শুক্রবার, ৬ ডিসেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

মহানবী (সা.)-এর স্মৃতিধন্য মসজিদ

মেজর নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ (অব.) পিএইচডি

মহানবী (সা.)-এর স্মৃতিধন্য মসজিদ

পৃথিবীর বুকে প্রথম মসজিদ কাবা (মক্কা)

পবিত্র কোরআনের তৃতীয় সূরা আল ইমরানের ৯৬তম আয়াতে উল্লিখিত আছে যে, ‘নিঃসন্দেহে মানুষের জন্য সর্বপ্রথম যে ইবাদত গৃহটি নির্মিত হয়, সেটি বাক্কায় (মক্কায়) অবস্থিত। তাকে কল্যাণ ও বরকত দান করা হয়েছিল এবং সমগ্র বিশ্ববাসীর জন্য হেদায়েতের দিশারি (কেন্দ্রে) পরিণত করা হয়েছিল।’ আর এই পবিত্র গৃহ (কাবা) নির্মাণের তথ্য রয়েছে পবিত্র কোরআনের দ্বিতীয় সূরা বাকারার ১২৭ নম্বর আয়াতে, যেখানে বলা হয়েছে হজরত ইব্রাহিম (আ.) এবং তাঁর পুত্র হজরত ইসমাইল (আ.) কাবাগৃহের ভিত্তি গড়ে তুলেছিলেন। পরবর্তীতে যুগের পরিক্রমায় তা অবিশ্বাসীদের দখলে চলে যায়। বিভ্রান্ত এই মানুষদের অন্ধকার থেকে আলোর পথে আনার জন্যই পৃথিবীতে মহানবী (সা.)-এর আগমন ঘটে। তবে পরিপূর্ণভাবে ইসলাম প্রতিষ্ঠা এবং মূর্তিপূজার বদলে পবিত্র কাবাঘরে নামাজ আদায়ের প্রথা চালু করতে মহানবী (সা.)-কে অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষার মধ্য দিয়ে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। ৬১০ সালে নবুয়ত লাভের পর থেকেই হজরত মুহাম্মদ (সা.) মক্কাবাসীকে ইসলামের দাওয়াত দিতে থাকেন। কিন্তু বংশ পরম্পরায় মূর্তিপূজায় অভ্যস্ত মক্কাবাসী তা কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি। বরং মহানবী (সা.)-এর কণ্ঠরোধ, একঘরে করে রাখা এমনকি তাঁকে হত্যার প্রচেষ্টা চালাতে থাকে। ৬১৯ সালে মহানবী (সা.) তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রী ও অর্থনৈতিক ভিত্তি হিসেবে স্বীকৃত মা খাদিজা (রা.)-এর মৃত্যু ঘটে। একই বছর তিনি তাঁর আশ্রয়দাতা এবং এতিম জীবনের অবলম্বন চাচা আবু তালিবকে হারান। ফলে হজরত মুহাম্মদ (সা.) নিজের নিরাপত্তা ও ইসলামের স্বার্থে মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করেন। মদিনায় শক্তি সঞ্চয় করে ৬২৯-৩০ সালের রমজান মাসে মক্কায় ফিরে আসেন এবং মক্কানগরী জয় করে পবিত্র কাবাঘরে প্রবেশ করেন। কাবাঘর তখন দেব-দেবীর মূর্তি এবং চিত্রকলায় পরিপূর্ণ ছিল। মহানবী (সা.) তার প্রিয় উটে বসেই হাতের লাঠির সাহায্যে বেশ কিছু মূর্তি মাটিতে ফেলে দেন। মূর্তির অনেক শক্তি এবং মূর্তিই তাদের রক্ষাকারী বলে বিশ্বাস ছিল মক্কাবাসী মূর্তি উপাসকদের। কিন্তু চোখের সামনে এসব মূর্তির মাটিতে লুটিয়ে পড়া এবং খন্ডবিখন্ড হয়ে যাওয়া দেখে সে বিশ্বাস নিমিষেই উবে যায়। অন্যদিকে সাধারণ ক্ষমা ও মুসলমানদের উদারতায় মুগ্ধ হয়ে মক্কাবাসী দলে দলে ইসলামের পতাকাতলে জড়ো হতে থাকে। মহানবী (সা.) তাঁর প্রিয় সাহাবি হজরত বিলাল (রা.) এর মাধ্যমে কাবা চত্বরের মূল ঘরের চাবি সংগ্রহ করেন এবং কাবার ভিতরে থাকা এসব মূর্তি ও দেব-দেবীর ছবি অপসারণ করেন। জমজম কূপের পবিত্র পানি দিয়ে কাবাঘরের ভিতর ও বাইরের দেয়ালে আঁকা সব ছবি ধুয়ে ফেলা এবং মুছে দেওয়া হয়। এ সময় জোহরের নামাজের সময় হলে হজরত বিলাল (রা.) কাবাঘরের ওপর দাঁড়িয়ে তাঁর স্বভাবজাত আবেগী ও সুরেলা কণ্ঠে উচ্চস্বরে আজান দেন। এই আজানের পর মহানবী (সা.) তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে কাবাঘরে জোহরের নামাজ আদায় করেন। পরবর্তীতে তিনি যতদিন মক্কায় ছিলেন, প্রায় ততদিনই কাবা চত্বরে নামাজ আদায় করেন। তাই কাবা আজ ‘বায়তুল্লাহ’ বা আল্লাহর ঘর এবং ‘মসজিদ আল হারাম’ বা পবিত্র মসজিদ নামে সুপরিচিত এবং বিশ্বের সবচেয়ে বড় মসজিদ হিসেবে স্বীকৃত। একাধিক হাদিস মতে, কাবা চত্বরে এক রাকাত নামাজ আদায় করলে অন্যত্র এক লাখ রাকাত নামাজ আদায়ের সওয়াব লাভ করা যায়।

 

নামাজের প্রচলন ও মসজিদের কথা

মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মাধ্যমে একজন মুসলমান মহান আল্লাহর আনুকূল্য এবং নিজের পাপ মোচনের বেশ কিছু প্রার্থনার রীতি বা ধর্মীয় রীতি-নীতি লাভ করে- যার অন্যতম নামাজ (আরবিতে সালাত)। মহানবী (সা.) নিজে নামাজ পড়েছেন, তাঁর অনুসারীদের নামাজ আদায়ের পদ্ধতি শিখিয়েছেন এবং আবশ্যিক কর্তব্য হিসেবে নামাজ আদায়ের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। পবিত্র কোরআন এবং হাদিসে বহুভাবে নামাজ আদায়ের সুফল এবং অনাদায়ে কঠোর শাস্তির কথা উল্লেখ রয়েছে। ৬২১ সালে অর্থাৎ মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের পূর্ববর্তী বছরে মহানবী (সা.) মহান আল্লাহতায়ালার দিদার লাভের জন্য সপ্তম আসমানে গমন করেন, যা ইসলামের ইতিহাসে ইসরা বা শবেমেরাজ নামে পরিচিত। মহান আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাৎকালে তিনি তাঁর উম্মতের জন্য রহমত ও ক্ষমা লাভের শ্রেষ্ঠ মাধ্যম হিসেবে নামাজ বা সালাত লাভ করেন। প্রথমে ৫০ ওয়াক্ত নামাজের আদেশ দেওয়া হয়েছিল। তবে মহানবী (সা.) তাঁর উম্মতের কথা বিবেচনা করে মহান আল্লাহর কাছে নামাজের ওয়াক্ত কমানোর ফরিয়াদ জানালে তা পাঁচ ওয়াক্তে নামানো হয়, যা আজো বিদ্যমান। উল্লেখ্য, মহানবী (সা.) শবেমেরাজের (৬২১ সাল) প্রায় ১১ বছর আগে (৬১০ সাল) মক্কার অদূরবর্তী হেরা পর্বতের গুহায় নবুয়তপ্রাপ্ত হন এবং পবিত্র কোরআনের বাণী এবং ওহি লাভ শুরু করেন। এই ১১ বছরে হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর আহ্বানে সাড়া দিয়ে তাঁর স্ত্রী মা খাদিজা (রা.), চাচাতো ভাই ও জামাতা হজরত আলী (রা.), শ্বশুর হজরত আবু বকর (রা.) এবং পালিত পুত্র জিয়াদসহ আরও অনেকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। এই ১১ বছর মহানবী (সা.) এবং তাঁর সঙ্গীরা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এবং বিপদসঙ্কুল জীবন অতিবাহিত করেন। এ সময় প্রকাশ্যে নামাজ পড়া বড় ধরনের বিপদের কারণ হতে পারত। তাই গোপনে বা প্রকাশ্যে- কীভাবে মহানবী (সা.) ও তাঁর সঙ্গীরা (৬১০ থেকে ৬২১ সাল (শবেমেরাজ) পর্যন্ত নামাজ আদায় কিংবা অন্য ইবাদত করেছেন, তা নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন তথ্য পাওয়া যায়। তবে এ বিষয়ে সবাই একমত যে, নামাজের পরিপূর্ণতা লাভ এবং নিয়মিত ও প্রকাশ্যে নামাজের প্রচলন শুরু হয় শবেমেরাজের (৬২১ সাল) পর থেকে। ফলে শবেমেরাজের পর গড়ে ওঠা মদিনা এলাকার বেশ কিছু মসজিদ এবং আগেই নির্মিত কাবাঘরে বিধর্মীদের দেবদেবীর মূর্তি সরিয়ে নামাজ আদায় করেছেন শান্তির দূত মহানবী (সা.)। কালের বিবর্তনে মহানবী (সা.)-এর স্মৃতিধন্য এসব মসজিদের আকার ও অবয়ব পরিবর্তন হলেও মুসলমানদের আবেগ আর ইসলামের ইতিহাসের আলোকে এসব মসজিদ পৃথিবীর বুকে অমূল্য সম্পদ হিসেবে বিবেচিত।

 

দুই কিবলার মসজিদ কিবলাতাইন

ইসলাম ধর্মে কিবলা বলতে সুনির্দিষ্ট একটি লক্ষ্যবস্তু বা দিককে বোঝানো হয়, যেদিকে মুখ করে মুসলমানগণ নামাজ আদায় করেন। আর কিবলা শব্দের দ্বিবচন হলো ‘কিবলাতাইন’ বা দুই কিবলা। মদিনা অঞ্চলে বর্তমানে মদিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিকটবর্তী স্থানে অবস্থিত মসজিদে কিবলাতাইন বা দুই কিবলার মসজিদ। ইতিহাস এবং হাদিসের আলোকে জানা যায়, হজরত মুহাম্মদ (সা.) নামাজ আদায়ের প্রত্যক্ষ নির্দেশ পান শবেমেরাজের সময় অর্থাৎ ৬২১ সালে। এরপর থেকে তিনিসহ সব মুসলমান জেরুজালেমের আল-আকসা মসজিদকে কিবলা গণ্য করে নামাজ আদায় করতেন। পরবর্তীতে হিজরতের পর মহানবী (সা.) ওহি বা কোরআনের বাণীর আলোকে (সূরা বাকারা আয়াত নম্বর ১৪৪) কিবলা পরিবর্তনের আদেশপ্রাপ্ত হন। এই আয়াতের একটি অংশে বর্ণিত হয়েছে যে, ‘...সুতরাং তুমি মসজিদুল হারাম (কাবা)-এর দিকে মুখ ফিরাও। তোমরা যেখানেই থাক না কেন, কাবার দিকে মুখ ফিরাও।’ পবিত্র কোরআনের এই বাণী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মাধ্যমে যখন এই মসজিদে পৌঁছে, তখন মসজিদের মুসল্লিগণ মদিনার উত্তরে অবস্থিত জেরুজালেমের দিকে মুখ করে নামাজ আদায় করছিলেন। কিবলা পরিবর্তনের আদেশ পাওয়ায় নামাজরত ইমাম এবং অন্য মুসল্লিগণ সঙ্গে সঙ্গে কিবলা পরিবর্তন করে মদিনার দক্ষিণে অবস্থিত কাবার দিকে মুখ করে অবশিষ্ট নামাজ আদায় করেন। এ ঘটনার পর থেকেই মসজিদটি ‘মসজিদে কেবলাতাইন’ বা দুই কিবলার মসজিদ নামে পরিচিত। দীর্ঘদিন ধরে মসজিদটিতে দুটি ‘মেহরাব’ বা ইমামতির জন্য বর্ধিত অংশ ছিল। পরবর্তীতে সংস্কারকাজ এবং মসজিদের আয়তন বৃদ্ধির সময় কেবল একটি মেহরাব রাখা হয়। সৌদি আরবের ‘দি এরাব নিউজ’ সংবাদপত্রের ২০১৮ সালের ৩ জুন তারিখের এক প্রতিবেদনে উল্লিখিত যে, হিজরি দ্বিতীয় সালে সাওয়াদ বিন ঘানাম বিন কাব এই মসজিদ নির্মাণ করেন। পত্রিকা মতে, শাবান মাসের ১৫ তারিখে হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর ইমামতিতে জোহর নামাজ আদায়ের সময় এই কিবলা পরিবর্তনের ঘটনা ঘটে। তবে ঠিক কার ইমামতিতে বা কোন ওয়াক্তের নামাজের সময় এই ঘটনা ঘটে, তা নিয়ে বিভিন্ন তথ্য পাওয়া যায়। মহানবী (সা.) কর্তৃক ইসলাম প্রচারের ঊষালগ্নে প্রতিষ্ঠিত মদিনার এই মসজিদে হজরত মুহাম্মদ (সা.) কর্তৃক নামাজ আদায়ের তথ্য উল্লিখিত আছে বিভিন্ন গ্রন্থে।

 

মদিনার অহঙ্কার মসজিদে আল নববী 

মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর নিজ হাতে গড়া মসজিদের নাম ‘মসজিদে আল নববী’। পৃথিবীর বুকে দ্বিতীয় বৃহত্তম এবং মক্কার পর দ্বিতীয় পবিত্রতম স্থান হিসেবে স্বীকৃত এই মসজিদ। মক্কায় শত্রুদের অত্যাচারে টিকে থাকা দুরূহ হয়ে পড়ায় মহানবী (সা.) ৬২২ সালে মদিনায় হিজরত করেন। মদিনাবাসী প্রিয় নবী (সা.)-কে নিজগৃহে বা নিজেদের গোত্রে ঠাঁই দিতে এক অঘোষিত

প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হন। মহানবী (সা.) কাউকে সন্তুষ্ট বা অসন্তুষ্ট না করে ঘোষণা দেন যে, তাঁকে বহনকারী প্রিয় উট যেখানে নিজ থেকে থেমে যাবে, সেখানেই তিনি বসবাস করবেন। এই ঘোষণা মতে দেখা যায় এই উট মদিনাবাসী আবু আইয়ুব আনসারী (রা.)-এর বাড়ির সামনে খেজুর শুকানোর কাজে ব্যবহৃত খোলা স্থানে মহানবী (সা.)-কে নিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে। এই সুযোগ পরমানন্দে গ্রহণ করেন আবু আইয়ুব (রা.)। তিনি উটের দড়ি ধরে তা বাঁধার ব্যবস্থা করেন এবং নিজের ঘরে প্রিয় নবী (সা.)-এর থাকার ব্যবস্থা করেন। অন্য এক বর্ণনায় দেখা যায়, ওই স্থান সাহল এবং সুহাইল নামক এতিম দুই ভাইয়ের জমি। এই জমিতে কিছু খেজুরগাছ এবং গৃহপালিত পশু একসঙ্গে রাখার ব্যবস্থা ছিল। এই জমি উপযুক্ত মূল্যে কিনে নেন হজরত মুহাম্মদ (সা.)। পরবর্তীতে এই জমির ওপর গড়ে ওঠে পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম মসজিদ আল নববী। মসজিদ গড়ার জন্য প্রথমে এলাকাটি পরিষ্কার করা হয়। তারপর পাথর ও কাদার সংমিশ্রণে মসজিদের ভিত ও পাশের দেয়াল নির্মাণ করা হয়। আর উপরে ছাদ বা চাল হিসেবে খেজুরগাছের কান্ড এবং ডাল বা পাতা ব্যবহার করা হয়, যা ইবাদতকারীদের ছায়া দিতে সক্ষম ছিল। বিভিন্ন সূত্র মতে, প্রাথমিক অবস্থায় মসজিদে আল নববী ছিল দৈর্ঘ্যে ৩০ মিটার এবং প্রস্থে ৩৫ মিটার। পরবর্তীতে মহানবী (সা.)-এর জীবদ্দশাতেই অধিক সংখ্যক মুসল্লি এবং নতুন ইসলাম গ্রহণকারীদের স্থান করে দেওয়ার উদ্দেশ্যে বর্ধিত করা হয়। মহানবী (সা.)-এর প্রিয় এই মসজিদে তিনটি দরজা ছিল। দক্ষিণ দিকের দরজার নাম ছিল ‘বাবে রহম’, যা রহমত বা করুণা লাভের আশায় মুসল্লিরা ব্যবহার করতেন। উত্তর দিকের দরজা দিয়ে মহান আল্লাহর বার্তাবাহক ফেরেশতা জিব্রাইল (আ.) ওহি নিয়ে প্রবেশ করতেন বিধায় এই দরজার নাম দেওয়া হয় বাবে জিব্রাইল। আর পূর্ব দিকের ‘বাবে নিসা’ নামক দরজা মহিলাদের ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত ছিল। এই মসজিদের পাশেই মহানবী (সা.) সপরিবারে বসবাস করতেন। মসজিদের ভিতরে এবং বাইরে দেশ-বিদেশের বহু প্রতিনিধি এবং কাফেলার আগমন ঘটে এবং হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর দর্শন লাভ এবং ইসলাম গ্রহণের সৌভাগ্য ঘটে। কালের পরিক্রমায় মসজিদের আকার এবং মসজিদ চত্বরের আয়তন বৃদ্ধি পেলেও মূল মসজিদের অংশটুকু আজো সাদা ও সবুজ কার্পেটে আচ্ছাদিত, যা ‘রিয়াদুল জান্নাহ’ বা ‘বেহেশতের বাগান’ নামে পরিচিত। মদিনা তথা মসজিদ আল নববী যেমন নবী করিম (সা.)-কে পেয়ে ধন্য হয়েছে, তেমনি তিনিও হৃদয় থেকে ভালোবাসতেন এই মসজিদকে। তাই মক্কা বিজয়ের পরও তিনি তাঁর জন্মভূমি মক্কা ছেড়ে মদিনায় ফিরে আসেন এবং মসজিদে নববীর পাশেই চিরনিদ্রায় শায়িত হন। এই মসজিদে নামাজ আদায় অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ।

 

হিজরতের পর প্রথম মসজিদে কুবা

পবিত্র কোরআনের নয় নম্বর সূরা তওবার ১০৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘... যে মসজিদের ভিত্তি প্রথম দিন থেকেই ধর্ম-কর্মের জন্য স্থাপিত হয়েছে ওখানেই নামাজের জন্য তোমার দাঁড়ানো উচিত। ওখানে পবিত্র হতে চায়- এমন লোক তুমি পাবে, আর যারা পবিত্র হয় আল্লাহ তাদের পছন্দ করেন।’ তফসিরবিদদের মতে, হিজরতের পথে মদিনার অদূরে মহানবী (সা.) এবং তাঁর সঙ্গীদের হাতে গড়া প্রথম মসজিদে কুবার প্রতি ইঙ্গিত করে এই আয়াত নাজিল হয়েছিল। ৬১০ সালে নবুয়তপ্রাপ্তির পর ১২ বছর মহানবী (সা.) চরম প্রতিকূল পরিবেশে মক্কায় ইসলাম প্রচারে সচেষ্ট ছিলেন। অতঃপর একান্ত বাধ্য হয়ে মহানবী (সা.) তাঁর চাচাতো ভাই হজরত আলী (রা.)-কে নিজ গৃহে রেখে গোপনে মক্কায় উদ্দেশ্যে হিজরত শুরু করেন। এ সময় হজরত আবু বকর (রা.) তাঁর সঙ্গী ছিলেন। প্রথমে তিন দিন তিনি মক্কার বাইরে একটি গুহায় লুকিয়ে ছিলেন। এ সময় শত্রুরা বহু অনুসন্ধান করেও তাঁকে খুঁজে পায়নি। এরপর তিনি মদিনার পথে প্রায় আট দিন হেঁটে এবং উটের পিঠে চড়ে প্রায় ৩২০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দেন এবং মদিনার অদূরে কুবা নামক গ্রামে পৌঁছান। স্থানীয় অধিবাসীরা এখানে মহানবী (সা.)-কে স্বাগত জানান এবং সম্মান ও শ্রদ্ধার আসনে অধিষ্ঠিত করেন। মহানবী (সা.) মক্কায় রেখে আসা হজরত আলী (রা.) এবং তাঁর সঙ্গীদের জন্য প্রায় চার দিন অপেক্ষা করেন। এ সময় তিনি কুবায় কুলহাম বিন হাদম (রা.)-এর সম্মতিতে তাঁর জমির ওপর নামাজ আদায়ের উদ্দেশ্যে একটি মসজিদ নির্মাণ শুরু করেন, যা মহানবী (সা.) কর্তৃক ইসলাম প্রচার শুরুর পর প্রথম মসজিদ বা কুবা মসজিদ নামে আজো সুপরিচিত এবং হাজীদের কাছে একান্ত দর্শনীয়। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, মহানবী (সা.) নিজে পিঠে পাথর বহন করে মসজিদের ভিত্তি ও দেয়াল নির্মাণে সাহায্য করেন। এ সময় তাঁর পবিত্র দেহ এবং কাপড়ে ধুলা লাগতে থাকে। সঙ্গীরা বাধা দিলেও তিনি কঠোর পরিশ্রম করেই মসজিদ গড়ায় সাহায্য করেন। কিছুদিন (কারও মতে চার দিন) মসজিদের কাজে নিয়োজিত থাকা অবস্থায় হজরত আলী (রা.) মহানবী (সা.)-এর পরিবারের সদস্যসহ কুবায় পৌঁছেন। এরপর হজরত মুহাম্মদ (সা.) কুবা ছেড়ে মদিনার পথে যাত্রা করেন। কুবায় অবস্থানকালে মহানবী (সা.) বেশ কয়েক ওয়াক্ত নামাজ এই মসজিদে আদায় করেন এবং কখনো কখনো নামাজে ইমামতি করেন। এই মসজিদে নামাজ আদায়ের ফজিলত সম্পর্কে একাধিক হাদিস রয়েছে। বর্তমানে আদি মসজিদ বিলুপ্ত করে বৃহদাকারে নতুন মসজিদ নির্মিত হয়েছে। আদি মসজিদের জন্য জমি দানকারী কুলহাম বিন হাদম (রা.)-এর ঘরটির কিছু অংশ আজো দেখা যায়।

 

আরও কিছু স্মৃতিময় মসজিদ

আরবিতে ঘামামাহ শব্দের অর্থ মেঘ। ৬৩১ সালে মদিনায় খরা দেখা দেয়। মদিনাবাসীর কষ্টের কথা বিবেচনা করে মহানবী (সা.) মসজিদে নববীর কিছুটা পশ্চিমে অবস্থিত আরেকটি মসজিদে বৃষ্টির জন্য ইসতিসকার নামাজ আদায় করেন। এরপর মদিনা এলাকা মেঘে ঢেকে যায় এবং আল্লাহর রহমতস্বরূপ বৃষ্টি নেমে আসে। সেই থেকে এই মসজিদের নাম ‘মসজিদ আল ঘামামাহ’ বা মেঘের মসজিদ। ৬৩১ সালে মহানবী (সা.) এই মসজিদে ঈদের নামাজও আদায় করেন। মসজিদে নববীর পশ্চিমে আস-সালাম নামক গেট থেকে ৫০০ মিটার দূরে এই মসজিদ অবস্থিত। অতি নিকটে হওয়ায় এই মসজিদ কিছুদিন বন্ধ থাকলেও পরবর্তীতে তা খুলে দেওয়া হয়।

মসজিদ আল নববী থেকে ছয় কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে এবং কুবা মসজিদ থেকে এক কিলোমিটার দূরে অবস্থিত আল জুমাহ মসজিদ। এই মসজিদের আরও কিছু নাম আছে। যেমন- বানি সালিম মসজিদ, আল ওয়াদি মসজিদ, আল ঘুবাইব মসজিদ, আতিকাহ মসজিদ ইত্যাদি। ইতিহাস মতে, মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের সময় মহানবী (সা.) ১২ রবিউল আউয়াল তারিখে কুবা এলাকায় কিছুদিন (কারও মতে চার দিন) অবস্থান করেন। এরপর শুক্রবার সকালে তিনি সঙ্গীদের নিয়ে মদিনার পথে যাত্রা করেন। পথিমধ্যে রানুনা নামক স্থানে একটি ‘ওয়াদি’ বা খালের পাড়ে (পাহাড়ি ঢল নামার স্থান) যাত্রাবিরতি করেন এবং জুমার নামাজ আদায় করেন। পরবর্তীতে এই স্থানের মসজিদটি আল জুমা মসজিদ এবং সমস্ত এলাকাটি জুমা অঞ্চল নামে পরিচিতি পায়।

জুমা মসজিদের ৬০ মিটার উত্তরে আতবান বিন মালিক মসজিদ অবস্থিত। আতবান বিন মালিক নামক ওই এলাকাবাসীর বাবা মালিক বিন ইজলান ছিলেন একজন স্থানীয় নেতা। ইজলানের অনুরোধে মহানবী (সা.) সঙ্গী আবু বকর (রা.)-কে নিয়ে তার বাড়িতে যান এবং একটি কোনায় অবস্থিত ঘরে নামাজ আদায় করেন। ইজলান ও তাঁর পরিবারের অন্য সদস্যরাও তখন মহানবী (সা.)-এর পেছনে সারিবদ্ধ হয়ে নামাজ আদায় করেন। পরবর্তীতে এখানে একটি মসজিদ প্রতিষ্ঠিত হয়, যা আতবান বিন মালিক মসজিদ নামে পরিচিত।

মসজিদ আল নববী থেকে ৫৮০ মিটার দূরে এবং জান্নাতুল বাকি কবরস্থানের ৩৮৫ মিটার দক্ষিণে আল ইসবাহ বা বানি মুয়াইয়াহ বা আল মুবাহালাহ নামে পরিচিত একটি মসজিদ রয়েছে। ইতিহাস মতে, মহানবী (সা.) আল আলিয়াহ নামক স্থান থেকে ফেরার পথে এই মসজিদে প্রবেশ করেন এবং দুই রাকাত নামাজ পড়েন। তাঁর সঙ্গীরাও তাঁকে অনুসরণ করেন। অপর একটি বর্ণনা মতে, মহানবী (সা.) দীর্ঘক্ষণ এই মসজিদে প্রার্থনা করেন এবং মদিনায় দুর্ভিক্ষ, বন্যা এবং হানাহানি বন্ধের জন্য দোয়া করেন। মহান আল্লাহ তাঁর প্রথম দুটি দোয়া কবুল করেন তথা দুর্ভিক্ষ ও বন্যা থেকে মদিনাকে রক্ষা করেন।

মসজিদ আল নববী থেকে ৯০০ মিটার উত্তরে অ্যাসি শুকর মসজিদ বা আবিজা মসজিদ অথবা আবু জাফর গিফারী মসজিদ নামে আরেকটি মসজিদ অবস্থিত, যা পরবর্তীতে ‘সিজদাহ মসজিদ’ নামে পরিচিতি পায়। বিভিন্ন সূত্র মতে, হজরত মুহাম্মদ (সা.) একদা ফেরেশতা জিব্রাইল (আ.)-এর কাছে দরুদ পাঠের ফজিলত সম্পর্কে অবহিত হন। এতে মহানবী (সা.) মহান আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতাস্বরূপ সিজদাহ করেন এবং দীর্ঘক্ষণ সিজদাহরত অবস্থায় থাকেন। এ ঘটনার পর থেকে মসজিদটি ‘সিজদাহ মসজিদ’ নামে পরিচিতি পায়।

শত্রুদের মাঝে আবদ্ধ অবস্থায় মহানবী (সা.) ও তাঁর সঙ্গীরা মসজিদ আল নববী থেকে সাড়ে তিন কিলোমিটার এবং কুবা মসজিদ থেকে এক কিলোমিটার দূরে ‘আল ফাদেখ’ বা আসি সাইয়ামস নামক মসজিদে অবস্থান নেন। এই মসজিদেই অবস্থানকালেই ইসলামে ‘মদ’কে হারাম ঘোষণা করা হয় বলে জানা যায়।

এ ছাড়াও যাত্রাপথে এবং বিভিন্ন যুদ্ধের সময় মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) বেশ কিছু ছোট ছোট মসজিদ এবং অস্থায়ী ইবাদতখানায় নামাজ আদায় করেছিলেন।

 

হাদিসের আলোকে মহানবী (সা.)-এর স্মৃতিধন্য মসজিদ

মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘আমার মসজিদে (মসজিদ আল নববী) একটি প্রার্থনা অন্য হাজার প্রার্থনার চেয়ে উত্তম; তবে ব্যতিক্রম হলো পবিত্র মসজিদ কাবা। পবিত্র মসজিদে (কাবা) একটি প্রার্থনা অন্যত্র এক লাখ প্রার্থনার চেয়ে উত্তম। (সুনান ইবনে মাজাহ-১৪০৬ এবং মুসনাদে আহমাদ-১৪৬৯৪)। হজরত আবু হুরাইরা (রা.) কর্তৃক বর্ণিত, মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘আমার মসজিদে (মসজিদ আল নববী) একটি প্রার্থনা অন্যত্র হাজার প্রার্থনার চেয়ে উত্তম, তবে মসজিদ আল হারাম (কাবা) ব্যতীত।’ সহি বুখারী প্রথম খন্ড ২১তম অধ্যায় ১১৯০ নং হাদিস)

সাহল ইবনে হুনাইফ কর্তৃক বর্ণিত মহানবী (সা.) বলেছেন, যদি কেউ নিজ ঘরে পবিত্র হয়ে কুবা মসজিদে প্রবেশ করে এবং প্রার্থনা করে, তবে সে একটি ওমরা হজের সাওয়াব প্রাপ্ত হবে।’ সুনান ইবনে মাজাহ-১৪১২।

সর্বশেষ খবর