শুক্রবার, ২৩ অক্টোবর, ২০২০ ০০:০০ টা

মুঘল আমলের মসজিদ

বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে দৃষ্টিনন্দন অনেক ধর্মীয় স্থাপনা ও মসজিদ। প্রাচীন এসব স্থাপনা দেখে আমাদের মন জুড়িয়ে যায়। মসজিদগুলোর অধিকাংশ প্রতিষ্ঠা পায় মুঘল আমলে। আমরা মুগ্ধ হই মুঘল আমলের সেইসব নির্মাণশৈলী দেখে। এ দেশে ইসলামের প্রচার ও প্রসারে এসব মসজিদের অবদান অনেক। প্রাচীন কয়েকটি মসজিদ নিয়ে আজকের আয়োজন।

মোস্তফা কাজল

মুঘল আমলের মসজিদ

ইলশা বখশী হামিদ মসজিদ (চট্টগ্রাম)

সাড়ে চার শ বছরের পুরনো মসজিদটি নির্মিত হয়েছে ইট, পাথর ও সুরকির ব্যবহারে। ইসলাম ধর্মের প্রচার ও প্রসারের ক্ষেত্রে এটি একটি মাইলফলক হিসেবে সমাদৃত। ইসলামী সভ্যতা-সংস্কৃতির বিকাশে এই মসজিদ গুরুত্বপূর্ণ  ভূমিকা রাখে

ইতিহাস থেকে জানা যায়, আরব সাগর পাড়ি দিয়ে মুঘল আমলে ধর্ম প্রচারকগণ এসেছিলেন ইসলাম ধর্মের শাশ্বত বাণী প্রচারের লক্ষ্যে। চট্টগ্রামের উপকূলীয় অঞ্চলে তারা প্রথমে বসতি স্থাপন করেন। সেজন্য এসব এলাকায় রয়েছে বহু প্রাচীন মসজিদ এবং মাদ্রাসাসহ ইসলামিক নিদর্শন। বাঁশখালীর মধ্য ইলশা বখশী হামিদ মসজিদও তেমনি একটি ঐতিহ্যবাহী মসজিদ। মসজিদটি অন্যতম প্রাচীন ইসলামিক নিদর্শন। সাড়ে চার শ বছরের পুরনো মসজিদটি নির্মিত হয়েছে ইট, পাথর ও সুরকির ব্যবহারে। ইসলাম ধর্মের প্রচার-প্রসারের ক্ষেত্রে এটি একটি মাইলফলক হিসেবে সমাদৃত। ইসলামী সভ্যতা-সংস্কৃতির বিকাশে এই মসজিদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। মুসলিম শিক্ষা-সংস্কৃতির ভিত রচনা করে এই মসজিদ। এটি নির্মিত হয় সেই বাদশাহর যুগে যাকে উপাধি দেওয়া হয় দ্বীন এবং মিল্লাতের সুলতানুল মুয়াজ্জম তথা-মহান সম্রাট। তিনি হলেন সুলাইমান কররানি (আল্লাহ তাকে বিপদাপদ থেকে মুক্ত রাখুন) তারিখ ৯৭৫ হিজরির ৯ রমজান। যা ইংরেজি তারিখ ১৫৬৮ সালের ৯ মার্চের সঙ্গে মিলে যায়। শিলালিপির বক্তব্য মতে, এটি সুলাইমান কররানি কর্তৃক প্রতিষ্ঠা করার কথা থাকলেও লোকমুখে বখশী হামিদের নির্মিত মসজিদ বলে পরিচিত।

স্থানীয় মুরব্বিরা বলেন, বখশী হামিদের পুরো নাম মুহাম্মদ আবদুল হামিদ। বখশী তাঁর উপাধি। বখশী ফার্সি শব্দ। এর অর্থ কালেক্টর বা করগ্রহীতা। তৎকালীন সময়ে বখশী হামিদ এ অঞ্চলের কালেক্টর বা প্রশাসক ছিলেন। তিনি এলাকার শিক্ষা, সভ্যতা, সংস্কৃতির ব্যাপক উন্নতি করেন। জনশ্রুতি আছে, তৎকালীন এ এলাকায় প্যারাবন ছিল। ঝোপঝাড়ে জনবসতি ছিল না। ইউসুফ ও কুতুব নামে গৌড়ের দুজন আমির শাহ আবদুল করিম নামক জনৈক সুফির সঙ্গে উপযুক্ত বাসস্থানের সন্ধানে বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়ে বাঁশখালীর এই জায়গায় আসেন। তারা উপকরণ নিয়ে বাঁশখালীর ইলশার দরগাহ বাড়ির স্থানে পৌঁছলে শাহ সাহেব ইল্লাল্লাহ শব্দ উচ্চারণ করে তার ছড়ি পুঁতে রাখেন। সেখানে বসবাসের ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। এ সময় থেকে স্থানটি ইল্লাল্লাহ শাহের স্থান এবং পরে ইলশায় রূপান্তরিত হয়। বখশী আবদুল হামিদ ওই শাহের অধস্তন বংশধর। কেউ কেউ মনে করেন, গৌড় থেকে আগত সুফি-দরবেশের মধ্যে একজন ছিলেন সুলাইমান। তিনি নেতৃস্থানীয় ও সাধক ছিলেন। জ্ঞানে-গুণে অসাধারণ বিচক্ষণ ও প্রভাবশালী ছিলেন। সবাই তাকে সুলতান বলে ডাকত। তিনি এ মসজিদ নির্মাণের উদ্যোগ নেন। পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের পর মুরব্বির প্রতি সম্মান প্রদর্শনার্থে একমাত্র কন্যাকে উপজেলার জলদী গ্রামে বিয়ে দেওয়া হয়। তার দুই ভাই ছিল।

এ অঞ্চলের মাটি খুঁড়লে আজও প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন খুঁজে পাওয়া যায়। অলি বুজুর্গের আবাদকৃত এ গ্রামে বহু দ্বীনদার পীর-মাশায়েখের আবির্ভাব হয়েছিল। তার মধ্যে শাহ চান মোল্লা অন্যতম। তিনি এ মসজিদ নির্মাণের সমসাময়িক যুগের বলে অনেকের ধারণা। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৫ সালে এটি ‘প্রটেকটেড মনুমেন্ট অ্যান্ড মৌন্ডস ইন বাংলাদেশ’-এর তালিকায় স্থান পাওয়ায় কিছু সংস্কার হয়েছে। মোগল স্থাপত্য কৌশলে নির্মিত মসজিদটি তিন মিনার বিশিষ্ট। মাঝেরটি অপেক্ষাকৃত বড় এবং ছোট মিনার দুটি ধনুকের মতো করে ছাদের সঙ্গে যুক্ত।

মসজিদের পূর্ব পার্শ্বে প্রাচীনকালের শান বাঁধানো একটি বড় পুকুর রয়েছে। পুকুরের পানি ব্যবহার করে মুসল্লিরা অজু করেন। মসজিদের পশ্চিমে কবরস্থান উত্তর-পূর্বে গড়ে উঠেছে বড় মাদ্রাসা ও এতিমখানাসহ ইসলামী কমপ্লেক্স। এই কমপ্লেক্সের নাম রাখা হয় দারুল কোরআন মুহাম্মদিয়া শাহ আবদুল হামিদ মাদ্রাসা ও এতিমখানা। প্রতি শুক্রবার জুমার নামাজ আদায় করার জন্য দূর-দূরান্ত থেকে হাজার হাজার ধর্মপ্রাণ মুসল্লি সমাবেত হন এই মসজিদে। বর্তমানে মসজিদটি নান্দনিকভাবে নতুন সাজে সজ্জিত করে গড়ে তুলেছেন মাওলানা আবদুল হামিদ (দা.বা.)। মসজিদটি পরিদর্শন করেছেন বহু গবেষক ও ইসলামী চিন্তাবিদ। প্রতি জুমায় নামাজ আদায়সহ বহু মানুষ ঐতিহাসিক মসজিদটি পরিদর্শনে আসেন।

 

 

চান্দামারী মসজিদ (কুড়িগ্রাম)

কালের সাক্ষ্য বহন করছে আনুমানিক ৪০০ বছর আগের কুড়িগ্রাম জেলার চান্দামারী মসজিদ। মসজিদটি মোগল আমলের শিল্পবৈশিষ্ট্য ও স্থাপত্যকলার সমন্বয়ে নির্মিত। এটি কুড়িগ্রাম জেলার রাজারহাট উপজেলা সদর থেকে তিন কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে চান্দামারী মন্ডলপাড়া গ্রামে অবস্থিত। স্থাপনাটির স্থাপত্যশৈলী প্রাচীন মোগল আমলের স্থাপনার সঙ্গে মিল থাকায় ধারণা করা হয়, মসজিদটির নির্মাণকাল আনুমানিক ১৫৮৪ থেকে ১৬৮০ সালের মধ্যবর্তী সময়ে। স্থানীয়রা জানান, চান্দামারী মসজিদটি কবরস্থানসহ ৫২ শতক জায়গাজুড়ে অবস্থিত। ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ধারক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মসজিদটির দৈর্ঘ্য ৪০ ফুট এবং প্রস্থ ২০ ফুট।

এর নির্মাণকাজে ‘ভিসকাস’ নামে এক ধরনের আঠালো পদার্থ ব্যবহার করা হয়। এর সামনের দিকে পাঁচ ফুট উঁচু তিনটি বড় দরজা আছে। আরও আছে তিনটি বড় মিনার। যার ব্যাসার্ধ প্রায় ৫.৫০ ফুট। মিনারগুলোর গায়ে রয়েছে দৃষ্টিনন্দন নকশা। চার কোনায় চারটি মাঝারি আকৃতির মিনার ও চারদিকে ঘিরে আছে আরও ১৬টি ছোট মিনার। ভিতরে তিনটি মেহরাব আছে। মসজিদের গায়ে অনেকগুলো খিলান আছে। এ ছাড়া বাতাস চলাচলের জন্য উত্তর ও দক্ষিণ দিকে একটি করে জানালা আছে। মসজিদ পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক আজহার ম-ল বলেন, মসজিদে জুমার নামাজে বহু মুসল্লির আগমন ঘটে। এটি দেখার জন্য দেশের বিভিন্ন এলাকার দর্শনার্থীও আসেন।

মসজিদটির স্মৃতি সংরক্ষণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে প্রতœতত্ত্ব বিভাগের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে।

 

বিনত বিবির মসজিদ (ঢাকা)

এটি হচ্ছে রাজধানীর ৫৬৪ বছরের পুরনো মসজিদ। ঢাকার সবচেয়ে প্রাচীন মসজিদ হিসেবে পরিচিত। মসজিদে খোদিত শিলালিপি থেকে জানা যায়, এটি পাঠান রাজা নাসিরুদ্দিন মাহমুদ শাহের আমলে ১৪৫৬ সালে নির্মিত হয়

এত মসজিদের ভিড়ে যদি জানতে ইচ্ছা করে ঢাকার অন্যতম প্রাচীন মসজিদ কোনটি? এর উত্তর পেতে হলে যেতে হবে পুরান ঢাকার নারিন্দা এলাকার ধোলাইখাল মোড় থেকে দয়াগঞ্জ যেতে মাঝামাঝি নারিন্দা মোড়। পুরান ঢাকার ৬ নম্বর নারিন্দা রোডের অতি প্রাচীন ‘হায়াৎ বেপারী’র পুলের উত্তর দিক থেকে ৫০ গজ পেরোলেই দেখা মিলবে স্বগর্বে দাঁড়িয়ে থাকা একটি প্রাচীন মসজিদ। নাম বিনত বিবির মসজিদ। এটি হচ্ছে রাজধানীর ৫৬৪ বছরের পুরনো মসজিদ। ঢাকার সবচেয়ে প্রাচীন মসজিদ হিসেবে পরিচিত। মসজিদে খোদিত শিলালিপি থেকে জানা যায়, এটি পাঠান রাজা নাসিরুদ্দিন মাহমুদ শাহের আমলে ১৪৫৬ সালে নির্মিত হয়। ছোট এ মসজিদটির গঠন সুদৃঢ়। যতীন্দ্রমোহন রায়ের ‘ঢাকার ইতিহাস’ গ্রন্থে এই মসজিদের উল্লেখ রয়েছে। মসজিদের অবস্থান অবশ্য এটাও প্রমাণ করে, ১৪৫৬ সালের আগে থেকেই এই এলাকায় মুসলমানদের বসবাস ছিল। মসজিদটি ছয়-সাত কাঠা জায়গার ওপর দাঁড়িয়ে আছে। মসজিদের আদি গঠন একটি কেন্দ্রীয় গম্বুজ এবং চার কোণ বিশিষ্ট হলেও বাংলা ১৩৩৭, ইংরেজি ১৯৩০ সালে দ্বিতীয়বার সংস্কারকালে আরও একটি গম্বুজ যুক্ত করা হয়। যা মসজিদটির বিবর্তন ও সম্প্রসারণের স্পষ্ট ধারণা  দেয়। এর দেয়ালে স্থাপিত একটি কালো পাথরে ফারসি ভাষায় লিখিত বর্ণনায় রয়েছে, সুলতান নাসিরুদ্দিন মাহমুদ শাহর আমলে আরকান আলী নামক এক পারস্য সওদাগর ব্যবসায়িক প্রয়োজনে ঢাকার নারিন্দায় বসবাস শুরু করেন। তিনিই ৩০-৪০ জন মুসল্লির ধারণক্ষমতা সম্পন্ন বিনত বিবির মসজিদ নির্মাণ করেন। ঢাকায় বসবাসকালেই আরকান আলীর অতি আদরের কন্যা বিনত বিবির আকস্মিক মৃত্যু হয়। তাকে ওই মসজিদ-সংলগ্ন স্থানে সমাহিত করা হয়। কন্যার আকস্মিক মৃত্যুতে শোকে-দুঃখে পিতা আরকান আলীও ছয় মাস পর মারা যান এবং তাকে কন্যার কবরের পাশে সমাহিত করা হয়। বিনত বিবির মসজিদের গায়ে বসানো একটি শিলালিপি থেকে জানা যায়, ৮৬১ হিজরি, ইংরেজি ১৪৫৬ সালে এটি নির্মাণ করা হয়। সেই হিসাবে মসজিদটি সুলতানি আমলের। ঐতিহাসিক আহমদ হাসান দানী লিখেছেন, এটি সুলতানি আমলে নাসিরুদ্দিন মাহমুদের রাজত্বকালে (১৪৩৫-১৪৫৯) নির্মিত হয়। মসজিদের ১০ গজ দূরেই আছে বিনত বিবি ও তার পিতার মাজার।

 

মসজিদকুড় (খুলনা) 

১৪৫০-১৪৯০ সালের মাঝামাঝি নির্মিত নয় গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদটি দক্ষিণ বাংলার অন্যতম প্রাচীন প্রত্নসম্পদ।

নয় গম্বুজ মসজিদটি খুলনার কয়রা উপজেলার গ্রাম আমাদিতে অবস্থিত। এ মসজিদটি কপোতাক্ষ নদের পূর্ব পাড়ে। ধারণা করা হয়, হজরত খানজাহান আলীর (রহ.) শিষ্য বুড়া খান ও ফতেহ খান এ গ্রামে কাছারি করে এলাকা শাসন করতেন। সময়কাল ছিল ১৪৫০-১৪৯০ সালের মাঝামাঝি। তারা এখানে একটি ৯ গম্বুজ মসজিদ নির্মাণ করেন। নাম রাখেন মসজিদকুড়। ইট-সুরকির তৈরি মসজিদটি দক্ষিণ বাংলার অন্যতম প্রাচীন প্রত্নসম্পদ।

মসজিদের দক্ষিণ দিকে বুড়া খান ও ফতেহ খানের কাছারিবাড়ি ও সমাধি ছিল। এর অনেকটাই কপোতাক্ষের বন্যায় ধুয়েমুছে গেছে। মূল মসজিদও এক সময় পলিতে তলিয়ে যায়। পুরো এলাকা জঙ্গলে পরিণত হয়। জীবজন্তুর ভয়ে মানুষ মসজিদে যেতে সাহস করতেন না। বিশ শতকের শুরুতে এলাকার মানুষ মসজিদটি উদ্ধার করেন। তারা প্রয়োজনীয় সংস্কারও করেন। বর্গাকার এই মসজিদের প্রতি পাশের মাপ হচ্ছে ১৬ দশমিক ৭৬ মিটার। ভিতরের মাপ ১২ দশমিক ১৯ মিটার। পশ্চিমমুখী দেয়াল বাদে বাকি তিন দেয়ালে মসজিদে  ঢোকার জন্য তিনটি করে খিলান প্রবেশদ্বার আছে। মাঝের প্রবেশদ্বারগুলো অপেক্ষাকৃত বড়। পশ্চিমমুখী দেয়াল-সংলগ্ন অর্ধবৃত্তাকার মিহরাব তৈরি করা হয়। মাঝের মিহরাব অপেক্ষাকৃত বড়।

মসজিদের ভিতরে চারটি স্তম্ভের ওপর ছাদ ভর করে আছে। এ চারটি স্তম্ভ মসজিদের ভিতরের অংশকে ৯টি সমবর্গক্ষেত্রে ভাগ করেছে। বর্গক্ষেত্রগুলো গম্বুজ দিয়ে ঢাকা। মসজিদটি এক সময় টেরাকোটা দিয়ে সজ্জিত ছিল। এখন এগুলোর অনেকটাই খসে পড়েছে। অনেকগুলো খোয়া গেছে। আমাদির মসজিদকুড় মসজিদের নকশার সঙ্গে পাদুয়ার আদিনা মসজিদের পাশে সিকান্দার শাহর ৯ গম্বুজ সমাধির নকশার মিল দেখা যায়। অবশ্য বাগেরহাটে খানজাহান আলী (রহ.) নির্মিত ইমারতগুলোর নকশাও প্রায় একই ধরনের। মসজিদটি বর্তমানে বাংলাদেশ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের তত্ত্বাবধানে আছে।

 

উচাইল শাহী মসজিদ (হবিগঞ্জ) 

স্থাপত্যশিল্পের অনন্য নিদর্শন হবিগঞ্জের উচাইল শংকরপাশা শাহী মসজিদ (গায়েবি মসজিদ)। মসজিদটি সুলতানি আমলের স্থাপত্য নিদর্শনগুলোর অন্যতম। সদর উপজেলার রাজিউরা ইউনিয়নের উচাইল গ্রামে প্রায় ছয় একর জমির ওপর কালের সাক্ষী হয়ে আছে মসজিদটি। অত্যন্ত চমৎকার কারুকাজ আর নির্মাণশৈলীর সমন্বয়ে এটি নির্মিত হয়েছে। উন্নতমানের প্রলেপহীন পোড়া ইট কেটে সেঁটে দেওয়া হয়েছে ইমারতে। দেয়ালের বাইরের অংশে পোড়া ইটের ওপর বিভিন্ন নকশা এবং অলঙ্করণ সহজেই মুসল্লি ও দর্শনার্থীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে। মসজিদটি লাল বা রক্তিম বলে অনেকে ‘লাল মসজিদ’ বলে থাকেন। আবার টিলার ওপরে বলে ‘টিলা মসজিদ’ও বলা হয়। দুটি মিলিয়ে ‘লালটিলা মসজিদ’ও বলা হয়। তবে অনেকের কাছে এটি গায়েবি মসজিদ নামে পরিচিত। জানা যায়, ১৫১৩ সালে মসজিদটি নির্মাণ করেন শাহ মজলিশ আমিন (রা.)। পরবর্তীতে মসজিদের সুদৃশ্য ইমারত বা ভবন নির্মাণ করা হয় সুলতান আলাউদ্দিন হুসেন শাহের আমলে। ইমারতটির দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ একই মাপের (২১ ফুট ৬ ইঞ্চি)। বারান্দা সাড়ে তিন ফুটের বেশি।

 একে অনেকে চার মিনার মসজিদ বলে থাকেন। কেননা মূল ভবনের ওপর একটি বড় মিনার এবং বারান্দার ওপর দেখতে পাওয়া যায় তিনটি ছোট মিনার। দরজা-জানালা আছে ১৫টি। দরজা ও জানালা প্রায় একই আকৃতির। সব দিকের দেয়ালের পুরুত্ব পাঁচ ফুটের বেশি। পশ্চিম দিকের দেয়ালের পুরুত্ব প্রায় ১০ ফুট। মসজিদে ছয়টি কারুকার্য শোভিত স্তম্ভ আছে। প্রধান কক্ষের চার কোণে ও বারান্দার দুই কোণে। উপরের ছাদ আর প্রধান প্রাচীরের কার্নিশ নির্মাণ করা হয়েছে বাঁকানোভাবে। মসজিদের দক্ষিণ পাশে রয়েছে বড় দিঘি। এটি মসজিদের সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। ধর্মীয় বিশেষ দিনগুলোতে এখানে বেশি ভিড় হয়। তবে প্রয়োজনীয় রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ঐতিহ্যবাহী মসজিদটি ক্রমেই ঐতিহ্য হারাচ্ছে।

 

আতিয়া জামে মসজিদ (টাঙ্গাইল)

টাঙ্গাইলের প্রত্নতত্ত্ব নিদর্শনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে আতিয়া জামে মসজিদ। টাঙ্গাইল শহর থেকে আট কিলোমিটার দূরে দেলদুয়ার উপজেলায় এর অবস্থান। সারা বছর হাজার হাজার দর্শনার্থীর আগমন ঘটে এখানে। ‘আতিয়া’ আরবি শব্দ; ‘আতা’ থেকে উৎপত্তি। যার অর্থ হলো ‘দান’। পঞ্চদশ শতকে আদম শাহ্ বাবা কাশ্মীরি নামে বিখ্যাত এক সুফি ধর্ম প্রচারক এ অঞ্চলে আসেন। তিনি এখানেই বসবাস করেন। তাঁর মৃত্যু হয় ১৬১৩ সালে। এই সাধকের মাজার আতিয়াতেই অবস্থিত। তিনি বাংলার সুলতান আলাউদ্দিন হুসেন শাহ কর্তৃক আতিয়ার জায়গিরদার নিযুক্ত (১৫৯৮ সালে) হয়েছিলেন বলে জানা যায়। ওই সময় কররানি শাসক সোলাইমান কররানির কাছ থেকে তাঁর ধর্মীয় কর্মকান্ড পরিচালনার ব্যয়ভার বহনের জন্য বিশাল একটি এলাকা ওয়াকফ হিসেবে পান। ধারণা করা হয়, তাঁকে এই এলাকা দান করায় ‘আতা’ থেকে এ পরগনার নাম ‘আতিয়া’ হয়েছে। শাহ্ বাবা কাশ্মীরির বৃদ্ধ বয়সে তাঁর পরামর্শে প্রিয় ভক্ত সাঈদ খান পন্নীকে মুঘল বাদশাহ জাহাঙ্গীর আতিয়া পরগনার শাসনকর্তা নিয়োগ করেন।

সাঈদ খান পন্নী ১৬০৮ সালে আতিয়া মসজিদ নির্মাণ করেন। সুলতানি ও মোগল আমলের স্থাপত্য শিল্পরীতির সমন্বয়ে নির্মিত এ মসজিদের পরিকল্পনা ও নির্মাণ কাজে নিযুক্ত ছিলেন প্রখ্যাত স্থপতি মুহাম্মদ খাঁ। মসজিদটি নির্মাণের পর ১৮৩৭ সালে রওশন খাতুন চৌধুরানী ও ১৯০৯ সালে আবুল আহমেদ খান গজনবী সংস্কার করেন। মসজিদটির কিবলাকোটা ও বারান্দাসহ সার্বিক পরিমাণ ১৭.৭০ মিঃ ১২ মিটার। মসজিদের দেয়াল ২.২২ মিটার প্রশস্ত। বারান্দা ৩.৮২ মিটার। মসজিদের চার কোণে চারটি বিরাট অষ্টকোণাকৃতির মিনার রয়েছে। মিনারগুলো ছাদের অনেক উপরে উঠে ছোট গম্বুজে শেষ হয়েছে। বাংলার স্থাপত্যসমূহ মূলত ইটের তৈরি। কারণ পাথর এ এলাকায় সহজলভ্য ছিল না। এ মসজিদে সুলতানি স্থাপত্য বৈশিষ্ট্যে যেমন বক্রাকার কার্নিশে, দ্বিকেন্দ্রিক সুচালো খিলান, গম্বুজ নির্মাণে বাংলা পান্দান্তিভ এবং উল্লেখযোগ্যভাবে পোড়ামাটির টেরাকোটা ব্যবহার করা হয়েছে।

 

আতিয়া মসজিদের গম্বুজের নির্মাণশৈলীতে দেখা যায় কিবলা কক্ষের ওপর বড় গম্বুজটি খিলানভিত্তিক নির্মাণ পদ্ধতিতে (স্কুইঞ্জ পদ্ধতি) এবং বারান্দার ওপর ছোট তিনটি গম্বুজ ‘বাংলা পান্দান্তিভ’ পদ্ধতিতে নির্মিত। পরবর্তীতে সংস্কারের সময় গম্বুজগুলো পলেস্তারা দিয়ে সমান করে দেওয়া হয়েছে। তবে মসজিদ নির্মাণের সময় এমন ছিল না। আদিতে গম্বুজগুলো পলকাটা বা ঢেউতোলা ছিল। বাংলার সুলতানি এবং মুঘল উভয় স্থাপত্য বৈশিষ্ট্যের সমন্বয়ে নির্মিত আতিয়া জামে মসজিদ যুগসন্ধিলগ্নের মসজিদ স্থাপত্য-নিদর্শনরূপে চিহ্নিত। বাংলাদেশে যেসব ঐতিহ্যবাহী মুসলিম স্থাপনা রয়েছে তার মধ্যে আতিয়া জামে মসজিদ অন্যতম উল্লেখযোগ্য কীর্তি। টাঙ্গাইল অঞ্চলে প্রাপ্ত মূল শিলালিপির মধ্যে আতিয়া জামে মসজিদে প্রাপ্ত একটি আরবি একটি ফারসি শিলালিপি রয়েছে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর