শুক্রবার, ১৩ নভেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

যে থাকে আঁখি পল্লবে

ফরিদুর রেজা সাগর

যে থাকে আঁখি পল্লবে

হুমায়ূন আহমেদের মূল পরিচয় তিনি লেখক। অবিস্মরণীয় জনপ্রিয় লেখক। বাংলাদেশের যে কোনো পরিবারে খোঁজ করলে তাঁর রচিত কোনো না কোনো বই পাওয়া যাবে। হিমু বা মিসির আলি তাঁর চরিত্র। হুমায়ূন আহমেদ নিয়মিতভাবেই বই লিখতেন। প্রকাশকরা বই প্রকাশ করেন। তারপর আরেকটি নতুন কোনো বই নিয়ে হুমায়ূন আহমেদ ভাবতেন।

বইয়ের চেয়ে নাটক ও চলচ্চিত্র নির্মাণের ব্যাপারে দেখেছি তাঁর বিপুল উৎসাহ। স্ক্রিপ্ট লেখা থেকে শুরু করে শুটিং, রিহার্সেল, এডিটিং সবকিছুতেই তিনি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সংযুক্ত থাকতেন। তিনি শুটিংয়ে সশরীরে উপস্থিত থাকতেন। শর্ট ‘ওকে’ করতেন।

নাটক-চলচ্চিত্র নির্মাণে তাঁর অন্যরকম ভালোবাসা। নিজের প্রকাশিত বই নিয়ে তাঁকে সবসময় উচ্ছ্বসিত হতে দেখিনি। কিন্তু নাটক বা চলচ্চিত্র নিয়ে উচ্ছ্বাসের শেষ নেই।

চলচ্চিত্র নির্মাণ শেষে সবাই মিলে সেটা দেখা হতো। হয়তো এভাবে নানাজনের সঙ্গে একই চলচ্চিত্র ২০/২৫ বার তিনি দেখতেন। আমি হয়তো তিন-চারবার একই চলচ্চিত্র তাঁর সঙ্গে দেখলাম। তখন দেখেছি, কী গভীর ও একাগ্রচিত্তে পর্দার দিকে তিনি তাকিয়ে আছেন। বারবার দেখতেন। কোথাও ভুলত্রুটি মনে হলে আমাকে বলতেন, সাগর তুমি আর কিছু টাকা দিলে আরও ভালো হতো দৃশ্যটা।

আমি বলতাম, যত টাকা লাগে সামর্থ্য অনুযায়ী দেব।

কিন্তু কাজ করতে গিয়ে বুঝেছি, টাকা-পয়সা নিয়ে তিনি কখনো ভাবেননি। টাকার জন্য কখনো কাজে আপস করেননি। লেখালেখি বা ছবি নির্মাণের ব্যাপারে অর্থকড়ি বা বাণিজ্যের বিষয়টা তিনি ভাবতেন না। কাজের প্রতি তাঁর ছিল তীব্র ভালোবাসা। অনেক ভালোবাসা ছিল বলেই তিনি প্রচ- রাগও করতেন। একটা স্মৃতি এ মুহূর্তে মনে পড়ছে।

আমরা ‘আমার আছে জল’ ফিল্মটি প্রযোজনা করছি। নির্মাণের মহান কারিগর হুমায়ূন আহমেদ পরিচালিত সেই ছবির শুটিং হচ্ছে সিলেটে। নাম ভূমিকায় চ্যানেল আই লাক্স সুন্দরী বিদ্যা সিনহা মীম। দুই দিন পরে স্যার খুব গম্ভীর কণ্ঠে ফোন দিয়ে বললেন, 

সাগর, ইচ্ছে করে তুমি আমাকে ঝামেলায় ফেলেছ। আমি আর শুটিং করব না। প্যাক আপ।

কেন স্যার? কেন স্যার?

যে মেয়েকে তোমরা নায়িকা হিসেবে পাঠিয়েছ সে তো নানা ঝামেলা তৈরি করছে। ইউনিটের খাবার সে খেতে পারে না।

আমি আর ইবনে হাসান খান অনেক কষ্টে সেবার স্যারকে ম্যানেজ করলাম। হুমায়ূন আহমেদের কথাবার্তায় খুব নিজস্বতা ছিল। তিনি বিশ্বাস করতেন, যারা তাঁর পরিচিত তারা তাঁর লেখা সব বই হয়তো পড়েছে। এ প্রসঙ্গে মনে পড়ে, নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু পরিচালিত ‘গেরিলা’ ছবির উদ্বোধনী শোতে স্যার এসেছেন।

বাচ্চু ভাইকে দেখেই তিনি স্বভাবসুলভভাবে বললেন,

আমার উপন্যাস নিয়ে ছবি করলেন না কেন? সৈয়দ শামসুল হকের বই পছন্দ করলেন কেন?

বাচ্চু ভাই সলজ্জ জবাব দিলেন, আপনার কাহিনি থেকেও নিশ্চয়ই ছবি করব।

হুমায়ূন আহমেদ জানতেন সবাই তাঁর বই খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ে। সিলেট থেকে আবার একদিন ফোন এলো,

সাগর- তুমি  যে আমার বই পড়নি সেটা ভেবে খুব কষ্ট পাচ্ছি।

আমি থতমত খেয়ে গেলাম।

হাসানও আমার বই পড়েনি। খুবই দুঃখ পেয়েছি।

কেন স্যার?

তোমরা তো ‘আমার আছে জল পড়নি’। ছবিটা প্রযোজনা করছ।

কেন স্যার? আবার জানতে চাই।

তোমরা তো জানাবে আমাকে যে, মেয়েটি সাঁতার জানে না। বইটা তোমাদের পড়া থাকলে বুঝতে পারতে, শেষ দৃশ্যে মেয়েটা পানিতে ভাসবে। এই মেয়েটা সেই দৃশ্যে কীভাবে ভেসে থাকবে? আমি আর শুটিং করব না। অসম্ভব।

আমি নিম্নকণ্ঠে বললাম,

স্যার, লাক্সের সঙ্গে আমাদের চুক্তি আছে।

আমি আগামীকালই প্যাক আপ করে ঢাকা ফিরব।

আমি আর হাসান নিরুত্তর। কী বলব স্যারকে?

তবে আসাদুজ্জামান নূর বললেন, ভয় পেও না সাগর। হুমায়ূনের রাগ বেশিক্ষণ থাকে না।

তাঁর কথাই সত্যি হলো। পরদিন পুকুরের পানিতে বাঁশের মাচান লাগানো হলো। সেই মাচানে ডুবো পানিতে মীমের ভেসে থাকার মৃত্যু দৃশ্য তৈরি হলো। বুদ্ধিটা স্যারের। খুব সহজেই শুটিং হয়ে গেল। একেবারে নির্ঝঞ্ঝাট।

ফিল্মের প্রতি ছিল তাঁর গভীর ভালোবাসা। তিনি উত্তেজিত হতেন। রাগ করতেন। সবই ভালো ফিল্মের জন্য। তিনি তরুণ নির্মাতা, অভিনেতা, অভিনেত্রীদের ব্যাপারে খুব উদার ছিলেন। নিজের কাহিনি নিয়ে ফিল্ম তৈরির জন্য তিনি তরুণ পরিচালকদের অকাতরে অনুমতি দিতেন।

আবু সাইয়ীদ ‘নিরন্তর’, এবং তৌকীর আহমেদ ‘দারুচিনি দ্বীপ’ নির্মাণ করেছিলেন হুমায়ূন আহমেদের কাহিনি অবলম্বনে। 

আমাদের সঙ্গে নিয়ে তিনি শেষ ছবি নির্মাণ করেছিলেন ‘ঘেঁটুপুত্র কমলা’।

আমি বললাম, স্যার- এমন জটিল ও অসামাজিক কাহিনি। আমাদের সমাজ কি এর জন্য প্রস্তুত?

স্যার বললেন, আমার ওপর ছেড়ে দাও। সেটা আমি বুঝব।

যারা ‘ঘেঁটুপুত্র কমলা’ দেখেছেন তারাই জানেন এর নির্মাণশৈলী কত নিখুঁত ও অসাধারণ।

আরেকটি ছবির কথা ‘শ্যামল ছায়া’।

সেই ছবিতে একটা চরিত্র ছিল বোরকা পরা। শেষ দৃশ্যে মেয়েটা শুধু বোরকা খোলে। তার মুখ দেখা যায়। দর্শকরা এ দৃশ্য দেখে আহা, আহা করে ওঠে। প্রথমে চরিত্রটির জন্য পূর্ণিমাকে ঠিক করা হয়। কিন্তু সারাক্ষণ বোরকা পরে থাকতে হবে। চেহারা দেখা যাবে না। পূর্ণিমা রাজি হননি। ফিল্ম মুক্তির পর পূর্ণিমা হয়তো এখনো আফসোস করেন।

হুমায়ূন আহমেদ শুটিংয়ের ফাঁকে একবার আমাকে বলেছিলেন,

আমি সিনেমা বানাই কেন জান? আমার ‘কথাসাহিত্যিক’ পরিচয়ের বাইরে গীতিকার পরিচয়ে আমি আনন্দ পাই। ফিল্ম বানালে নিজের গান নিজে শুটিং করি। আমি তো গীতিকার হতে চাই।  ফিল্মের প্রতি এমন ভালোবাসার মানুষের আর কি দেখা পাব?

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর