শুক্রবার, ১৫ মে, ২০২০ ০০:০০ টা

ইতিহাসের আলোকে রমজানের শেষ নয়টি দিন

মেজর নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ (অব.) পিএইচডি

ইতিহাসের আলোকে রমজানের শেষ নয়টি দিন

পবিত্র কোরআন নাজিল ও দাওয়াত শুরু

মহানবী (সা.) কোনো বাণী জিব্রাইল (আ.) থেকে প্রাপ্ত হওয়া মাত্র তা অবিকল সঙ্গী বা সাহাবিদের সামনে উচ্চারণ করতেন এবং সাহাবিরা তা মুখস্থ করে একজন অন্য অনেককে শিখাতেন।

 

পবিত্র রমজান মাসের প্রতিটি মুহূর্ত এবং প্রতিটি অংশ বিভিন্ন কারণে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ এবং বরকতময়। তবে রমজান মাসের শেষ অংশ বিশেষত শেষ অংশের বিজোড় রাতগুলো বিশেষভাবে কল্যাণকর। কারণ এমন এক পবিত্র রাতেই নাজিল হয়েছিল নানা বিচারে পৃথিবীতে বিরাজমান শ্রেষ্ঠতম গ্রন্থ মহাপবিত্র ‘আল কোরআন’। পবিত্র কোরআন শরিফেই কোরআন নাজিল সম্পর্কে ৪৪ নং ‘সূরা দুখান’-এর ৩ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন, ‘আমি (আল্লাহ) তো এ (কোরআন) অবতীর্ণ করেছি লাইলাতুল মুবারকে (সৌভাগ্যের রাতে)। আমি তো সতর্ককারী, একইভাবে ৯৭ নম্বর ‘সূরা কদর’ এর প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় আয়াতে বলা হয়েছে, (আমি আল্লাহ) এ (কোরআন) অবতীর্ণ করেছি লাইলাতুন কদরে (মহিমার রাতে)। মহিমার রাত সম্পর্কে তুমি কী জান? মহিমার রাত হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। এই সৌভাগ্যের রাত কোনটি, তা জানার জন্য মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সঙ্গী এবং সাহাবিরা উদগ্রীব ছিলেন। তাঁদের প্রশ্নের জবাব পাওয়া যায় সহি ‘বুখারি শরিফ’-এর ৩২ নম্বর খন্ডের বা অধ্যায়ের ২৩৪ নম্বর হাদিসে। যেখানে বলা হয়েছে, হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘রমজান মাসের শেষ ১০ দিনের বিজোড় রাত তো তোমরা মহিমান্বিত রাত বা লাইলাতুল কদর অনুসন্ধান কর’। এ ছাড়াও আরও অসংখ্য হাদিসে পবিত্র রমজান মাসে মহাগ্রন্থ আল কোরআন অবতীর্ণের প্রমাণ মিলে। পবিত্র কোরআনের ২ নম্বর সূরা বাকারার ১৮৫ নম্বর আয়াতে বর্ণিত ‘রমজান মাস, এতে মানুষের পথপ্রদর্শক ও সৎপথের স্পষ্ট নিদর্শন এবং ন্যায়-অন্যায়ের মীমাংসারূপে কোরআন অবতীর্ণ হয়েছিল। লাইলাতুল কদরের রাত যে পবিত্র রমজান মাসে, এর সপক্ষে রয়েছে বহু হাদিস। তাই সৌভাগ্যের রজনি এবং পবিত্র কোরআন নাজিলের রজনি হিসেবে পবিত্র রমজান মাসের শেষ ১০ দিবাগত রাত বিশেষ মর্যাদাবান।

পবিত্র কোরআনের বিভিন্ন আয়াতে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে ‘কোরআন’ শব্দ বা প্রসঙ্গ উত্থাপিত হয়েছে। পবিত্র কোরআনের দ্বিতীয় সূরা বাকারার শুরুতে কোরআনের পরিচয় এবং উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘এ সেই কিতাব, এতে কোনো সন্দেহ নেই। সাবধানিদের জন্য এ (কোরআন) পথ প্রদর্শক, যারা অদৃশ্য বিশ্বাস করে নামাজ কায়েম করে ও তাদের যে জীবিকা দান করেছি, তার থেকে ব্যয় করে, যারা তোমার [মহানবী (সা.)-এর] আগে যা (পবিত্র গ্রন্থ যাবুর, তাওরাত ও ইঞ্জিল) অবতীর্ণ হয়েছে, তাতে বিশ্বাস করে এবং যারা পরলোকে নিশ্চিত বিশ্বাসী, তারাই তাদের প্রতিপালকের (আল্লাহর) পথে রয়েছে ও তারাই সফলকাম। পবিত্র কোরআনকে মহান আল্লাহর কিতাব, শ্রেষ্ঠ কিতাব, মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর ওপর অবতীর্ণ কিতাব, পথপ্রদর্শক, আলো বা পথপ্রদর্শক, আল্লাহর আয়াত, উপদেশ বাণী, প্রভৃতি নামে উল্লেখ করেছেন। পবিত্র কোরআনের মোট ১১৪টি সূরার মধ্যে অর্ধেকের বেশি সূরায় নানা প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনের বিষয়টি উল্লেখিত রয়েছে।

উইকিপিডিয়ায় লন্ডনভিত্তিক তা হা পাবলিশার্স কর্তৃক প্রকাশিত ও ফজলুল রহমান সাইখ রচিত ‘ক্রনোলজি অব প্রফেটিক ইভেন্টস’ বইয়ের ৫০ পৃষ্ঠা উদ্ধৃত করে ৬০৯ সালের ২২ ডিসেম্বর তারিখে পবিত্র কোরআন নাজিল হয়েছিল বলে উল্লেখ করেছে। মুসলমানদের ইতিহাস ও বিশ্বাসমতে পবিত্র কোরআন নাজিল হয় মহানবী (সা.)-এর ৪০ বছর বয়সে (৬১০ সাল)। পবিত্র কোরআন নাজিলের পরে বিভিন্ন আমল বা ধর্মীয় রীতিনীতি প্রচলিত হয়, যার অন্যতম রমজান মাসে রোজা রাখা। তবে তৎকালে প্রচলিত আরবি ক্যালেন্ডারের হিসাবে রমজান মাসের শেষেই কোরআন নাজিল হয়, নবুওত লাভের আগে মহানবী (সা.) মক্কার জাবালে নূর পাহাড়ের ‘হেরা’ নামক গুহায় ধ্যান করতেন। এ সময় আরবের লোকেরা ছিল অন্ধকার যুগে বা বিভ্রান্তিতে। তারা একত্ববাদ ভুল মূর্তি পূজা এবং কুসংস্কার লালনে অভ্যস্ত ছিল। তবে মুহাম্মদ (সা.) কখনো কোনো দেব-দেবীতে বিশ্বাসী ছিলেন না। তাই তিনি মহান স্রষ্টা ও তাঁর সৃষ্টি নিয়ে ভাবতেন ও ধ্যান করতেন।

মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর ৪০ বছর বয়সে আরবি রমজান মাসে এমনিভাবে হেরা, পর্বতের গুহায় ধ্যান করার সময় মহান আল্লাহর নির্দেশে হজরত জিব্রাইল (আ.) (ফেরেস্তা) পবিত্র কোরআনের বাণী নিয়ে হাজির হন। পরবর্তীতে পবিত্র কোরআনের ৯৬ নম্বর সূরা আলাকের শুরুতে সংকলিত এই আয়াতে জিব্রাইল (আ.) মহানবী (সা.)-কে বলেন, ‘পড় তোমার প্রতিপালকের নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন’। প্রতি উত্তরে মহানবী (সা.) তাঁর নিরক্ষতার কথা প্রকাশ করলে জিব্রাইল (আ.) তাঁকে সঠিক উচ্চারণে কোরআনের বাণী উচ্চারণ শিখিয়ে দেন। জিব্রাইল (আ.)-এর কণ্ঠ থেকে শ্রুত বাণী মহানবী (সা.) উচ্চারণ করেন এবং এভাবেই রমজান মাসে পবিত্র কোরআন নাজিল শুরু হয়, যা পরবর্তী ২৩ বছর অর্থাৎ মহানবী (সা.)-এর জীবনের শেষ বছর পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। মহানবী (সা.) যেহেতু নিজে লিখতে পারতেন না বা পড়তে পারতেন না, সেহেতু এই বাণী বা গ্রন্থ যে ঐশ্বরিক, তা নিয়ে সন্দেহ নেই। তা ছাড়া সেই যুগে কোরআনে উল্লেখিত মহাকাশ বিজ্ঞান, মানবদেহ, সৃষ্টির রহস্য ও দর্শন নিয়ে যা বর্ণিত হয়েছে তাও কারও জানা ছিল না। তাই পবিত্র কোরআনকে বলা হয় সব জ্ঞানের আধার এবং পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান।

মহানবী (সা.) কোনো বাণী জিব্রাইল (আ.) থেকে প্রাপ্ত হওয়া মাত্র তা অবিকল সঙ্গী বা সাহাবিদের সামনে উচ্চারণ করতেন এবং সাহাবিরা তা মুখস্থ করে একজন অন্য অনেককে শিখাতেন। এভাবে মানুষের হৃদয়ে বা কলবে কোরআন স্থায়ী হয়ে যায় আর যারা সম্পূর্ণ কোরআন মুখস্থ করতে পারেন, তারা হাফেজ বলে গণ্য হন। হাজেফ হওয়ার এই ধারা আজো বলবৎ আছে। হাদিস ও ইতিহাস মতে মহানবী (সা.)-এর জীবদ্দশায় রমজান মাসে জিব্রাইল (আ.) আল্লাহর নির্দেশে মহানবী (সা.)-কে কোরআন শুনিয়ে পুনরায় পাঠ রিভিশন করাতেন, পবিত্র কোরআন গ্রন্থ, যা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মুখস্থ করা সম্ভব, যেটা এক কুদরাত। একজন দুজন নয়, লাখো মুসলমানের স্মরণশক্তি বা কলবে পবিত্র কোরআন গাঁথা থাকে, ফলে এই গ্রন্থ কখনো বিকৃত করা সম্ভব নয়।

পবিত্র রমজান মাসে মহাগ্রন্থ আল কোরআন নাজিলের পরপরই হজরত মুহাম্মদ (সা.) একজন নবী এবং আল্লাহর রসুল হিসেবে প্রকাশ্যে আসেন এবং মহান আল্লাহর এবাদত জিব্রাইল (আ.) কর্তৃক শিখানো পদ্ধতিতে পালন শুরু করেন, যা অন্যরা অনুসরণ করেন। বিভ্রান্ত ও বিপথগামী আরব সমাজকে সরল ও সঠিক পথে আনার যে কঠিন সংগ্রাম মহানবী (সা.) তাঁর জীবনে করেছেন, তার শুরুটা ছিল কোরআন নাজিল অর্থাৎ রমজান মাস থেকে। রমজান মাসে মহানবী (সা.) বেশি করে পবিত্র কোরআন আবৃত্তি করতেন (পড়তেন) এবং অন্যদের পড়তে বলতেন। তাই পবিত্র রমজান এবং পবিত্র কোরআন এক দৃঢ় ও পবিত্র বন্ধনের মূর্ত প্রতীক।

প্রথম দিকে পবিত্র কোরআন কেবল মানুষের মুখে মুখে বা কলবে ধারণ করা হয়েছিল। পরবর্তীতে বিশেষত বদরের যুদ্ধের পর বন্দী অমুসলমানদের মধ্যে যারা শিক্ষিত ছিল তাদের মাধ্যমে শিক্ষা বিস্তারের পর কোরআনের বাণী পাথর, চামড়া, গাছের কা- বা ছাল, শুকনা পাতা কাপড় ইত্যাদিতে লেখা হয়। ৬৩২ সালে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মৃত্যুর পর ইসলামের ছদ্মবেশী শত্রু এবং বিপথগামীরা কোনো কোনো ক্ষেত্রে কোরআনের বাণী নিজেদের স্বার্থে পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও সংকোচনের প্রচেষ্টা চালায়। ফলে পবিত্র কোরআনের অবিকৃত রূপ সংরক্ষণ জরুরি হয়ে পড়ে। ইসলামের প্রথম তিন খলিফা হজরত আবু বকর (রা.), হজরত ওমর (রা.) এবং হজরত ওসমান (রা.)-এর আমলে পর্যায় ক্রমে বিভিন্ন স্থানে লেখা কোরআনের বাণী সংকলন এবং বিভিন্ন হাফেজের মাধ্যমে তা বারবার যাচাই-বাছাই করার প্রক্রিয়া চলে। এর মধ্যে হজরত আবু বকর (রা.)-এর শাসনামলে বর্তমান সৌদি আরবের আল ইয়ামামা নামক স্থানে হজরত আবু বকর (রা.)-এর সেনাবাহিনী এবং স্বঘোষিত নবী মুসাইলিমা আল খাদ্ধাবের সৈন্যদের মধ্যে ৬৩২ সালের ডিসেম্বরে যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে আবু বকর (রা.)-এর সৈন্যরা বিজয়ী হলেও শাহাদাৎ বরণ করেন প্রায় ১২ হাজার মুসলমান। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক যোদ্ধা ছিলেন আংশিক বা পরিপূর্ণরূপে কোরআনে হাফেজ।

ফলে লিখিত আকারে কোরআন সংরক্ষণের প্রয়োজন আলোচনায় আসে। এরপরই শুরু হয় কোরআন সংকলনের মহাযজ্ঞ। এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর একান্ত লিপিকার ও পত্র লেখক জায়িদ ইবনে থাবিট, তিনি এক পর্যায়ে মহানবী (সা.)-এর কণ্ঠে উচ্চারিত কোরআনের বাণী লিখে রাখতেন, তাঁর নেতৃত্বে অপরাপর লেখকদের লেখা কোরআনের বাণী, চামড়া, গাছের শুকনা পাতা, কাপড়, পাথর ও কাঠে লেখা বা খোদাইকৃত বাণী সব কিছু একটি পা-ুলিপিতে হাতে লিখা হয় এবং হজরত আবু বকর (রা.)-এর কাছে তা সংরক্ষিত থাকে। হজরত আবু বকর (রা.)-এর মৃত্যুর পর পর্যায়ক্রমে হজরত ওমর (রা.) এবং মহানবী (সা.)-এর স্ত্রী মা হাফসা বিনতে ওমর [হজরত ওমর (রা.)-এর কন্যা]-এর জিম্মায় রাখা হয়। ওমর (রা.)-এর মৃত্যুর পর হজরত ওসমান (রা.)-এর সময়ে ইসলাম পৃথিবীর নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় কোনো কোনো স্থানে কোরআন বিকৃতি বা ভুল উচ্চারণের অভিযোগ ওঠে। তাৎক্ষণিকভাবে খলিফা হজরত ওসমান (রা.) আবারও হজরত জায়িদ ইবনে থাবিটের স্মরণাপন্ন হন এবং তাঁর নেতৃত্বে একটি কমিটিকে আগে লিপিবদ্ধ পান্ডুলিপিকে ভিত্তি করে পবিত্র কোরআনের চূড়ান্ত পান্ডুলিপি তৈরির দায়িত্ব দেন।

এই কমিটি বহু ধরনের যাচাই-বাছাই শেষে পবিত্র কোরআনের পান্ডুলিপি চূড়ান্ত করে, যা আজ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম গ্রন্থ বলে স্বীকৃত। তুরস্কের দৈনিক পত্রিকা দ্য ডেইলি সাবাহ ২০১৭ সালের ২ জুলাই তারিখে একরাম বুগড়া একিঞ্চির লেখা একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনের তথ্য মতে, এই চূড়ান্ত পান্ডুলিপিতে সংকলিত ১১৪টি সূরা, ৬২৩৬টি আয়াত ও ৩২৩০০০টি অক্ষর নির্ভুলভাবে পশুর চামড়ায় লিখেছেন সুন্দর হাতের লেখার অধিকারী সাঈদ ইবনে আল আস। এই পান্ডুলিপি চূড়ান্ত করার আগে পর্যায়ক্রমে ৩৩০০০ সাহাবি ও কোরআনে হাফেজকে পড়ে শোনানো হয় এবং তাদের সবাই সংকলনের প্রতিটি অক্ষর নির্ভুল বলে সাক্ষ্য দেন। এরপর প্রাথমিকভাবে কোরআনের সাতটি কপি করা হয় এবং এগুলো রেখে বিদ্যমান সব কোরআন বা আংশিক বাণী অথবা সূরা যা কিছু ছিল, সব ধ্বংস করা হয়। এই সাতটি কপি বাহরাইন, দামেস্ক, বশরা, কুফা, ইয়েমেন এবং মক্কায় রাখা হয়। অন্যদিকে মিসর এবং জাজিরায় দুটি কপি পাঠানো হয় বলে দাবি করা হয়। পরবর্তীতে মূল কপির সবগুলোর সন্ধান পাওয়া যায়নি। তবে তুরস্কের টপকাপি রাজপ্রাসাদ অ্যান্ড মিউজিয়াম অব ইসলামিক আর্ট (ইস্তাম্বুল)-এ পবিত্র কোরআনের দুটি মূলকপি সংরক্ষিত আছে। অন্যদিকে মিসরে থাকা মূলকপি অটোমান সম্রাট দ্বিতীয় সেলিমকে তুরস্ক বিজয়ের পর উপহার দেওয়া হয় যা একই রাজপ্রাসাদে আনা হয়েছিল। এ ছাড়াও পবিত্র কোরআনের প্রাচীন কিছু কপি বর্তমানে কায়রোর (মিসর) আল-হোসেন মসজিদে, প্যারিসের (ফ্রান্স) জাতীয় লাইব্রেরি, লন্ডনের ব্রিটিশ লাইব্রেরি, তাসখন্দের হাস্ট ইমাম লাইব্রেরি এবং অন্যান্য কিছু জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে।

বাংলাদেশেও হাতে লেখা ও তালপাতায় লেখা কোরআন শরিফ আছে। তবে সুখের বিষয় পৃথিবীতে বিরাজমান সব কোরআন শরিফের অক্ষরে অক্ষরে মিল রয়েছে। দুই একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া পবিত্র কোরআন বিকৃতির তেমন কোনো বড় ঘটনা ঘটেনি। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনের ১৫ নম্বর সূরা হিজরের ৯ নম্বর আয়াতে স্বয়ং আল্লাহ এই পবিত্র গ্রন্থের রক্ষণের প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করে বলেন, ‘নিশ্চয় আমি (আল্লাহ) এই উপদেশ বাণী (কোরআন) অবতীর্ণ করেছি আর আমিই এর রক্ষণাবেক্ষণ করব।’ বর্তমান যুগে অগ্নিকান্ডে সব কিছু পুড়লেও কোরআন অক্ষত থাকার এমনকি কোরআনের পৃষ্ঠার চারপাশের সাদা অংশ পুড়লেও অক্ষরগুলো অক্ষত থাকার অলৌকিক ঘটনা ঘটছে। রমজান মাসের শেষ দশ দিনের রোজার রাতে পবিত্র কোরআন নাজিলের পরপরই মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর দাওয়াত কার্যক্রম নতুন মাত্রা লাভ করে। জাবালে নূরের হেরা পর্বতের গুহায় ফেরেস্তা জিব্রাইল (আ.) এর মাধ্যমে পবিত্র কোরআনের প্রথম বাণী লাভের ঘটনায় মহানবী (সা.) অত্যন্ত ভীত হয়ে পড়েন এবং তাঁর শরীরে কাঁপনসহ জ্বর আসে।

এ সময় তিনি ঘরে ফিরলে তাঁর স্ত্রী মা খাদিজা (রা.) সব কিছু শুনে বিনাবাক্যে তাঁর কথা বিশ্বাস করেন, ইসলাম গ্রহণ করেন এবং মহানবী (সা.) কে আল্লাহর প্রেরিত রাসুল হিসাবে স্বীকার করেন। মা খাদিজা (রা.) অকৃত্রিম সেবা, সমর্থন ও অনুপ্রেরণায় এগিয়ে চলে মহানবী (সা.) এর দিনের পথে দাওয়াতের কাজ। তাই একদল গবেষকের দাবি রমজানের শেষ ভাগেই ইসলামের দাওয়াত পর্ব শুরু করেন মহানবী (সা.) এবং তাঁর আমলে প্রথম ইসলাম ধর্ম গ্রহণের ঘটনা মা খাদিজা (রা.) এর মাধ্যমে এই রমজানেই শুরু হয়।

ইবনে মাজাহর মৃত্যু ২২ রমজান

হিজরি তৃতীয় শতক তথা ইংরেজি নবম শতকে একজন হাদিস সংগ্রহ ও সংকলনকারী হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করেন ইমাম আবু আবদুল্লাহ মোহাম্মদ ইবনে ইয়াজিদ ইবনে মাজাহ আল রাবি আল কাযবিনি। সংক্ষেপে তিনি ইবনে মাজাহ নামে অধিক পরিচিত। ৮২৪ সালে অর্থাৎ হিজরি ২০৯ সালে বর্তমান ইরানের কাযবিন অঞ্চলে জন্মলাভ করায় তার নামের শেষ কাযবিনি যুক্ত হয়েছে। আর মাজাহ তার দাদা ও বাবার পারিবারিক নামের অংশ বলে অনেকে ধারণা করলেও একদল গবেষকের দাবি, ‘মাজাহ’ ছিল তার মায়ের নাম।

বাল্যকালে নিজ জন্মস্থানেই তিনি প্রাথমিক শিক্ষাপর্ব সমাপ্ত করেন। বাল্যশিক্ষার পাশাপাশি তিনি পবিত্র কোরআন মুখস্থ করে একজন হাফেজ হিসেবে পরিচিতি পান। এরপর শুরু হয় তার হাদিসের সন্ধানে পথচলা ও চিরন্তন সাধনা। বিভিন্ন গ্রন্থ এবং উইকিপিডিয়া মতে তিনি ২২ বছর বয়সে হাদিসের সন্ধানে বিভিন্ন দেশ এবং শহর ভ্রমণ করেন। মক্কা-মদিনার পাশাপাশি এ সময় তিনি বশরা, কুফা, বাগদাদ, সিরিয়া, জর্ডান, প্যালেস্টাইন, ইসরায়েল ও তুরস্ক অঞ্চল ভ্রমণ করেন বলে একাধিক ইসলামী গবেষক মত দিয়েছেন। এ সময় তিনি সে কালের জগৎ সেরা হাদিস বর্ণনাকারী ও ইসলামী আলেমদের সাক্ষাৎ লাভ করেন এবং সবার সহযোগিতায় বিশুদ্ধ হাদিসের এক বিশাল সংগ্রহ গড়ে তোলেন। এরপর দীর্ঘ ১৫ বছর তিনি ইসলামী বিষয় নিয়ে গবেষণা ও ধ্যান করেন। দীর্ঘ গবেষণা এবং ধ্যানের মধ্য দিয়ে তিনি প্রায় চার হাজার বিশুদ্ধ হাদিস সংগ্রহ করেন। এবং একের পর এক গ্রন্থে তা লিপিবদ্ধ করেন। ‘সুনান ইবনে মাজাহ হাদিসের ওপর তাঁর রচিত শ্রেষ্ঠতম গ্রন্থ। গ্রন্থের ছয়টি খন্ডে ১৫০০ অধ্যয় রয়েছে, যেখানে ঠাঁই পেয়েছে চার হাজার হাদিস। এই হাদিস গ্রন্থের বিশুদ্ধতা যাচাইয়ের জন্য তিনি তৎকালীন হাদিস বিশারদ আবু জুরাহর কাছে যান এবং একে একে সব হাদিস তাকে পড়ে শোনান। প্রতি উত্তরে পন্ডিত আবু জুরাহ বলেন, এই হাদিস গ্রন্থ মানুষের কাছে পৌঁছানো উচিত। এই গ্রন্থ মানুষের কাছে পৌঁছলে অন্যান্য সূত্রের পাওয়া হাদিস গ্রন্থ বা তাদের বেশির ভাগ পরিত্যাজ্য বা বাতিল হয়ে যাবে। সুনান ইবনে মাজাহ বইটি পৃথিবীর বহু ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে। বাংলাদেশের ইসলামিক ফাউন্ডেশন এই বইটি বাংলা ভাষায় প্রকাশ করেছে। ইবনে মাজাহ আরও কিছু বই রচনা করেছেন। এর মধ্যে ‘কিতাব আত তাফসির’ বইটিতে পবিত্র কোরআনের বিশদ তাফসির রয়েছে। আর সাহাবিদের আমল থেকে তার আমল পর্যন্ত সময়ের ইসলামের ইতিহাস উঠে এসেছে তার ‘কিতাব আত তারেখ’ বইটিতে।

ইবনে মাজাহ একদিকে যেমন সেকালের সেরা ইসলামী চিন্তাবিদদের সান্নিধ্য পেয়েছিলেন, ঠিক তেমনি তাঁর কাছে দীক্ষা নিয়ে জগৎসেরা হয়েছেন তাঁর অগণিত শিষ্য ও ভক্ত। সবাইকে শোক সাগরে ভাসিয়ে হিজরি ২৭৩ মতান্তরে ৭২৪ সালের ২২ রমজান ইবনে মাজাহ পরলোক গমন করেন। মৃত্যুর সন নিয়ে মতভেদ থাকলেও একাধিক গ্রন্থে তিনি পবিত্র রমজান মাস শেষ হওয়ার আট দিন আগে মৃত্যুবরণ করেন বলে উল্লেখিত। তবে ইংরেজি তারিখ হিসাবে তাঁর মৃত্যুর তারিখ ভিন্নতা পাওয়া যায়। মৃত্যুর পর মোহাম্মদ ইবনে আলী কেহেরমান এবং ইব্রাহিম ইবনে দিনার তাঁকে গোসল করান। স্বীয় ভাই আবু বক্করের ইমামতিতে জানাজা শেষে দুই ভাই আবু বকর এবং আবু আবদুল্লাহ এবং পুত্র আবদুল্লাহ ইবনে মুহাম্মদ ইবনে ইয়াজিদ তাঁকে কবরে নামান। এরপর তাঁকে যথা নিয়মে কবরস্থ করা হয়।

 

 

রোজা শেষে পরলোক যাত্রা করেন ইমাম বুখারি (রহ.)

ইমাম আবু আবদুল্লাহ মোহাম্মদ ইবনে ইসমাইল ইবনে ইব্রাহিম ইবনে আল মুঘিরাহ ইবনে বারডিজবাহ আল জুফি আল বুখারি,  সংক্ষেপে আল বুখারি (রহ.)। হাদিস সংগ্রহের ক্ষেত্রে অসাধারণ অবদানের জন্য তাকে ‘আমিরুল মুমিনিন ফিল হাদিস’ অর্থাৎ হাদিস বর্ণনায় মুমিনদের নেতা উপাধি দেওয়া হয়।

 

সুন্নি মতবাদে বিশ্বাসী মুসলমানদের কাছে হাদিসের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি গ্রহণ যোগ্যতা পেয়েছে ‘সহি আল বুখারি’ নামক হাদিসগ্রন্থ। এই গ্রন্থে বর্ণিত হাদিসগুলো সংগ্রহ করেছেন ইমাম আবু আবদুল্লাহ মোহাম্মদ ইবনে ইসমাইল ইবনে ইব্রাহিম ইবনে আল মুঘিরাহ ইবনে বারডিজবাহ আল জুফি আল বুখারি, সংক্ষেপে আল বুখারি (রহ.)। হাদিস সংগ্রহের ক্ষেত্রে অসাধারণ অবদানের জন্য তাকে ‘আমিরুল মুমিনিন ফিল হাদিস’ অর্থাৎ হাদিস বর্ণনায় মুমিনদের নেতা উপাধি দেওয়া হয়। ৮১০ সালের ২১ জুলাই বর্তমান উজবেকিস্তানের বুখারা অঞ্চলের রাজধানী বুখারা শহরে তার জন্ম। বাবা ইসমাইল ইবনে ইব্রাহিমও ছিলেন একজন হাদিস সংগ্রহকারী এবং ইমাম মালিক ইবনে আনাস (রহ.) এর শিষ্য। ইতিহাসবিদ আধ ধাহারির মতে, মাত্র ১১ বছর বয়সেই তিনি অসংখ্য হাদিস মুখস্থ করেন এবং প্রখর ইসলামী জ্ঞান লাভ করেন। বাল্যকালে বাবাকে হারিয়ে মায়ের কাছে বেড়ে ওঠা ইমাম বুখারি (রহ.) ১৬ বছর বয়সে সপরিবারে মক্কায় চলে আসেন। মক্কা থেকে হজ পালন শেষে শুরু হয় তার জ্ঞানের সন্ধান তথা বিশুদ্ধ হাসিদের সন্ধানে পথ চলা, তৎকালে ইসলামিক জ্ঞানের তীর্থভূমি নামে পরিচিত বহু স্থানে তিনি সশরীরে উপস্থিত থেকে ইসলামী জ্ঞান এবং সঠিক হাদিসে নিজেকে সমৃদ্ধ করেন। কথিত আছে এ সময় তিনি এক হাজার ইমাম ও ইসলামী চিন্তাবিদের কাছ থেকে প্রায় ৬ লাখ ইসলামী রীতিনীতি, ফতোয়া আইন এবং হাদিসের সন্ধান লাভ করেন। পাশাপাশি পবিত্র কোরআনের তফসিল বিষয়েও নিজের জ্ঞানকে সমৃদ্ধ করেন। অন্য এক বর্ণনায় জানা যায়, ১৮ বছর বয়সে হজ শেষে তার মা ও ভাই বুখারায় ফেরত গেলেও ইমাম বুখারি (রহ.) ২ বছর মক্কায় এবং ৪ বছর মদিনায় অবস্থান করে ইসলামের জ্ঞানে নিজেকে সমৃদ্ধ করেন। মহান আল্লাহ প্রদত্ত অসাধারণ স্মৃতিশক্তির অধিকারী ছিলেন ইমাম বুখারি (রহ.)। ফলে তিনি সংগৃহীত জ্ঞান বা হাদিস কোথাও না লিখলেও, তা অধিককাল তার স্মৃতিতে গেঁথে থাকত। কথিত আছে, প্রথম দিকে তিনি প্রায় ৭০ হাজার হাদিস মুখস্থ করেন এবং পরবর্তী জীবনে তার মুখস্থকৃত হাদিসের সংখ্যা ৩ লাখ পৌঁছে। ইরাকের রাজধানী বাগদাদে ইমাম বুখারি (রহ.) কে পরীক্ষার জন্য স্থানীয়দের মধ্যে ১০ জন ১০০টি হাদিস সামান্য পরিবর্তন করে তার সামনে পাঠ করেন এবং তার মতামত জানতে চান। তিনি প্রথমে সবাইকে আমার জানা নেই বলে উত্তর দেন। একটু পরেই তিনি সবাইকে তাদের পঠিত ভুল পরিবর্তিত বা বিকৃত হাদিস শুনিয়ে দেন এবং তার বিপরীতে সঠিক ও বিশুদ্ধ ১০০টি হাদিস একই হাদিসের শুদ্ধরূপ বর্ণনা করেন।

পৈতৃক সম্পদের সব কিছুই তিনি দান করে দিয়ে অতি সাধারণ এক জীবন বেছে নেন। শেষ জীবনে এমনও সময় আসে যে তিনি সারা দিনে মাত্র ২টি বা ১টি পেস্তা বাদাম খেয়ে জীবনযাপন করতেন। ইমাম বুখারি (রহ.) নিজেই বর্ণনা করেন যে তিনি জ্ঞান ও হাদিসের সন্ধানে ১০৮০ জন শিক্ষকের দ্বারস্থ হন, যার অন্যতম ইমাম আহাম্মদ বিন হানবাল (রহ.)। তার ছিল অগণিত ভক্ত, শিষ্য এবং নিবেদিত ছাত্র। তবে ধারণা করা হয় যে এই সংখ্যা ৯০ হাজার ছাড়িয়ে যায়, যার অন্যতম অপর তিনজন প্রখ্যাত হাদিস সংগ্রহকারী ঈমাম মুসলিম (রহ.), ইমাম তিরমিজি (রহ.) এবং ইমাম নিসাই (রহ.) তার সংগৃহীত হাদিসের বিশুদ্ধতা নিয়ে বিতর্কের অবকাশ নেই। তিনি প্রথমেই হাদিস বর্ণনাকারীর জীবন, আচরণ ও গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে গবেষণা করতেন এবং পরবর্তীতে তার কাছে থেকে প্রাপ্ত হাদিস সংগ্রহ বা তার গ্রন্থে স্থান দেওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতেন। সংগৃহীত প্রতিটি হাদিস তিনি মক্কা বা মদিনায় বসে লিখতেন এবং প্রতিবার লেখার আগে নফর নামাজ আদায় করে হাদিসের বিশুদ্ধতার জন্য মহান আল্লাহর সাহায্য কামনা করতেন। এভাবে ১৬ বছরে তিনি ৬টিরও বেশি হাদিসের বই রচনা করেন যার অন্যতম  ‘সহি আল বুখারি’ বা ‘বুখারি শরিফ’। অসংখ্য হাদিস জানা এবং মুখস্থ থাকলেও তার সম্পাদিত বইয়ে ৭২৫২টি হাদিস স্থান দিয়েছেন, যা বিশুদ্ধতার নিরিখে অতুলনীয়। শেষ জীবনে তিনি নিজে জন্মভূমি বোখারায় ফেরত আসেন এবং একটি মাদ্রাসা স্থাপন করেন। তৎকালীন স্থানীয় শাসক তার সন্তানকে এই মাদ্রাসায় পৃথকভাবে পড়ানোর প্রস্তাব দিলে তিনি প্রত্যাখ্যান করেন, ফলে বোখারা ছেড়ে তাকে আশ্রয় নিতে হয় ৩০ মাইল দূরের নিভৃত এক গ্রামে। এই গ্রামেই ৬২ (মতান্তরে ৭০) বছর বয়সে অর্থাৎ ৮৭০ সালের ৩১ আগস্ট রাতে অর্থাৎ হিজরি ২৫৬ সালের সব কটি রোজা শেষে পরলোকগমন করেন ইমাম বুখারি (রহ.)। সমরখন্দের খারতাংক গ্রামে তাকে দাফন করা হয়। দীর্ঘদিন অবহেলিত থাকলেও ১৯৯৮ সালে সমরখন্দে তার সম্মানে স্মৃতিসৌধ, মসজিদ, মাদ্রাসা, পাঠাগার এবং সংগ্রহশালা গড়ে তোলা হয়।

 

মোঙ্গলদের পতন-২৫ রমজান

বর্তমান ইসরায়েলের অন্যতম শহর জেরুজালেমের উত্তরে পাহাড় ও উপত্যকা বেষ্টিত এলাকা জাজরিল। এই উপত্যকায় দুটি কৃষি নির্ভর গ্রাম গড়ে উঠেছিল মাঝখানের একটি ঝরনাকে কেন্দ্র করে, যা আরবিতে ‘আইন জালুত’ নামে পরিচিত ছিল। এই এলাকাতে ইংরেজি ১২৬০ সালের ৩ সেপ্টেম্বর তথা ৬৫৮ হিজরির ২৫ রমজান তারিখে মুসলমান ও তাদের সমর্থক অমুসলমান সম্প্রদায় এবং মোঙ্গলদের মধ্যে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়, যা ইতিহাসে আইন জালুতের যুদ্ধ নামে পরিচিত। ত্রয়োদশ শতকে মোঙ্গলদের দুর্ধর্ষ সেনাপতি চেঙ্গিস খান সমগ্র বিশ্ব জয়ের উন্মত্ত নেশায় মেতে ওঠেন।

১২২৭ সালে এই রক্ত পিপাসুর মৃত্যু ঘটে। এরপর প্রায় ১৫০ বছর তারই বংশধররা মোঙ্গলদের শাসন করে এবং একের পর এক দেশ বা রাজ্য দখল করতে থাকে। একই ধারাবাহিকতায় ১২৫১ সালে মোঙ্গল সম্রাট মংকি খান ও তার ভাই আরেক দুর্ধর্ষ মোঙ্গল রণবীর হালাকু খানকে সঙ্গে নিয়ে তাদের দাদা চেঙ্গিস খানের বিশ্ব জয়ের স্বপ্ন বাস্তবায়নে মাঠে নামেন। পাঁচ বছরের প্রস্তুতি শেষে হালাকু খান বিশ্ব জয়ের যুদ্ধে নামেন। তার নীতি ছিল প্রথমেই কোনো দেশ বা রাজ্যকে বশ্যতা স্বীকারের প্রস্তাব দেওয়া এবং প্রস্তাব না মানলে তাকে নির্দয়ভাবে খুন করে সমগ্র দেশ বা রাজ্য তছনছ করা। তার নিষ্ঠুরতা এমনই ভয়াবহ ছিল যে, তার ভয়েই অনেকে বশ্যতা স্বীকার করত এবং তার সেনাদলে সৈন্য বাড়াতে বাধ্য হতো। ১২৫৮ সালে বাগদাদ ধ্বংস ও আব্বাশীয় সাম্রাজ্যের পতন ঘটিয়ে তিনি ইতিহাস কাঁপিয়ে দেন। এরপর জয় করেন সিরিয়া এবং নজর দেন মিসরের দিকে। কিন্তু মিসরের সম্রাট কুতুজ ও তার মিত্ররা তার বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। প্রথা মোতাবেক আত্মসমর্পণের বার্তা নিয়ে আসা মোঙ্গল বার্তা বাহককে সম্রাটের আদেশে হত্যা করে তার খ-িত মাথা মিসরের প্রবেশ দ্বারে ঝুলিয়ে রাখা হয়। ঠিক এ সময় হালাকু খানের ভাই ও মঙ্গল সম্রাট মংকি খানের মৃত্যু ঘটে। নতুন সম্রাট হওয়ার আশায় সব মোঙ্গল নেতা তখন মোঙ্গলিয়া পাড়ি জমায়। একই পথ অনুসরণ করেন হালাকু খান এবং সঙ্গে নিয়ে যান সৈন্যদের বিরুদ্ধে মিসরের সম্রাট কুতুজের নেতৃত্বে আশপাশের সব মুসলমান দেশ ও গোষ্ঠী এক হয় এবং সিরিয়ার জাজরিলের আইন জুলুত নামক গ্রামে উভয় পক্ষের মধ্যে ভয়াবহ যুদ্ধ হয়। হিজরি ৬৫৮ সালের ২৫ রমজান ১০ হাজার সৈন্যসহ মোঙ্গল নেতা কিবুক প্রাণ হারালে মোঙ্গলদের পতন ও মুসলমানদের বিজয় ঘটে।

 

আরও কিছু ঘটনা

হিজরি ৯২ সালের ২৫ রমজান (মতান্তরে ২৮ রমজান) বীর মুসলিম সেনাপতি তারিখ বিন জিয়াদের নেতৃত্বে তৎকালীন হিসপেন (বর্তমান স্পেন) এর মাটিতে মুসলমানদের বিজয় কেতন ওড়ে। তানজিয়ার্স থেকে তারিক সমুদ্র পাড়ি দিয়ে স্পেনের উপকূলে পৌঁছেন এবং বিজয় বা মৃত্যুর সিদ্ধান্ত নিয়ে সব নৌকা পুড়িয়ে দেন। পরবর্তীতে গুয়াজ লেটের যুদ্ধে স্পেনের তৎকালীন সম্রাট রোডরিক মুসলমানদের হাতে প্রাণ হারান এবং স্পেনে মুসলমানদের বিজয় ও ইসলাম প্রচার নতুনভাবে সূচিত হয়। ইসলামের ইতিহাসের অন্যতম জ্ঞানী হিসাবে স্বীকৃত এবং জ্ঞান-বিজ্ঞান, ইতিহাস, দর্শন, শিল্প-সাহিত্য, রাজনীতি, সমাজ বিজ্ঞান লোকপ্রশাসন, অর্থনীতিসহ বহুবিধ জ্ঞানে সমৃদ্ধ পন্ডিত আবু জাইয়াদ আবদুর রহমান ইবনে মুহাম্মদ ইবনে খালদুন আল হাদরামি (সংক্ষেপে ইবনে খালদুন) হিজরি ৮০৮ সালের ২৬ রমজান মৃত্যুবরণ করেন। ১ রমজান ৭৩২ হিজরিতে তার জন্ম বিধায় তাকে বিরল ভাগ্যবান বলে গণ্য করা হয়।

সর্বশেষ খবর