবির্ভাব সম্পর্কে যে ভবিষ্যৎ বাণী করেছিলেন, তিনিই ইমাম মালিক (রহ.)। ১৭ বছর বয়সে তিনি ইসলাম ধর্মের ওপর অনবদ্য জ্ঞানের কারণে অন্যদের ইসলামী শিক্ষা প্রদান এবং ফতোয়া প্রদানের স্বীকৃতি লাভ করেন। দীর্ঘ ৪০ বছর যাবৎ তিনি বিভিন্ন উৎস থেকে বিশুদ্ধ হাদিস সংগ্রহে নিবেদিত ছিলেন তবে বিশুদ্ধতার বিষয়ে তিনি ছিলেন অত্যন্ত সজাগ।

অগাধ জ্ঞানের অধিকারী হলেও তিনি নিশ্চিত না হয়ে কোনো কিছু বলতেন না এবং অজু না থাকলে কোনো হাদিস উচ্চারণ করতেন না। প্রত্যক্ষদর্শী আল হাতিমের বর্ণনায় জানা যায় যে, একদিন ইমাম মালিক (রা.)-কে ৪৮টি প্রশ্ন করা হলে ৩২ বারই তিনি উত্তর জানা নেই বলেন এবং নিশ্চিত হওয়ায় মাত্র ১৬টি প্রশ্নের উত্তর দেন। আবু মুসআব নামক আরেক বর্ণনাকারীর মতে, ইমাম মালিক (রা.) ৭০ জন ইসলামী চিন্তাবিদ, দার্শনিক ও গুরুর কাছে পরীক্ষা দিয়ে নিজের জ্ঞান সম্পর্কে আগে নিশ্চিত হন এবং পরবর্তীতে হাদিস বর্ণনা ও ফতোয়া দেওয়া শুরু করেন। দীর্ঘ ৪০ বছরের সাধনায় তিনি প্রায় ১০ হাজার হাদিস সংগ্রহ করলেও বিশুদ্ধতার কথা মাথায় রেখে মাত্র ২০০০ হাদিস বর্ণনা করেন। তার রচিত গ্রন্থের সংখ্যা নিয়ে মতভেদ থাকলেও সর্বমোট ৯টি গ্রন্থের বিষয়ে বর্ণনা পাওয়া যায়। তার মধ্যে সবচেয়ে প্রসিদ্ধ হলো আল মুয়াত্তা। মুয়াত্তা শব্দের অর্থ অনুমোদিত। বিশুদ্ধতার কারণে এই বই তথা ইমাম মালিক (রহ.)-এর সব সংগ্রহ ও প্রকাশনাকে ‘গোল্ডেন চেইন’ বলে অভিহিত করেছেন একাধিক ইসলামিক চিন্তাবিদ ও গবেষক। পরবর্তীতে তার পথ ধরে অনেক গবেষক ও হাদিস সংগ্রহকারীর জন্ম হয়, তার সন্তানেরাও ইসলামী জ্ঞান ও প্রজ্ঞায় খ্যাতিমান ছিলেন। তার অন্যতম ছাত্র ইমাম আল সাফী পবিত্র কোরআনের পর ইমাম মালিক (রহ.) রচিত ‘আল মুয়াত্তাকে বিশুদ্ধতম বই হিসেবে গণ্য করেন। এ ছাড়াও তাকে ইসলামী জ্ঞানের আকাশে ‘ধ্রুবতারা বা পথনির্দেশক বলে গণ্য করা হয়। হিজরি ১৭৯ সালের ১০ রবিউল আউয়াল তারিখে (সোমবার) তথা ইংরেজি ৭৯৫ সালে ২২০ দিন রোগভোগের পর মৃত্যুবরণ করেন এই প্রখ্যাত হাদিস সংগ্রহকারী। মসজিদই নববীর নিকটবর্তী জান্নাতুল বাকি কবরস্থানে তাকে কবর দেওয়া হয়। তার স্মৃতি ধরে রাখতে কবরের ওপর একটি স্থাপনা নির্মিত হলে ১৯৩২ সালে অন্য সব মাজারের সঙ্গে এই স্থাপনা ভেঙে ফেলা হয়। তবুও ইমাম মালিক (রা.) বেঁচে আছেন হাদিস বইয়ের পাতায় পাতায় এবং ইসলামী বিচার ব্যবস্থার ওপর রচিত সব বইয়ে।

 

 

ইমাম মুসলিম (রহ.), ইরান

শুদ্ধ এবং সহি হাদিস সংগ্রহ, সংকলন, প্রকাশ ও শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে ইমাম বোখারি (রহ.) প্রদর্শিত পথেই হেঁটেছেন ইমাম মুসলিম ইবনে হাজ্জাজ (রহ.) সংক্ষেপে ইমাম মুসলিম (রহ.) তাঁর জন্ম বর্তমান ইরানের খোরাসান রাজ্যের নিশাপুর অঞ্চলে। তাঁর জন্মসাল নিয়ে মতভেদ

থাকায় ধারণা করা যায় যে ৮১৫ সালের পর পরই তাঁর জন্ম হয় বিখ্যাত কুশাইরী বংশে। তাঁর পূর্ব পুরুষ ছিলেন আরব গোত্রীয় এবং হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর সঙ্গী। পরবর্তীতে এই বংশ ইরানে বসবাস শুরু করে। ইসলামী জ্ঞানে পারদর্শী এবং পারিবারিকভাবে নম্র, ভদ্র, ধার্মিক এবং দয়ালু হিসেবে এই বংশের সুনাম ছিল। এই বংশেই ইমাম হাজ্জাজ (রহ.) এর ঘরে জন্ম নেন ইমাম মুসলিম (রহ.)। পারিবারিক আবহেই তিনি ইসলামী জ্ঞান, বিশেষত হাদিসের ওপর ব্যাপক বিদ্যা অর্জন করেন। পরবর্তীতে স্থানীয় ইসলামী চিন্তাবিদ এবং  জ্ঞানী-গুণীদের সান্নিধ্যে এগিয়ে গেলে তার হাদিসভিত্তিক জ্ঞানের অšে¦ষণ। বিশিষ্ট মুসলমান লেখক এবং গবেষক এস্ সিউতি-এর মতে মাত্র ১৪ বছর বয়সেই তিনি জ্ঞান অন্বেষণে ঘর ছেড়ে ইরানের বসরা গমন করেন। সেখান থেকেই তিনি আরবে পাড়ি জমান এবং হজ শেষে মক্কা ও মদিনায় বিশিষ্ট ওলামাদের কাছ থেকে হাদিস সংগ্রহে মনোনিবেশ করেন। এরপর শুরু হয় তার কঠোর জ্ঞান চর্চা। এ সময় শুদ্ধ ও সহি হাদিসের সন্ধানে দীর্ঘ ১৫ বছর তিনি ইরাক, সিরিয়া মিসরসহ মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ করেন এবং প্রখ্যাত ও ধর্মপ্রাণ প-িতদের কাছ থেকে হাদিস সংগ্রহ করতে থাকেন। দীর্ঘ সাধনা শেষে তিনি নিজ জন্মস্থান নিশাপুরে ফেরত আসেন এবং বিশুদ্ধ হাদিস সংকলনে নিমগ্ন হন। গবেষকদের মতে, দীর্ঘদিনের সাধনায় তিনি বিভিন্ন দেশের প্রায় ২২০ জন ইসলামী গবেষক এবং হাদিস বর্ণনাকারীর কাছ থেকে প্রায় ৩ লাখ হাদিস সংগ্রহ করেন। এরপর শুরু করেন বিশুদ্ধতার নিরিখে যাচাই-বাছাই এবং শ্রেণিবিন্যাসকরণ। তাঁর সময়কার গবেষকদের বর্ণনায় জানা যায়, তিনি সংগৃহীত সব হাদিসকে তিনটি শ্রেণিতে বিভক্ত করেন। ইমাম মুসলিম (রা) সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেন এমন সব হাদিসের ওপর যা তিনি সংগ্রহ করেছিলেন সৎ, জ্ঞানী, সাহসী ও কোনো প্রকার বিতর্ক বা মতভেদের ঊর্ধ্বে থাকা হাদিস বর্ণনাকারী ও ইমামদের কাছ থেকে। দ্বিতীয় শ্রেণিতে স্থান পায় জ্ঞানের দিক থেকে পিছিয়ে থাকলেও সত্যবাদী, সৎ, ধার্মিক ও সাহসী হিসেবে সুপরিচিত ইমাম ও হাদিস বর্ণনাকারীদের কাছ থেকে প্রাপ্ত সব হাদিস। এর বাইরে রাখা হয় সন্দেহ বা বিতর্ক রয়েছে এমন হাদিসগুলো। এ প্রক্রিয়া চলাকালে তিনি ইমাম বোখারি (রহ.)-এর সান্নিধ্য লাভ করেন এবং নিজ সাধনালয়ে অত্যন্ত মর্যাদা দিয়ে তাকে বরণ করে নেন। প্রথমেই তিনি ইমাম বোখারি (রহ.) কর্তৃক সংগৃহীত এবং অনুমোদিত সহি হাদিসের সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত পোষণ করেন। পরবর্তীতে অন্যান্য হাদিস নিয়েও তিনি ইমাম বোখারি (রহ.)-এর পরামর্শ গ্রহণ করেন। এ প্রক্রিয়ায় ইমাম মুসলিম (রহ.) প্রথমে ৪ হাজার হাদিসকে শুদ্ধ ও সহি বলে ধরে নিলেও পরবর্তীতে এই সংখ্যা ২ হাজারে নামিয়ে আনেন। ফলে মুসলিম বিশ্বে আজ বিশুদ্ধতার প্রশ্নে ইমাম বোখারি (রহ.)-এর পাশাপাশি ইমাম মুসলিম (রহ.)-এর স্বীকৃত ও অনুমোদিত হাদিস অত্যন্ত সমাদৃত। ইসলামের ইমান, আকিদা, রীতিনীতি ব্যক্তিজীবন, ব্যবসা-বাণিজ্য, বিচার ব্যবস্থা, জ্ঞান চর্চা, অপরাধ, শাস্তি প্রভৃতি বিষয়ে ইমাম মুসলিম (রহ.) রচিত বইয়ের সংখ্যা নয়টিরও বেশি। তবে বিশুদ্ধ হাদিস সংকলন হিসেবে তার সম্পাদিত ‘সহি মুসলিম শরিফ’ এর কদর বিশ্বজুড়ে বিস্তৃত। তার গুণমুগ্ধ ভক্ত, শিষ্য এবং ছাত্রের সংখ্যা অগণিত। তবে তাদের মধ্যে অন্যতম ইমাম তিরমিজি (রহ.)। দুঃখজনকভাবে তার মৃত্যু হয় বলে জানা যায়। ইরানেরই ইসলামী চিন্তাবিদ এবং লেখক আহাম্মদ ইবনে সালামহ্কে উদ্ধৃত করে আধ ধাহাবি নামক আরেক গবেষক উল্লেখ করেন যে, তৎকালীন প্রথা অনুসারে এক ধর্মীয় সমাবেশে ইমাম মুসলিম (রহ.) বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তরে একের পর এক হাদিস বর্ণনা করেন। মাত্র একটি ক্ষেত্রে তিনি হাদিসের উত্তর দিতে না পেরে বাড়ি ফিরে রাত জেগে সেই হাদিস খুঁজতে থাকেন। এ সময় উপহার হিসেবে প্রাপ্ত একঝুড়ি খেজুর তার সামনে দেওয়া হয়। তিনি হাদিস খুঁজতে খুঁজতে একটি একটি করে খেজুর খেতে থাকেন। সকাল পর্যন্ত এভাবে খেজুর খেয়ে তিনি শেষ পর্যন্ত হাদিসটি খুঁজে পান। পরবর্তীতে তিনি মৃত্যুবরণ করায় ধারণা করা হয় খেজুর খেয়েই তার মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৫৫ বছর। তাকে দাফন করা হয় নিজ গ্রাম ইরানের খোরাসান রাজ্যের নিশাপুরে।

 

ইমাম বুখারী (রহ.), উজবেকিস্তান

সুন্নি মতবাদে বিশ্বাসী মুসলমানদের কাছে হাদিসের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে ‘সহি আল বুখারী’ নামক হাদিস গ্রন্থ। এই গ্রন্থে বর্ণিত হাদিসগুলো বর্ণনা করেছেন ইমাম আল জুফি আল বুখারি। সংক্ষেপে ইমাম বুখারী (রহ.)। ৮১০ সালের ২১ জুলাই বর্তমান উজবেকিস্তানের বুখারাঞ্চলের রাজধানী বুখারা শহরে জন্ম নেন ইমাম বুখারী (রহ.)। তার বাবা ইসমাইল ইবনে ইব্রাহীমও ছিলেন একজন হাদিস সংগ্রহকারী এবং ইমাম মালিক ইবনে আনাস (রহ.)-এর শিষ্য। ইতিহাসবিদ আধ ধাহাবির মতে, মাত্র ১১ বছর বয়সেই তিনি অসংখ্য হাদিস মুখস্থ করেন এবং ইসলামী জ্ঞান লাভ করেন। বাল্যকালে বাবাকে হারিয়ে মায়ের কাছে বেড়ে ওঠা ইমাম বুখারী (রহ.) ১৬ বছর বয়সে সপরিবারে মক্কায় চলে আসেন। মক্কা থেকে হজ পালন শেষে শুরু হয় তাঁর জ্ঞানের সাধনা তথা বিশুদ্ধ হাদিসের সন্ধান। তৎকালে ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানে বিখ্যাত বহু অঞ্চলে সশরীরে উপস্থিত হয়ে তিনি ইসলামী জ্ঞান ও হাদিস সংগ্রহ করেন। কথিত আছে এই সময় তিনি প্রায় ১০০০ ইমাম ও ইসলামী চিন্তাবিদের কাছ থেকে প্রায় ৬ লাখ ইসলামী রীতি-নীতি, ফতোয়া ও হাদিসের  সন্ধান লাভ করেন। অন্য এক বর্ণনায় জানা যায়, ১৮ বছর বয়সে হজ শেষে তাঁর মা ও ভাই বুখারায় ফিরে গেলেও ইমাম বুখারী (রহ.) ২ বছর মক্কায় এবং ৪ বছর মদিনায় জ্ঞানচর্চা করেন। মহান আল্লাহ প্রদত্ত অসাধারণ স্মৃতিশক্তির অধিকারী ছিলেন ইমাম বুখারী (রহ.)। ফলে তিনি সংগৃহীত জ্ঞান বা হাদিস কোথায় না লিখলেও, তা অবিকল  তাঁর স্মৃতিতে গেঁথে থাকত। কথিত আছে, প্রথম দিকে তিনি প্রায় ৭০ হাজার হাদিস মুখস্থ করেন এবং পরবর্তী জীবনে তাঁর মুখস্থকৃত হাদিসের সংখ্যা ৩ লাখে পৌঁছে। ইরাকের রাজধানী বাগদাদে ইমাম বুখারী (রহ.) কে পরীক্ষার জন্য স্থানীয়দের মধ্যে ১০ জন ১০০টি হাদিস সামান্য পরিবর্তন করে তাঁর সামনে পাঠ করেন এবং তাঁর মতামত চায়। তিনি প্রথমে সবাইকে ‘আমার জানা নেই’ বলে উত্তর দেন। একটু পরে তিনি তাদের সবাইকে তাদের পঠিত ভুল বা পরিবর্তিত হাদিস বা বিকৃত হাদিস শুনিয়ে দেন এবং এর বিপরীতে সঠিক ১০০টি হাদিস বলে তাদের সংশোধন করে দেন। পৈতৃক সূত্রে পাওয়া ধন-সম্পদের সবই তিনি দান করে অতি সাধারণ জীবন বেছে নেন। শেষ জীবনে এমনও সময় ছিল যে, তিনি সারা দিনে মাত্র ২টি বা ১টি পেস্তা বাদাম খেয়ে জীবন ধারণ করতেন। ইমাম বুখারী (রহ.) নিজেই বর্ণনা করেন যে, তিনি জ্ঞান ও হাদিসের সন্ধানে অন্তত ১০৮০ জন শিক্ষকের দারস্থ হন। যার অন্যতম বাগদাদের ইমাম আহাম্মদ বিন হানবাল (রহ.)। ইমাম বুখারী (রহ.) এর কাছ থেকে হাদিস শিক্ষা নেওয়া ছাত্রের সঠিক সংখ্যা বলা কঠিন।

তবে ধারণা করা হয় যে, এ সংখ্যা কমপক্ষে ৯০ হাজার, যার অন্যতম অপর তিন হাদিস সংগ্রহকারী ইমাম মুসলিম (রহ.), ইমাম তিরমিজি (রহ.) এবং ইমাম নিসাই (রহ.)। তাঁর সংগৃহীত হাদিসের বিশুদ্ধতা নিয়ে বিতর্কের অবকাশ নেই। তিনি প্রথমেই হাদিস বর্ণনাকারীর জীবন, আচরণ ও গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে গবেষণা করতেন এবং পরবর্তীতে তাঁর কাছ থেকে প্রাপ্ত হাদিস গ্রন্থে স্থান দেওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতেন। সংগৃহীত প্রতিটি হাদিস তিনি মক্কা বা মদিনায় বসে লিখতেন এবং প্রতিবার লিখার আগে নফল নামাজ পড়ে হাদিসের বিশুদ্ধতার  জন্য আল্লাহর সাহায্য কামনা করতেন। এভাবে ১৬ বছরে তিনি ছয়টিরও বেশি বই সম্পাদন করেন, যার অন্যতম ‘সহী আল বোখারী’ বা ‘বোখারী শরিফ’। অসংখ্য হাদিস মুখস্থ করলেও তাঁর সম্পাদিত বইয়ে ৭২৫২টি হাদিস স্থান দিয়েছেন এই মহান ইমাম। শেষ জীবনে নিজ জন্মভূমি বোখারায় ফেরত এসে একটি মাদ্রাসা স্থাপন করেন ইমাম বোখারী (রহ:)। তৎকালীন শাসক তার সন্তানকে উক্ত মাদ্রাসায় পৃথকভাবে পড়াতে বললে ইমাম বোখারী (রহ:) তা প্রত্যাখ্যান করেন, ফলে বোখারা ছেড়ে তাঁকে আশ্রয় নিতে হয় ৩০ মাইল দূরের এক গ্রামে। এখানেই ৬২ বছর বয়সে অর্থাৎ ৮৭০ সালে ইন্তেকাল করেন ইমাম বোখারী (রহ.) খারতাংক নামের সেই নিভৃত গ্রামেই তাঁকে কবর দেওয়া হয়। অনেক বছর অবহেলিত থাকলেও ১৯৯৮ সালে এখানে একটি স্মৃতিসৌধ, মসজিদ ও মাদ্রাসা গড়ে তোলা হয়।

 

ইমাম আবু দাউদ (রহ.), ইরান

ইসলামের ইতিহাসে যুগসেরা বেশ কয়েকজন চিন্তাবিদ, দার্শনিক প-িত ও লেখকের জন্মস্থান বর্তমান ইরানের খোরাসান। এই খোরাসান এলাকার সাজিস্তান গ্রামে হিজরি ২০২ সালে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন ইমাম আবু দাউদ সুলায়মান ইবনে আসহাক, সংক্ষেপে ইমাম আবু দাউদ (রহ.)। বাল্যকাল থেকেই শুরু হয় তার জ্ঞানচর্চা। একদল গবেষকের মতে, ইমাম দাউদ (রহ.) বর্তমান পাকিস্তানের বেলুচিস্তানে জন্মগ্রহণ করেন এবং জ্ঞান অšে¦ষণে সপরিবারে ইরানের খোরাসানে আগমন করেন। জ্ঞান অর্জনের ক্ষেত্রে তাঁর গুরু ছিলেন ইসলামের আরেক দিকপাল ইমাম হানাবিল (রহ.)। এ ছাড়া প্রায় একই বয়সী ইমাম মুসলিম (রহ.) এর সান্নিধ্যেও তিনি হাদিস বিষয়ে বিশেষ জ্ঞান অর্জন করেন। ২০ বছরে পৌঁছানোর আগেই তিনি হাদিস সংগ্রহ ও ব্যাখ্যার জন্য নিজেকে সমর্পণ করেন। এরই মধ্যে ইরাকের বাশরা নগরে হিজরি ২৫৭ সালে এক যুদ্ধের কারণে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় এবং এলাকাবাসী দলে দলে বাশরা এলাকা ত্যাগ করলে নগরটি পরিত্যক্ত হয়। এমনই এক প্রেক্ষাপটে বাশরার গর্ভনর বা শাসক আবু আহাম্মদ স্বয়ং তৎকালে বাগদাদে বসবাসরত ইমাম দাউদ (রহ.) বাড়িতে উপস্থিত হন এবং তাকে বাশরায় যাওয়ার আমন্ত্রণ জানান। গভর্নর আবু আহাম্মদ বাশরাকে ইমাম দাউদ (রহ.)-এর উপস্থিতিতে নতুন করে গড়ে তোলার এবং তার মাধ্যমে দেশ বিদেশের বিখ্যাত ইসলামী প-িত ও জ্ঞানপিপাসুর সমাবেশ ঘটানোর আকাক্সক্ষা প্রকাশ করেন। ইমাম দাউদ (রহ.) বাশরার গভর্নরের আকাক্সক্ষা পূরণে রাজি হন এবং বাগদাদ ছেড়ে বাশরায় চলে আসেন। এখানেই নতুন করে শুরু হয় হাদিস নিয়ে ইমাম দাউদ (রহ.)-এর গবেষণা। হাদিসের বিশুদ্ধতা এবং যোগসূত্র খুঁজতে গিয়ে বর্তমান আরব বিশ্বের বহু দেশ বা অঞ্চল ভ্রমণ করেন। এর ফলে তাঁর সংগ্রহে প্রায় ৫০ হাজার হাদিস জমা হয়। কিন্তু হাদিসে শুদ্ধতার কথা বিবেচনা করে তিনি প্রথমেই ‘সহি’ বা সঠিক হিসাবে বিবেচিত হাদিস বাছাই করেন। দ্বিতীয় পর্যায়ে বাছাই করেন ‘হাসান’ বা গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হাদিস। আর দুর্বল বিবেচিত হাদিসগুলো তিনি তৃতীয় শ্রেণিভুক্ত করেন। এই প্রক্রিয়াজাত করার মধ্য দিয়ে তার সংগৃহীত হাদিসের সংখ্যা ৫০ হাজার থেকে কমিয়ে ৪ হাজার ৮০০ তে নামিয়ে আনেন। দাউদ (রহ.)-এর বিবেচনায় বিশুদ্ধ বা সহি হাদিস গ্রন্থের নাম ‘সুনান আবু দাউদ’ বা আমাদের মাঝে দাউদ শরিফ নামে পরিচিত। তিনি যেমন হাদিস চর্চা করতে গিয়ে অসংখ্য জ্ঞানী-গুণীর সান্নিধ্য লাভ করেছিলেন, তেমনি তাঁর সান্নিধ্যপ্রাপ্ত বহু শিষ্য বা ছাত্র ইসলামের ইমান হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। ইমাম তিরমিজি (রহ.) এদের মধ্যে অন্যতম। তিনি হাদিস সংগ্রহের পাশাপাশি বক্তা হিসেবেও বেশ সুনাম অর্জন করেন। তাছাড়াও হাদিসের দৃষ্টিতে আইন প্রয়োগ ও বিচার পরিচালনা করা এবং কোনো কাগজে লিপি কালি বা অন্য কোনো লেখা দেখে তা কতদিন আগের তা নির্ধারণ করা ইত্যাদি ক্ষেত্রে সর্বজন স্বীকৃত ব্যাখ্যা দিতে সিদ্ধহস্ত ছিলেন। তার সম্পাদিত বইয়ের সংখ্যা ৩৫ বলে দাবি করেন একদল গবেষক, সেখানে ঠাঁই পেয়েছে ১ হাজার ৮৭১টি অধ্যায়।  ৭২ বছর বয়স অর্থাৎ ২৭৫ হিজরির ১৬ শাওয়াল তারিখে (শুক্রবার) ইমাম দাউদ (রহ.) ইরাকের বাশরায় মৃত্যুবরণ করেন।

 

 

ইমাম তিরমিজি (রহ.), উজবেকিস্তান

মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর জন্মস্থান মক্কা থেকে প্রায় ৪ হাজার কিলোমিটার দূরে বর্তমান উজবেকিস্তানের সমরখন্দ এলাকার তিরমিজ নামক স্থানে জন্ম নেন মহান ইসলামী চিন্তাবিদ ও হাদিস সংগ্রহকারী মুহাম্মদ ইবনে ইসাআত তিরমিজি, সংক্ষেপে ইমাম তিরমিজি (রহ.)। এই দূরত্ব ঘুচিয়ে আরব জাহানের পথে-প্রান্তরে ঘুরে শুদ্ধ হাদিস সংগ্রহ করে অমর হয়ে আছেন তিনি। একদল গবেষক তাঁর জন্ম মক্কায় দাবি করলেও অধিকাংশের মতে তাঁর জন্ম বর্তমান উজবেকিস্তানে আনুমানিক ৮২৪-২৫ সালে। তাঁর পূর্বপুরুষ দেশ থেকে অন্য দেশে বসতি স্থাপন করেছেন বলে তথ্য পাওয়া যায়। বিশেষত ইরান এবং ইরাকে সপরিবারে বসবাস এবং ইসলামী জ্ঞানচর্চার মধ্য দিয়ে ইমাম তিরমিজি (রহ.) এর শৈশব কাটে বলে জানা যায়। ইসলামী জ্ঞানের পাশাপাশি ভাষা, ব্যাকরণ ও বিজ্ঞান বিষয়ে জ্ঞানী ছিলেন তিনি। তাই তার রচনা ভাষাগত ও ব্যাকরণগত শুদ্ধতার বিচারে অনন্য স্থান লাভ করেছে। তবে বিশুদ্ধ হাদিসের সন্ধানে তাঁর পথচলা শুরু হয় আনুমানিক ২০ বছর বয়সে। এই পথযাত্রায় তিনি বিভিন্ন দেশের প্রায় ২০০ ইসলামী চিন্তাবিদ এবং হাদিস সংগ্রহকারীর সান্নিধ্যে আসেন এবং তাদের কাছ থেকে বিশুদ্ধ হাদিস এবং হাদিসের সূত্র বা পরম্পরার সন্ধান করেন। এ ক্ষেত্রে তাঁর দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হয় তৎকালে ইসলামী জ্ঞানে সমৃদ্ধ বসরা ও কুফা নগরে। শুধু কুফা নগরেই তিনি ৪২ জন ইসলামী আলেম ওলামা থেকে হাদিস সংগ্রহ করেন। এ ছাড়াও তাঁর জীবনে আশীর্বাদ হয়ে আসেন আরেক হাদিস সংগ্রহকারী ইমাম বুখারী (রহ.)। ইতিহাস মতে ইমাম তিরমিজি (রহ.) দীর্ঘ পাঁচ বছর ইমাম বুখারী (রহ.) এর সান্নিধ্যে ইরানের নিশাপুর অঞ্চলে অবস্থান করেন এবং সংগৃহীত হাদিসের বিশুদ্ধতার বিষয়ে নিশ্চিত হন। তাই ইমাম বুখারী (রহ.) এর প্রতি তিনি সর্বদা কৃতজ্ঞ ছিলেন। একটি হাদিসের গ্রন্থে ইমাম তিরমিজি (রহ.) ১১৪ বার ইমাম বুখারী (রহ.) এর নাম উল্লেখ করেন। এ ছাড়াও ইরাকের বিভিন্ন এলাকায় তার দীর্ঘদিন হাদিসের সন্ধানের বিচরণের তথ্য রয়েছে। ইমাম বুখারী (রহ.) ছাড়াও তার শিক্ষা এবং কর্মজীবনে ইমাম আদ দারিমী (রহ.), ইমাম মুসলিম (রহ.) এবং ইমাম দাউদ (রহ.) এর প্রভাব লক্ষ করা যায়। তাঁর সংকলিত বিভিন্ন গ্রন্থের মধ্যে ৮টি গ্রন্থ বিশেষভাবে সমাদৃত। তবে তার সংকলিত বিশুদ্ধ হাদিস গ্রন্থ ‘সামাইম মোহাম্মদীয়া’ অথবা ‘সামাইল আততিরমিজি’ অথবা জামি আততিরমিজি’ ইসলামী বিশ্বে বিশেষভাবে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। তার সংকলিত ৩ হাজার ৯৬২টি হাদিস শুদ্ধতার নিরিখে বিতর্কের ঊর্ধ্বে। ৮৭০ সালে ইমাম বুখারী (রহ.) মৃত্যুবরণ করলে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন ইমাম তিরমিজি (রহ.)। দীর্ঘদিনের সঙ্গী, পরামর্শক ও শিক্ষক ইমাম বুখারী (রহ.) এর শোকে প্রায়ই কান্নাকাটি করতেন ইমাম তিরমিজি (রহ.)। এ ছাড়াও পরকালের চিন্তা ও আল্লাহর ভয়েও কেঁদে বুক ভাসাতেন তিনি। শেষ জীবনে তিনি কিছুই চোখে দেখতেন না। তাই তাঁকে অনেক গবেষক ‘লাকাব’ বা ‘আজ জারির’ উপাধি দেন, যার অর্থ দৃষ্টিহীন। অনেকেই আবার তাঁকে জন্মান্ধ বললেও ইতিহাস তা সমর্থন করে না। নিজ জীবনে তিনি যেমন কেঁদেছেন, তেমনি অসংখ্য ভক্ত ও শিষ্যদের কাঁদিয়ে ৮৯২ সালের ৯ অক্টোবর পরকালে পাড়ি জমান ইমাম তিরমিজি (রহ.)। জীবনের শেষভাগে তিনি নিজ জন্মস্থান উজবেকিস্তানের তিরমিজে ফেরত আসেন এবং ইসলামী শিক্ষা বিস্তারে নিবেদিত হন। এখানেই তাঁর মৃত্যু ঘটে। মৃত্যুর পর তিরমিজ থেকে ৬০ কিলোমিটার দূরে শিরাবদ নামক স্থানে তাকে দাফন করা হয়। বর্তমানে সেখানে একটি স্মৃতিসৌধ রয়েছে। ১৯৯০ সালে তাঁর জন্মের ১২০০তম বার্ষিকী উদযাপন করা হয় এই স্মৃতিসৌধে।

 

 

সর্বশেষ খবর