শুক্রবার, ২৫ ডিসেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

মসজিদের দেশ বাংলাদেশ

মোস্তফা কাজল

মসজিদের দেশ বাংলাদেশ

মসজিদ অর্থ সিজদার স্থান। যে কোনো মসজিদ মুসলিম সমাজের অন্যতম পবিত্র স্থান। মুসলিম ঐতিহ্য, স্থাপত্যকৌশল, বিজয়স্মারক এবং শিক্ষা ও প্রশাসনিক বহুবিধ উজ্জ্বলতায় মসজিদের সবিশেষ ভূমিকা রয়েছে। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই মসজিদগুলো আল্লাহর।’ (সুরা জিন, আয়াত : ১৮)। বাংলাদেশ হলো মসজিদকেন্দ্রিক সমাজের আদর্শ। বাংলাদেশের লালমনিরহাট জেলার পঞ্চগ্রাম ইউনিয়নের রামদাস গ্রামের জঙ্গলে ১৯৮৭ সালে আবিষ্কৃত হয় প্রাচীন মসজিদের ধ্বংসাবশেষ। জঙ্গলটি খনন করে একটি ইট পাওয়া যায়। এতে কালেমা তাইয়েবা ও ৬৯ হিজরি লেখা রয়েছে। হিজরি ৬৯ মোতাবেক ৬৯০ খ্রিস্টাব্দ। রংপুর জেলার ইতিহাস গ্রন্থ থেকে জানা যায়, রসুল (সা.)-এর মামা, বিবি আমেনার চাচাতো ভাই আবু ওয়াক্কাস (রা.) ৬২০ থেকে ৬২৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বাংলাদেশে ইসলাম প্রচার করেন (পৃষ্ঠা ১২৬)। অনেকে অনুমান করেন, ৬৯০ খ্রিস্টাব্দের মসজিদটি আবু ওয়াক্কাস (রা.) নির্মাণ করেন। লালমনিরহাট জেলার এ প্রাচীন মসজিদ ও এর শিলালিপি দেখে জানতে পারি, বখতিয়ার খিলজির বাংলা বিজয়ের (১২০৪ খ্রি.) ৬০০ বছর আগেই বাংলা অঞ্চলে সাহাবির মাধ্যমে ইসলামের আবির্ভাব। মুসলিম ঐতিহ্যের জীবন্ত কিংবদন্তি বিভিন্ন দৃষ্টিনন্দন মসজিদ। এগুলো কোনো ধ্বংসাবশেষ নয়। বরং তাওহিদি চেতনায় সমুজ্জ্বল। বাংলাদেশে রয়েছে দুই থেকে আড়াই লাখ মসজিদ। এসব মসজিদ ইবাদতের কেন্দ্র ও পারলৌকিক মুক্তির দিশারি হিসেবে চিরকাল টিকে থাকবে। মুসল্লি ও স্থাপত্য সৌন্দর্যে যুগে যুগে হতে থাকবে সমৃদ্ধ। কেননা প্রিয় নবী (সা.) বলেছেন, কিয়ামতের কঠিন দিনে সাত শ্রেণির মানুষ মহান আল্লাহর ‘আরশের ছায়া’ লাভে ধন্য হবেন। এসব নিয়েই আজকের আয়োজন...

 

বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিময় শেখ জামে মসজিদ, নীলফামারী

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৫১ বছর ধরে স্মৃতি বহন করে চলেছে নীলফামারী সদরের শেখ জামে মসজিদ। খড়ের ঘর দেখে বঙ্গবন্ধু মসজিদটির তৎকালীন মোতাওয়াল্লি উমর শেখের হাতে ৫০০ টাকা দিয়ে বলেন, আমার জন্য দোয়া করবেন। আমার দল ক্ষমতায় এলে পাকা মসজিদ বানিয়ে দেব। ৫১ বছর আগে আইয়ুব খান বিরোধী আন্দোলনের প্রচারণায় অংশ নিতে নীলফামারী গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যাত্রাপথে সদর উপজেলার চড়াইখোলা ইউনিয়নের পশ্চিম কুচিয়ার মোড় ফকিরপাড়া গ্রামে একটি কুঁড়েঘরের মসজিদে সফর সঙ্গীদের নিয়ে নামাজ আদায় করেছিলেন তিনি। তখন ওই মসজিদের কোনো নামও ছিল না। নামাজ শেষ করে তিনি সেখানে একটি পাকা মসজিদ বানিয়ে দেবেন বলে এলাকাবাসীকে কথা দিয়েছিলেন। ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর কথা রেখেছিলেন বঙ্গবন্ধু। তাঁর নামানুসারে ওই মসজিদের নাম রাখা হয় শেখ জামে মসজিদ। সেদিনের চারচালা কুঁড়েঘরের মসজিদটি এখন মডেল মসজিদে পরিণত হয়েছে। পাঁচ দশক ধরে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালির স্মৃতি বহন করে চলেছে মসজিদটি। এলাকাবাসী জানান, ১৯৬৯ সালের ২৩ অক্টোবর নীলফামারীর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে দলীয় ব্যানারে জনসভা (প্রচারণা) করার জন্য ঢাকা থেকে মাইক্রোবাসে আসার পথে ওই মসজিদে সফরসঙ্গীদের নিয়ে (নতুন মসজিদ) নামাজ আদায় করেন শেখ মুজিবুর রহমান। উপজেলার পশ্চিম কুচিয়ামোড় ফকিরপাড়া গ্রামের বাসিন্দা ও ১৩ নম্বর চড়াইখোলা ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য শহিদুল শেখ (৬৬) বলেন, তখন আমার বয়স ছিল ১৪-১৫ বছর। গাড়ি থেকে নেমে বঙ্গবন্ধু চারচালা কুঁড়েঘরে নামাজ আদায় করতে আসেন। তখন কাঁচাঘরটিতে নামাজ আদায় করতেন অনেকে। কোনো নামও ছিল না মসজিদের। খড়ের ঘর দেখে বঙ্গবন্ধুর চাচা উমর শেখের হাতে ৫০০ টাকা দিয়ে বলেন, আমার জন্য দোয়া করবেন, আমার দল ক্ষমতায় এলে পাকা মসজিদ বানিয়ে দেব। এরপরই মসজিদটির নতুন নাম রাখা হয় শেখ জামে মসজিদ। পরে তিনি বড় মাঠের জনসভায় লাখো জনতার মাঝে বক্তব্য রাখেন।

জনসভা শেষ করে ডোমার হয়ে ঢাকার উদ্দেশে চলে যান। একই গ্রামের বাসিন্দা ও শেখ জামে মসজিদের সহসভাপতি ওসমান গনি টুনু (৭২) স্মৃতিচারণ করে বলেন, নামাজ শেষে তিনি (বঙ্গবন্ধু) সবার সঙ্গে হ্যান্ডশেক ও মোলাকাত করেন। পরে তিনি একচালা কুঁড়েঘরটিকে মসজিদ হিসেবে ঘোষণা দেন। সেদিনই সর্বসম্মতিক্রমে মসজিদটির নাম রাখা হয় শেখ জামে মসজিদ। এলাকার চায়ের দোকানদার ও ব্যবসায়ী আবদুল হামিদ (৬৭) বলেন, তিনি (বঙ্গবন্ধু) তড়িঘড়ি করে অজু করে নামাজে শরিক হয়ে যান। নামাজ শেষে সবার উদ্দেশে তিনি পরিচয় দিয়ে বলেন, আমি শেখ মুজিবুর রহমান। আমরা মুসল্লিরা সবাই হতবাক হয়ে যাই। এলাকাবাসী জানান, সেদিন বঙ্গবন্ধুর সফরসঙ্গী ছিলেন এম মনসুর আলী, তাজউদ্দীন আহমদ, এ এইচ এম কামারুজ্জামান ও নীলফামারী সৈয়দপুরের ডা. জিকরুল হক, মো. আলিম উদ্দিন, জেলা শহরের আফসার আলী, ডোমার উপজেলার আবদুর রব প্রমুখ। ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপতি হলে মসজিদ কমিটির লোকজন যোগাযোগ করেন। পরে ২৫ হাজার টাকা দেন বঙ্গবন্ধু। সেই টাকা দিয়ে মসজিদ কমিটি প্রথম ধাপে ইট সিমেন্ট দিয়ে ২০ হাত দৈর্ঘ্য ও ১০ হাত প্রস্থের একটি পাকা টিনশেড মসজিদ ঘর নির্মাণ করা হয়। এরপর ধীরে ধীরে বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনার অনুদানে এখন মডেল মসজিদে পরিণত হয়েছে। জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট মমতাজুল হক জানান, ২০১৪ সালে জেলা পরিষদের অর্থায়নে ৭১ লাখ টাকা ব্যয়ে একটি মডেল মসজিদ নির্মাণ করা হয় এখানে। বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া শেখ জামে মসজিদটি এখন এলাকার বাইরেও দেশের  বিভিন্ন স্থানে ধর্মপ্রাণ মানুষের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু।

 

বাবা আদম মসজিদ, মুন্সীগঞ্জ

ইসলাম ধর্ম প্রচারে ভারতবর্ষে এসেছিলেন আধ্যাত্মিক সাধক বাবা আদম (রহ.)। উপমহাদেশে সেন শাসনামলে ১১৭৮ সালে ধলেশ্বরীর তীরে মুন্সীগঞ্জের মিরকাদিমে আসেন তিনি। তখন বিক্রমপুর তথা মুন্সীগঞ্জ ছিল বল্লাল সেনের রাজত্বে। ওই বছরই বল্লাল সেনের হাতে প্রাণ দিতে হয় তাঁকে। শহীদ বাবা আদমকে (রহ.) মিরকাদিমের দরগাবাড়িতে  দাফনের পর তাঁর মাজারের পাশে ১৪৮৩ সালে নির্মাণ করা হয় বাবা আদম মসজিদ। এটি ছিল তাঁর মৃত্যুর ৩১৯ বছর পরের ঘটনা। সেই থেকে ৫৩০ বছর ধরে ঐতিহ্যের সাক্ষী হয়ে টিকে আছে এই মসজিদটি।

কিন্তু মুসলিম ঐতিহ্যের চোখজুড়ানো এই শৈল্পিক স্থাপনার গায়ে এখন শুধুই অযত্ন-অবহেলার ছাপ। তৎকালীন ভারতবর্ষে যে কটি প্রাচীন মসজিদ ছিল, সেগুলোর একটি বাবা আদম মসজিদ। বাংলার সুলতান জালাল উদ্দিন ফতেহ শাহর শাসনামলে তাঁর আগ্রহে এটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। সৌদি আরবের পবিত্র মক্কা নগরের অদূরে তায়েফে ১০৯৯ সালে জন্মগ্রহণ করেন ইসলাম ধর্ম প্রচারক বাবা আদম (রহ.)। পরবর্তী সময়ে তিনি আধ্যাত্মিক জ্ঞান সাধনায় বড়পীর হজরত আবদুল কাদের জিলানি (রহ.)-এর সাহচর্য পেতে বর্তমান ইরাকের বাগদাদে আসেন। সেখানে শিক্ষা গ্রহণ করেন তিনি।

মুন্সীগঞ্জ শহর থেকে উত্তর-পশ্চিমে চার কিলোমিটার পথ পেরোলেই বাবা আদম মসজিদ। আর ঢাকা থেকে সড়কপথে মসজিদটির দূরত্ব মাত্র ২৮ কিলোমিটার। সদরঘাট থেকে নৌপথে মিরকাদিমের কাঠপট্টি ঘাটে নামার পর আধা কিলোমিটারের মধ্যেই মসজিদটির অবস্থান। সদরঘাট-কাঠপট্টিঘাট এক ঘণ্টার পথ। এলাকাবাসীর ভাষ্য, বাবা আদমের নামে নির্মিত এ মসজিদটি দেখতে বছরজুড়েই দরগাবাড়িতে আসেন দেশ-বিদেশের পর্যটক ও দর্শনার্থীরা। সম্প্রতি বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনাও এ মসজিদ দেখতে গিয়েছিলেন। তবে পর্যটকদের আকর্ষণ ধরে রাখা কিংবা কয়েক শ বছরের ঐতিহ্যের সাক্ষী হয়ে টিকে থাকা এ স্থাপনাটি সংরক্ষণে নেই তেমন কোনো উদ্যোগ। ইতিহাস থেকে জানা যায়, ভারতবর্ষ প্রত্নতত্ত্ব জরিপ বিভাগ ১৯০৯ সালে একবার এ মসজিদটি সংস্কার করে সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়। কিন্তু তার পর দীর্ঘ সময় সেভাবেই ফেলে রাখা হয়। ১৯৯১ সালের দিকে এর চার পাশে লোহার সীমানা বেড়া নির্মাণ করা হয়। সে বছরই বাংলাদেশ সরকারের ডাক বিভাগ মসজিদের ছবি দিয়ে ডাকটিকিট প্রকাশ করে। মসজিদটির ঐতিহ্য ধরে রাখতে এটাই ছিল সরকারের উল্লেখ করার মতো কোনো পদক্ষেপ। বাবা আদম মসজিদ সম্পর্কে আরও জানা যায়, দীর্ঘদিন পরিচর্যার অভাবে মসজিদের দেয়ালে শ্যাওলা পড়েছে। মসজিদের ভিতর ও বাহিরে ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা নামাজ পড়ছেন।

 

বজরা শাহী মসজিদ, নোয়াখালী

নোয়াখালী জেলার সোনাইমুড়ী উপজেলার বজরা ইউনিয়নে নির্মিত ঐতিহাসিক মসজিদের নাম বজরা শাহী মসজিদ। দিল্লি শাহী জামে মসজিদের নকশার অনুকরণে বজরা শাহী মসজিদটি গড়ে তোলা হয়েছিল। ইতিহাস থেকে প্রাপ্ত তথ্য মতে, ১৭৪১-৪২ সালে জমিদার আমানুল্লাহ ৩০ একরের ভূমিতে একটি বিশাল দিঘি খনন করেন। দিঘির পশ্চিম প্রান্তে তিনি একটি আকর্ষণীয় মসজিদ নির্মাণ করেন। সুন্দর তোরণবিশিষ্ট বজরা শাহী মসজিদটির দৈর্ঘ্য প্রায় ১১৬ ফুট, প্রস্থে প্রায় ৭৪ ফুট। মসজিদটির উচ্চতা প্রায় ২০ ফুট। তিন গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদটির ভিত মাটির প্রায় ২০ ফুট নিচ থেকে তৈরি করা হয়েছে। তিনটি গম্বুজই সুদৃশ্য মার্বেল পাথরে সুসজ্জিত। মসজিদের অভ্যন্তরে প্রবেশের জন্য তিনটি ধনুকাকৃতির দরজা এবং কেবলার দিকে তিনটি কারুকার্যখচিত মেহরাব রয়েছে। মসজিদের প্রবেশপথের তোরণের ওপর আরও কয়েকটি গম্বুজ দেখা করা যায়। ঐতিহ্যবাহী বজরা শাহী মসজিদটি নির্মাণের প্রায় ১৭৭ বছর পর ১৯০৯ সালে প্রথমবার সংস্কার করা হয়। লোকমুখে প্রচলিত আছে, বজরা শাহী মসজিদে কোনো কিছু মানত করলে ভালো ফল পাওয়া যায়। তাই দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ এসে এই মসজিদে নামাজ আদায় এবং দুরারোগ্য ব্যাধি থেকে মুক্তি পাওয়ার আশায় টাকা-পয়সা ও শিরনি বিতরণ করেন। ১৯৯৮ সালের ২৯ নভেম্বর থেকে বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ ঐতিহাসিক বজরা শাহী মসজিদের ঐতিহ্য রক্ষা এবং দুর্লভ নিদর্শন সংরক্ষণের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। মুঘল সম্রাট মোহাম্মদ শাহের অনুরোধে সৌদি আরবের পবিত্র কাবা শরিফ থেকে এসে মাওলানা শাহ আবু সিদ্দিক (রহ.) বজরা শাহী মসজিদের প্রথম ইমাম হিসেবে দায়িত্ব পালন শুরু করেন। মাওলানা শাহ আবু সিদ্দিক (রহ.)-এর বংশধররা যুগ যুগ ধরে বজরা শাহী মসজিদের ইমামের দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। বর্তমানে শাহ আবু সিদ্দিক (রহ.)-এর সপ্তম পুরুষ ইমাম হাসান সিদ্দিক বজরা শাহী মসজিদে ইমাম হিসেবে নিযুক্ত আছেন।

 

সমাজ শাহী মসজিদ, পাবনা

মসজিদ আল্লাহর ঘর। মসজিদ মুসলিম উম্মাহর ইবাদত ও ঐতিহ্যের প্রতীক। বিশ্বব্যাপী শতাব্দীর পর শতাব্দী সংস্কার ছাড়াই টিকে রয়েছে অসংখ্য মসজিদ। এ রকমই একটি মসজিদ হলো সমাজ শাহী মসজিদ। ১৫৫২ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট শেরশাহর ছেলে সুলতান সমির বা সেলিম শুরের আমলে বর্তমান পাবনা জেলার চাটমোহর উপজেলার সমাজ গ্রামে অবস্থিত ৪৬৫ বছরের সুপ্রাচীন ঐতিহাসিক সমাজ শাহী মসজিদ। করতোয়া নদী-সংলগ্ন চাটমোহর থানা থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত সমাজ শাহী মসজিদটি দীর্ঘদিন পরিত্যক্ত থাকার পর বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের তত্ত্বাবধানে ১৯৮০ সালে  পুনর্নির্মাণ করা হয়। দেশ বিভাগের আগে ১৯৪২ সালে ভারত সরকার এ ঐতিহাসিক মসজিদটি একবার পুনর্নির্মাণ করে। ওই সময় মসজিদটির মূল অবকাঠামো ঠিক রেখে পুনর্নির্মাণের কাজ সম্পন্ন করা হলেও মসজিদটির প্রাচীনত্ব অনেকাংশেই বিলুপ্ত হয়ে যায়। ৩০ হাত উচ্চতার এ মসজিদটির দৈর্ঘ্য ৩৪ হাত, প্রস্থ ১৫ হাত। ছোট-বড় মিলিয়ে গম্বুজের সংখ্যা তিনটি। বড় গম্বুজের নিচের দিকে রয়েছে দৃষ্টিনন্দন কারুকার্য।

মসজিদটির বারান্দায় কষ্টিপাথরের কালো দুটি স্তম্ভ প্রাচীন স্থাপত্যশৈলীর ঐতিহ্যের প্রমাণ বহন করে। চারপাশের দেয়ালেও রয়েছে সুন্দর নকশা, যা খুব সহজেই দর্শনার্থীদের নজর কাড়ে। মসজিদের রয়েছে তিনটি মূল দরজা ও একটি মেহরাব। ১৯৪২ সালে মসজিদটি পুনর্নির্মাণের সময় ভারতের জাদুঘরে এ মসজিদের দুটি শিলালিপি স্থানান্তর করা হয়। শিলালিপি দুটি হলো- মেহরাবের ওপরের একটি এবং দক্ষিণাংশের দেয়ালের একটি শিলালিপি। একটি লিপিতে লেখা ছিল মসজিদটির নির্মাণ তারিখ এবং অন্যটিতে সুরা মুলক খোদাই করা ছিল। সমাজ শাহী মসজিদ প্রমাণ করে, চাটমোহরের সমাজ গ্রাম ঐতিহাসিকভাবে একটি সমৃদ্ধিশালী মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চল ছিল। সেখানে অনেক ঐতিহাসিক এবং প্রাচীন নিদর্শন ছিল, যা বিলুপ্ত হয়ে গেলেও সমাজ শাহী মসজিদ এখনো স্বমহিমায় মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থেকে ইসলাম ও মুসলিম সভ্যতার  স্বর্ণযুগের মহিমা ঘোষণা করছে।

 

অনন্য নির্মাণশৈলী ছোট সোনামসজিদ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ

৫০০ বছরের ইতিহাসের সাক্ষী ছোট সোনামসজিদ। এ মসজিদ প্রাঙ্গণে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের দুই বীর সন্তানের কবর। মসজিদের পূর্ব-দক্ষিণ কোণে সীমানা প্রাচীরের ভিতরেই বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর ও মুক্তিযুদ্ধে সাত নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক মুক্তিযোদ্ধা মেজর নাজমুল হকের কবর। মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের পশ্চিম পাশে শায়িত আছেন তিনি। তাঁর জন্ম চট্টগ্রামে। তিনি ছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গোলন্দাজ রেজিমেন্টের কর্মকর্তা। রাজশাহী থেকে মহাসড়ক হয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরে ঢুকতেই বিশ্বরোডের মোড়। সেখান থেকে সোনামসজিদ স্থলবন্দর সড়ক হয়ে ছোট সোনামসজিদ ৩৮ কিলোমিটারের পথ। মূল সড়ক থেকে নেমে ডানে অপ্রশস্ত সড়ক ধরে ৫০-৬০ ফুট এগোলেই উত্তর-পূর্ব দিকে একটি বড় পুকুর। বাঁ দিকে বাঁক নিয়ে সামান্য এগোলেই ছোট সোনামসজিদের তোরণ। মধ্যযুগের সুলতানি আমলের গৌড় নগরীর এক ঐতিহাসিক স্থাপনা ছোট সোনামসজিদ। মসজিদটিকে বলা হতো ‘গৌড়ের রত্ন’। মসজিদের বাইরের দিকে সোনালি রঙের আস্তরণ ছিল। সূর্যের আলো পড়লেই তা সোনার মতো ঝলমল করে উঠত। এ জন্যই এর নাম হয়ে যায় সোনামসজিদ। চাঁপাইনবাবগঞ্জে প্রাচীন ঐতিহ্যের প্রধানতম নিদর্শন হচ্ছে ছোট সোনামসজিদ। মধ্যযুগে বাংলার স্বাধীন সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহের রাজত্বকালে (১৪৯৩-১৫১৯) নির্মিত হয় সোনামসজিদ। নির্মাতা হিসেবে ওয়ালী মুহাম্মদের নাম পাওয়া যায়। প্রতি বছর দেশ-বিদেশের হাজারও দর্শনার্থী মসজিদটি দেখতে আসেন। বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতি গ্রন্থমালা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ বইয়ের প্রধান সমন্বয়কারী নবাবগঞ্জ সরকারি কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক মাযহারুল ইসলাম বলেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জকে চেনার একটি প্রতীক এই ছোট সোনামসজিদ। চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জে ঐতিহাসিক গৌড় নগরীর আরও স্থাপনা রয়েছে। যাতায়াত, থাকা ও নিরাপত্তার সুবন্দোবস্ত করা গেলে এগুলো পর্যটন কেন্দ্র হয়ে ওঠার উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে।

সোনামসজিদ-সংক্রান্ত নানা তথ্য পাওয়া যায় ১৯৮৫ সালে বাংলা একাডেমি প্রকাশিত বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতি গ্রন্থমালা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, ২০১৪ সালে বাংলা একাডেমি প্রকাশিত গৌড় ও পা-ুয়া স্মৃতি এবং ১৯৮৪ সালে শিল্পকলা একাডেমি প্রকাশিত বাংলাদেশের প্রত্ন সম্পদ বইয়ে। মসজিদটি ইট দিয়ে তৈরি। তার ওপর পাথরের একটি স্তর বসানো আছে। মসজিদের বাইরের পরিমাপ ৮২ ফুট বাই সাড়ে ৫২ ফুট। ভিতরের পরিমাপ ৭০ ফুট ৪ ইঞ্চি বাই ৪০ ফুট ৯ ইঞ্চি। উচ্চতা প্রায় ২০ ফুট। মধ্যবর্তী তিনটি নামাজের স্থানে খিলান করা চার খ- ছাদ তৈরি করে মাঝখানে এনে মিলিয়ে দেওয়া হয়েছে। তার দুই পাশের প্রতি অংশে আছে ছয়টি করে গোলাকার গম্বুজ। এই ১২টির পাশাপাশি চৌচালা গম্বুজ আছে তিনটি। মাঝখানে অবস্থিত এই চৌচালা গম্বুজগুলোর ভিতরের দিকে গোলাপ ফুলের মতো কারুকার্য করা। মসজিদের চারদিকে চারটি বুরুজ রয়েছে। এগুলোর ভূমি অষ্টকোনাকৃতির। বুরুজগুলোতে ধাপে ধাপে বলয়ের কাজ আছে।

বুরুজগুলোর উচ্চতা ছাদের কার্নিশ পর্যন্ত। মসজিদের সামনে পাঁচটি এবং ডানে ও বামে দুই পাশে তিনটি করে দরজা রয়েছে। প্রতিটি দরজারই কিনারায় আছে বেশ চওড়া করে খোদাই করা কারুকাজ। তবে তা খুব গভীর নয়। দূর থেকে বোঝা যায় না। দরজার পাশের দেয়ালগুলোতেও খোদাই করা কারুকাজ রয়েছে। মসজিদের প্রবেশপথের পাথরের তোরণটিও সুদৃশ্য কারুকার্যময়। এই তোরণের সামনেই রয়েছে সেই আমলের সারি সারি কবর। সবই বাঁধানো। দুটি কবর বড় কালোপাথর দিয়ে বাঁধানো। এর পরেই মসজিদের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে চোখে পড়বে আমবাগান। ১৮৯৭ সালে ভূমিকম্পে মসজিদের তিনটি গম্বুজ ও পশ্চিম পাশের দেয়ালের কিছু অংশ বিধ্বস্ত হয়। ১৯০০ সালে ব্রিটিশ সরকার গম্বুজ ও দেয়ালটি সংস্কার করে। তবে পশ্চিম পাশের ইটের দেয়ালের বাইরের বেশির ভাগ অংশে পাথর স্থাপন করা হয়নি। মসজিদের বিভিন্ন স্থানে ছোট ছোট ফাটল রয়েছে। গম্বুজেরও জীর্ণ দশা। আর সোনামসজিদ স্থলবন্দর থেকে প্রতিদিন মালবোঝাই  ভারী ট্রাক মসজিদের পাশ দিয়ে যায়।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর