শুক্রবার, ২৫ জুন, ২০২১ ০০:০০ টা

বিস্ময়কর ভাসমান মসজিদ

সাইফ ইমন

বিস্ময়কর ভাসমান মসজিদ

ব্রুনাইয়ের ভাসমান বিস্ময়

ব্রুনাইয়ের রাজধানী বন্দর সেরি বাগওয়ানে অবস্থিত সুলতান ওমর আলী সাইফুদ্দিন মসজিদটি যেন এক ভাসমান বিস্ময়। ‘ভেনিস অব দ্য ইস্ট’ খ্যাত ব্রুনাইয়ের রাজধানী শহরের ‘ক্যাম্পং আইয়ার’ গ্রামের কৃত্রিম হ্রদের ধারে নির্মিত হয় বিখ্যাত এই মসজিদটি। এর মার্বেলের তৈরি মিনারের উচ্চতা ৫২ মিটার। ৩ হাজার মানুষ এখানে জামাতে অংশ নিতে পারেন। হ্রদ থেকে মসজিদের প্রবেশপথ হিসেবে রয়েছে মনোরম একটি বজরা। এই বজরাটি মূলত ১৬ শতকে নির্মিত একটি বজরার অনুরূপ। প্রাচীন সেই বজরাটি তৎকালীন ব্রুনাই সালতানাতের সুলতান বলকিয়াহ তাঁর জলযাত্রায় ব্যবহার করতেন। এই বজরাটিও ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের জন্য বিশেষ কিছু। পবিত্র কোরআন নাজিল হওয়ার ১ হাজার ৪০০ বছর পূর্তি উপলক্ষে এই বজরাটি তৈরি করা হয়। বজরা থেকে মসজিদ পর্যন্ত সর্পিল সেতুটি সম্পূর্ণ পাথরের তৈরি। আর মসজিদের বিশালাকায় দরজাগুলো তৈরি করা হয়েছিল ফিলিপাইন থেকে আমদানি করা উৎকৃষ্ট কাঠ দিয়ে। প্রতি বছর এই মসজিদটি দেখতে অনেক মানুষ ভিড় জমান।

 

মরক্কোয় দ্বিতীয় হাসান মসজিদ

সমুদ্রের নীল ঢেউয়ে ভাসমান মসজিদের মিনার আর নামাজ আদায়রত মুসল্লিদের দেখে বিস্মিত হতে চাইলে যেতে হবে মরক্কো। বাদশাহ দ্বিতীয় হাসান এ মসজিদটি তৈরি করেছেন কাসাবাঙ্কা শহরে। এর নকশা তৈরি করেছিলেন বাদশাহ হাসানের ফরাসি স্থপতি মিশেল পিনচিউ। মসজিদটির তিন ভাগের এক ভাগ আটলান্টিক মহাসাগরের ওপর অবস্থিত। দূরের কোনো জাহাজ থেকে দেখলে মনে হয়, ঢেউয়ের বুকে মসজিদটি দুলছে। এখানে প্রায় ১ লাখ মানুষ একসঙ্গে নামাজ পড়তে পারেন। এর মিনারের উচ্চতা ২০০ মিটার। আর মেঝে থেকে ছাদের উচ্চতা ৬৫ মিটার। মসজিদের ছাদটি প্রতি ৩ মিনিট পরপর যান্ত্রিকভাবে খুলে যায়। ফলে মসজিদের ভিতরে প্রাকৃতিক আলো ও সমুদ্রের খোলা বাতাস প্রবেশ করতে পারে। ২২.২৪ একর জায়গার ওপর অবস্থিত এ মসজিদের মূল ভবনের সঙ্গেই আছে লাইব্রেরি, কোরআন শিক্ষালয়, অজুখানা এবং কনফারেন্স রুম। এ মসজিদের ভিতরের পুরোটাই টাইলস বসানো। কোথাও কোথাও সোনার পাত দিয়ে মোড়া হয়েছে। মসজিদ এলাকায় রয়েছে ১২৪টি ঝরনা এবং ৫০টি ঝাড়বাতি। এর নির্মাণ কাজ শুরু হয় ১৯৮৭ সালে। প্রায় ২৫ হাজার শ্রমিক ও কারুশিল্পীর দিনে দুই শিফট শ্রমের ফলে সাত বছরে নির্মিত হয় এ মসজিদ। এটি নির্মাণে খরচ হয় বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৬ হাজার ৬০০ কোটি টাকা।

 

সৌদিতে বিশ্বের প্রথম

সৌদি আরবে তৈরি হয় বিশ্বের প্রথম ভাসমান মসজিদ। লোহিত সাগরে জেদ্দার সমুদ্রতটে অবস্থিত এই মসজিদের নাম আল-রাহমা মসজিদ। ১৯৮৫ সালে নির্মিত হয় এটি।   বৃত্তাকার গম্বুজ ও সুউচ্চ মিনারবিশিষ্ট মসজিদটি দেখলে মনে হয় যেন পানির ওপর ভাসছে। এটি ‘আল মসজিদুল আয়েম’ নামেও পরিচিত। এর অর্থ ভাসমান মসজিদ। ২ হাজার ৪০০ বর্গমিটার জায়গাজুড়ে এর বিস্তৃতি। নারী-পুরুষ মিলিয়ে এখানে একসঙ্গে অন্তত ২ হাজার ৩০০ ধর্মপ্রাণ মুসলমান নামাজ আদায় করতে পারেন। মসজিদের বৃত্তাকার বড় গম্বুজের পাশাপাশি ছোট ছোট আরও ৫২টি গোলাকৃতির গম্বুজ এবং আঙিনায় ২৩টি স্বয়ংক্রিয় ছাতা রয়েছে। এসব গম্বুজ ও ছাতার ওপর লিপিবদ্ধ করা হয়েছে পবিত্র কোরআনের বিভিন্ন আয়াত। নারীদের নামাজের স্থান মসজিদের মাঝ বরাবর ঝুলন্ত অবস্থায় স্থাপন করা হয়েছে। কাঠের তৈরি ঝুলন্ত স্থানটিতে ৫০০ নারী একত্রে নামাজ পড়তে পারেন।  মসজিদটি তৈরিতে নির্মাতারা সমুদ্র-জলের লবণাক্ততা, তীব্র স্রোত এবং পারিপার্শ্বিক আবহাওয়ার কথা বিবেচনা করেই এর উপযোগী রসদসামগ্রী ব্যবহার করেছেন।

 

মালয়েশিয়ায় ক্রিস্টাল মসজিদ

মালয়েশিয়ার ক্রিস্টাল মসজিদ মালয়েশিয়ার তেরেংগানুর ওয়ান ম্যানের একটি মসজিদ। এটি ভ্যান ম্যান দ্বীপের ইসলামিক ঐতিহ্য পার্কে অবস্থিত। ২০০৮ সালে তেরেংগানুর ১৩তম ইয়াং ডি-পার্টুয়ান আগোং, সুলতান মিজান জয়নাল আবিদিনের দ্বারা আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয়েছিল। এটিতে একসঙ্গে ১ হাজার ৫০০ মানুষ নামাজ পড়তে পারেন। মূল্যবান ক্রিস্টাল আর সঙ্গে স্বচ্ছ কাচ ও স্টিলের দন্ড দিয়ে বানানো হয়েছে এই ক্রিস্টাল মসজিদ। স্বচ্ছতার কারণেই এই মসজিদের এমন নামকরণ। মুসলিম স্থাপত্যের অপূর্ব এক নিদর্শন এটি। প্রাকৃতিক শোভা ও মননশীল নির্মাণশৈলীর অভূতপূর্ব সমন্বয়ে তৈরি এই মসজিদ শুধু মালয়েশিয়ায় নয়, পুরো বিশ্বের কাছে আকর্ষণীয় স্থাপনা হিসেবে স্বীকৃত। খাঁটি ক্রিস্টাল দিয়ে নির্মিত মসজিদটি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম মসজিদ। শুধু এই মসজিদ দেখতেই প্রতি বছর দেশ-বিদেশ থেকে অসংখ্য পর্যটকের আগমন ঘটে। রাতে এই মসজিদের সৌন্দর্য যেন বেড়ে যায় আরও কয়েক গুণ। মসজিদটির কিছু অংশ সমুদ্রে আর কিছু অংশ স্থলে হওয়ায় আশপাশে সৃষ্টি হয়েছে এক নৈসর্গিক পরিবেশ।

 

আরকাম মসজিদ

ইন্দোনেশিয়ার পালুর বিখ্যাত ভাসমান মসজিদ আরকাম বাবু রহমান মসজিদ। এটি ছিল দেশটিতে আগমনকারী পর্যটকদের জন্য একটি আকর্ষণীয় গন্তব্য। কিন্তু কয়েক বছর আগে সুনামিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় মসজিদটি। কিন্তু এর পরেও বিস্ময়করভাবে এখনো টিকে রয়েছে স্থাপনাটি। সুন্দরতম এই মসজিদ ভবনটির অর্ধাংশই এখন পানিতে নিমজ্জিত। সংবাদমাধ্যমের সূত্রে জানা যায়, মসজিদটিকে এখনো মেরামত না করায় এটি ধসে পড়ার উপক্রম হয়েছে। মসজিদটিকে সংযোগকারী সেতুটি এখনো দৃশ্যমান হচ্ছে না। ইন্দোনেশিয়ার সুলাইয়িসি দ্বীপে সুনামি আঘাত হানে। এতে হাজারের ওপর লোক নিহত এবং অসংখ্য লোক আহত হয়। রিখটার স্কেলে ৭.৫ মাত্রার ভূমিকম্পের ফলে এই সুনামির সৃষ্টি হয়েছিল। এর ফলে সেখানে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হলেও টিকে থাকে এই আরকাম বাবু রহমান মসজিদ। এখনো অনেক মানুষ আসেন এই মসজিদটি দেখতে। যেন সাগরের বুকে এক ভাসমান বিস্ময়।

 

মালয়েশিয়ায় কোটা কিনাবালু সিটি মসজিদ

মালয়েশিয়ার সাবাহ প্রদেশের রাজধানী কোটা কিনাবালুতে অবস্থিত দেশটির দ্বিতীয় বৃহত্তম মসজিদ ‘কোটা কিনাবালু সিটি মসজিদ’। অসম্ভব সুন্দর এই মসজিদটি দেখতে প্রতি বছর অনেক মানুষ ভিড় করতেন এক সময়। কিন্তু মসজিদের সামনে দুজন পর্যটক নাচ করছেন এমন একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়ার পর  মসজিদ কর্তৃপক্ষ পর্যটকদের সেখানে পরিদর্শন নিষিদ্ধ করেছে।

দুজন নারী ছোট পোশাক পরে কোটা কিনাবালু সিটি মসজিদের সামনের একটি ছোট দেয়ালে নাচ করছিল। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে সামাজিকভাবে। পর্যটকদের জন্য নিষিদ্ধ হলেও নীল এবং সোনালি রঙের গম্বুজ দিয়ে নির্মিত এই মসজিদটি ভ্রমণপিপাসুসহ অনেক দর্শনার্থীর আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। সিটি মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে সৌদি আরবের মদিনায় অবস্থিত মসজিদে নববীর আদলে।  মসজিদটির চারপাশ কৃত্রিম হ্রদ দিয়ে ঘেরা। দেখে মনে হয় যেন হ্রদের মাঝে একখন্ড ভূমির মতো ভেসে আছে মসজিদটি। দিনের বেলা পানিতে মসজিদের প্রতিবিম্ব পড়ে আর রাতে চাঁদের আলোয় সেই দৃশ্য যেন আরও মোহনীয় হয়ে ওঠে। সিটি মসজিদের অবস্থান দক্ষিণ চীন সাগরের লাইকাস বে উপকূলে পাসির রোডে।

 

সাগরে ডোবে না ভারতের হাজী আলী শাহ দরগাহ মসজিদ

পৃথিবীর অন্যতম বিস্ময়কর এই মসজিদের নাম হাজী আলী শাহ দরগাহ মসজিদ। এটি আরব সাগরের উপকূল থেকে ৫০০ মিটার দূরে একটি ছোট দ্বীপে অবস্থিত। মসজিদটি সম্পর্কে জানতে হলে চলে আসবে সৈয়দ পীর হাজী আলী শাহ বুখারির নাম। তিনি ছিলেন একজন সুফী পীর এবং বর্তমান উজবেকিস্তানের (তৎকালীন নাম বুখারা) একজন ধনী বণিক। সাধনা এবং আল্লাহর প্রেমে তিনি বিশেষ রহমত অর্জন করেন বলে ইতিহাসে লেখা হয়েছে। অনেক অলৌকিক কাজ করতেন বলে মানুষ বিশ্বাস করতেন। তিনি বিশ্ব ভ্রমণ করেন এবং একসময় ভারতের মুম্বাইয়ে এসে অবস্থান করেন। এখানে তিনি ইসলামের বাণী প্রচার করতে থাকেন। ভারতের মুম্বাইয়ে অবস্থিত হাজী আলী শাহ দরগাহ মসজিদটি এই সুফি সাধকের স্মরণেই নির্মাণ করা হয়েছে। অনেকে বলেন, তিনি ছিলেন ধনী মুসলিম বণিক। তাঁর মৃত্যুর আগের ও পরের রয়েছে নানান কিংবদন্তি। মৃত্যুর আগে তিনি তাঁর অনুসারীদের বলেন, মৃত্যুর পর তাঁর মরদেহ যেন কফিনে ভরে আরব সাগরে ভাসিয়ে দেওয়া হয়।

 

তুরস্কের ঐতিহাসিক ওরতাকয় মসজিদ

তুরস্কের ইস্তাম্বুলে অবস্থিত ওরতাকয় মসজিদ। এর প্রকৃত নাম গ্র্যান্ড ইম্পেরিয়াল মস্ক অব সুলতান আবদুল মজিদ। পূর্ববর্তী একটি মসজিদের ধ্বংসাবশেষের ওপর অটোমান সুলতান আবদুল মজিদের শাসনামলে ১৮৫৪ থেকে ১৮৫৬ সালে মসজিদটি নির্মিত হয়েছিল। মসজিদটির নকশা করেছিলেন দুজন আর্মেনিয়ান স্থপতি। ঐতিহাসিক এই মসজিদটির ভিতরে সুসজ্জিত ছাদ থেকে ঝুলন্ত অবস্থায় আজও শোভা পাচ্ছে সুলতান আবদুল মজিদের হাতে করা অসাধারণ কিছু আরবি ক্যালিগ্রাফি। দুটি মিনার, একটি গম্বুজ এবং বিশালাকৃতির জানালাবিশিষ্ট মসজিদটির মূল নামাজকক্ষ তুলনামূলকভাবে ছোট। মসজিদটির ভিতরে দুই কক্ষবিশিষ্ট একটি ভবন আছে, যা সুলতানের গ্রীষ্মকালীন প্রাসাদ হিসেবে ব্যবহৃত হতো। বিখ্যাত বসফরাস ক্রুজ থেকেও এই মসজিদটি চমৎকার দেখতে পাওয়া যায়। প্রতি বছর বহু লোক এই মসজিদটি দেখতে আসেন। এমনিতেই ইস্তাম্বুল পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয় জায়গা গোটা বিশ্বের মধ্যেই। তাই এখানে প্রচুর লোক সমাগম ঘটে প্রায় প্রতিদিনই। রাতে মসজিদটির চমৎকার আলোকসজ্জার ব্যবস্থা এর সৌন্দর্য বাড়িয়ে বহুলাংশে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর