শুক্রবার, ২২ মে, ২০২০ ০০:০০ টা

জুমাতুল বিদা ও আল কুদস দিবস

মেজর নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ (অব.) পিএইচডি

জুমাতুল বিদা ও আল কুদস দিবস

ইতিহাসের পাতা থেকে জুমার দিন

আজ শুক্রবার, ২৮ রমজান ১৪৪১ হিজরি। পৃথিবীময় সব মসজিদে পবিত্র জুমার নামাজের আগে খুতবায় আজ উচ্চারিত হবে ‘আল বিদা’ ধ্বনি। তাই আজকে জুমার আরেক নাম ‘জুমাতুল বিদা’ বা বিদায়ী জুমা। যদিও পরবর্তী সপ্তাহে আবারও শুক্রবার আসবে এবং জুমার নামাজ আদায় হবে, তবুও ‘বিদা’ বা বিদায় কথাটির মূলে রয়েছে আমাদের মাঝ থেকে বিদায় নেবে পবিত্র ও বরকতময় মাস মাহে রমজান। এই মাসটিকে বিভিন্ন যৌক্তিক কারণে বছরের ১২টি মাসের মধ্যে শ্রেষ্ঠ মাস বিবেচনা করা হয়। আর কোরআন ও হাদিসের আলোকে ‘জুমা’ বা শুক্রবার হলো সপ্তাহের শ্রেষ্ঠতম দিন। ফলে শ্রেষ্ঠ মাসে শেষবারের মতো উপস্থিত হলো শ্রেষ্ঠ দিন। অনেকের জীবনে হয়তো এমন দুটি শ্রেষ্ঠ মুহূর্তের মিলন এই শেষ। তাই এক ভাবগাম্ভীর্যের পরিবেশে মসজিদের মিম্বরে দাঁড়িয়ে ইমাম সাহেবের দরাজ কণ্ঠে উচ্চারিত হবে ‘আলবিদা’ বা বিদায় শব্দটি।

পৃথিবীর সব ভাষা এবং ধর্মে সপ্তাহের সাত দিনের পৃথক সাতটি নাম রয়েছে। এসব নামের নেপথ্যে কখনো গ্রহ নক্ষত্র আবার কখনো কোনো বিশেষ কর্ম, পরিবেশ বা ঘটনার সংযোগ খুঁজে পাওয়া যায়। এরই ধারাবাহিকতায় আরবিতে একটি দিনের নাম নির্ধারিত হয় ‘জুমা’ বা ‘জুমাহ’ হিসেবে। বাংলা, উর্দু, হিন্দিসহ বেশকিছু ভাষায় জুমা একটি পরিচিত শব্দ এবং মূলত বিশেষ পবিত্র দিন হিসেবে বিবেচিত। ‘জুমা’ শব্দটির আরেক পরিচিতি দিনের মধ্যভাগে জোহর নামাজের পরিবর্তে মসজিদে সম্মিলিতভাবে বা জামাতে আদায়যোগ্য বিশেষ নামাজ হিসেবে। এ ছাড়াও পবিত্র কোরআনের ৬২ নং সূরাটির নাম ‘জুমা’ হওয়ায় সপ্তাহের এই দিনটি বিশেষ মর্যাদাবান। এই  সূরার ৯ ও  ১০ নং আয়াতে বলা হয়েছে, ‘হে বিশ্বাসীগণ, জুমার দিনে যখন নামাজের দিকে ডাকা হয়, তখন তোমরা আল্লাহকে মনে রেখে তাড়াতাড়ি করবে ও কেনাবেচা বন্ধ করবে। এটাই তোমাদের জন্য উত্তম, যদি তোমরা বোঝ। নামাজ শেষ হলে তোমরা বাইরে ছড়িয়ে পড়বে ও আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধান করবে এবং আল্লাহকে বেশি করে ডাকবে, যাতে তোমরা সফলকাম হও।’ পবিত্র মদিনায় ১১ আয়াতের এই সূরা হজরত আবু হুরাইরার উপস্থিতিতে নাজিল হয় বলে বোখারি ও মুসলিম শরিফের হাদিসে উল্লিখিত।

মুসলমানদের মধ্যে অসুস্থ বা কেনা গোলাম ছাড়া সাবালক সব পুরুষের জন্য নির্দিষ্ট মসজিদে উপস্থিত হয়ে ইমামের বক্তব্য (খুতবা) শোনা এবং জামাতে নামাজ আদায়ের বিধান রয়েছে। এই জামাতবদ্ধ হওয়া বা একত্রিত হওয়াকে আরবিতে ‘জামাহ’ বা ‘ইজতেমা’ শব্দ দ্বারা প্রকাশ করা হয়। ফলে জামাহ বা ইজতেমা থেকেই জুমাহ শব্দটি এবং জুমার নামাজ কথাটি এসেছে বলে উইকিপিডিয়াসহ বিভিন্ন গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে জুমার দিনের উৎপত্তি নিয়ে বেশ কিছু তথ্য পাওয়া যায়। এর মধ্যে কানাডার ক্যানবেরা থেকে প্রকাশিত এবং মোহাম্মদ আমিন ও সামাদ সংকলিত ‘সিলেকেটব খুতবা-৩’ গ্রন্থের নভেম্বর ২০১৭ সংস্করণের প্রথম পৃষ্ঠার বর্ণনামতে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর আগমনের আগে বা আইয়েমে জাহেলিয়াত (অন্ধকার) যুগে বর্তমানে শুক্রবার নামক দিনটির স্থানীয় আরবি নাম ছিল ‘আল আরুরাহ’। যার অর্থ গৌরবান্বিত দিন। বইটির একই পৃষ্ঠায় জনৈক ‘ইবনে শিরিন’-এর উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়, মহানবী (সা.) মদিনায় হিজরতের আগে সেখানে যে সীমিত সংখ্যক স্থানীয় মুসলমান ছিল, তারা লক্ষ্য করে যে, ইহুদিরা সপ্তাহের একটি দিন শনিবার একত্রিত হয় এবং প্রার্থনা করে। উল্লেখ্য, ইহুদিদের কাছে শনিবার দিনটি ‘সাব্বাত’ নামে পরিচিত ও ধর্মীয় রীতিনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। একইভাবে খ্রিস্টানদের কাছে পবিত্র ছিল রবিবার, যে দিন তারাও একত্রিত হয়ে বিশেষ প্রার্থনায় যোগ দিত। মুসলমানরা এ সময় ভিন্ন দিন হিসেবে শুক্রবার দিনটিকে সম্মিলিত প্রার্থনার জন্য বেছে নেয়। এই শুক্রবার দিনটি তখনো ‘আরুবাহ’ বা গৌরবান্বিত দিন হিসেবে পরিচিত ছিল। পরবর্তীতে মহান আল্লাহর নির্দেশে এই দিনটিকেই সপ্তাহের সবচেয়ে পবিত্র দিন হিসেবে গণ্য করা হয় এবং এই দিনে জোহরের নামাজের পরিবর্তে কেবল মসজিদে আদায়যোগ্য জুমার নামাজ প্রবর্তিত হয়। উল্লেখ্য, বাংলাদেশে প্রায় সব মসজিদেই জুমার নামাজ অনুষ্ঠিত হলেও মধ্যপ্রাচ্যসহ বহু দেশে জুমার নামাজে কেবল বৃহৎ আকৃতির কিছু নির্দিষ্ট মসজিদে আদায়ের বিধান রয়েছে। এসব মসজিদে দেশবরেণ্য ইসলামিক চিন্তাবিদ ও পন্ডিতরা ইসলাম ও সমসাময়িক বিষয়ে তাদের বক্তব্য ও দিকনির্দেশনা দিয়ে থাকেন। কয়েকটি পাড়া বা মহল্লার মুসলমান একই মসজিদে উপস্থিত হয়ে জুমার নামাজ আদায় করেন বিধায় এই মসজিদগুলো জুমা মসজিদ নামে পরিচিত পায়।

 

মদিনায় প্রথম জুমার নামাজ

মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর স্মৃতিধন্য মদিনা শহরে ‘আল জুমা’ নামে একটি মসজিদ রয়েছে। স্থানীয়ভাবে মসজিদটি বানি সেলিম মসজিদ, আল ওয়াদি মসজিদ, আল ঘুবাইব মসজিদ, আল আতিকা মসজিদ প্রভৃতি নামেও পরিচিত। ৬২২ সালে কুরাইশ ও ইসলামের অন্যান্য শত্রু মহানবী (সা.) এবং তাঁর অনুসারীদের (সাহাবি) প্রতি হিংস্র হয়ে ওঠে। সবার নিরাপত্তার কথা ভেবে মহানবী (সা.) মহান আল্লাহর নির্দেশে মদিনায় হিজরত বা স্থানান্তরিত হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন এবং সবাইকে ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে মদিনার উদ্দেশে যাত্রার সিদ্ধান্ত নেন। পথিমধ্যে অনেকেই আবার মহানবী (সা.)-এর সঙ্গে পুনরায় মিলিত হয়ে একত্রে মদিনার দিকে যাত্রা করেন। হিজরি প্রথম বছরের ১২ রবিউল আউয়াল বা মক্কা থেকে যাত্রার ১২ দিনের মাথায় হজরত মুহাম্মদ (সা.) মদিনা থেকে নয় কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে ‘কুবা’ নামক স্থানে পৌঁছেন এবং অন্যান্য ছোট ছোট দলের অপেক্ষায় এখানে চার দিন অবস্থান করেন। এরপর পঞ্চম দিন শুক্রবার সকালে তিনি সবাইকে নিয়ে মদিনার দিকে যাত্রা করেন। যাত্রাপথে কুবা এলাকার উত্তরে তারা (রানুনা) নামক একটি ওয়াদি বা ঝরনাধারার (খালের) তীরে উপস্থিত হলে দুপুর হয়ে যায় এবং জুমার নামাজের সময় হয়। এ সময় খালের নিকটবর্তী বানু সেলিম গোত্রের লোকেরা মহানবী (সা.)-এর কাছে উপস্থিত হয় এবং বলে যে, মহানবী (সা.)-এর অবস্থানের কারণে তাদের আত্মীয় কুবার জনগণ বিশেষ মর্যাদা লাভ করবে। তাই তারা মহানবী (সা.)-কে তাদের জন্য এমন কিছু করার বিনীত অনুরোধ জানায়। তাদের অনুরোধে সাড়া দিয়ে মহানবী (সা.) তার উট থেকে নেমে যান এবং সেখানে জুমার নামাজ আদায় করেন। মদিনার বুকে এটাই ছিল প্রথম জুমার নামাজ।

এই জুমার নামাজে প্রায় ১০০ মুসলমান অংশ নেন, যার মধ্যে ছিলেন বানি আন নাজ্জার গোত্র থেকে আসা মহানবী (সা.)-এর আত্মীয়স্বজন এবং মহানবী (সা.)-এর নিরাপত্তার জন্য কুবার বানি আমর গোত্রের লোকজন। এখানে জুমার নামাজ শেষে মহানবী (সা.) সঙ্গীদের নিয়ে মদিনার দিকে আবারও যাত্রা শুরু করেন। প্রথমে এ স্থানে একটি ছোট মসজিদ থাকলেও সৌদি সরকার পুরনো মসজিদটি ভেঙে বর্তমানে একটি বড় গম্বুজ, চারটি ছোট গম্বুজ, একটি মিনার, লাইব্রেরি, অজুখানা, মাদ্রাসা, মহিলাদের নামাজের স্থান ইত্যাদির সমন্বয়ে একটি মসজিদ কমপ্লেক্স গড়ে তুলেছে।

অপরদিকে ইসলাম ডট স্টাক এক্সচেঞ্জ ডট কম শীর্ষক একটি ওয়েবসাইটে আবদুল্লাহর বিন আব্বাস (রা.)-কে উদ্ধৃত করে উল্লেখ করা হয়েছে, হজরত মুহাম্মদ (সা.) থেকে বর্ণিত হিজরতের আগেই মহান আল্লাহ জমাতবদ্ধ হয়ে জুমার নামাজ পড়ার দিক-নির্দেশনা দেন। তবে তৎকালে মুসলমানদের পক্ষে একটি নির্দিষ্ট স্থানে একত্রিত হওয়া এবং নামাজে মনোনিবেশ করা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। তখন মহানবী (সা.)-এর নির্দেশে হজরত মুসাব বিন উমাইর (রা.) মদিনায় ইসলামের দাওয়াত প্রচারে নিয়োজিত ছিলেন। মহানবী (সা.) মুসাব বিন উমাইর (রা.) কাছে একট চিঠি লিখে প্রতি শুক্রবার একত্রিত হয়ে দুই রাকাত জুমার নামাজ পড়ার নির্দেশনা পাঠান। এরপর মহানবী (সা.) মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতকালে পথিমধ্যে জুমার নামাজ আদায় করেন।

 

 

জুমার দিনে ঐতিহাসিক ঘটনা

অসংখ্য হাদিসে পবিত্র জুমার নামাজ এবং এই দিনের বরকত ও ফজিলত সম্পর্কে বর্ণনা পাওয়া যায়। তবে বিশেষ একটি হাদিসে জুমার দিনের কিছু ঐতিহাসিক ঘটনা ও ভবিষ্যদ্বাণী খুঁজে পাওয়া যায়। সহি মুসলিম শরিফের ৪নং বইয়ের ১৮৫৭ নম্বর হাদিসে হজরত আবু হুরাইরাকে (রা.) উদ্ধৃত করে বর্ণিত মহানবী (সা.) বলেছেন, যেসব দিনে সূর্য ওঠে, সেসব দিনের মধ্যে (সপ্তাহের সাত দিনের মধ্যে) জুমার দিন (শুক্রবার) সর্বশ্রেষ্ঠ। শুক্রবার আমাদের আদি পিতা হজরত আদম (আ.)-কে মহান আল্লাহ সৃষ্টি করেন। হজরত আদম (আ.)-কে শুক্রবারেই মহান আল্লাহ বেহেশতে প্রবেশ করান এবং শুক্রবারেই ভুলের কারণে তাঁকে বেহেশতের বদলে পৃথিবীতে নেমে আসার আদেশ দেন। এই শুক্রবারই পৃথিবী ধ্বংস হয়ে কেয়ামত পর্ব সূচিত হবে।

 

আল কুদস দিবসের নেপথ্যে ৬ দিনের যুদ্ধ

মুসলমানদের জন্য এক বিতর্কিত এবং সংঘাতময় এলাকার নাম ইসরায়েল। যুগে যুগে ইসরায়েলের প্রকৃত সীমানা নিয়ে ফিলিস্তিনসহ আশপাশের মুসলমান অধ্যুষিত দেশ মিসর, জর্ডান ও সিরিয়া তথা মুসলমান বিশ্বের সঙ্গে ইসরায়েলের বহু যুদ্ধ হয়েছে। বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বহু দেশের অসংখ্য মুসলমান ফিলিস্তিনিদের পক্ষে ইসরায়েলিদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছে। অনেকে আবার জীবন বিসর্জন দিয়েছেন। তবুও একদিকে ইসরায়েলের পক্ষে আমেরিকা ও সমগ্র বিশ্বের ইহুদিদের ঐক্যবদ্ধ অবস্থান আর অন্যদিকে মুখে মুখে মুসলিম ঐক্যের কথা বললেও নিজ স্বার্থে গোপনে আমেরিকা ও ইসরায়েলের সঙ্গে মুসলমানদের হাত মিলান তথা বিভক্তির কারণে বহাল তবিয়তেই নিজেদের আধিপত্য ধরে রেখেছে ইসরায়েল। তদুপরি শুধু ইহুদিরাই নয়, মুসলমানদের বিরোধী অন্য ধর্মাবলম্বী সবার অবস্থান বরাবরই ইসরায়েলের পক্ষে। ফলে ইসরায়েল নানা ধরনের সুবিধা কাজে লাগিয়ে গড়ে তুলেছে এক শক্তিশালী সামরিক বাহিনী।

ইসরায়েলের সঙ্গে আরবদের অসংখ্য যুদ্ধের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখ্য ১৯৬৭ সালের ৫ জুন থেকে ১০ জুন তারিখ পর্যন্ত সংঘটিত তৃতীয় আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ, যা ইতিহাসের পাতায় ‘সিক্স ডে ওয়ার’ বা ছয় দিনের যুদ্ধ নামেও পরিচিত। মার্কিন সমর্থিত ইসরায়েলিদের বিরুদ্ধে এই যুদ্ধে অংশ নেয় মিসর (তৎকালীন নাম ইউনাইটেড আরব রিপাবলিক) জর্ডান ও সিরিয়া পরবর্তীতে ইরাক ও লেবাননও যোগ দিয়েছিল এই যুদ্ধে। ইসরায়েলের দুই লাখ ৬৪ হাজার সৈন্যের মধ্যে সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেয় প্রায় এক লাখ সৈন্য। অন্যদিকে আরবদের পক্ষে পাঁচ লাখ ৪৭ হাজার সৈন্যের মধ্যে প্রায় আড়াই লাখ সৈন্য এই যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। উভয়পক্ষের হাজার হাজার সৈন্যের প্রাণহানি, মারাত্মক জখম, বন্দিত্ববরণ ও শত শত ট্যাংক এবং বিমান ধ্বংসের মধ্য দিয়ে ছয় দিনের জন্য মধ্যপ্রাচ্যের ওই এলাকা এক বিভীষিকাময় মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়। ওই যুদ্ধে আমেরিকা ও রাশিয়াও জড়িয়ে পড়ে। ছয় দিনের যুদ্ধ শেষে কাগজে-কলমে ১১ জুন ১৯৬৭ তারিখে ‘যুদ্ধ বিরতি’ কার্যকর হলেও বাস্তবে এটি ছিল ইসরায়েলিদের কাছে আরবদের করুণ পরাজয়। এই যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ইসরায়েল গাজা উপত্যকা, সিনাই পেনিনসুলা, জর্ডান নদীর পশ্চিমতীর, পূর্ব জেরুজালেম এবং গোলান উপত্যকা দখল করে। প্রায় ১০ লাখ আরব সরাসরি ইসরায়েলিদের দখলকৃত এলাকায় নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন করতে বাধ্য হয়। মূল ইসরায়েলি ভূখ- থেকে তাদের নিয়ন্ত্রিত এলাকার সীমানা উত্তরে ২০ কিলোমিটার, দক্ষিণে ৩০০ কিলোমিটার এবং পূর্বে ৬০ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তার লাভ করে। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল মুসলমানদের কাছে মক্কা ও মদিনার পর তৃতীয় সর্বোচ্চ পবিত্রস্থান হিসেবে স্বীকৃত আল আকসা মসজিদে ও তৎসংলগ্ন পুরাতন শহর এলাকায় ইসরায়েলি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা। এই শহরটিকে আরব বা ইসরায়েলিদের নিয়ন্ত্রণে না রেখে উভয়ের সমান অধিকারের ভিত্তিতে একটি আন্তর্জাতিক শহর হিসেবে গণ্য করার প্রচেষ্টা ১৯৪৭ সালে থেকেই চলছিল। কিন্তু উভয় পক্ষ এ বিষয়ে একমত হতে পারেনি। কিন্তু ছয় দিনের যুদ্ধে জয়লাভের পর থেকে এই পুরাতন শহরের নিয়ন্ত্রণ ইসরায়েলিদের হাতে চলে যায়। এই জয়ের প্রথম বর্ষপূর্তির আগে ১৯৬৮ সালের ১২ মে ইসরায়েল সরকার বছরের একটি দিনে ইহুদিদের ঐক্য, সংহতি এবং বিজয়ের গৌরব উদযানের জন্য ‘জেরুজালেম দিবস’ পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। ইহুদিদের ‘জেরুজালেম দিবস’ মূলত মুসলমানদের জন্য এক অপমানজনক দিন, যার বিপরীতে ‘আল আকসা’ মসজিদ তথা জেরুজালেমের পুরাতন শহরের স্মরণে ‘আল কুদস’ দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেয় মুসলমানদের একটি বিরাট অংশ।

 

 

ইরান থেকে শুরু আল কুদস দিবস

ইসরায়েলের রাজধানী জেরুজালেমকে আরবিতে ‘কুদস’ বলা হয়। প্রতি বছর পবিত্র রমজান মাসের শেষ শুক্রবার বা জুমাতুল বিদার দিনে পৃথিবীর প্রায় ৮০টি দেশে ‘আন্তর্জাতিক কুদস’ দিবস পালন করা হয়। জেরুজালেম ভূখন্ড মূলত ফিলিস্তিন তথা মুসলমানদের প্রাপ্য, যা ইসরায়েলি ইহুদিরা অন্যায়ভাবে অস্ত্রের জোর ও মুসলমানদের বিভক্তির কারণে দখল করে রেখেছে বলে মনে করে মুসলিম বিশ্ব। তাই ফিলিস্তিনের দাবি সমর্থন এবং ইসরায়েলিদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে বছরের এই পবিত্র মাসের পবিত্র দিনে এক সূরে আওয়াজ তোলাই এই ‘আল কুদস’ দিবস পালনের উদ্দেশে। সত্তরের দশকে ইরানের রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে সে দেশের ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক নেতা ও তাত্ত্বিক গুরু সাঈদ রুহুল্লাহ মাসাভি খোমেনির (সংক্ষেপে আয়াতুল্লাহ খোমেনি) নির্দেশে তীব্র সংগ্রাম ও আন্দোলন গড়ে ওঠে। এই আন্দোলন সামাল দিতে না পেরে প্রায় আড়াই হাজার বছরের পুরনো ও ঐতিহ্যবাহী ইরানের পারস্য রাজবংশ তথা শাহ বংশের শেষ রাজা মোহাম্মদ রেজা পাহলভি (জনপ্রিয় নাম রেজা শাহ্ পাহলভি) ১৬ জানুয়ারি ১৯৭৯ সালে দেশ ছেড়ে পালান এবং বিভিন্ন দেশে আশ্রয় শেষে ১৯৮০ সালের ২৭ জুলাই মৃত্যুবরণ করেন। রেজা শাহ পাহলভির ইরান ত্যাগের দুই সপ্তাহ শেষে ১ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৯ আয়াতুল্লাহ খোমেনি নির্বাসিত জীবন শেষে নিজ দেশ ইরানে প্রত্যাবর্তন করেন এবং সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতার মর্যাদায় নেপথ্য থেকে রাষ্ট্র পরিচালনার নিয়ামক শক্তি হয়ে ওঠেন।

আয়াতুল্লাহ খোমেনির আস্থাভাজন এবং তৎকালে ইরানের প্রথম পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইব্রাহিম ইয়াজদি নতুন সরকার প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ইরানের পররাষ্ট্র নীতিতে ফিলিস্তিনিদের প্রতি সমর্থন এবং ইসরায়েলের বিরোধিতাকে অগ্রাধিকার দেন। তারই ধারাবাহিকতায় তিনি ইহুদিবিরোধী দিবস পালনের ডাক দেন। ১৯৭৯ সালের ২২ এপ্রিল লেবাননের ১৬ বছরের কিশোর সামির কুন্তার তিন সঙ্গীসহ ছোট নৌকাযোগে লেবানন ছেড়ে ইসরায়েল ভূখন্ডের উপকূলীয় শহর নাহারিয়ায় ঢুকে পড়েন এবং একজন পুলিশ অফিসারসহ বেশ কয়েকজনকে গভীর রাতে হত্যা করেন। পরদিন ইসরায়েল নৌবাহিনীর গানবোট থেকে লেবাননের রাজধানী বৈরুতের একটি শরণার্থী শিবিরে বোমা নিক্ষেপ করে। ফলে লেবানন ও ইসরায়েলের মধ্যে চরম উত্তেজনা বিরাজ করতে থাকে। আয়াতুল্লাহ খোমেনির নীতিগত অবস্থান এবং রাজনৈতিক দর্শন বরাবরই ছিল ইসরায়েলবিরোধী। ফলে লেবানন ও ইসরায়েলে বিরাজমান উত্তেজনা প্রশমনে তিনি পৃথিবীর সব দেশের মুসলমানের মাঝে অন্তত জেরুজালেম (আল কুদস) প্রশ্নে ঐক্য প্রত্যাশা করেন এবং কেবল লোক দেখানো নয়, প্রকৃত অর্থে ইসরায়েলবিরোধী অবস্থান কামনা করেন। এই প্রত্যাশা থেকেই তিনি এই মর্মে ফতোয়া দেন যে, জেরুজালেমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা সব মুসলমানের ধর্মীয় দায়িত্ব। এরপর তিনি প্রতি রমজান মাসের শেষ শুক্রবার জেরুজালেমের স্বাধীনতা দাবি ও ইসরায়েলবিরোধী অবস্থান নেওয়ার দিন আড়ম্বরপূর্ণভাবে পালনের আহ্বান জানান, যা আন্তর্জাতিক কুদস দিবস নামে পরিচিতি পায় এবং দেশে দেশে বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে উদযাপন শুরু হয়।

 

আয়াতুল্লাহ খোমেনির ডাক

“আমি সারা বিশ্বের মুসলমান সমাজকে প্রতি বছর পবিত্র রমজান মাসের শেষ শুক্রবার আল কুদস দিবস পালন এবং ফিলিস্তিনের মুসলমানদের আইনসম্মত ও যৌক্তির দাবি এবং অধিকারের প্রতি সব মুসলমানকে সমর্থন প্রদানের আহ্বান জানাই। বহু বছর ধরে আমি লক্ষ্য করেছি যে, অবৈধভাবে ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদের জন্য বিপদ ডেকে আনছে। আজ ইসরায়েল সেই মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে ও ফিলিস্তিনের ভাইবোনদের ওপর বারবার আক্রমণ করেছে। সুনির্দিষ্টভাবে তারা দক্ষিণ লেবাননে আক্রমণ করছে এবং ফিলিস্তিনিদের আন্দোলন ধূলিসাৎ করার মানসে ফিলিস্তিনিদের বাড়িঘরে অনবরত বোমাবর্ষণ করছে। আমি বিশ্বের সব মুসলমান এবং মুসলিম বিশ্বের সরকারসমূহকে আহ্বান জানাই এই অবৈধ শক্তির (ইসরায়েল) বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ ও দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করার জন্য। আমি বিশ্বের মুসলমানদের কাছে আহ্বান জানাই পবিত্র রমজান মাসের শেষ শুক্রবারে আল কুদস দিবস পালন করার জন্য। এই দিনটিই (রমজানের শেষ শুক্রবার) একটি নিয়মক শক্তি, যা ফিলিস্তিনি জনগণের ভাগ্য নির্ধারণে ভূমিকা রাখতে পারে, যদিও এটি একটি আনুষ্ঠানিকতা, তবুও এর মধ্য দিয়েই সমগ্র বিশ্বে মুসলিম উম্মার ঐক্য প্রকাশ ও মুসলমানদের বৈধ ও ন্যায়সঙ্গত অধিকারের প্রতি সমর্থন প্রকাশ করা সম্ভব। আমি মহান আল্লাহর কাছে কাফেরদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের জয়ের জন্য প্রার্থনা করি।”

 

দেশে দেশে আল কুদস দিবস উদযাপন

পৃথিবীর প্রায় ৮০টিরও অধিক মুসলিম প্রধান দেশে নানা আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে আল কুদস দিবস পালন করা হয়। ইরানে সরকারিভাবে দিনটি পালনের ঐতিহ্য গড়ে উঠেছে। ইরানে আল কুদস দিবসে রাস্তায় শোভাযাত্রা বের করা হয়। ইরানের জ্যেষ্ঠ মুসলমান নেতারা এই দিনে আমেরিকা ও ইসরায়েলের তীব্র নিন্দা করে বিপ্লবী ভাষণ প্রধান করেন। মার্কিন ও ইসরায়েলবিরোধী সেøাগানে ইরানের আকাশ প্রকম্পিত হয় এই বিশেষ দিনে। খোদ মার্কিন মুলুকের মধ্যেই ১৮টি অঞ্চল বা শহরে আল কুদস দিবসের র‌্যালি বের করা হয়। ২০১৮ সালে লন্ডনে প্রায় তিন হাজার মানুষ এবং জার্মানির বার্লিন শহরে প্রায় ১৬০০ জনের অংশগ্রহণে আল কুদস দিবসের র‌্যালি বের হয়। মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে চলে আল কুদস দিবসের নানা কর্মসূচি। সরকারিভাবে আল কুদস দিবসের সম্মানে ডাকটিকিট ও পোস্টার প্রকাশ করেছে বিশ্বের বহু দেশ। ‘আল কুদস কমিটি বাংলাদেশ’ নামের একটি সংগঠন এ উপলক্ষে সেমিনার পথসভা শোভাযাত্রা, ব্যানার ও পোস্টার প্রদর্শন করে থাকে রাজধানী ঢাকায়। অন্যান্য দেশেও প্রায় একই ধরনের অনুষ্ঠানমালা সাজানো হয়। ফিলিস্তিনিদের অসহায় অবস্থানের অবসান কামনা করে মসজিদে মসজিদে বিশেষত জুমার নামাজের পর দোয়া করা হয়।

 

 

প্রাচীন কিছু জুমা মসজিদ

ডারবেন্ট জুমা মসজিদ, রাশিয়া

রাশিয়া (পূর্বের সোভিয়েট ইউনিয়ন) এবং বৃহত্তর ককেশাস অঞ্চলের প্রাচীনতম মসজিদের নাম ডারবেন্ট জুমা মসজিদে। রাশিয়ার দক্ষিণে অবস্থিত ডাগেস্টান অঞ্চলের ডারবেন্ট জেলায় ৭৩৪ সালে এই মসজিদ নির্মিত হয়। ইতিহাস মতে, আরবে উমাইয়া খেলাফতের সময় বৃহত্তর ককেশাস অঞ্চলে মুসলমানদের বিজয় সূচিত হয়। এই সময়েই এই মসজিদ নির্মিত হয়। মাঝে সোভিয়েট ইউনিয়নের কড়া কমিউনিজম নীতির কারণে ১৯৩০ সালে মসজিদটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। ১৯৩৮ থেকে ১৯৪৩ এই পাঁচ বছর মসজিদটি জেলখানা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এ সময় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলায় তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নে এ ধরনের বহু অস্থায়ী কারাগার গড়ে উঠেছিল। পরবর্তীতে ১৯৪৩ সালে আবারও এখানে নামাজ আদায় শুরু হয় এবং জুমার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়।

 

সামাখি জুমা মসজিদ, আজারবাইজান

পূর্ব ইউরোপ ও এশিয়ার পশ্চিমাঞ্চলের সংযোগস্থলে অবস্থিত ইউরেশিয়ার অন্যতম দেশ আজারবাইজান। এ দেশের সামাখি জেলায় অবস্থিত ‘জুমা মস্ক অব সামাখি’ বা সামাখি জুমা মসজিদ। মসজিদের প্রাপ্ত আরবি শিলালিপি অনুসারে হিজরি ১২৬ সালে অর্থাৎ ইংরেজি ৭৪৩-৭৪৪ সালে মসজিদটি নির্মিত হয়। এ অঞ্চলে এটি ছিল প্রাচীনতম মসজিদ। ইতিহাস মতে, সামাখি প্রাচীনকাল থেকেই শিক্ষা ও সংস্কৃতির কারণে প্রসিদ্ধ ছিল। তাই আরব বিশ্বের উমাইয়া খলিফা ভালিনের আমলে তারই ভাই মুসলিম সেনাপতি মাসলাম ইবনে আবদুল মালেক বর্তমান আজারবাইজানের সামাখিতে বসতি গড়েন। তার সময়েই সামাখি জুমা মসজিদ গড়া হয় এবং সেখানে জুমার নামাজ আদায় শুরু হয়। যুদ্ধ, ভূমিকম্প এবং আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় অন্তত পাঁচবার মসজিদটি পুনর্নির্মিত হয়। 

 

চিরামান জুমা মসজিদ, ভারত

ভারতের কেরেলা রাজ্যের ত্রিসুর জেলার মেথালা নামক স্থানে অবস্থিত ভারতের সবচেয়ে প্রাচীন মসজিদ হিসেবে স্বীকৃত চিরামান জুমা মসজিদ। ইতিহাস মতে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর অন্যতম সাহাবি ও পারস্যের ধর্মপ্রচারক মালিক দিনার সর্বপ্রথম ইসলামের বাণী নিয়ে ভারতে আসেন। তার হাত ধরেই কেরেলার তৎকালীন রাজা চিরামান পিরামালের আদেশে স্থানীয় স্থাপত্য রীতিতে এই মসজিদ নির্মিত হয়। ১৫০৪ সালে পর্তুগিজ আক্রমণে মসজিদটি ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং পুনর্নির্মিত হয়। স্থানীয়দের মতে, চিরামান পিরামাল মূলত কেরালার রাজার উপাধি ছিল, যিনি পবিত্র কোরআনের ৫৪ নং সূরা কসবের প্রথম ও দ্বিতীয় আয়াতে বর্ণিত মহানবী (সা.)-এর পবিত্র হাতের ইশারায় মহান আল্লাহ কর্তৃক চাঁদ দ্বিখন্ডিত করার বিরল দৃশ্য নিজ প্রাসাদের ছাদে বিশ্রামের সময় প্রত্যক্ষ করেন। মহানবী (সা.)-এর নির্দেশে তিনি নাম পরিবর্তন করেও হজ পালন শেষে পারস্যের সাহাবি মালিক দিনারকে সঙ্গে নিয়ে নিজ দেশ ভারতের দিকে যাত্রা করেন। সূত্র : আরব নিউজ, ৯.২.২০১২।

 

ইস্পাহান জামে মসজিদ, ইরান

ইরানের ইস্পাহান জেলার প্রাণকেন্দ্রে আনুমানিক ৭২১ সালে গড়ে ওঠে জামে মস্ক অব ইস্পাহান বা ইস্পাহানের জামে মসজিদ। মুসলিম বিশ্বে উমাইয়াদের শাসনকালে এই মসজিদ গড়ে ওঠে। কথিত আছে যে তৎকালে বর্তমান সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কের সম্রাট নিজ হাতে এই মসজিদের একটি মিনার নির্মাণ করেন।

পরবর্তীতে বহু ঘটনা ও দুর্ঘটনার মধ্য দিয়ে মসজিদটি বেশ কয়েকবার সংস্কার ও পুনর্নির্মাণ করা হয়। বৃহৎ পরিধি, নির্মাণ সৌন্দর্য এবং তৎকালে জানা মতে সর্ববৃহৎ গম্বুজের জন্য মসজিদটি বিখ্যাত ছিল। পবিত্র শুক্রবারে বৃহৎ জুমার নামাজের আয়োজন মসজিদের পরিচিতি ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করেছে।

সর্বশেষ খবর