শুক্রবার, ১ মে, ২০২০ ০০:০০ টা

ইতিহাসের আলোকে রমজানের দ্বিতীয় সপ্তাহ

মেজর নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ (অব.) পিএইচডি

ইতিহাসের আলোকে রমজানের দ্বিতীয় সপ্তাহ

হজরত দাউদ (আ.)-এর ওপর জাবুর গ্রন্থ নাজিল

পবিত্র রমজান মাসে মহাগ্রন্থ আল-কোরআন নাজিলের আগে তিনজন নবীর ওপর তিনটি পবিত্র গ্রন্থ নাজিল হয়েছিল। এই তিনটি গ্রন্থের একটি হলো পবিত্র ‘জাবুর’, যা হজরত দাউদ (আ.)-এর ওপর নাজিল হয়েছিল। পবিত্র কোরআনের ৪ নং সূরার ১৬৩ নম্বর আয়াতে হজরত নূহ (আ.) থেকে শুরু করে হজরত সুলাইমান (আ.) পর্যন্ত বিভিন্ন নবীর ওপর প্রত্যাদেশ বা ওহি পাঠানোর কথা বর্ণিত হয়েছে। একই আয়াতের শেষ অংশে বলা হয়েছে। ‘আর আমি (আল্লাহ) দাউদকে দিয়ে ছিলাম জাবুর’। একদল গবেষকের গবেষণায় দেখা যায়, পবিত্র কোরআনে হজরত দাউদ (আ.)-এর নাম ১৬ বার উল্লেখ করা হয়েছে। পবিত্র কোরআনের বিভিন্ন অংশে হজরত দাউদ (আ.)-এর নামের পাশাপাশি হজরত সুলায়মান (আ.)-এর নামও উল্লেখ করা হয়েছে। হজরত সুলায়মান (আ.) ছিলেন হজরত দাউদ (আ.)-এর বেশ কয়েকজন (সম্ভাব্য ১৯) পুত্রের মধ্যে সবচেয়ে সুযোগ্য পুত্র। পবিত্র কোরআনের ২৭ নং সূরা নমল-এর ১৫ নম্বর আয়াতে হজরত দাউদ (আ.) ও হজরত সুলাইমান (আ.)-কে উন্নত হিকমত বা বিশেষ জ্ঞান দেওয়ার কথা বর্ণিত হয়েছে। পবিত্র কোরআনের দ্বিতীয় পারার শেষ আয়াতে (সূরা বাকারা-২৫১) মহান আল্লাহ হজরত দাউদ (আ.)-কে কর্তৃত্ব ও হিকমত দান এবং তিনি (আল্লাহ) যা ইচ্ছা করলেন, তা শিক্ষা দেওয়ার বর্ণনা দিয়েছেন। এই কর্তৃত্ব প্রসঙ্গে গবেষকদের মতে, মূলত হজরত দাউদ (আ.) আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ১০১০ থেকে ৯৭০ অব্দ পর্যন্ত মোট ৪০ বছর তৎকালীন ইসরায়েল ও জুদাহ সাম্রাজ্যের সম্রাট ছিলেন। পবিত্র কোরআন ছাড়াও খ্রিস্টান ও ইহুদিদের ধর্মগন্থে হজরত দাউদ (আ.)-কে এই সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় সম্রাট হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এসব গ্রন্থে হজরত দাউদ (আ.)-কে ডেভিড নামে সম্বোধন করা হয়েছে।

মহান আল্লাহ হজরত দাউদ (আ.) এবং তাঁর পুত্র হজরত সুলায়মান (আ.)-কে নানাবিধ গুণ দিয়েছিলেন বলে বর্ণিত রয়েছে। এর মধ্যে পবিত্র কোরআনের ২১ নম্বর সূরা আম্বিয়ার ৭৯ নম্বর আয়াতের শেষাংশে এবং ৮০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘...আমি (আল্লাহ) পাহাড় এবং পাখিদের জন্য নিয়ম করে দিয়েছিলাম তারা যেন দাউদের সঙ্গে আমার পবিত্র মহিমাকীর্তন করে। আমি (আল্লাহ) ছিলাম এসবের কর্তা। আমি (আল্লাহ) তাকে দাউদ (আ.)-কে তোমাদের জন্য বর্ম তৈরি করতে শিখিয়ে ছিলাম, যা যুদ্ধে তোমাদের রক্ষা করে; সুতরাং তোমরা কি কৃতজ্ঞ হবে না?’ এই আয়াতের সূত্র ধরে একদল গবেষকের মতে, হজরত দাউদ (আ.) পাখির ভাষা জানতেন এবং পাখির মতো সুরেলা কণ্ঠের অধিকারী ছিলেন। তিনি সম্রাট হয়েও লোহা গলিয়ে বর্ম তৈরির কৌশল রপ্ত করেছিলেন এবং রাজকোষ থেকে বেতন না নিয়ে বর্ম বানানো বাবদ মজুরি দিয়ে জীবন ধারণ করতেন। হজরত দাউদ (আ.) অত্যন্ত ধার্মিক ছিলেন। পবিত্র কোরআনের ৬ নং সূরা আন-আমের ঘোষণা অনুসারে মহান আল্লাহ হজরত দাউদ (আ.)-কে সৎকর্মপরায়ণদের অন্তর্ভুক্ত করেছেন এবং তাঁকে পুরস্কৃত করেছেন। এই পুরস্কারের অন্যতম হলোÑতাঁর ওপর পবিত্র ‘জাবুর’ গ্রন্থ নাজিল করা। তিনি একই সঙ্গে সাম্রাজ্যের আধিপত্য ও নবুয়ত লাভ করেছিলেন যা ইসলামের ইতিহাসে বিরল ঘটনা। অন্য নবী-রসুলগণ ইসলাম প্রচার করতে গিয়ে সে দেশের রাজা-বাদশাহদের বিরাগভাজন হন এবং নির্যাতনের শিকার হন। সে ক্ষেত্রে হজরত দাউদ (আ.) স্বয়ং সম্রাট হিসেবে তাঁর অধীনস্থদের ইসলামের পক্ষে ডাকার গুরুদায়িত্ব পেয়েছিলেন। এই দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে তিনি মহান আল্লাহর কাছ থেকে যে বাণী বা ওহি পেয়েছিলেন, তাই উদ্ধৃত রয়েছে পবিত্র জাবুর কিতাবে। এই কিতাব স্থানীয় ভাষা বা হিব্রু ভাষায় লেখা হয়েছে। গবেষক এবং ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের মতে, ‘জাবুর’ শব্দটি হিব্রু ‘জিমরা’ শব্দের মধ্য থেকে উঠে এসেছে, যার শাব্দিক অর্থ গান বা সুর। কালের বিবর্তনে পৃথিবী থেকে অবিকৃত জাবুর গ্রন্থ হারিয়ে গেছে। বর্তমানে ছন্দ ও তালে বিধর্মীরা যেভাবে জাবুর আবৃত্তি করে, তা অনেকাংশে মূল জাবুর থেকে বেশ দূরে। তবে এ কথা সত্য যে, হজরত দাউদ (আ.) অতি দ্রুত জাবুর আবৃতি করতে পারতেন এবং ঘোড়ার পিঠে আসন লাগানোর সময়টুকুতেই মধুর কণ্ঠে জাবুরের একটি অংশ (সূরা/ঘটনা) আবৃত্তি করে ফেলতেন। এ সময় ঘোড়া বা পার্শ্ববতী অন্য পশুরাও তার তেলাওয়াত শুনত। একটি ইসলামী ব্যাংক প্রকাশিত ডায়েরির তথ্য মোতাবেক পবিত্র রমজান মাসের ১২ তারিখে হজরত দাউদ (আ.) পবিত্র জাবুর লাভ করেন। আর শুধু রমজানই নয়, বছরব্যাপী হজরত দাউদ (আ.)-এর আমল সম্পর্কে ইমাম বোখারি (রা.) তাঁর হাদিস সংকলনের দ্বিতীয় গ্রন্থের ২১ নং খ-ের (গ্রন্থ) ২৩১ নম্বর হাদিসে লিখেছেন, আবদুল্লাহ বিন আমর আল আস হতে বর্ণিত, রসুলে পাক হজরত মুহাম্মদ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘‘আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় ইবাদত ছিল হজরত দাউদ (আ.)-এর ইবাদত। সবচেয়ে প্রিয় রোজা ছিল হজরত দাউদ (আ.)-এর রোজা। তিনি অর্ধেক রাত পর্যন্ত ঘুমাতেন। এরপর তিন ভাগের এক ভাগ পর্যন্ত ইবাদত করতেন এবং রাতের ষষ্ঠ অংশে ঘুমাতেন। তিনি একদিন পরপর রোজা রাখায় অভ্যস্ত ছিলেন। মহান আল্লাহ আমাদের হজরত দাউদ (আ.)-এর মতো আমল করার তৌফিক দান করুক। আমিন।

পবিত্র কোরআনের তৃতীয় সূরা আল ইমরানের ৪ নম্বর আয়াতে বর্ণিত হয়েছে, ‘‘তিনি (আল্লাহ) মানব জাতিকে সৎপথ প্রদর্শনের জন্য আগেই তাওরাত ও ইঞ্জিল অবতীর্ণ করেছেন এবং অবতীর্ণ করেছেন ফুরকান (ন্যায়-অন্যায়ের মীমাংসা), নিশ্চয় যারা আল্লাহর নির্দেশাবলিকে অমান্য করে তাদের জন্য রয়েছে কঠোর শাস্তি। আল্লাহ তো পরাক্রমশালী দ- বিধাতা।” একই সূরায় আরও দুইবার, পাঁচ নম্বর সূরা মায়িদায় পাঁচবার, সাত নম্বর সূরা আ’রাফ, নয় নম্বর সূরা তওবা, ৪৮ নম্বর সূরা ফাত্হ্ এবং ৫৭ নম্বর সূরা হাদিদে একবার করে সর্বমোট ১২ বার পবিত্র গ্রন্থ ইঞ্জিলের কথা বর্ণিত হয়েছে, যা মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে হজরত ইসা (আ.)-এর ওপর অবতীর্ণ হয়েছিল। এর মধ্যে ৫ নম্বর সূরা মায়িদার ৪৬ ও ৪৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছেÑ“আমি (আল্লাহ) তাদের পেছনে মরিয়ম পুত্র ইসাকে প্রেরণ করেছি, তিনি পূর্ববর্তী গ্রন্থ তাওরাতের সত্যায়নকারী ছিলেন। আমি (আল্লাহ) তাকে ইঞ্জিল প্রদান করেছি। এতে হেদায়েত ও আলো রয়েছে। এটি পূর্ববর্তী গ্রন্থ তাওরাতের সত্যায়ন করে, পথ-প্রদর্শন করে এবং খোদাভীরুদের জন্য হেদায়েত ও উপদেশবাণী। ইঞ্জিলের অধিকারীদের উচিত আল্লাহ তাতে যা অবতীর্ণ করেছেন, তদানুযায়ী ফয়সালা করা। যারা আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন তদানুযায়ী ফয়সালা করে না তারাই পাপাচারী।” এমনিভাবে পবিত্র কোরআনে ইঞ্জিল কিতাবের পাশাপাশি প্রত্যক্ষভাবে ইসা (আ.) নামে এবং পরোক্ষভাবে ও হজরত মরিয়ম (আ.)-এর পুত্র হিসেবে শতাধিকবার হজরত ইসা (আ.)-এর প্রসঙ্গ এসেছে। তবে হজরত ইসা (আ.)-এর আগমন, তাঁর ওপর পবিত্র গ্রন্থ ইঞ্জিল অবতীর্ণ হওয়া এবং জাগতিক সম্পর্ক ছেলে, তাঁর অন্তর্ধানের সঠিক সময় নিয়ে গবেষক ও চিন্তাবিদদের ভিন্ন ভিন্ন মত পাওয়া যায়। আর ইসলাম ধর্মের নবীর পাশাপাশি খ্রিস্টান সম্প্রদায় তাঁকে মহাপ্রভু ও খ্রিস্টান ধর্মের প্রবর্তক হিসেবে মান্য করে এবং জেসাস বা যিশুখ্রিস্ট নামে সম্বোধন করে। ইহুদি ধর্ম গ্রন্থেও তাঁর জীবনের বিভিন্ন দিক বর্ণিত। খ্রিস্টানগণ ‘ইঞ্জিল’ কিতাবের স্থলে তার ওপর ‘গোসপেল’ গ্রন্থ অবতীর্ণ হয়েছিল বলে বিশ্বাস করেÑযা পরবর্তীকালে বাইবেল নামে পরিচিতি পায়। ফলে মুসলমানদের পাশাপাশি খ্রিস্টান ও ইহুদি ধর্মাবলম্বীরাও হজরত ইসা (আ.)-এর জীবনকাল ও তাঁর ওপর পবিত্র গ্রন্থ নাজিলের সময় নিয়ে গবেষণা করে এবং ভিন্ন ভিন্ন মত প্রদান করে। তবে মাসনাদ শরিফের ১৬৫৩৬ নম্বর হাদিসে পবিত্র রমজান মাসের ১৩তম রজনীর পর হজরত ইসা (আ.)-এর ওপর পবিত্র গ্রন্থ ইঞ্জিল নাজিলের তথ্য রয়েছে।

বিভিন্ন গবেষণা ও বর্ণনায় খ্রিস্টপূর্ব দুই থেকে সাত অব্দের মধ্যে হজরত ইসা (আ.)-এর জন্ম হয় বলে তথ্য পাওয়া যায়। মহান আল্লাহর বিশেষ কুদরতে কুমারী মা হজরত মরিয়ম (আ.) হজরত ইসা (আ.)-কে গর্ভে ধারণ করেন এবং বর্তমান ফিলিস্তিনের বেথেল হেমে তাঁকে জন্ম প্রদান করেন। তিনি ফিলিস্তিন, জেরুজালেম এবং ইসরায়েলসহ আশপাশের এলাকায় মহান আল্লাহর বাণী ও একাত্ববাদ প্রচার করেন। জীবদ্দশায় মানুষকে মহান আল্লাহর অসীম ক্ষমতা ও তাঁকে আল্লাহর নবী হিসেবে প্রমাণের জন্য বেশ কিছু অলৌকিক ঘটনার জন্ম দেন। যার অন্যতম কুষ্ঠ রোগীদের সুস্থ করে তোলা। বর্তমানে বিশ্বের করোনার মতো তৎকালে কুষ্ঠ রোগকে অত্যন্ত ঘৃণা ও ভয়ের চোখে দেখা হতো। পবিত্র কোরআনের ৫ নম্বর সূরা মায়িদার ১১০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, হজরত ইসা (আ.) মহান আল্লাহর নির্দেশে জন্মান্ধ ও কুষ্ঠু রোগীদের কাছে যেতেন ও তাদের সুস্থ করে তুলতেন। তিনি কাদা দিয়ে বানানো পাখিতে আল্লাহর নির্দেশে ফুঁ দিয়ে জীবন্ত পাখি বানাতেন এবং মৃত ব্যক্তিকে জীবিত করতেন বলেও এই আয়াতে উল্লেখ আছে। একত্ববাদ তথা আল্লাহর বাণী প্রচার করতে গিয়ে হজরত ইসা (আ.) তাঁর সম্প্রদায়ের একদল মানুষের বিরাগভাজন হন, যারা তাঁর বিরুদ্ধে নানান জঘন্য কথা প্রচার ও ষড়যন্ত্র করে। পবিত্র কোরআনের ৪ নম্বর সূরা নিসার ১৫৮ নম্বর আয়াত অনুসারে মহান আল্লাহ হজরত ইসা (আ.)-কে তাঁর (আল্লাহর) কাছে তুলে নিয়ে গেছেন। গবেষকের মতে, সম্ভাব্য ৩০ খ্রিস্টাব্দের পর তাঁর অন্তর্ধান ঘটে। আর তাঁর ওপর নাজিলকৃত গ্রন্থ ইঞ্জিল বিধর্মীরা বিকৃত করে ফেলে। ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর ইবনে খাত্তাব ৬৩৭ সালে জেরুজালেম জয় করে বেথেল হেম আগমন করেন। হজরত ইসা (আ.)-এর জন্মস্থান হিসেবে খ্যাত বেথেল হেমে তিনি নামাজ আদায় করেন। বর্তমানে সেখানে ওমর মসজিদ বা ‘মস্ক অব ওমর’ অবস্থিত।

 

মা খাদিজা (রা.)-এর মৃত্যু

পৃথিবীর বুকে হজরত মুহাম্মদ (সা.) কর্তৃক ইসলাম প্রচার শুরুর পর সর্বপ্রথম মহান আল্লাহর প্রতি ইমান এনে এবং মুহাম্মদ (সা.)-কে আল্লাহর রসুল মেনে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন মহানবী (সা.)-এর প্রিয়তমা স্ত্রী ও তৎকালে মক্কার বিশিষ্ট ব্যবসায়ী হজরত খাদিজা বিনতে খোয়ালিদ। মুসলমানদের মাঝে তিনি মা খাদিজা (রা.) নামে অধিক পরিচিত। প্রিয়নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে বিয়ের আগে মক্কার একজন ধনাঢ্য বা ধনী ব্যবসায়ী হিসেবে মা খাদিজা তাঁর ব্যবসার হিসাব ও টাকা-পয়সা রক্ষণাবেক্ষণের জন্য একজন সৎ ও নির্ভরযোগ্য ব্যক্তি খুঁজছিলেন। এ সময় একজন সত্যবাদী, পরোপকারী এবং নির্লোভ ব্যক্তি হিসেবে যুবক মহানবী (সা.)-এর সুপরিচিতি ছিল। ফলে মা খাদিজা (রা.) মহানবী (সা.)-কে নিয়োগ দেন এবং ব্যবসায়ী কাজে সিরিয়া পাঠান। তখন ব্যবসায়িক সফরেই আগের তুলনায় এবং প্রত্যাশার চেয়ে দ্বিগুণ লাভ এনে দেন মহানবী (সা.)। যথাযথভাবে ব্যবসা পরিচালনা ও সৎভাবে হিসাব রাখার ফলে এই মুনাফা হয় বলে জানতে পারেন মা খাদিজা (রা.)। ফলে তিনি মহানবী (সা.)-এর প্রতি আগ্রহী হন এবং পারিবারিকভাবে তাঁদের বিয়ে হয় সম্ভাব্য ৫৯৫ খ্রিস্টাব্দে। এ সময় মহানবী (সা.)-এর বয়স ছিল ২৫ বছর আর মা খাদিজা (রা.)-এর বয়স ছিল ৪০ বছর। দাম্পত্য জীবনে তাঁরা অত্যন্ত সুখী ছিলেন এবং তাদের কোলজুড়ে পাঁচ (মতান্তরে সাত বা আট) সন্তানের জন্ম হয়, যার অন্যতম ছিলেন মা ফাতেমা (রা.)।

বিয়ের প্রায় ১৪-১৫ বছর পর মক্কার অদূরবর্তী হেরা পর্বতের গুহায় ইংরেজি ৬১০ সালে মহান আল্লাহ তাঁর দূত ফেরেশতা হজরত জিব্রাইল (আ.)-এর মাধ্যমে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর কাছে পবিত্র কোরআনের প্রথম বাণী প্রেরণ করেন এবং তা পড়তে বলেন। প্রত্যুত্তরে মহানবী (সা.) নিজেকে অক্ষর-জ্ঞানহীন তথা পড়তে জানেন না বলায় জিব্রাইল (আ.) তাঁকে বুকে জড়িয়ে ধরেন এবং তাঁকে সৃষ্টিকর্তার নাম শুনে শুনে পড়তে বলেন। পবিত্র কোরআনের ৯৬ নম্বর সূরা আলাকের প্রথম ও দ্বিতীয় আয়াত অনুসারে মহানবী (সা.)-কে বলা হয়, ‘পড়... তোমার প্রতিপালকের নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টি করেছেন মানুষকে রক্তপি- থেকে।’ মহানবী (সা.) শুনে শুনে তা আবৃত্তি করেন। এভাবেই নবুয়তপ্রাপ্ত হন ইসলামের প্রাণপুরুষ মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)। তবে এ ঘটনার পর তিনি অত্যন্ত ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন এবং তাঁর শরীরে কাঁপনসহ জ্বর আসে। এ সময় মা খাদিজা (রা.) মহানবী (সা.)-এর শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেন, সাহস জোগান এবং তাঁর কথার প্রতি প্রশ্নাতীত বিশ্বাস স্থাপন করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। এভাবেই মহানবী (সা.)-এর হাতে প্রথম ইসলাম ধর্ম গ্রহণের বিরল সৌভাগ্য অর্জন করেন মা খাদিজা (রা.)।

ইসলাম প্রচারে মা খাদিজা (রা.)-এর অসামান্য অবদান ছিল। মুসলমান ক্রীতদাসদের মাঝে তিনি প্রচুর খাবার ও অর্থ দান করতেন এবং দাসত্ব অবসানে সাহায্য করতেন। জিহাদ পরিচালনার জন্য তিনি অনেক অর্থ ব্যয় করেন। মহানবী (সা.)-এর হৃদয়ে তাঁর প্রতি যে ভালোবাসা, তা মহান আল্লাহই মহানবীর হৃদয়ে জাগ্রত রেখেছিলেন বলে মুসলিম শরিফে উল্লিখিত। আর সহি বুখারি অনুসারে হজরত ইমরান (আ.)-এর কন্যা হজরত মরিয়ম যেমন তাঁর আমলে শ্রেষ্ঠ নারী ছিলেন, ঠিক তেমনি খোয়ালিদ (খালিদ) কন্যা হজরত খাদিজা (রা.)ও তাঁর আমলে শ্রেষ্ঠ নারী ছিলেন। মা খাদিজা (রা.)-এর জীবদ্দশায় মহানবী (সা.) দ্বিতীয় বিয়ে করেননি বরং তাঁর মৃত্যুর পরও মহানবী (সা.) তাঁকে স্মরণ করতেন এবং বাড়িতে কোনো পশু জবাই করলে গোস্তের কিছু অংশ মা খাদিজা (রা.)-এর আত্মীয় বা বান্ধবীদের বাড়িতে প্রেরণ করতেন। মহানবী (সা.) এবং তৎকালীন মুসলমান সমাজকে শোকসাগরে ভাসিয়ে ৬১৯ খ্রিস্টাব্দের ২২ নভেম্বর মা খাদিজা (রা.) মৃত্যুবরণ করেন বলে একদল ইতিহাসবিদ দাবি করেন। হিজরি সাল গণনা শুরু হয় ১৬ জুলাই ৬২২ সাল থেকে। ফলে তাঁর মৃত্যুর হিজরি কোনো তারিখ নেই। তবে একটি ইসলামী ব্যাংক প্রকাশিত ডায়েরি অনুসারে তৎকালে প্রচলিত আরবি হিসাবে ১০ রমজান তারিখে পৃথিবী ছেড়ে যান ‘প্রিন্সেস অব কুরাইশ’, ‘দ্য পায়াস ওন্সেন’, ‘দ্য গ্রেট’Ñ প্রভৃতি উপাধিপ্রাপ্ত মা খাদিজা (রা.)।

পবিত্র কোরআনের ৩৩ নম্বর সূরা আজহাবের ৬ নম্বর আয়াতে মহানবী (সা.)-এর স্ত্রীগণকে বিশ্বাসীদের ‘মা’ বলে সম্বোধন করা হয়েছে। তাফসিরকারীদের একটি অংশ মনে করেন, মা খাদিজা (রা.)-এর প্রতি ইঙ্গিত করে এই পবিত্র বাণী রচিত হয়েছে। মক্কার জান্নাতুল মুয়াল্লায় তাঁকে দাফন করা হয়।

মা ফাতেমা (রা.)-এর ইন্তেকাল

মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) এবং মা খাদিজা (রা.)-এর অত্যন্ত আদরের কন্যা (সম্ভবত কনিষ্ঠ) ছিলেন ফাতেমা বিনতে মুহাম্মদ (রা.), যিনি মুসলমানদের মাঝে মা ফাতেমা (রা.) নামে অধিক পরিচিত। আর জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায় তিনি ছিলেন ‘খাতুনে জান্নাত, ফাতেমা জননী, বিশ্ব দুলালী, নবী নান্দিনী’। অনেকের মতে ৬০৯ খ্রিস্টাব্দে অর্থাৎ পবিত্র কোরআন নাজিলের আগে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। আবার অনেকের বিশেষ শিয়াদের দাবি নবুয়ত প্রাপ্তির পর জন্ম নেন মা ফাতেমা (রা.)। ফলে তিনি বিশেষ মর্যাদাবান ও সমাদৃত। প্রথা অনুসারে কোনো বেদুইন পরিবারে না পাঠিয়ে নিজ ঘরেই অতি আদরে বড় হতে থাকেন মা ফাতেমা (রা.)। ৬১৯ সালে মা খাদিজা (রা.)-কে হারিয়ে অত্যন্ত ভেঙে পড়েন মা ফাতেমা (রা.)। এরপর হজরত মুহাম্মদ (সা.) একাই মা ও বাবার স্নেহ দিয়ে গড়ে তোলেন মা ফাতেমা (রা.)-কে। বিভিন্ন দিক বিবেচনা করে হজরত মুহাম্মদ (সা.) অনেক আগ্রহী পাত্রের মধ্য থেকে হজরত আলী (রা.)-কে মা ফাতেমা (রা.)-এর পাত্র হিসেবে পছন্দ করেন। মা ফাতেমা (রা.) এতে কোনো অসম্মতি জানাননি। তবে আর্থিকভাবে দুর্বল থাকায় হজরত আলী (রা.)-কে তাঁর যুদ্ধের ঢাল বিক্রির পরামর্শ দেন হজরত মুহাম্মদ (সা.)। ঢাল বিক্রির টাকা দিয়ে হজরত আলী (রা.) মহানবী (সা.)-এর পরিচালনায় বিয়ে করেন। মহানবী (সা.)-এর আরেক প্রিয়ভাজন হজরত ওসমান বিন আফফান (রা.) সেই ঢাল কিনে ছিলেন আবার বিয়ের উপহার হিসেবে সেই ঢাল ফেরত দেন। বিয়ে উপলক্ষে হরেক রকম খাবার তৈরি করেন মহানবী (সা.)-এর অপর দুই স্ত্রী মা আয়েশা (রা.) এবং মা উম্মে সালমা (রা.)। দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত ছিল মা ফাতেমা (রা.)-এর জীবন। নিজ হাতে সব কাজ করতে গিয়ে তাঁর হাতে এবং শরীরের বিভিন্ন অংশে ক্ষতের সৃষ্টি হয়। হজরত আলী (রা.) নিজেও জীবিকার টানে ঘরের বাইরে অনেক পরিশ্রম করতেন। তবে তাদের মধ্যে ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার কোনো কমতি ছিল না। তাই তাদের কোলজুড়ে আসে মহানবী (সা.)-এর অতি আদরের দুই ধন ইমাম হাসান (রা.) ও ইমাম হোসেন (রা.)। মা ফাতেমা (রা.) ৬২৪ খ্রিস্টাব্দে ওহুদের যুদ্ধে আহতদের সেবা-শুশ্রুষা করেন এবং আহত ও শহীদদের পরিবারকে সান্ত্বনা প্রদান করেন। ইতিহাসবিদ, গবেষক এবং শিয়া ও সুন্নি মতাবলম্বীরা মা ফাতেমা (রা.)-এর মৃত্যুর কারণ, সঠিক দিনক্ষণ, জানাজা এবং সমাহিত করার স্থান নিয়ে বহুভাগে বিভক্ত। তবে মোটামুটিভাবে হিজরি ১১ সনে অর্থাৎ ৬৩২ খ্রিস্টাব্দে তিনি মৃত্যুবরণ করেন বলে ধরা যায়। একদল গবেষকের দাবি মা ফাতেমা (রা.) রমজান মাসের সম্ভাব্য ১৩ তারিখে ইন্তেকাল করেন। সুন্নাহ্ ডট অরগ অনুসারে ২০ রমজান তারিখে তাঁকে জান্নাতুলবাকী কবরস্থানে দাফন করা হয়। আবার ৩ রমজানে তাঁর মৃত্যু হয় বলে তথ্য রয়েছে লাস্ট প্রফেট ডট নেটে। তবে মৃত্যু নিয়ে যতই তর্ক থাকুক, এ বিষয়ে সবাই এক মত যে, পৃথিবীর বুকেই জান্নাতের প্রতিশ্রুতি পেয়েছিলেন হজরত ফাতেমা (রা.)।

 

ইহুদিদের ওপর মুসলমানদের জয়

বিংশ শতাব্দীতে মুসলমানদের একটি বড় অর্জন হলো ১৯৭৩ সালে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে সিনাই ও গোলান এলাকা দখলদার ইসরায়েলি বাহিনী থেকে পুনরুদ্ধারের আগে ১৯৬৭ সালে তৃতীয় আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে ইসরায়েল সৈন্যরা প্রতিবেশী মিসর, জর্ডান এবং সিরিয়ার মুসলমান সৈন্যদের হটিয়ে গাজা ভূখন্ড, সিনাই উপদ্বীপ পশ্চিমতীর দখল করে। যুদ্ধ বিরতি আরোপিত হলে একটি নিয়ন্ত্রণ রেখা পর্যন্ত ইসরায়েল দখল করে রাখে। এই এলাকা ১৯৬৭ থেকে ১৯৭৩ পর্যন্ত প্রায় ছয় বছর ইসরায়েলিদের দখলে ছিল। এই ভূখন্ড পুনরুদ্ধার মিসর তথা মুসলমানদের জন্য একটি মানসম্মানের প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায়। ফলে মিসর নিজ অবস্থান সুয়েজ খালের পশ্চিমতীর থেকে ঝটিকা আক্রমণ করে খাল অতিক্রম ও সুয়েজ খালের অপর প্রান্ত বা পূর্বপ্রান্তে সীমিত পরিসরে নিজেদের দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করে, যা পরবর্তীতে বিস্তৃত করারও পরিকল্পনা করা হয়।

এই যুদ্ধে শত্রুকে চমকে দিতে ইহুদিদের বছরের পবিত্রতম দিন ‘ইয়াম কিপুর’-কে বেছে নেওয়া হয়। ইহুদি ধর্ম মতে, এই দিনে বিগত দিনের পাপ মোচন হয় এবং আগামী এক বছরের জন্য তাদের ভাগ্য নির্ধারিত হয়। তাই এই দিনে দীর্ঘ ২৫ ঘণ্টার উপবাস ও ছোট্টঘরে বসে প্রার্থনা ইহুদিদের প্রাচীন ধর্মীয় রীতি। ইহুদিদের নিজস্ব ক্যালেন্ডারের ভিত্তিতে চাঁদ দেখা সাপেক্ষে এই দিন ধার্য করা হয়। ১৯৭৩ সালে ইহুদিদের এই পবিত্র দিন নির্ধারিত ছিল ৬ অক্টোবর। এই একই দিনটি মুসলমানদের প্রিয় রমজানের ১০ তারিখ, ১৩৯৩ হিজরি। এই তারিখেই সুয়েজ খাল অতিক্রমের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। যুদ্ধের আগে মিসর ২০ হাজার সৈন্যকে ছুটিতে পাঠায়। রিজার্ভ বা সংরক্ষিত সৈন্যদেরও যুদ্ধ ক্ষেত্রে না আসার পরামর্শ দেয়। যুদ্ধে অংশে নেওয়া নবীন অফিসার ক্যাডেটদের সামরিক প্রশিক্ষণের জন্য সামরিক একাডেমিতে পাঠিয়ে দেয়। সর্বোপরি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সৈন্যকে বিশেষত জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তাদের ওমরা হজ পালনের অনুমতি দেয়। অন্যদিকে মিসর তার মিত্র সিরিয়া ও জর্ডানে তখনো তাদের মিত্রদের থেকে প্রত্যাশিত অস্ত্র আসা বাকি ছিল। এসব আয়োজন দেখে এবং পবিত্র রমজান মাসে সৈন্যরা রোজা রাখে ও ইবাদত করে বিধায় যুদ্ধ শুরুর দিন সকালেও ইসরায়েলি সেনাপ্রধান ও অন্যান্য নেতা বুঝতে পারেনি কী হতে চলেছে। এমনকি ৬ অক্টোবর ১৯৭৩ (১০ রমজান) সকাল ৮টা ৩ মিনিটে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী, প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও চিফ অব জেনারেল স্টাফ মিটিং করেও নিশ্চিত হতে পারেননি মিসরীয় বাহিনীর আসল উদ্দেশ্য অথচ মিটিংয়ের ছয় ঘণ্টার মধ্যেই যুদ্ধ শুরু হয়।

১০ রমজান (৬ অক্টোবর ১৯৭৩) মিসর ও জর্ডানের মিত্রবাহিনী ইহুদিদের চমকে দিয়ে আক্রমণ শুরু করে। যুদ্ধবিরতি রেখা অতিক্রম করে তারা দখল করতে থাকে ইসরায়েলি অবস্থান। দ্রুতই সুয়েজখাল অতিক্রম করে পৌঁছে যায় সিনাই উপত্যকায়। তিন দিন ইসরায়েলিদের মাথাচাড়া দেওয়ার তেমন সুয়োগই দেয়নি মুসলমানরা। জর্ডানের সেন্যরাও এ সময় গোলান হাইটের দখল নিয়ে নেয়। এরপর ইসরায়েল তার চিরমিত্র আমেরিকার বুদ্ধি, পরামর্শ ও উন্নত অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে। মুসলমানরাও এর যোগ্য জবাব দিতে থাকে। এভাবে আক্রমণ পাল্টা আক্রমণ চলে সমগ্র রমজানজুড়ে। এক পর্যায়ে যুদ্ধ ও যুদ্ধ বন্ধে যুক্ত হয় তিন পক্ষ; আমেরিকা, সোভিয়েত ইউনিয়ন (রাশিয়া) এবং জাতিসংঘ। সব পক্ষের সিদ্ধান্তে রোজার ঈদের দুই দিন আগে অর্থাৎ ২৫ অক্টোবর ১৯৭৩ (২৮ রমজান) কার্যকর হয় যুদ্ধবিরতি। এই যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ইসরায়েল ও আমেরিকা বুঝতে পারে বিভক্তি না ঘটালে মুসলমানকে দাবিয়ে রাখা যাবে না। তার পরের ইতিহাস মধ্যপ্রাচ্যে মুসলমানদের নিজেদের মধ্যে আত্মঘাতী সংঘাত যা আজো চলছে।

সর্বশেষ খবর