শুক্রবার, ১২ জুন, ২০২০ ০০:০০ টা

চমক লাগানো চার চিকিৎসাবিজ্ঞানী

মেজর নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ (অব.) পিএইচডি

চমক লাগানো চার চিকিৎসাবিজ্ঞানী

শুরুর কথা

পবিত্র কোরআন এবং হাদিসে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মানুষের জীবনে রোগ, শোক, দুঃখ, কষ্ট ও জ্বালা-যন্ত্রণা ভোগের কথা বলা হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে প্রেরিত মহান আল্লাহর নবী-রসুলদের দেহেও বিভিন্ন রোগ, শোক বাসা বেঁধেছিল। এর মধ্যে হজরত আইয়ুব (আ.) এর সমগ্র শরীরে বিশেষ চর্মরোগ ও পচন ধরার কথা পবিত্র কোরআনে উল্লিখিত আছে। মহান আল্লাহর প্রিয় বন্ধু হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর জীবনে অসুস্থতা নেমে আসে। নবী রসুলগণ এবং প্রকৃত মুসলমানগণ এসব অসুখ-বিসুখে ধৈর্য ধারণ করেছেন এবং যথাসাধ্য চিকিৎসা নিয়েছেন।

মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর জীবদ্দশায় ৬২২ সালে মদিনায় ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা খ্রিস্টীয় নবম শতক থেকে শুরু করে ১২৫৮ সালে মোঙ্গলদের দ্বারা বাগদাদ অবরোধের পূর্ব পর্যন্ত সময়ে জ্ঞান, বিজ্ঞান, চিকিৎসা দর্শন, ইতিহাস, সাহিত্যসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিভাবান মুসলমান পন্ডিতগণ স্ব স্ব ক্ষেত্রে সাফল্য দেখিয়ে সমগ্র বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করেন। এ সময়েই চিকিৎসাচর্চায় চমক সৃষ্টি লাগিয়েছিলেন চারজন মুসলমান চিকিৎসক।

 

ইবনে সিনা (৯৮০-১০৩৭)

চিকিৎসাশাস্ত্র এবং চিকিৎসাবিষয়ক ইতিহাসে এক নক্ষত্রের নাম আবু আলী হুসাইন ইবনে আবদুল্লাহ আল ইবনে আল হাসান ইবনে আলী ইবনে সিনা। তবে বিশ্বজগতে তিনি চিকিৎসাবিজ্ঞানের দিকপাল হিসেবে ‘ইবনে সিনা’ নামে সুপরিচিত। ৯৮০ সালে বর্তমান উজবেকিস্তানের বুখারা অঞ্চলের আফসান গ্রামে বাবা আবদুল্লাহ এবং মা সীমারার কোলজুড়ে পৃথিবীতে আগমন ঘটে ইবনে সিনার। বাল্যকালেই তার বিরল প্রতিভা ও প্রখর স্মৃতিশক্তি সবাইকে সম্মোহিত করে। মাত্র ১০ বছর বয়সে ইবনে সিনা পবিত্র কোরআন মুখস্থ করে হাফেজে পরিণত হন। মাহ্মুদ মাসাহী নামে এক ভারতীয় পন্ডিতের কাছে তিনি অঙ্ক শাস্ত্রে দীক্ষা লাভ করেন। এ ছাড়াও তৎকালে যারা চিকিৎসা প্রদান করে রোগীদের আরোগ্য লাভে সহায়তা করতেন বা শিশুদের শিক্ষাদান করতেন তিনি তাদেরও শিষ্যত্ব গ্রহণ করে অনেক বিষয়ে জ্ঞান লাভ করেন। অন্যদিকে ইসলাম ধর্মে অনুরক্ত এবং সুন্নি মতবাদে বিশ্বাসী বিধায় ইসলামী বিচারব্যবস্থা, সমাজরীতি ও ফিকা শাস্ত্রেও তিনি বিশেষ জ্ঞান লাভ করেন। বরাবরই তিনি ছিলেন অনুসন্ধিৎসু মনের অধিকারী। তাই দর্শন ও যুক্তির পেছনে তিনি অনবরত ছুটেছেন। কথিত আছে যে, গ্রিক দার্শনিক এরিস্টটলের একটি বই তিনি ৪০ বার পড়েছিলেন অর্থ বোঝার জন্য। কোনো কোনো বই বারবার পড়তে গিয়ে বইয়ের অক্ষরগুলোই মুছে গিয়েছিল বলে প্রচলিত আছে। জ্ঞানের একাধিক শাখায় বিচরণ করলেও চিকিৎসাবিজ্ঞানের প্রতি তার ছিল বিশেষ আকর্ষণ। তাই ১৬ বছর বয়সে তিনি চিকিৎসাবিজ্ঞান চর্চায় বিশেষ মনোযোগী হন এবং মাত্র ১৮ বছর বয়সে একজন চিকিৎসক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। চিকিৎসাবিজ্ঞান তার কাছে অঙ্ক কিংবা দর্শনের চেয়ে সহজ মনে হতো। তাই দ্রুতই তিনি প্রচলিত চিকিৎসা পদ্ধতি রপ্ত করে রোগীদের সেবায় নেমে পড়েন। একজন প্রসিদ্ধ ডাক্তার হিসেবে তার সুনাম অল্প সময়ের মধ্যে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। তথাপি তিনি অজু করে রাতভর পড়ালেখা করতেন। আর দিনভর বিনা পয়সায় রোগীদের সেবা করতেন।

চিকিৎসক হিসেবে সুনামের কারণে তিনি দ্রুতই প্রশাসনের নজরে আসেন। এ সময় তিনি ইরান, তাজিকিস্তান, উজবেকিস্তান, কাজাখস্তান, আফগানিস্তান, পাকিস্তান প্রভৃতি অঞ্চল নিয়ে গঠিত তৎকালীন সামানিদ সাম্রাজ্যের প্রধান চিকিৎসক নিযুক্ত হন এবং সাম্রাজ্যের আমির ৯২ বছর বয়সী নূহুর ব্যক্তিগত চিকিৎসক হিসেবে তাকে এবং দুরারোগ্য রোগ থেকে পরিত্রাণ পেতে সাহায্য করেন। ১০০৪ সালে সামানিদ সাম্রাজ্যের পতন ঘটে। নতুন শাসকবর্গের সঙ্গে সখ্য না থাকায় তিনি একে একে বহু অঞ্চলে আশ্রয় নেন। কিছু সময়ের জন্য তিনি যুক্তবিদ্যা এবং জ্যোতির্বিদ্যা বিষয়ে শিক্ষকতা এবং বক্তৃতা করেন। যাযাবর জীবন সত্ত্বেও এ সময় তিনি বহু বই রচনা করেন। বিভিন্ন কারণে তিনি এই সময়ে নিজের অসুস্থতাসহ বহু প্রতিকূলতা মোকাবিলা করেন। প্রতিকূল পরিবেশের কারণে তাকে আত্মগোপনেও থাকতে হয়। প্রায় ২০ বছর পর এমন বিচ্ছিন্ন ও বিরূপ পরিবেশের অবসান হয় এবং তৎকালীন বৃহত্তর (ইরান) পারস্য অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত কাকুইদ সাম্রাজ্যের শাসক মোহাম্মদ ইবনে রুস্তম দুশমানজিয়ার একজন চিকিৎসকের মর্যাদায় ইবনে সিনাকে কাছে টেনে নেন। শুধু চিকিৎসকই নন, সম্রাট রুস্তম পর্যায়ক্রমে ইবনে সিনাকে সাহিত্য ও বিজ্ঞান বিষয়েও উপদেষ্টা নিযুক্ত করেন এবং বিভিন্ন অভিযানকালে তাকে সঙ্গে রাখেন। কিন্তু ক্রমান্বয়ে ইবনে সিনা দুর্বল হতে থাকেন এবং পেটের ব্যথায় কাবু হয়ে পড়েন। শেষ জীবনে তিনি পার্থিব জীবনের সব মায়া ত্যাগ করে ধর্মকর্মে মন দেন। এ সময় তিনি তার সব সম্পদ গরিবদের বিলিয়ে দেন এবং তার ক্রীতদাসদের মুক্ত করে দেন। কথিত আছে মূলত পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত করেই এ সময় তার দিন কাটত এবং প্রতিদিন তিনি একবার কোরআন খতম করতেন। ১০৩৭ সালের জুন মাসে পবিত্র রমজান চলাকালে ৫৬ বছর বয়সে ইবনে সিনা মৃত্যুবরণ করেন। ইরানের হামাদানে তাকে সমাহিত করা হয়।

বহু বিষয়ে বই রচনা করলেও চিকিৎসা বিষয়ে রচিত বই ইবনে সিনাকে অমর করে রেখেছে। ‘আল কানুন ফি ত্বিব’ তার রচিত একটি মূল্যবান বই। ইংরেজিতে বইটিকে ‘দি ক্যানন অব মেডিসিন’ নামে অনুবাদ করা হয়, যা অষ্টদশ শতকেও চিকিৎসাবিজ্ঞানের অভিকোষ (ইনসাইক্লোপিডিয়া) হিসেবে পাঠ্য হতো। ভেষজ চিকিৎসার ক্ষেত্রে আজও এ বইটি মূল্যবান অবদান রাখছে। চিকিৎসা বিষয়ে ইবনে সিনার মতবাদ বিশেষত ‘বিরল রোগের নেপথ্যে প্রাকৃতিক কারণে’ তত্ত্ব আজও আলোচিত হয়। চিকিৎসাবিজ্ঞান ছাড়াও মৃত্তিকাবিজ্ঞান, ভূগোল, বিজ্ঞানের দর্শন, যুক্তিবিদ্যা, পদার্থবিদ্যা ও মনোবিজ্ঞানের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তিনি বহু বই ও তত্ত্ব লিখে গেছেন। যা পৃথিবীর মূল্যবান সম্পদ। জ্যোতির্বিদ্যা কিংবা রসায়নের মতো জটিল বিষয়েও তার বিচরণ ছিল। অন্যদিকে তার কাব্য প্রতিভাও ছিল ঈর্ষণীয়। ইবনে সিনার নামে পৃথিবীর বহু দেশে মেডিকেল কলেজ, ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান (ফার্মেসি), ছাত্রাবাস প্রভৃতি নির্মিত হয়েছে। বিভিন্ন দেশের ডাকটিকিটেও তাকে খুঁজে পাওয়া যায়। অস্ট্রেলিয়ার দফতরে ইবনে সিনার ভাস্কর্য ঠাঁই পেয়েছে। তার একটি বিখ্যাত উক্তি হলো- ‘এই দুনিয়ার লোকেরা দুই দলে বিভক্ত। এক দলের ধর্ম নেই কিন্তু বুদ্ধি আছে। আরেক দলের বুদ্ধি নেই কিন্তু ধর্ম আছে।’

 

আল রাজী (৮৫৪-৯২৫)

৮৫৪ সালে বর্তমান ইরানের রাজধানী তেহরানের নিকটবর্তী আলবোর্জ পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত ‘রে’ শহরে জন্মগ্রহণ করেন শিশু চিকিৎসার অন্যতম পথিকৃৎ আবু বকর মুহাম্মদ ইবনে জাকারিয়া আল রাজী, যিনি সংক্ষেপে আল রাজী নামে অধিক পরিচিত। নিজ জন্মস্থান ‘রে’ থেকেই তার নামের পাশে ‘রাজীস’ বা ‘রাজী’ শব্দটি যুক্ত হয়। তরুণ বয়সেই তিনি ইরান ছেড়ে ইরাকের রাজধানী বাগদাদে গমন করেন এবং সেখানকার একটি চিকিৎসাকেন্দ্রে বা হাসপাতালে পড়ালেখার পাশাপাশি হাতেকলমে চিকিৎসাব্যবস্থা রপ্ত করতে থাকেন। চিকিৎসক হিসেবে সুনাম ছড়িয়ে পড়ায় তার জন্মস্থান ‘রে’ শহরের গভর্নর মনসুর ইবনে ইসহাক সসম্মানে আল রাজীকে ফেরত আনেন এবং হাসপাতালসহ সার্বিক চিকিৎসাসেবার গুরু দায়িত্ব প্রদান করেন। এ দায়িত্ব তিনি সুনাম ও দক্ষতার সঙ্গে পালন করেন। ফলে চারদিকে তার সুনাম আরও বৃদ্ধি পায়। এ সুনামের কারণে তিনি বাগদাদ থেকে একটি হাসপাতাল পরিচালনার আমন্ত্রণ পান এবং আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে বাগদাদ গেলে তাকে সেখানকার শাসক ‘আল মুতাদিদ’ নিজ নামে প্রতিষ্ঠিত একটি হাসপাতাল পরিচালনার দায়িত্ব প্রদান করেন। আল মুতাদিদের পুত্র আল মুকতাফিও ছিলেন আল রাজীর ভক্ত ও পৃষ্ঠপোষক। আল মুকতাফি তৎকালীন আব্বাসীয় সাম্রাজ্যে সর্ববৃহৎ হাসপাতাল নির্মাণের পরিকল্পনা করেন এবং দায়িত্ব আল রাজীর হাতে তুলে দেন। আল রাজী হাসপাতালের জন্য উপযুক্ত স্থান নির্মাণ করার লক্ষ্যে বাগদাদ শহরের বিভিন্ন এলাকায় পশুর কাঁচা গোশত ঝুলিয়ে দেন এবং যে স্থানে গোশত পচতে বা দুর্গন্ধ ছড়াতে বেশি সময় নেয় সেখানেই হাসপাতাল নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন। তাই বলা হয়, ‘অ্যাভিডেন্স বেইজড অ্যাপ্রোচ’ বা পর্যবেক্ষণভিত্তিক মতবাদের ভিত্তিতে যে চিকিৎসা গবেষণা ও বিজ্ঞান ভিত্তিক কার্যক্রম পরিচালিত হয়, তা আল রাজীর হাত ধরে বেগবান হয়।

চিকিৎসাবিজ্ঞানসহ জ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে আল রাজী অসামান্য অবদান রাখেন। ২০১৫ সালে ক্লাউডি ফিলিপস রচিত বইয়ে তাকে মনোবিজ্ঞান এবং মনোরোগ উপসমে প্রদত্ত থেরাপির (সাইকো থেরাপি) জনক বলে অভিহিত করা হয়। ইনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটেনিকার মতে, আল রাজীই নবম শতকে গুটিবসন্ত ও হাম রোগ নির্ণয় এ দুটি রোগের মধ্যে পার্থক্য ও নিরাময়ের উপায়ের ওপর ব্যাপক অবদান রাখেন। এ দুটি রোগের কথা প্রথম ঠাঁই পায় আল রাজী রচিত ‘আল জুদারি আল হাসবা’ নামক বইয়ে। তীব্র মাথাব্যথা বা মিনিনজাইটিস রোগের ওপর তার মতবাদ চিকিৎসাবিজ্ঞানের অনন্য সম্পদ। তিনি চিকিৎসা এবং চিকিৎসাসামগ্রী উৎপাদনের ক্ষেত্রে পারদের ব্যবহার শুরু করেন। মর্টার, ফাস্ক, গলা দেখার জন্য চামচের মতো বিশেষ বস্তু (স্পেটুলাস) এবং ওষুধ সংরক্ষণের শিশি আবিষ্কার হয় আল রাজীর হাত ধরে। চিকিৎসকদের নীতি বা মনোবৃত্তি নিয়ে আজ বিতর্ক হয়। এ বিষয়ে আল রাজী হাজার বছর আগেই গুরুত্ব দিয়েছেন। তার মতে, একজন চিকিৎসকের উদ্দেশ্য হবে ভালো কাজ করা এবং শত্রুর প্রতিও ভালো আচরণ করা। ডাক্তারি পেশা কারও ক্ষতি করতে পারে না। মানুষের সেবা ও কল্যাণই চিকিৎসাশাস্ত্রের ভিত্তি।

আল রাজী রচিত অসংখ্য বই, মতবাদ, তত্ত্ব, উপদেশ ও অন্যান্য রচনা চিকিৎসাবিজ্ঞানের অনন্য সম্পদ। ২৩ খন্ডে রচিত তার বই ‘আল কিতাব আল হাওই’ গাইনি ও সার্জারিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রেখেছে। অন্যদিকে সার্বিক চিকিৎসার ক্ষেত্রে ৯ খন্ডে রচিত ‘আল হাওই’ চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইনসাইক্লোপিডিয়া হিসেবে সমাদৃত। শিশুদের অসুস্থতা ও প্রতিকার এবং মানসিক রোগের ওপরও তিনি বই লিখেছেন। ইনসাইক্লোপিডিয়ায় তার রচিত ৫০টিরও বেশি বইয়ের নাম পাওয়া যায়। পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় আল রাজী রচিত বই অনুবাদ করা হয়েছে। অন্যদিকে অ্যাসিডসহ বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ এবং দেহ বা কোনো বস্তুতে বা পরিবেশে রাসায়নিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ওপর ‘ক্র্যাল ক্যামি’ নামক বিষয়ে তার রচিত আরও ২০টি বইয়ের নাম রয়েছে। দর্শনের ওপর তার রচিত বইয়ের সংখ্যা ১৬।

বাগদাদ ছেড়ে শেষ জীবনে তিনি নিজ জন্মভূমি ইরানের ‘রে’ শহরে ফিরে যান। জীবনভর বহু মানুষকে রোগ থেকে মুক্তি দিলেও শেষ জীবনে তিনি ‘গ্লুকোমা’ নামক জটিল রোগে আক্রান্ত হন এবং ক্রমেই তার চোখের আলো নিভে যায়। এ অন্ধত্বের নেপথ্যে একাধিক কিংবদন্তি রয়েছেন। অসংখ্য ভক্ত, গুণগ্রাহী ও দেশ-বিদেশের অগণিত ছাত্র-ছাত্রীকে কাঁদিয়ে সত্তরের বেশি বয়সে ৯৩২ সালে (মতান্তরে ৯২৫ সালে) নিজের জন্মভূমিতেই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এবং সেখানেই তাকে সমাহিত করা হয়।

 

আল জাহারাউই (৯৩৬-১০১৩)

মানবদেহে অস্ত্রোপচার (সার্জারি) বা শল্যচিকিৎসা বর্তমান চিকিৎসাব্যবস্থার এক যুগান্তকারী ঘটনা। অথচ আজ থেকে হাজার বছর আগে এ সার্জারির প্রবর্তন ঘটে মুসলমান চিকিৎসক ও শল্যবিদ (সার্জন) আবুল কাসেম খালাফ ইবনে আল আব্বাস আল জাহারাউই আল আনসারীর হাত ধরে। চিকিৎসা জগতে আল জাহারাউই নামেই তিনি অধিক পরিচিত। বতর্মান স্পেনের (পূর্ববর্তী আন্দালুসিয়া) কর্ডোবা শহরের ৮ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে অবস্থিত আজাহারা অঞ্চলে সম্ভাব্য ৯৩৬ সালের পর জন্ম নেন এই উজ্জ্বল নক্ষত্র। আল আনসারী খেতাবের কারণে মদিনায় মহানবী (সা.) এর আমলে বসবাসরত আনসারদের সঙ্গে তার পূর্বপুরুষের সংযোগ ও পারিবারিক বন্ধনের বিষয়টি আলোচিত হয়। আবার আরবের একদল মুসলমান স্পেন বিজয়ের পর সেখানে বসতি গড়েন এবং আনসার বলে পরিচিতি পান। তাদের সঙ্গেও আল জাহারাউইর বন্ধন ছিল বলে ধারণা করা হয়। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, দীর্ঘদিন এ মুসলিম দিকপালের তথ্য অনুচ্চারিত ছিল। তার জীবনী স্মৃতিচিত্র রচনার অনেক কিছুই স্পেন ও ব্রুনাইয়ের মধ্যে সংঘটিত ‘কাস্টিলিয়ান আন্দালুসিয়ার’ যুদ্ধের সময় ধ্বংস হয়। ফলে তার শৈশব, কৈশোর, কর্মক্ষেত্র এবং অর্জন সম্পর্কে এমনকি তার মৃত্যু নিয়েও বেশি কিছু জানা যায়নি। তবে তিনি কর্ম এবং তার রচিত অসংখ্য বইয়ের মাঝে অমর হয়ে আছেন।

প্রাপ্ত তথ্যমতে, জন্মভূমি কর্ডোভার মানুষের সেবায় সারাটি জীবন অতিবাহিত করেছেন এ মহান চিকিৎসক। এখানেই তিনি পড়ালেখা করেন, শিক্ষকতা করেন এবং আমৃত্যু দেশের মানুষের চিকিৎসা বিশেষত, সার্জারি বা অপারেশনে নিজেকে বিলিয়ে দেন। ৯৬১ সাল থেকে ৯৭৬ সাল পর্যন্ত তৎকালীন আন্দালুসের (বর্তমান স্পেন) কর্ডোভা অঞ্চলের শাসক ছিলেন উমাইয়া সম্রাট মনোনীত দ্বিতীয় আল হাক্কাম। এ সময় তিনি রাজবংশ এবং রাজ্যের প্রধান চিকিৎসক ছিলেন।

আল জাহারাউই তৎকালে বৈজ্ঞানিক ও স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে আগুনে পুড়ে রোগীর দেহের জীবাণু কোনো অঙ্গের অনাকাক্সিক্ষত বর্ধিত অংশ বা ক্ষতিকর টিস্যু নির্মূলে সাফল্য লাভ করেন এবং সর্বমহলে প্রশংসিত হন। শরীরের বিভিন্ন অংশ যেমন- গলা, নাক, কান এমনকি পেটের ভিতরের কোনো কোনো অঙ্গ বাহির থেকে দেখার পরীক্ষার বিভিন্ন যন্ত্র আবিষ্কার করে তিনি সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন। বর্তমানে দেহে স্যালাইন প্রয়োগ এবং শরীরের ভিতর থেকে মলমূত্র বা দূষিত রক্ত বের করার কাজে কেনুলা নামক প্লাস্টিকের পাইপ বা টিউব ব্যবহৃত হয়, তারও আবিস্কারক আল জাহারাউই। আঁচিল, টিউমার বা পায়ের নিচে শক্ত কর্ণ সার্জিক্যাল যন্ত্র দিয়ে তিনিই প্রথম অপারেশনের মাধ্যমে কাটার প্রচলন করেন। এক ক্রীতদাসী আত্মহত্যার উদ্দেশ্যে নিজের গলায় ছুরি চালানোর পর আল জাহারাউই অপারেশন করে তাকে মৃত্যুর দ্বারপ্রান্ত থেকে ফিরিয়ে আনেন। মস্তিষ্কের ভিতর মাথার খুলি কিংবা মেরুদন্ডের মতো স্পর্শকাতর ও ঝুঁকিপূর্ণ অঙ্গে সার্জিক্যাল অপারেশনের শুরুও হয় তার হাত ধরে। দীর্ঘ প্রায় ৫০ বছর তিনি একাধারে চিকিৎসা করেছেন, সার্জিক্যাল অপারেশন করেছেন। শিষ্যদের হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ করিয়েছেন এবং অসংখ্য বই লিখেছেন। শিষ্যদের তিনি ‘সন্তান’ বলে সম্বোধন করতেন এবং ডাক্তার ও রোগীর সুসম্পর্কের ওপর গুরুত্ব দিতেন। তার রচিত ২০ খন্ডের চিকিৎসাবিষয়ক বইয়ের শিরোনাম ‘কিতাব-ই তাশরিফ’। চিকিৎসার পাশাপাশি বিভিন্ন ওষুধ আবিষ্কার এবং ওষুধ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রেও তিনি অসামান্য অবদান রাখেন। বর্তমান বিশ্বে বহুল আলোচিত সৌন্দর্যচর্চার রূপকার ছিলেন আল জাহারাউই। এ বিষয়ে তার লেখা বইয়ের নাম ‘অদউইয়াত অল জিনাহ’, যার অর্থ মেডিসিন অব বিউটি বা সৌন্দর্যের ওষুধ। সুগন্ধির প্রতি তার ছিল দুর্বার আকর্ষণ। তার হাত ধরেই বর্তমান পারফিউম, আতর বডি স্প্র্রে, ধূপকাঠি, আগরবাতি এমনকি লিপস্টিকের আদি রূপ আবিষ্কৃত হয়।

শরীরের রগ নিয়ে অপারেশন পরবর্তী সেলাইর প্রচলন করেন আল জাহারাউই। জন্মগত রোগ এবং অস্বাভাবিক গর্ভধারণের চিকিৎসার ক্ষেত্রেও তিনি ছিলেন অগ্রপথিক। তিনিই প্রথম প্যারালাইসিস রোগের মূল কারণ নির্ণয়ে সাফল্য লাভ করেন। চোখের ছানি অপারেশন এবং বর্তমান বিশ্বে বহুল প্রচলিত সিজারিয়াল অপারেশনের জন্য সার্জিক্যাল যন্ত্রসহ অসংখ্য চিকিৎসাসামগ্রী বা মেডিকেল আবিষ্কারের জনক ছিলেন আল জাহারাউই। ব্যক্তিজীবনে তিনি ছিলেন অত্যন্ত ধার্মিক এবং হজরত মুহাম্মদ (সা.) বর্ণিত রোগ ও প্রতিকারমূলক ব্যবস্থার প্রতি বিশেষ আগ্রহী। চিকিৎসার ক্ষেত্রে তিনি মহানবী (সা.)-এর উপদেশ বা বাণী অনুসরণ করতেন। তার মৃত্যু বা সমাধিস্থল নিয়ে বিশেষ কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে ধারণা করা হয় যে, নিজ জন্মভূমি কর্ডোভাতেই ১০১০ সালে যে গৃহযুদ্ধ এবং লুটতরাজ হয়, তার আনুমানিক ২ বছর পর ১০১২ কিংবা ১০১৩ সালে মৃত্যুবরণ করেন জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সবার প্রিয় চিকিৎসক এবং চিকিৎসাবিজ্ঞান বিশেষত সার্জারির দিকপাল আল জাহারাউই।

 

ইবনে জহুর (১০৯৫-১১৬২)

১০৯৫ সালে তৎকালীন আন্দালুসিয়ার (বর্তমান স্পেন) সিভাইল অঞ্চলে সম্ভ্রান্ত বানু জহুর গোত্রে জন্মগ্রহণ করেন আবু মারওয়ান আবদুল মালিক ইবনে আবি আল আলা ইবনে জহুর (সংক্ষেপে ইবনে জহুর)। বানু জহুর মূলত আরব দেশের প্রসিদ্ধ গোত্র ছিল, যার একটি অংশ ইসলাম প্রচারের সময় আন্দালুসিয়া (স্পেন) গমন করে এবং সেখানেই স্থায়ী হয়। ইবনে জহুরের জন্মের প্রায় ১০০ বছর আগে থেকেই এই বানু জহুর গোত্র থেকে বহু ডাক্তার, কবি, বিচারক, প্রশাসক, পরামর্শক, রাজ্যের সভাসদ, সেবিকা আত্মপ্রকাশ করে এবং স্ব-স্ব ক্ষেত্রে প্রতিভার স্বাক্ষর রাখে। তাই ইবনে জহুরের পূর্ববর্তী ছয় বংশ (জেনারেশন) প্রতিভাবান পেশাজীবীদের আঁতুড়ঘর বলে বিবেচিত হতো। এই ১০০ বছরজুড়েই রাজ্যের এবং প্রশাসকদের চিকিৎসার মূল দায়িত্ব বানু জহুর গোত্রের চিকিৎসকদের ওপর ন্যস্ত ছিল।

আরব বিশ্বের প্রাচীন প্রথা অনুসারে ছোটবেলায় ইবনে জহুর ধর্মীয় শিক্ষা ও সাহিত্য রপ্ত ও চর্চা করতে থাকেন। পরবর্তীতে বাবা আবুল আলা জহুরের হাত ধরে তিনি চিকিৎসা বিষয়ে জ্ঞান অর্জন শুরু করেন। ইবনে জহুরের নিজের ভাষ্য অনুসারে তার পিতা তাকে প্রখ্যাত রোমান চিকিৎসক গ্যালেন এবং ‘ফাদার অব মেডিসিন’ খ্যাত গ্রিক চিকিৎসক হিপোক্রেটসের চিকিৎসা পদ্ধতির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। এ ছাড়াও চিকিৎসাসেবায় ব্রত থাকার লক্ষ্যে ‘হিপোক্রেটিক ওথ’ নামক শপথ বাক্য পাঠ করান।

চিকিৎসাশাস্ত্রে যথাযথ জ্ঞান লাভের পর তিনি মরক্কোর ‘আলমোরাভিদ’ সাম্রাজ্যে প্রধান ও রাজকীয় চিকিৎসক নিযুক্ত হন। তবে রহস্যজনক কারণে তিনি রাজপরিবার ছেড়ে জন্মভূমি সিভাইল চলে আসেন। এতে মরক্কোর ক্রুদ্ধ শাসক আলী বিন ইউসুফ বিন তাসুফিন তাকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠান। ১১৪০ থেকে ১১৫৭ সাল অর্থাৎ ৭ বছর কারাভোগের পর তিনি মুক্তি পান এবং নিজ ভিটায় চিকিৎসাসেবায় মনোনিবেশ করেন। তার রচিত বেশ কিছু বই চিকিৎসাবিজ্ঞানে কালজয়ী রূপে বিবেচিত। এর মধ্যে ‘কিতাব আল ইকতিসাদ’, ‘কিতাব আল আঘাধিরা’ ‘কিতাব আল তায়সির’ বিশেষভাবে প্রসিদ্ধ।

ইবনে জহুর দেহ ও ত্বকের সৌন্দের্যের জন্য বিভিন্ন চিকিৎসাব্যবস্থা এমনকি প্লাস্টিক সার্জারির মাধ্যমে লম্বা নাক, মোটা ভ্রু এবং আঁকাবাঁকা দাঁত ঠিক করার কথা বলে গেছেন। বিভিন্ন প্রকার খাবার বিশেষত পুষ্টিকর খাবার, ফলমূল, মিষ্টি প্রভৃতির প্রতিক্রিয়ার কথাও তার রচনায় ওঠে আসে। খাদ্য হিসেবে সিংহ, সাপ ও বন্য পশুসহ বিভিন্ন জীবজন্তুর গোশত গ্রহণ এবং তার প্রতিক্রিয়া তুলে ধরেন ইবনে জহুর। বিভিন্ন ঋতুতে কী খাবার গ্রহণীয় কিংবা বর্জনীয়, সেই তথ্য রয়েছে তার রচনায়। জীবনের শেষপ্রান্তে তিনি ৩০ খন্ডে চিকিৎসাবিজ্ঞানে ইনসাইক্লোপিডিয়া লিখে গেছেন। প্রায় হাজার বছর আগে তিনি ক্যান্সারের পূর্বাভাস দিয়েছেন এবং স্যালাইনের মাধ্যমে দেহে খাদ্য উপাদান বা পানীয় প্রয়োগের প্রথা চালু করেন। তিনি বিভিন্ন ধরনের চর্মরোগ বিশেষত শ্বেতরোগ, ত্বকের ঘা নিয়ে আলোচনা করেছেন। এ আলোচনার সূত্র ধরেই আধুনিক মাইক্রোবায়োলজির যাত্রা শুরু হয়। যে কোনো ওষুধ এমনকি সার্জিক্যাল অপারেশন মানুষের দেহে প্রয়োগ করার আগে তা পশুর ওপর পরীক্ষা করার সফল প্রচলন করেন ইবনে জহুর। ১১৬২ সালে জন্মভূমি সিভাইলিতে মৃত্যুবরণ করেন এ মহান মুসলমান চিকিৎসক। বিভিন্ন ধর্মে তার অনুসারী, গুণগ্রাহী ও ভক্তের সন্ধান পাওয়া যায়।

 

 

সর্বশেষ খবর