শুক্রবার, ৮ মে, ২০২০ ০০:০০ টা

ইতিহাসের আলোকে রমজানের তৃতীয় সপ্তাহ

মেজর নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ (অব.) পিএইচডি

ইতিহাসের আলোকে রমজানের তৃতীয় সপ্তাহ

বদরের যুদ্ধ ১৭ রমজান

ইসলামের ইতিহাসে ১৭ রমজান ‘বদর দিবস’ নামে আখ্যায়িত। ইমানি শক্তিতে বলীয়ান অল্প সংখ্যক মুসলমানও যে মহান আল্লাহর অনুগ্রহ ও কুদরতে পরাক্রমশালী অমুসলিমদের ওপর বিজয় লাভ করতে পারে, তার উদাহরণ সৃষ্টি হয়েছিল হিজরি দ্বিতীয় বছরের ১৭ রমজান, ইংরেজি ১৩ মার্চ ৬২৪ সাল। মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) ইসলামের শত্রুদের চাপের মুখে নিকটাত্মীয় ও সঙ্গীদের (সাহাবি) নিয়ে ৬২২ সালে মক্কা ছেড়ে মদিনায় স্থানান্তরিত হন, যা হিজরত নামে পরিচিত। এই সময় থেকেই হিজরি বছর গণনা শুরু হয়। হিজরি দ্বিতীয় সালে মদিনায়ও মুসলমানদের জীবন নানাভাবে অতিষ্ঠ করে তোলে মক্কার কুরাইশ ও মদিনায় থাকা তাদের দোসররা। উভয় পক্ষের মধ্যে ছোটখাটো সংঘাতও ঘটে ২ বছরজুড়ে। তবে দ্বিতীয় বছরের ১৭ রমজান মদিনা থেকে ৭০ মাইল দক্ষিণে পানির উৎস বা কুয়া সমৃদ্ধ বদরের মাঠে অনুষ্ঠিত হয় মহানবী (সা.) এর জীবদ্দশায় প্রথম বড় আকারের যুদ্ধ। তাফসিরকারীদের মধ্যে হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) এর মতে, বদরের যুদ্ধের পূর্বে নির্যাতনের শিকার হলেও অন্তত ৭০টি আয়াতে মুসলমানদের যুদ্ধ না করার নির্দেশ দেওয়া হয় এবং এই পরিপ্রেক্ষিতে মহানবী (সা.) সবাইকে ধৈর্য ধরার উপদেশ দেন। কিন্তু বদরের যুদ্ধের পূর্বেই পবিত্র কোরআনের ২২ নম্বর সূরা ‘হজ্জ’ এর ৩৮ ও ৩৯ নম্বর আয়াতে নাজিল হয়; যেখানে বলা হয়েছে, “আল্লাহ বিশ্বাসীগণকে রক্ষা করেন তিনি কোনো বিশ্বাসঘাতক  অকৃতজ্ঞকে ভালোবাসেন না। যারা আক্রান্ত হয়েছে, তাদের যুদ্ধ করার অনুমতি দেওয়া হলো। কারণ তাদের প্রতি অত্যাচার করা হয়েছে। আল্লাহ তাদের সাহায্য করতে অবশ্যই সক্ষম। এমনি এক প্রেক্ষাপটে মহানবী (সা.) মক্কা থেকে শত্রুদের খবর সংগ্রহ ও মক্কায় অবশিষ্ট মুসলমানদের নিরাপদ হিজরতের জন্য মক্কা-মদিনার রাস্তা এবং বাণিজ্যিক কাফেলা চলাচলের রাস্তায় খ- খ- টহল দল পাঠাতে থাকেন। মুসলমানদের ৮ সদস্যের এমনি একটি টহল দল, সুযোগ পেয়ে মক্কার কুরাইশদের একটি বাণিজ্যিক কাফেলার ওপর আক্রমণ চালিয়ে কুরাইশ নেতা অমর ইবনে হাদরামিকে হত্যা করে দুজনকে বন্দী করে এবং মালামাল দখল করে। একই ধারাবাহিকতায় কুরাইশ নেতা আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ব্যবহারের জন্য অস্ত্রসহ কাফেলা চলাচলের খবর পৌঁছে মুসলমানদের কাছে। মুসলমানরা তা আক্রমণের পরিকল্পনা করে, যা আবু সুফিয়ান টের পায় এবং কাফেলার নিরাপত্তা চেয়ে মক্কায় সংবাদ পাঠায়। কুরাইশ নেতা তখন মুসলমানদের আক্রমণের জন্য এবং আবু সুফিয়ানের নিরাপত্তার জন্য বিশাল কুরাইশ বাহিনী নিয়ে মদিনার দিকে যাত্রা করে। মহানবী (সা.) সবার সঙ্গে পরামর্শক্রমে মুসলমান বাহিনী নিয়ে কুরাইশদের প্রতিরোধ করতে এগিয়ে যান। ১১ মার্চ ৬২৪ সালে উভয় বাহিনীর দূরত্ব ছিল একদিনের হাঁটার পথ। পরদিন ১২ মার্চ মুসলমানরা আরও অগ্রসর হয় এবং বদরের পানির উৎস বা কুয়ার কাছে অবস্থান নেয়। কুরাইশরাও বদরের দক্ষিণে অবস্থান নেয় এবং আবু সুফিয়ান তাদের পেছনে এসে যোগ দেয়। এ সময় মুসলমানদের ছিল ৩১৩ থেকে ৩৫০ জনের মতো সৈন্য, মাত্র দুটি ঘোড়া এবং ৭০টি উট। পক্ষান্তরে কুরাইশদের ছিল প্রায় ১০০০ সৈন্য, ১০০টি ঘোড়া এবং ১৭০টি উট। ১৭ রমজান (১৩ মার্চ) রাতে কুরাইশরা এগিয়ে আসে মুসলমানদের দিকে। ফলে শুরু হয় বদরের যুদ্ধ। তৎকালীন প্রথা মোতাবেক প্রথমে দুই পক্ষের তিনজন করে সেরা যোদ্ধার ডাক পড়ে সম্মুখযুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার জন্য। প্রথম সম্মুখযুদ্ধ হয় হজরত আলী (রা.) এবং কুরাইশদের সবচেয়ে শক্তিশালী সেনাপতি ওয়ালিদ ইবনে উৎবার মধ্যে। এতে ওয়ালিদকে হত্যা করে হজরত আলী (রা.) জয়ী হন। দ্বিতীয় যুদ্ধে মুসলমানদের পক্ষে সাহাবি হজরত হামজা (রা.) হত্যা করেন কুরাইশ নেতা উৎবা ইবনে রাবিয়াহকে। তৃতীয় যুদ্ধে মুসলমানদের পক্ষে উবায়দাহ কুরাইশদের নেতা শোয়াইবা ইবনে রাবিহার অস্ত্রের আঘাতে আহত হন এবং পরে শাহাদতবরণ করেন। তবে শোয়াইবা হজরত আলী (রা.) এবং হজরত হামজা (রা.) এর হাতে প্রাণ হারান। এরপর উভয় পক্ষের মধ্যে প্রথমে তীর নিক্ষেপ ও পরে তলোয়ার নিয়ে হাতাহাতি যুদ্ধ শুরু হয়। এ সময় মহানবী (সা.) তার পবিত্র হাতে এক মুঠো বালি নিয়ে শত্রুর দিকে ছুড়ে মারেন। এতে মক্কার কুরাইশরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় এবং পালাতে থাকে। বদরের যুদ্ধে ১৪ জন বীর সাহাবি শাহাদতবরণ করেন। অপর পক্ষে কুরাইশদের মধ্যে ৭০ জন বন্দী হয় এবং ৭০ জন মারা যায়। আহত হয় আরও অনেকে। বদরের যুদ্ধ নিয়ে পবিত্র কোরআন ও হাদিসে বেশ কিছু তথ্য পাওয়া যায় ৩ নম্বর সূরা আল ইমরানের ১৩ নম্বর আয়াত অনুসারে বদরের যুদ্ধে শত্রুরাও তাদের চোখের দেখায় মুসলমানদের দুই গুণ বেশি দেখেছিল। একই সূরার ১২৩ নম্বর আয়াতে বর্ণিত ‘আর নিশ্চয় বদরের যুদ্ধে আল্লাহ তোমাদের (মুসলমানদের) সাহায্য করেছিলেন, তখন তোমরা ছিলে হীনবল। সুতরাং তোমরা আল্লাহকে ভয় করো, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারে।’ পবিত্র কোরআনের ৮ নম্বর সূরা আনফালে ‘বদর’ শব্দটির উল্লেখ নেই, তবে পুরো সূরায় নানাভাবে বদর প্রসঙ্গ এসেছে। এর মধ্যে অন্যতম ৯ নম্বর আয়াত, যেখানে এই যুদ্ধে আল্লাহ এক হাজার ফেরেস্তাকে একের পর এক পাঠিয়ে মুসলমানদের সাহায্য করার তথ্য রয়েছে।

 

মা আয়েশা (রা.) এর মৃত্যু-১৭ রমজান

 

বদরের যুদ্ধের ঠিক ৫৬ বছর পর হিজরি ৫৮ সালের ১৭ রমজান (ইংরজি ১৩ জুলাই ৬৭৮) তারিখে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর তৃতীয় এবং বয়সের বিবেচনায় সর্বকনিষ্ঠ স্ত্রী আয়েশা বিনতে আবু বকর সংক্ষেপে মা আয়েশা (রা.) মৃত্যুবরণ করেন। তিনি ছিলেন মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর বিশ্বস্ত সাহাবি, সাহসী যোদ্ধা, অন্যতম সঙ্গী এবং পরবর্তীতে ইসলামের প্রথম খলিফা হজরত আবু বকর (রা.) এর কন্যা। তার মার নাম উম্মে রুমান ঠিক কত বছর বয়সে মা আয়েশা (রা.) মহানবী (সা.) এর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন, তা নিয়ে ইতিহাসবিদ ও মহানবী (সা.) এর জীবনী রচনাকারীদের মধ্যে মতবেদ রয়েছে। তবে সন্দেহাতীতভাবে তিনি নিতান্ত বালিকা বয়সে (কম বেশি ১০ বছর বয়সে) বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন বলে বিভিন্ন গ্রন্থে উল্লেখ আছে। ৬২২ সালে মক্কায় ইসলামের শত্রুদের অত্যাচার বৃদ্ধি এবং প্রাণনাশের হুমকি থাকায় মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) সঙ্গী, সাহাবি ও নিকটাত্মীয়দের ছোট ছোট দলে মদিনায় হিজরতের আদেশ দেন। মহানবী (সা.) এ সময় হজরত আবু বকর (রা.) কে তার সঙ্গে নেন। মা আয়েশা (রা.) এর বয়স তখন সম্ভাব্য ৯ বছর। তার মা উম্মে রুমান তাকে নিয়ে পরবর্তীতে মদিনা গমন করেন। মা উম্মে রুমানও ছিলেন মহানবী (সা.) এর ভক্ত এবং বিশিষ্ট মুসলমান। মদিনায় হিজরতের অব্যবহিত পরেই মহানবী (সা.) এর সঙ্গে মা আয়েশা (রা.) এর বিবাহ সম্পন্ন হয় বলে অধিকাংশ গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে।

মহানবী (সা.) মা আয়েশা (রা.) কে অত্যন্ত স্নেহ করতেন ও প্রাণ উজাড় করে ভালোবাসতেন। উভয়ের মধ্যে মধুরতম দাম্পত্য সম্পর্ক ও বোঝাপড়ার বহু ঘটনা বিভিন্ন কিতাবে স্থান পায়। মহানবী (সা.)-কে প্রশ্ন করলে তিনি মা আয়েশা (রা.) কে অত্যন্ত বেশি ভালোবাসতেন বলে উত্তর দিতে শুনেছেন অনেক সাহাবা। রাতের অন্ধকারে নির্জন মরুভূমিতে তারা দুজন দৌড় প্রতিযোগিতা করতেন। এতে প্রথম দিকে মা আয়েশা (রা.) বিজয়ী হয়েও পরবর্তীতে তার ওজন বৃদ্ধি পাওয়ায় মহানবী (সা.) বিজয়ী হতেন বলে মা আয়েশা (রা.) এর বর্ণনায় উঠে আসে। এ ছাড়াও মহানবী (সা.) তাকে নানাভাবে গৃহকর্মে সাহায্য করতেন ও বিভিন্ন বিষয়ে তার সঙ্গে পরামর্শ করতেন। তার প্রখর প্রজ্ঞা, বিচক্ষণতা, কাব্যপ্রতিভা এবং ইতিহাস ও চিকিৎসা নানা বিষয়ে জ্ঞান সমাদৃত ছিল। মহানবী (সা.) এর মূল কর্মক্ষেত্র মসজিদ এ নববীর কাছেই মহানবী (সা.) তাঁর জন্য ঘর নির্মাণ করেন এবং এমনভাবে দরজা নির্মাণ করেন যে, কেবল মহানবী (সা.) তাকে সহজে দেখতে পেতেন। তীক্ষ  স্মৃতিশক্তির কারণে মহানবী (সা.) ধর্মীয় বহু বিধিবিধান মা আয়েশা (রা.) কে সরেজমিন শিক্ষা দিতেন। তিনি পরবর্তীতে তা অন্যদের শেখাতেন।

৬৩২ সালে মহানবী (সা.) মা আয়েশা (রা.) এর ঘরে ইন্তেকাল করেন এবং এ ঘরেই তাকে সমাহিত করা হয় যা আজ মসজিদই নববীর রওজা মোবারক নামে সুপরিচিত। মহানবী (সা.) এর মৃত্যুর ৪৬ বছর পর ১৭ রমজান ৫৮ হিজরি তারিখে মা আয়েশা (রা.) মৃত্যুবরণ করেন। এ সময় ফিৎনা বা গৃহবিবাদ চলার কারণে তিনি হত্যাকা-ের শিকার হন বলে তথ্য রয়েছে। প্রখ্যাত হাদিস বর্ণনাকারী ইমাম আবু হুরাইরা (রা.) এর ইমামতিতে জানাজা শেষে মসজিদই নববীর নিকটবর্তী জান্নাতুল বাকি কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়। ইসলামের বিভিন্ন হাদিস গ্রন্থে মা আয়েশা (রা.) এর উদ্ধৃতিতে দুই হাজারের বেশি হাদিস লেখা হয়েছে। মহানবী (সা.)-এর দর্শন, জীবনাচার, মূল্যবোধ এবং ধর্মীয় বিষয়ে বহু নির্দেশনার সূত্র হিসেবে মা আয়েশা (রা.) চিরস্মরণীয়।

 

 

ইমাম হাসান (রা.) এর জন্ম ১৫ রমজান

ইংরেজি ক্যালেন্ডারে ১২ মাসে ৩৬৫ দিন গণনা করা হলেও আরবি বছর ১২ মাসে তা ১০ দিন কম। তাই প্রতিবছর রমজান ঈদ বা চাঁদ দেখার ওপর নির্ভরশীল অনুষ্ঠান বা উৎসব ১০ দিন করে এগিয়ে যায়। এর ফলে ইংরেজি ও আরবি তারিখের সঙ্গে বিভিন্ন গ্রন্থে-বিভিন্ন গড়মিল লক্ষ্য করা যায়। ইসলামের ইতিহাসে মহানবী (সা.) পরবর্তী যুগের এক ঐতিহাসিক নাম ইমাম হাসান (রা.)।

হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর আদরের কন্যা মা ফাতেমা (রা.) এবং তার স্বামী ইসলামের চতুর্থ খলিফা হজরত আলী (রা.) এর জ্যেষ্ঠ পুত্র হিসেবে ইমাম হাসান (রা.) এর সম্পূর্ণ নাম হাসান ইবনে আলী (রা.)। মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) মক্কা ছেড়ে মদিনায় হিজরত করার পর মা ফাতেমা (রা.) এবং হজরত আলী (রা.) এর শুভবিবাহ সম্পন্ন হয়। এই বিবাহের আনুমানিক ২ বছর পর তাঁদের কোলজুড়ে আসে প্রথম সন্তান হজরত ইমাম হাসান (রা.)। উইকিপিডিয়া, ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন ডট অরগ এবং জিইসলাম ডট নেটে ইমাম হাসান (রা.) এর জন্ম হিজরি ৩ সালের রমজান মাসের ১৫ তারিখ বলে উল্লেখিত, যদিও ইংরেজি তারিখে তা ভিন্ন রকম। একটি ওয়েব সাইডের তথ্য মোতাবেক ৬২৫ সালে রমজান শুরু হয় ১৪ ফেব্রুয়ারি। সে হিসাবে রমজানের ১৯ তারিখে (ইংরেজি ০৪ মার্চ ৬২৫) জন্মগ্রহণ করেন হজরত ইমাম হাসান (রা.)। সার্বিক বিচারে রমজানের তৃতীয় সপ্তাহে তাঁর জন্মের বিষয়ে সন্দেহ নেই। মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) বড় নাতি (দৌহিত্র) হিসাবে মা ফাতেমার এই পুত্র সন্তান জন্মের সংবাদে অত্যন্ত আনন্দিত হন এবং একটি  ভেড়া জবাই করে আকিকা করেন এবং তাঁর নাম রাখেন আল হাসান। মহানবী (সা.) তার নিজ সন্তান এবং নাতি-নাতনিদের অত্যন্ত স্নেহ করতেন। তিনি তার স্নেহের দ্বারাই তাদের শাসন করতেন এবং কখনো কোনো সীমা অতিক্রম করতে দিতেন না। শিয়া সম্প্রদায়ের বিশ্বাস এবং অন্যান্য বর্ণনায় মহানবী (সা.) তাঁর নাতিদের সঙ্গে খেলতেন এবং তাঁদের চুমু খেতেন বলে বর্ণিত হয়েছে। তবে এ নিয়ে বহু কিংবদন্তিও হয়েছে। মাত্র সাত বছর ইমাম হাসান (রা.) তার প্রিয় নানার সান্নিধ্য পেয়ে ছিলেন। ৬৩২ সালে মহানবী (সা.) এর জাগতিক মৃত্যুর পর এক কঠোর বাস্তবতার মুখোমুখি হন ইমাম হাসান, তার বাবা হজরত আলী (রা.) সহ পুরো পরিবার। হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর মৃত্যুর পর পর্যায়ক্রমে হজরত আবু বকর (রা.), হজরত ওমর (রা.) ও হজরত ওসমান (রা.) ইসলামের খলিফা নিযুক্ত হন। এরপর খলিফা নিযুক্ত হন হজরত আলী (রা.)। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে এই চার খলিফার মধ্যে একমাত্র হজরত আবু বকর (রা.) স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করেন। বাকিদের মধ্যে হজরত ওমর (রা.) এবং হজরত ওসমান (রা.) বিরোধীদের আক্রমণে নিজেদের ঘরেই হত্যাকা-ের শিকার হন। একইভাবে হজরত আলী (রা.)ও বিষ মাখানো তরবারি দিয়ে আঘাতের ২/৩ দিন পর মৃত্যুবরণ করেন। হজরত আলীর মৃত্যুর পর একদল মুসলমানের সমর্থন নিয়ে ইমাম হাসান (রা.) খলিফা নিযুক্ত হলেও অন্য দল তার বিরোধিতা করতে থাকে এবং ষড়যন্ত্র করতে থাকে। এসব ষড়যন্ত্রের মুখে মুসলিম উম্মার বৃহত্তর ঐক্য ও শান্তির স্বার্থে বছর পেরোনোর আগেই অপর পক্ষের নেতা মুয়াইবিয়ার হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দেন। এরপর প্রায় ৯ বছর তিনি মদিনায় অবস্থান করেন এবং ধর্মীয় ও পারিবারিক কাজে নিয়োজিত থাকেন। তবুও চক্রান্ত চালিয়ে যায় তার শত্রুরা। ৬৭০ সালের ১ এপ্রিল এই শত্রুদের চক্রান্তে ইমাম হাসান (রা.) কে হত্যা করা হয়। কে এই বিষপ্রয়োগ করে ছিলেন, তা নিয়ে নানাবিধ তথ্য পাওয়া যায়। এই বিষ প্রয়োগকারী হিসাবে ইমাম হাসান (রা.) এর স্ত্রী, নিকটাত্মীয়, গৃহপরিচালিকা এবং নিকটাত্মীয়র স্ত্রীর নাম উঠে আসে বিভিন্ন গ্রন্থে। মসজিদ আল নববী পাশে জান্নাতুল বাকি কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়।

 

মক্কা বিজয় রমজানের তৃতীয় সপ্তাহ

৬২২ সালে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) কুরাইশদের বিরোধিতা, অত্যাচার ও প্রাণনাশের হুমকির মুখে মক্কা ছেড়ে মদিনায় হিজরত করতে বাধ্য হন। এ ঘটনার ৭ বছর পর মহানবী (সা.)-এর নেতৃত্বে এক রক্তপাতহীন অভিযানের মধ্য দিয়ে সেই মক্কা মুসলমানদের দখলে আসে। বিভিন্ন ঘটনা এবং ছোটখাটো আক্রমণ ও পাল্টা আক্রমণের মধ্য দিয়ে ইংরেজি ৬২৯ সালের শেষ থেকে মধ্য জানুয়ারি, ৬৩০ সালের মধ্যে মক্কায় মুসলমানদের বিজয় সংঘটিত হয়। আরবি হিসাবে সময়টা ছিল হিজরি ৮ সাল। এই আরবি বছরের রোজা শুরু হয় ২২ ডিসেম্বর ৬২৯ সালে আর ৩০তম বা শেষ রোজা পালিত হয় ২০ জানুয়ারি ৬৩০ সালে। মহানবী (সা.) একজন সফল রাষ্ট্রনায়ক সুদক্ষ সেনাপতি এবং দূরদর্শী সমরবিদ হিসেবে উপলব্ধি করেন যে, মক্কায় অভিযানের তথ্য প্রকাশিত হলে কুরাইশরা প্রতিহত করার সর্বশক্তি নিয়োগ করবে। তাই মক্কা অভিযানের পরিকল্পনা, দিন-ক্ষণ নেতৃত্ব সর্বোপরি মহানবী (সা.) এর অবস্থান সব সময় গোপন রাখা হয়। বিশেষত কোন পথে চূড়ান্ত আক্রমণ চালানো হবে এবং মহানবী (সা.) কোন পথে মক্কায় প্রবেশ করবেন তা ছিল সম্পূর্ণ গোপনীয়। শত্রুকে ধোঁকা দেওয়ার জন্য একটি সেনাদলকে আবু কুতাদাহের নেতৃত্বে মক্কার বদলে ‘বাতান ইজম’ নামক স্থানে পাঠানো হয়। ফলে মক্কা বিজয়ের একাধিক তারিখ বিভিন্ন গ্রন্থে পাওয়া যায়। তবে অধিকাংশের মতে, হিজরি আট সালের ১৮ রমজান মক্কা সম্পূর্ণরূপে মুসলমানদের দখলে আসে। তবে রমজানের তৃতীয় সপ্তাহ যে মক্কায় মুসলমানদের বিজয় সূচিত হয়েছিল, এ ব্যাপারে কারও কোনো সন্দেহ নেই। 

জীবনের মায়া ও নতুন মুসলমানদের নিরাপত্তার কথা ভেবে মহানবী (সা.) মক্কা ছেড়ে মদিনা গেলেও তার মন জন্মভূমি মক্কার জন্য সব সময়ই ব্যাকুল ছিল। তাছাড়াও পবিত্র ঘর কাবার প্রতি তার ছিল দুর্নিবার আকর্ষণ। সব মিলিয়ে তিনি মক্কায় ফেরার জন্য একদিকে সামরিক প্রস্তুতি নেন আর অন্যদিকে বিভিন্ন কূটনৈতিক তৎপরতা ও সন্ধি বা চুক্তি করেন। এমনি একটি চুক্তি ছিল ‘হুদাইবিয়ার চুক্তি’। ৬২৮ সালে সম্পাদিত এই চুক্তির মাধ্যমে মক্কার কুরাইশ ও তাদের মিত্ররা মদিনার মুসলমান এবং মক্কায় অবস্থিত মুসলমানদের সমর্থকদের কোনো প্রকার ক্ষতি বা আক্রমণ করবে না বলে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়। ১০ বছর মেয়াদের এই চুক্তির ২ বছর পেরুতেই (৬৩০ সালে) কুরাইশদের পক্ষে বানবক্স গোত্র মক্কায় থাকা মুসলমানদের মিত্র বানু খোজা গোত্রকে আক্রমণ করেও হত্যাকা- ঘটায়। এ হত্যাকা- ঘটে রমজান পূর্ববর্তী শাবান মাসে, তা-ও আবার কাবা চত্বরে, সেখানে কোনোপ্রকার রক্তপাত নিষিদ্ধ ছিল। এই ঘটনায় বানু খোজা গোত্র মুসলমানদের সাহায্য চায় এবং মক্কা আক্রমণের আমন্ত্রণ জানায়। গোয়েন্দা সূত্রে মহানবী (সা.) মক্কায় কুরাইশ ও তাঁদের মিত্রদের মধ্যে কোন্দল লক্ষ্য করেন। ফলে মহানবী (সা.) মক্কা আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন। এরও আগে পবিত্র কাবায় মুসলমানদের ওমরা হজ পালনের প্রচেষ্টাকে কুরাইশরা বাধা দিলে মক্কা আক্রমণ-অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে।

রণকৌশলগত কারণে মক্কা আক্রমণের সব বিষয় সম্পূর্ণ গোপন রাখা হয়। ইতিহাসবিদদের মতে, রমজান মাসের ৬ তারিখে মুসলমানরা আনুষ্ঠানিকভাবে মদিনা ছেড়ে মক্কার দিকে যাত্রা করেন। মক্কা, মদিনা ও পারিপার্শ্বিক এলাকার মুসলমান সমর্থন সব গোত্র মহানবী (সা.) এর নির্দেশে একই পতাকা তলে আবদ্ধ হয়। ফলে যোদ্ধা সমর্থক ও সাহায্যকারী মিলিয়ে প্রায় ১০ হাজার মুসলমান ও তাঁদের সমর্থক প্রস্তুত হয়ে যায়। বিভিন্ন রাস্তা, গিরিপথ, পাহাড়ের ঢাল ও খোলা মরুভূমি মিলিয়ে প্রায় ৪৫০-৫০০ কিলোমিটার পথ ১০-১২ দিনে পাড়ি দিয়ে মদিনা থেকে যাত্রা করা মুসলমানরা মক্কা থেকে আনুমানিক ১০ কিলোমিটার দূরে ‘মার উজ জাহারান’ নামক স্থানে তাঁবু ফেলে। মহানবী (সা.) এর নির্দেশে সেখানে রাতের বেলা সবাই আগুন জ্বালে। ফলে দূর থেকে কুরাইশ ও অন্য শত্রুরা মুসলমানদের জনবল ১০ হাজারের কয়েকগুণ বেশি মনে করে এবং ভীত হয়ে পড়ে। পরাজয়, নিশ্চিত জেনে কুরাইশ নেতা আবু সুফিয়ান ইবনে হার্ব মুসলমানদের সঙ্গে সমঝোতার চেষ্টা করলেও কোনো সাফল্য লাভ করতে পারেননি। ইতিহাসবিদদের মতে, এ সময় আবু সুফিয়ান উপলব্ধি করেন যে মক্কার দেব-দেবী মানুষের চেয়েও অধম এবং তাদের কোনো ক্ষমতাই নেই কুরাইশদের বাঁচানোর। ফলে তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন।

পরদিন ১৮ রমজান তারিখে কাবাঘর ও মক্কাকে ঘিরে রাখা পাহাড়ের মাঝের চারটি পথ বা গিরিপথ দিয়ে একই সঙ্গে মুসলমানরা কাবা ও মক্কার দিকে অগ্রসর হয়। চারটি পথ দিয়ে প্রবেশের জন্য মুসলমানদের চার ভাগে বিভক্ত করা হয় এবং চারজন সেনাপতি নিয়োগ করা হয়। তিনটি দল বিনাবাধায় মক্কায় প্রবেশ করলেও খালিদ বিন ওয়ালিদের দল কুরাইশদের বাধার সম্মুখীন হয়। এ সময় দুজন মুসলমান শহীদ হন। পক্ষান্তরে ১২ জন যোদ্ধাকে হারিয়ে কুরাইশরা পেছনে পালিয়ে যায়।

এ সময় মহানবী (সা.) এর পক্ষ থেকে এক ঐতিহাসিক ঘোষণা দেওয়া হয়। এতে বলা হয়, আত্মরক্ষা ছাড়া অন্য কোনো কারণে কোনো মুসলমান অস্ত্র ধরবে না। কুরাইশরা অস্ত্র ফেলে দিলে এবং দরজা বন্ধ করে ঘরে থাকলে তাদের কিছুই বলা হবে না। কোনো দরজা ভাঙা হবে না, লুটতরাজ করা হবে না, গাছ কাটা হবে না ও অত্যাচার করা হবে না। তদুপরি আবু সুফিয়ানের বাড়িতে শান্তি এলাকা বা নিরাপদ আশ্রয় ঘোষণা করা হয় এবং সেখানে অবস্থানকারী কাউকে কিছু না বলার সিদ্ধান্ত জানানো হয়। মহানবী (সা.) এর এই উদারতা ও মহানুভবতা কুরাইশ ও তাঁদের মিত্রদের মনে সত্যের আলো জ্বালিয়ে দেয় এবং তারা দলে দলে ইসলাম গ্রহণের প্রস্তুতি নেয়। মহানবী (সা.) মদিনা থেকে মক্কায় প্রবেশের মূলরাস্তা ধরে মক্কায় প্রবেশ করেন এবং কাবায় থাকা সব দেব-দেবীর মূর্তি অপসারণ করেন। এরপর জমজম কূপের পবিত্র পানি দিয়ে কাবাঘর ধোয়া হয় এবং দেয়ালে আঁকা দেব-দেবীর চিত্র মুছে ফেলা হয়। অন্যদিকে হজরত বিলাল (রা.) এর মধুর কণ্ঠে ধ্বনিত আজানের পর নামাজ আদায়ের মধ্য দিয়ে মক্কায় মুসলমানদের সার্বিক কর্তৃত্ব স্থাপিত হয়। ততক্ষণে ১৮তম রমজান শেষ হয়ে যায়। তাফসিরবিদদের মতে, এ সময় মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) তার পবিত্র কণ্ঠে মহাগ্রন্থ আল কোরআনের ১৭ নম্বর সূরা আল ইশরা (বনি ইসরাইল) এর ৮১ নম্বর আয়াত পাঠ করেন, যেখানে বলা হয়েছে, ‘বলুন : সত্য এসেছে এবং মিথ্যা বিলুপ্ত হয়েছে। নিশ্চয় মিথ্যা বিলুপ্ত হওয়ারই ছিল।’

 

মুহাম্মদ বিন কাসেমের জন্ম : ১৯ রমজান

খ্রিস্টীয় অষ্টম শতকে যার হাত ধরে ভারত উপমহাদেশে ইসলামের প্রচার, প্রসার ও অগ্রযাত্রা শুরু হয়, তিনি হলেন তৎকালীন হেজাজ (বর্তমান সৌদি আরব এলাকায় জন্ম নেওয়া বীর সেনাপতি মুহাম্মদ বিন কাসেম। বাংলা উইকিপিডিয়াসহ বিভিন্ন গ্রন্থে তার জন্ম ৬৯৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর, যা আরবি হিসাবে ১৯ রমজান ৭৬ হিজরি। বংশগতভারে মুহাম্মদ বিন কাসেমের পরিবার সামরিক অভিজ্ঞতা ও যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শিতার জন্য বিখ্যাত ছিল। সে আমলে ইরাকের বিভিন্ন শহর জ্ঞান, বিজ্ঞান ও সামরিক বিদ্যার জন্য বিখ্যাত ছিল। এসব এলাকাতেই মুহাম্মদ বিন কাসেম বড় হন এবং একজন সামর্থ্যবান সেনানায়ক হিসাবে নিজেকে গড়ে তোলেন। সপ্তম শতকের শেষ ভাগে ইরাক এবং বর্তমান সৌদি আরবের পূর্বাঞ্চলের গভর্নর ছিলেন হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফ। আর মুসলিম বিশ্বে তখন চলছিল উমাইয়া সাম্রাজ্যের খলিফা আব্দাল মালিকের শাসন। গভর্নর হাজ্জাজের হাত ধরে তার সামরিক জীবনের শুরু। মুহাম্মদ বিন কাসেমের কাছের নিজের বোনকে বিবাহ প্রদানের মাধ্যমে হাজ্জাজ তাকে ক্ষমতার পাদপীঠে নিয়ে আসেন। প্রথমেই তাকে বর্তমান ইরাকে কুর্দিদের একটি বিদ্রোহ দমনের দায়িত্ব দেওয়া হয়, যা তিনি সফলভাবে সম্পন্ন করেন। পরবর্তীতে তিনি ফারসি নামক ওই অঞ্চলের গভর্নর নিযুক্ত হন। আশপাশের আরও কিছু এলাকায় বিদ্রোহ দমন এবং উমাইয়া আধিপত্যের বিস্তার ঘটিয়ে তিনি সবার নজর কাড়েন। ভারতবর্ষে ইসলাম প্রচার হয় দুইভাবে। প্রথমত : পৃথক পৃথক ধর্মপ্রচারকগণ তাদের ব্যক্তিগত আগ্রহ এবং একান্ত কর্তব্য মনে করে ইসলামের মর্মবাণী প্রচার করেন। দ্বিতীয় ইসলামের বার্তা নিয়ে সামরিক অভিযান পরিচালনার মাধ্যমে ইসলাম প্রচার করা হয়, যার শুরু খোলাফায়ে রাশেদিন অর্থাৎ প্রথম চার খলিফার আমল থেকে। সেই যুগে বর্তমান পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশে বসবাসরত জাট সম্প্রদায় ইসলামের প্রচার ঘটে। অষ্টম শতকে সিন্ধু অঞ্চল থেকে একদল জলদস্যুর তৎপরতা বৃদ্ধি পায়, যারা ভারত সাগর এবং আরব সাগরে চলাচলকারী বাণিজ্যিক জাহাজে লুটতরাজ চালাত। ফলে উমাইয়া শাসকগণ শাকরান, বেলুচিস্তান ও সিন্ধু প্রদেশে অভিযান পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেন।

সিদ্ধান্ত মোতাবেক সিন্ধু প্রদেশে ৭০৮ থেকে ৭১১ সালের মধ্যে অভিযান পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয় মুহাম্মদ বিন কাসেমকে। তার বয়স তখন মাত্র ১৫ থেকে ১৭ এর মধ্যে ছিল বলে ইতিহাসবিদদের মত। মুহাম্মদ বিন কাসেম মূলত ৬ হাজার সিরীয় সৈন্য নিয়ে সিন্ধু প্রদেশের দিকে যাত্রা করেন। এই সৈন্যরা ছিল মূলত অশ্বারোহী। পরবর্তীতে তার সঙ্গে দাস থেকে মুক্ত হওয়া সৈন্য এবং মারকান থেকে আসা ৬ হাজার উটে চলাচলকারী সৈন্য যোগ দেয়। সিন্ধু প্রদেশ তখন হিন্দু রাজা দাহিরের দাহিরার অধীন ছিল। তিনিও মহা শক্তিধর ছিলেন এবং এর আগে উমাইয়াদের দুটি সেনা অভিযান ব্যর্থ করে দেন। তাই পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়েই মুহাম্মদ বিন কাসেম যুদ্ধ শুরু করেন এবং একের পর এক জনপদ দখল করে ইন্দাজ রিভার বা সিন্দু নদের তীরে পৌঁছে যান। নদীর অপর তীর রাজা দাহি  তার শক্তিশালী বাহিনী নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন যোগ্য জবাব দেওয়ার জন্য। মুহাম্মদ বিন কাসেম স্থানীয় পর্যায়ের নেতা, জেলে ও মাঝি সম্প্রদায় এবং সাধারণ জনগণকে নিজের আস্থায় এনে সিন্ধু নদী অতিক্রম করেন এবং প্রবল যুদ্ধে রাজা দাহিরকে পরাজিত ও হত্যা করেন। সিন্ধু বিজয়ের ধারা অব্যাহত রাখার মাঝেই ইরাক তথা মুসলমান খেলাফতের পালাবদল হয়। মুহাম্মদ বিন কাসেমের পৃষ্ঠপোষক হাজ্জাজের মৃত্যু ঘটলে তার বিপক্ষশক্তি ক্ষমতায় আসে এবং হাজ্জাজের কাছের লোক হিসাবে মুহাম্মদ বিন কাসেমকে সামান্য অজুহাতে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে ইরাকে ডেকে পাঠান। পথিমধ্যে কারও মতে (বন্দী অবস্থায়) তার মৃত্যু ঘটে। আরেক দল গবেষকের মতে পথিমধ্যে নয়, ইরাকে পৌঁছার পর অত্যাচারের কারণে তার মৃত্যু হয়।

 

হজরত আলী (রা.) এর মৃত্যু-২১ রমজান

ইসলামের ইতিহাসে রমজানের তৃতীয় সপ্তাহ একদিকে যেমন ইমাম হাসান (রা.) এর জন্মের জন্য আনন্দের তাঁর চেয়ে অনেক বেশি বেদনার তাঁর পিতা হজরত আলী (রা.) এর করুণ মৃত্যুর জন্য। তাঁর পূর্বসূরি হজরত ওসমান (রা.) ১৭ জুন ৬৫৬ সালে নিজের ঘরে থাকা অবস্থায় তার শত্রুদের আক্রমণে করুণ হত্যাকা-ের শিকার হন। এই শত্রুরা তখন বিভিন্ন বিদ্রোহী দলে বিভক্ত ছিল। ফলে পরবর্তী খলিফা নির্বাচনে বিশেষ জটিলতা দেখা দেয়। খলিফার দায়িত্ব নেওয়ার মতো তখন হজরত আলী (রা.) ছাড়া আরও দুজন ছিলেন, যাদের নাম যথাক্রমে তালহা ও আল জুবায়ের। কিন্তু চারদিকের বিদ্রোহের দাবানল এমনভাবে ছড়িয়ে পড়ে যে, তাদের কেউ খেলাফতের দায়িত্ব নিতে রাজি ছিলেন না। পরবর্তীতে বিদ্রোহীরা একদিনের মধ্যে পরবর্তী খলিফা দায়িত্ব না নিলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ করার হুমকি দিতে থাকে। এমনি এক প্রেক্ষাপটে মসজিদ আল নববীতে এক পরামর্শ সভার মাধ্যমে হজরত আলী (রা.) এর হাতে খিলাফতের দায়িত্ব তুলে দেওয়া হয়। ১৮ জুন ৬৫৬ থেকে ২৯ জানুয়ারি ৬৬১ সাল পর্যন্ত হজরত আলী (রা.) ইসলামের চতুর্থ খলিফা হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। তার শাসনামল জুড়ে তিনি কখনো শান্তিতে খিলাফত পরিচালনা করতে পারেননি। নিজেদের মধ্যে কলহ-বিবাদ, এক বিদ্রোহী দলের বিরুদ্ধে আরেক বিদ্রোহী দলের আক্রমণ, একের বিরুদ্ধে অন্যের নালিশ, বিচার শালিস,  দুর্নীতি দমন ইত্যাদির মধ্য দিয়েই মূলত তার দিন অতিবাহিত হয়। তবুও তার শাসন পরিচালনার বিচক্ষণতা আজও সমাদৃত। বিশেষত মালিক আল আস্থারকে মিসরের প্রশাসক নিয়োগের পর প্রশাসন পরিচালনা ও জনগণের সেবা নিয়ে তিনি একটি চিঠি লিখেন, যা আজও পৃথিবীর বিভিন্ন লোকপ্রশাসন একাডেমিতে পড়ান হয়।

খলিফা থাকা অবস্থাতেই হিজরি ৪০ সালের ১৯ রমজান (ইংরেজি ২৬ জানুয়ারি ৬৬১ সাল) সকালে ইরাকের কুফা নগরে নিজের ঘরে সকালে ফজর নামাজ পড়ার সময় একটি বিদ্রোহী দলের ঘাতক সদস্য খারিজিত আব্দাল রাহমান ইবনে মুজামের বিষ মাখানো তরবারির আঘাতে মারাত্মকভাবে আহত হন হজরত আলী (রা.)। চিকিৎসকদের সব প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করে দিয়ে দুই দিন পর অর্থাৎ ২১ রমজান ৪০ হিজরিতে ইন্তেকাল করেন হজরত আলী (রা.)। শত্রুরা তাঁর কবরকে অবমাননা করতে পারে বিবেচনা করে হজরত আলী (রা.) তাঁকে গোপনে দাফন করার জন্য নিকটাত্মীয় ও বন্ধুদের নসিয়ত করেন। সেই অনুসারে গোপনেই তাঁকে সমাহিত করা হয়। বর্তমানে আফগানিস্তানের মাজার-ই-শরিফ নামক স্থানে এবং ইরাকের নাজাফ শহরে অবস্থিত দুটি মাজারই হজরত আলী (রা.) এর মাজার বলে স্থানীয়দের দাবি। উভয় স্থানেই মনোরম মসজিদ রয়েছে যেখানে প্রতিবছর ভিড় জমান শিয়া সম্প্রদায়। মুসলিম সমাজ ও দেশ-বিদেশি পর্যটকরা।

সর্বশেষ খবর