শুক্রবার, ২০ মার্চ, ২০২০ ০০:০০ টা

করোনাসহ তিন সংকটের মুখে জরুরি অবস্থা চাই

পীর হাবিবুর রহমান

করোনাসহ তিন সংকটের মুখে জরুরি অবস্থা চাই

করোনার ভয়াবহতায় মুখ থুবড়ে পড়েছে গোটা বিশ্ব। কার্যত অচল পৃথিবী থেমে গিয়ে করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে জীবন বাঁচানোর লড়াইয়ে এখন মুখোমুখি। মানবতার লড়াইয়ে মানুষের জীবন রক্ষায় গোটা বিশ্ব এখন এক মোহনায় মিলিত। বিশ্বের রাষ্ট্রনায়করা লড়ছেন জনগণের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে। মহাশক্তিধর রাষ্ট্রগুলো যারা একসময় যুদ্ধের হুঙ্কার দিতেন, চাইলেই যে কোনো দেশ আক্রমণ করে দখল নিতে পারতেন তারাও এখন করোনাভাইরাসের সামনে নিষ্প্রভ, অসহায়। চীনের উহান থেকে করোনাভাইরাস ভয়ঙ্কর মূর্তি নিয়ে বিশ্বের ১৭৫টি দেশকে আক্রান্ত করেছে। পরাক্রমশালী রাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দুনিয়া এই ভয়াবহ ভাইরাসের চিকিৎসা আবিষ্কার না হওয়ায় কেবল সচেতনতা, আইসোলেশন আর কোয়ারেন্টাইনেই আটকে আছে। নীরব, নিথর হয়ে গেছে একেকটি রাষ্ট্রের রাজপথগুলো। জরুরি অবস্থা, লকডাউন একের পর এক ঘোষিত হচ্ছে। নীরব, নিথর হয়ে গেছে পৃথিবীর দিবারাত্রি সরগরম থাকা একেকটি শহর, নগর ও পর্যটনস্থল। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাটবাজার, শপিং মল বন্ধ ঘোষণা করে দেশে দেশে খাবার আর ওষুধের দোকান ছাড়া কেবল হাসপাতালের ফটক খোলা রেখেছে। রাজতন্ত্রের অবসানের পর বলা হয়ে থাকে ব্রিটেনের রাজা, স্প্রেইডের রাজা, ক্লাভসের রাজা, ডাইসের রাজা, হার্টসের রাজা টিকে আছেন। সংসদীয় গণতন্ত্রের তীর্থভূমি ব্রিটেনের রাজতন্ত্রকে সেদেশের জনগণ আশীর্বাদের বটবৃক্ষ মনে করে। সেই ব্রিটেনের রানীও শত বছরের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে রাজপ্রাসাদ ছেড়ে কোয়ারেন্টাইনে চলে গেছেন। কানাডার জনপ্রিয় প্রধানমন্ত্রী মানবতাবাদী জাস্টিন ট্রুডো কোয়ারেন্টাইন থেকে তার জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছেন। সকল দায়িত্ব নিয়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। তার স্ত্রী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন। চীনের পর করোনার ভয়াবহতা দেখা দিয়েছে ইতালিতে। সেখানে লাশের মিছিলের সামনে নিস্তব্ধ মানুষ, নিস্তব্ধ রাষ্ট্র অসহায়। ইসলামী রাষ্ট্র ইরানের অবস্থাও করুণ। প্রকৃতির এই অভিশাপ থেকে কে ধনী রাষ্ট্র কে গরিব রাষ্ট্র কিংবা কোনটা ইসলামিক রাষ্ট্র অথবা কোন দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ খ্রিস্টান, ইহুদি, বৌদ্ধ, হিন্দু নাকি মুসলমান  সেটি দেখছে না। মরণ আঘাত ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে মানব জাতির ওপর আঘাত হেনেছে। মানব জাতির অস্তিত্ব রক্ষার এই লড়াইয়ে মুসলমানদের পবিত্র স্থান আল্লাহর ঘর কাবাঘর থেকে মধ্যপ্রাচ্যের সব মসজিদে নামাজ বন্ধ হয়ে গেছে। দেশে দেশে সব গির্জা, মন্দির বা ধর্মশালায় সমাগম বা প্রার্থনা নিষিদ্ধ হয়ে গেছে। তাবৎ শিক্ষাঙ্গন বন্ধ ঘোষিত হয়েছে। চীনের ভয়াবহতা দেখে ইতালি যেমন উদাসীনতা দেখিয়ে এখন একের পর এক লাশের সংখ্যা গুনছে আর শোকার্ত হৃদয়ে ক্রন্দন করছে সেখানে ইরানের ইসলামী চিন্তাবিদদের মধ্যেও শোকের মাতম চলছে। প্রকৃতির এই আঘাত রুখে দাঁড়ানোর লড়াই গোটা পৃথিবী কার্যত সংঘবদ্ধভাবে করছে।

পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতও সীমাবদ্ধতা নিয়ে বিশাল জনগোষ্ঠীর জীবন রক্ষায় যেখানে লড়ছে সেখানে সচেতনতার সীমানা লঙ্ঘন করে, চিকিৎসা বিজ্ঞানের চিরসত্যকে অস্বীকার করে ধর্মান্ধ একটি গোষ্ঠী গো-মূত্র পান করে আরেক দফা বিপদ ডেকে আনছে। চীনের ভয়াবহতা দেখে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যমন্ত্রীসহ দায়িত্বশীলরা বলেছিলেন, পরিস্থিতি মোকাবিলায় আমরা সক্ষম। বিপদ যখন দরজায় কড়া নেড়ে উঠেছে, করোনাভাইরাসে যখন মৃত্যুর খবর ছড়িয়েছে, আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে তখন এই নির্মম সত্য উদ্ভাসিত হয়েছে যে আমরা কোনো কার্যকর প্রস্তুতিই নেইনি। তিন লাখ প্রবাসী দেশে ফিরেছেন যার অধিকাংশ করোনা আক্রান্ত ইতালি থেকে। আমরা তাদের বিমানবন্দরে পরীক্ষা করার সামর্থ্যটুকুও দেখাতে পারিনি। এমন উদাসীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও তার মন্ত্রণালয় যেটি আগেই দুর্নীতিতে সীমাহীন দুর্নাম কুড়িয়েছে। এবারের বিপদে প্রতিরোধের প্রথম দফায় সুনাম বা প্রশংসা কুড়ানোর উদাহরণ স্থাপন করতে পারেনি। হজক্যাম্পকে প্রয়োজনীয় কোয়ারেন্টাইন সেন্টারে পরিণত করতে পারেননি। তিন লাখ বিদেশির মধ্যে মাত্র ২৬৮ জনকে পরীক্ষা করা হয়েছে। সারা দেশে চিকিৎসাব্যবস্থা নিশ্চিত করা না গেলেও বিদেশ থেকে আসা প্রবাসীরা মানুষের মধ্যে মিশে গেছেন। যাদের অনেকের শরীরে ভয়ঙ্কর ছোঁয়াচে করোনাভাইরাসের জীবাণু রয়েছে। বিভিন্ন স্থানে কোয়ারেন্টাইন থেকে অনেকে পালিয়ে যাচ্ছেন। পরীক্ষার জন্য করোনা শনাক্তের কিট পর্যন্ত আমরা পর্যাপ্ত সংরক্ষণ করে রাখিনি। এমনকি যে চিকিৎসক, নার্স, টেকনিশিয়ান ও স্বাস্থ্যকর্মীরা পরীক্ষা করবেন বা চিকিৎসাসেবা দেবেন তাদের প্রতিরোধক সরঞ্জাম পর্যন্ত আমাদের নেই। জীবন রক্ষায় চিকিৎসকরা জীবন বাজি রাখবেন কিন্তু নিশ্চিত ঝুঁকির মধ্যে নিজেকে ঠেলে দিয়ে নয়। চীনে যে চিকিৎসক করোনা রোগী শনাক্ত করেছিলেন সেই মহান মানুষটি মৃত্যুবরণ করেছেন। চীন আজ সামলে উঠেছে। আমাদের জরুরি ভিত্তিতে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রকে কিট তৈরির যে অনুমতি দেওয়া হয়েছে সেখানে সরকারকে ধন্যবাদ দেওয়ার আগে দেশের যে সুসন্তান বিজন কুমার শীল গবেষণা করে কীট আবিষ্কার করেছেন তাকে আজ রাষ্ট্রীয় বরমাল্য দেওয়া উচিত। তিনি গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রধান গবেষণা বিজ্ঞানী। চিকিৎসকদের সুরক্ষার সেইফটি আইসোলেশন গাউন, মাস্ক, স্যানিটাইজার, সেইফটি গগলসসহ সুরক্ষা সামগ্রী ও টেস্ট কিট জরুরি ভিত্তিতে আমদানি করা জরুরি। একই সঙ্গে শুধু পাঁচটি হাসপাতালকে করোনা রোগীদের জন্য নির্দিষ্ট করলেই হবে না, সারা দেশের সব হাসপাতালেই দ্রুত আইসোলেশন সেন্টার ও ল্যাব চালু করা দরকার। মনে রাখতে হবে, সীমাবদ্ধতা যেমন রয়েছে, তেমনি ১৮ কোটি মানুষ গিজগিজ করছে যার সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ সকল সচেতনতার বাইরে। মানুষের জীবন রক্ষায় সচেতনতা সৃষ্টিতে প্রয়োজনে রাষ্ট্রের বলপ্রয়োগ দরকার। মসজিদ, মন্দির, উপাসনালয়ে জমায়েত নিষিদ্ধ করে দিতে হবে। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজের সময়সীমা নতুন করে সাজাতে হবে। আমরা নির্বাচন পর্যন্ত বন্ধ করতে পারিনি। সিইসি বলেছেন, নির্বাচন বন্ধ হবে না, করোনা চলে যাবে। হায়রে দায়িত্বশীল। লক্ষ্মীপুরে মোনাজাতের নামে মুসল্লিদের যে বিশাল জনস্রোত তা আজকে মানুষের জন্য হুমকি। কাবাঘরের চারপাশে যেখানে মানুষ ঘুরছে না, সেখানে লাখো জনতার ঢল নামিয়ে মোনাজাত বিবেচনা সম্মত নয়। জনগণকেও গণজাগরণ ঘটিয়ে সচেতনতায় নিয়ে আসতে হবে। পাশাপাশি সরকারকে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা ও চিকিৎসা ব্যবস্থার পর্যাপ্ত আয়োজন সম্পন্ন করে কঠোর অবস্থানে যেতে হবে। জরুরি অবস্থার সময় দরজায় কড়া নাড়ছে। মনে রাখতে হবে, তিন বিপদের মুখে আমরা। এক, ভয়াবহ করোনার মুখোমুখি এখন। দুই, সামনে ডেঙ্গুর প্রকোপ আরেক মৃত্যুকূপ হয়ে আসছে। তিন, করোনার প্রভাবে বিশ্বে অর্থনৈতিক মন্দার যে সুর উঠেছে তার প্রভাব আমাদেরও অর্থনৈতিক বিপর্যয় ঘটাবে। এখানে রাষ্ট্রকে দেশের শিল্প-কলকারখানার মালিকই নয়, শ্রমিক ও কৃষকের পাশে সহযোগিতার হাত বাড়ানোর নীতি গ্রহণ করতে হবে। একদল মন্ত্রী নেতাদের দায়িত্বহীন কথাবার্তা, অতিকথন ও বিশাল বহর নিয়ে সফর বন্ধ করতে হবে। লোকসমাগমের নিষেধাজ্ঞা অনিবার্য হয়ে পড়েছে।

আমি বারবার নিবেদন করছি, প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে দেশের সকল রাজনীতিবিদ, খ্যাতনামা চিকিৎসক, সরকারি-বেসরকারি শীর্ষ হাসপাতালের প্রধানদের ও দেশসেরা ব্যবসায়ীদের নিয়ে জাতীয় দুর্যোগ প্রতিরোধ কমিটি গঠন করা জরুরি। এই তিন সংকটের মুখে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে প্রয়োজনে সেনাবাহিনীকে নামাতে হবে। একই সঙ্গে গোটা পৃথিবী যেখানে মানুষের জন্য লড়ছে, দেশে যেখানে মানুষ মানুষের জন্য সাহায্যের মানবিক হাত প্রসারিত করবে সেখানে একদল মুনাফাখোর, মজুদদার নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের দাম বাড়িয়ে চলছে। বাণিজ্যমন্ত্রী আগে থেকেই ব্যর্থ হয়ে আসছেন।  জনগণকেই এটা প্রতিরোধ করতে হবে। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের সাঁড়াশি অভিযান বাড়াতে হবে। জনগণকেও বেঁহুশ হয়ে একাই সব পণ্যসামগ্রী কিনে ফেলার অসুস্থ প্রতিযোগিতা থেকে  বিরত থাকতে হবে।

                লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।

সর্বশেষ খবর