শুক্রবার, ১৮ জুন, ২০২১ ০০:০০ টা

বিশ্বের প্রাচীনতম মসজিদ

সাইফ ইমন

বিশ্বের প্রাচীনতম মসজিদ

৫০ হিজরিতে কাইরুয়ান নগরীতে প্রতিষ্ঠিত

ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সেলিমিয়ে মসজিদ

তুরস্ক (১৫৬৮ খ্রি.)

মুসলিম বিশ্বে অটোমান সাম্রাজ্যের অন্যতম প্রাচীন স্থাপনা সেলিমিয়ে মসজিদ। অসম্ভব দৃষ্টিনন্দন এই মসজিদটি আকারে বিশাল। এই মসজিদটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব বিবেচনা করে একে ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ ঘোষণা করেছে ২০১১ সালে। দেশ-বিদেশ থেকে বহু মুসলিম পর্যটক আসেন এই মসজিদে নামাজ পড়তে। এই মসজিদটির নির্মাণ শুরু হয় ১৫৬৮ সালে এবং শেষ হয় ১৫৭৫ সালে। এর নির্মাণ কাজ পরিচালনা করেন মিমার সিনান। তিনি ছিলেন প্রধান উসমানীয় স্থপতি এবং সুলতান প্রথম সুলেইমান, দ্বিতীয় সেলিম এবং তৃতীয় মুরাদের বেসামরিক প্রকৌশলী। তাঁর আরও সব দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্যশিল্পের মধ্যে এটি অন্যতম। মসজিদটিকে সে সময়ের তৈরি মাস্টার পিস হিসেবে বিবেচনা করা হয়।  এটি এখনো দাঁড়িয়ে আছে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে।

 

ভারতবর্ষের প্রথম মসজিদ চেরামান

ভারত (৬২৯ খ্রি.)

ইসলাম প্রচারের জন্য ও ব্যবসায়িক কর্মকান্ডের কারণে রসুলে কারিম (সা.)-এর জীবদ্দশাতেই এখানে ছুটে আসেন সাহাবায়ে কিরাম। সেই সুবাদে ভারতবর্ষে প্রতিষ্ঠিত প্রথম মসজিদ। দেশটির কেরালা রাজ্যের ত্রিসুর অঞ্চলের চেরামান জামে মসজিদ। মসজিদটির সম্মুখভাগে স্থাপিত শিলালিপি অনুযায়ী পঞ্চম হিজরি মোতাবেক ৬২৯ খ্রিস্টাব্দে সাহাবি মালিক বিন দিনার (রা.) মসজিদটি প্রতিষ্ঠা করেন। স্থানীয়দের কাছে মসজিদটি ‘চেরামান জুমা মসজিদ’ নামে পরিচিত। মালিক ইবনে দিনার ছিলেন এই মসজিদের প্রথম ইমাম। একাদশ শতাব্দীতে মসজিদটির সংস্কার ও পুনর্র্নির্মাণ করা হয়।  ক্রমান্বয়ে মুসল্লিদের সংখ্যা বৃদ্ধির ফলে ১৯৭৪, ১৯৯৪ ও ২০০১ সালে মসজিদের সামনের অংশ ভেঙে আয়তন সম্প্রসারিত করা হয়।

 

শানজি প্রদেশের জিয়ান মসজিদ

চীন (৭৪২ খ্রি.)

চীনের শানজি প্রদেশের জিয়ান শহরে ২০ হাজার মুসলিম অধিবাসীর বসবাস। শহরের মুসলিম অধ্যুষিত এলাকাটি জিয়ান মুসলিম কোয়ার্টার নামে পরিচিত। জিয়ান মুসলিম কোয়ার্টারের ভিতরে ৩০ হুয়াজু লেনে অবস্থিত চীনের সবচেয়ে প্রাচীন ও বৃহত্তম মসজিদ জিয়ান মসজিদ। ১৯৮৫ সালে এই স্থাপনাটি ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের অন্তর্ভুক্ত হয়। ৭৪২ খ্রিস্টাব্দে ট্যাং রাজবংশের সময় এটি নির্মিত হয়। তারপর বিভিন্ন সময় সংস্কার ও পুনর্র্নির্মাণের মধ্য দিয়ে গেছে মসজিদটি। ১৩৯২ সালে মিং রাজবংশের নৌ সেনাপতি চাং হো এটি পুনর্র্নির্মাণ করেন। বর্তমানের জিয়ান মসজিদটির কাঠামো মূলত ১৭ ও ১৮ শতকে ১২ হাজার  বর্গমিটার এলাকাজুড়ে নির্মিত।

 

পালাইয়া জুমা পল্লী

ভারত (৬২৮ খ্রি.)

পালাইয়া জুমা পল্লী বিশ্বের চতুর্থ প্রাচীনতম মসজিদ। এই মসজিদটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে ১ হাজার বছরের ইসলামী ঐতিহ্য ও ইতিহাস। ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্যে অবস্থিত এটি। ইসলামী সংস্কৃতির জন্য পরিচিত এই মসজিদটি ৬২৮-৬৩০ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত হয়েছিল। এখানে ভ্রমণ করেছেন প্রখ্যাত বিশ্বপর্যটক ইবনে বতুতা। তিনি তাঁর ভ্রমণ গ্রন্থে বলেন, এটা হচ্ছে সেই জায়গা যেখানে সবচেয়ে বেশি আরব ঔপনিবেশিকরা বাস করেন এবং তিনি তাঁদের সেখানে আরব ভূমি হিসেবে বসবাস করতে দেখে বিস্মিত হন। তাই এই মসজিদসহ শহরের অন্য মসজিদগুলো দ্রাবিড় ইসলামী স্থাপত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ উদাহরণ। প্রাক ইসলামী যুগে ইয়েমেনের গভর্নর বাধান (বাযান ইবনে সাসান)-এর  আদেশে পান্দিয়া রাজ্যে ইয়েমেনের ঔপনিবেশিকরা এই মসজিদ নির্মাণ করেন।

 

মসজিদ আল কুফা

ইরাক (৬৭০ খ্রি.)

ষষ্ঠ শতাব্দীতে নির্মিত মসজিদ আল-আজম বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন ও পবিত্র মসজিদগুলোর অন্যতম মসজিদ আল-কুফা। ৬৭০ খ্রিস্টাব্দে ইরাকের নাজাফ নগরীতে মসজিদটি নির্মিত হয়। এটি ইরাকের নাজাফ প্রদেশের কুফা নগরীতে অবস্থিত হওয়ায় মসজিদ আল-কুফা নামে সর্বাধিক পরিচিত। মসজিদটির গুরুত্ব হিসেবে ইতিহাসবিদরা বলেন, এটি সেই জায়গা যেখানে  হজরত আলী (রা.) মারাত্মকভাবে মাথায় আঘাতপ্রাপ্ত হন যখন তিনি সেজদারত অবস্থায় ছিলেন। দোউদি বোহরার ৪২তম দা’য়ি আল মুতলাক সৈয়্যদেনা মোহাম্মদ বোরহান উদ্দিন মসজিদটির পুনঃসংস্কারের কাজ হাতে নেন, যা ২০১০ সালের শুরুর দিকেই সংস্কারের কাজ শেষ হয়।  বর্তমানে ভবনটির আয়তন প্রায় ১১ হাজার মিটার।

 

প্রথম কিবলা আল-আকসা

ইসরায়েল

ইসলাম ধর্মে মুসলমানদের প্রথম কিবলা আল-আকসা মসজিদ। যা ‘মসজিদুল আকসা’ নামেও পরিচিত। মসজিদুল আকসা অর্থ দূরের মসজিদ। এটি ইসলামের প্রথম কিবলা হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। মসজিদটি মুসলিমদের অধিকারে থাকলেও ভৌগোলিকভাবে অঞ্চলটি দখল করে রেখেছে অবৈধ রাষ্ট্র ইসরায়েল। ইতিহাসে আছে, পবিত্র কাবা শরিফ নির্মাণের পর হজরত ইয়াকুব (আ.) জেরুজালেমে মসজিদুল আকসা নির্মাণ করেন। পরবর্তীতে হজরত দাউদ (আ.)-এর নির্দেশে হজরত সুলায়মান (আ.) মসজিদটি পুনর্নির্মাণ করেন। আগে এর নাম ছিল ‘বাইতুল মাকদাস’। পবিত্র কোরআনে মসজিদটিকে আল-মসজিদুল আকসা নামকরণ করা হয়েছে। পবিত্রতার দিক থেকে মসজিদুল আকসা তৃতীয় পবিত্র স্থান। হজরত মুহাম্মদ (সা.) মিরাজের রাতে মসজিদুল হারাম  থেকে আল-আকসা মসজিদে এসে ঊর্ধ্বাকাশে যাত্রা করেন।

 

গ্রেট মস্ক অব আলেপ্পো

সিরিয়া (৭১৫ খ্রি.)

বিশ্বের প্রাচীন মসজিদগুলোর অন্যতম সিরিয়ার ‘গ্রেট মস্ক অব আলেপ্পো’। যে মসজিদ সাক্ষী হয়ে আছে প্রাচীন ওমাইয়াদ, সেয়্যুক, আইয়ুব, মামলুক, অটোমান সাম্রাজ্যের। মসজিদটি সিরিয়ার দামেস্ক নগরীর কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত। মসজিদের সম্মুখে লেখা রয়েছে- ওমাইয়াদ শাসনামলে নির্মিত ভবনের নির্মাণ কাল। অষ্টম শতকের গোড়ার দিকে মসজিদটির নির্মাণ শুরু হয়েছিল, যা পূর্ণাঙ্গ রূপ পায় ৭১৫ খ্রিস্টাব্দে। বর্তমান ভবনটির আগে মসজিদটি বহুবার সংস্করণ করা হয়েছিল। একাদশ শতাব্দী থেকে চতুর্দশ শতাব্দী পর্যন্ত মসজিদে অনেক কিছুর সংযোজন ঘটে। মসজিদের বাড়তি শোভাবর্ধনকারী এই মিনারগুলো নির্মাণ হয়েছিল ১০৯০ সালে। কয়েক শতক ধরে নানা দুর্যোগ-বিগ্রহ, ভূমিকম্প সহ্য করে মসজিদ ভবন টিকে ছিল।  তবে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের কারণে ২০১৩ সালে মসজিদের ভবন আঘাতপ্রাপ্ত হয়।

 

মসজিদুল কুবা

সৌদি আরব (৬২২ খ্রি.)

ইসলামী ইতিহাসের সবচেয়ে ফজিলত ও মর্যাদাপূর্ণ মসজিদ ‘মসজিদুল কুবা’। কথিত আছে, মসজিদে কুবায় নামাজ আদায় করলে ওমরাহর সমপরিমাণ সওয়াব পাওয়া যায়। এটি ইসলামের ইতিহাসে প্রথম নির্মিত মসজিদ। মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করার সময় মদিনার অদূরে এ মসজিদ নির্মাণ করেন। মক্কা শরিফ থেকে ৩২০ কিলোমিটার উত্তরে এবং মদিনার দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে অবস্থিত এই কুবা নগরীতে মসজিদে কুবা অবস্থিত। ‘কুবা’ একটি কূপের নাম। আর এই কূপকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে কুবা নগরী। প্রতিষ্ঠার পর ওসমান বিন আফফান (রা.), ওমর বিন আবদুল আজিজ (রহ.), উসমানীয় সুলতান দ্বিতীয় মাহমুদ ও তাঁর ছেলে প্রথম আবদুল মাজিদ প্রমুখ শাসকরা মসজিদটির সংস্কার কাজ করেন। বাদশাহ ফাহাদ বিন আবদুল আজিজ আল সৌদের সময় সর্বশেষ মসজিদটির  সম্প্রসারণ করা হয়।

 

মসজিদ আল হারাম

সৌদি আরব (খ্রিস্টপূর্ব ২১৩০)

কালের বিবর্তনে একটু একটু করে মসজিদ আল-হারামের কাজ শেষ হয়। খ্রিস্টপূর্ব ২১৩০ সালে নির্মাণ শুরু হয়।

ইতিহাসের সাক্ষী ‘মসজিদ আল-হারাম’। মুসলিমরা নামাজের সময় কাবার দিকে মুখ করে দাঁড়ান। প্রতি বছর হজের মৌসুমে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মানব সমাবেশ ঘটে সৌদি আরবের মক্কা নগরীতে অবস্থিত এই মসজিদে। ধারণা করা হয়, খ্রিস্টপূর্ব ২১৩০ সালের দিকে পবিত্র কাবা নির্মাণ করা হয়। পবিত্র কোরআনে বর্ণিত আছে, মুসলিম জাতির পিতা ইবরাহিম (আ.) ও তাঁর পুত্র ইসমাইল (আ.) একত্রে কাবা শরিফ নির্মাণ করেন। আগে কাবাকে কেন্দ্র করে একটি খোলা স্থানই ছিল মসজিদ। কালের বিবর্তনে একটু একটু করে মসজিদ আল-হারামের নির্মাণ কাজ হয়। ৬৯২ সালে প্রথম ছাদসহ দেয়াল দিয়ে মসজিদটি ঘিরে দেওয়া হয়। ১৫৭০ সালে উসমানীয় সুলতান দ্বিতীয় সেলিম প্রধান স্থপতি মিমার সিনানকে মসজিদ পুনর্র্নির্মাণের আদেশ দেন। এই সময় সমতল ছাদগুলোর বদলে ক্যালিওগ্রাফি সংবলিত গম্বুজ ও নতুন স্তম্ভ স্থাপন করা হয়। ১৯৫৫ থেকে ১৯৭৩ সালের মধ্যে সাফা ও মারওয়াকে মসজিদের দালানের মধ্যে নিয়ে আসা হয়। বর্তমানে মসজিদ আল-হারামের মোট আয়তন ৩ লাখ ৫৬ হাজার ৮০০ বর্গমিটার। ভিতরে ও বাইরে মিলিয়ে পবিত্র  মসজিদের কাঠামো প্রায় ৮৮.২ একর।

 

হুয়াইশেং প্রাচীনতম মসজিদ

চীন (৬২৭ খ্রি.)

বিশ্বনবী (সা.) কে স্মরণ করে এই মসজিদটির নামকরণ করা হয় হুয়াইশেং মসজিদ। এটি নূর টাওয়ার নামেও পরিচিতি পায়...

হুয়াইশেং মসজিদ পৃথিবীর প্রাচীন মসজিদগুলোর একটি। কথিত আছে, জ্ঞানের প্রয়োজনে চীন ভ্রমণের সুবাদেই চীনে ইসলাম বিস্তার সম্ভব হয়। খ্রিস্টীয় ৬২৭ বা তৃতীয় হিজরির কাছাকাছি সময় রসুলে কারিম (সা.)-এর মামা হজরত সা’দ বিন আবি ওয়াক্কাস বিশিষ্ট তিনজন সাহাবিকে নিয়ে সর্বপ্রথম মসজিদটি নির্মাণ করেন। মসজিদটি ‘লাইটহাউস বা বাতিঘর মসজিদ’ নামেও পরিচিত। এটি চীনের গুয়াংজুর প্রধান মসজিদ। চীনা পরিভাষায় হুয়াইশেং শব্দটির অর্থ হলো ‘জ্ঞানী লোককে স্মরণ’। বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে স্মরণ করে মসজিদটির নামকরণ করা হয় ‘হুয়াইশেং মসজিদ’।  প্রাচীন মসজিদটি ‘নূর টাওয়ার’ বা ‘মেমোরিয়াল মসজিদ’ নামে বেশি পরিচিত। হুয়াইশেং মসজিদের মিনার নির্মিত হয়েছিল আজান দেওয়ার প্রয়োজনে। ১১৮ ফুট উঁচ মিনারটি আবহাওয়ার পূর্বাভাস প্রদানের জন্যও ব্যবহৃত হতো। যেটিকে মসজিদের আলোক বুরুজও বলা হয়।  এতে পাথর ও চুন-সুরকির সুনিপুণ কাজ রয়েছে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর