শুক্রবার, ১৭ এপ্রিল, ২০২০ ০০:০০ টা

যে কারণে বন্ধ কাবা শরিফের কপাট

মেজর নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ (অব.) পিএইচডি

যে কারণে বন্ধ কাবা শরিফের কপাট

যেভাবে কাবার সৃষ্টি

পবিত্র কোরআনের তৃতীয় সূরা আল ইমরানের ৯৬ নম্বর আয়াতে পবিত্র কাবাঘরকে মানবজাতির জন্য সর্বপ্রথম ঘর (উপাসনালয়) বলে উল্লেখ করা হয়েছে। যা মহান আল্লাহর আশীর্বাদপ্রাপ্ত এবং বিশ্ব জগতের দিশারী। অন্যদিকে ২২নং সূরা হজের ২৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘আর স্মরণ কর, যখন আমি (আল্লাহ) ইব্রাহিমের জন্য কাবা শরিফের জায়গা ঠিক করে দিয়েছিলাম (তখন) আমি বলেছিলাম আমার সঙ্গে কোনো শরিক দাঁড় করিও না ও আমার ঘরকে পবিত্র রেখ তাদের জন্য যারা তাওয়াফ করে এবং যারা নামাজে দাঁড়ায় রুকু ও সেজদা করে।’

পবিত্র কেরআনের দ্বিতীয় সূরা বাকারার ১২৭নং আয়াতে হজরত ইব্রাহিম (আ.) এবং তাঁর পুত্র ইসমাইল (আ.) কাবাঘরের ভিত্তি স্থাপন করেন বলে উল্লিখিত আছে। পবিত্র কাবাঘরের পাশে ‘মাকাম-ই ইব্রাহিম’ নামের একটি পাথর আছে, যেখানে হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর পায়ের ছাপ রয়েছে। কথিত আছে হজরত ইব্রাহিম (আ.) এ পাথরের ওপর দাঁড়িয়ে কাবাঘরের উপরের অংশের নির্মাণ কাজ করেন। আবার এ পাথরের ওপর দাঁড়িয়ে এবং নিজ পুত্র হজরত ইসমাইল (আ.)-কে কাঁধে বসিয়ে তিনি সবচেয়ে উপরের অংশ নির্মাণ করেন বলেও বর্ণিত আছে। এ সময় মহান আল্লাহর নির্দেশে পাথরটি কাদার মতো নরম হয়ে যায় এবং সেই পাথরে হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর পা দেবে যায় বলে বিশ্লেষকদের মত। তাই ‘মাকাম-ই ইব্রাহিম’-এ এখনো হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর পায়ের ছাপ বা দাগ দেখা যায়।

ত্রয়োদশ শতকে সিরিয়ায় জন্ম নেওয়া বরেণ্য ইতিহাসবিদ এবং তাফসিরকারী ইবনে কাথির কাবার বিষয়ে দুটি ব্যাখ্যা তুলে ধরেছেন। তার মতে, পৃথিবীতে মানুষ আগমনের আগে পবিত্র কাবা এবং মসজিদ আল হারামের স্থানটি ফেরেশতাদের ইবাদতের স্থান ছিল। মানুষ সৃষ্টির পর এখানে একটি উপাসনালয় নির্মিত হয়। তবে হজরত নূহ (আ.)-এর জামানায় মহাপ্লাবনে সেই উপাসনালয় হারিয়ে যায়। অপর ব্যাখ্যায় তিনি হজরত ইব্রাহিম (আ.) এবং তাঁর পুত্র হজরত ইসমাইল (আ.)-এর আমলে কাবাঘর নির্মাণের বর্ণনা দেন, যা পবিত্র কোরআনে উল্লেখ রয়েছে। এ ক্ষেত্রে লক্ষণীয় যে, ধারণা করা হয় খ্রিস্টপূর্ব ১৯৯৭ থেকে ১৮২২ অব্দ, এই ১৭৫ বছর বেঁচে ছিলেন হজরত ইব্রাহিম (আ.)।

তাঁর মৃত্যুর প্রায় ২৫৭৩ বছর পর হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জন্ম হয়। এ দীর্ঘ সময়ে অসংখ্য নবী-রসুলের আগমন ঘটে। তবে মক্কা এলাকায় মহানবী (সা.)-এর জন্মের সময় আরবের লোকেরা ছিল পথভ্রষ্ট এবং অন্ধকারে নিমজ্জিত। মক্কাবাসী ক্রমান্বয়ে একাত্ববাদ থেকে সরে যায় এবং দেব-দেবীর পূজায় ফিরে যায়। তখনই জন্ম নেন মহানবী (সা.)। যিনি কাবা থেকে সব দেব-দেবী সরিয়ে মহান আল্লাহর ইবাদত এবং সঠিক পদ্ধতিতে হজ চালু করেন। মহানবী (সা.)-এর হাদিস মতে, মদিনায় এক রাকাত নামাজ অন্যত্র ৫০ হাজার রাকাত নামাজ আদায়ের সমান এবং পবিত্র কাবায় এক রাকাত নামাজ অন্যত্র এক লাখ রাকাত নামাজের সমান। (সূত্র সহি বোখারি)।

কাবা নিয়ে কিছু কথা

ইসলাম ধর্মের প্রচার এবং প্রসারের শুরু থেকেই সমগ্র মুসলিম জাতির কাছে এক আবেগ এবং অনুভূতির নাম পবিত্র কাবাঘর। ‘কাবা’ শব্দটির অর্থ কিউব বা চারদিকে সমান চার কোনাবিশিষ্ট বস্তু বা ঘর।

কাবাঘরের দিকে মুখ করে নামাজ আদায় এবং মহান আল্লাহর প্রতি মাথানত করে সমস্ত পৃথিবীর মুসলমান সম্প্রদায়। আর পবিত্র কাবাঘরকে কেন্দ্র করে কাবার চারদিকে ঘিরে গড়ে উঠছে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ উপাসনালয় মসজিদ আল হারাম বা পবিত্র মসজিদ। এ মসজিদকে পবিত্র কোরআনের পঞ্চম সূরা মায়িদার ৯৭ নং আয়াতে ‘বাইতুল হারাম’ (পবিত্র ঘর), দ্বিতীয় সূরা বাকারার ১২৫ নং আয়াতে ‘আল বাইত’ (বিশেষ ঘর) এবং ২২ নং সূরা হজের ২৬ নং আয়াতে ‘বাইতিয়া (আমার অর্থাৎ আল্লাহর ঘর) ও ২৯ নং ‘আয়াতে বাইতিল আতিক’ (প্রাচীন ঘর) নামে উল্লেখ করা হয়েছে। অপরদিকে ১৪ নং সূরা ইব্রাহিমের ৩৭ নং আয়াতে মহাপবিত্র এ স্থানকে ‘বাইতিকাল মহারুরামি’ অর্থাৎ মহা পবিত্র ঘর নামে সম্মানিত করা হয়েছে। পবিত্র কাবাঘর সাতবার প্রদক্ষিণ তথা তাওয়াফ করা ওমরাহ এবং বার্ষিক হজের অন্যতম শর্ত। কাবা শরিফের এক কোনায় রয়েছে হজরে আসওয়াত বা কালো পাথর। যা স্পর্শ এবং চুম্বনের মাধ্যমে গুনাহ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। এ কাবা চত্বরেই রয়েছে বরকতময় জমজম কূপ। সাফা-মারওয়া পাহাড় এবং মাকাম-ই ইব্রাহিম সমগ্র মসজিদ কমপ্লেক্স ঘিরে গড়ে উঠেছে এক পবিত্র নগরী। পবিত্র কোরআনের ৪৮ নং সূরা ফাতাহর ২৪ নম্বর আয়াতে এ নগরীর নাম ‘মক্কা’ বলে উল্লেøখিত। আর তৃতীয় সূরা আল ইমরানের ৯৬ নম্বর আয়াতে এ নগরীর নাম ‘বাক্কা’ যা নগরীর প্রাচীন নাম। এ ছাড়াও পবিত্র কোরআনে মক্কা নগরীকে ‘উম আল কুড়া’ অর্থাৎ সব গ্রাম বা জনপদের মা (কেন্দ্র) এবং ‘বালাদ আল আমিন’ অর্থাৎ নিরাপদ নগর নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে।

হাতির আক্রমণে কাবা ধ্বংসের ব্যর্থ চেষ্টা

পবিত্র কেরাআনের ১০৫ নম্বর সূরার নাম ‘ফিল’। আরবি ফিল শব্দের অর্থ হাতি। হাতি নিয়ে ধ্বংসের উদ্দেশে কাবায় আক্রমণের ঘটনা বর্ণিত হয়েছে এই সূরা ফিল-এ। সঠিক সন-তারিখ নিয়ে মতভেদ থাকলেও অধিকাংশের মতে, মহানবী (সা.)-এর জন্মের বছর অর্থাৎ ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে এ যুদ্ধ হয়েছিল। সে সময় বর্তমান সৌদি আরবের পার্শ্ববর্তী দেশ ইয়েমেন আফ্রিকার ইথিওপিয়ার আকসুম সাম্রাজ্যের অংশ ছিল। ইয়েমেনের শাসক ছিলেন আবিসিনিয়ান বংশোদ্ভূত আবরাহা।

খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী আবরাহা তৎকালে মূর্তিপূজা ও ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের জন্য বিখ্যাত কাবাঘরের প্রভাব-প্রতিপত্তির বিপরীতে নিজ দেশ ইয়েমেনের সানা শহরে একটি চার্চ নির্মাণ করেন। কোয়ালিজ নামের এই চার্চের অপূর্ব নির্মাণশৈলীর সুনাম ছড়িয়ে পড়ে দেশ-বিদেশে। নিজের গড়া চার্চের প্রতি আরও মানুষকে আকৃষ্ট করার জন্য আবরাহা কাবা ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় তথা মক্কায় দুজন উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি পাঠান। মক্কাবাসীর মধ্যে থেকে দুই ভাই মুহাম্মদ ইবনে খুজা ও কায়েস আবরাহার চার্চের প্রতি আগ্রহী হয়। আবরাহার পরামর্শ ও উৎসাহে উক্ত দুই ভাই মক্কার আশপাশের মানুষকে আবরাহার চার্চে যেতে বলে। এতে কাবা অনুরাগীরা রাগান্বিত হন এবং একভাইকে মেরে ফেলে। অন্য ভাই পালিয়ে ইয়েমেন যায় এবং সব ঘটনা আবরাহাকে খুলে বলে। তদুপরি কাবা পূজারি এক ভক্ত গোপনে আবরাহারের চার্চে যায় এবং তা অপরিষ্কার ও অপবিত্র করে আসে। এতে ক্রুদ্ধ আবরাহার প্রায় ৪০ হাজার সৈন্য এবং বেশ কিছু হাতি নিয়ে কাবা আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেয়। আবরাহা তার বিশাল বাহিনী নিয়ে অগ্রসর হলে পথে পথে স্থানীয় গোত্রদের দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হয়। কিন্তু প্রতিটি ক্ষেত্রেই তারা আবরাহার কাছে পরাজিত হয়। কাবার চারপাশে থাকা বিভিন্ন গোত্র যেমন কুরাইশ, বানু কিন্না, বানু খাজা, বানু হুধাই প্রভৃতি সম্মিলিতভাবে কাবার চারদিকে অবস্থান নেয় এবং আবরাহাকে বাধা দেওয়ার সব প্রস্তুতি নেয়। কুরাইশ বংশের নেতা আবদুল মোতালেব [হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর দাদা] অন্যদের নিকটবর্তী পাহাড়ে পাঠিয়ে কয়েকজনকে নিয়ে কাবা চত্বরে অবস্থান করেন। আবরাহা এ সময় মক্কাবাসীর কাছে তার একজন প্রতিনিধি পাঠায় এবং ঘোষণা দেয় যে, তার বাহিনী কেবল কাবাঘর ধ্বংস করবে, অন্য কিছু নয়। কিন্তু কেউ এতে বাধা দিলে তাকেও ধ্বংস করা হবে। এরপর আবরাহা কুরাইশ নেতা আবদুল মোতালেবকে আলোচনার জন্য আমন্ত্রণ জানান। আবদুল মোতালেব যথারীতি আলোচনা শেষ করে কারাঘরের দিকে ফেরার পথে অলৌকিক কিছু কথা শুনতে পান বলে বিভিন্ন বর্ণনায় পাওয়া যায়।

এ অলৌকিক কথার সারমর্ম ছিল কাবা মহান স্রষ্টার ঘর এবং তিনিই এ ঘর রক্ষা করবেন।

এ যুদ্ধের পরবর্তী অংশের বর্ণনা রয়েছে পবিত্র কোরআনের ১০৫ নং ‘সূরা ফিল’-এ। এ সূরার প্রথম অংশে দুটি প্রশ্ন রাখা হয়, ‘তুমি কি দেখনি তোমার প্রতিপালক হস্তীবাহিনীর প্রতি কী করেছিলেন? তিনি কি ওদের (আবরাহা বাহিনীর) কৌশল ব্যর্থ করে দেননি?’ এই প্রশ্ন দুটির উত্তর রয়েছে সূরার শেষ তিনটি আয়াতে। যেখানে বলা হয়েছে আবরাহার বাহিনীকে ধ্বংস করার জন্য মহান আল্লাহ ঝাঁকে ঝাঁকে ‘আবাবিল’ নামে ক্ষুদ্রাকৃতির পাখি পাঠান। বর্ণনা মতে এ সময় আকাশ কালো করা মেঘের মতো অসংখ্য আবাবিল পাখি আবরাহার বাহিনীর ওপর দিয়ে ওড়ে যান। এসব পাখির ঠোঁটে ছিল ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কঙ্কর ও পাথর, যা পাখিগুলো আবরাহার বাহিনীর ওপর ফেলেছিল। এর ফলে আবরাহার বাহিনীর কী অবস্থা হয়েছিল তার বর্ণনা রয়েছে সূরার শেষ আয়াতে। এখানে বলা হয়েছে, আবরাহার সব হাতি ও অন্যান্য সৈন্যদের অবস্থা হয়েছিল পশুর খাওয়া ভুসির মতো।

 

হজে বিঘ্ন ঘটার কাহিনি

শারীরিক ও আর্থিকভাবে সামর্থ্যবান মুসলমানদের জন্য আরবি জিলহজ মাসে হজ করা ফরজ বা অবশ্য কর্তব্য। প্রত্যেক মুসলমানের হৃদয়ে হজ আদায়ের একটি সুপ্ত বাসনা থাকে। তাই হজ মৌসুমে লাখো মুসলমানের মিলনমেলায় পরিণত হয় পবিত্র নগরী মক্কা ও কাবা চত্বর। তবে দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, নানাবিধ কারণে একাধিকবার হজের আনুষ্ঠানিকতা বাতিল হয়েছিল। ইসলামিক পোর্টাল ‘দ্য ইসলামিক ইনফরমেশন ডটকম’ ৪ এপ্রিল ২০২০ তারিখে প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ পর্যন্ত ৪০ বার হজের আনুষ্ঠানিকতা বাতিল হয়েছিল বলে তথ্য প্রকাশ করে। হজ পালনের কতিপয় আবশ্যিক শর্তের অন্যতম জিলহজ মাসের ৯ তারিখে আরাফাতে পাহাড় বা ময়দানে অবস্থান করা। ৮৬৫ সালের এই দিনে আরাফাতের পাহাড়ে জমায়েত হন হজপ্রত্যাশী মুসলমানগণ। কিন্তু হঠাৎ করে এদিন হাজীদের ওপর আক্রমণ চালায় ‘আল সাফাক’ নামে পরিচিত আরব নেতা ইসমাইল বিন ইউসুফ। বাগদাদের শাসক আব্বাসীয় খলিফার সঙ্গে শত্রুতার ধারাবাহিকতায় এ আক্রমণ চালানো হয়। ফলশ্রুতিতে ৮৬৫ সালে বার্ষিক হজ বাতিল করা হয়।

৯২৩ থেকে ৯৪৪ পর্যন্ত ২১ বছর বর্তমান বাহরাইনে তৎকালীন কারমতিয়ান নামক রাজ্যের শাসক ছিলেন আবু তাহির সুলায়মান আল জান্নাবি। তিনি ছিলেন মূলত ইরানি বংশোদ্ভূত এবং অতিমাত্রায় সুন্নি সম্প্রদায়বিরোধী। তবে একজন যুদ্ধবাজ এবং লুটতরাজ সিদ্ধহস্ত বিপথগামী হিসেবে তিনি ইতিহাসে আখ্যায়িত। আপন ভাইকে সরিয়ে ক্ষমতা গ্রহণের পর তিনি একে একে ইরাকের বশরা এবং কুফা নগরীতে অভিযান চালান। এরপর তিনি ইরাকের আব্বাসীয় শাসনকে হুমকি দিয়ে বাগদাদ দখলের পরিকল্পনা করেন। বিভিন্ন কারণে তার এ পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়নি। পরবর্তীতে ৯৩০ সালে আবু তাহির তার বাহিনী নিয়ে মক্কায় আক্রমণ চালায়। কিন্তু তাকে মসজিদ আল হারামের নির্দিষ্ট গন্ডির ভিতরে প্রবেশ করতে প্রবল বাধার সম্মুখীন হতে হয়। এরপর শান্তি প্রস্তাবের কথা বলে ভিতরে প্রবেশ করেই দস্যুরূপে আবির্ভূত হন আবু তাহির। হাজিদের হত্যা ও লুটতরাজে মেতে ওঠেন। ফলে অসংখ্য হাজীর মৃত্যুর তথ্য পাওয়া যায় বিভিন্ন গ্রন্থে। এ সময় হজ বাতিল করা হয়। (তথ্য সূত্র : এ ব্রিফ হিস্ট্রি অব সৌদি এরাবিয়া; রচনা জেমস ওয়াইন ব্রান্ডর্ট)।

৯৮৩ থেকে ৯৯০ এ আট বছর বর্তমান ইরাক এবং সিরিয়ার আব্বাসীয় শাসকগোষ্ঠী এবং মিসরের ফাতেমীয় শাসকদের মাঝে রাজনৈতিক এবং আঞ্চলিক ক্ষমতার দ্বন্দ্ব তীব্র আকার ধারণ করে। তৎকালে মুসলিম বিশ্ব থেকে কাবা তথা মক্কায় আসার মূল রাস্তা ছিল মিসর, সিরিয়া ও ইরাকভিত্তিক। শাসকদের এ দ্বন্দ্বের কারণে মক্কামুখী সব রাস্তা বন্ধ করে দেওয়ায় দীর্ঘদিন (কারও মতে আট বছর) হজ বিঘিœত হয় আবার অনেকের মতে বন্ধ থাকে। তবে ৯৯১ সাল থেকে স্বাভাবিকভাবে হজ চালুর তথ্য রয়েছে উইকিপিডিয়ায়।

দ্বন্দ্ব-সংঘাতের বাইরে শুধু সংক্রমণ রোধকল্পে হজ বাতিল করার বিভিন্ন তথ্য পাওয়া যায়। এর মধ্যে ১৮৩১ সালে প্লেগের প্রাদুর্ভাব, ১৮৩৭ সালে কলেরা, ১৮৪৪ সালে আবারও প্লেগ এবং ১৮৪৬ সালে পুনরায় কলেরার সংক্রমণের ভয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে হজ বাতিলের তথ্য পাওয়া যায় একাধিক সূত্রে। পরবর্তীতে ১৮৫৮, ১৮৬৫ এবং ১৮৮৩ সালেও মক্কায় প্লেগ রোগের বিস্তার এবং পরিণতিতে হজ বাতিলের তথ্য রয়েছে। (সূত্র সব শেষে দেওয়া হলো)।

 

ইরানি শিয়াদের বিক্ষোভ

১৯৭১ সাল থেকে প্রতিবছর শিয়া মতবাদে বিশ্বাসী ইরানি হাজিরা তাদের ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনির নির্দেশে মক্কা ও মদিনায় ইসলামের শত্রু হিসেবে তাদের বিবেচনায় চিহ্নিত আমেরিকা ও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রকাশ করতে থাকে এবং সব হাজীর মাঝে তাদের বার্তা পৌঁছে দিতে থাকে। বিষয়টিকে আয়ত্তে রাখতে তখন থেকেই ইরানি শিয়া হাজীদের ওপর বিশেষ নজর রাখত সুন্নি মতাদর্শে বিশ্বাসী সৌদি কর্তৃপক্ষ। ইরানিদের তৎপরতা ক্রমাগত বৃদ্ধি পেলে সৌদি নজরদারিও ক্রমাগত বাড়তে থাকে। এক পর্যায়ে সৌদি ন্যাশনাল গার্ডের সৈন্যরা ইরানি হজের কাফেলাকে সব সময় ঘিরে রাখত এবং অন্য দেশের বিশেষত সুন্নি অধ্যুষিত দেশের হাজীদের সঙ্গে তাদের সংঘাত রোধের সব ব্যবস্থা রাখত। আশির দশকে ইরানিদের প্রতিবাদ ক্রমাগত বাড়তে থাকে। সৌদি সেনারাও তা নিয়ন্ত্রণে রাখতে তাদের শক্তি বাড়াতে থাকে। ১৯৮৭ সালে হজের সময় একইভাবে ইরানি হাজীদের কাফেলাকে ঘিরে রাখে সৌদি সেনা দল। ইরানিরা তাদের প্রতিবাদ জানাত কাফেলা নিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে বা মিছিল করে। সৌদি সেনারা তাদের মিছিল বা চলাচলের রাস্তা ঘিরে রাখত। ১৯৮৭ সালের ৩১ জুলাই, শুক্রবার, ইরানি হাজীরা যথারীতি কাফেলা নিয়ে প্রতিবাদ জানাতে থাকে। সৌদি বাহিনীও তাদের নির্দিষ্ট রাস্তা ঘিরে রাখে। কিন্তু ইরানিরা এই ঘেরাও ভেঙে মসজিদ আল হারামের দিকে এগিয়ে যেতে চাইলে সৌদি সেনারা তাদের বাধা দেয়। এ সময় অজ্ঞাতনামা একটি দল ইরানি কাফেলার দিকে ইট-পাথর ছুড়তে থাকে। এতে ক্ষিপ্ত ইরানিরা ঘেরাও ভেঙে বের হওয়ার এবং আক্রমণকারীদের ধাওয়া করার চেষ্টা চালায়। সম্ভাব্য রায়ট থামাতে সৌদিরা ইরানিদের জোরপূর্বক বাধা দিলে ইরাকিরা সৌদি সেনাদের ওপর চড়াও হয়। ফলে দ্রুত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় এ সময় গুলি চালাতে বাধ্য হয় সেনারা। এরপর পরিস্থিতি শান্ত হলেও এ ঘটনায় ২৭৫ জন ইরানি, ৮৫ জন সৌদি এবং ৪২ জন অন্যান্য দেশের হাজী প্রাণ হারান। আর আহত হন ৩০৩ জন ইরানি, ১৪৫ জন সৌদি এবং ২০১ জন অন্যান্য দেশের হাজী।

 

করোনার কারণে বন্ধ কাবার কপাট

বর্তমান বিশ্বে আতঙ্ক ছড়ানো ভাইরাস করোনা বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়লে নড়েচড়ে বসে সৌদি প্রশাসন। কারণ চীনসহ পৃথিবীর অধিকাংশ দেশ থেকে লাখো মুসলমানের আগমন ঘটে সৌদি আরব তথা কাবা চত্বরে। অতীতের অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, সংক্রমণজনিত রোগ দ্রুত ছড়ানোর প্রেক্ষাপট তৈরি হয় কাবাঘরে প্রচন্ড ভিড়ে বিভিন্ন ধর্মীয় রীতিনীতি অনুসরণ বিশেষত হজরে আসোয়াতে চুম্বন প্রদান, কাবার দরজা স্পর্শ করা, হাতিম ও মাকামে ইব্রাহিমের পিছনে নামাজ আদায় করার সময়। তাই ফেব্রুয়ারি ২০২০-এর শেষ দিকে মধ্যপ্রাচ্যে ২২০ জনের শরীরে করোনাভাইরাস থাকার নিশ্চিত খবর পাওয়ার পরপর সৌদি আরবে বিশ্বের অন্য দেশের নাগরিকদের ওমরাহ হজের উদ্দেশে প্রবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। পরিস্থিতির অবনতি হলে সৌদি কর্তৃপক্ষ সে দেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে নাগরিক ও প্রবাসীদের মক্কা ও মদিনায় প্রবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। মার্চের প্রথম সপ্তাহে কাবা চত্বর জীবাণুমুক্ত করার জন্য দুদিনের জন্য তাওয়াফ ও অন্যান্য রীতিনীতি বন্ধ রাখা হয়। দুদিন পর মসজিদ আল হারাম আবার উন্মুক্ত ঘোষণা করা হলে ভিড় বেড়ে যায়, একই সঙ্গে বাড়ে করোনার ঝুঁকি। সংক্রমণ ঠেকানো আবার সীমিত আকারে ওমরা চালু রাখার জন্য কয়েক দিন বিশেষ ব্যারিকেড বা প্রতিবন্ধকতা দিয়ে কাবাঘর থেকে দূরে দূরে হেঁটে তাওয়াফ করার সুযোগ দেওয়া হয়। তবে হজরে আসওয়াদে চুমু খাওয়া, দরজা স্পর্শ, হাতিমে বা মাকামে ইবরাহিমের পিছনে নামাজের সুযোগ বন্ধ করা হয়। তখন অনেক মুসল্লি কাবা চত্বরকে বাইরের দিক থেকে ঢেকে রাখা মসজিদের বিভিন্ন তলা (ফ্লোর) এবং ছাদে হেঁটে তাওয়াফ করতে থাকে। তখন পর্যন্ত টেলিভিশনে সরাসরি কাবাঘর ও চত্বর দেখা যেত। কিন্তু পরিস্থিতি দ্রুত খারাপ হতে থাকলে সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করা হয় কাবার প্রবেশের সব গেট। প্রতি বছরের মতো এ বছরও পবিত্র হজে যাওয়ার নিয়ত করেছিলেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের লাখো মুসলমান। এসব হজপ্রত্যাশীর জন্য অপ্রত্যাশিত খবর আসে ১ এপ্রিল ২০২০ তারিখে। বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ইংরেজি সংবাদপত্র ‘দ্য গার্ডিয়ান’সহ মধ্যপ্রাচ্যের অসংখ্য সংবাদপত্র ও অন্যান্য গণমাধ্যম এ দিন সৌদি আরবের ওমরা ও হজবিষয়ক মন্ত্রী মোহাম্মদ সালেহ বিন তাহের বিন তিনের বরাত দিয়ে সংবাদ প্রকাশ করে বলে যে, বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বার্ষিক হজ পালনের আনুষ্ঠানিকতা হিসেবে চুক্তি স্বাক্ষরের বিষয়টি বর্তমান পরিস্থিতিতে স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সৌদি সরকার। এসব সংবাদ মাধ্যমে আরও উল্লেখ করা হয় যে, অতীতে বিভিন্ন কারণে ৪০ বার হজ স্থগিত ছিল এবং এবার স্থগিত হলে তা হবে ৪১তম বার। পত্রপত্রিকার দাবি সর্বশেষ ১৭৯৮ হজ স্থগিত হলেও বিগত ২২২ বছরে তা স্থগিত হয়নি কখনো। পরদিন ২ এপ্রিল ২০২০, আল হাজিরার তথ্য মতে, মক্কা ও মদিনায় কার্ফু জারি করেছে সৌদি কর্তৃপক্ষ।

অবরুদ্ধ কাবা

হিজরি ১৪০০ সালের শুরু হয় প্রথম মাস মহররমের ১ তারিখে। ইংরেজি ক্যালেন্ডারে দিনটি ছিল ১৯৭৯ সালের ২০ নভেম্বর। ভোর ৫টা ২৫ মিনিটে কাবা চত্বরে (মসজিদে আল হারাম) ফজরের নামাজ আদায়রত কয়েক হাজার মুসল্লি হঠাৎ করে শুনতে পান গুলির শব্দ। মুহূর্তে এলোপাতাড়ি গুলিতে প্রাণ কেড়ে নেয় কয়েক মুসল্লির। আহতদের আর্তনাদে ভারী হয়ে ওঠে মক্কার বাতাস। মসজিদের উপরের তলা এবং মিনার থেকে বাইরের সাধারণ মানুষকে লক্ষ করেও গুলি ছুড়তে থাকে আক্রমণকারীরা। তাদের অন্যতম দাবি ছিল সৌদি রাজপরিবারকে উচ্ছেদ করা। এ ছাড়াও তারা দাবি করে যে, ইসলামের ত্রাণকর্তা হিসেবে বিবেচিত ইমাম মেহেদি তাদের নেতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন, যার নাম আবদুল্লা আল কাহতানি। তার নির্দেশেই এই আক্রমণ এবং সবার উচিত তাদের সঙ্গে যোগ দেওয়া। একই সময় তারা পশ্চিমাদের থেকে দূরে থাকা, টেলিভিশন প্রচার বন্ধ করা, মহিলাদের চাকরি বেআইনি করা প্রভৃতি দাবি প্রচার করে। ওয়াহাবি মতবাদের বিরুদ্ধেও তারা সোচ্চার হয়। পরবর্তীতে জানা যায়, এই আক্রমণ ও অবরোধের নেতৃত্ব দেন জুহায়মান আল ওতায়বি নামের একজন সৌদি নাগরিক। তার মতবাদে বিশ্বাস করতে থাকে একদল মুসলমান। এদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন একদল ব্যবসায়ী। যাদের অর্থায়নে দীর্ঘদিন গোপনে অস্ত্র ও গোলাবারুদ সংগ্রহ করা হয় এবং কাবা চত্বরের বেজমেন্ট বা মাটির নিচের কয়েকশ কক্ষে বা আনাচে-কানাচে লুকানো হয়। নির্দিষ্ট দিন (২০ নভেম্বর ১৯৭৯ সাল) সকালে নারী ও শিশুসহ প্রায় ৪০০-৫০০ আক্রমণকারী অস্ত্র হাতে আবির্ভূত হয়। তাদের আক্রমণের প্রথম শিকার হন অস্ত্রধারী দুজন সৌদি পুলিশ। এরপর বন্ধ করে দেওয়া হয় কাবা চত্বরে ঢোকার সব গেট। টেলিফোনের তার কেটে যোগাযোগও বিচ্ছিন্ন করা হয়। সরকারি বাহিনি আক্রমণকারীদের সংখ্যা, সক্ষমতা ও প্রস্তুতি সম্বন্ধে ছিল সম্পূর্ণ অজ্ঞ।

অবরুদ্ধ অবস্থা থেকে মসজিদ আল হারাম বা কাবা শরিফ মুক্ত করার জন্য সর্বপ্রথম প্রচেষ্টা চালায় সৌদি নিরাপত্তা বাহিনীর ১০০ অফিসারের সমন্বয়ে গড়া একটি বিশেষ দল। কিন্তু নিজেদের ব্যাপক ক্ষতি শিকার করে দলটি ফিরে আসে। এরপর এগিয়ে আসে সৌদি সেনাবাহিনী ও সৌদি ন্যাশনাল গার্ড। সৌদি বাদশাহ খালিদ বিন আবদুল আজিজ আল সৌদের আমন্ত্রণে এ সময় ফ্রান্সের কমান্ডো দল এগিয়ে আসে এবং যুদ্ধ পরিকল্পনাসহ যাবতীয় পরামর্শ প্রদান করে। তবে এক্ষেত্রে বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায় মসজিদ আল হারামে অভিযানের কারণে সম্ভাব্য রক্তপাতের বিষয়টি। কারণ পবিত্র কোরআনের পঞ্চম সূরা মায়িদার দ্বিতীয় আয়াতে কাবাকে ‘পবিত্র ঘর’ হিসেবে ইঙ্গিত করা হয়েছে এবং মসজিদ আল হারামে প্রবেশের ক্ষেত্রে কোনো বাধা এলে সীমা লঙ্ঘন না করার সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা রয়েছে। এক্ষেত্রে ইসলামী চিন্তাবিদ ও ওলেমাগণ প্রয়োজনমতো শক্তি প্রয়োগ করে মসজিদ আল হারাম অবমুক্ত করার পক্ষে ফতোয়া বা রায় দেন।

এর ফলে দ্বিধাদ্বন্দ্ব সরিয়ে সৌদি সেনারা তিনটি দলে ভাগ হয়ে মসজিদের তিনটি মূল প্রবেশদ্বার বা গেট দিয়ে ঢোকার চেষ্টা করে। কিন্তু অবরোধকারীদের তীব্র বাধার কারণে তারা ফিরে আসে। এরপর আরও কিছু বিক্ষিপ্ত চেষ্টা এমন কি মাটির নিচের ড্রেন ও টানেল ব্যবহার করে মসজিদে ঢোকার চেষ্টাও ব্যর্থ হয়। সৌদি সেনারা এরপর তাদের চাপ বৃদ্ধি করলে এবং সুড়ঙ্গ কেটে টিয়ারগ্যাস প্রয়োগ করলে ১ ডিসেম্বর ১৯৭৯ আক্রমণকারীদের বেশ কয়েকজন নেতা পালিয়ে যায়। তারপরও অবরোধকারীরা গুলিবর্ষণ অব্যাহত রাখে। এভাবে মোট ১৮ দিন অবরুদ্ধ থাকার পর অবরুদ্ধকারীদের আটক করা সম্ভব হয়। এ ঘটনায় ১২৭ সৌদি সেনা মারা যান এবং ৪৫১ জন আহত হন। অন্যদিকে সরকারিভাবে বলা হয়, এ ঘটনায় সাধারণ হাজী, অবরোধকারী ও সৌদি সেনাদের মধ্যে ২৫৫ জন মৃত্যুবরণ করেন এবং ৫৬০ জন আহত হন। কূটনীতিকরা এ সংখ্যা আরও বেশি বলে মত দেন।

 

তথ্য সূত্র :

১. এ ব্রিফ হিস্ট্রি অব সৌদি এরাবিয়া রচনা জেমস ওয়াইব্র্যান্ডট প্রকাশক লাইব্রেরি অব কংগ্রেস। ২. নিউজ পোর্টাল মিডল ইস্ট আই ডটনেট।

৩. দ্য ইসলামিক ইনফরমেশন ডটকম। ৪. দ্য মুসলিম ভাইব ডটকম।

৫. হজ ওমরা ইনফো ডটকো ডট জেডএ ৬. উই দি পিডিয়া

৭. দ্য গার্ডিয়ান ১ এপ্রিল ২০২০ ৮. আল হাজিরা, কাতার।

সর্বশেষ খবর