শুক্রবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা
পর্ব ১

একাত্তরের সেইসব নিষ্ঠুরতার ভয়ঙ্কর চিত্র

বিচারপতি ওবায়দুল হাসান

একাত্তরের সেইসব নিষ্ঠুরতার ভয়ঙ্কর চিত্র

প্রতি বছর ১৪ ডিসেম্বর অত্যন্ত ভাবগম্ভীর পরিবেশে বিনম্র শ্রদ্ধায় জাতি পালন করে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। স্মরণ করে জাতির শ্রেষ্ঠ মেধাবী সন্তানদের। জাতির জন্য এটি বেদনাবৃত একটি কালো দিন। সুসংগঠিত পরিকল্পনায় ১৯৭১ সালের এই দিনে জাতির শ্রেষ্ঠ মেধাসম্পন্ন সন্তানদের নির্মমভাবে হত্যা করে পাকিস্তানি দখলদার সেনাবাহিনীর এ-দেশীয় কুখ্যাত দোসর আলবদররা। ১৯৭১ সালে নয় মাসের স্বাধীনতা যুদ্ধকালে বাংলাদেশের ভূখন্ডে সুসংগঠিতভাবে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধ, গণহত্যাসহ এই বুদ্ধিজীবীদের বর্বর হত্যাকান্ডের বিচার চেয়ে আসছিল জাতি। এ লক্ষ্যে ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধুর দৃঢ়তায় প্রণীত হয় ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস (ট্রাইব্যুনালস) অ্যাক্ট, ১৯৭৩। কিন্তু ১৯৭৫-এর আগস্টে সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর সামরিক শাসকদের দৃশ্যমান অনুমোদনে শুরু হয় বিচারহীনতার সংস্কৃতি। অসীম বেদনা বুকে নিয়ে জাতি হতে থাকে রক্তাক্ত। ১৯৭৩ সালে প্রণীত আইনটি থেকে যায় নীরব।

অবশেষে বিচারহীনতার গ্লানি থেকে জাতিকে মুক্ত করার সাহসী উদ্যোগ নেন বঙ্গবন্ধুকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ লক্ষ্যে ২০১০ সালের ২৫ মার্চ গঠিত হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। ২০১২-এর মার্চে গঠিত হয় আরেকটি ট্রাইব্যুনাল। শুরু হয় শীর্ষস্থানীয় রাজাকার, আলবদর ও পাকিস্তানি দখলদার সেনাবাহিনীর শক্তিধর দোসরদের বিচারকাজ। বিচার শুরু হয় শহীদ বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডের। বিচারকার্য সম্পন্ন করে ২০১৩ সালের ৩ নভেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এই ‘বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডের’ মূলনায়ক আশরাফুজ্জামান খান ওরফে নায়েব আলী খান এবং চৌধুরী মইন উদ্দীনকে দোষী সাব্যস্ত করে রায় ঘোষণা করে। ট্রাইব্যুনালের ওয়েবসাইটে এ রায়সহ ঘোষিত সব রায়ই আপলোডেড রয়েছে। দেখা যায়, এ মামলায় ১১টি চার্জ গঠন করা হয়। ২৫ জন সাক্ষীর মৌখিক সাক্ষ্য ও দালিলিক সাক্ষ্য তথা তথ্যনির্ভর সমসাময়িক দেশি-বিদেশি পত্রপত্রিকার রিপোর্ট বিবেচনায় নিয়ে ট্রাইব্যুনাল প্রতিটি চার্জেই এ দুই অভিযুক্তকে দোষী সাব্যস্ত করে সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করে।

এ ধরনের বর্বর প্রকৃতির আন্তর্জাতিক অপরাধ-সংশ্লিষ্ট মামলায় অভিযুক্তকে দোষী সাব্যস্ত করে দন্ড প্রদানই একমাত্র লক্ষ্য নয়; এই প্রকৃতির মামলার রায়ের মাধ্যমে জাতি বিশেষ করে নতুন প্রজন্ম জানতে পারবে কী অসীম রক্তস্নাত আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি, পেয়েছি প্রিয় মাতৃভূমি ‘বাংলাদেশ’। আর এই নির্মম প্রতিষ্ঠিত সত্যই নতুন প্রজন্মকে স্বাধীনতার চেতনা বুকে ধারণ করতে অনুপ্রাণিত করবে। একই সঙ্গে বিশ্ব ও জানবে এসব সত্য। আর এই সত্যের অংশ হিসেবে বুদ্ধিজীবী হত্যা মামলায় শহীদদের স্বজনদের বুকে জমে থাকা ক্ষত ও নিরন্তর কান্নাকে তাদের ভাষায় তুলে ধরার প্রয়াসেই এই লেখা। একই সঙ্গে রায়ে প্রতিফলিত বিচারকদের বিশ্লেষণপ্রসূত ভাবনাগুলোও প্রাসঙ্গিকভাবে এসে যাবে এই লেখায়।

বিচারকগণ তাঁদের রায়ে উল্লেখ করেছেন- বুদ্ধিজীবী শ্রেণি বাঙালি জাতিগোষ্ঠীর অংশ। এই হত্যাকান্ড প্রকারান্তরে একটি জাতিকে নির্মূলের জন্য পরিকল্পিত ম্যাসাকার। এটি ছিল জাতিকে মেধাশূন্য করার এক নীলনকশা। বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডের দায়ে দোষী সাব্যস্ত করে এ মামলায় মইন উদ্দীন ও আশরাফুজ্জামানকে সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়ার যৌক্তিকতা তুলে ধরে রায়ে বলা হয়- বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডের হিংস্রতা মৌলিক মানবতাবোধের জন্য হুমকি। ইতিহাস বলে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নানা সময়ে বেসামরিক নিরস্ত্র জনগোষ্ঠীকে লক্ষ্য করে নানা ধরনের নৃশংস আক্রমণ হয়েছে। কিন্তু বিশ্বের ইতিহাস এমন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়নি যেখানে জাতির বিবেক সরব মেধাদীপ্ত বুদ্ধিজীবীদের লক্ষ্য করে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়েছে।

এই পাশবিক হত্যাযজ্ঞ শুধু অপরাধীর অপরাধের মাত্রাই বাড়ায়নি, গোটা জাতির হৃদয়ে অবর্ণনীয় এক যন্ত্রণার ছাপ এঁকে দিয়েছে। দশকের পর দশক ধরে জাতি ও শহীদ বুদ্ধিজীবীদের পরিবারের সদস্যরা সেই অব্যক্ত যন্ত্রণা বুকে চেপে আছেন। আইনের অক্ষর এখানে নির্বিকার থাকতে পারে না। বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডে অপরাধের প্রকৃতি, মাত্রা ও গভীরতার বিচারে একমাত্র মৃত্যুদন্ড দেওয়া হলে ন্যায়বিচার করা হবে। ট্রাইব্যুনাল-২ প্রদত্ত রায়ে এসব পর্যবেক্ষণ দেয়। তখন আমি ছিলাম আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২-এর চেয়ারম্যান। আমার সঙ্গে ট্রাইব্যুনালের বিচারিক প্যানেলের অন্য দুই সদস্য বিচারক ছিলেন ব্রাদার জাজ মাননীয় বিচারপতি জনাব মুজিবুর রহমান মিয়া (বর্তমানে হাই কোর্ট বিভাগে কর্মরত) এবং মাননীয় বিচারপতি জনাব মো. শাহীনুর ইসলাম, (বর্তমানে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এর চেয়ারম্যান)।

যেহেতু, অভিযুক্ত দুজনই পলাতক ছিলেন তাই আইনের বিধান অনুযায়ী তাদের পক্ষে স্টেট ডিফেন্স আইনজীবী নিয়োগের জন্য দুজন দক্ষ আইনজীবীর নাম সরকারের কাছে পাঠাই এবং আমাদের মনোনীত আইনজীবীদের সরকার মামলাটি পরিচালনার জন্য রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী বা স্টেট ডিফেন্স আইনজীবী হিসেবে নিয়োগ প্রদান করে। মামলাটি ‘চিফ প্রসিকিউটর বনাম আশরাফুজ্জামান খান ওরফে নায়েব আলী খান ও চৌধুরী মইন উদ্দীন’ এই নামে নামাঙ্কিত হয়। প্রসিকিউশনের পক্ষে মামলা পরিচালনায় অংশগ্রহণকারী আইনজীবীরা ছিলেন চিফ প্রসিকিউটর জনাব গোলাম আরিফ টিপু এবং তাঁর সহযোগী ছিলেন জনাব সৈয়দ হায়দার আলী, জনাব জেয়াদ আল মালুম, জনাব সাহিদুর রাহমান, মিস তুরিন আফরোজ, মিস নুরজাহান মুক্তা ও মিস সাবিনা ইয়াসমিন খান প্রমুখ বিজ্ঞ প্রসিকিউটর। অভিযুক্তদের পক্ষে ছিলেন রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী জনাব আবদুস শুকুর খান (আশরাফুজ্জামানের পক্ষে) এবং মিস সালমা হাই টুনি (চৌধুরী মইন উদ্দীনের পক্ষে)।

যে কোনো অপরাধ-সংশ্লিষ্ট মামলার রায় প্রদান করতে গিয়ে সাক্ষীদের সাক্ষ্য পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যালোচনা করা হয়। এই সাক্ষ্য এবং পারিপাশির্^ক আরও অন্যান্য সাক্ষ্যের ওপর নির্ভর করা হয়। যৌক্তিকভাবে এসবের বিশ্লেষণ করা হয়। এভাবেই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে হয়। আর এটি করতে গিয়ে রায়ে সাক্ষীদের সবটুকু বক্তব্য আলোচনায় আসে না। কেবল প্রদত্ত বক্তব্যের প্রাসঙ্গিক অংশটুকুই তুলে ধরা হয়। এ মামলার রায় প্রচারিত হয়েছে আজ থেকে ছয় বছর আগে। রায়টির সারাংশ এবং ট্রাইব্যুনালের পর্যবেক্ষণ তখনকার দেশি-বিদেশি পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। বর্তমানে পূর্ণাঙ্গ রায়টি সংশ্লিষ্ট নথিতে ট্রাইব্যুনালে সংরক্ষিত আছে। যেহেতু, দন্ডিত দুজন আইনে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আত্মসমর্পণের পর এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে কোনো আপিল দায়ের করেননি তাই বিষয়টি আর সাবজুডিস বা বিচারাধীন নয়। এটি এখন একটি পাবলিক ডকুমেন্ট বা গণদলিল। ট্রাইব্যুনালের ওয়েবসাইটে এবং আইসিসি লিগ্যাল টুলস প্রজেক্টের ওয়েবসাইটেও তা আপলোডেড রয়েছে। যে কেউ চাইলেই এ রায় সেখান থেকে পেতে পারেন, পড়তে পারেন।

যেহেতু এ মামলার রায় ও সাক্ষ্য সবই এখন পাবলিক ডকুমেন্ট, সেহেতু আমি ভাবলাম মহান বিজয়ের এই মাসে দেশের মানুষের জানার অধিকার আছে বিশেষ করে এই মামলার সাক্ষীগণ ট্রাইব্যুনালে এসে স্বজন হারানোর বেদনা ব্যক্ত করতে গিয়ে কী বলে গেছেন। এই সাক্ষীগণের মধ্যে অনেকেই শহীদদের সন্তান বা নিকটাত্মীয় এবং তাদের স্বজন ও কাছের মানুষ। এই মামলার সাক্ষীগণ ট্রাইব্যুনালে যে কথাগুলো বলে গেছেন তা সবই বলেছিলেন বাংলায় এবং সেভাবেই তা লিপিবদ্ধ করা হয়। কিন্তু রায় যেহেতু ইংরেজিতে লেখা সেহেতু সংগত কারণেই ইংরেজিতে অনুবাদ করেই তা রায়ে তুলে ধরা হয়েছে। ট্রাইব্যুনাল ও এর বিচারিক কার্যক্রমের প্রতি শুরু থেকেই বৈশ্বিক দৃষ্টি ও আগ্রহ রয়েছে। আমাদের ট্রাইব্যুনালের দেওয়া সব রায়ই বিশ্বের বিভিন্ন দেশের যেসব সংস্থা ও গবেষক, আন্তর্জাতিক অপরাধ, গণহত্যা প্রভৃতি নিয়ে কাজ করেন তাঁরা দেখেছেন। রায় প্রদানের মাধ্যমে যে সত্য, জাতির যে আত্মত্যাগের বিষয়টি বেরিয়ে আসে তা তাদের কাছে ও বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্যই ইংরেজিতে রায় লেখার প্রয়াস। সাক্ষীদের আবেগের কথা রায়ে সামান্যই উল্লেখ আছে। কেননা রায়ে এর সবটুকু প্রতিফলিত করা বেশ কঠিন।

১৪ ডিসেম্বরের শোকাবহ কালো দিনটিতে আমরা অনেকেই শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মরণ করতে গিয়ে আবেগাক্রান্ত হই। অনেকেই বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম জানতে চায় সেই কালো দিনটির নির্মম সত্যের অধ্যায়টি। তাই সাক্ষীগণের সাক্ষ্যের সবটুকু তুলে না ধরে এর উল্লেখযোগ্য অংশগুলো (কিছু কিছু বানান শুদ্ধিকরণসহ) পাঠকদের জন্য তুলে ধরছি। আমার বিশ্বাস, এটি থেকে সবাই জানতে পারবেন ক্ষত ও বেদনায় পূর্ণ সত্যটি। জানতে পারবেন কীভাবে সেদিন জাতির শ্রেষ্ঠ মেধাবী সন্তান বুদ্ধিজীবীদের তাঁদের স্ব স্ব বাসা থেকে কুখ্যাত আলবদররা ধরে নিয়ে যায় এবং তারপর কীভাবে স্বজনরা তাঁদের প্রিয় মানুষটির লাশের খোঁজ পেয়েছিলেন বা আদৌ পাননি। সাক্ষীদের এসব কথার প্রতিটিই যেন তাদের বুকে বয়ে বেড়ানো নিরন্তর কান্না। তাঁদের এ কান্না থেকে এও বেরিয়ে এসেছে কীভাবে এই শহীদ পরিবারগুলো এমনকি ছোট ছোট সন্তান বুকে নিয়ে সামনের পথে হেঁটেছেন। কীভাবে তাঁরা বেঁচে থাকার সংগ্রাম করেছেন এবং বর্তমানে তাঁরা কেমন আছেন।

 

সাংবাদিক সিরাজ উদ্দীন হোসেনের অপহরণ ও হত্যা

এই অভিযোগের সমর্থনে ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দিতে এসেছিলেন শহীদ সিরাজ উদ্দীন হোসেনের পুত্র জনাব তৌহিদ রেজা নূর। ঘটনার সময় তিনি ছিলেন মাত্র তিন বছরের শিশু। বড় হয়ে তিনি তাঁর মায়ের কাছ থেকে তাঁর বাবার অপহরণ ও হত্যাকান্ডের কথা শুনেছেন।

সাক্ষী তৌহিদ রেজা নূর ট্রাইব্যুনালে যে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন তার কিয়দংশ :

“১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার বয়স ছিল তিন বছর। ওই বয়সেই আমি আমার বাবাকে হারাই। আমরা আট ভাই, আমাদের কোনো বোন নেই। আমি ভাইদের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ। ১৯৭১ সালে আমার বাবাকে কীভাবে অপহরণ করা হয়েছিল তার বিস্তারিত বিবরণ পরবর্তীতে আমার মা এবং আমার মেজ ভাই শাহীন রেজা নূরের কাছ থেকে শুনেছি এবং জেনেছি।

১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর দৈনিক ইত্তেফাকে ‘এতদিনে’ শিরোনামে একটি লেখা বের হয়, যেখানে আমার বাবা আমাদের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও জাতিসংঘের অবস্থান সম্পর্কে সমালোচনা করেন। সে সময় আমার বাবা দৈনিক ইত্তেফাকের বার্তা ও কার্যনির্বাহী সম্পাদক ছিলেন।

১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর দিবাগত রাতে ঢাকায় ব্ল্যাক আউট চলছিল। মধ্যরাত ১২টা-সাড়ে ১২টার দিকে আমাদের বাসার দরজায় করাঘাত হয়। এই করাঘাতের শব্দে আমার বাবা-মাসহ অন্যরা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে ওঠেন। এক পর্যায়ে যখন আমার বাবা দরজা খোলেন তখন সেখানে কাউকে দেখতে পাননি। এই অবস্থায় আমার বাবা দরজা বন্ধ করে তিনিসহ সবাই ঘরে শুতে যান। এরপর রাত ৩টা-সাড়ে ৩টার দিকে আবার দরজায় করাঘাতের শব্দ শোনা যায়। আমার মেজ ভাই শাহীন রেজা নূর ঘুম থেকে উঠে শুনতে পান বাড়িওয়ালা তাকে ডেকে বলছে ‘শাহীন দরজা খোলো’। এ অবস্থায় আমার ভাই দরজা খুলে দেখতে পায় বাড়িওয়ালা, তার দুই ছেলে এবং তার শ্যালকগণ পয়েন্টে দরজার বাইরে দাঁড়ানো ছিল। তিনি আরও দেখতে পান ছয়-সাতজন সশস্ত্র লোক কেউ মাফলার, কেউ মাংকি ক্যাপ বা অন্য ধরনের কাপড় দিয়ে মুখঢাকা অবস্থায় দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। তারা আধো বাংলা আধো উর্দুতে জানতে চায় ঘরে কে আছে। এদের মধ্যে কেউ কেউ জোরপূর্বক আমাদের ঘরের ভিতর ঢুকে বাবার শোবার ঘরের সামনে চলে আসে। আমার মা সে সময় কী হয়েছে জানার জন্য সামনে এগিয়ে এসে শোবার ঘরের দরজাটি খোলেন। এই অবস্থায় সশস্ত্র লোকগুলো আমার বাবার শোবার ঘরে ঢুকে যায় এবং আমার বাবাকে লক্ষ্য করে বলে ‘হ্যান্ডস আপ’। তখন আমার বাবা লুঙ্গি গেঞ্জি পরিহিত অবস্থায় আলনার দিকে যাচ্ছিলেন সেখান থেকে একটি পাঞ্জাবি নিয়ে গায়ে দেবার জন্য কিন্তু তা পারেননি। তার আগেই তাঁকে হাত উঁচু করতে বলা হয়। এই অবস্থায় আমার বাবাকে সশস্ত্র ব্যক্তিরা ভাঙা ভাঙা উর্দুতে তাঁর পরিচয় জিজ্ঞেস করে। তিনি তাঁর পরিচয় দিলে ওই লোকগুলো তাদের সঙ্গে বাইরে আসতে বলে এবং বাড়ির লোকদের কাছে একটি গামছা চায়। আমার বাবার পিছে পিছে যারা ঘরের বাইরে এসেছিল তাদেরকে বন্দুকধারীরা বন্দুকের নলের মুখে ঘরের ভিতরে চলে যেতে বলে। ইতিমধ্যেই আমার মা একটি গামছা বন্দুকধারীদের হাতে তুলে দিয়ে তারা সবাই ঘরের ভিতরে চলে আসে। এরপর বন্দুকধারী ব্যক্তিরা গামছা দিয়ে আমার বাবার চোখ বেঁধে নগ্ন পায়ে নিয়ে যায়। এটাই ছিল আমার বাবা প্রথিতযশা সাংবাদিক সিরাজ উদ্দীন সাহেবের শেষ যাত্রা।

পরবর্তীতে বিজয়ের পরে ১৮ ডিসেম্বর, ১৯৭১ যখন জানা গেল রায়েরবাজার এবং মিরপুরের বধ্যভূমিতে বেশ কিছু বুদ্ধিজীবীর লাশ পড়ে আছে তখন আমাদের স্বজনরা সেখানে যান কিন্তু গলিত বিকৃত লাশের মধ্যে আমার বাবার লাশটি শনাক্ত করতে পারেনি।”

সাক্ষী তৌহিদ রেজা নূরের সাক্ষ্য হতেই উঠে এসেছে বর্বরতার প্রকৃতি। শহীদ সাংবাদিক সিরাজ উদ্দীন হোসেনের লাশ খুঁজে পাওয়া যায়নি। শহীদের স্বজনদের এ বেদনা জাতি কোনো দিন বিস্মৃত হবে না। ১৯৭১ সালে ঘটনার সময় সাক্ষী তৌহিদ রেজা নূর ছিলেন একজন শিশু। বাবার স্নেহ-আদর কি তিনি পেয়েছেন? শহীদ পিতার প্রতি নির্মমতা তাকে এবং শহীদের স্বজনদেরও চরম নির্মমতায় নিক্ষেপ করেছে। কিন্তু তার পরও শহীদের পরিবার থেমে থাকেনি। শহীদ সাংবাদিক সিরাজ উদ্দীন হোসেনের সেই শিশু সন্তান এই মামলার সাক্ষী তৌহিদ রেজা নূর ভারতের দিল্লিতে অবস্থিত জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে মাইক্রো ফিন্যান্স বিষয়ে পিএইচডি করেছেন। শত প্রতিকূলতা শহীদের পরিবারের আদর্শ, সাহস, দৃঢ়তার কাছে হার মেনেছে।

 

সাংবাদিক সৈয়দ নাজমুল হকের অপহরণ ও হত্যা

শহীদ সৈয়দ নাজমুল হকের ছেলে সৈয়দ মোর্তুজা নাজমুল এই মামলায় সাক্ষ্য প্রদান করেন। ১৯৭১ সালে তাঁর বয়স ছিল পাঁচ বছর। তিনি বড় হয়ে মা ও পরিবারের মুরব্বিদের কাছ থেকে তাঁর বাবার অপহরণের কথা জানতে পেরেছেন। তাঁদের কষ্ট শহীদ সৈয়দ নাজমুল হকের লাশ তাঁদের পরিবার কখনো খুঁজে পায়নি।

শহীদ সৈয়দ নাজমুল হকের ছেলে সৈয়দ মোর্তুজা নাজমুল ট্রাইব্যুনালে যে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন তার কিয়দংশ :

“১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের মধ্যরাতে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে যখন পাকিস্তানের কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয় তৎপরবর্তীতে আমার বাবাকে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য দুবার পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে আটক রাখা হয় এবং অকথ্য নির্যাতন সত্ত্বেও আমার বাবা সাক্ষ্য দিতে রাজি না হওয়ায় পাকিস্তানিরা তাকে দেশে ফেরত পাঠিয়ে দেয়। উপরে উল্লিখিত ঘটনাগুলো আমি আমার মা, আমার চাচা সাবেক সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল সৈয়দ সাজ্জাদুল হক (বর্তমানে মৃত) এবং আমার পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ অন্য সদস্যদের কাছ থেকে জানতে পারি।

আমার মায়ের কাছ থেকে জেনেছি যে, ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর রাত অনুমান ৪টার সময় আলবদর বাহিনীর একটি সশস্ত্র দল আমাদের ৯০ নম্বর পুরানা পল্টনের বাসায় এসে দরজা জোরপূর্বক ভেঙে ফেলে এবং ছয়-সাতজনের একটি দল ঘরের ভিতরে প্রবেশ করে। তখন আমার বাবা, মা, আমার এক বোন এবং আমি দোতলার সিঁড়িতে আশ্রয় নিই। এ সময় আলবদররা আমার বাবার নাম ধরে ডাকে। এরা সবাই মুখোশ পরা ছিল। তখন আমার বাবা নিচে গিয়ে নিজের পরিচয় দেন। তখন তারা অস্ত্রের মুখে আমার বাবাকে আটক করে ধরে নিয়ে একটি গাড়িতে তোলে।

আমি পরিবারের মুরব্বিদের কাছ থেকে আরও জানতে পারি, বদরবাহিনীর লোকেরা আমার বাবাকে অপহরণের পূর্বে শহীদ সাংবাদিক সিরাজ উদ্দীন হোসেন ও আ ন ম গোলাম মোস্তফা সাহেবকে অপহরণ করে নিয়ে গিয়েছে। জাতিকে মেধাশূন্য করার জন্যই বদরবাহিনীর সদস্যরা একটি নীলনকশার মাধ্যমে এই সাংবাদিকদের অপহরণ করে।

আমরা ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১-এর পর থেকে আমার বাবাকে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু রায়েরবাজার বধ্যভূমি, মিরপুর জল্লাদখানাসহ বিভিন্ন জায়গায় অনেক খোঁজাখুঁজির পরও আমার বাবার লাশ পাইনি।”

এই সাক্ষীর সাক্ষ্য থেকেও পাওয়া যায় বর্বরতার আরেক চিত্র। বাবাকে ধরে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। বাবার লাশটিও খুঁজে পাওয়া গেল না। ঘটনার ভয়াবহতা কেবল শহীদের পরিবারকে শোকে মুহ্যমান করেনি। বিশ্বও হয়েছে হতবাক। দৈনিক পূর্বদেশের ২৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১-এ ‘আলবদরের নরপিশাচরা ওদের হৃৎপিন্ড টেনে বের করেছে’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বলা হয় হয়-

“... কুখ্যাত বদরবাহিনী বাংলার শত শত বুদ্ধিজীবীকে একই উপায়ে অপহরণ করে এবং তাদের উপর অমানুষিক নির্যাতনের পর হত্যা করে। বাংলার এসব সুসন্তানদের খুনিরা প্রথমে মোহাম্মদপুরস্থ ফিজিক্যাল ট্রেনিং স্কুলে নিয়ে যায় এবং রায়েরবাজারের ইটখোলার কাছে বধ্যভূমিতে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে। সৈয়দ নাজমুল হকের ভাগ্যেও এই-ই ঘটেছে।... শতাধিক বিদেশী সাংবাদিক দেখতে গিয়েছিলেন এই নারকীয় হত্যাকা-। পিশাচদের এই রক্তপিপাসা দেখে তারা স্তম্ভিত হয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে গেছেন। তারা বলেন, বিশ্বের ইতিহাসে এরূপ নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ এই প্রথম। একজন বিদেশী সাংবাদিক এরূপও বলেছেন, ‘আমরা যে মানুষ তা এ দেখে বিশ্বাস করার কোনো উপায় নেই’ নিজেদের মানুষ বলে পরিচয় দিতেও আমাদের লজ্জিত হওয়া উচিত।” [রায়ের পৃষ্ঠা-৯৮-এ উদ্ধৃত]

 

সাংবাদিক এ এন এম গোলাম মোস্তফার অপহরণ ও হত্যা

শহীদ গোলাম মোস্তফার ভাই গোলাম রহমান দুলু ছিলেন তাঁর ভাইয়ের অপহরণের প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী। ১৯৭১ সালে তার বয়স ছিল ২২-২৩ বছর। এই মামলার অন্য সাক্ষী শহীদ গোলাম মোস্তফার ছেলে অনির্বাণ মোস্তফা। পেশায় তিনি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের অধ্যাপক। ১৯৭১ সালের ৫ মার্চ তাঁর জন্ম। বাবার মৃত্যুর সময় তিনি ছিলেন নয় মাসের শিশু।

শহীদ সাংবাদিক আ ন ম গোলাম মোস্তফার ছোট ভাই সাক্ষী আ ন ম গোলাম রহমান ওরফে দুলু ট্রাইব্যুনালে বলেন :

“১৯৭১ সালের ১১ ডিসেম্বর আমরা যখন মুক্তিযুদ্ধের একেবারেই বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে উপনীত ঠিক সেদিন ভোর ৬টার দিকে আমার ভাবীর (জনাব আ ন ম মোস্তফা সাহেবের স্ত্রী) বড় ভাই ইঞ্জিনিয়ার সামসুদ্দোহা সাহেবকে সঙ্গে নিয়ে একটি জিপে কয়েকজন মিলিশিয়া ও আলবদর আমাদের বাসার সামনে এসে থামে।... সেদিন আমার বড় ভাই তাঁর নয় মাসের বাচ্চা অভিকে কোলে নিয়ে বারান্দায় পায়চারি করছিলেন। এরই এক পর্যায়ে আগত আলবদর ও মিলিশিয়ারা আমাদের বাসার দরজায় কড়া নাড়ে। কড়া নাড়ার শব্দ শুনে আমার ভাই-ই দরজা খুলে দেন। আগত লোকেরা আমার ভাইকে জিজ্ঞেস করে তিনি আ ন ম গোলাম মোস্তাফা কিনা। তিনি হ্যাঁ-সূচক জবাব দেন। দুই-তিনজন মুখোশধারী লোক ঘরের ভিতরে প্রবেশ করে বাকি বেশ কয়েকজন মিলিশিয়া ছাই রঙের পোশাক পরিহিত অবস্থায় অস্ত্র হাতে বাইরে অবস্থান করছিল।... আমার বাবা-মাসহ আমরা সকলেই কান্নাকাটি করতে থাকি। আমার বাবাকে আগন্তুকদের একজন সান্ত্বনা দিয়ে বলে বিচলিত হওয়ার কিছু নেই, আপনার ছেলের পরিচয় নিশ্চিত করেই তিনি ফিরে আসবেন। এ কথা বলে আমার ভাইকে তারা তাদের সঙ্গে নিয়ে যায়।

বিজয় অর্জনের পর আমি প্রায় প্রতিদিন রায়েরবাজারের বধ্যভূমি থেকে শুরু করে ঢাকার আশপাশের প্রায় প্রতিটি বধ্যভূমিতে আমার ভাইয়ের লাশ খুঁজেছি। লাশ খুঁজতে গিয়ে অনেক অর্ধগলিত লাশ টেনে সরাতে হয়েছে। তখন অনেক লাশের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। আমরা আর আমার ভাইয়ের লাশ খুঁজে পাইনি। আমার ভাইকে আলবদররা ধরে নিয়ে যাওয়ার পর থেকে আমার বাবা যে শয্যাশায়ী হয়েছিলেন তিনি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আর উঠে দাঁড়াতে পারেননি। তিনি ১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মৃত্যুবরণ করেছেন।”

অনির্বাণ মোস্তফা সাক্ষ্য দিতে গিয়ে বলেন : “আমার বাবার মৃত্যুর সময় আমার বয়স ছিল মাত্র নয় মাস। আমার মা তখন অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। ১৯৭২ সালের ২৩ মার্চ আমার ছোট বোন ঊর্মি মোস্তফার জন্ম হয়। আমার মা বর্তমানে বেঁচে আছেন।

আমি শিশুকাল থেকেই পিতৃহারা হওয়ার কারণে আমার বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে আমার পিতার অপহরণ এবং হত্যাকা-  সম্পর্কে জানার আগ্রহ বাড়তে থাকে। যেহেতু আমি আমার বাবাকে বাবা বলে সম্বোধন করতে পারিনি সেহেতু তাঁর ব্যাপারে এবং তাঁর অপহরণকারী যার নাম আমি পরবর্তীতে জেনেছি চৌধুরী মইন উদ্দীন এই দুজন মানুষের ব্যাপারে আমার জানার আগ্রহ প্রবল থেকে প্রবলতর হয়।

আমি জেনেছি ১০ ডিসেম্বর, ১৯৭১ রাতে আমি সারা রাত ঘুমাইনি। সে কারণে ১১ ডিসেম্বর ভোরবেলা থেকেই আমার বাবা আমাকে কোলে নিয়ে বারান্দায় পায়চারি করছিলেন। সেদিন ভোর ৬টার দিকে একটি জিপে করে কিছু লোক রায়েরবাজার থেকে আমার বড় মামা ইঞ্জিনিয়ার সামসুদ্দোহা সাহেবকে নিয়ে আমাদের ঢাকার গোপীবাগের বাসায় আসেন। বাবাকে ওই আগন্তুকরা তাদের সঙ্গে দৈনিক পূর্বদেশ অফিসে যেতে বলেন। বাবা সেই যে গেলেন আর ফিরে আসেননি।

আমি আরও জেনেছি যে, বাবা ফিরে না আসার কারণে বাসায় সবাই কান্নাকাটি করছিল, এই অবস্থায় আমার চাচা আ ন ম গোলাম রহমান বাবার খোঁজে দৈনিক পূর্বদেশ অফিসে যান। সেখানে গিয়ে তিনি এহতেশাম হায়দার চৌধুরী ও আতিকুর রহমানকে আমার বাবার অপহরণের কথা জানান। তখন তারা আমার চাচাকে বলেন, সম্ভবত চৌধুরী মইন উদ্দীন বিষয়টি অবগত আছেন। আমি এও শুনেছি তখন এহতেশাম হায়দার চৌধুরী, চৌধুরী মইন উদ্দীনকে ডেকে আমার চাচাকে সঙ্গে নিয়ে বাবার খোঁজ করতে বলেছিলেন কিন্তু চৌধুরী মইন উদ্দীন চাচাকে নিয়ে কয়েকটি জায়গায় খোঁজ করে জানিয়েছিল যে, বাবার কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। আমি চাচার কাছ থেকে শুনেছি মইন উদ্দীন যখন মোহাম্মদপুর ফিজিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারে প্রবেশ করছিলেন তখন দ-ায়মান প্রহরীরা তাকে যথেষ্ট সম্মান করেছিল।... আমি আরও জানতে পেরেছি ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১-এর পর আমার চাচা ঢাকার আশপাশে অনেক বধ্যভূমিতে আমার বাবার লাশ খুঁজেছেন কিন্তু পাননি।”

কী অবর্ণনীয় বীভৎসতা! অসহায় স্বজনদের সামনে থেকে একজনকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। বধ্যভূমিতে গিয়ে তাঁর লাশ খুঁজতে হয়েছে। লাশ পাওয়া যায়নি। বর্বর ঘটনাটি শহীদের বাবাকেও ঠেলে দেয় মৃত্যুর দিকে। মাত্র নয় মাসের সন্তান অভি বাবার স্নেহ-আদর পাননি। বাবাকে কোনো দিন বাবা বলে ডাকতে পারেননি। এই করুণ চিত্র যে কারও হৃদয়কে করবে বেদনাক্রান্ত। নাড়া দেবে বিশ্ববিবেক ও মানবতাকেও। তার পরও এই শহীদের পরিবার শত প্রতিকূলতায় সামনে এগিয়ে গেছে। এই অনির্বাণ মোস্তফা অভি যখন বাবা হারানোর কথা ব্যক্ত করতে ট্রাইব্যুনালে আসেন তখন তিনি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের অধ্যাপক।

 

সাংবাদিক নিজাম উদ্দীন আহমেদের অপহরণ ও হত্যা

শহীদ সাংবাদিক নিজাম উদ্দীনের ছেলে সাফকাত নিজাম এই মামলায় সাক্ষ্য প্রদান করেন। ১৯৭১ সালে সাফকাত নিজাম ওরফে বাপ্পী ছিলেন চার বছরের শিশু। তিনি বড় হয়ে তাঁর মা, নানা, নানী, মামা ও খালার কাছ থেকে তাঁর বাবার অপহরণ ও হত্যাকান্ডের কথা জানতে পারেন। এই পরিবারেরও কষ্ট পরিমাপের কোনো সুযোগ নেই। শহীদ সাংবাদিক নিজাম উদ্দীনের লাশটি তারা খুঁজে পায়নি। শহীদের সন্তান সাফকাত নিজাম এই ট্রাইব্যুনালে বেদনাবৃত যে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন তার কিয়দংশ :

“আমার বাবা শহীদ সাংবাদিক নিজাম উদ্দীন আহমেদ স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখতেন। তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। ১৯৬৫ সালে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য হিসেবে এ দেশের মানুষের অধিকার নিয়ে কথাবার্তা বলতেন। ১৯৭১ সালে তিনি বিবিসির বাংলাদেশের সংবাদদাতা এবং পাকিস্তান প্রেস ইন্টারন্যাশনালের (পিপিআই) জেনারেল ম্যানেজার ছিলেন। এটি একটি সরকারি সংস্থা ছিল। তিনি সরকারি সংস্থার দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি হয়েও ১৯৭১ সালে পাকবাহিনী কর্তৃক সংঘটিত বাঙালিদের ওপর নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞের চিত্র বিশ্ববাসীর সামনে সাহসিকতার সঙ্গে তুলে ধরেছিলেন। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন সাফল্যগাথাও তাঁর বিবিসির রিপোর্টিংয়ে তুলে ধরতেন।

১৯৭১ সালের ১২ ডিসেম্বর কারফিউ ছিল। দুপুর আনুমানিক ১টা থেকে ২টার মধ্যে বাসার সবাই দুপুরের খাবার খেতে বসেছিলাম। এই সময় এক পর্যায়ে দরজায় কড়া নাড়ার আওয়াজ পাওয়া যায়। দরজা খোলামাত্রই আমাদের বাসায় দুজন অস্ত্রধারী প্রবেশ করে। তারা ভাঙা ভাঙা উর্দুতে আমার বাবার নাম ধরে খোঁজ করতে থাকেন। আমার বাবা পরিবারের সবার নিরাপত্তার কথা ভেবে তিনি নিজেই খাবার টেবিল থেকে উঠে অস্ত্রধারীদের কাছে নিজের পরিচয় দিয়ে বলেন, আমিই নিজাম উদ্দীন আহমেদ। উনার পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার জন্য অস্ত্রধারীরা তাঁর কাছে পরিচয়পত্র চান। উনি এক পর্যায়ে পরিচয়পত্র দেখান। তখন অস্ত্রধারীরা কালবিলম্ব না করে উনাকে তাদের সঙ্গে নিয়ে যেতে থাকে। আমার মা তখন আমার বাবার পিছু পিছু যাচ্ছিলেন তখন অস্ত্রধারীরা মাকে পিছনে আসতে মানা করেন।

পরবর্তীতে আমরা আমাদের এক প্রতিবেশীর কাছ থেকে জানতে পারি তাঁকে একটি কাদামাখা মিনিবাসে করে উনার চোখ এবং হাত বেঁধে উঠিয়ে নিয়ে যায়। এই সময় ওই গাড়িতে পিছন দিকে হাত বাঁধা এবং চোখ বাঁধা অবস্থায় আরও অনেক ব্যক্তি ছিলেন।

আমার বাবাকে আটক করে নিয়ে যাবার পূর্বেই তিনি জানতে পেরেছিলেন যে, তাঁর সহকর্মী সাংবাদিক জনাব সিরাজ উদ্দীন হোসেন, সৈয়দ নাজমুল হক, আ ন ম গোলাম মোস্তফাসহ আরও কয়েকজন সাংবাদিককে আলবদররা ধরে নিয়ে গিয়েছিল। তিনি এ ব্যাপারে একটি নিউজ করেছিলেন বলে শুনেছি। অন্য অপহৃতদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করে আমার পরিবারের সদস্যরা আমার বাবাসহ অন্যদের খোঁজ করতে থাকে। কিন্তু আমার বাবার কোনো সংবাদ পাওয়া যায়নি।... আমার বাবাকে অপহরণ এবং হত্যা করাসংক্রান্ত তথ্যাদির ভিত্তিতে আমি যে বক্তব্য দিলাম আমি তা আমার মা, নানা-নানী, মামা-খালা এদের কাছ থেকে বড় হয়ে শুনেছি।”

প্রগতিশীল মুক্তবাক একজন মানুষ ছিলেন শহীদ সাংবাদিক নিজাম উদ্দীন আহমেদ। স্বাধীনতার সূর্যোদয়ের ঠিক কদিন আগেই নির্মমতার শিকার হন তিনি। ১৯৭১-এ বাংলাদেশের ভূখ-ে চলমান বর্বরতা অসীম সাহসে তিনি তুলে ধরেছেন বিশ্বের কাছে। এটিই কি ছিল তাঁর অপরাধ? কী নির্মমভাবে আক্রমণ ও হত্যা করা হয় তাঁকে! অসহায় স্বজনদের সামনে থেকেই তাঁকে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়া হয়। এসবই উঠে এসেছে শহীদের সন্তান এই সাক্ষীর বেদনাবৃত উচ্চারণ থেকে। ৩০ ডিসেম্বর, ১৯৭১-এর দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকায় ‘স্বাধীনতার সূর্যোদয় তিনি দেখে যেতে পারেননি’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে দেখতে পাই :

“খুনে রাঙ্গা সোনার বাংলায় স্বাধীনতার সূর্য দেখার সৌভাগ্য যাদের হয়নি সাংবাদিক জনাব নিজাম উদ্দীন আহমেদ তাদের অন্যতম।... জনাব আহমেদকে ১২ই ডিসেম্বর বিকেল দু’টায় কুখ্যাত আলবদর বাহিনী ধরে নিয়ে যায়। এর পর থেকে তিনি নিখোঁজ রয়েছেন। গেস্টাপো আলবদর আলশামস বাহিনীর কলংকিত বধ্যভূমি ও সম্ভাব্য স্থানে খোঁজ করেও তাঁর কোন পাত্তা পাওয়া যায়নি।’ [রায়ের পৃষ্ঠা ১০৪-১০৫-এ উদ্ধৃত]

 

সাংবাদিক সেলিনা পারভীনের অপহরণ ও হত্যা

শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীনের ছেলে সুমন জাহিদ এই মামলায় সাক্ষ্য প্রদান করেন। এ অভিযোগটি প্রমাণের জন্য রায়েরবাজার বধ্যভূমি থেকে ফিরে আসা একমাত্র মানুষ দেলোয়ার হোসেনও সাক্ষ্য প্রদান করেন। ১৯৭১ সালে সুমন জাহিদের বয়স ছিল আট বছর। ১৮ ডিসেম্বর, ১৯৭১ শহীদ সেলিনা পারভীনের পরিবারের সদস্যরা রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে তার লাশ শনাক্ত করেন এবং তা উত্তোলন করে আজিমপুর কবরস্থানে সমাধিস্থ করেন। শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীনের ছেলে সুমন জাহিদ বুকে একরাশ কান্না নিয়ে ট্রাইব্যুনালে বলেন :

“১৯৭১ সালে আমার বয়স ছিল আট বছর। ১৯৭১ সালের ১৩ ডিসেম্বর আনুমানিক দুপুর ১.৩০ মি. সময় আমি এবং আমার এক মামা (উজির) দুপুরের গোসল সেরে বাসার ছাদে অবস্থান করছিলাম। সে সময় মা রান্না করছিলেন। আমরা বুঝতে পারলাম বাসার সামনে কিছু গাড়ি এসে থেমেছে। তখন আমরা ১১৫ নিউ সার্কুলার রোড (বর্তমানে ২৯ নম্বর শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীন সড়ক)-এ থাকতাম।... কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের বাসার কলাপসিবল গেটে কড়া নাড়ানোর আওয়াজ পাই। আমাদের পাশের ফ্ল্যাটে তখন জাতীয় পরিষদ সদস্য (সংসদ সদস্য) অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম সৈয়দ সালাউদ্দিন সাহেব থাকতেন। তখন তিনি কলাপসিবল গেটটির দরজা খুলে দেন। আগন্তুকরা আমার মায়ের ফ্ল্যাট কোনটি জানতে চাইলে তিনি আমাদের ফ্ল্যাটটি দেখিয়ে দেন।... তখন আমাদের বাসার কড়া নাড়াবার আওয়াজ পাই। মা তখন দরজা খুলে দেন, তারা তখন মার পরিচয় জানতে চায়। আগন্তুকদের মধ্যে একজন তখন আমাদেরকে দেখে ফেলে এবং বন্দুক তাক করে বলে হ্যান্ডস আপ। আমি এবং উজির মামা তখন হাত তুলে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে আসি। তারা আমাদের পরিচয় জানতে চায়। মা তখন আমাকে দেখিয়ে বলে, ‘এ আমার ছেলে’, উজির মামাকে দেখিয়ে বলে, ‘আমার ছোট ভাই’। আগন্তুকরা উজির মামাকে দেখিয়ে বলে ইয়ে মুক্তি হ্যায়। এ সময় আমি মায়ের কাছে গিয়ে তাঁর আঁচল ধরে দাঁড়িয়ে থাকি। তখন আগন্তুকরা আমার মাকে বলে আপনাকে আমাদের সঙ্গে সেক্রেটারিয়েটে যেতে হবে। মা তখন বলে ‘আমার সঙ্গে তো কারফিউ পাস নেই আমি কীভাবে যাব’। আগন্তুকরা বলে, ‘আমাদের কাছে কারফিউ পাস আছে অসুবিধা হবে না’। আমি মায়ের সঙ্গে যেতে চাইলে তারা বাধা দেয়, এদের মধ্যে একজন বলে, ‘বাচ্চা লোক নেহি জায়েগা, অন্দর মে যাও’। আগন্তুকরা যারা এসেছিল তাদের মুখ মাফলার দিয়ে ঢাকা ছিল এবং হাতে আগ্নেয়াস্ত্র ছিল। তাদের ধমকে আমি এবং মামা ভয় পেয়ে দরজার কাছে চলে যাই। এই সময় মা আমার মাথায় হাত রেখে বলেছিলেন যে, ‘সুমন তুমি মামার সঙ্গে খেয়ে নিও, আমি কিছুক্ষণের মধ্যে চলে আসব’। এটাই ছিল আমার মায়ের সঙ্গে আমার শেষ কথা। তখন আগন্তুকরা মায়ের হাতে থাকা একটি গামছা দিয়ে মায়ের চোখ বেঁধে ফেলে এবং ওদের হাতে থাকা মাফলার জাতীয় একটি জিনিস দিয়ে মাকে পিঠমোড়া করে বাঁধে। এ অবস্থায় আগন্তুকরা আমার মাকে কাদামাখা গাড়িটিতে উঠিয়ে নিয়ে চলে যায়। আমরা তাঁর আর কোনো খবর পাইনি।

এরপর ১৭ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে শহীদ মুনীর চৌধুরী ও কবীর চৌধুরীর ভাই শমসের চৌধুরীর কাছ থেকে আমার মেজ মামা এবং উজির মামা জানতে পারে রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে আমার মায়ের লাশ পড়ে আছে। ১৮ ডিসেম্বর, ১৯৭১ সেই লাশ সেখান থেকে উজির মামা এবং মহসিন মামা শনাক্ত করে তা উত্তোলন করে আজিমপুর নতুন কবরস্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের কবরের পাশে দাফন করেন।”

এই সাক্ষীর সাক্ষ্যে যে নির্মম সত্য উঠে এসেছে তা হলো, একজন নারী যিনি মাতৃজাতির একজন, তাকেও বর্বররা রেহাই দেয়নি। শিশু পুত্র অসহায়ের মতো তাকিয়ে দেখেছে তার মাকে বেঁধে নিয়ে যেতে। কদিন পর সেই অসহায় শিশুর মায়ের লাশ রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে খুঁজে পাওয়া যায়। কী নির্মমতা! ট্রাইব্যুনাল রায়ে পর্যবেক্ষণ দেয় যে, এটি কেবল সেলিনা পারভীনকে হত্যা ছিল না, এটি ছিল মাতৃজাতি হত্যা যা ‘ম্যাট্রিসাইড’। মানববিবেককে এটি আঘাত করেছে। আজ এই নির্মম সত্যটি সবাই জানুন। শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীনের প্রতি চরম নির্মমতার প্রতিফলন দেখতে পাই ২১ ডিসেম্বর, ১৯৭১-এ দৈনিক পূর্বদেশে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে। এখানে বলা হয় :

‘বেগম সেলিনা পারভীনের লাশ মোহাম্মদপুর রায়েরবাজারের বিলের বধ্যভূমিতে তাঁহার ক্ষতবিক্ষত লাশ গত শনিবার পাওয়া গিয়াছে। গত ১৪ই ডিসেম্বর বেলা ২টায় বেগম সেলিনা পারভীনকে জামায়াতে ইসলামীর গু-াবাহিনী আলবদরের জল্লাদেরা তাঁহার সিদ্ধেশ্বরীর বাসভবন হইতে ধরিয়া নিয়া যায়।... বেগম সেলিনা পারভীনের ডান চোয়ালে দুটি গুলির আঘাত ও পেটে বেয়নেটের আঘাত রহিয়াছে।’ [রায়ের পৃষ্ঠা-১০৮-এ উদ্ধৃত]

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাতজন সর্বজনশ্রদ্ধেয় শিক্ষক যথাক্রমে অধ্যাপক গিয়াস উদ্দীন, অধ্যাপক ডা. আবুল খায়ের, অধ্যাপক ড. ফয়জুল মহিউদ্দীন, অধ্যাপক ড. রাশিদুল হাসান, অধ্যাপক ড. আনোয়ার পাশা ও অধ্যাপক ড. সন্তোষচন্দ্র ভট্টাচার্যের অপহরণ ও হত্যাকাণ্ড।

এই অভিযোগটি প্রমাণ করার জন্য ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দিয়েছেন অধ্যাপক গিয়াস উদ্দীনের ভাগ্নি মাসুদা বানু রতœা, অধ্যাপক সিরাজুল হকের ছেলে ডা. এনামুল হক খান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আনিসুুজ্জামান, শহীদ ড. মোর্তুজার নিকটাত্মীয় জনাব ওমর হায়াৎ এবং শহীদ ড. আবুল খায়েরের পুত্র রাশেদুল ইসলাম। ১৯৭১ সালে এই রাশেদুল ইসলাম ছিলেন ছয় বছরের শিশু। কিছু কিছু ঘটনা তাঁর আবছা আবছা মনে থাকলেও বড় হয়ে তিনি তাঁর মা ও আত্মীয়দের কাছ থেকে তাঁর বাবার অপহরণ ও হত্যাকান্ডের কথা জানতে পারেন। এই সাক্ষীগণ ট্রাইব্যুনালে যে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন তার কিয়দংশ তুলে ধরছি :

সাক্ষী মাসুদা বানু রতœার (শহীদ অধ্যাপক গিয়াস উদ্দীন আহমেদের ভাগ্নি) সাক্ষ্যের অংশ :

“১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার বয়স ছিল ১৭ বছর। আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত বিভাগে প্রথম বর্ষ সম্মান শ্রেণির ছাত্রী ছিলাম। ওই সময় আমি আমার মামা শহীদ অধ্যাপক গিয়াস উদ্দীন আহমেদ সাহেবের নীলক্ষেতস্থ বাসায় থেকে লেখাপড়া করতাম। আমার মামা শহীদ গিয়াস উদ্দীন আহমেদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক ছিলেন এবং পাশাপাশি তিনি হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলের হাউস টিউটর ছিলেন।

১৪ ডিসেম্বর, ১৯৭১ সালে মুহসীন হলে সাপ্লাইয়ের কোনো পানি ছিল না এই খবর পেয়ে সকাল সাড়ে ৭টা বা পৌনে ৮টার দিকে আমার মামা অধ্যাপক গিয়াস উদ্দীন সাহেব পিপিং স্যুটের শার্ট এবং লুঙ্গি পরে মুহসীন হলে পানির পাম্পের কাছে যান। আনুমানিক সকাল ৮টার দিকে ইপিআরটিসির একটি মিনিবাস বাসার সামনে এসে থামে। সেই বাস থেকে দুজন লোক নেমে দোতলায় উঠে আসে যেখানে আমার মামা গিয়াস উদ্দীন সাহেব এবং আমরা থাকতাম। তারা দোতলায় এসে দরজায় কড়া নাড়ে। ... আমার খালু নূরুল হক সাহেব দরজা খুলে দিলে তারা জানতে চায় গিয়াস উদ্দীন সাহেব কোথায়। দুজনের হাতেই আগ্নেয়াস্ত্র ছিল। গিয়াস উদ্দীন সাহেব বাসায় নেই এ কথা শোনার পর ওই দুই ব্যক্তি নিচে নেমে যায় এবং ৮-১০ মিনিট পর আবার দোতলায় আসে। সারা বাসা তল্লাশি করে। এক পর্যায়ে আমার মামা কিবরিয়া সাহেব বলেন যে, গিয়াস উদ্দীন সাহেব মুহসীন হলের পানির পাম্প হাউসে গিয়েছেন। এ কথা শোনার পর তারা কিবরিয়া সাহেবকে ধরে মুহসীন হলের পানির পাম্পের কাছে নিয়ে যায়। সেখানে যাওয়ার পর গিয়াস উদ্দীন সাহেবকে পায়। তখন হলের দারোয়ান রহিম উদ্দিনের গামছা দিয়ে আমার মামা গিয়াস উদ্দীন সাহেবের চোখ বেঁধে সেই ইপিআরটিসির মিনিবাসে উঠায়। আমার অপর মামা কিবরিয়া সাহেব মুহসীন হল থেকে বাসায় ফিরে এসে আমাদের কাছে এই ঘটনাটি বর্ণনা করেন।

যে দুজন ব্যক্তি আমার মামার বাসায় সশস্ত্র অবস্থায় মামাকে খুঁজতে গিয়েছিল এবং পরবর্তীতে মুহসীন হল এলাকা থেকে উনাকে চোখ বেঁধে ধরে নিয়ে যায় এরা হলো আশরাফুজ্জামান খান এবং চৌধুরী মইন উদ্দীন। এরা দুজনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন এবং ইসলামী ছাত্র সংঘের নেতা ছিলেন। যেহেতু আমি ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলাম সে কারণে আমি এদেরকে চিনতাম। এরা দুজনই মুহসীন হলের আবাসিক ছাত্র ছিলেন।

কিবরিয়া মামার কাছ থেকে আরও জানতে পারলাম ওই বাসে চোখ বাঁধা অবস্থায় আরও কিছু লোক বসা অবস্থায় ছিলেন। পরবর্তীতে আমরা আরও জানতে পারি ওই গাড়িতে করে ড. মোর্তুজা, ড. আবুল খায়ের, ড. সন্তোষ ভট্টাচার্য, ড. ফয়জুল মহি, অধ্যাপক আনোয়ার পাশা, অধ্যাপক রাশিদুল হাসান প্রমুখকে নিয়ে গিয়েছে। ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ বিজয় লাভের পর আমরা শুনতে পাই যাদেরকে সেই ইপিআরটিসির মিনিবাসে করে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তাদের অনেকের লাশ রায়েরবাজার ও মিরপুরের ‘বধ্যভূমি’তে পড়ে আছে। আমরা আরও খবর পাই কিছু লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে নিয়ে আসা হয়েছে। প্রথমে আমি এবং আমাদের আত্মীয়স্বজন রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে যাই এবং পরবর্তীতে ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে আসি। এই দুই জায়গার কোথাও আমার মামার লাশ আমি দেখতে পাইনি। মেডিকেল কলেজের মর্গে অন্য শহীদ বুদ্ধিজীবীদের আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয় তারাও তাদের স্বজনদের লাশ খুঁজছিলেন। মেডিকেল কলেজের মর্গে ড. মোর্তুজা, ড. সন্তোষ ভট্টাচার্য, ড. আবুল খায়ের প্রমুখের গলিত এবং বিকৃত লাশ তাদের স্বজনরা চিহ্নিত করতে পেরেছিলেন।

১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসের ৫ তারিখে আমার বড় খালু জনাব আবদুল মোমেন খান (সাবেক খাদ্য সচিব, খাদ্যমন্ত্রী) খবর পেয়ে মিরপুরের বধ্যভূমিতে যান এবং আমার মামার পরিধেয় বস্ত্রাদি দেখে মামার গলিত লাশ শনাক্ত করেন এবং পরিধেয় বস্ত্রাদিসহ গলিত বিকৃত লাশ ওইখান থেকে তুলে এনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদের পাশে অন্যান্য বুদ্ধিজীবীর কবরের পাশে ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী দাফন করা হয়।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে আমি যখন অন্যান্য বুদ্ধিজীবীর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলছিলাম তখন ড. মোর্তুজার স্ত্রী এবং অন্যরাও বলেছিলেন যে, তাদের স্বজনদেরও আশরাফুজ্জামান খান ও চৌধুরী মইন উদ্দীন অস্ত্রের মুখে অপহরণ করে ইপিআরটিসির বাসে করে তুলে নিয়ে গিয়েছিলেন। পরবর্তীতে পত্রপত্রিকায় আশরাফুজ্জামান ও মইন উদ্দীনের ছবি দেখে আমি আরও নিশ্চিত হই যে তারাই আমার মামাকে অপহরণ করে হত্যা করেছিল।”

এই সাক্ষীর সাক্ষ্যে বলে দেয় যে, কুখ্যাত আলবদর আশরাফুজ্জামান ও মইন উদ্দীন ছিলেন বুদ্ধিজীবী নিধন মিশনের মূল কারিগর। বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক ছাত্র হওয়ায় সংগত কারণেই তারা কেউ অচেনা ছিলেন না। ছাত্র হয়ে শিক্ষকদের প্রাণসংহার! এ যে কী বীভৎসতা! অবশেষে স্বজনরা শহীদ অধ্যাপক গিয়াস উদ্দীনের গলিত লাশ পান মিরপুর বধ্যভূমিতে। সাক্ষী মাসুদা বানু রতœার সাক্ষ্যে এই বেদনাবৃত চিত্রটিই উঠে এসেছে।

                [ধারাবাহিকের দ্বিতীয় পর্ব পড়ুন আগামীকাল]

সর্বশেষ খবর