শুক্রবার, ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

বিশ্বজুড়ে স্মৃতির মিনার ও স্মৃতিসৌধ

মেজর নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ (অব.) পিএইচডি

বিশ্বজুড়ে স্মৃতির মিনার ও স্মৃতিসৌধ

শুরুর কথা

কোনো ব্যক্তি বা ঘটনার স্মরণে নির্মিত বিভিন্ন স্থায়ী স্থাপনাকে মিনার বা স্মৃতিসৌধ বলে বিবেচনা করা হয়। ইংরেজিতে এমন স্থাপনাকে মনুমেন্ট বলা হয়, যা একটি গ্রিক ও ল্যাটিন শব্দের সংমিশ্রণে সৃষ্ট। গ্রিক এবং ল্যাটিন শব্দ দুটির প্রায়োগিক অর্থ স্মরণ করিয়ে দেওয়া, উপদেশ দেওয়া, সতর্ক করা প্রভৃতি। এ সূত্র ধরে পৃথিবীর ইতিহাসে বিভিন্ন ব্যক্তি বা ঘটনার স্মরণে কিংবা ধর্মীয় কারণে সৃষ্ট এবং শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে স্থায়ী যে কোনো সৃষ্টিকর্মকেই মিনার বা স্মৃতিসৌধ নামে অভিহিত করা যায়। পৃথিবীর বুকে আজও বিরাজমান সবচেয়ে পুরাতন মিনার নিয়ে নিশ্চিত কিছু বলা কষ্টসাধ্য ও বিতর্কিত। তবে ধারণা করা হয়, যিশুখ্রিস্টের জন্মের কয়েক শত বছর আগে নির্মিত চীনের প্রাচীর, মিসরের পিরামিড কিংবা প্রাচীন গ্রিসের মন্দির পৃথিবীর প্রাচীনতম স্মৃতিসৌধগুলোর অন্যতম। অন্যদিকে বাংলাপিডিয়া মতে, ‘মিনার’ শব্দটি আরবি বা ফরাসি শব্দ মানার বা মানারার প্রাচীন ভারতীয় রূপ, শাব্দিক অর্থে এর দ্বারা এমন স্থানকে বোঝায় যেখানে আলো জ্বালানো হতো, প্রাচীন আমলে নাবিকদের সতর্ক করা বা দিকনির্দেশনা দেওয়ার জন্য উঁচু ভবনে আলো জ্বালানো হতো। বাংলাদেশের কুতুবদিয়া এমন বাতিঘর বা মিনারের জন্য বিখ্যাত ছিল। ইসলাম ধর্মে নামাজের উদ্দেশ্যে মুসল্লিদের আজান দিয়ে ডাকার জন্য সরু উঁচু ভবন বা টাওয়ারের ওপরে উঠতেন একজন মুয়াজ্জিন। পরবর্তীতে এ ধরনের টাওয়ার মিনার নামে সুপরিচিত হয়ে ওঠে। বর্তমানে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উৎকর্ষতার কারণে মুয়াজ্জিনগণ মিনারে উঠে আজান না দিলেও ঐতিহ্য আর সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য  মসজিদের সঙ্গে মিনার নির্মাণের প্রচলন রয়েছে।

 

যুদ্ধ স্মৃতিসৌধ

পৃথিবীর ইতিহাস এবং যুদ্ধ, সংঘাত, ধ্বংস, বিদ্রোহ, প্রভৃতির ইতিহাস এগিয়েছে প্রায় সমান গতিতে। আর যুদ্ধ কিংবা যে কোনো সংঘাতের অনিবার্য পরিণতি মানুষের করুণ মৃত্যু। যুদ্ধ, সংঘাত ও বিদ্রোহে নিজেকে উৎসর্গ করা যোদ্ধা বা তাদের সহযোগীদের চিরস্মরণীয় করার লক্ষ্যে স্মৃতিসৌধ নির্মাণের প্রচলনও বেশ পুরনো। যিশুখ্রিস্টের জন্মের আগে এবং পরবর্তী প্রায় ১০০ বছর যুদ্ধে নিহতদের স্মরণে তাদের কবরের ওপরে কিংবা যুদ্ধক্ষেত্রে মাটির উঁচু ঢিবি বা টিলা তৈরির তথ্য পাওয়া যায় ইতিহাসের পাতায়। ১০৯০ সালে বর্তমান ইরানের রাজধানী তেহরান থেকে প্রায় ২০০ কিলোমিটার দূরে মুসলমানদের শিয়া সম্প্রদায়ের ‘নাজারি ইসমাইলি’ নামে পরিচিত বিশেষ গোষ্ঠী ‘এলামাট ক্যাসেল’ নামে একটি রাজপ্রাসাদ নির্মাণ করেছিল। এই রাজপ্রাসাদের একটি অংশে বিভিন্ন যুদ্ধ-সংঘাতে প্রাণ হারানো তৎকালীন শিয়া সম্প্রদায়ের সদস্যদের নাম খোদাই করা হয়েছিল, যেখানে শ্রদ্ধাভরে তাদের স্মরণ করা হতো। আক্ষরিক অর্থে এই ‘এলামাট ক্যাসেল’ই প্রাচীনতম যুদ্ধ স্মৃতিসৌধ বলে অনেকেই বিবেচনা করেন। (সূত্র : উইকি পিডিয়া)।

মধ্যযুগের ১৩৩৭ থেকে ১৪৫৩ সাল পর্যন্ত সময়ে তৎকালীন ইংল্যান্ড এবং ফ্রান্সের মধ্যে এক দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধ ও সংঘাত হয়, যা ইতিহাসের পাতায় ‘শতবর্ষী যুদ্ধ’ বা ‘হান্ড্রেড ইয়ার্স ওয়ার’ নামে পরিচিত। এই যুদ্ধে শহীদদের স্মরণে তৎকালীন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের (College of the souls of all the Faithful Departed) কলেজ অব দি সোলস অব অল দি ফেইথফুল ডিপারটেড। (সংক্ষেপে অল সোলস কলেজ) নামে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্মাণ করা হয়, যার অর্থ ‘পরলোকগত সব বিশ্বাসীর আত্মার কলেজ।’ ১৪৩৮ সালে প্রতিষ্ঠিত এই কলেজের নির্মাণশৈলী স্মৃতিসৌধের মতোই। ১৯ জুলাই ১৮৭০ থেকে ২৮ জানুয়ারি ১৮৭১ পর্যন্ত তৎকালীন ফ্রান্স এবং জার্মানিদের মধ্যে সংঘটিত ছয় মাসের যুদ্ধে উভয়পক্ষের প্রায় ২ লাখ যোদ্ধা প্রাণ হারায় এবং আরও ২ লাখ আহত হয়। হারিয়ে যাওয়া ও বন্দীর সংখ্যা দাঁড়ায় সাড়ে ৭ লাখে, যুদ্ধে বিজয়ী জার্মানিদের শর্ত মোতাবেক এই যুদ্ধে প্রাণ হারানো প্রতিটি যোদ্ধার স্মরণে একটি নির্দিষ্ট স্থান চিহ্নিত করা হয় এবং পরবর্তীতে বিভক্ত বিভিন্ন দেশে ‘ওয়ার মেমোরিয়ালস্ অব দি ফ্র্যাংকো-প্রুসিয়ান ওয়ার; ১৮৭০-৭১’ (War memorials of the franco–Prussian war; 1870-71) নামের স্মৃতিসৌধ গড়ে ওঠে।

বিংশ শতক ছিল মূলত যুদ্ধের শতক। এই শতকে পৃথিবী প্রত্যক্ষ করেছে দুই দুটি বিশ্বযুদ্ধ। পৃথিবীর প্রায় ২০০ দেশ স্বাধীনতা লাভ করে এই বিংশ শতকে। এসব দেশের স্বাধীনতা লাভের নেপথ্যে অনেকটাজুড়েই আছে যুদ্ধ, সংগ্রাম, বিপ্লব ও অন্দোলন, যার নির্মম ফলাফল অকাতরে জীবন উৎসর্গ করা।  এই সূর্যসন্তানদের স্মরণে এ সময় গড়ে তোলা হয় নানা আকৃতি, বর্ণ ও শোভার স্মৃতিসৌধ।

 

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ডুয়ামন্ট আসুয়ারি স্মৃতিসৌধ (ফ্রান্স)

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে আত্মাহুতি দেওয়া সেনাদের স্মরণে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গড়ে ওঠে শত শত স্মৃতিসৌধ। শুধু অস্ট্রেলিয়ায় এমন ৯৫টি স্মৃতিসৌধ রয়েছে। ইংল্যান্ডে ১৮৬টি, আমেরিকায় ৫১টি এবং ফ্রান্সে ৮টি স্মৃতিসৌধের তথ্য পাওয়া যায়। স্মৃতিসৌধগুলোর অন্যতম ডুয়ামন্ট আসুয়ারি (Douamont Ossuary)। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অংশরূপে ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯১৬ থেকে ১৯ ডিসেম্বর ১৯১৬ পর্যন্ত ৩০৩ দিনের যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে ফ্রান্স ও জার্মানি।  ফ্রান্সের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ভেরডান (Verdan) এলাকার ২০ বর্গকিলোমিটার যুদ্ধক্ষেত্রে এই যুদ্ধ সংঘটিত হয়। মিউসে (Meuse) নদীর তীরে ফ্রান্সের সেকেন্ড আর্মির শক্তিশালী প্রতিরক্ষা অবস্থানের ওপর ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯১৬ সালে আক্রমণ করে জার্মানির ফিফথ আর্মি (5th Army)। প্রথম দিকে জার্মানরা সাফল্য লাভ করলেও শেষ পর্যন্ত ফ্রান্সের কাছে তাদের পরাজয় মানতে হয়। প্রায় ৭ লাখ সৈন্যের জার্মান বাহিনী থেকে প্রায় ২ লাখ ৩০ হাজার সৈন্য এই যুদ্ধে মারা যায়। তাদের সহযোগীসহ মোট মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় সাড়ে ৩ লাখ। ফ্রান্সের পক্ষেও জীবন উৎসর্গ করেন ১ লাখ ৬৩ হাজার যোদ্ধা। আহত ও নিখোঁজের তালিকায় নাম ওঠে ২ লক্ষাধিক। ফ্রান্সের পক্ষে জীবন উৎসর্গকারী মুসলমান যোদ্ধার সংখ্যা ছিল ৭০ হাজার। এই যুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত সব দুর্গ, প্রতিরক্ষা অবস্থান, মৃত যোদ্ধাদের কবর এবং দেহাবশেষ নিয়ে স্মৃতিসৌধ, জাদুঘর, উপাসনালয়, ওয়ার সিমেট্রি বা কবর গড়ে উঠেছে পুরো ভেরডান এলাকায়। এর মধ্যে ‘ডুয়ামন্ট আসুয়ারি’ স্মৃতিসৌধে রয়েছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে প্রাণ হারানো ১৬ হাজার ১৪২ যোদ্ধার কবর। এ ছাড়াও উভয় পক্ষের অন্তত ১ লাখ ৩০ হাজার সৈন্যের দেহাবশেষও সংরক্ষিত আছে বিশেষ মর্যাদায়। স্মৃতিসৌধ ভবনের দেয়ালে উৎকীর্ণ আছে যুদ্ধে আত্মাহুতি দেওয়া ফরাসি যোদ্ধাদের নাম। এই স্মৃতিসৌধে আরও রয়েছে ১৫১ ফুট (৪৬ মিটার) উঁচু একটি টাওয়ার। টাওয়ারে সংযুক্ত করা হয়েছে দুই টন ওজনের ব্রোঞ্জ নির্মিত ঘণ্টা, যা মৃত্যুঘণ্টা বা ‘ডেথ বেল’ নামে পরিচিত। আনুষ্ঠানিক কর্মসূচিতে এই ঘণ্টা বাজানো হয়। আর রাতের অন্ধকারে আলো ছড়ায় টাওয়ারের ওপরে থাকা লাল ও সাদা রঙের ঘুরতে থাকা (রোটেটিং) বাতি, যার নাম দেওয়া হয়েছে ‘মৃতদের বাতি’। (লেনটের্ন অব দি ডেথ)। এই বিশাল স্মৃতিসৌধ গড়ে উঠেছে একটি স্থানীয় সংগঠনের মাধ্যমে, যার নেতৃত্বে ছিলেন একজন ধর্মগুরু। দেশ-বিদেশ থেকে অনুদান সংগ্রহ করা হয় এই স্মৃতিসৌধ গড়ার জন্য।  সেখানে অনুদান প্রদানকারীদের নামও উৎকীর্ণ করা হয়েছে।

 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ হিরোশিমা পিস মেমোরিয়াল পার্ক  (জাপান)

মানব সভ্যতার ইতিহাসে এক কলঙ্কিত এবং লজ্জাজনক অধ্যায়ের নাম দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। ১ সেপ্টেম্বর ১৯৩৯ থেকে ২ সেপ্টেম্বর ১৯৪৬ পর্যন্ত দীর্ঘ সাত বছরের বিশ্বযুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে পৃথিবীর ৩০টি দেশের ১০ কোটি মানুষ এবং পরোক্ষভাবে পৃথিবীর প্রায় সব দেশ এবং পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার একটি বড় অংশ দুটি শিবিরে বিভক্ত হয়ে জড়িয়ে পড়ে। যুদ্ধজনিত দুর্ভিক্ষ, গণহত্যা, মহামারী, দাঙ্গা, সন্ত্রাস, অগ্নিসংযোগসহ নানাবিধ মানবসৃষ্ট বিপর্যয়ে পড়ে সমগ্র বিশ্ব। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি, জাপান ও ইতালির নেতৃত্বাধীন অক্ষশক্তির বিরুদ্ধে জোট বাঁধে রাশিয়া, আমেরিকা, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও চায়নাসহ পৃথিবীর অন্যান্য সব দেশের সমন্বয়ে গড়া মিত্র শক্তি। এই যুদ্ধে জার্মানি, জাপান ও ইতালির পরাজয় ঘটলেও চূড়ান্ত বিচারে মানব সভ্যতা ও মানবিকতার চরম পরাজয় ঘটেছিল। প্রায় ২ কোটি ৪০ লাখ যোদ্ধার পাশাপাশি প্রায় ৫ কোটি সাধারণ মানুষের মৃত্যু ঘটে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে। আহত, নিখোঁজ, বাস্তুচ্যুতদের সঠিক পরিসংখ্যান আজও পাওয়া যায়নি।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জঘন্যতম ঘটনা ঘটেছিল ১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের একপর্যায়ে জাপানিরা প্রায় অপরাজেয় হয়ে ওঠে। তাই জাপানিদের চাপে রাখতে পারস্য অঞ্চলে আমেরিকার বিমান বহরের প্রধান কার্ল স্পাটজ (Carl Spaats) জাপানের নির্বাচিত কিছু শহরে আকাশ থেকে বোমা হামলার আদেশ পান। এসব শহরের অন্যতম ছিল জাপানের হিরোশিমা। এই শহরে জাপান সেনাবাহিনী প্রায় ৪০ হাজার সৈন্য, একটি বন্দর ও জাপানি সেকেন্ড জেনারেল আর্মির সদর দফতর পাহারার দায়িত্বে ছিল। ৬ আগস্ট ১৯৪৬ সাল সকাল ৮টা ১৫ মিনিটে আমেরিকার এনোলা গে (Enola Gay) নামক বোয়িং বি-২৯ নামক বিমানে বহনকৃত ‘লিটল বয়’ নামক পারমাণবিক বোমা একটি সেতুকে লক্ষ্য করে নিক্ষিপ্ত হয়। এই বোমার ধ্বংস ক্ষমতা ছিল ১৫ হাজার টন টিএনটি। নিক্ষেপের ৪৩ সেকেন্ডের মধ্যে সেতুর প্রায় ২৪০ মিটার দূরে ‘শিমা হাসপাতাল’-এর ওপর বোমাটি বিস্ফোরিত হয়। এই হাসপাতালের কাছেই ছিল গোনাবাকু ডোম (Genbaku Dome) নামের একটি এক্সিবিশন সেন্টার। এক গম্বুজবিশিষ্ট এই এক্সিবিশন সেন্টারটি ভূমিকম্প সহনীয় শক্তিশালী অবকাঠামোর ওপর নির্মিত হয়েছিল। পারমাণবিক বোমা ‘লিটল বয়’ ১৫ হাজার টন টিএনটি (TNT) ক্ষমতা নিয়ে বিস্ফোরিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এক্সিবিশন সেন্টারে থাকা সব মানুষের তাৎক্ষণিক মৃত্যু ঘটে। এ ছাড়াও ৬০ থেকে ৭০ হাজার হিরোশিমাবাসীও এ সময় মৃত্যুবরণ করে, যা ছিল মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ। আহতদের সংখ্যাও ৭০ হাজার ছাড়িয়ে যায়, নিহতদের মধ্যে ২০ হাজার জাপানি সৈন্যও ছিল। তীব্র আলো, শব্দ ও উত্তাপ এক বিভীষিকাময় পরিবেশ তৈরি করে হিরোশিমায়। অধিকাংশ আহত বা নিহতের নেপথ্য কারণ ছিল তীব্র উত্তাপ, শরীর ঝলসে যাওয়া। পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের পর অধিকাংশ স্থাপনা ধ্বংস হলেও ভূমিকম্প সহনশীল কিছু স্থাপনার মজবুত অবকাঠামো (স্ট্রাকচার) ধ্বংসস্তূপের মাঝে দাঁড়িয়ে ছিল। যার একটি ছিল গম্বুজবিশিষ্ট এক্সিবিশন সেন্টার।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর শুরু হয় জাপানিদের ঘুরে দাঁড়ানোর যুদ্ধ। এরই অংশ হিসেবে হিরোশিমা শহর পুনর্গঠনের কাজও শুরু হয়। নতুন ইমারত তৈরির জন্য ধ্বংসস্তূপ সরানো হলেও গম্বুজবিশিষ্ট এক্সিবিশন সেন্টারের দন্ডায়মান অবকাঠামো সেই অবস্থাতেই সংরক্ষিত হয়। এই অবকাঠামোকে ঘিরে ১৯৫০ থেকে ১৯৬৪, এই ১৪ বছরে তিলে তিলে গড়ে ওঠে ‘হিরোশিমা শান্তি স্মরণি উদ্যান’ বা হিরোশিমা পিস মেমোরিয়াল পার্ক।  প্রকৃতিপ্রেমী, শান্তিকামী, পারমাণবিক অস্ত্রবিরোধী এবং উৎসুক মানুষের ভিড়ে সারা বছর উজ্জীবিত থাকে এই পার্ক।

 

ভাষা ঐক্যবদ্ধ করে শিরোনামে সৌধ (এস্তোনিয়া)

উত্তর ইউরোপের বাল্টিক সাগরের তীরে গড়ে ওঠা এক ক্ষুদ্র দেশ এস্তোনিয়া। মূল ভূখন্ড ছাড়াও ২২২২টি বিভিন্ন আকৃতির দ্বীপ নিয়ে গড়ে উঠেছে এস্তোনিয়া। দেশটির আয়তন ৪৫২২৭ বর্গকিলোমিটার এবং মোট জনসংখ্যা প্রায় ১৩ লাখ। এই দেশে বহু উপজাতীয় জনগোষ্ঠী থাকলেও ৬৮.৪ শতাংশ মানুষ এস্তোনিয়ান। এস্তোনিয়ার রাষ্ট্রীয় ভাষাও এস্তোনিয়ান।

এস্তোনিয়ার জনগণ বিশ্বাস করে যে, তাদের মাতৃভাষা অত্যন্ত মধুময় এবং মর্যাদাসম্পন্ন। এই চেতনা থেকেই এস্তোনিয়ার উত্তরাঞ্চলে ক্যাডরিনা নামক স্থানে একটি সৌধ গড়ে তোলা হয়। পাথর দিয়ে নির্মিত এই সৌধের গায়ে স্থানীয় এস্তোনিয়ান ভাষায় লেখা হয়েছে ‘সোনা সিইয়ব’’(Sona Seob); যার অর্থ ভাষা ঐক্যবদ্ধ করে বা ওয়ার্ডস ইউনাইট। ভ্রমণপিপাসু মানুষের কাছে এই Words Unite সৌধ একটি অন্যতম আকর্ষণ। সৌধটি গড়ার নেপথ্য কারিগর সাংবাদিক রেইন শিক (Rein sikk)। তিনি সৌধ নির্মাণের জন্য তহবিল সংগ্রহ করেন।  ১৯৯৪ সালের ২১ মে স্থাপনাটি জনসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয়।

 

আফ্রিকানস ভাষা স্মৃতিসৌধ (. আফ্রিকা)

বর্ণবাদের কারণে বিশ্বের বুকে আলোচিত এক দেশ দক্ষিণ আফ্রিকা। সপ্তদশ শতকে দেশটি ডাচ ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে ছিল দীর্ঘদিন যাবৎ। তারও আগে দেশটি পর্তুগিজ প্রভাবের অধীন ছিল। ফলে দেশটির নিজস্ব ভাষা, শিল্প, সাহিত্য প্রভৃতির বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়েছে বারবার। তবে সপ্তদশ শতকে দক্ষিণ আফ্রিকায় ডাচ ভাষা, কৃষ্টি ও সভ্যতার ব্যাপক অনুপ্রবেশ ঘটে। এই প্রভাব পরবর্তীকালে দেশটিতে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলেও বজায় ছিল।

আফ্রিকা মহাদেশের জনগণ প্রচলিত বিভিন্ন ভাষার পাশাপাশি খই খই (Khai Khai), গুণী (Ngani), সথো (Sotho)-এর মতো তুলনামূলকভাবে কম প্রচলিত ও আঞ্চলিক ভাষায়ও কথা বলে থাকে। তবে দক্ষিণ আফ্রিকা ও পার্শ্ববর্তী নামিবিয়ায় ব্যাপক পরিচিত এবং সার্বিকভাবে ব্যবহৃত ভাষা হলো ‘আফ্রিকানস’ (Africans)। এই ভাষা মূলত ডাচ ভাষার স্থানীয় সংস্করণ বলে মনে করা হয়। তবে যুগের সঙ্গে সঙ্গে এই আফ্রিকানস ভাষাতে স্থানীয় অন্যান্য ভাষার প্রবল প্রভাব ও বিস্তার শুরু হয়। ঔপনিবেশিক শাসকরা আফ্রিকানস ভাষার এই বিস্তার সহজে মেনে নিতে পারেনি। বিশেষত অ্যাংলো-বোয়ার যুদ্ধ (১৮৯৯-১৯০২) শেষ হওয়ার পর তারা ইংরেজিকে মেধাচর্চার ভাষা (Language of Intecelt) হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে ব্যাপক কার্যক্রম শুরু করে। এর প্রতিবাদে নিজস্ব ‘আফ্রিকানস’ ভাষা এবং স্থানীয় ‘আফ্রিকানস’ সংস্কৃতি তুলে ধরতে দক্ষিণ আফ্রিকাজুড়ে বিভিন্ন সংগঠন জনমত তৈরি করে এবং ধারাবাহিক কার্যক্রম চালিয়ে যায়। এর ফলে ১৯২৫ সালে আফ্রিকানসকে ‘দাফতরিক ভাষার’ (Official Language)-এর স্বীকৃতি দেওয়া হয় এবং আফ্রিকার সংস্কৃতি বিস্তারের পথ প্রশস্ত করা হয়।

ঐতিহাসিক এই স্বীকৃতির সুবর্ণজয়ন্তীতে অর্থাৎ ১৯৭৫ সালের ১০ অক্টোবর দক্ষিণ আফ্রিকার পশ্চিম কেপ (Cape) অঞ্চলের পার্ল (parl) এলাকার একটি পাহাড়ি জনপদে নির্মিত হয় একটি স্মৃতিসৌধ, যার নাম ‘আফ্রিকানস ভাষা স্মৃতিসৌধ’ বা আফ্রিকানস ল্যাংগুয়েজ মনুমেন্ট। একটি প্রতিযোগিতার মাধ্যমে স্থপতি জন ভ্যান উইজক (Jonn Van Wigk) এই স্মৃতিসৌধের নকশা তৈরি করেন। অন্তর্মুখী ও বহুর্মুখী অর্ধচন্দ্রের আদলে নির্মিত এই স্মৃতিসৌধে আফ্রিকানস ভাষার বহুমাত্রিকতা ও বিভিন্ন ভাষার প্রভাব ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।  সবুজের মাঝে এই স্মৃতিস্তম্ভ ‘আফ্রিকানস’ ভাষার গৌরবগাথাই প্রকাশ করে।

 

অহংকার আর প্রেরণার উৎস শহীদ মিনার (বাংলাদেশ)

দীর্ঘ ১৯০ বছর ব্রিটিশ ঔপনিবেশ থেকে মুক্ত হয়ে পাকিস্তানের অংশ হিসেবে পূর্ব পাকিস্তানের জন্ম হয় ১৯৪৭ সালে, যা বর্তমানে বাংলাদেশ। এই অঞ্চলের মানুষ বাংলায় কথা বলা ও লেখাপড়া করলেও বাংলাকে দাফতরিক বা রাষ্ট্রীয় ভাষার মর্যাদা না দেওয়ার মধ্য দিয়ে সূচিত হয় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানের নব্য ঔপনিবেশিকতার নতুন ষড়যন্ত্র। এর প্রতিবাদে গড়ে ওঠে তীব্র আন্দোলন, যা চূড়ান্ত রূপ নেয় ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। এদিন পাকিস্তানি জান্তা ঘোষিত ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল নিয়ে বেরিয়ে পড়ে অকুতোভয় একদল ছাত্র-জনতা। এই আন্দোলন রুখতে নির্মমভাবে গুলি চালায় পাকিস্তানি বাহিনী। ফলে শহীদ হন সালাম, রফিক, জব্বার, বরকতসহ অনেকে। আহত হন একদল ছাত্র-জনতা। এই আন্দোলনের ফলে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দিতে বাধ্য হয় পাকিস্তান সরকার।

ভাষার জন্য জীবন উৎসর্গের এমন ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। তাই একুশ বাঙালির অহংকার ও প্রেরণার উৎস। ভাষার জন্য এই অসামান্য অবদানকে স্মরণীয় করার প্রয়াসে ঘটনাস্থল ঢাকা মেডিকেল কলেজের কাছে ১৯৫২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ক্ষুদ্র আকারে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হয়, যা শহীদ মিনার নামে পরবর্তীতে বিশ্বব্যাপী পরিচিতি পায়। ২৬ ফেব্রুয়ারি দৈনিক আজাদ পত্রিকার সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দীন আনুষ্ঠানিকভাবে শহীদ মিনারটি উদ্বোধন করলেও ওইদিনই তা ভেঙে ফেলে পাকিস্তানি বাহিনী। এর ফলে সারা দেশে বিভিন্ন আকারের শহীদ মিনার গড়ে উঠতে থাকে। ১৯৫৩ সাল থেকে শুরু হয় প্রভাত ফেরির প্রচলন।

১৯৫৬ সালে নতুন করে শহীদ মিনার নির্মাণের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন পূর্ববঙ্গ সরকারের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী আবু হোসেন সরকার, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও ভাষা শহীদ আবুল বরকতের মা হাসিনা বেগম। একই সঙ্গে একুশে ফেব্রুয়ারিকে শহীদ দিবস ও সরকারি ছুটি হিসেবে ঘোষণার প্রচলনও শুরু হয়। ১৯৫৭ সালে শিল্পী হামিদুর রহমানের পরিকল্পনা ও নকশায় একটি পূর্ণাঙ্গ শহীদ মিনার নির্মাণের কাজ শুরু হয়। শিল্পী হামিদের সহকর্মী ছিলেন ভাস্কর নভেরা আহাম্মেদ, বিভিন্ন কারণে মূল নকশার পরিবর্তন ও অঙ্গহানি ঘটলেও সংশ্লিষ্টদের অদম্য চেষ্টায় ১৯৬২ সালে মোটামুটিভাবে শহীদ মিনারের নির্মাণ কাজ শেষ হয় এবং ১৯৬৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা শহীদ বরকতের মা হাসিনা বেগম তা উদ্বোধন করেন।

এই শহীদ মিনারের ভাবনায় রয়েছে একজন মা ও তার চার সন্তানের প্রতীকী রূপ একটি বড় স্তম্ভ ও চারটি ছোট স্তম্ভ। এই ভাবনা এবং প্রতীক নিয়ে দেশ-বিদেশে অসংখ্য শহীদ মিনার গড়ে ওঠে পরবর্তী সময়ে। ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো কর্তৃক একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মর্যাদা পেলে এই শহীদ মিনার বিশ্বব্যাপী  মাতৃভাষার প্রতীক হয়ে ওঠে।

 

ভারতজুড়ে স্মৃতির মিনার

মিনার শব্দটি উচ্চারিত হলে উপমহাদেশের ইতিহাসপ্রিয় মানুষের মনে সবার আগে ভেসে ওঠে দিল্লির ‘কুতুব মিনার’-এর নাম। ভারতের প্রথম মুসলিম শাসক কুতুবুদ্দিন আইবেকের আদেশে ১১৯৩ সালে কুতুব মিনার নির্মাণের কাজ শুরু হয় এবং ১৩৮৬ সালে ফিরোজ শাহ তুঘলকের সময় মিনারটি পরিপূর্ণভাবে নির্মিত হয়। এই মিনারের উচ্চতা সাড়ে ৭২ মিটার, যার মাঝে রয়েছে ৩৭৯টি সিঁড়ি। লাল বেলে পাথর জাতীয় মাটি দিয়ে তৈরি ব্লক ও ইট ব্যবহার করে এই মিনার নির্মিত হয়। পৃথিবীর বুকে ইট নির্মিত সর্বোচ্চ মিনার হিসেবে স্বীকৃত কুতুব মিনার। কথিত আছে, দিল্লির তথা ভারতের শাসক কুতুবুদ্দিন আইবেক খাজা মইনুদ্দীন চিশতির শিষ্য ও খলিফা সৈয়দ মোহাম্মদ কুতুবুদ্দিন বখতিয়ার কাকির ভক্ত ও মুরিদ ছিলেন। তাই এই পীরের নামেই উৎসর্গ করা হয় কুতুব মিনার।

ভারতের পশ্চিমবঙ্গের গৌড়ে পাঁচতলাবিশিষ্ট একটি বিশেষ স্থাপনা ফিরোজ মিনার। বাংলার শাসক এবং হাবশি রাজবংশের দ্বিতীয় সুলতান সাইফ উদ্দিন ফিরোজ শাহ ১৪৮৫ থেকে ১৪৮৯ সালের মধ্যে এই মিনার নির্মাণ করেন এবং তার নামেই মিনারটির নামকরণ করা হয়। মিনারটি ৬২ মিটার (৮৫ ফুট) উঁচু এবং সর্পিল ৭৩টি সিঁড়িবিশিষ্ট। বিশেষ ধরনের টেরাকোটা মিনারটির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। কথিত আছে, সুলতান ফিরোজ শাহ চেয়েছিলেন মিনারটি আরও উঁচু হোক। কিন্তু তা না হওয়ায় মিনারের স্থপতিকে তিনি মিনারের ওপর থেকে ফেলে দেন।

ভারতের মহারাষ্ট্র রাজ্যের দৌলতাবাদ দুর্গের কাছে রয়েছে ১৪৪৫ সালে তৎকালীন শাসক রাজা আলাউদ্দিন বাহমানি নির্মিত চাঁদ মিনার বা টাওয়ার অব মুন। চারতলা বিশিষ্ট মিনারটি ৬৩ মিটার উঁচু ও চার কক্ষবিশিষ্ট। দৌলতাবাদে দুর্গের যে কোনো স্থানে দাঁড়ালেই এই মিনার চোখে পড়ে। মিনারের বেলকনি তৎকালে স্থাপত্য ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা যোগ করে। এই মিনারে চিনিমহল নামে একটি আবাসস্থল রয়েছে যেখানে গোলকন্ডার শেষ রাজা আবদুল হাজান তানাকে ১৩ বছর বন্দী রাখা হয়।  বর্তমানে এই মিনার এবং মিনার-সংলগ্ন সুড়ঙ্গ ও বিশেষ একটি কামান দেখতে ভিড় জমান বহু পর্যটক।

সর্বশেষ খবর