শুক্রবার, ২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা

যে শহর পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচুতে

সাইফ ইমন

যে শহর পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচুতে

অবিশ্বাস্য রকম উঁচুতে অবস্থিত স্বর্ণনগরী এটি। ইউরোপের আল্পস পর্বতমালার সর্বোচ্চ উচ্চতা যত, পেরুর লা রিনকোনাডা শহর তার চেয়েও ১০০০ ফুট বেশি উচ্চতায় অবস্থিত। আন্দিস পর্বতমালার কোলে অবস্থিত এই শহরটিই পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচুতে অবস্থিত শহর। শহরটিতে বসবাস করে প্রায় ৫০ হাজার মানুষ। আর সবার এখানে জড়ো হওয়ার পেছনে যে জিনিসটি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত সেটি হলো সোনা। ইনকারা যাকে বলত ‘সূর্যের ঘাম’! সেই ইনকাদের সময় থেকেই এটি স্বর্ণনগরী হিসেবে বিখ্যাত। আর এখনো নাকি এখানে কয়েকশ কোটি ডলারের সোনা রয়েছে!

 

খনির বর্তমান চিত্র

পৃথিবী অনেক দূর এগিয়েছে। সর্বত্রই লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। দৈনন্দিন জীবন থেকে শুরু করে সোনা উত্তোলন পর্যন্ত সর্বত্রই আধুনিকতার জয়জয়কার। কিন্তু এই আধুনিকতার ছোঁয়া লাগেনি লা রিনকোনাডার সোনার খনি কিংবা দৈনন্দিন জীবনযাত্রায়। এখানকার সোনার খনিতে কাজ করা হয় সেই প্রাচীন পদ্ধতিতে। আজ থেকে একশ দেড়শ বছর আগে যেভাবে সোনা উত্তোলন করত, এখনো সেই পদ্ধতি চালু আছে। শ্রমিকদের কাজ করতে হয় অস্বাস্থ্যকর আর ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে। প্রতিকূল পরিবেশে করতে হয় কঠোর আর অমানবিক পরিশ্রম। বিস্ময়কর মনে হতে পারে, ছোট একটি আংটিতে যে পরিমাণ সোনা রয়েছে তা সংগ্রহ করতে পাহাড় কেটে সরাতে হয় ২৫০ টন পাথর! গোদের উপর বিষ ফোঁড়ার মতো এখানে শ্রমিকদের পারিশ্রমিক দেওয়া হয় স্পেনিশ আমলে চালু হওয়া ক্যাচেররো নামক নিষ্ঠুর পদ্ধতিতে। এই পদ্ধতিতে শ্রমিকরা খনিতে ৩০ দিন বিনা বেতনে কাজ করেন। ৩১তম দিনে তাদের চার ঘণ্টা বা তার কিছু বেশি সময়ের একটা সুযোগ দেওয়া হয়। এ সময়ের ভিতরে শ্রমিকরা বস্তায় করে যত খুশি তত আকরিক খনি থেকে নিয়ে যেতে পারবেন। ‘যত খুশি তত’ বলা হলেও সুযোগটা তারা পাবেন মাত্র ‘একবার’ এবং বস্তা বহনের জন্য কোনো যানবাহন ব্যবহার করতে পারবেন না। অর্থাৎ যতটুকু নেওয়া যায়। সত্যিকার অর্থে তাই ৩০ দিনের অমানবিক পরিশ্রমের বিনিময়ে শ্রমিকরা বস্তায় করে অল্পকিছু আকরিকই নিতে পারেন। এই লটারি পদ্ধতিতে যে কোনো কিছুই হতে পারে- শ্রমিকরা সাধারণত তাদের আকরিক থেকে অল্প কিছু মূল্যের সোনা পান, আবার কারও কারও আকরিক হয় মূল্যহীন- সেখানে কোনো সোনাই থাকে না। কিন্তু শ্রমিকরা স্বপ্ন দেখেন, তাদের আকরিক থেকে একদিন এমন পরিমাণ সোনা পাবেন যাতে বাকি জীবনে তাদের ভাগ্য পরিবর্তন হয়ে যাবে। কিন্তু এমনটা খুব কমই ঘটে। তারপরও ঝাঁকে ঝাঁকে সোনা সন্ধানী আর শ্রমিকরা লা রিনকোনাডা শহরে ভিড় জমাচ্ছেন। গত ১০ বছরে এ শহরে জনসংখ্যা বেড়েছে ২৩০%। একদিকে বেকারত্ব, অন্যদিকে বিশ্বব্যাপী সোনার দামের ক্রমাগত বেড়ে চলা-এ দুই কারণে মানুষজন এখানে বাসস্থান গড়ে চলছে। কিন্তু এই প্রতিকূল পরিবেশে কেউ স্থায়ীভাবে থাকার জন্য আসে না।

 

ইনকাদের সোনার খনি

অনেক দিন আগের কথা। একেবারে ইনকা সাম্রাজ্যের গল্প। পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম ধনী ও সভ্য প্রাচীন জাতি ইনকারাই সর্বপ্রথম সোনার সন্ধান পায় লা রিনকোনাডায়। এর পর থেকেই এটিকে একটি স্বর্ণনগরী হিসেবে জেনে এসেছে পৃথিবীবাসী। ইনকাদের পথ অনুসরণ করে পরবর্তী লা রিনকোনাডায়ও ভিড় জমায় সোনালোভী স্প্যানিশরা। সেই সময় ইনকা সাম্রাজ্য তো বটেই গোটা বিশ্ব জয় করার এক অসম্ভব উদ্দেশ্য নিয়ে এগোচ্ছিল স্প্যানিশরা। রাজ্য জয়ের পাশাপাশি সোনা আর হীরা-মুক্তার খোঁজে চষে বেড়িয়েছে পৃথিবীর এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত। সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার হলো এত বছর পেরিয়ে গেছে, তবু সোনা সন্ধানীদের কাছে লা রিনকোনাডার গুরুত্ব এতটুকু কমেনি। লা রিনকোনাডা এমন একটি জায়গা, যেখানে সোনা সন্ধানীরা নিশ্চিতভাবে জানে সোনা আছে। লা রিনকোনাডা এমন একটি জায়গা যেখানে সব কিছুই আবর্তিত হয় সোনাকে ঘিরে। ভূ-তত্ত্ববিদের মতে, ‘এখানে এখনো কয়েকশ’ কোটি ডলারের বেশি মূল্যের সোনা রয়েছে।’ কিন্তু সেই সোনাকে হাতের মুঠোয় পাওয়াটা সহজ কোনো ব্যাপার নয়। লা রিনকোনাডায় অসংখ্য ছোট বড় সোনার খনি রয়েছে। এখানে পাহাড়ের গা থেকে বা খোলা জায়গায় মাটি সরিয়ে যেমন আকরিক সংগ্রহ করা হয়, আবার সুড়ঙ্গ কেটে পাহাড়ের ভিতরে ঢুকে সেখান থেকেও আকরিক সংগ্রহ করা হয়। একে বলা হয় হার্ড রক মাইনিং। লা রিনকোনাডায় হার্ড রক মাইনিংয়ে বেশি সোনা পাওয়া যায়। এখানে সোনার সন্ধানে যুগের পর যুগ ধরে পাহাড়ের ভিতরে মাইলের পর মাইল সুড়ঙ্গ কাটা হয়েছে। সুড়ঙ্গের ভিতরের বাতাসে অক্সিজেনের স্বল্পতা, ডিনামাইট বিস্ফোরণের কারণে সৃষ্ট ধুলা আর বিষাক্ত গ্যাস, আলোর স্বল্পতা, অপ্রত্যাশিতভাবে আঘাত পেয়ে আহত হওয়া-এসবের মধ্যেই শ্রমিকরা কাজ করে যান। পাথর ধসে সুড়ঙ্গ বন্ধ হয়ে শ্রমিকদের আটকা পড়ার ঘটনা প্রায়ই ঘটে। প্রায়ই ঘটে অনাকাক্সিক্ষত মৃত্যুর ঘটনাও ক্ষুধায় মৃত্যু, টানেল বন্ধ হয়ে মৃত্যু, অক্সিজেনের অভাবে শ্বাসকষ্ট হয়ে মৃত্যু, বিষাক্ত বর্জ্য আর গ্যাসের প্রভাবে মৃত্যু।

সর্বশেষ খবর