শুক্রবার, ১৭ জানুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা

কোরআন ও হাদিসে বর্ণিত বৃক্ষরাজি

মেজর নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ (অব.) পিএইচডি

কোরআন ও হাদিসে বর্ণিত বৃক্ষরাজি

পৃথিবী ও বেহেশতে গাছের সমারোহ

মহাগ্রন্থ আল কোরআনের গুরুত্বপূর্ণ সূরা ইয়াসিনের ৩৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘পবিত্র মহান তিনি, যিনি উদ্ভিদ, মানুষ এবং ওরা (অবিশ্বাসী) যাদের জানে না, তাদের প্রত্যেককে জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করেছেন।’ কেবল এই বিশ্বই নয়, কেয়ামতের পর পুণ্যবান ব্যক্তিদের ঠিকানা বেহেশতেও হবে বৃক্ষশোভিত। এ বিষয়ে সূরা আর রহমানের ৪৬ থেকে ৬৮ নম্বর আয়াতের বর্ণনা মতে, যে ব্যক্তি আল্লাহর সামনে উপস্থিত হওয়ার ভয় করে, তার জন্য রয়েছে দুটো বাগান। এই বাগান দুটি ঘন শাখা-প্রশাখায় ভরা থাকবে। সেখানে উপচে পড়বে দুটি ঝরনা। এর বাইরে আরও দুটি ঘন সবুজ বাগান থাকবে, যার মাঝেও বয়ে যাবে দুটি উচ্ছলিত ঝরনা। নেয়ামত হিসেবে সেই বাগানে থাকবে ফলমূল, খেজুর ও ডালিম। একই সূরার (আর রহমান) শুরুতে বলা হয়েছে যে, পৃথিবীর তৃণলতা এবং বৃক্ষাধি সেজদারত বা ইবাদতরত আছে। পৃথিবীকে সৃষ্ট জীবের জন্য বিছিয়ে দেওয়ার কথা উল্লেখ করে সেখানে ফলমূল, বহিরাবরণবিশিষ্ট খেজুর গাছ, খোসাবিশিষ্ট শস্য ও সুগন্ধি ফুল উৎপন্নের বর্ণনাও রয়েছে পবিত্র কোরআনের সূরা আর রহমানে। এ ছাড়া আরও অনেক ফল-ফুল ও বৃক্ষলতার বর্ণনা উঠে এসেছে পবিত্র কোরআনের বিভিন্ন সূরায়, একইভাবে বেহেশতের বর্ণনা প্রসঙ্গে বারবার বৃক্ষ-লতাশোভিত সবুজ বাগান আর নদী ও ঝরনার কথা বলা হয়েছে। আরও বলা হয়েছে, গাছের নিচে শীতল ছায়ার কথা। পবিত্র কোরআনের ১৪ নম্বর সূরা ইব্রাহিমের ২৪ নম্বর আয়াতে প্রতীকী অর্থে ভালো কথা (অর্থাৎ মুসলমানের ইমান ও আকিদা)-কে ভালো গাছের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে যার শিকড় দৃঢ়ভাবে মাটিতে বিরাজমান আর শাখা-প্রশাখা আকাশের দিকে ধাবিত। ৫২ নম্বর সূরা আত-তুরের ২২ ও ২৩ নম্বর আয়াতে জান্নাতে পানীয় এবং মাংসের সঙ্গে ফলমূল পরিবেশনার কথা বর্ণিত হয়েছে। ৯৫ নম্বর সূরা আত-ত্বিনে মহান আল্লাহ শপথ করেছেন ‘তুর ও জয়তুন’ অর্থাৎ ডুমুর ও এক ধরনের ছোট জলপাইয়ের নামে। এভাবে পবিত্র কোরআন এবং অসংখ্য হাদিসে বারবার উঠে এসেছে বিভিন্ন বৃক্ষরাজির নাম।

 

পৃথিবীতে আগমনের নেপথ্যে যে নিষিদ্ধ গাছ

পবিত্র কোরআনের দ্বিতীয় সূরা বাকারার ৩৫ নম্বর আয়াতেও এই সংক্রান্ত বর্ণনা রয়েছে। তবে পবিত্র কোরআনে এই গাছের কোনো নির্দিষ্ট নাম উল্লেখ করা হয়নি। বিভিন্ন বর্ণনায় এই গাছকে ‘নিষিদ্ধ গাছ’ এবং গাছের ফলকে ‘নিষিদ্ধ ফল’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

 

পৃথিবীতে মানুষের আগমনের নেপথ্যে রয়েছে একটি বিশেষ গাছ এবং ফলের সম্পৃক্ততা। পবিত্র কোরআনের ২০ নম্বর সূরা ত্বাহার শেষাংশের বর্ণনা মতে, মহান রাব্বুল আলামিন ফেরেশতাগণকে হজরত আদম (আ.)-এর প্রতি সেজদা করার নির্দেশ দেন। ওই আদেশ ইবলিশ ব্যতীত সব ফেরেশতা মান্য করেন। এ ঘটনার পর মহান আল্লাহ হজরত আদম (আ.)-কে সতর্ক করেন এবং ইবলিশকে তাঁর এবং তাঁর (আদম আ.) স্ত্রীর শত্রু বলে উল্লেখ করেন। মহান আল্লাহ এই মর্মেও সতর্ক করেন যে, ইবলিশ হজরত আদম (আ.) এবং তাঁর স্ত্রীকে জান্নাত থেকে বিতাড়িত করে কষ্টময় জীবনে ঠেলে দিতে পারে। জান্নাত ছিল উভয়ের জন্য আরামপ্রদ, যেখানে তৃষ্ণা ও ক্ষুধার ভয় ছিল না এবং রোদে ক্লান্ত হওয়ার সম্ভাবনা ছিল না। এরপর ইবলিশ হজরত আদম (আ.)-কে কুমন্ত্রণা দেয়। সূরা ত্বাহার ১২০ নম্বর আয়াত মতে, এ সময় ইবলিশ হজরত আদম (আ.)-কে অমরত্ব লাভ এবং অক্ষয় রাজ্যের লোভ দেখিয়ে একটি গাছের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। অথচ এই গাছের ফল-ফুল খাওয়া এমনকি গাছের নিকটবর্তী হওয়াও নিষেধ ছিল। এই নিষিদ্ধ গাছের ফল খাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে হজরত আদম (আ.) এবং তাঁর স্ত্রীকে বেহেশত থেকে পৃথিবীতে প্রেরণ করা হয়। পবিত্র কোরআনের দ্বিতীয় সূরা বাকারার ৩৫ নম্বর আয়াতেও এ-সংক্রান্ত বর্ণনা রয়েছে। তবে পবিত্র কোরআনে এই গাছের কোনো নির্দিষ্ট নাম উল্লেখ করা হয়নি। বিভিন্ন বর্ণনায় এই গাছকে ‘নিষিদ্ধ গাছ’ এবং গাছের ফলকে ‘নিষিদ্ধ ফল’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

 

বেহেশতের গাছ সিদরা

হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর ওপর নাজিলকৃত সূরাসমূহ তিনি মক্কা এবং মদিনায় তার উম্মত ও সঙ্গীদের শুনিয়ে ছিলেন। এই ধারাবাহিকতায় মক্কায় ঘোষিত প্রথম সূরার নাম ‘সূরা আন্ নাজম’। এই সূরাতেই সর্বপ্রথম সেজদার আয়াত নাজিল হয়, যা শুনে মুসলমান এবং কাফের, উভয় সম্প্রদায় সেজদায় শামিল হন। কোরআনের ৫৩তম এই সূরার ১৪ নম্বর আয়াতে একটি বিশেষ গাছের নাম বর্ণিত হয়েছে। কোরআনের ভাষায় এই গাছের নাম ‘সিদর’। ইংরেজিতে এই গাছ ‘লোটি ট্রি’ নামে পরিচিত। ঘন পাতায় আচ্ছাদিত এই গাছ হজরত মুহাম্মদ (সা.) শবেমিরাজের সময় ঊর্ধ্বাকাশে গমন এবং মহান আল্লাহর সাক্ষাতের সময় দেখতে পান। তাফসির মতে, শবেমিরাজের একপর্যায়ে হজরত মুহাম্মদ (সা.) এমন এক প্রান্তে পৌঁছান, যার কাছেই ছিল ‘জান্নাতুল মাওয়া’ বা আশ্রয় উদ্যান। অন্য বর্ণনা মতে, সাতটি বেহেশতের মধ্যে সব শেষে রয়েছে জান্নাতুল মাওয়া, যা নেক শরণার্থীদের আশ্রয়স্থলে পরিণত হবে। এই জান্নাতুন মাওয়ার শেষ সীমানা নির্দেশ করার জন্য রয়েছে ‘সিদরা’ নামক গাছ।

সূরা আন্ নাজমের ১৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, এই গাছ যা দিয়ে আচ্ছাদিত থাকার কথা তা দিয়েই অর্থাৎ ঘন পাতা দিয়ে আচ্ছাদিত ছিল। এই গাছের কাছেই মহানবী (সা.) ফেরেশতা জিব্রাইল (আ.)-এর সাক্ষাৎ দ্বিতীয়বারের মতো লাভ করেন। উল্লেখ্য, পৃথিবীর বুকে মক্কায় মাত্র একবার জিব্রাইল (আ.) স্বরূপে মহানবী (সা.)-কে সাক্ষাৎদান করেন। অপর বর্ণনা মতে, ‘সিদরাতুল মুনতাহা’ বলতে শেষপ্রান্তের গাছ  বোঝানো হয়েছে। এই গাছের পর কোনো ফেরেশতার প্রবেশাধিকার নেই।

গবেষণালব্ধ বর্ণনায় জানা যায়, সিদরা গাছ বা লোটি ট্রির উদ্ভিদবিদ্যা বা বোটানিক্যাল নাম হলো ‘জিজিফার্স লোটাস। ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল এবং মরক্কোর সাহারায় এই গাছ দেখতে পাওয়া যায়। এই গাছ ৬ থেকে ১৭ ফুট পর্যন্ত লম্বা এবং উজ্জ্বল সবুজ পাতাবিশিষ্ট হয়ে থাকে। গাছটির ফল গাঢ় হলুদ বর্ণের। ভিতরে বিচিবিশিষ্ট এই ফল খাওয়া যায়। আরব বিশ্ব এবং ভূমধ্যসাগর অঞ্চলের কোনো কোনো স্থানে মৃতদেহ ধোয়ার সময় এই গাছের পাতা ব্যবহৃত হয়। এ ছাড়াও বেহেশতে ‘তুবা’ নামক একটি অতি বিশাল গাছের কথা কিছু হাদিসে উল্লেখ আছে।

জাহান্নামের গাছ জাক্কুম

পবিত্র কোরআনের ১৭ নম্বর সূরা বনি ইসরাইলের ৬০ নম্বর আয়াতে একটি অভিশপ্ত গাছের কথা বলা হয়েছে। ৩৭ নম্বর সূরা সাফ্ফাতের ৬২ থেকে ৬৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, সীমা লঙ্ঘনকারীদের জন্য জান্নাতের আরাম আয়েশের বদলে রয়েছে ‘জাক্কুম’ গাছ, আল্লাহ সীমা লঙ্ঘনকারীদের জন্য পরীক্ষাস্বরূপ এই গাছ সৃষ্টি করেছেন। জাক্কুম গাছ জাহান্নামের তলদেশ থেকে ওঠে। এই গাছের গুচ্ছ শয়তানের মাথার মতো। সীমা লঙ্ঘনকারীরা, কাফেররা এই গাছ খাবে এবং তাদের পেট ভরাবে। তদুপরি তাদের দেওয়া হবে ফুটন্ত গরম পানি, পরে তাদের জাহান্নামের দিকে নিয়ে যাওয়া হবে। পবিত্র কোরআনের ৪৪ নম্বর সূরা দুখানের ৪৩ থেকে ৪৬ নম্বর আয়াতের বর্ণনা মতে, জাক্কুম গাছ হবে পাপীদের খাদ্য। গলিত তামার মতো তা পেটে ফুটতে থাকবে, যেমনটি উত্তপ্ত পানি ফুটতে থাকে। কোরআন শরিফের ৫৬ নম্বর সূরা ওয়াকিয়ার ৫০ থেকে ৫৬ নম্বর আয়াত মোতাবেক পথভ্রষ্ট এবং মিথ্যাবাদীদের একটি নির্দিষ্ট দিনের নির্দিষ্ট সময়ে একত্রিত করা হবে। তারা জাক্কুম গাছ খেতে বাধ্য হবে এবং এই খাবার (গাছ) খেয়েই তাদের পেট ভরতে হবে। এরপর তারা তৃষ্ণার্ত উটের মতো উত্তপ্ত পানি পান করবে। এটাই হবে কেয়ামতের দিন তাদের আপ্যায়ন।

আলমুনজিদ নামক আরবি অভিধান মতে, জাক্কুম জাহান্নামের গাছ। এই গাছের ফল বিষাক্ত যা পাপীদের খাওয়ানো হবে। অধিকাংশ গবেষক এবং তাফসিরবিদ মনে করেন, পৃথিবীর বুকে জাক্কুম গাছ নেই। আবার একটি অংশ মনে করেন, সুদান ও জর্ডানের কিছু অঞ্চলসহ মরুভূমিতে জন্ম নেওয়া ইউফরবিয়া আবিসসিনিকা নামক কাঁটাযুক্ত গাছই জাক্কুম গাছ। ভারতবর্ষে অতি পরিচিত ফণীমনসা গাছের সঙ্গে এই গাছের সাদৃশ্য রয়েছে।

 

ইহুদিদের গাছ ঘারকাড

মুসলিম শরিফের ২৯২২ নম্বর হাদিস মোতাবেক বর্ণিত হয়েছে যে, পৃথিবীর শেষ সময় বা কেয়ামত সেই সময় পর্যন্ত হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত মুসলমানরা ইহুদিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে।

এক্ষেত্রে আরও বর্ণিত হয়েছে যে, ততক্ষণ পর্যন্ত কেয়ামত হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না এই যুদ্ধে মুসলমানরা ইহুদি নিধন এমনভাবে চালিয়ে যাবে যে ইহুদিরা পাথর ও গাছের পেছনে লুকিয়ে থাকবে। এই সময় পাথর ও গাছের কণ্ঠস্বর শোনা যাবে, যারা বলবে, হে মুসলমান, হে আল্লাহর বান্দা, আমার  পেছনে একজন ইহুদি লুকিয়ে আছে, আমার নিকটে আস এবং তাকে হত্যা কর। এক্ষেত্রে ঘারকাড গাছ কিছুই বলবে না, কারণ এটি ইহুদিদের গাছ।

তবে এই হাদিসে ইহুদি বলতে অপশক্তিকে বোঝানো হয়েছে বলে মনে করেন একদল ইসলামী চিন্তাবিদ। কিন্তু ইহুদি সম্প্রদায় ধর্মীয় উগ্রতা ছড়াতে এই গাছের প্রসঙ্গ টেনে আনে। উল্লেখ্য, ইহুদিদের তীর্থভূমি ইসরায়েলসহ প্যালেস্টাইন এবং মধ্যপ্রাচ্যের আরও কিছু অঞ্চলে ঘারকাড গাছ দেখতে পাওয়া যায়। এই গাছ চেরি গাছের মতো এবং চেরি ফলের মতো লাল ফলে গাছটি শোভিত থাকে। ইসরায়েলের সর্বত্র বিশেষত অধিকৃত গাজা ভূখন্ডে ঘারকাড গাছ ব্যাপকহারে লাগানো হয়।

 

দেশে দেশে কোরআনিক বোটানিক গার্ডেন

আয়তনের দিক থেকে মধ্যপ্রাচ্যের ছোট্ট দেশ কাতার। তেল, গ্যাস এবং পেট্রো-কেমিক্যালের কল্যাণে সার্বিক বিচারে পৃথিবীর অন্যতম শীর্ষস্থানীয় ধনী রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে স্বল্প জনসংখ্যার এই দেশটি। ব্যবসা-বাণিজ্য এবং অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি দেশটি গুরুত্ব দিয়েছে আধুনিক ও জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনে। এই লক্ষ্যকে সামনে রেখে আজ থেকে প্রায় দুই যুগ আগে কাতারের বর্তমান আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানির বাবা (তৎকালীন আমির) শেখ হামাদ বিন খলিফা আল থানি এবং তার শিক্ষিত স্ত্রী শেখ মোজা বিনতে নাসেরের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রতিষ্ঠা করা হয় কাতার ফাউন্ডেশন। নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্মাণ এবং স্বনামধন্য বিদেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শাখা খুলে বিশ্ববাসীর প্রশংসা পেয়েছে কাতার ফাউন্ডেশন। এই কাতার ফাউন্ডেশনেরই সাম্প্রতিক প্রয়াস কোরআনিক বোটানিক গার্ডেন (বোটানিকা গার্ডেন) বা কোরআন ভিত্তিক বোটানিক গার্ডেন, পৃথিবীর বুকে এ ধরনের বাগান এটাই প্রথম। কোরআন এবং হাদিসে যেসব গাছ, লতা, পাতা, ফুল, ফল ও মূলের বর্ণনা রয়েছে, তার প্রায় সবই এই বাগানে রোপণ ও প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এক দর্শনার্থীর মতে, জাহান্নামের গাছ হিসেবে পরিচিত ‘জাক্কুম’ গাছ এবং ইহুদিদের গাছ নামে উল্লিখিত ঘারকাড গাছ ব্যতীত কোরআন-হাদিসে বর্ণনাকৃত প্রায় সব গাছই ক্রমান্বয়ে দেখা যাবে এই কোরআনিক বোটানিক্যাল গার্ডেনে। এই বাগানের বিভিন্ন বিভাগে প্রায় ১৫০ ধরনের গুল্ম, লতা ও গাছ ইতিমধ্যে সন্নিবেশিত হয়েছে, বিভিন্ন প্রচেষ্টায় এই কার্যক্রম সম্ভব হয়েছে বলে দাবি করেছেন কাতার ফাউন্ডেশনের ভাইস চেয়ারম্যান ড. সাইফ আল হাজারী। স্থানীয় কিছু উদ্ভিদসহ প্রায় ৩৫০ ধরনের উদ্ভিদরাজি রোপণ ও পরিচর্যার পরিকল্পনা রয়েছে এই প্রকল্পে। তিন পর্বের প্রকল্পটি বিস্তৃত হবে প্রায় ২৪ হেক্টর জায়গাজুড়ে। ইতিমধ্যে প্রকল্পের একটি অংশ খুলে দেওয়া হয়েছে। কাতারের তৎকালীন ফার্স্টলেডি এবং কাতার ফাউন্ডেশনের কো-ফাউন্ডার শেখ মোজা নাসের জান্নাতের গাছ নামে খ্যাত ‘সিদরা’ গাছের চারা রোপণের মধ্য দিয়ে এই কোরআনিক বোটানিক গার্ডেনের অগ্রযাত্রা শুরু করেন। এই বাগান বর্তমানে একাধারে শিক্ষা, গবেষণা, বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ, পরিবেশ রক্ষা, ইসলামিক সংস্কৃতির প্রচার, সুস্থ বিনোদন প্রভৃতি ক্ষেত্রে ব্যাপক অবদান রাখছে। এই বাগান ক্রমেই সম্প্রসারিত হচ্ছে একটি বোটানিক জাদুঘর। এই জাদুঘরে কোরআন এবং হাদিসে উল্লিখিত গাছ-গাছালির তথ্য, ছবি, বীজ, জীবন্ত গাছ, গাছের প্রতিকৃতি প্রভৃতি স্থান পেয়েছে।

২০১৪ সালে সংযুক্ত আরব আমিরাতের সারজায় আরও একটি ইসলামিক বোটানিক গার্ডেন চালু হয়েছে। সারজার শাসক ড. শেখ সুলতান বিন মুহাম্মদ আল কাসেমির উদ্যোগে এই বাগান তৈরি করা হয়। এই বাগানে কোরআন ও হাদিসে উল্লিখিত বৃক্ষরাজির আরবি, ইংরেজি এবং বৈজ্ঞানিক নাম, ঔষধি গুণ এবং পুষ্টিগুণ প্রদর্শিত হয়েছে, একই আদলে পাকিস্তান ও সৌদি আরবেও কোরআন-হাদিসভিত্তিক বোটানিক গার্ডেন এবং ইসলামিক গার্ডেন তৈরি করা হয়েছে, যার পরিধি, সৌন্দর্য ও গাছের সংখ্যা প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে।

 

খ্যাতির শীর্ষে খেজুর গাছ

কোরআন এবং হাদিসে বহুবার বহুভাবে উঠে এসেছে খেজুর গাছের কথা। পবিত্র কোরআনের ৬ নম্বর সূরা আন আমি-এর ৯৯ নম্বর আয়াতের বর্ণনা মতে, মহান আল্লাহ আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করেন, যার দ্বারা তিনি সব ধরনের উদ্ভিদের চারা তৈরি করেন, অনন্তকাল তা থেকে সবুজ পাতা উৎপন্ন করেন এবং সেখান থেকে ঘন সন্নিবিষ্ট শস্যদানা উৎপাদন করেন এবং খেজুর গাছের চূড়া থেকে ঝুলন্ত কাঁদি (খেজুর) বের করেন আর আঙ্গুর জয়তুন ও ডালিমের বাগান সৃষ্টি করেন। এসব ফল একটি আরেকটির সঙ্গে কোনো ক্ষেত্রে সামঞ্জস্যপূর্ণ আবার কোনো ক্ষেত্রে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। এই আয়াতে মহান আল্লাহ এসব গাছ যখন ফলবতী হয় এবং পরিপূর্ণতা পায়, তখন তার (গাছের) প্রতি লক্ষ্য করার নির্দেশ দেন এবং মুমিনদের জন্য এতে অবশ্যই নিদর্শন রয়েছে বলে বর্ণনা করেন। প্রায় একই ধরনের বর্ণনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে একই সূরার (আল আম) ১৪১ নম্বর আয়াতে। অন্যদিকে ৩৬ নম্বর সূরা ইয়াসিনের ৩৩ ও ৩৪ নম্বর আয়াতের আলোকে মহান আল্লাহ মৃত ধরিত্রী অর্থাৎ মরুভূমি পুনর্জীবিত করা এবং সেই জমিতে শস্য উৎপাদনের কথা উল্লেখ করেছেন। সুনির্দিষ্টিভাবে এখানে খেজুর ও আঙ্গুরের বাগান সৃষ্টি এক ঝরনাধারা বইয়ে দেওয়ার কথা উল্লেখ করেছেন। আজ থেকে ১৪০০ বছর আগে মহাবিশ্ব বিশেষত চন্দ্রের গতিপথ নিয়ে মানুষের তেমন কোনো ধারণাই ছিল না। এই গতিপথ বা কক্ষপথের স্বরূপ বোঝানোর জন্য সূরা ইয়াসিনের ৩৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘আর চন্দ্রের জন্য আমি বিভিন্ন কক্ষপথ নির্দিষ্ট করেছি, অবশেষে তা শুকনো বাঁকা খেজুর শাখার আকার ধারণ করে।’ সূরা হাক্কার ৭ নম্বর আয়াতে ধ্বংসপ্রাপ্ত মানুষ বা অবিশ্বাসীদের মৃতদেহকে তুলনা করা হয়েছে পড়ে থাকা মৃত বা অন্তসারশূন্য খেজুর গাছের গুঁড়ির সঙ্গে। মহান আল্লাহর বিশেষ কুদরতে কুমারী মাতা মারিয়াম (আ.) গর্ভধারণ করেন এবং হজরত ঈসা (আ.)-কে জন্ম দেন। এ প্রসঙ্গে ১৯ নম্বর সূরা মারিয়মের ২২ থেকে ২৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, গর্ভবতী অবস্থায় মা মারিয়াম (আ.) লোকালয় ছেড়ে দূরে চলে যান। প্রসব বেদনা তাকে এক খেজুর গাছের নিচে আশ্রয় নিতে বাধ্য করল। একপর্যায়ে ফেরেশতা তাকে তার দিকে খেজুর গাছের কা-  বাঁকাতে পরামর্শ দেন এবং তা পাকা খেজুর দেবে বলে ঘোষণা দেন।

বিভিন্ন হাদিসেও খেজুর গাছের বর্ণনা পাওয়া যায় বিভিন্নভাবে। সহি  বোখারি শরিফের ষষ্ঠ খ-ের ৬০ নম্বর বইয়ের ২২০তম হাদিসে ইবনে ওমর (রা.)-কে উদ্ধৃত করে বর্ণিত হয়েছে, একদা হজরত মুহাম্মদ (সা.) তাঁর অনুসারীদের এমন একটি গাছের নাম উল্লেখ করতে বলেন, যে গাছের প্রকৃতি (চরিত্র) একজন মুসলমানের মতো। এই গাছের পাতা কখনো ঝরে পড়ে না এবং গাছটি যে কোনো সময় ফল দিয়ে থাকে। এক্ষেত্রে ইবনে ওমর (রা.) খেজুর গাছের কথা মনে মনে ভাবলেও তাঁর সম্মুখে উপস্থিত হজরত আবু বকর (রা.) এবং বাবা হজরত ওমর (রা.)-কে নীরব থাকতে দেখে তিনিও নীরবতা পালন করেন। সবাইকে নীরব থাকতে দেখে মহানবী (সা.) বলেন যে, এটা হলো খেজুর গাছ।

সহি বোখারি শরিফের ৬১ নম্বর বইয়ের ৯৩ নম্বর হাদিস, চতুর্থ খন্ডের ৫৬ নম্বর বইয়ের ৭৮৪ নম্বর হাদিস এবং অন্যত্র ৩৫৮৪ নম্বর হাদিসে এক খেজুর গাছের কান্নার কথা উল্লিখিত হয়েছে। বর্ণনা মতে, হজরত মুহাম্মদ (সা.) খুতবা পড়ার জন্য একটি উঁচু খেজুর গাছের কান্ডের ওপর দাঁড়াতেন। মহানবী (সা.)-এর অনুমতি নিয়ে মাটি দিয়ে তৈরি একটি উঁচুস্থান (মিম্বর) তৈরি করেন। পরবর্তী শুক্রবারে হজরত মুহাম্মদ (সা.) খুতবা পাঠের জন্য নবনির্মিত মাটির উঁচুস্থানের দিকে যাত্রা করেন। আগে ব্যবহৃত খেজুর গাছের কান্ড অতিক্রমের সময় কা-টি শিশুর মতো (কারও মতে গর্ভবতী উটের মতো) কাঁদতে শুরু করে। ফলে মহানবী (সা.) উঁচুস্থান থেকে নিচে নেমে আসেন এবং খেজুরের কা-টি জড়িয়ে ধরেন। মহানবী (সা.) এর মতে, খেজুর গাছ প্রতি শুক্রবার মহানবী (সা.)-এর কণ্ঠ থেকে পবিত্র কোরআন ও হাদিসের কথা শুনতে পেত। এক্ষেত্রে আজ তা শুনতে পায়নি বলে কান্ড টিকে এভাবে কাঁদতে দেখা যায়।

সর্বশেষ খবর